সংস্কৃত একটি সমৃদ্ধ ভাষা। অতীতে এটি স্রোতস্বিনী নদীর মতো বহমান থাকলেও বর্তমানে এটি ক্ষীণস্রোতা৷ কালের আবর্তনে সংস্কৃত তার গৌরব হারিয়ে ফেললেও এর মহান ইতিহাস, সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বৈদগ্ধ্য উপেক্ষা করার উপায় নেই৷ কালিদাসের মেঘদূত কিংবা বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্র বর্তমান সময়েও সাহিত্যগুণে সারাবিশ্বে সমাদৃত৷ সংস্কৃত কবিদের হাতে রচিত হয়েছে অদ্ভুত ও অনন্য সব কাব্য ও শ্লোক। শব্দ, অলংকার, ছন্দ প্রভৃতির ব্যবহার করে কবিগণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।
❝দাদদো দদ্দদুদ্দাদী দাদাদো দূদদীদদোঃ।
দুদ্দাদং দদদে দুদ্দে দদাদদদদোঽদদঃ॥❞
(শিশুপালবধ– ১৯।১১৪)
আবার এই ১৯তম সর্গেই তিনি এমন অনেক শ্লোক রচনা করেছেন যেখানে প্রতিটি শ্লোকে মাত্র দুটি করে বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন–
❝ভূরিভির্ভারিভির্ভীরৈর্ভূভারৈরভিরেভিরে।
ভেরীরেভিভিরভ্রাভৈরভীরুভিরিভৈরিভাঃ॥❞
(শিশুপালবধ– ১৯।৬৬)
এই শ্লোকে শুধু 'র' ও 'ভ' বর্ণদ্বয় ব্যবহার হয়েছে৷
❝নীলেনানালনলিননিলীনোল্ললনালিনা।
ললনালালনেনালং লীলালোলেন লালিনা॥❞
(শিশুপালবধ– ১৯।৮৪)
এখানে শুধু 'ন' ও 'ল' ব্যবহার করা হয়েছে৷
এরকম আরও বহু শ্লোক রয়েছে এই সর্গেই৷ আর মজার ব্যাপার হলো এই শ্লোকগুলোতে ব্যবহৃত এরকম শব্দগুলো নিরর্থক নয়৷ প্রতিটি শব্দেরই অর্থ রয়েছে এবং শ্লোকগুলোরও সুন্দর অর্থ রয়েছে৷
আবার সংস্কৃত সাহিত্যে এমন শ্লোকও রয়েছে যার প্রতিটি পাদে (লাইনে) একই শব্দ বার বার ব্যবহার হয়েছে৷ এখানে প্রতিটি পদ সার্থক বা নিরর্থকভাবে ব্যবহার হয়েছে শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি করেছে৷ অলংকারশাস্ত্রে এই বিষয়টিকে বলা হয় যমক৷ যমকের কিছু অনন্য উদাহরণ হলো–
❝ঘনং বিদার্যার্জুনবাণপূগং সসারবাণোঽয়ুগলোচনস্য।
ঘনং বিদার্যার্জুনবাণপূগং সসার বাণোঽয়ুগলোচনস্য॥❞
(কিরাতার্জুনীয়– ১৫।৫০)
❝বিকাশং ঈয়ুর্জগতীশমার্গণা বিকাশং ঈয়ুর্জগতীশমার্গণাঃ।
বিকাশং ঈয়ুর্জগতীশমার্গণা বিকাশং ঈয়ুর্জগতীশমার্গণাঃ॥❞
(কিরাতার্জুনীয়– ১৫।৫২)
এই শ্লোক দুইটিতে প্রথম পাদে (লাইনে) যে বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, দ্বিতীয় পাদেও (লাইনেও) একই বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ অথচ এদের প্রতি পাদের অর্থের ভিন্নতা রয়েছে৷
❝বভৌ মরুৎবান্ বিকৃতঃ সমুদ্রো বভৌ মরুৎবান্ বিকৃতঃ সমুদ্রঃ।
বভৌ মরুৎবান্ বিকৃতঃ সমুদ্রো বভৌ মরুৎবান্ বিকৃতঃ সমুদ্রঃ।।❞
(ভট্টিকাব্য– ১০।১৯)
এই শ্লোকে আবার প্রতিপাদের প্রথমার্ধে ও শেষার্ধে একই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার হয়েছে৷
এ তো গেল যমক অলংকার। আবার শ্লেষ অলংকার ব্যবহার করেও অসংখ্য শ্লোক রচনা করেছেন সংস্কৃত কবিগণ৷ শ্লেষ অলংকার হলো একই শব্দের দুইটি অর্থ৷ এভাবে শ্লেষের মাধ্যমে শুধু দুই একটি করে শ্লোকই নয়, পুরো একটি কাব্য রচনা করা হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যে৷ বঙ্গভূমির কবি সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ❝রামচরিত❞ কাব্যের প্রতিটি শ্লোকে শ্লেষের মাধ্যমে একই সাথে অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্র ও পালশাসক রামপালের প্রশংসা বর্ণনা করেছেন৷ প্রতিটি শ্লোকের শুধু অন্বয় পরিবর্তন করলে ভিন্ন অর্থ পাওয়া যায়। যেমন–
❝রামেণোচিতরূপা কাপি দশাস্যোহিতা বিপদ্ঘোরা৷
স্বশিরশ্ছেদব্যতিকরমদর্শদে স্বয়ং হি দৃশ্য৷৷❞
(২।৪৭)
- শ্রীরাম অর্থে– রামকর্তৃক অত্যন্ত সুবিদিত এবং দশানন (রাবণ) কর্তৃকও বিতর্কিত কি এক (অন্যের অচিন্তিতপূর্ব) বিপদ ঘোর বা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াল। কারণ, এই (দশানন রাবণ) নিজের (একেকটি) শিরশ্ছেদরূপ বিপদ নিজ নয়ন দ্বারা স্বয়ং দেখলেন।
- রামপাল অর্থে– রামপাল কর্তৃক এই ভীমের কি এক বিপদ-বহুল অবস্থা চিন্তিত হয়েছিল। কারণ, এই (ভীম) নিজ নেত্র দ্বারা আত্মীয়গণের শিরশ্ছেদরূপ ঘটনা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
আবার আমরা বাংলায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করি, যেগুলো সামনের দিক থেকে পড়লেও যা হয়, পেছন থেকে পড়লেও তাই হয়৷ যেমন– নয়ন, নতুন, নবীন প্রভৃতি৷ এই বিষয়টিকে ইংলিশে বলা হয় Palindrome. সংস্কৃত কবিগণ শুধু শব্দেই নয়, পুরো শ্লোক রচনাতেই Palindrome ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা এমনভাবে শ্লোক রচনা করেছেন যে, শ্লোকটি শুরু থেকে (বাম থেকে ডানে) পড়লেও যে বাক্য পাওয়া যায়, আবার উল্টো দিক থেকে (ডান থাকে বামে) পড়লেও সেই একই বাক্য পাওয়া যায়৷ যেমন–
❝বারণাগগভীরা সা সারাভীগগণারবা।
কারিতারিবধা সেনা নাসেধা বারিতারিকা॥❞
(শিশুপালবধ– ১৯.৪৪)
এই শ্লোকে প্রথম পাদের শুরু থেকে (বাম থেকে ডানে) পড়লেও যে বাক্য পাওয়া যায়, শেষ থেকে (ডান থেকে বামে) পড়লেও একই বাক্য পাওয়া যায়৷ দ্বিতীয় পাদেও একই Palindrome রয়েছে৷
❝বাহনাজনি মানাসে সারাজাবনমা ততঃ।
মত্তসারগরাজেভে ভারীহাবজ্জনধ্বনি॥
নিধ্বনজ্জবহারীভা ভেজে রাগরসাত্তমঃ।
ততমানবজারাসা সেনা মানিজনাহবা॥❞
(শিশুপালবধ– ১৯।৩৩–৩৪)
আবার এখানে যে শ্লোক দুইটি ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রথম শ্লোকটি শুরু থেকে পড়ে গেলে যে বাক্য পাওয়া যায়, দ্বিতীয় শ্লোকটির শেষ থেকে শুরুর দিকে অর্থাৎ উল্টো দিকে পড়ে গেলেও একই বাক্য পাওয়া যায়! বাক্য বা শ্লোক রচনার ক্ষেত্রে এরকম নৈপুণ্য ও চাতুর্য সংস্কৃত ভিন্ন অন্য সাহিত্যে বিরল।
আবার সংস্কৃত সাহিত্যে এক প্রকার কাব্য পাওয়া যায়, যাদের 'অনুলোম-বিলোম কাব্য' বলে৷ এসব কাব্যের শ্লোকগুলোকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক ক্রমে পড়লে যে অর্থ পাওয়া যায়, শেষ থেকে শুরুর দিকে উল্টো ক্রমে পড়লে আবার ভিন্ন অর্থ পাওয়া যায়৷ ❝রাঘবযাদবীয়❞ নামের একটি কাব্যে প্রতিটি শ্লোককে স্বাভাবিক (অনুলোম) ক্রমে পড়লে রাঘব অর্থাৎ রামের বর্ণনা পাওয়া যায়, আবার যদি উল্টো (বিলোম) ক্রমে পড়া হয় তবে যাদব অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা পাওয়া যাবে! এভাবে অনুলোম-বিলোম ক্রমে কাব্যটিতে ৩০টি শ্লোক রয়েছে৷ যেমন উক্ত কাব্যের প্রথম শ্লোকটি হলো–
❝বন্দেঽহং দেবং তং শ্রীতং রন্তারং কালং ভাসা যঃ।
রামো রামাধীরাপ্যাগো লীলামারায়োধ্যে বাসে॥❞
শ্লোকটির স্বাভাবিক ক্রমে অর্থাৎ অনুলোম ক্রমে অর্থ হলো– আমি সেই ভগবান শ্রীরামের চরণে প্রণাম করি যার হৃদয়ে সীতা অবস্থান করবন তথা যিনি নিজের পত্নী সীতার জন্য সমুদ্র-পাহাড় অতিক্রম করে লঙ্কা গিয়ে রাবণ বধ করেছেন তথা বনবাস পূর্ণ করে অয়োধ্যা ফিরে এসেছেন।
এবার শ্লোকটিকে উল্টো ক্রমে অর্থাৎ বিলোম ক্রমে পাঠ করলে পাওয়া যায়–
❝সেবাধ্যেয়ো রামালালী গোপ্যারাধী ভারামোরাঃ।
যস্সাভালঙ্কারং তারং তং শ্রীতং বন্দেঽহং দেবম্॥❞
বিলোম ক্রমে এর অর্থ– আমি রূক্মিণী তথা গোপিদের পূজ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণাম করি যিনি সদাই মা লক্ষ্মীর সাথে বিরাজমান তথা যাঁর শোভা সমস্ত রত্নের শোভাকে হরণ করে নেয়।
এভাবে শ্লোকে একই বর্ণের ও শব্দের পুনরাবৃত্তি, শ্লেষ ও যমক অলংকারের ব্যবহার, পেলিনড্রমিক বা অনুলোম-বিলোমের ব্যবহার সংস্কৃত সাহিত্যেকে অন্য সাহিত্য হতে অনন্য করে তুলেছে।