দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা কিভাবে সম্ভব ?

সত্যান্বেষী
0


কমলঃ দাদা ! বলো, ঈশ্বর যদি নিরাকার হন, তাঁকে মনে করব কেমন করে?
 
বিমলঃ আচ্ছা, শোনো । ‘মনে করা’—তাই না? মনে রেখো, ‘মনে করা’ দুই প্রকারের ।
 
◼️ প্রথমতঃ—জগতের প্রাণী ও জগতের পদার্থকে মনে করা।
◼️দ্বিতীয়তঃ- সর্বব্যাপক, সর্বনিয়ন্তা, ইন্দ্রিয়াতীত পরম প্রভু পরমাত্মাকে মনে করা।
জগতের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বস্তু সমূহকে মনে করা যায়, তাদের দর্শন করে, অথবা তাদের বিয়োগ হলে । যথা—এক বন্ধুকে আমি কলকাতায় দেখলাম, তার সঙ্গে পরিচয় হলো । ছ'বছর পর আবার আমি তাকে বোম্বাই নগরে দেখলাম । এবার আমার মনে হলো একে তো আমি কলকাতায় দেখেছিলাম । এবার শোনো বিয়োগ হলে কেমন করে মনে করা যায় — যেমন নাকি, – আমার এক বন্ধু, তার সঙ্গে আমার গভীর ভালোবাসা । একদিন সে বেড়াতে চলে গেল । এবার তার কথা বার বার মনে হতে লাগল না জানি এখন সে কোথায় আছে । যত সময় আমরা পরস্পরকে দর্শন করি, তত সময় মনে করার কোনো প্রশ্নই আসে না । কেননা, যে বস্তু চোখের সামনে আছে, তার সম্বন্ধে মনে করা আবার কি? যখন পরস্পর বিযুক্ত হলাম, তখন তার কথা মনে জাগল এ হলো জাগতিক বস্তু সমূহকে মনে করা । ঈশ্বরকে মনে করা এ হতে সম্পূর্ণ পৃথক্ ব্যাপার । ঈশ্বরকে মনে করা বা ঈশ্বরের ধ্যান করা, মানে — মনকে নির্বিষয় করা । ‘মনে করা’ অর্থাৎ মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহে ছড়ানো আত্মিক শক্তিকে আত্মায় একত্র করা । যত সময় মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহ জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তত সময় আত্মা ঈশ্বরের ধ্যান বা ঈশ্বরকে মনে করতে পারবে না । ঈশ্বরের ধ্যান করার জন্যে মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহকে নিরন্তর অভ্যাস দ্বারা বিষয়ের প্রতি ধাবিত হতে না দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।
মনে রাখতে হবে যে, যোগের অষ্ট অঙ্গের মধ্যে ধ্যান হলো সপ্তম অঙ্গ । যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা এই ছয়টি অঙ্গের পরিপালন করা সর্বপ্রথম আবশ্যক, তারপর সাধক ধ্যানের অধিকারী হয়। নিয়মানুসারে যোগের ছয়টি অঙ্গের পরিপালন বা অনুশীলন হওয়ার পর ধ্যান স্বাভাবিক ভাবেই হতে থাকে । যখন যোগের ছয় অঙ্গের পর ধ্যানের স্থান, সে অবস্থায় মূর্তির দ্বারা আরম্ভেই কেমন করে ধ্যান হবে?
কমলঃ দাদা! মন যে বড় চঞ্চল,—ছট্‌ফটে । নিরাকারে সে কেমন করে যুক্ত হবে বুঝতে পারছি না? মনকে অভীষ্ট স্থানে যুক্ত করতে হলে সাকার পদার্থের সাহায্য ছাড়া কেমন করে তা সম্ভব হবে? মন নিবিষ্ট করার জন্য সাকার পদার্থ একান্ত আবশ্যক । সাকার পদার্থ ছাড়া মনে স্থিরতা আসতেই পারে না ।
বিমলঃ স্নেহের ভাইটি ! তুমি বড় সরল । আরে মন যে নিরাকারেই স্থির হয় একথা জানোনা? সাকারে যে স্থির হতেই পারবে না । কেননা, সাকার পদার্থ যে, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ বিষয় যুক্ত তাই মন ঐ সব বিষয়ে আবদ্ধ হয়ে নিজের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে । যদি সাকার পদার্থে মন স্থির হতো, তাহলে জগৎটাই তো আকার যুক্ত, অর্থাৎ সাকার । যেহেতু জগৎটা সাকার, অতএব সকলের মন জগতে স্থির হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু তা তো হয় না । জাগতিক বস্তুতে যতই মন প্রবেশ করেছে, ততই তার মনে চঞ্চলতা অধিকতর হচ্ছে । যদি আরও একটু গভীরভাবে বিচার করো তাহলে বুঝতে পারবে যে, মন কখনও স্থির হয় না, মন স্থির হওয়া মানেই মরণ । মন অথবা হৃদয়ের গতি রুদ্ধ হওয়াই মরণ । মন কোথাও স্থির হচ্ছে না — মানে, মানুষ মরে নাই । বাস্তবিক পক্ষে মনের বাহ্য বৃত্তি সমূহের অন্তর্মুখী হওয়াকেই মানসিক স্থিরতা বলে । মানুষ যত সময় বেঁচে থাকবে তত সময় তার মন গতিশীল থাকবে ।
কমলঃ তাহলে, তুমি বলতে চাও যে, যারা মূর্তিপূজা দ্বারা ঈশ্বরের ধ্যান করে তারা সব ভুল করে । আমার বিবেচনায় মূর্তি দ্বারা মনের চাঞ্চল্য দূর হতে পারে । এই জন্যই তো মানুষ শ্রীরাম, কৃষ্ণ, দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেব দেবীর মূর্তি পূজা করে থাকে।
বিমলঃ মূর্তি পূজা দ্বারা ঈশ্বরের ধ্যান কোনো কালেও হতে পারে না । আমি প্রথমেই বলেছি যে, ধ্যান মানে মনকে বিষয় শূন্য করা অর্থাৎ মনের ঝুলিতে কোনো জিনিষটি থাকবে না, মনের ঝুলিটিকে একেবারে খালি করে রাখতে হবে ।
একটু ভেবেই দ্যাখো, মূর্তিতে কী আছে? মূর্তিতে পঞ্চ বিষয় বিদ্যমান । মোটামুটিভাবে বিচার করলে দেখবে মূর্তিতে‘রূপ’ আছেই । ফল, সন্দেশ, দুধ, জল যা সমর্পণ করা হয় তাতে ‘রস’ আছে । মূর্তি পূজায় যে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হয় সেই ফুলে ‘গন্ধ’ আছে । পূজার সময়, কাঁসর, শঙ্খ, ঘন্টা বাজান হয় তাতে ‘শব্দ’ আছে । বিষয় রূপ মূর্তিটাই পঞ্চতত্ত্বের দ্বারা নির্মিত সেই পঞ্চতত্ত্ব নির্মিত মূর্তিতে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ আছে । এই অবস্থায় মনের চঞ্চলতা মূর্তির দ্বারা কেমন করে দূরে হতে পারে?
যদি মূর্তি দ্বারা মনের চাঞ্চল্য দূর হতো তাহলে মূর্তিপূজক, শ্রীকৃষ্ণকে যে ভগবান বলে থাকে সেই সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ধনুর্ধর অর্জুনের সামনে কেনো, অতি নিকটে থেকেও, তার মনের চঞ্চলতা দূর হয় নি কেনো? তার মনে চঞ্চলতা যেমন তেমনই ছিল, আদৌ দূর হয়নি । অর্জুনের মনের চঞ্চলতা দূর হলে কি শ্রীকৃষ্ণকে সে প্রশ্ন করত?
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।। গীতা ৬/৩৪ ।।
অর্থাৎ - হে কৃষ্ণ মন যে বড়ই চঞ্চল, বড় শক্তিধর, হঠকারী, একে স্ববশে আনা, বায়ুকে গাঁঠরী বাঁধার মত দুষ্কর, বড়ই কঠিন ।
একথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বলেছিলেন—
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।। গীতা ৬/৩৫ ।।
অর্থাৎ - হে অর্জুন । মন যে বড় চঞ্চল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, মনকে নিগ্রহ করা দুষ্কর তা আমি জানি, কিন্তু মনে রেখো, এই প্রবল ও দুর্নিগ্রহ চঞ্চল মনকে অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা বশে আনা যায় — অর্থাৎ বশে আনা অসম্ভব নয় ।
বাস্তব শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সামনে মূর্তিমান থেকেও অর্জুনের মন স্থির হলো না, সে সময় তো তাঁকে দিনরাত সে প্রত্যক্ষ করছিল কিন্তু মানুষ আজ তার জড়মূর্তি সামনে রেখে চঞ্চল মনকে স্থির করার দুঃসাহস দেখায় । এতে কি কখনও মন স্থির হতে পারে ?
কমলঃ তাহলে মূর্তিপূজা করাই উচিত নয় বুঝি?
বিমলঃ হ্যাঁ, মূর্তি পূজা করতে হবে বৈকি তবে, সে মূর্তির পূজা কেমন জানো? জড় মূর্তির পূজা জড়ের মতো, আর চেতন মূর্তির পূজা চেতনের মত কর উচিত ।
কমলঃ জড়মূর্তির পূজা জড়ের মতো, আর চেতন মূর্তির পূজা চেতনের মতো করা উচিত, এ কথার রহস্য বুঝলাম না। একটু পরিষ্কার করে বললে বুঝতে পারি ।
বিমলঃ ‘পূজা’ শব্দের ধাতুগত এবং ব্যবহারিক প্রভৃতি কয়েক প্রকারের অর্থ হয় । ‘পূজা’ অর্থাৎ আদর, যত্ন করা, যাকে সংস্কৃতে — সৎকার বলা হয়। কোনো বস্তুর যথাযথ ব্যবহার, কোনো বস্তুর যথাযথভাবে রক্ষা, কাহাকেও যথাযথ দান দেওয়াকেও পূজা বলে । এবার একটু বিচার-বিবেচনা করে জড়মূর্তি পূজার অর্থ চিন্তা কর । জড়মূর্তি পূজা মানে, সেই জড়মূর্তিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা । মূর্তিটিকে এমন স্থানে স্থাপন করবে, যেথায় সেই মূর্তিটির কোন প্রকার ক্ষতি না হয় অর্থাৎ যেন ভেঙে না যায়, ময়লা না হয়, তার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট না হয়, অবহেলিত হয়ে না থাকে এখানে মূর্তি পূজা অর্থাৎ জড়মূর্তির যথাযথ উপযোগ, উচিত রক্ষণাবেণ। পূজা মানে এ নয় যে, প্রত্যেক বস্তুর সামনে ঢিপ্‌-টিপ্ করে মাথা ঠুকে তাতে ফুল বেলপাতা, তুলসীপাতা, ফল-মিষ্টি-নৈবদ্য অর্পণ করা । যেমন নাকি, একজন আর একজনকে বলল—আরে ভাই ! এই সাধুজীর ‘পেট পূজা’ করিয়ে দাও । এর মানে কী? না, সাধুকে খাইয়ে দাও । ওর মানে এ নয় যে, সাধুর পেটের উপর এক গুচ্ছ বেলপাতা, ফুল-ফুল, মিষ্টি রেখে তাকে প্রণাম কর । ঠিক্ এমনি— একজন আর একজনকে বলল—এই যে গুণ্ডাকে দেখছ, কেবল বাজে বকেই যাচ্ছে, যা তা বলছে, পিঠ পুজো করে দাও, তবে এ শান্ত হবে— নইলে হবে না । এর মানে—এর পিঠে আচ্ছা করে কয়েক ডাণ্ডা কষে দাও । পিঠ পূজার অর্থ এ হবেনা যে, কিছু বেলপাতা, ফুল, ফল পিঠের ওপর রেখে প্রণাম কর । দেখলে একস্থানে পূজার অর্থ হল খাওয়ান, আর একস্থানে অর্থ হল মার দেওয়া । ঠিক্ এমনি জড়মূর্তি পূজার অর্থ—মূর্তিকে যথাস্থানে সুরক্ষিত রাখা, যেন তার চাক্‌চিক্য নষ্ট না হয় — ময়লা না হয় । জড়মূর্তির ওপর ফুল-ফল অর্পণ, এবং তার সামনে মাথা ঠুকে প্রণাম করার অর্থ মূর্তি পূজা নয় কেননা, মূর্তিতে সে যোগ্যতা নেই যে, সে তোমার ভক্তি শ্রদ্ধা, অনুভব করবে এবং সে ফল-ফুল-মন্ডামিঠাই খাবে ।
যত সজীব বা চেতন মূর্তি এ জগতে আছে— যথা মাতা, পিতা, গুরু, অতিথি, সন্ন্যাসী, উপদেশক তথা অন্যপ্রাণী, এরা সবাই ফল-ফুল-মন্ডা-মিঠাই পেয়ে লাভবান হয় । ফল-ফুল, মন্ডা, মিঠাই প্রভৃতি দ্বারা বিবিধ প্রকারে তাদের পূজা করা উচিত । এখানে ‘পূজা’ অর্থ আদর যত্ন করা -সংস্কৃতে যাকে সৎকার বলে । এর নাম সজীব মূর্তি পূজা ।
কমলঃ ঈশ্বর যদি সর্বত্র বিদ্যমান থাকেন, তিনি মূর্তিতেই বা থাকবেন না কেনো? যদি মূর্তিতে ঈশ্বর থাকেন, তাহলে মূর্তি পূজা করায় দোষ কোথায়? যারা মূর্তি পূজা করে তারা মাটি বা পাথরের পূজা করে না, ব্যাপক পরমাত্মারই পূজা করে ।
বিমলঃ একথা সত্য যে, ঈশ্বর সর্বত্র বিদ্যমান বলে, তিনি মূর্তিতেও ব্যাপক । কিন্তু তিনি সর্বত্র আছেন বলে সব স্থানে সর্ববস্তুতে তাঁর পূজা হয়, এর মূলে কোনো যুক্তি নেই! দ্যাখো, পূজা যে করে সে ‘জীবাত্মা’ পূজার উদ্দেশ্য কী? জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন । কেমন? মিলন—কখন হয় —যখন উভয়ে উপস্থিতি থাকে । মূর্তিতে ঈশ্বর আছেন সত্য, কিন্তু সেখানে ‘জীবাত্মা’ নেই। এ অবস্থায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন হবে কেমন করে । হ্যাঁ, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জীবাত্মা এবং পরমাত্মা উভয়েই বর্তমান, তাই সেখানেই উভয়ের মিলন সম্ভব । অতএব যে মানুষটি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে চায়, তাকে আপন হৃদয়েই মন এবং ইন্দ্রিয়কে স্ব-অধীন করে ঈশ্বরের পূজা করা কর্তব্য ।
দ্যাখো ! ঈশ্বর সর্বত্র, এ কথা জেনেও কি সব জল পানের যোগ্য ? সিংহ এবং সাপ উভয়েই পরমাত্মায় ব্যাপক, এ অবস্থায় আমি জিজ্ঞাসা করি, সিংহ ও সাপের কাছে যাওয়া কি উচিত? অতএব, পরমাত্মা মূর্তিতেও ব্যাপক আছেন সুতরাং মূর্তির পূজা করা উচিত, একথা বলার মত অজ্ঞানতা ও মূর্খতা আর কী হতে পারে? পরমাত্মা মিছরীর টুকরোতেও আছেন, বিষেও আছেন, তাই বলে কী বিষ খাওয়া উচিত? কদাপি নয় সেই জিনিষই খাওয়া উচিত যা খাওয়ার যোগ্য । মূর্তি পূজক মনে করবে যে, সে মূর্তিতে ব্যাপক পরমাত্মার পূজা করছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে মূর্তির দ্বারা ব্যাপক ঈশ্বরের পূজা হয় না । হয়ত তুমি বলবে, কেনো হবেনা? কেনো হবে না, তাই বলছি । যে সমস্ত বস্তু মূর্তির ওপর দেওয়া হয় যথা— বেলপাতা, ফুল, চাল, কলা, গামছা, কাপড় ইত্যাদি, তাতেও তো পরমাত্মা ব্যাপক আছেন । যথা—আকাশ ঘটেও ব্যাপক এবং ইটেও ব্যাপক এই অবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তি ঘটে আকাশ ব্যাপক এই মনে করে ইটটা তুলে ঘটাকাশে ছুঁড়ে মারে, তাহলে সে ভুল করবে । কেননা, আকাশ ব্যাপক হওয়ায় আকাশের গায়ে ইঁট লাগতে পারে না, ইঁট তুলে যদি ঘটে আঘাত করা যায় তাহলে ঘট ভেঙে যাবে, কিন্তু আকাশ ভাঙবে না । কেননা আকাশ যে, সে ইটেও ব্যাপক ঠিক তেমনি, যে কোনো ব্যক্তি যদি সে পত্র-পুষ্প, ফল-জল, মিষ্টি আদি মূর্তির সামনে বা মূর্তির উপর, অর্পণ করে তা মূর্তিতেই অর্পিত হয়, ঈশ্বরে নয় । কেননা, ঈশ্বর যে ঐ সব পদার্থেও ব্যাপক।
কমলঃ মূর্তির উপর বা সামনে ফল, ফুল প্রভৃতি না হয় অর্পণ নাই বা করলাম, কিন্তু সেই মূর্তিকে শ্রদ্ধা সহকারে দর্শন করলে ব্যাপক পরমাত্মা এবং তাঁর মহিমার জ্ঞান অবশ্যই হবে।
বিমলঃ এও উল্টো কথা বলছো । একটু ভেবে দ্যাখো, দর্শনে ব্যাপক পরমাত্মার এবং তাঁর মহিমার জ্ঞান কেমন করে হবে? শোনো। তিলে, তেল ব্যাপক আছে,—কেমন? কিন্তু, যে তিলকে দ্যাখে, সে দ্যাখে তিলকে, তিলে তেল দ্যাখে কী? সে তো তিলই দেখবে, তাই তো? সে যতই শ্রদ্ধা এবং মনযোগ সহকারে তিলকে দর্শন করুক না কেনো, সে তিলই দেখবে, তিলে তেল দেখতে পারবে না । তেল দেখবে কখন, যখন সেই তিলকে ঘানিতে ফেলে পেষণ করা হবে,—তখন । এইভাবে মূর্তিতে ঈশ্বর ব্যাপক আছেন, সত্য, কিন্তু দর্শক সেই মূতিকে দর্শন করে মাত্র ঈশ্বরকে সে দর্শন করে না । ঈশ্বর দর্শন তখনই সম্ভব, যখন দর্শক জড়মূর্তির সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছেদ করে আত্মায় সেই ব্যাপক পরমাত্মার সন্ধান করবে । বাকী রইল ঈশ্বরের মহিমা জ্ঞান । সেও তো মানুষের গড়া মূর্তিতে ঈশ্বরের মহিমা দর্শন? তাই বা কেমন করে হবে? মানুষের গড়া মূর্তিতে শিল্পীর মহিমাই প্রকাশ পায় । মূর্তি-দর্শক বলবে— “বাঃ, বলাই পাল কী ঠাকুরই না গড়েছে, যেন কথা কইছে, কী অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য।” এ কার মহিমা? এ সেই মূর্তি রচয়িতার মহিমা, ঈশ্বরের নয় । হ্যাঁ, পরমাত্মা যা নিমার্ণ করেছেন তাতে পরমাত্মার মহিমা দর্শন করতে পারবে, দেখতেও পাবে। তুমি পরমাত্মার মহানতা দর্শন করতে চাও তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রচনা বিচার বিবেচনা করে সন্ধান কর, দেখবে ঈশ্বরের রচিত ক্ষুদ্রাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম বস্তুতে কী অপূর্ব সৃষ্টি কৌশল! মানুষের তৈরী জড় মূর্তিতে পরমাত্মার মহিমার কোন চিহ্নটা রয়েছে যে, তুমি তা দেখতে পাবে?
কমলঃ দাদা ! ফল সদাসর্বদা ভাবনাময়ই হয়ে থাকে । মূর্তিকে ঈশ্বর না মেনেও আমরা তাতে ঈশ্বরের ভাবনা আরোপ করে ফল লাভ করতে পারি। দ্বিতীয় কথা, যদি কোনো লোক এক লাফে খুব উঁচুতে উঠতে না পারে, তার জন্য মই বা সিড়ি প্রয়োজন। আমি মূর্তি পূজাকে ঈশ্বর প্রাপ্তির প্রথম সিঁড়ি বলেই মনে করি । অতএব যদি কোন লোক ভগবানের কল্পিত মূর্তি তৈরী করে, তাতে ঈশ্বরের ভাবনা আরোপ করে পূজা করে, আমি তাতে কোনো দোষ দেখি না ।
বিমলঃ তোমার মনে রাখা উচিত যে, ভাবনা কোনো পদার্থের বাস্তবিকর্তাকে অর্থাৎ সত্যকে পরিবর্তন করতে পারে না। কোনো মানুষ যদি অজ্ঞানতা বশতঃ চুনের জলে দুধের ভাবনা আরোপ করে তাকে মন্থন করে, তা বলে তুমি কি বলতে পারো, তা থেকে সে মাখন পাবে? জলে অগ্নির ভাবনা করে শীতার্ত ব্যক্তি কি শীত দূর করতে পারবে? পাথরে রুটির ভাবনা করে কি মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারবে? ভাবনা বা মনে করলেই যদি প্রত্যেক জিনিষ পাওয়া যেতো, তাহলে জগতে কেহই দুঃখী ও নির্ধন থাকত না । আর কাহাকেও কোনো বস্তুলাভ করার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রমও করতে হতে না । সেই ভাবনাই বাস্তবিক ভাবনা, যার আধার সত্য, নইলে সে অভাবনা । কোনো মানুষ যদি জোলাপের গুলিকে হজমীর গুলি মনে করে তা খায়, তার কি পেট খারাপ হবে না? তাই বলছিলাম — কোনো বস্তুতে ভাবনা আরোপ করে সেই বস্তু লাভ করার আশা নিরেট বোকামী ।
দ্যাখো, সোমনাথের মন্দিরের মূর্তিতে পূজারীদের জড় ভাবনা ছিল না, সোমনাথ যে সাক্ষাৎ মহাদেব । যখন মহমুদ গজনবী সোমনাথ মন্দিরের উপর আত্রমণ চালাল, তখন পাণ্ডা এবং পূজারীর দল নিশ্চিন্ত মনে, নিশ্চেষ্ট হয়ে বসেছিল । তারা বলতে লাগল—সকলে মিলে সোমনাথের জপ কর, তিনি নিজেই ম্লেচ্ছকুল নাশ করবেন, আমাদের লড়াই করার কোনো প্রয়োজনই নেই। এই ভাবনা এবং বিশ্বাসের পরিণাম কী হয়েছিল? ইতিহাস পাঠকদের জিজ্ঞাসা করো। তারা বলবে এর পরিণাম কী হয়েছিলো । এর পরিণামের কথা সকলে ভাল করে জানে ।
শুধু সোমনাথই বা কেনো? এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে সহস্র মন্দির ও মূর্তি গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল । লুণ্ঠনকারীদল কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুটে নিয়ে বিদেশে চলে গেল এ সব দেখে শুনেও মূর্তি পূজকদের অন্ধ বিশ্বাস ঘুচলো না । কী আশ্চর্যের কথা! নির্জীব— অচেতন জড় মূর্তি, যে কিছুই করতে পারে না, মানুষ কিনা সেই জড় মূর্তিতে সৃজন ক্ষমতার ভাবনা আরোপ করল! কী ভয়াবহ অন্ধবিশ্বাস? আর যারা চেতন, যারা সব কিছু করতে সক্ষম তাদের উপর কিনা, না করতে পারার ভাবনা আরোপ করল! আমাদের দেশের এবং জাতির অধঃপতনের মূল কারণই এই । এবার তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ অজ্ঞানতাপূর্ণ ভাবনা আরোপ কত ভয়াবহ ও দুঃখ-জনক হতে পারে ।
তুমি যে বলছো মূর্তি পূজা ঈশ্বর প্রাপ্তির প্রথম সোপান বা সিঁড়ি - এ একেবারে ডাহা মিথ্যা। হ্যাঁ, চেতন মূর্তির পূজা ঈশ্বর প্রাপ্তির প্রথম সোপান কিছু অংশে স্বীকার করা যেতে পারে । কিন্তু জড় মূর্তির পূজা তো কোনো মতেই স্বীকার করা যেতে পারে না । জড় মূর্তি পূজাকে হিমালয় পাহাড়ের ওপর আরোহণ করার প্রথম সোপান যদিও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যে মূর্তি জ্ঞানশূন্য, তাকে ঈশ্বর প্রাপ্তির প্রথম সোপান কেমন করে মেনে নেওয়া যেতে পারে?
যদি কেহ ইংরেজী ভাষায় কথা বলা শিক্ষা করতে চায়, তাহলে তার ইংরাজী ভাষা শিক্ষার প্রথম সোপান হবে, এ, বি, সি, ডি প্রভৃতি বর্ণ । যদি কেহ সংস্কৃত বা হিন্দী ভাষায় কথা বলা শিক্ষা করতে চায়, তাহলে তাকে সংস্কৃত বা হিন্দি শিক্ষার প্রথম সোপান শিক্ষা করতে হবে অ, আ, ই, ঈ প্রভৃতি বর্ণমালা । কিন্তু যদি কেহ এ, বী, সী, ডী প্রভৃতি বর্ণকে সংস্কৃত শিক্ষার প্রথম সোপান মনে করে এ, বী, সী, ডী পড়তে আরম্ভ করে তা হলে কি সে সংস্কৃত শিক্ষা করতে পারবে? যার সিঁড়ি যা, তা দিয়েই কৃতকার্যতা লাভ করা যেতে পারে । ঈশ্বর প্রাপ্তির সিঁড়ি বা সোপান হলো চেতন প্রাণীর নিষ্কাম সেবা, সৎসঙ্গ, যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি । এইসব সিঁড়ির উপর নিরন্তর আরোহণ অর্থাৎ এদের বিধিপূর্বক অনুষ্ঠান দ্বারাই ঈশ্বর প্রাপ্তি হতে পারে । তুমি যে প্রশ্ন করলে— ঈশ্বরের কাল্পনিক মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করার দোষ কোথায়? দোষ একটা নয়–বহু ।
◼️ প্রথম দোষ - নকল বস্তুতে আসল বস্তুর গুণ আছে মনে করে মানুষ নিজে নিজেকে প্রতারণা করবে । পশু, পাখী, পোকামাকড়ও ভালভাবে জানে যে, কোনো মেকীবস্তু আসল হয়ে কাজে লাগবে না। বিড়ালের সামনে মাটি বা রবারের ইঁদুর রেখে দিয়ে দেখো, সে কখনও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরতে যাবে না । মৌমাছির সামনে কাগজের ফুল রেখে দিয়ে দেখো, সে ভুলেও আসল ফুল মনে করে তাতে মধু খাওয়ার জন্য বসবে না। এইভাবে অন্য প্রাণীরাও মেকি বস্তুর সঙ্গে প্রেম করে না, করবে না। কিন্তু মানুষ, যে প্রাণী জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবীদার তারাই মেকি বস্তুর কাছ থেকে যথেষ্ট ফল পাবার আশা করে এবং তাতে আসক্ত হয় । হায়! এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে?
◼️ দ্বিতীয় দোষ — ঈশ্বরের কাল্পনিক মূর্তি পূজক ঈশ্বরকে নিজের মতই ভাবে । নিজের প্রয়োজনীয় বস্তুর মতো তারও প্রয়োজন আছে মনে করে। যথাঃ—মানুষ যেমন নিজের জন্য ভোজনের প্রয়োজন অনুভব করে, ঠিক্ তেমনি সেও ঈশ্বরের ভোজনের প্রয়োজন আছে মনে করে থালায় নৈবেদ্য ও ভোগ সাজিয়ে দেয় । যেমন সে নিজে কাপড় পরে। তেমনি সে কল্পিত ঈশ্বরের মূর্তিকেও কাপড় পরায়, সে যেমন নিজে স্নান করে, তেমনি সেই কল্পিত ঈশ্বরের মূর্তিকে জল দিয়ে স্নান করায় । সে যেমন নিজে ঘুমায় এবং জাগে, তেমনি সে তার কল্পিত ঈশ্বরের মূর্তিকেও ঘুম পাড়ায় এবং জাগায় । সে যেমন নিজে অলংকার ধারণ করে, তেমনি সে কল্পিত ঈশ্বরের মূর্তিকেও অলংকার ধারণ করায় । মানুষ যখন ঈশ্বরেও নিজের মতো অভাব ও প্রয়োজন অনুভব করে, সেই অবস্থায় অভাবগ্রস্ত ঈশ্বরের কাছে কোনো কল্যাণের আশা করা যেতে পারে কিনা সে বিচার তুমিই কর । যে ঈশ্বর নিজেই অভাবগ্রস্ত সে অন্যের অভাব মোচন করবে কেমন করে? তুমিই বলো— একজন অন্ধ অপর অন্ধকে পথ দেখাবে কেমন করে? অন্ধ কি অপর অন্ধকে পথ দেখাতে পারে?
◼️ তৃতীয় দোষ—ঈশ্বর এক, আর তাঁর মূর্তি অনেক । কেননা, যতগুলি সম্প্রদায় তারা তাদের আপন আপন বিশ্বাস মতে ততগুলি মূর্তি গড়ে থাকে। পরিণাম পরস্পর রাগ-দ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ থেকেই যায়। ঝগড়া-বিবাদ জাতীয় সংগঠনের পক্ষে মহান ক্ষতিকর এরূপ আরও অনেক দোষ দেখান যেতে পারে।
কমলঃ তোমার বলার উদ্দেশ্য - মূর্তি তৈরী করাও উচিত নয় আর মূর্তির পূজা করাও উচিত নয় । আমার মনে হয়, অবশ্য আমি যতদূর বুঝি— শান্ত-রাগ-রাগিণীময় গীত মহাপুরুষদের চিত্র এবং মূর্তি দর্শনে মনে শান্তি আসে আর ভক্তের চিত্তে তার বেশ ভাল প্রভাবও পড়ে
বিমলঃ আমার বলার উদ্দেশ্য মোটেই এ নয় যে, কারো মূর্তি গড়বে না, কারো ফটো বা ছবি তৈরী করবে না। আমি চিরদিনই বলে আসছি—মূর্তি গড়া প্রয়োজন । বিশ্বের মহাপুরুষদের মূর্তি অথবা চিত্র তৈরী করলে তাঁদের স্মৃতি রক্ষা করা হয় কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চেতন মানুষের মতো তাদের পূজাও করা উচিত । অথবা তাঁদের সকলকে পরমাত্মা বা পরমাত্মার প্রতিনিধি বোধে তাঁদের কাছে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষলাভের আশায় প্রার্থনা করা উচিত । প্রাণহীন বস্তু চিরদিনই প্রাণহীন তার মধ্যে জীবিত মানুষের বা সর্বব্যাপক ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কর্ম করার যোগ্যতা কোথায়? যে পিতা জীবিত অবস্থায় সন্তানকে স্নেহ করতে সক্ষম, মৃত্যুর পর সে কি সন্তানকে স্নেহ করতে পারে? যে শরীরে পিতা আপন সন্তানকে কোলে বসিয়ে খাইয়েছে, সেই প্রাণহীন শরীর কি সন্তানের কোনো কাজে লাগে? পিতার সেই প্রাণহীন শরীরে এবং পাথরের বা মাটির তৈরী মূর্তিতে পার্থক্য কোথায়? হ্যাঁ, সামান্য তফাৎ অবশ্যই আছে বলা যেতে পারে । পাথর বা ধাতু নির্মিত মূর্তি পচে গলে যায় না, আর প্রাণহীন শরীর পচে-গলে যায় - তাছাড়া উভয়ের একই অবস্থা । জড় দেবতার পূজার অর্থ হলো তাদের যথাযোগ্য ব্যবহার করা। যদি যথাযথভাবে তাদের ব্যবহার না করা হয়, তাহলে সেই বস্তু সমূহই মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর হতে বাধ্য । যদি বলো সে কেমন করে হয়? তো শোনো ।
একজন গঙ্গার বড় ভক্ত। সে রাতদিন তার পূজায় রত থাকে । গঙ্গায় ফুল, নৈবেদ্য অর্পণ করে, গঙ্গা লহরী স্তোত্র পাঠ করে । কিন্তু সে সাঁতার কাটা জানে না । একদিন সে গঙ্গায় নেমে পূজা করছে এমন সময় হঠাৎ সে গঙ্গার গভীর জলে তলিয়ে গেল, — গঙ্গার ভক্ত ডুবে গেল । এতদিন সে গঙ্গার কতো পূজো করেছে–আরাধনা করেছে, আর কিনা সেই গঙ্গা, তার ভক্তকে একেবারে পেটে পুরে নিল ! কই, সে যার এত স্তোত্র পাঠ করত, পুজো পাঠ করত, গঙ্গা তাকে ছাড়ল না তো? এখানে ছাড়াছাড়ি নেই সে তার যত শ্রদ্ধা-ভক্ত দিয়েই পূজা করুক না কেনো? ফুল, বেলপাতা আর যত ইচ্ছা ঘটি বা কলসী-কলসী দুধ ঢালুক না কেনো, সে যত বড় ভক্তই হোক না কেনো, সাঁতার না জানার জন্য তাকে গঙ্গার পেটে যেতেই হবে ।
আর একজন গঙ্গাকে “গঙ্গা মা” মনে না করে নদী মনে করত । সে বোধ হয় কাউকে হত্যা করেছিল । তাই তার হাত পা ছিলো রক্তে রক্তাক্ত । ধরা পড়ার ভয়ে সে সাকার গঙ্গা নদীতে দিল ঝাঁপ । সে সাঁতার জানত, আরকী ভয়? গঙ্গার বুক চিরে সাঁতার কেটে সে পার হয়ে গেল । একজন ‘গঙ্গা মায়ের’ পুজো করে ডুবে মরল, আর একজন গঙ্গাকে জড় জেনে তার যথার্থ ব্যবহার করে রক্ষা পেল এমনটা হলো কেনো জানো? একজন জলের যথাযথ ব্যবহার করা জানত, তাই সে সাঁতার কেটে পার হয়ে গেল, আর একজন জলের যথাযথ ব্যবহার জানত না, তাই গঙ্গার পূজা করেও সে ডুবে গেল । একজন বেঁচে গেল, আর একজন মরে গেল।
একদল গঙ্গা পূজক আছে তারা মনে করে শুধু গঙ্গা স্নান করলেই মুক্তি হবে । তারা প্রতি বৎসর লক্ষলক্ষ, কোটি কোটি টাকা রেল কোম্পানীকে দিয়ে থাকে। তারা টাকা দেয়, টাকা দিয়ে গাড়ীতে ধাক্কা খায়, তারপর হয়রানি, তারা মনে করে গঙ্গায় স্নান করলে— প্রণাম করলে, ফল-মূল গঙ্গায় দিলে গঙ্গার পূজা হবে । আর একদল আছে যারা গঙ্গা হতে খাল কেটে লক্ষলক্ষ বিঘে জমিতে জল দিয়ে জমিকে উর্বরা করাকে গঙ্গাপূজা মনে করে । তারা গঙ্গার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে, চাকী চালাচ্ছে । তারা কোনোও দিন পুণ্যের আশায় গঙ্গায় স্নান করে না। কিন্তু তারা গঙ্গাকে পাইপের মধ্যে দিয়ে নিজের ঘরে এনেছে, আর নানা প্রকারে তার দ্বারা লাভবান হচ্ছে । এইভাবে তারা জড় পদার্থের যথাযথ ব্যবহার দ্বারা জড়ের পূজা করে চলছে এইভাবে প্রত্যেক জড় পদার্থের বিষয়ে উদাহরণ উপস্থিত করা যেতে পারে ।
শেষে রইল, মূর্তি বা ছবি বা ফটো দেখে প্রভাব সৃষ্টির কথা । এ বিষয়ে একটু বিচার বিবেচনা করে দ্যাখো–একটু ভাবো । মনে রাখবে মূর্তি দেখলেই চিত্তে ভাল মন্দের প্রভাব পড়ে না, কিন্তু যে প্রভাবটা পড়ে সেটা আন্তরিক সংস্কারের কারণেই পড়ে থাকে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে । একজন হিন্দু সে শ্রীরাম বা কৃষ্ণের মূর্তি দর্শন করল, সেই মূর্তির সামনে মাথা নত করে প্রণাম করল জানো, সে মূর্তির সামনে মাথা নত করল কেনো? সে শ্রীরাম ও কৃষ্ণের ইতিহাস জানত। তার অন্তরে তাঁদের সম্বন্ধে সংস্কার ছিল যে, শ্রীরাম ও কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার ছিলেন, তাঁরা রাবণ ও কংসকে সংহার করেছিলেন সে পুস্তক পাঠ করেই হোক বা অন্যের কাছে শুনেই হোক্, তার মনের মধ্যে এইরূপ সংস্কার জমা হয়েছিল । তাই সে তাঁদের মূর্তি দেখে প্রভাবিত হয়েছে ।
আর যদি সেই হিন্দুর সামনে কোনো জাপানী দেবতা ‘কন্‌ফিউশিয়াস’ এর মূর্তি রেখে দেওয়া হয় তাহলে কি সেই মূর্তি দেখে তার মনে প্রভাব সৃষ্টি হবে? জাপানী দেবতাকে দেখে তার মনে শ্রদ্ধা জন্মাবে না কেননা, ‘কন্‌ফিউশিয়াস’ সম্বন্ধে তার কিছুই জানা নেই । যে ব্যক্তিটির অন্তরে‘কন্‌ফিউশিয়াস’ সম্বন্ধে কোনো সংস্কারই নেই, সেই মূর্তি দেখে তার মাথা নত হয় না।
একজন অহিন্দু সে হিন্দুর কোনো দেব-দেবীর মূর্তিকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে না। এর কারণ — সেই অহিন্দুদের মনে হিন্দুদের দেব-দেবী সম্বন্ধে কোনো সংস্কার নেই । একজন মুসলমানের কাছে এক দুর্বল তথা কুরূপ মুসলমানের ছবি ভাল, কিন্তু কোনো হিন্দুর দেব দেবীর ছবি তার কাছে ভাল নয়, কেননা, তাদের সম্বন্ধে তার মনে একটুও শ্রদ্ধা নেই । হিন্দু দেব-দেবীদের চিত্র মুসলমানদের কেনো ভাল লাগে না? তার কারণ তারা যে মোমিন বা তারা যে ইসলামের একজন সহায়ক এই সংস্কার তাদের মনে দৃঢ় হয়ে আছে। এবার তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ যে, মনে যা কিছু প্রভাব পড়ে সে তাদের আপন আপন সংস্কারের জন্য পড়ে, মূর্তি দেখে প্রভাব পড়ে না । যদি মূর্তি দেখে প্রভাব পড়ত, তাহলে প্রত্যেক মানুষের মনে মূর্তির দর্শন মাত্রই তাদের মনে প্রভাব পড়ত এবং তাদের মনে শান্তি আসত, কিন্তু তা হয় না ।
কমলঃ স্কুলে মানচিত্র দেখান হয় । ছোট্ট মানচিত্র দেখে যদি বিশাল পৃথিবীর জ্ঞান হতে পাবে, ছোট্ট ছবি বা মূর্তি দেখলে বিশাল ঈশ্বরের বা ব্রহ্মের জ্ঞান লাভ হবে না কেনো?
বিমলঃ স্নেহের ভাইটি, শোনো । মানচিত্র সাকার জগতেরই হয়ে থাকে। সেই মানচিত্র দ্বারা নদী, হ্রদ, পাহাড়-পর্বত, নগর, রাজপথ, রেল, বন, উপবন প্রভৃতির জ্ঞান করান যেতে পারে । কিন্তু যে ঈশ্বর সর্বব্যাপক এবং নিরাকার, তার মানচিত্র বা ছবি কী করে সম্ভব হবে? সম্ভব হয় না, তা দিয়ে ঈশ্বরের জ্ঞানও হয় না ।
কমলঃ অক্ষর এবং শব্দ নিরাকার, কিন্তু দ্যাখো তারও মূর্তি আছে । সেই নিরাকার শব্দের অক্ষর তৈরী করে ছেলেদের বোধ করান হয় । যদি অক্ষর এবং শব্দের আকার সৃষ্টি না হত, তাহলে ছেলেরা কেমন করে বিদ্যালাভ করতে পারত ? তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধে বলা চলে কিনা?
বিমলঃ দ্যাখো, অক্ষর এবং শব্দ চোখ দিয়ে দেখা যায় না, যায় কী? কিন্তু কান দিয়ে শোনা যায় । বোধ করার জন্য যা কানের বিষয়, মানুষ তাকে চোখের বিষয় করে ফেলেছে । আর যা কোনো ইন্দ্রিয়ের নয়, অর্থাৎ যে ইন্দ্রিয়াতীত তার বোধ করানোর জন্য কোন ইন্দ্রিয়ের বিষয় করা যাবে বল? যে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয়, তাকে কেবল অনুভব দ্বারাই জানা যেতে পারে । আর এ আবশ্যক নয় যে, নিরাকার অক্ষরের এবং শব্দের কল্পিত চিহ্ন গড়লে তবেই বিদ্যা হবে, নইলে হবে না? যদি এমনটি হতো, তাহলে অন্ধ-বিদ্বান ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যেত না । কেননা, অন্ধ তো জীবনেও অ, আ, ই, ঈ এদের রূপ দেখেনি । তারা, এ, বি, সি, ডি ও চোখে দেখেনি, চোখ নেই তো দেখবে কেমন করে? কিন্তু তুমি দেখেছ, অন্ধব্যক্তিও এম. এ./বি.এ. পাশ করেছ, শাস্ত্রী হয়েছে । তারা ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত ভাষা শিখেছে । দ্বিতীয়তঃ লিখিত এবং কল্পিত চিহ্নকে বলা হয়‘বর্ণ’ । যা মুখে উচ্চারিত হয় তাকে বলা হয়‘অক্ষর’ । অক্ষর নিরাকার, অক্ষরের কোনো রূপ নেই। যা লেখা যায় তাকে বর্ণ বলে। সেই বর্ণের আকার আছে,—বর্ণ সাকার ।
কমলঃ আচ্ছা, যদি তাই হয়, সময় তো নিরাকার কেমন? কিন্তু সময়েরও মূর্তি সাকার ঘড়ি রূপে তৈরী হয়েছে । আর আমরা নিরাকার সময়কে ঘড়ির মধ্যে সাকার রূপে দেখছি ।
বিমলঃ ঘড়ি সময়ের মূর্তি নয় । ঘড়ি সূর্যের মূর্তি । সূর্যকে দেখে যেমন সময়ের জ্ঞান হয়, তেমনি ঘড়ি দেখে সময়ের জ্ঞান হয় । ঘড়ির যাবতীয় ক্রম সূর্যের উপর নির্ভর করে ।
কমলঃ নিরাকার ধ্যান যদি করতেই হয় তা করব কেমন করে? যদি চোখের সামনে কোনো মূর্তি থাকে তবেই তো তার ধ্যান সম্ভব হয় । নিরাকারের ধ্যান করতে চোখ বন্ধ করলাম, আর কোনো কিছুই দেখতে পেলাম না - এ অবস্থায় মন বসবে কেমন কেরে?
বিমলঃ শোনো, জগৎ দুই প্রকারের, আধ্যাত্মিক আর ভৌতিক। আধ্যাত্মিক জগৎ — অর্থাৎ আত্মা সম্বন্ধীয় বা আত্মা সম্পৰ্কীয় জগৎ। ভৌতিক জগৎ অর্থাৎ — পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ এই পঞ্চভূত সম্বন্ধীয় বা পঞ্চভূত সম্পৰ্কীয় জগৎ । মনে রাখতে হবে পরমাত্মা সম্পর্কীয় চিন্তন আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত । যখন তুমি ধ্যান করতে বসেছ, তখন তোমার মাথার মধ্যে মূর্তির আকৃতি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে । এ অবস্থায়, আধাত্মিক অর্থাৎ পরমাত্মা সম্পর্কীয় চিন্তন হলো কী করে? সে চিন্তন তো ভৌতিক অর্থাৎ পঞ্চভূত সম্পর্কীয় চিন্তন । কেননা, মূর্তি পঞ্চভূতের দ্বারা নির্মিত। আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভ তখনই সম্ভব যখন জগতের সমস্ত মূর্তিমান বস্তুর ভাবনা-চিন্তা ত্যাগ করে আত্মাতেই পরমাত্মার ব্যাপকতার অনুভব করতে পারবে । পরমাত্মায় এবং আত্মায় দেশকালের দূরত্ব বা ব্যবধান নেই আছে কেবল জ্ঞানের ব্যবধান । অজ্ঞানতার আবরণ দূর হলেই পরমাত্মার অনুভূতি হতে থাকবে।
বাকী রইল মন বসার কথা । মনকে বসালে সে বসে, না বসালে সে কেমন করে বসবে? জগতে অভ্যাসের দ্বারাই সমস্ত কর্ম সিদ্ধ হয়। এমন অনেক মেয়ে মানুষ আছে, যারা মাথায় পর পর দুটো তিনটে কলস রেখে কোমরে ছেলে নিয়ে, পরস্পর গল্পগুজব করতে করতে উঁচু-নীচু পথের উপর দিয়ে চলে, সাধ্য কী যে মাথার কলসী থেকে এক ফোঁটা জল মাটিতে পড়ে ! পথে ঘাটে যারা বাঁশবাজীর খেলা দেখায়, তারা মাথার উপর পর-পর কয়েকটা কলস, আর দুই কাঁধে দু-দুটো ছেলে নিয়ে লম্বা বাঁশের উপর সর-সর করে উঠে যায় । সার্কাসে মেয়েরা তারের উপর সাইকেল চালায় এসব তো অভ্যাসের পরিণাম ।
রোগা-পটকা মানুষ ভোর চারটের সময় উঠে শীতের দিনে গঙ্গা বা যমুনায় স্নান করতে চলেছে, আর ঠিক সেই সময় মোটা মোটা, তাগড়া-তাগড়া মানুষ লেপের ভিতর থেকে মুখ বার করতে ভয় পায় কেনো? যারা ভোরে স্নান করার অভ্যাস করেছে, তাদের পক্ষে শীত-গ্রীষ্ম সবই সমান । এইভাবে যে ঈশ্বরের চিন্তন করার অভ্যাস করেছে, সে যম, নিয়ম সাধনা দ্বারা ঘন্টার পর ঘন্টা নদী, পাহাড়ে একান্ত স্থানে বসে বসে চিন্তন করতে সক্ষম। আর যারা সমাধিস্থ হয় তারা একই আসনে কয়েকদিন ধরে ধ্যান করতেই থাকে । তারা কি কোনো মূর্তির ধ্যান করে বলতে পারো? একটুখানি গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝবে মূর্তিতে তো মনই বসে না কেননা, মন কখনও নাকের চিন্তন করবে, কখনও বা হাত পায়ের । মূর্তির সারা অঙ্গে মন ঘুরে বেড়াবে যখন মনের সামনে কোনো মূর্তি থাকবে না তখনই তার বৃত্তি সমূহ আত্মার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকবে।
কমলঃ ময়রার দোকান হতে চার আনার সন্দেশ কিনে আনলাম। সন্দেশ খেয়ে সত্যি খুবই আস্বাদ পেলাম । সন্দেশ সাকার, আর আস্বাদ নিরাকার। যদি ময়রাকে বলা যায় — আমার চার আনার নিরাকার আস্বাদ দাও তো । সে কেমন করে দেবে এ থেকে বুঝলাম যে, সাকার মূর্তি হতেই নিরাকার পরমাত্মার আস্বাদ বা আনন্দ পাওয়া সম্ভব ।
বিমলঃ ভাইটি শোনো । যার যা গুণ, খেলে পরে তা জানা যাবেই । সন্দেশ খেলে সন্দেশের আস্বাদ পাওয়া যাবে, জিলিপী খেলে জিলিপীর আস্বাদ পাওয়া যাবে । সন্দেশ এবং আস্বাদে গুণ ও গুণীর সম্বন্ধ আছে, ব্যাপ্য ব্যাপকের নেই । সন্দেশ দ্রব্য, আস্বাদে গুণ ও গুণীর সম্বন্ধ আছে, ব্যাপ্য ব্যাপকের নেই। সন্দেশ দ্রব্য, আস্বাদ তার গুণ। কিন্তু মূর্তি এবং পরমাত্মা দু'জনেই যে দ্রব্য। সন্দেশ খেলে গুণ আস্বাদ, অনুভব করবে । কিন্তু মূর্তি দ্বারা পরমাত্মার আনন্দ কেমন করে অনুভব করলে বলো? কেননা, পরমাত্মা তো মূর্তির গুণ নয় । আর এক কথা, সন্দেশ খেলে সন্দেশের আস্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু যদি কেউ মাটির নকল সন্দেশ তৈরী করে খাওয়া আরম্ভ করে, তা হলে কি সন্দেশের আস্বাদ পাবে? কোনো মতেই নয় । ঠিক্ তেমনি, পরমাত্মার অনুভূতি হলেই পরমাত্মার আনন্দ লাভ করে, পরমাত্মার পরিবর্তে যদি কেউ মাটি বা পাথরের নকল পরমাত্মার মূর্তি তৈরী করে, তাহলে সে তাতে পরমাত্মার আনন্দ কেমন করে অনুভব করবে?
কমলঃ মূর্তি থাকায়, যেমন — নোটের এবং টাকা পয়সার ব্যবহার সুখদায়ক তেমনি মূর্তির পূজাও সুখদায়ক ।
বিমলঃ ◼️প্রথমতঃ — রাজা শরীরধারী, তাই তার মূর্তি ছাপ নোট এবং টাকা পয়সা তৈরী হতে পারে, কিন্তু পরমাত্মা যিনি নিরাকার তাঁর মূর্তি তৈরী হবে কেমন করে?
◼️ দ্বিতীয়তঃ — নোট এবং টাকা পয়সা রাজার আদেশ, রাজকীয় ট্যাকশালে তৈরী বলে সুখদায়ক । কিন্তু যদি কোনো মানুষ রাজকীয় বিধি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের ঘরে জাল মুদ্রা তৈরী করা আরম্ভ করে, তাহলে রাজা তাকে জেলখানা দর্শন করিয়ে ছাড়বে । সেইরূপ পারমাত্মাকে তৈরী করা এবং তার মূর্তি পূজা করা অনেক যোনিরূপ জেলখানা দর্শনের প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয় জানবে ।
কমলঃ মহাভারতে পড়েছি—একলব্য দ্রোণাচার্যের মূর্তি গড়ে শস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা করেছিল ।
বিমলঃ দ্রোণাচার্য সশরীর, মূর্তিমান ছিলেন, তাই একলব্য তাঁর মূর্তি নির্মাণ করেছিল । সে তো ঈশ্বরের স্থানে তাঁর পূজা করেনি । তাছাড়া—সেই মূর্তিটি একলব্যকে শাস্ত্র-বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিল একথা যদি সত্য হয়, তাহলে একলব্যের শস্ত্র সঞ্চলন অভ্যাস করার প্রয়োজন কী ছিল? মনে রেখো একলব্য সমস্ত শাস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস দ্বারাই শিক্ষা করেছিল । শিক্ষার কথা দ্রোণাচার্য জানতেনই না। যখন তিনি জানতে পারলেন তখান তার পরিণাম একলব্যকে ভোগ করতে হয়েছিল তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে দিয়ে । কোনো কর্ম বা শিক্ষাদানের যোগ্যতা মূর্তিতে আসবে কোথা হতে? যদি মূর্তিতে শিক্ষাদানের যোগ্যতা থাকে তাহলে সকলের উচিত, ব্যাসের মূর্তি গড়ে তার কাছে বেদ পড়া।
একজন বেয়ারা কোনো ইংরাজের কাছে চাকরী করতে করতে ইংরেজী বলতে শিখে ফেলে । ময়রার কাছে চাকরী করতে করতে মানুষ মিষ্টি করতে শিখে ফেলে । আগুনের কাছে বসলে উষ্ণতা বোধ হবে । যার সঙ্গতি করা যাবে তার গুণ সঙ্গতিকারীর উপর প্রভাব বিস্তার করবে জড় মূর্তির সঙ্গতিতে জড়তা এলো, পিটনী খেলো, মন্দির ভাঙলো, দেশে ভয়াবহ পরাধীনতা ও দারিদ্র্য দেখা দিলো । জড়ের সঙ্গতিতে আত্মবিশ্বাস এবং কর্মশক্তিও হয়ে গেল ।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)