বেদ কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উপমালঙ্কারের ব্যবহারের দিক থেকে বাকি সকল
গ্রন্থ থেকে একদম ই আলাদা। ঈশ্বরের পবিত্র বাণী হওয়ায় এতে ব্যবহৃত অনেক
শব্দের ই অর্থ প্রচলিত যোগরূঢ় অর্থের চেয়ে ভিন্নতর। আর বেদের ভাষা ও বৈদিক
সংস্কৃত যার সাথে লৌকিক সংস্কৃতের সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে। এই ভাষাগত
পার্থক্যের জন্য কোনো একটি শব্দের বৈদিক অর্থ আর প্রায়োগিক অর্থের মাঝে
ভিন্নতা দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপঃ বেদে গো/গবঃ, বৃষ বা অশ্বার্থক শব্দ প্রতিটি ই সূর্যরশ্মি কে সূচিত করে।
এমন
সূক্ষ্ম শব্দগুলোর ক্ষেত্রে অর্থগত ভ্রান্তি ভাষ্যের ত্রুটি ঘটায়। যার ফলে
বৈজ্ঞানিক ভুল, অশ্লীলতা, জীবহত্যা প্রভৃতি দৃষ্ট হয়। এই বিভ্রান্তি দূরে
আচার্য যাস্ক প্রণিত বেদাঙ্গ নিরুক্ত ই আমাদের কষ্টিপাথর।
গো/গবঃ
আদিত্যোহপি
গৌরুচ্যতে। উতাদঃপরুষে গবি। পর্বতি ভাস্বতীস্যৌপমন্যবঃ। অথাপ্যস্যৈকো
রশ্মিশ্চন্দ্রমসং প্রতি দীপ্যতে তদেতেনোপেক্ষিতব্যমাদিত্যহস্য
দীপ্তির্ভবতীতি। সুষুম্ণঃ সূর্যরশ্মিশ্চন্দ্রমা গন্ধর্ব ইত্যপি নিগমো
ভবতি। সোহপি গৌরুচ্যতে অত্রাহ গোরমন্বতেতি তদুপরিষ্টাট ব্যাখ্যাসামঃ।
সর্বেহপি রশ্ময়ো গাব উচ্যনাতে।।
২।৬
আদিত্য
কে গৌ বলা হয়।সূর্যের সেই পর্বযুক্ত পুরুষ কে নমস্কার। ঔপমনব্যের মতে,
পর্ব থাকা অর্থ নিজ জ্যোতি তে ভাস্বর হওয়া। অধিকন্তু, সূর্যের রশ্মি চন্দ্র
কে আলোকিত করে। তা নিম্নোক্ত উক্তি দ্বারা সিদ্ধ হয়।" সূর্যরশ্মি
সুষুম্নারূপী আর চন্দ্র ধারকরূপী "।
রশ্মি কে ও গৌ বলে সম্বোধন করা হয়।
এখানে অবশ্যই বৈদিক ঋষিগণ রশ্মির কথা ই ভেবেছেন। গাবঃ শব্দেও সূর্যরশ্মিকেই
প্রকাশ করা হয়।
Point to be noted: এখানে আরেকটা বিষয় পাওয়া গেল যে, চন্দ্রের আলো সূর্য থেকে প্রাপ্ত।
২।১৪ তে এর ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা ও দেখা যায়।
গম্ ধাতু গমনার্থে প্রযুক্ত হওয়ায় সূর্য কে গৌ বলা যায় ( কেননা সূর্য অন্তরীক্ষে গমন করে )।
১২।৭ এ ও আমরা এমন অংশের উল্লেখ পাই।
সূর্যরশ্মিকে গাবঃ বলা হয় গমনধর্মিতার জন্য।
অশ্ববাচক শব্দ নিয়ে বিভ্রান্তিঃ
ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডল পঞ্চাশতম সূক্তের প্রথম ও অষ্টম মন্ত্রে এই শঙ্কার উদ্ভব হয় যে, অশ্ব সূর্য কে বহন করে।
খেদয়ঃ, কিরণঃ, গাবঃ, রশ্ময়ঃ, অভীশ্বঃ, দীধিতয়ঃ, গভস্তয়ঃ, বনম্, উস্ত্রাঃ, বসবঃ, মরীচিপা,ময়ুখাঃ, সপ্ত ঋষয়ঃ, সাধ্যাঃ, সুপর্ণঃ।
২।১৭
নিরুক্ত মতে, এই পনেরো টি রশ্মির নাম। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি হল অশ্ব ও রশ্মির সাধারণ নাম।
আ দধিকাঃ শবসা পঞ্চ কৃষ্টীঃ সূর্য ইব জ্যোতিষাপস্ততান। সহস্রমাঃশতসা বাজ্যর্বা পৃণক্তু মধ্যা সমিমা বচাংসু।।
১০।৩১
দধিকর
পাঁচ বর্ণের মানুষ কে ছড়িয়ে দেয় শক্তির সাথে যেমনটা দিয়ে
সূর্য অন্তরীক্ষলোক কে আলোকিত করে তার জ্যোতিতে। শত সহস্র লাভকারী হচ্ছেন
এই দ্রুতগামী।
এর দ্বারা ই সর্বপ্রথম অশ্ববাচক দধিকর ও সূর্যরশ্মির অভেদরূপ কল্পিত হয়।
সপ্ত
যুঞ্জন্তি রথমেকচক্রমেকচারিণম্। চক্রং চক্রতের্বা করতের্বা ক্রামতের্বা।
একোহশ্বো বহাতি সপ্তনামাদিত্যঃ সপ্তাস্মৈ রশ্ময়ো রসানভিন্নাময়ন্তি
সপ্তৈনমৃষয়ঃ স্তুবন্তীতু বা।
৪।২৭
সাতজন
সেই একচক্র রথ বহন করে। এক অশ্ব ই সপ্ত নামে এই রথ বহন করে। এই চক্রের তিন
সংখ্যক নাভি থাকে যা ভূলোক, অন্তরীক্ষলোক ও দ্যুলোকের প্রতিনিধি।
সাতজন
সেই একচক্র রথ বহন করে, সেই রথ যা একচক্র দ্বারা গতিশীল। চক্রম্ চক (দূর
করা) ধাতু অথবা কর ধাতু( কার্য) বা ক্রম (গতি) ধাতু থেকে উদ্ভূত। এক অশ্ব
সপ্ত নামে এই রথ তথা সূর্য কে বহন করে। সাত রশ্মি ই সূর্যের তেজ রূপী রস
বহন করে।
শেষ অংশের আবার উদ্ধৃতি পাওয়া যায় অন্যত্র।
"উদুত্যং
জাতবেদসং দেবং বহন্তি কেবতঃ।। দৃশে বিশ্বায় সূর্যম্"।। উদ্বহন্তি তং
জাতবেদসং রশ্ময়ঃ কেতবঃ সর্বেষাং ভূতানাং দর্শনায় সূর্যমিতি,
কমন্যমাদিত্যাদেবমবক্ষ্যত। তসৈষাপরা ভবতি।
(১২।১৫)
রশ্মি তাকে বহন করে, সেই দেব কে যিনি সমস্ত জগৎ কে সৃষ্টি করেছেন, সেই সূর্যকে যেন সবাই দর্শন করে সেজন্য।
এর অর্থ রশ্মি ই সূর্য কে বহন করে যিনি সমস্ত সৃষ্টি করেছেন।
পরবর্তী শ্লোক তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
এই অংশের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ
সূর্যের সপ্তরশ্মিঃ
সাদা বা যৌগিক বর্ণের আলোকে সাতটি মৌলিক আলোতে বিভক্ত করার পদ্ধতিকে বলে আলোর বিচ্ছুরণ।
সংক্ষেপে
বলা যায়, আলোর এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে স্থানান্তরের ফলে
প্রতিসরাঙ্কের পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন বর্ণের আলো পৃথক হয়ে যায়।
Light
changes speed as it moves from one medium to another (for example, from
air into the glass of the prism). This speed change causes the light to
be refracted and to enter the new medium at a different angle (Huygens
principle). The degree of bending of the light's path depends on the
angle that the incident beam of light makes with the surface, and on the
ratio between the refractive indices of the two media (Snell's law).
The refractive index of many materials (such as glass) varies with the
wavelength or color of the light used, a phenomenon known as dispersion.
This causes light of different colors to be refracted differently and
to leave the prism at different angles, creating an effect similar to a
rainbow. This can be used to separate a beam of white light into its
constituent spectrum of colors.
দেখুনঃ
স্যার আইজাক নিউটন সর্বপ্রথম সূর্যের সাদা রশ্মিকে সাত বর্ণে বিভক্ত করেন যার বিষয়ে বেদে আগে থেকেই বলা হচ্ছে।
রশ্মি কর্তৃক সূর্য কে বহনঃ
রশ্মি হচ্ছে আলো যা কোয়ান্টাম থিওরি মতে ফোটন নামক কণার তরঙ্গ।
Eventually the modern theory of quantum mechanics came to picture light as (in some sense) both a particle and a wave.
Gilbert N. Lewis named these light quanta particles photons.
এই ফোটন হচ্ছে তাড়িতচৌম্বক বলের force carrier। অর্থাৎ তা তাড়িতচৌম্বক শক্তি কে বহন করে।
The
photon is a type of elementary particle, the quantum of the
electromagnetic field including electromagnetic radiation such as light,
and the force carrier for the electromagnetic force.
সূর্য
সতত নিউক্লীয় ফিউসন প্রক্রিয়ায় (ছোট মৌল কে যুক্ত করে বড় মৌল তৈরি) শক্তি
উৎপাদন করে যা ফোটন কণারূপে নির্গত হয়, বিভিন্ন ফোটন কণার তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি
নির্দিষ্ট সীমার ভেতর (380nm-740nm) হলেই কেবল আলোরূপে তা আমরা দেখতে পাই।অর্থাৎ এই ফোটন কণা দিয়ে দৃশ্যমান আলোকরশ্মি ই মূলত সূর্যের অস্তিত্ব আমাদের কাছে বহন করে।
The
visible spectrum is the portion of the electromagnetic spectrum that is
visible to the human eye. Electromagnetic radiation in this range of
wavelengths is called visible light or simply light. A typical human eye
will respond to wavelengths from about 380 to 740 nanometers.
সুতরাং রশ্মি বা ফোটন কণা সূর্যকে বহন করে উক্তিটি যথাযথ বিজ্ঞানসিদ্ধ।
আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাঃ উক্ত মন্ত্রের ক্ষেত্রে(ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডল পঞ্চাশতম সূক্তের অষ্টম মন্ত্র) মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী মূলত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ই করেছেন।
তার সারানুবাদ এই,
সপ্ত রশ্মি যেমন সূর্যকে বহন করে, সেরূপ গায়ত্রী,ত্রিষ্টুপ,অনুষ্টুপাদি সাত ছন্দ ঈশ্বরের পবিত্র বেদবাণী কে বহন করে।
ঈশ্বর
তথা ঈশ্বরের বাণী পবিত্র বেদ সূর্যের মতো ই আমাদের জন্য জ্যোতির্ময়। সূর্য
যেমন জাগতিক ভৌত অন্ধকার দূর করে, ঈশ্বরচিন্তা ও বেদাধ্যায়ন আমাদের মানসিক
অন্ধকার দূর করে আলোর পথে ধাবিত করে।
বৃষ শব্দ নিয়ে বিভ্রান্তিঃ
অথর্ববেদ
চতুর্থ মণ্ডলের একাদশ সূক্তের প্রথম মন্ত্রে বৃষের সমার্থক শব্দ প্রয়োগে
এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যে, ষাঁড় পৃথিবী কে ধারণ করে। বৃষবাচক শব্দ
দ্বাবা এখানে ইন্দ্র তথা সূূর্যকে সিদ্ধ করে।
মরুত্বানিন্দ্র! মরুদ্ভিস্তদ্বান্। বৃষভো বর্ষিতাহপাং।।
৪।৮
ইন্দ্র, যিনি বৃষ বলে খ্যাত, তিনি মরুৎগণের সাথে যুদ্ধযাত্রা করছেন। বৃষঃ যিনি বৃষ্টি প্রদান করেন।
ইন্দ্রের বৃষ্টি প্রদানকারী স্বরূপ জানতে দেখুন
আবার সূর্য যদি বৃষ হয়, তাহলে সূর্যরশ্মি সেই বৃষের শৃঙ্গ।
তানি বাং বাস্তুতি কাময়ামহে গমনায়। যত্রগাবো ভূরিশৃঙ্গা বহুশৃঙ্গ।
২।৭
আমরা তোমাদের দুজনের সেই অংশে যাবার মনোভৃব পোষণ করি যেখানে রশ্মি বহুশৃঙ্গরূপী রশ্মি গমন করে।
শুধু বৃষ না, বৃষাকপি শব্দে ও সূর্য ই সিদ্ধ হয়।
অথ যদ্রশ্মিভিরভিপ্রকম্পয়ন্নেতি তদ্বৃষাকপির্ভিবতিবৃষাকম্পনঃ। তসৈষা ভবতি।।
পুনরেহি বৃষাকপে সুপ্রসুতানি বঃ কর্মাণি কল্পয়াবহৈ য এষ স্বপ্নংশনঃ। স্বপ্নান্নাশয়ত্যাদিত্য উদয়ে ন সোহস্তমেষি পথা পুনঃ।
১২।২৭-২৮
বৃষ যিনি রশ্মি দ্বারা সকল জগৎ প্রকম্পিত করেন (কম্প) তিনি ই বৃষাকপি।
হে
বৃষাকপি, তুমি সে যে স্বপ্নের ধ্বংসকারী,যে আবার ও অস্তমিত হতে যাচ্ছে।এসো
আবার। আমরা উন্নতির পথে ধাবমান হই। ইন্দ্র সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
হে বৃষাকপি, তুমি সে যে স্বপ্নের ধ্বংসকারী, সূর্য। কেননা প্রাতে সূর্যোদয়ের ফলে স্বপ্নের ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটে।
সবিতা সর্বস্য প্রসবিতা
১০।৩১
সবিতা
যন্ত্রৈঃ পৃথিবীমরমঙদনারম্ভণেহন্তরিক্ষে সবিতা
দ্যামদৃংহদশ্বমিবাধুক্ষদ্ধুনিমন্তরিক্ষে মেধং বদ্ধমতুর্তে বদ্ধমতুর্ণ ইতি
বা ত্বরমাণ ইতি বা, সবিতা সমুদিতারমিতি। কমন্যং মধ্যমাদেবমবক্ষত।
আদিত্যোহপি সবিতোচ্যতে।
১০।৩২
সবিতা জগতের সকল কিছুর প্রসবকারী (প্রসবিতা)।তিনি নিচের শ্লোকটির উদ্দিষ্ট।
সবিতা
পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন কক্ষপথে সমর্থন দ্বারা। সবিতা দ্যুলোক কে অসীম
মহাবিশ্বে স্থাপন করেছেন।সবিতা অশ্বের মতো কম্পনের দ্বারা এই বায়ুমণ্ডল ও
অন্তরীক্ষ সমুদ্র মন্থন করেছেন।
সবিতা রজ্জুবৎ সমর্থনকারীর
দ্বারা পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন। সবিতা এই মহাশূণ্যের মাঝে দ্যুলোক কে
অপরিবর্তনীয় ভাবে স্থাপন করেছেন। সবিতা অন্তরীক্ষ লোকে আবদ্ধ মেঘ কে মন্থন
করেছেন অশ্বের ন্যায়।
সবিতা মধ্যম স্থানীয় দেবতা ছাড়া কে?
আদিত্য কে ও সবিতা বলা হয়। তিনি এই রূপে হিরণ্যস্তুপ সূক্তে উদ্দিষ্ট।
সূর্য
ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী মহাকর্ষ বলের কারণেই পৃথিবী নির্দিষ্ট কক্ষপথে আছে।
সূর্যের আকর্ষণ বল না থাকলে পৃথিবী এই অসীম মহাশূণ্যে সঞ্চরণশীল হয়ে
অস্থায়ীভাবে ঘুরে বেড়াত।পৃথিবীর স্থায়িত্ব সূর্য ছাড়া অসম্ভব।
তাই, বৃষরূপী সূর্য পৃথিবী কে ধারণ করে এই উক্তি সর্বতোভাবে ই সত্য।
আবার আধ্যাত্মিক অর্থে পরমাত্মা ও এই বিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবীর স্থাপন ও ধারণকারী জ্যোতির্ময় সত্তা রূপে সিদ্ধ হন।
এ প্রসঙ্গে উক্ত সূক্তের শুরুতে ডঃ তুলসি রাম শর্মা কৃত ব্যাখ্যা অংশ দ্রষ্টব্য।
জয়তু অগ্নিবীর জয় সনাতন।
ReplyDelete