আজ ইতিহাসের গল্পে কিছুটা বিরতি দিবো। ইতিহাস আসবেই, কিন্তু সেটিই প্রধান উপজীব্য নয়। উপজীব্য আমাদের সেক্যুলার, প্রগতিশীল হিন্দুরা, তাদের পালানোর গল্প, ভুল সেক্যুলারিজমের গল্প। কিভাবে সেক্যুলার হিন্দুরাই প্রথম
হিন্দু বিরোধী শিকার হয়, সেই গল্প।
১৯৪৭ সাল। দেশবিভাগ হবেই এটা নিশ্চিত। সেক্যুলার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মনে তখন ব্রাহ্মনবিরোধি মনোভাব প্রবল। তিনি দেশের সকল তথাকথিত নিম্নবর্ণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুর ভোটে সিলেট আসাম না হয়ে পুর্ব পাকিস্তান হয়েছে। এদিকে ৫২% হিন্দু থাকা খুলনার নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও পাকিস্তানে আসতে চায়। খুব ভালোকথা।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেল। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল খুব খুশিমনে আইনমন্ত্রী হলেন। কিন্তু এই খুশি বেশিদিন টিকলো না। ১৯৫০ সালে তিনি পদত্যাগ করলেন পাকিস্তানের প্রশাসনকে হিন্দুবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে। করাচি থেকে ১৯৫০ সালে তিনি বনগাঁ আসলেন মানে ভারতে গেলেন। সেই ভারত যাকে তিনি ব্রাহ্মন্যবাদী মনে করতেন, সেই ভারতেই তিনি আশ্রয় নিলেন। গোপালগঞ্জ, খুলনার মতুয়াবাদি অসংখ্য লোক তার দেখাদেখি বনগাঁ তে চলে আসলো। হরিচাদ ঠাকুরের উত্তর পুরুষেরা এক এলাকার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তার আশেপাশেই সবাই একে একে এসে আশ্রয় নিতে লাগলো। এলাকার নাম লোকমুখে হয়ে গেল ঠাকুরনগর। বনগার পরের স্টেশন। ব্রাহ্মন্যবাদী ভারতের হাত থেকে বাচতে অহিন্দুদের সাথে হাত মিলিয়ে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের শেষ জীবনের আশ্রয়স্থল ব্রাহ্মন্যবাদী (!) ভারত। ঠাকুরবাড়ির ছেলে শান্তনু ঠাকুর ওই এলাকার বিজেপি থেকে প্রার্থী হয়ে বর্তমান সংসদের এমপি।
ইলা মিত্র। বামপন্থী নেত্রী ছিলেন। সারাজীবন অসাম্প্রদায়িকতার বানী ছড়িয়েছেন। দেশভাগের সময় তিনি পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫০ সালে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। পুলিশ তাকে বিদ্রোহি হিসেবে গ্রেপ্তার করে জেলে নেয়। ১৯৫৪ সালে পর্যন্ত জেলে অসংখ্যবার ধর্ষিত ও শারীরিক নির্যাতন এর শিকার হন। এরপর এই কমিউনিস্ট নেত্রী তীব্র অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ভারতে গিয়ে আর তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেননি। কেন? ভয়ে আসেননি। প্রথমত তিনি হিন্দু, দ্বিতীয়ত কমিউনিস্ট নেত্রী। পাকিস্তান কমিউনিস্টদের টিকতে দেয় না। তারপরও কমিউনিস্টদের পাকিস্তান প্রেম যায় না। আমার মতে, এইটা একধরনের মানসিক রোগ। যাহোক, ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আগে
এবং তারপর পুর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলায় দাংগা ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালীতে হিন্দুদের গণহারে হত্যা করা হয়। কে এখন মানবতা ও ভালবাসার বাণী নিয়ে পশ্চিম বাংলাতে এগিয়ে আসে? উত্তর খুব সহজ, ইলা মিত্র ও সাথের কমিউনিস্টরা। যেই কমিউনিস্টদের ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান থেকে পিটিয়ে বের করেছে তারাই ভারতে গিয়ে সেকুলারিজম
দেখাচ্ছে। অসাধারন মানবিক এরা। কিন্তু পূর্ব বাংলাতে তাদের অস্তিত্বই নাই।
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার দাবি করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৭১ সালে তাকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাও করে। আজ ২০২০ সাল, তার নিজের বসতভিটাটি এখনো অর্পিত বা শত্রু সম্পত্তি। এই হলো প্রতিদান। এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও পাকিস্তান চেয়েছিলেন পরে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রথম দাবি তোলেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অপরিসীম। প্রাপ্তি তো চোখের সামনে। পাঠ্যবইতে ছোট করে তার নাম আছে একখানে। জগতজ্যোতির গল্প তো জানলাম এই সেদিন।
একটু বাংলার বাইরে যাই। কাশ্মীর, কাশ্যপ মুনির নামে নামকরন। ওখানেও ইসলামি শাষণ ছিল। প্রচুর সুফি, পীরেরা এসেছে। তারপরে ১৯ শতকে এসে ডোগরা সিংহ বংশ আবার রাজ্য জয় করে। কাশ্মীরে হিন্দুরা নিজের মেয়ের সাথে অনুষ্ঠান করে মুসলিমদের বিয়ে দিতো যদি সামাজিক মর্যাদা এক হতো। অবশ্য বাংলায়ও এরকম হতো। যাহোক, মুসলিমের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। আর কাশ্মীরিদের জাত্যাভিমান ছিল। তারা আলাদা থাকতে চায়। ভারতের সাথেও আসবে না, পাকিস্তানের সাথেও না। আসলে রাজা হরি সিংহের সাথে জওহরলাল নেহেরু পরিবারের সমস্যা ছিল। হরিসিং ছিল রাজা আর নেহেরুরা প্রজা। সেখানে ভারতে আসতে হলে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী মানতে হতো। ব্যক্তিস্বার্থে হরিসিং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রজার ভরসায় স্বাধীন থাকার চেষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস বলে পাকিস্তানের কাছে কাশ্মীরের অংশ হারিয়ে তিনি ভারতে যোগ দেন। তখন নেহেরুকে নানারকম শর্ত দিয়েছিলেন। যত সমালোচনাই করি নেহেরু রাজা হরিসিং এর দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে আর্টিকেল ৩৭০ যোগ করেছিলেন। এই আর্টিকেল এ এক মজার ক্লজ ছিল,
"পাক অধিকৃত কাশ্মীরের লোক ভারতের কাশ্মীরে জমি, বাড়ি কিনতে পারবে কিন্তু ভারতের অন্য অঞ্চলের লোক কাশ্মীরে জমি, সম্পত্তি কিনতে পারবে না।" এরকম আরো কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদি শর্ত ছিল। যেটি আসলে কাশ্মীরের হিন্দুদের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি করে। অবশ্য কাশ্মীরি হিন্দুরাও হিন্দু ভারতে নয়, কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল। ফলে, স্বাধীন ভারতে ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি হিন্দুদের বাড়ি ছেড়ে জীবন বাচাতে পালাতে হয়। হরিসিং এর উত্তর পুরুষ করন সিং কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তিনি কখনোই কাশ্মীরে থাকেননি। রাজ্যসভায় দিল্লি এলাকার এমএলএ
হিসেবে কংগ্রেস তাকে মনোনীত করে সম্মানিত করে। আর কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা তো আমরা জানিই।
এই হরিসিং যদি কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ নিয়ে অতি আদিখ্যেতা না দেখাতো, সেক্যুলার আদর্শে সবাই কাশ্মীরি ভাই ভাই, তাহলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরও হয়না। আর্টিকেল ৩৭০ যোগ না করলে অন্য এলাকার লোক কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতো, তাহলে হিন্দুদের ওরকমভাবে বিতাড়িত হতো না। কলকাতায় বাংলাপক্ষ এর গর্গ এরকম মুসলিম হিন্দু সব বাঙ্গালী এক বলার চেষ্টা করছে। অতীতে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলও হিন্দু ভারত নয়, দলিত মুসলিম ভাইভাই মটোতে বিশ্বাসী হয়ে একইরকম ক্ষতি করেছে।
তাই দেখা যাচ্ছে সেক্যুলার বানী যারা ছড়িয়েছে, হিন্দুবিরোধীরা প্রথমে তাদেরকেই দংশন করেছে। আজও বাঙ্গালি হিন্দু বিশেষত শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায় যদি এই একপাক্ষিক সেক্যুলার আদর্শের বানী ছড়ায় তাহলে তারাই প্রথমে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই আজগুবি সেক্যুলারিজম পরিত্যাগ করা প্রয়োজন।
-বিজয় সিংহ