ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহের অপৌরুষেয় প্রাপ্ত নয়, বরং এটি সংহিতারই ব্যাখ্যান, এগুলো স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এবং অথর্ববেদ অপৌরুষেয়, এটাও স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বেদের ইয়ত্তা (সংখ্যা বা পরিমান) নির্ধারিত হয়ে যায় আর জানা হয়ে যায়, অপৌরুষেয় বেদ চারটি আর তাদের নাম ঋগ, যজু, সাম, অথর্ব, কিন্তু যখন আমরা দেখি, প্রাচীন কালে ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ আর অথর্ববেদের অনেক শাখা ছিলো আর এখনো আট দশটি শাখা পাওয়া যায় তখন বেদসমূহের ইয়ত্তা (সংখ্যা বা পরিমান) পাওয়ার প্রশ্নটা শুরুর থেকে আরো অধিক জটিল হয়ে যায় ৷ তখন প্রশ্ন চলে আসে, বেদসমূহের শাখাগুলো কি তবে বৃক্ষের শাখার মত (এক কান্ডের উপর) না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কোনো স্তম্ভের (কান্ডের) সাথে যুক্ত থাকে ? তাহলে কি বেদের অনেক শাখা লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বেদের অনেক ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে ? আর তবে কি প্রাপ্ত শাখাসমূহে পরস্পর কোনো পার্থক্য নেই ? সবগুলো কি এক প্রকারেরই ? ইত্যাদি যেগুলোর সমাধান করা ছাড়া বেদের ইয়ত্তা (সংখ্যা বা পরিমান) নির্ধারন করা কঠিন হয়ে যায়, এজন্য আমরা এখানে শাখাসমূহের তত্ত্ব, তাদের ইতিহাস, প্রাপ্ত শাখাসমূহের রহস্য, ইয়ত্তা ইত্যাদি বিষয়সমূহকে সংক্ষেপে লিখেছি আর দেখিয়েছি যে, বেদের শাখাপ্রকরণ কতটা বিচারণীয় ৷
- সবার প্রথমে স্বনামধন্য পণ্ডিত হলেন সত্যব্রত সামশ্রমী ৷ তাঁর 'ঐতরেয়ালোচন' নামীয় গ্রন্থে শাখার উপর ভালোভাবে আলোকপাত করেছেন ৷
- এর পর স্বামী হরিপ্রসাদ 'বেদসর্বস্ব' নামীয় গ্রন্থে শাখাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন
- আর এর পর গবেষক পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত বী. এ. ও শাখাসমূহের উপর লিখেছেন ৷
এই বিদ্বানগন শাখাসমূহ কি, শুরুর দিকে কত শাখা ছিলো আর এখন কতটি প্রাপ্ত হওয়া গেছে, প্রাপ্ত শাখাসমূহের বিবরণ কি আর তাতে কতটা পার্থক্য আছে, ইত্যাদি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন ৷ তাদের বর্ণনাসমূহ পড়ে শাখাবিষয়ে প্রবেশ হয়ে যায় আর আনায়াসেই এই প্রশ্ন সামনে এসে যায় যে, এই সকল প্রাপ্ত শাখাসমূহের মধ্যে জ্যেষ্ঠত্ব কোনগুলোর ? আর কোন কোন শাখা আদি অপৌরুষেয় ৷ আমরা চাই এখানে শাখার সাথে সম্পর্কিত সকল কথা সংক্ষেপে লিখে এটা বলার চেষ্টা করব, কোন শাখার জ্যেষ্ঠত্ব আছে আর কোন শাখাটি অপৌরুষেয় ৷
বৈদিক কালে যে সময় কেবল বেদেরই পঠন পাঠন হতো, বৈদিক বিদ্বান এক, দুই, তিন অথবা চার বেদ পড়তো আর সেই পঠন পাঠনের যোগ্যতা অনুসারে ঋগ্বেদী, যজুর্বেদী আর সামবেদী অথবা ত্রিবেদী, চতুর্বেদী ইত্যাদি বলা হতো ৷ সেই সময় কেবল চার বেদেরই পঠন পাঠন হতো আর এই চার বেদের স্বরূপ ঋক, যজু, সাম আর অথর্ব ই ছিলো, অর্থাৎ অর্থবশ পাদব্যবস্থাযুক্ত মন্ত্র ঋগ্বেদ, গীত হওয়া সাম, সরলার্থ ছন্দযুক্ত অথর্ব আর শেষটি গদ্যাকৃতি ছন্দযুক্ত যজু বলা হতো ৷
এই চার ভিন্ন বিষয়ের জ্ঞাতা ঋগ্বেদী, যজুর্বেদী, দ্বিবেদী অথবা ত্রিবেদী ছিলো, কিন্তু যখন এধরনের যোগ্যতাযুক্ত আর এই এই উপাধিযুক্ত ব্রাহ্মণ অনেক হয়ে গেল আর প্রাচীন মৌলিক বেদসমূহের পঠন পাঠনের প্রচার পুরানো হয়ে গেল তথা বেদসমূহে সন্দেহ হতে লাগলো, তখন নতুন- নতুন প্রকারের সংহিতাগুলোর সৃষ্টি হতে লাগলো ৷ আদিম মূল সংহিতাসমূহের স্বরূপ সংহিতাই ছিলো ৷
যেভাবে আছে সেভাবে থাকা মন্ত্রগুলোকে সংহিতা বলে ৷
সংহিতার অর্থ করতে গিয়ে পাণিনি মুনি অষ্টাধ্যায়ী ১/৪/১০৮ এ বলেন, 'পরঃ সন্নিকর্ষঃ সংহিতা', অর্থাৎ 'পদান্তান্পদাদিভিঃ সন্দধেতি যৎসা', অর্থাৎ পদের শেষকে অন্য পদের শুরুর সাথে সন্ধিনিয়মে বন্ধন করার নাম সংহিতা ৷
ঋকপ্রতিশাখ্যে লেখা আছে, 'পদপ্রকৃতিঃ সংহিতা', অর্থাৎ পদসমূহের প্রকৃতির বাস্তবিক অবস্থার নাম সংহিতা ৷ আদিমকালীন সংহিতাসমূহ সংহিতাই ছিলো ৷ তাহাতে মন্ত্রসমূহের পদ আলাদা আলাদা ছিলো না ৷ সব মন্ত্র সন্ধিযুক্তই ছিলো, কিন্তু কিছু দিন বাদে বেদার্থ করার ক্ষেত্রে ঝগড়া হতে লাগলো ৷ কেউ কেউ 'ন তস্য' কে 'নতস্য' বলতে লাগলো আর কেউ 'ন তস্য' বলল ৷
এমন অবস্থায় পদসমূহের বিচ্ছেদ পাঠও আরম্ভ করার দরকার হলো, অতঃপর বৈদিক আচার্যগন আলাদা আলাদা করে এক এক সংহিতাকে দুই দুই সংহিতা করে নিলো ৷ এখান থেকেই শাখাসমূহের আরম্ভ হলো ৷ এই আরম্ভকাল অনেক প্রাচীন ৷ এই সময়কাল ব্রাহ্মণকালের অনেক পূর্বের, কারন শাখা আরম্ভকালের বহুদিন পরে সংহিতাসমূহের মধ্যে খৈলিক ভাগ - প্রক্ষিপ্ত ভাগ জুড়ে গেছে আর সেই খৈলিক ভাগের বর্ণনা ব্রাহ্মণসমূহে আছে, এতে প্রতীত হয় শাখাসমূহের আরম্ভ অনেক পুরাকালেই হয়েছিলো ৷ এছাড়াও শাখাগুলোর কারনে গোত্রের প্রচারও হয়েছে ৷ শাখাপ্রচারকদেরকেই প্রায়শঃ গোত্র প্রবর্তক হিসেবে দেখা গেছে ৷ এই গোত্রপ্রবর্তক ঋষিগনের সময়টাও অনেক প্রাচীন, এতেও পাওয়া যায় শাখাগুলোর আরম্ভ অত্যন্ত পুরাকালেই হয়েছে ৷
উপর্যুক্ত প্রকৃতিসংহিতা আর পদসংহিতার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে ঐতরেয় আরণ্যক ৩/৩ তে লেখা আছে, 'যদ্ধি সন্ধিং বিবর্তযতি তন্নির্ভূজস্য রূপমথ যচ্ছদ্ধে অক্ষরে অভিব্যাহরতি তৎ প্রতৃণ্ণস্য', অর্থাৎ যাহাতে সন্ধি যেমন আছে তেমনই রয়ে যায় সেটাই নির্ভূজসংহিতা আর যাহাতে সন্ধি ছাড়া কেবল পদের উচ্চারণ হয় সেটাই প্রতৃণ্ণ সংহিতা ৷
উদাহরণের জন্য যাহাতে 'অগ্নিমীলে পুরোহিতম্' এই প্রকারের পাঠ আছে, সেটি নির্ভূজসংহিতা আর যাহাতে এর প্রকৃতি পাঠের 'অগ্নিম্ ঈলে পুরঃ অহিতম্' করে পদপাঠ করে দেয়া হয়েছে, সেটা প্রতৃণ্ণ সংহিতা ৷ এই দুই প্রকারের সংহিতার মধ্যে পাঠভেদ হয় না আবার পাঠ ন্যূনাধিক হয় না ৷ এই দুই সংহিতাতে সকল মন্ত্র যেমন আছে তেমনই থাকে ৷ প্রাচীন কালে এই ধরনের শাখা ছিলো; কিন্তু কিছু দিন পর এতেও আর সন্তোষ হলো না ৷ বেদসমূহকে শুদ্ধ রাখার জন্য মন্ত্রসমূহ পাঠ করার অনেক বিধির আয়োজন হলো আর প্রত্যেক বিধিও আলাদা আলাদা এক এক শাখা হয়ে গেল ৷
ঐতরেয় আরণ্যক ৩/১৩ তে লেখা আছে, 'অগ্র উ এবোভযমন্তরেণোভযব্যাপ্তং ভবতি', অর্থাৎ এভাবে চলতে চলতে প্রতৃণ্ণসংহিতা উক্ত দুইটির সাথে যুক্ত হয়ে যায়, আর ঘন, জটা, মালা আদি ভেদ বা পার্থক্যের কারনে বিকৃত রূপ হয়ে যায় আর তাকে ক্রমসংহিতা বলা হতে থাকে ৷ এরও তাৎপর্য হলো এটাই যে, যেখানে মূল মন্ত্র থাকে, তার পদও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, আর এই পদসমূহের বিকৃতিও হয় সেটাই ক্রমসংহিতা ৷
ক্রমসংহিতার এই বিকৃত প্রকরণ নিয়ে ব্যাডিমুনি বিকৃতবল্লী নামে এক গ্রন্থই তৈরী করে নিয়েছেন ৷
(নোট ১ঃ বেদ যিনি পাঠ করান তিনিও পিতা ৷ মনুস্মৃতিতে 'গরীযান্মন্ত্রদা পিতা' লেখা আছে । এই শাখাপ্রচারক মন্ত্রদা পিতাই নাতী পুতি-শিষ্য-প্রশিষ্যের গোত্র হয়ে যেত ৷)
সেই গ্রন্থে লিখা আছে-
জটা মালা শিখা রেখা ধ্বজো দণ্ডো রথো ঘনঃ ৷
অষ্টৌ বিকৃতযঃ প্রোক্তাঃ ক্রমপূর্বা মনীষিভিঃ ॥
-বিকৃতবল্লী ১/৪
অর্থাৎ জটা, মালা, শিখা, রেখা, ধ্বজ, দণ্ড, রথ, আর ঘন আদি আট ভেদ বা বিকৃতি আছে ৷
এই বিকৃতিসমূহের কারনে প্রথম শাখাসমূহের আট ভাগ হয়ে গেছে আর এদের সংস্থা দশ বারোটি হয়ে গেছে, কিন্তু এত কিছুর পরেও সন্তুষ্ট হয়নি ৷ গোত্রপ্রবর্তন আর শাখাসম্প্রদায় দ্বারা প্রেরিত হয়ে বৈদিক আচার্যগন শাখাসমূহের পার্থক্য আরো অধিক বৃদ্ধি করেছেন ৷
বৃহদ্দেবতা ১/১৪ তে লেখা আছে, 'দেবতার্ষার্থছন্দোভ্যো বৈবিধ্যং তস্য জাযতে', অর্থাৎ দেবতা, ঋষি, অর্থ আর ছন্দ ভেদে সুক্তসমূহের অনেক পার্থক্য হয়ে গেছে ৷
সকলেই জানে, প্রত্যেক মন্ত্রের দেবতা, ঋষি, ছন্দ আর অর্থ হয়ে থাকে, অতঃপর এই সুক্তক্রম থেকেও সংহিতা তৈরী হলো ৷ অমুক দেবতাযুক্ত সুক্তগুলো বাদ দিয়ে অমুক দেবতাযুক্ত সুক্তগুলো রেখে যে সংহিতা তৈরী করা হলো সেগুলোকে দৈবত শাখা বলা হলো ৷ এভাবেই অমুক ঋষির সুক্তগুলো বাদ দিয়ে অমুক ঋষির সুক্তগুলো রেখে যে সংহিতা বানানো হলো সেগুলোকে আর্ষশাখা বলা হলো ৷ এভাবেই অমুক অর্থযুক্ত সুক্তগুলোকে বাদ দিয়ে অমুক অর্থযুক্ত সুক্তের ক্রম নিয়ে সংহিতাকে অর্থশাখা আর অমুক ছন্দযুক্ত সুক্তগুলোর ক্রমযুক্ত সংহিতাকে ছান্দশাখা বলা হয় ৷ যদিও মন্ত্রগুলোর এত অধিক উলট পালট হয়েছে, তবু তখন পর্যন্ত মন্ত্রসমূহে পাঠভেদ অথবা ন্যূনাধিকতা হয়নি ৷ উপরোক্ত সমস্ত শাখা বিভাগের সংখ্যা চৌদ্দ-পনেরটি পর্যন্ত পৌছে ৷ প্রত্যেক সংহিতা এত এত প্রকার হয়ে গেল কিন্তু মন্ত্রগুলোতে কোনো বিশৃঙ্খলতা হলো না ৷
গোত্রপ্রবর্তক বৈদিক ঋষিগনের শাখাভেদ এতটুকুই করা ছিলো ৷ তারা বিশ্বাস করতেন, পঠন পাঠন শৈলীতে তো পার্থক্য আছে, কিন্তু মূল মন্ত্রগুলোতে ভেদ বা পার্থক্য পড়তে পারেনি ৷
মীমাংসাদর্শন ১/১/৩০ এ শাখাতত্ত্বের নির্বচন করতে গিয়ে জৈমিনিমুনি লিখেছেন, 'আখ্যাপ্রবচনাৎ', অর্থাৎ প্রবচনের কারনেই শাখার নাম হয়েছে ৷
যে ঋষি মূলমন্ত্রগুলোকে যে ক্রমানুসারে পড়াতেন কেবল সেই ক্রমই অমুক শাখা ৷ ভাগ, অংশ, চরণ আদি ভাব শাখার নয়, বরং পঠন-পাঠনের ক্রম-শৈলীই শাখার তাৎপর্য ৷
মহাভাষ্যের কারিকা (অষ্টা ৪/১/৬৩) তে লেখা আছে, 'গোত্রং চ চরণৌঃ সহ', অর্থাৎ চরণের সাথে গোত্র ৷
এখানে চরণ শব্দ শাখার জন্যই এসেছে আর চরণ-আচরণ–পঠন অধ্যয়ন ইত্যাদিই অর্থ রাখে, কিন্তু অনেক ব্যাক্তিগন চরণ শব্দের তাৎপর্য বেদসমূহের এক দেশ-একভাগ মনে করেন ৷ তাদের চরণ শব্দের আচরণ অর্থ গ্রহণ করার সুবুদ্ধি হয় না, কিন্তু মহাভাষ্যের এই কারিকার অর্থ স্পষ্ট করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ কৈয়ট মহোদয় লিখেছেন, 'চরণশব্দাঽধ্যযনবচনঃ', অর্থাৎ চরণ শব্দ অধ্যয়নবাচক ৷ এই কথার তাৎপর্য হলো, চরণ আর শাখা শব্দ বেদসমূহের পঠন-পাঠনেরই শৈলীবাচক, বেদসমূহের বিভাগের বোধক নয় ৷ এই শাখাতত্ত্বের উপর বিচার করতে গিয়ে বৈদিক সাহিত্যের বিখ্যাত মর্মজ্ঞ পণ্ডিত সত্যব্রত সামাশ্রমী 'ঐতরেয়লোচনে' লিখেছেন, তত্ত্বতো নহি বেদশাখা বৃক্ষশাখেব নাপি নদীশাখেব প্রত্যুতাধ্যেতৃভেদাৎ সম্প্রদাযভেদজন্যাধ্যযনবিশেষরূপৈব', অর্থাৎ বাস্তবে বেদের শাখাগুলো বৃক্ষের শাখার মত না, আবার নদীর শাখার মত না, বরং এটি পঠন-পাঠনের পার্থক্য থেকে সম্প্রদায়গত অধ্যয়নেরই বিশেষ রূপ ৷
এই নিষ্পত্তি থেকে জানা গেল যে, বেদের শাখাগুলো বেদের অংশ বা ভাগ নয় ৷ বরং পঠন-পাঠনের ভিন্ন ভিন্ন প্রকার ৷ এই কথা আমরা শাখাগুলোর জন্য প্রযুক্ত হয়েছে এমন শব্দগুলো থেকেও জানতে পারি ৷ অনেক গ্রন্থে লেখা আছে-
একশতমধ্বর্যুশাখাঃ সহস্রবৎর্মা সামবেদঃ ৷
একবিংশতিধা বাহ্বৃচ্যং নবধাঽথর্বণো বেদঃ ॥
-মহাভাষ্য পস্পশাহ্নিক
একবিংশতিভেদেন ঋগ্বেদঃ কৃতবান্ পুরা ৷
শাখানাং তু শতং নাথ যজুর্বেদমথাকরোৎ ॥
সামবেদং সহস্ত্রেণ শাখানাং চ বিভেদতঃ ৷
আথর্বাণমথো বেদং বিভেদং নবকেন তু ॥
- কূর্মপুরাণ
পশ্চৈতে শাকলা শিষ্যা শাখাভেদপ্রবর্তকাঃ ।
- বিকৃতবল্লী
শাখাসু ত্রিবিধা ভূপ শাকলযাস্কমাণ্ডুকাঃ ॥
-দেবীপুরাণ
সামবেদস্য কিল সহস্ত্রভেদা আসন্
যজুর্বেদস্য ষড়শীতির্ভেদা ভবন্তি অথর্ববেদস্য নবভেদা ভবন্তি ॥
-চরণব্যূহ
এখানে যত বাক্য উদ্বৃত হয়েছে সবগুলোতে শাখাগুলোর জন্য ভেদ, বিধি, বৎর্মা, ধা ইত্যাদি শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে ৷ এগুলো সব প্রকার, উপায় আর ঢং ইত্যাদি বাচক শব্দ ৷ এগুলো খণ্ড, ভাগ, প্রকরণ, দেশ আর অংশ ইত্যাদি বাচক শব্দ নয় ৷ এতে ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে যায়, শাখাগুলো বেদের ভাগ নয়, বরং এগুলো ভেদ (বিভিন্ন বিন্যাস ভাগ) । ভেদ (বিভিন্ন বিন্যাস ভাগে) মধ্যে হ্রাস-বৃদ্ধির অনুমতি থাকে না কেবল পরিবর্তনই হতে পারে ৷ একারনেই দৈবত, আর্ষ ইত্যাদি বিভাগ পর্যন্ত মন্ত্রগুলোর (আগে পিছে) অদল বদলই হয়েছে ৷ যতক্ষন পর্যন্ত এই প্রকারের অদল বদলযুক্ত শাখাই ছিলো ততক্ষন পর্যন্ত বেদের স্বরূপে পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্য ছিলো না-ওতে কমানো বাড়ানো হয় নি, কিন্তু কৃষ্ণযজুর্বেদের অবতার ধারণ করতে গিয়েই বৈদিক শাখাগুলোতে উথাল পাথাল শুরু হয়েছে ৷ রাবণাদিকৃত সাহিত্যের সংমিশ্রন থেকে শাখাগুলোতে বিশৃঙ্খলতা হয়ে গেল আর সংহিতাগুলোতে ব্রাহ্মণভাগ তথা ব্রাহ্মণেতর ভাগও মিশিয়ে মিশিয়ে অথবা মূলমন্ত্রগুলোকেই ঘেটে ঘুটে আর পাঠভেদ করে করে অনেক শাখার জন্ম দেয়া গেলো ৷ পুরাতন গ্রন্থগুলোতে শাখাগুলোর যে সংখ্যা লেখা হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা হাজারে পৌছেছিলো আর সবগুলোতেই মতভেদ ছিলো ৷ মহাভাষ্যকার চার বেদের শাখার সংখ্যা ১,১৩১ বলেছে ৷ সর্বানুক্রমণীতে ১,১৩৭ লেখা আছে ৷ কূর্মপুরাণ অনুসারে ১,১৩০ আর চরণব্যুহে ১১৬ টিই লেখা আছে ৷ এভাবে অন্য গ্রন্থগুলোতেও মনগড়া সংখ্যা পাওয়া যায় ৷ এই অতিরিক্ত শাখাগুলোতে আর্য-অনার্য সকল শাখা গননা করা হয়েছে ৷ এজন্য আমরা আবশ্যক মনে করি, মূল আর্যশাখাগুলোর খোঁজ করব ৷
যে সময় গোত্র আর শাখাপ্রচারের ধূম হচ্ছিলো সে সময় এক এক বেদের অনেক শাখা হয়ে গিয়েছিলো ৷ মূলমন্ত্রগুলোকে যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য, মন্ত্রগুলোকে উলট পালট করেই (অর্থাৎ বিভিন্ন মানদণ্ডে বিন্যাস করে) কেবল যতগুলো শাখা হওয়া সম্ভব ছিলো তা হলো ৷ অামরা সেই শাখাগুলোকে আর্যশাখা বলে থাকি, কিন্তু রাবণ-সম্প্রদায়ের কারনে যত শাখা সৃষ্টি হলো সেগুলোতে আর্যশাখাগুলোর চেয়ে দুই বিষয় অধিক হয়েছে ৷ একটি বিষয় হলো, মন্ত্রে পাঠভেদ করা হলো আর এর সাথে আসুরী সাহিত্য, ব্রাহ্মণভাগ আর মনঃকল্পিত বাহ্য সংস্কৃতের মিশ্রণ করে শাখা বানানো হলো ৷ আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, মন্ত্রগুলোর অনেক ভাগ বের করে দেয়া গেল আর মন্ত্রগুলোর রূপ বিকৃত করে ছোটো ছোটো বেদাংশীর নামও শাখা রাখা হলো ৷ এই দুই প্রকারে বানানো শাখাগুলোকে আমরা অনার্যশাখা বলি ৷ আর্যশাখার ভালো নমুনা শাকল, বাষ্কল, ইত্যাদি শাখাগুলো আর অনার্য শাখার নমুনা তৈত্তিরীয় আর কাঠক ইত্যাদি শাখাগুলো ৷ আর্যশাখাগুলোতে উলট পালট ছাড়া আর অন্যকিছু করা হয়নি, কিন্তু অনার্যশাখাগুলোতে দুইটি বিষয় বিদ্যমান আছে ৷
ঋগবেদের মূল আর্যশাখা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো অনার্যশাখা পাওয়া যায় নি ৷ বলা হয়ে থাকে ঋগবেদের ২১ শাখা ছিলো, কিন্তু এখন ঋগবেদের শাকল ও বাষ্কল দুইটি শাখাই পাওয়া যায় ৷ ঋক্ প্রাতিশাখ্যে লিখা আছে -
ঋচাং সমূহ ঋগ্বেদস্তমভ্যস্য প্রযত্নতঃ ৷
পঠিতঃ শাকলেনাদৌ চতূর্ভিস্তদনন্তরম্ ॥
অর্থাৎ ঋগ্বেদের সমস্ত ঋচগুলোকে স্বাধ্যায় করে খুব যত্নের সহিত এটিকে প্রথম দিকে শাকল ঋষি শাখায় রূপ দিয়েছেন আর শাকল ছাড়া অন্য চার শাখাকরগন অন্যান্য শাখার প্রবচন করেছেন ৷
এই প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, সবার প্রথম শাকল ঋষিই শাকল শাখার প্রবচন করেছেন ৷ শাকল ঋষি অত্যন্ত প্রাচীন আর এর প্রামাণিকতা সর্বমান্য, কারন শাকল সংহিতার বিষয়ে ঐতরেয়ব্রাহ্মণে লেখা আছে-
যদস্য পূর্বমপরং তদস্য যদ্বস্য পরং তদ্বস্য পূর্বম্ ৷
অহেরিব সর্পণ শাকলস্য ন বিজানন্তি যতরৎ পরস্তাৎ ॥
-ঐতরেয ব্রাহ্মণ ১৪/৫(3.43)
অর্থাৎ শাকলসংহিতার যেমন আদি আছে তেমনই অন্তও আছে আর যেমন অন্ত আছে তেমনই আদিও আছে ৷ যেভাবে সর্পের চলন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক সমান হয়, এভাবেই শাকলসংহিতারও ক্রম একই সমান, এটির গতিতে কেউ ভেদ বা পার্থক্য করতে পারে না ৷
এই প্রমাণে শাকলের প্রাচীনতা আর তার শাখার সাম্যতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ৷ উপরোক্ত শ্লোক ঐতরেয় এরই গাথা ভাগ, আর ব্রাহ্মণ গ্রন্থের গাথাভাগ ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোর পূর্ব সাহিত্যের নির্বিবাদ ভাগ, এজন্য এর প্রাচীনতা আদিম কাল পর্যন্ত পৌছে যায় ৷ এই আদিমকালীন প্রমাণে শাকলশাখার পূর্ণতা আর সাম্যতাভাবের স্পষ্ট বর্ণনা আছে, এজন্যে শাকলসংহিতাই প্রাচীন সংহিতা, এতে সন্দেহ নেই ৷ অনুবাকানুক্রমণীতে লেখা আছে-
ঋগ্বেদে শৈশিরীযাযাং সংহিতাযাং যথাক্রমম্ ৷ প্রমাণমনুবাকানাং সূক্তৈঃ শৃণুত শাকলাঃ ॥
অর্থাৎ মণ্ডল, অনুবাক আর সুক্তগুলোতে শাকল নিজের শাখার কথা বলেছে ৷ জানা হলো যে শাখায় মণ্ডল, অনুবাক আর সূক্ত আছে সেটাই শাকলসংহিতা ৷
বর্তমান শাকলসংহিতাতে যে লক্ষণ পাওয়া যায়, তাতে বুঝা যায় শাকলসংহিতাই আদি, কেননা লেখা হয়েছে, 'পঠিতঃ শাকলেনাদৌ', অর্থাৎ সবচেয়ে আগে শাকলই তার কথা বলেছে ৷ এতে জানা গেল, অন্য বাকী শাখাগুলো শাকলের পরেই তৈরী হয়েছে ৷ বিকৃতবল্লীর টীকাতে লেখা আছে-
শিশিরো বাষ্কলঃ শাঙ্খো বাতশ্চৈবাশ্বলাযনঃ ।
পঞ্চৈতে শাকলাঃ শিষ্যাঃ শাখাভেদপ্রবর্তকাঃ ॥
অর্থাৎ শাকল ঋষির শিষ্যপরম্পরাতে পাঁচ আচার্য - শিশির, বাষ্কল, শঙ্খ, বাত আর আশ্বলায়ন - শাখাভেদের প্রচিরক হয়েছেন ৷
এই পাঁচের মধ্যে বাষ্কল অনেক প্রাচীন ৷ এতে ঋগ্বেদকে অষ্টক, অধ্যায় আর বর্গে সংকলিত করেছেন ৷ এভাবে এই শাকল ও বাষ্কল এই দুইটি অত্যন্ত প্রাচীন, অর্থাৎ আদিম কালীন ৷ কোনো কোনো মহানুভব শাকল কে শাকল্যও মানেন আর বলেন, শাকল শাখার পদপাঠকারী শাকল্যই আর শাকল্যের কারনেই তার শাকল শাখা নাম হয়েছে, কিন্তু আমাদের এই বিবাদে কোনোই প্রয়োজন নেই ৷ শাকলসংহিতা শাকলের নামে প্রসিদ্ধ হোক বা শাকল্যের নামে প্রসিদ্ধ হোক, দেখতে তো হবে এটাই, যেখানে ঋকপ্রতিশাখ্যে স্পষ্ট রীতিতে বলে দেয়া হলো, 'পঠিতঃ শাকলেনাদৌ', অর্থাৎ সবার প্রথমে শাকলই এর কথা বলেছেন তাই এই কথায় "এর পূর্বেও আর কোনো শাখা ছিলো" এই কথার আর কোনো জায়গা থাকে না ৷ শাকল্য বা শাকলই সবার প্রথমে প্রাচীন প্রকৃতি আর পদপাঠযুক্ত সংহিতাকে দশ মণ্ডল আর এক হাজার আটাশ সুক্তে বিভক্ত করেছে ৷
গোপথ ১.১.২৯ বলছে-
কিং দেবতম্ ইতি ঋচাম্ অগ্নির্ দেবতম্ তদ্ এব জ্যোতিঃ গায়ত্রং ছন্দঃ পৃথিবী স্থানম্ অগ্নিম্ ঈঌএ
পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্ ঋৎবিজং হোতারং রত্নধাতমম্ ইত্য্ এবম্ আদিং কৃৎবা ঋগ্বেদম্ অধীয়তে
যা শৌনক শাখা নির্দেশ করে ।
এজন্য এই সংহিতা দাশতয়ী অর্থাৎ দশযুক্ত বলা হয়ে থাকে ৷ এই শাখার পর কিছু দিনেই এর প্রধান শিষ্য বাষ্কল সেই শাখাকে অষ্টক, বর্গ আর অধ্যায়ে বিভাজিত করে দিলেন, কিন্তু এই বিভাজনের কারণ মন্ত্রগুলোর কেবল সংখ্যা অঙ্কই আলাদা আর বাষ্কল বালখিল্য সূক্ত সংহিতায় রাখেনি , এজন্য বৈদিকগণ দুটিকেই বাষ্কলের গুরু ধস্কল্কেই প্রাচীন ও মূল বলেন৷
পাণিনি শৌনককে মূল মেনেছেন -৪.৩.১০৬
৪.৩.১২৮
এখন পর্যন্ত দুই শাখাকে একটিতেই মিলিত পাওয়া যায় আর কেবল ইতিহাস স্মরণের জন্য দুই প্রকারের ঠিকানা বর্তমান ঋগ্বেদের পৃষ্ঠাতে লিখে রাখে ৷ এই ক্রম আদিকাল থেকেই চলে আসছে ৷ এইভাবেই এইটি আদি প্রবচনকর্তার স্থির করা ঋগ্বেদশাখা প্রাপ্ত আর এতে এখন পর্যন্ত আরম্ভিক সংহিতার প্রকৃত মন্ত্র আর পদপাঠ দুইটি একটিতেই ছাপা হয় ৷ বর্তমান ঋগ্বেদসংহিতার সায়নাচার্য আর স্বামী দয়ানন্দের ভাষ্যে মন্ত্র আর পদপাঠ তথা মণ্ডল, সূক্ত আর অষ্টক, বর্গ ইত্যাদি চার আরম্ভিক আর প্রাথমিক চিহ্ন আজ পর্যন্ত লিখিত থাকা পাওয়া যায়, এজন্য আদিম অপৌরুষেয় ঋগ্বেদসংহিতা পূর্ণরূপে প্রাপ্ত আছে, এতে সামান্যতমও সন্দেহ নেই ৷
গোপথ ১.১.২৯ বলছে-
কিং দেবতম্ ইতি ঋচাম্ অগ্নির্ দেবতম্ তদ্ এব জ্যোতিঃ গায়ত্রং ছন্দঃ পৃথিবী স্থানম্ অগ্নিম্ ঈঌএ
পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্ ঋৎবিজং হোতারং রত্নধাতমম্ ইত্য্ এবম্ আদিং কৃৎবা ঋগ্বেদম্ অধীয়তে
যা শৌনক শাখা নির্দেশ করে ।
এজন্য এই সংহিতা দাশতয়ী অর্থাৎ দশযুক্ত বলা হয়ে থাকে ৷ এই শাখার পর কিছু দিনেই এর প্রধান শিষ্য বাষ্কল সেই শাখাকে অষ্টক, বর্গ আর অধ্যায়ে বিভাজিত করে দিলেন, কিন্তু এই বিভাজনের কারণ মন্ত্রগুলোর কেবল সংখ্যা অঙ্কই আলাদা আর বাষ্কল বালখিল্য সূক্ত সংহিতায় রাখেনি , এজন্য বৈদিকগণ দুটিকেই বাষ্কলের গুরু ধস্কল্কেই প্রাচীন ও মূল বলেন৷
পাণিনি শৌনককে মূল মেনেছেন -৪.৩.১০৬
৪.৩.১২৮
এখন পর্যন্ত দুই শাখাকে একটিতেই মিলিত পাওয়া যায় আর কেবল ইতিহাস স্মরণের জন্য দুই প্রকারের ঠিকানা বর্তমান ঋগ্বেদের পৃষ্ঠাতে লিখে রাখে ৷ এই ক্রম আদিকাল থেকেই চলে আসছে ৷ এইভাবেই এইটি আদি প্রবচনকর্তার স্থির করা ঋগ্বেদশাখা প্রাপ্ত আর এতে এখন পর্যন্ত আরম্ভিক সংহিতার প্রকৃত মন্ত্র আর পদপাঠ দুইটি একটিতেই ছাপা হয় ৷ বর্তমান ঋগ্বেদসংহিতার সায়নাচার্য আর স্বামী দয়ানন্দের ভাষ্যে মন্ত্র আর পদপাঠ তথা মণ্ডল, সূক্ত আর অষ্টক, বর্গ ইত্যাদি চার আরম্ভিক আর প্রাথমিক চিহ্ন আজ পর্যন্ত লিখিত থাকা পাওয়া যায়, এজন্য আদিম অপৌরুষেয় ঋগ্বেদসংহিতা পূর্ণরূপে প্রাপ্ত আছে, এতে সামান্যতমও সন্দেহ নেই ৷
শাকল আর বাষ্কল শাখাগুলোর সংযুক্ত রূপের অতিরিক্ত ঋগ্বেদের দ্বিতীয় কোনো শাখা এখন পাওয়া যায় না ৷ বলা হয়ে থাকে, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির পুস্তকালয়ে ঋগ্বেদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত শাংখ্যায়নী শাখা পাওয়া যায়, কিন্তু এটির স্বরূপ এলোমেলো ৷ এলোমেলো হওয়া ছাড়াও এটি শাকলের শিষ্যদেরকে প্রবচন দেয়া হয়েছে, এজন্য শাকলের অপেক্ষা ওটির জ্যেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায় না ৷ ঋগ্বেদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত শাখাভেদ এটুকুই ৷