ভারতবর্ষের শিক্ষা সংস্কৃতি
মণি-মঞ্জুষাই হল সংস্কৃত শাস্ত্র। ভারতের প্রাণ-স্রোতটিকে যদি একটা নদীর সঙ্গে
তুলনা করা হয়, তবে সেই নদীর বেগ এবং গতিধারাকে নিত্য বহমান রেখেছে এই ভাষা।
সংস্কৃতের সঞ্জীবনী সুধারসই হল ভারতের জীয়ন-কাঠি। সংস্কৃত চর্চাকে যেদিন থেকে
দেশের মানুষ অবহেল করেছে, “মৃত ভাষা’ বলে নাসিকা কুঞ্চন করতে শিখেছে, সেইদিন থেকেই
এদেশের দুর্ভাগ্যের বোঝা শুরু। সাধারণ লোকে সংস্কৃতকে কতকগুলি পূজার্চনা এবং নিছক
ধর্মচর্চার প্রাণহীন মন্ত্র বলে ধরে নিয়েছে।
.
কিন্তু ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, সেই সুদূর অতীত ৮১০ খৃষ্টাব্দে আরবের জ্ঞানীরা সংস্কৃত ভাষার কদর বুঝতে পেরেছিলেন। “বায়ত্-অল-হিকমা” বা জ্ঞানের আগার নাম দিয়ে তাঁরা শত শত সংস্কৃত গ্রন্থ সংগ্রহ করে তার চর্চা এবং গবেষণা শুরু করে দিয়েছিলেন। আরব-সংস্কৃতি থেকেই ইউরোপীয় সভ্যতা পুষ্ট হয়েছে আর আরব সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে এই সংস্কৃত তথা ভারতীয় সংস্কৃতির দৌলতে। ভারতীয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানী চরক ও সুশ্রুতের লেখা চিকিৎসা-শাস্ত্র, আর্যভট্টের জ্যোতিষ সিদ্ধান্ত, ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, শ্রীধর ও ভাস্করাচার্যের অঙ্কশাস্ত্র প্রভৃতি অনুবাদ করে আরবরাই ঐ সমস্ত বিজ্ঞানের তত্ত্ব আয়ত্ত করেন। আমাদের “কথাসরিৎসাগর” নামক গ্রন্থটিকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করে তারা এর নাম দিয়েছিলেন “আলিফ-লায়লা-ও-লায়লা’। পারসী ভাষায় এই গ্রন্থের নাম হয়, ‘হাজারদস্তান’ বা সহস্র কাহিনী।
.
শুধু কি আরব? চীন, ইংল্যান্ড, জার্মানী এবং ইউরোপের অন্যান্য সব দেশেরই কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, জ্যামিতি শাস্ত্র, রসায়ন ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য- এক কথায় যে সব শাস্ত্রের অবদানে বর্তমান সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তার মূল উৎস হল এই সংস্কৃত।
.
কোন দেশে বা কোন ভাষায় আজ পর্যন্ত ব্যাস বাল্মীকির মত মহাকবি, কালিদাস ভবভূতির মত কবি, শূদ্রকের মত নাট্যকার, বিষ্ণুশর্ম্মার মত গল্পলেখক, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম, শঙ্কর প্রভৃতির মত দার্শনিক, পাণিনি কাত্যায়নের মত বৈয়াকরণ, পিঙ্গলের মত ছন্দ-শাস্ত্রজ্ঞ, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত ও ভাস্করাচার্যের মত জন্মগ্রহণ করেছেন? পঞ্চম শতাব্দীতে আর্যভট্ট সংস্কৃত পড়েই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আবর্তন জনিত দিবা-রাত্রির ভেদ আবিষ্কার করেছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ভাস্করাচার্য সংস্কৃত পড়েই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আবর্তন জনিত দিবা-রাত্রির ভেদ আবিষ্কার করেছিলেন।
.
দ্বাদশ শতাব্দীতে ভাস্করাচার্য সপ্তদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী নিউটনের বহুপূর্বহ, পৃথিবীর উপর থেকে সকল বস্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যই মাটিতে পড়ে, একথা বলেছিলেন। এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা এবং শূণ্যের (০) সাহায্যে অঙ্ক লেখার প্রণালী, পাটীগতিতের যোগ বিয়োগ গুণ ও ভাগের পদ্ধতি সংস্কৃতসেবী হিন্দুরাই জগৎকে শিক্ষা দিয়েছেন। ব্রহ্মগুপ্ত এবং পদ্মনাভ সর্বপ্রথম অজ্ঞাত রাশির সাহায্যে গণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এজন্য তারা বীজগণিতের নাম দেন “অব্যক্ত গণিত”। মহম্মদ-বেন-মুসা আমাদের কাছ থেকে বীজগণিত শিক্ষা করেন এবং আরবদের কাছ থেকেই ইউরোপ বীজগণিতের প্রথম পাঠ লাভ করে। আরবী “এলজিবর’ থেকেই ইংরেজী Algebra শব্দের উৎপত্তি। আরব-মনীষী এই ঋণের স্বীকৃতিস্বরুপ তাদের অঙ্কশাস্ত্রের নাম দিয়েছিলেন হিসাব-উল-হিন্দ অর্থাৎ হিন্দুস্থানের গণনা পদ্ধতি।
.
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও সংস্কৃত জানা পণ্ডিতরা যে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরাই বিষুবরেখা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এবং চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের কার্যকারণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেতে পেরেছিলেন। “চলা পৃথী স্থিরা ভাতি ব্যোম্নি সচলো তিষ্ঠাতি’ – পৃথিবী নিজের কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, প্রথিবীর আবর্তনের জন্যই দিবারাত্রির ভেদ হয় এই যুগান্তকারী তত্ত্ব কোপারনিকাসের জন্মের বহু পূর্বেই সংস্কৃত পড়ুয়া আর্যভট্ট আবিষ্কার করেন। শুধু কি তাই? সোনা ও লোহার যৌগিক পদার্থ প্রস্তুত প্রণালী, পারদ ও গালার নানারকম রাসায়নিক ক্রিয়াকৌশল, জাহাজ ও নৌকা তৈরীর নানারকম কারিগরী বিদ্যা অতীতকালে সংস্কৃতের পণ্ডিতরাই আবিষ্কার করেছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের History of Hindu Chemistry এবং মনীষী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের History of Indian Shipping বইটি পড়লে বিজ্ঞান সাধনায় সংস্কৃতের দান যে কি অপরিমেয় তার বিশদ পরিচয় পাওয়া যাবে। কাজেই যারা বলেন, “সংস্কৃত মৃত ভাষা এবং সংস্কৃত জানলে সায়েন্স জানা যায় না তারা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত এবং একদেশদর্শী।