সংশয়ীঃ তোমরা আর্যরা ভণ্ড, তোমরা মিথ্যাবাদী, তোমরা হিন্দুসমাজের বর্জ। তোমাদের গুরু দয়ানন্দ প্রতারক। তোমরা সত্যার্থ প্রকাশ ছাড়া আর কিছু পড় না। সত্যার্থ প্রকাশই তোমাদের ধর্মগ্রন্থ। তোমরা ধর্মের নামে মিথ্যাচার করছ। তোমরা সাধারণ হিন্দুদের প্রতারিত করে ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণা দিচ্ছ।
আর্যঃ শান্ত হোন সংশয়ীজি! শান্ত হোন! আপনি যা যা বলছেন সবই মিথ্যা এবং আমরা তা হাতেনাতে প্রমাণ করতে পারব। আচ্ছা সংশয়ীজি মহর্ষি দয়ানন্দের প্রতি যে এত আক্রোশ তা কি এই কারণে যে তিনি স্ত্রী সমাজ ও তথাকথিত শূদ্র সমাজকে বেদ পাঠের অনুমতি দিয়েছেন? তিনি সকলকে শাস্ত্র পাঠ করতে বলেছেন, ফলে যুগযুগ ধরে চলে আসা আপনাদের ধর্মের নামে ব্যবসা মার খেয়েছে এই জন্যে?
সংশয়ীঃ তোমরা মূঢ়। তোমরা বল যে ভাগবতাদি পুরাণ নাকি প্রকৃত পুরাণ নয়! ব্রাহ্মণ গ্রন্থই নাকি পুরাণ। এসবই তোমাদের গুরু দয়ানন্দের আবিষ্কার। উনার আগে কোন আচার্যই বলেন নি ব্রাহ্মণ গ্রন্থই পুরাণ। এসব সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। তোমাদের গুরু দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশ ও ঋগবেদাদি ভাষ্যভূমিকায় এই মিথ্যাচার করেছে। বরং আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ৩.৩.১ এবং তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২.৯ এ দেখ ব্রহ্মযজ্ঞ এর স্বাধ্যায় বিধানে এ প্রথমে ঋগবেদ, তারপর যজুর্বেদ, তারপর সামবেদ ও তারপর অথর্ববেদ এভাবে চার বেদ পাঠ করার পর “ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পান্গাথা নারাশংসী” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাথা, নারাশংসী পাঠ করতে বলা হয়েছে। যদি ব্রাহ্মণ এর নামই পুরাণ হত তাহলে কি আলাদাভাবে পড়তে বলা হত?
আর্যঃ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে একটা ছোট প্রশ্ন করছি, আশা করি উত্তর দিবেন। আচ্ছা আপনারা কি শঙ্করাচার্য, সায়ণাচার্য, ভাস্করাচার্যের ভাষ্য মানেন?
সংশয়ীঃ মানব না কেন? অবশ্যই মানব! শঙ্করাচার্য সাক্ষাৎ শিব, সায়নাচার্যের মত মহান বেদ ভাষ্যকার কখনো জন্মানই নি। তাঁরা প্রত্যেকেই তোমার গুরু দয়ানন্দের চেয়ে অনেক বড় শাস্ত্রবিদ।
আর্যঃ বেশ, আপনার অভিযোগে ফিরি এবার। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ৩.৩.১ এবং তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২.৯ এই দুই স্থানেই ব্রহ্মযজ্ঞ শেষে স্বাধ্যায় অর্থাৎ অধ্যয়নের নির্দেশ দেয়া আছে সত্য। আর সেখানে বলেও দেওয়া আছে কিভাবে পাঠ করতে হবে। যা আপনিও উল্লেখ করেছেন বিধায় পুনরায় আর উল্লেখ করলাম না। এবার চলুন আপনার তথাকথিত অভিযোগের দিকে তাকাই। আপনার মতে যেহেতু চার বেদ পাঠের পর ব্রাহ্মণ, ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাথা, নারাশংসী পাঠ করতে বলা হয়েছে, তারমানে এই সবগুলোই আলাদা আলাদা শাস্ত্র তাইতো?
সংশয়ীঃ ঠিক তাই। ব্রাহ্মণ, ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাথা, নারাশংসী সবই আলাদা আলাদা শাস্ত্র আর এখানে পুরাণ বলতে ভাগবতাদি অষ্টাদশ পুরাণকেই বুঝিয়েছে।
আর্যঃ আসলেই কি তাই? আচ্ছা আপনার মতে ইতিহাস বলতে যদি মহাভারত আর পুরাণ বলতে ভাগবতাদি পুরাণ ধরে নেই তবে গাথা ও নারাশংসী শাস্ত্র কোনগুলো?
সংশয়ীঃ ওগুলো হবে কোন শাস্ত্র বিশেষ। এর জন্য সায়নাদি আচার্যের ভাষ্য দেখতে হবে। প্রতারক দয়ানন্দের কথা মানলে হবে না।
আর্যঃ শোনেন মশাই স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নিজ থেকে হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে এনে হাজির করেন নি। তিনি আপনার চেয়েও উত্তম রূপে শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন এবং আপনার প্রিয় সায়নাদি ভাষ্যও তিনি উত্তমরূপে অধ্যয়ন করেছেন। চলুন দেখি আপনার সায়নাচার্য কি ভাষ্য করেছেন!
সায়নাচার্যের সময় ভাগবতাদি পুরাণের প্রচলন ছিল সর্বত্র এবং ইতিহাস বলতে মহাভারত ও রামায়ণ সর্বত্র গৃহীত হয়েছিল। তাই তিনি প্রথমে পুরাণ বলতে ব্রহ্মাণ্ডাদি পুরাণ বলেছিলেন এবং ইতিহাস বলতে মহাভারতের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপরের লাইনেই দেখুন তিনি ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বিভিন্ন বচনকে উদাহরণ রূপে উল্লেখ করছেন। দেখুন উনি বলছেন “দেবাসুরাঃ সংয়ত্তা আসন্ ইত্যাদয় ইতিহাসাঃ” অর্থাৎ দেবাসুরেরা পরস্পর যুদ্ধে তৎপর হয়েছিল এই বচন হচ্ছে ইতিহাস। উল্লেখ্য এটি হচ্ছে তৈত্তিরীয় সংহিতার ১-৫-১ এর ব্যাখ্যা বা ব্রাহ্মণ বচনকে নির্দেশ করছে।
সায়নাচার্য বলছেন “আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীন্নান্যৎ কিঞ্চন মিষৎ ইত্যাদীনি সৃষ্টাদিপ্রতিপাদকানি পুরাণানি” অর্থাৎ আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীন্নান্যৎ কিঞ্চন মিষৎ এর মত সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে এমন বচনগুলোই পুরাণ। উল্লেখ্য উক্ত বচনটিও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় উপনিষদের ২-৭-১ বচন। তা সংশয়ী মহাশয় কি বুঝলেন? আপনার প্রিয় সায়নাচার্যও স্বীকার করে নিয়েছেন যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বচনই ইতিহাস ও পুরাণ। শুধু আপনার মত যারা মিথ্যা বলে ধর্মের নামে মানুষকে যুগযুগ ধরে শোষণ করে ও ধর্মের নামে ব্যবসা করে তারাই এই সত্য স্বীকার করবেন না। শুধু তাই না, তিনি গাথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন “য়োঅস্য কৌষ্ঠচ্যঃ” হচ্ছে গাথা এবং এটিও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বচন(তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৬-৫)। আর নারাশংসীও কোন আলাদা শাস্ত্র না। সায়নাচার্যের মতে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২-৬-১১ এর বচনটি নারাশংসীর অন্তর্গত। আর ব্রাহ্মণে যজ্ঞ করার যে বিধি সেটাই কল্প।
শুধু সায়নাচার্যই না, তৈত্তিরীয় আরণ্যকের আরেক ভাষ্যকার ভাস্করাচার্যও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ২-৯ এর ভাষ্যে একই কথা বলেছেন যে ব্রাহ্মণের বচনই পুরাণ, ইতিহাস, কল্প, গাথা ও নারাশংসী। এই দেখুন প্রমাণঃ
তারমানে কি দাঁড়াল মহাশয় ব্রাহ্মণই কি পুরাণ, ইতিহাস নয়? কে মিথ্যাবাদী? আপনারা যারা শাস্ত্রের নাম করে ব্যবসা করেন নাকি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত সনাতনীরা যারা “সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত” তারা? আপনিও ভুল স্বীকার করে সত্যকে গ্রহণ করুন।
সংশয়ীঃ তোরা মিথ্যাবাজ, তোরা শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করছিস। তোরা নরকে পুড়ে মরবি.........
আর্যঃ বলিহারি যাই আপনাদের হিন্দুত্ব দেখে! প্রথমে অভিযোগ করলেন যে আমরা নাকি মনগড়া প্রচার করে বেড়াই যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থই পুরাণ ও ইতিহাস। এখন যখন প্রমাণ দেখলাম সায়নাচার্য ও ভাস্করাচার্যও একই কথা বলেছেন তখন আপনাদের আসল রূপ বেড়িয়ে আসলো। যাই হোক আরো প্রমাণ দেখুন তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৮-২ এ সায়নাচার্য কি বলছেনঃ
সায়নাচার্য বলছেন “ব্রাহ্মণং চাষ্টধা ভিন্নম” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে আটটি ভিন্ন ভাগ রয়েছে বা ব্রাহ্মণ গ্রন্থ আটটি ভিন্ন নামে অভিহিত। সেই আটটি নাম কি কি সেটাও সায়নাচার্য ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে বচন উল্লেখ করে স্পষ্ট করে বলেছেন সেই নামগুলো হচ্ছেঃ
১। ইতিহাস,
২। পুরাণ,
৩। বিদ্যা,
৪। উপনিষদ,
৫। শ্লোক,
৬। সূত্র,
৭। অনুব্যাখ্যান এবং
৮। ব্যাখ্যান।
শঙ্করাচার্যও তাঁর বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০ এর ভাষ্যতেও পরিষ্কার করে ব্রাহ্মণের আটটি নাম ব্যাখ্যা করে বলেছেন “এবমষ্টবিধং ব্রাহ্মনং” অর্থাৎ এই হচ্ছে আট প্রকার ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে এই আটটি ভাগ রয়েছে।
আপনারা লক্ষ্য করুন শঙ্করাচার্যও বলছেন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে সৃষ্টি তত্ত্ব বিষয়ক যে বচন আছে তাই পুরাণ। তাহলে আপনারা কি বুঝতে পারলেন ব্রাহ্মণ গ্রন্থই কি পুরাণ নাকি ভাগবতাদি নব্য সৃষ্ট পুরাণ সমূহ প্রকৃত পুরাণ?
সংশয়ীঃ এ ঘোর কলিযুগ, তোদের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, তোদের গুরু প্রতারক, তোরা সত্যার্থ প্রকাশ ছাড়া কিছু জানিস না, তোদের সত্যার্থ প্রকাশ ভুল, তোরা শাস্ত্র পড়িস না, তোরা শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াচ্ছিস, তোরা শাস্ত্রবিদ্বেষী, তোরা মিথ্যাবাজ.........(ব্লা ব্লা ব্লা)।
আর্যঃ এসব গালাগাল বাদ দিয়ে সত্য গ্রহণ করতে শিখুন। মনে রাখুন সত্যমেব জয়তে অতএব আপনাদের এই মিথ্যা গলাবাজি অচিরেই বন্ধ হবে। এখন আর সেই অন্ধকার যুগ নেই যে সাধারণ সনাতনীরা আপনাদের সৃষ্ট অপনিয়ম ও বেদ বিরোধী বিধানের দ্বারা নতজানু হবে। আপনাদের শোষণের যুগ শেষ। এখন সনাতনী হিন্দুদের জাগরণের যুগ এসেছে। আপনারা সকলেই দেখুন সত্য কি! নিজে পরখ করে নিয়ে সত্য গ্রহণ করুন। সত্যের আলোয় আলকিত হয়ে আদর্শ সনাতনী হয়ে উঠুন। মনে রাখবেন বেদ মতে আমরা সকলেই “অমৃতস্য পুত্রাঃ” অর্থাৎ আমরা সকলেই অমৃত পরমেশ্বরের সন্তান। তাই সকলে সত্য গ্রহণ করুন ও সত্যের প্রচার করে নিজের মাঝে প্রকৃত বৈদিক চেতনা জাগিয়ে তুলুন।