প্রারম্ভ
স্থানীয় হিন্দুদের বিশ্বাস বলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেছিলেন৷ আর বিজ্ঞান বলছে, পাক সেনার ছোঁড়া গোলার কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় রক্ষা পেয়েছিল গুজরাটের দ্বারকাধীশ মন্দির৷ বিশ্বাস ও বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন জন্মাষ্টমীর দিন এলেই এই যুদ্ধের কথা উঠে আসে দ্বারকার বাসিন্দাদের মধ্যে৷ যে আক্রমণ অনেকেই খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন৷ কিন্তু বিশ্বাস যাই থাকুক, দ্বারকা নগরীর উপর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর আক্রমণ ভারতের নৌবাহিনীর ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছিল। আজ সেই গল্পই বলবো।
১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ
আরব সাগরের তীরে ভারতের গুজরাটের এক শহর দ্বারকা৷ সেখানকার রাজা ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ৷ দ্বারকাধিপতি কৃষ্ণ যুগ যুগ ধরে এই শহরের রক্ষাকর্তা৷ এমনই বিশ্বাস রয়েছে স্থানীয় সব ধর্মের মানুষের মধ্যে৷
১৯৬৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর৷ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলছে যুদ্ধ৷ আরব সাগরের বুকে দ্বারকা নগরীকে ধ্বংস করতে বিশেষ পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তান নৌ বাহিনী৷ করাচি বন্দর থেকে শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন দ্বারকা’।অভিযানে অংশ নেয় পিএনএস বাবর, পিএনএস খায়বার, পিএনএস বদর, পিএনএস জাহাঙ্গীর, পিএনএস শাহজাহান, পিএনএস আলমগীর, পিএনএস টিপু সুলতান এই সাতটি জাহাজ৷
দ্বারকার কাছে পৌঁছে অনবরত বোমা ছোড়তে শুরু করে পাকিস্তানি নৌ বাহিনী৷ বিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক স্থাপত্য দ্বারকা মন্দির লক্ষ্য করে অন্তত ১৫৬টি বোমা ছোড়া করা হয়৷ আর প্রতিবারই তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷
পরে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে রিপোর্ট দেওয়া হয়, মন্দিরের কাছে নরম মাটিতে আছড়ে পড়েছিল বেশিরভাগ পাকিস্তানি রোমা৷ তাই সেগুলি ফোটেনি৷ কয়েকটি বোমার আঘাতে অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয় মন্দিরের কিছু অংশ, স্থানীয় স্টেশন ও কিছু বাড়ি৷ কিন্তু বড়সড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল দ্বারকা৷
রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্তত ৪০টি বোমার গায়ে ‘ইন্ডিয়ান অর্ডিনেন্স’ লেখা ছিল৷ তারিখ ছিল ১৯৪০ সালের, ভারত বিভাগেরও আগের৷ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণেই তা কার্যকরী হয়নি৷দ্বারকাবাসীর বিশ্বাস, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অদৃশ্য থেকেই তার শহরকে রক্ষা করেছেন৷
দ্বারকা আক্রমণের পেছনে পাকিস্তানের সামরিক কৌশল ছিল আরো বড়৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দ্বারকায় ভারতীয় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে ব্যস্ত রেখে মুম্বাই উপকূলে ভারতীয় জাহাজের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি নৌবাহিনী। অন্য একটি সূত্র বলছে, দ্বারকা নগরকে পাকিস্তানি নৌবাহিনী আক্রমণ করার জন্য লক্ষ্য স্থির করেছিল দুটো কারণে। প্রথমত, এই নগরটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। দ্বিতীয়ত, এই নগরের ভিতর একটি রাডার সিস্টেম আছে যা ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে।
এই কাজে নামানো হয়েছিল পাক সাবমেরিন পিএনএস গাজীকে৷ যদিও সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে পিএনএস গাজী বিশেষ পরিচিত৷ ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বিশাখাপত্তনমের কাছে এই পাক ডুবোজাহাজটিকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয় ভারতীয় নৌ বাহিনী৷
দ্বারকার যুদ্ধে চরম বিব্রত হয়েছিল পাকিস্তান সরকার৷ তড়িঘড়ি পাকিস্তান রেডিও ঘোষণা করে দেয় দ্বারকা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে৷ সেই সংবাদে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র শোরগোল পড়েছিল৷ পরে নিজেদের ব্যর্থ আক্রমণের রিপোর্ট পেয়ে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার৷
সেই ধাক্কা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে ভারতীয় নৌসেনাকে। প্রয়োজন পড়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী অত্যাধুনিক রণতরীর।
ভারতের ঘুরে দাঁড়ানো
১৯৬৮ সাল। যুদ্ধের গন্ধ তখন আরও গাঢ়। তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শক্তিশালী রণতরী 'ওসা-১' চেয়ে পাঠায় ভারত। ওসা-১ যুদ্ধজাহাজ থেকে নির্ভুল লক্ষ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে শত্রুজাহাজকে ধ্বংস করা যেত নিমেষে। নিজেদের মিসাইল বোট স্কোয়াড্রন তৈরির জন্য আটটি 'ওসা-১' রণতরীর দরকার ছিল ভারতের। শোনা যায় ভারতের নৌবাহিনীর কম্যান্ডাররা এই রণতরীর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন রাশিয়াতে গিয়ে। ১৯৭১ সাল নাগাদ ভারতের অস্ত্রভাণ্ডারে যোগ দেয় রাশিয়ার এই রণতরী।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সাল, নৌবহর সাজাচ্ছে ভারত, চুপিচুপি করাচি বন্দরের তথ্য সংগ্রহ করলেন গোয়েন্দারা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) তখন মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালাচ্ছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ান্তর না-দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।’পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারতীয় ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধাবস্থা' ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। পাকিস্তানের তরফ থেকে ফের পাঠানো হল পিএনএস গাজিকে। এই ডুবোজাহাজ ততদিনে আরও উন্নত ও শক্তিশালী। কিন্তু সেই পিএনএস গাজির পতন হল বিশাখাপত্তম উপকূলে। ভারতের ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রাজপুতের হাতে ধ্বংস হল পিএনএস গাজি। জয় হল ভারতীয় নৌবাহিনীর।
পাল্টা আক্রমণ
জয় তো হল, পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল ভারতীয় নৌবাহিনী। ফের যদি জলপথে হামলার পরিকল্পনা করে পাকিস্তান, তাহলে তাদের সেই বিষদাঁতই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের পরে নৌসেনা অফিসাররা ঠিক করলেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বন্দর ও পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করতে পারলেই পাকিস্তানের মনোবল ভেঙে যাবে। অতি গোপনে নৌঅভিযানের প্রস্তুতি শুরু হল। করাচি বন্দরের নকশা ও হালহকিকতের খবর এনে দিলেন গোয়েন্দারা। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে করাচি বন্দরের আদলে অস্থায়ী বন্দর তৈরি করে ভারতীয় নৌবাহিনীকে সমুদ্রযুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী।
'অপারেশন ট্রাইডেন্ট'-এর প্লট তৈরি, ছক সাজালেন নৌসেনারা
করাচিতে অতর্কিতে প্রবল প্রত্যাঘাতের নাম দেওয়া হল 'অপারেশন ট্রাইডেন্ট।' রণসাজে সেজে উঠল ভারতের তিন ক্ষেপণাস্ত্রবাহী রণতরী আইএনএস নিপাত (K86), আইএনএস নির্ঘাত (K89) ও আইএনএস বীর (K82)। প্রতিটি রণতরীর মধ্যে ছিল ৪টি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি SS-N-2B Styx SSM ক্ষেপণাস্ত্র। যাদের প্রত্যেকের পাল্লা ৪০ নটিক্যাল মাইল। তাছাড়াও ২টি আর্নালা গোত্রের অ্যান্টি-সাবমেরিন করভেট আইএনএস কিলতান ও আইএনএস কাচালি এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। ছিল ফিল্ড ট্যাঙ্কার আইএনএস পোশাক।
৩ ডিসেম্বর রাতে গুজরাটের ওখা বন্দর থেকে করাচির দিকে ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করে এই তিন রণতরী। আইএনএস নিপাতের কম্যান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট বিএন কাভিনা, আইএনএস নির্ঘাতের কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট আইজে শর্মা, আইএনএস বীরের কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট ওপি মেহতা।
৪ ডিসেম্বরের রাত, করাচি বন্দরে প্রবল আঘাত হানল ভারতীয় নৌসেনা
রাত সাড়ে ১০টা। অস্ত্রসাজে সজ্জিত ভারতের নৌবহর পৌঁছল করাচির দক্ষিণপ্রান্তে ১৮০ নটিক্যাল মাইলে। রেডারে ধরা দিল পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ। রাত ১০টা ৪৫ মিনিট। প্রথম আঘাত হানল আইএনএস নির্ঘাত। রাতের অন্ধকার চিরে গর্জে উঠল শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র। নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত করল পিএনএস খাইবার যুদ্ধজাহাজের ডান দিকে। আগুন ধরে গেল বয়লার রুমে। আর সময় নষ্ট নয়। আবারও গর্জে উঠল ক্ষেপণাস্ত্র। বিকট বিস্ফোরণে ছারখার হয়ে গেল পিএনএস খাইবার। মৃত্যু হল শত্রুপক্ষের প্রায় ২২২ জনের।
জ্বলছে করাচি বন্দর রাত ১১টা। এবার শত্রুপক্ষের দিকে ধেয়ে গেল ভারতের আইএনএস নিপাত। পরপর দু'টি মিসাইলের ধাক্কায় ধরাশায়ী হল পাকিস্তানের এমভি ভেনাস চ্যালেঞ্জার, পিএনএস শাহাজাহান ও সি-ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। রাত ১১টা ২০মিনিট । আইএনএস বীর নিশানা করল পিএনএস মুহাফিজকে। এক ধাক্কায় ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল পাক রণতরী। শোনা যায়, এই আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল পাকিস্তানের ৩৩ জন নৌসেনার। এর পরেও পাকিস্তানের একাধিক যুদ্ধজাহাজের জ্বালানি নষ্ট করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী। ডুবিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক রণতরী। একটা গোটা রাতের অপারেশনে সামান্য আঁচড়ও লাগেনি ভারতীয় নৌসেনার গায়ে। বিজয়ের হাসি হেসে ৭ ডিসেম্বর ফিরে এসেছিল মুম্বইয়ের বন্দরে। শোনা যায়, গুজরাটের ওখা বন্দরে নাকি ক্রমাগত এয়ার স্ট্রাইক চালাচ্ছিল পাকিস্তান। তবে ভারতের একটিও রণতরীর ক্ষতি করতে পারেনি। ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধজয়ের এই দিনটিকেই নৌসেনা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে । ওই তিন রণতরী 'কিলার স্কোয়াড্রন'-এর তিন কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট বাহাদুর কাভিনা, লেফটেন্যান্ট ইন্দ্রজিত্ শর্মা ও লেফটেন্যান্ট ওম প্রকাশ মেহতাকে 'বীর চক্র' সম্মান দেওয়া হয়। পুরো অপারেশনের নির্ভুল ও দক্ষ পরিকল্পনার জন্য জি এম হীরানন্দানিকে দেওয়া হয় 'নৌসেনা মেডেল।' পরবর্তীকালে তিনি নৌসেনার ভাইস অ্যাডমিরাল হন। অসীম সাহসের জন্য কম্যান্ডার বাবরু ভান যাদব পেয়েছিলেন 'মহাবীর চক্র।'
এইভাবেই দ্বারকা নগরীর উপর হামলা ভারতের নৌবাহিনীর ইতিহাসকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ এবং শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের অসুর শক্তিকে গুঁড়িয়ে দেয় ভারতের নৌবাহিনী।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। জি নিউজ
৩। দি ওয়াল