দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫



নিরাকার ঈশ্বর কি মলমূত্র আদি অপবিত্র জায়গাতেও বসবাস করেন ?

সত্যান্বেষী
0

 


প্রশ্নঃ নিরাকার ঈশ্বর কি মলমূত্র আদি অপবিত্র জায়গাতেও বসবাস করেন ?
 
উত্তর: সর্বব্যাপক ঈশ্বর জগতের সর্বত্রই ব্যাপ্ত থেকে নিবাস করছেন। জগতের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তিনি নেই।
 
ঈশা বাস্যমিদ্ঁ সর্বং য়ৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্।।
(যজুর্বেদ ৪০।১)
অর্থাৎ, হে মানুষ! এই যে প্রকৃতি থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত চলমান সৃষ্টিতে জড়-চেতন জগৎ রয়েছে, তা সর্বশক্তিমান পরমাত্মা দ্বারা আচ্ছাদিত, এজন্য তোমরা তা ত্যাগপূর্বক ভোগ করো, অন্য কারো ধনে লোভ করো না।
 
এই মন্ত্রে 'জগৎ' শব্দের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এই মন্ত্রে জগতকে চলমান বলা হয়েছে, গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় জী একটি উদাহরণের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন—"এই জগৎ সংসার সদা গতিশীল থাকে । যদি সত্তর মাইল গতিতে চলতে থাকা কোনো গাড়ীতে আপনি নিজের জায়গায় বসে থাকেন, তবুও আপনাকে নিশ্চল বলা যাবে না, কারণ আপনিও ওই গাড়ির সাথে সত্তর মাইল বেগে চলছেন। আর পৃথিবী ২৪ ঘন্টায় প্রায় ২৪,৮৯৮ মাইল অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১,০৩৭ মাইলের বেশি গতিতে চলছে ! তাহলে আমরা নিশ্চল কী করে? বিজ্ঞানবেত্তাগণ আমাদের জানিয়েছেন যে, যাকে আমরা প্রথমে পরমাণু বলতাম, সেও এক বিশাল মণ্ডল, তার ভেতর বিদ্যুৎ বিন্দু বা ইলেকট্রন খুব গতির সাথে চলছে। এজন্য চলমান সংসারকে 'জগতী' বলা হয়েছে, কারণ সংস্কৃতে চলমান বস্তুর নাম জগতী (জগতী, গম্-গতৌ — চলমান)।" আবার, আমাদের মহাবিশ্বের বিশাল নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকা, জ্যোতিষ্ক, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ কিছুই স্থির নেই। সবই গতিশীল। কাজেই এই মহাবিশ্বের বিশালতম পিণ্ড থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণবিক কণা সবকিছুর মাঝেই নিরাকার ঈশ্বর ব্যাপ্ত রয়েছেন। 
 
কঠোপনিষদে বলা হচ্ছে, 
 
অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব ৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ ৷। (৫।৯)
যেরূপ এক অগ্নি লোক‌ লোকান্তরে ব্যাপ্ত হয়ে প্রত্যেক রূপবান পদার্থে তদাকার হয়ে রয়েছেন, সেরূপ এক সবার অন্তর্যামী পরমাত্মা প্রত্যেক রূপবান পদার্থে তদাকার হয়ে ব্যাপ্ত রয়েছেন এবং তার বাইরেও আছেন। 
 
ঈশ্বর ব্যতীত কোনো স্থানই ফাঁকা নেই এই জগতে। কাজেই ঈশ্বর মলমূত্র আদি সর্বত্রই আছেন। এখন প্রশ্ন আসে মলমূত্রাদির পবিত্রতার বিষয়ে। মানবের মলমূত্র আমাদের কাছে অতিশয় অপবিত্র, দুর্গন্ধ ও ঘৃণিত বস্তু। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি এই মল মাটির সাথে মিশে গাছের জন্য সার হয়! অথবা, এই মলের ভেতরেই পোকামাকড় বা অণুজীব বাস করে। গোরু, এমনকি কেঁচোর মল উত্তম সার। মুরগির মল মাছের জন্য খাদ্য। অর্থাৎ এক প্রাণীর মল বা মূত্র কেবল সেই প্রাণির সাপেক্ষে অপবিত্র। অন্য প্রাণির কাছে সেগুলোই পুষ্টি। জলচক্র বা নাইট্রোজেন চক্র এভাবেই চলে আসছে। কাজেই মল মূত্র পরম অপবিত্র কিছু না যে তাতে ঈশ্বর থাকবেন না। 
 
বরং মলমূত্রের চেয়েও অনেক বেশি অপবিত্র হলো পাপী বা ষড়যন্ত্রকারীর হৃদয়। পাপীর হৃদয়েও ঈশ্বর অবস্থান করলে কেন সে পাপ করে? 
 
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে ।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ ।। (যজুর্বেদ ৪০।৫) 
 
এই মন্ত্রে একটি বিরোধাভাস অলঙ্কার রয়েছে। 'তদেজতি' অর্থ তিনি চলেন। আর 'তন্নৈজতি' অর্থ তিনি চলেন না। এই আপাত বিরোধের মীমাংসা করেছেন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী। তিনি অর্থ করেছেন এভাবে, "হে মানুষ ! সেই ব্রহ্ম মূর্খের দৃষ্টিতে চলমান হন, বাস্তবে তিনি না চলেন এবং না কেউ তাকে চালনা করতে পারে । তিনি অধার্মিক-অবিদ্বান-অযোগীদের থেকে দূরে কিন্তু ধার্মিক-বিদ্বান-যোগীদের নিকটে । ব্রহ্ম এই সমস্ত জগত এবং জীবের মধ্যে বিরাজমান তিনি নিশ্চয়ই এই প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ জগতের বাহিরেও বিরাজমান, এটা নিশ্চিৎ জানো।" অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বদাই স্থির আছেন আমাদের হৃদয়ে বা আশেপাশের সর্বত্র। মূর্খ ব্যক্তি বা পাপী ব্যক্তি তা অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। তাই সে পাপ করা অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে সে ধীরে ধীরে ব্রহ্ম থেকে , জ্ঞান থেকে, আলোক থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম কারো থেকে দূরে যান না, বা নিকটেও আসেন না। মানব তাদের স্বীয় জ্ঞান ও কর্মের দ্বারাই ব্রহ্মের কাছে আসেন ও দূরে যান। কাজেই অমুক তীর্থ, তমুক মন্দিরে গেলে ব্রহ্মকে পাওয়া যাবে, এই ধারণা ভিত্তিহীন। ব্রহ্ম সবদা সর্বত্রই আছেন। আমাদের সকল পাপকর্ম ও সকল পাপ চিন্তা সবকিছুই তিনি দেখছেন। শেষ করব, এমন দুইটি মন্ত্র দিয়েই, 
 
বৃহন্নেষামধিষ্ঠাতা অন্তিকাদিব পশ্যতি।
য় স্তায়ন্মন্যতে চরন্ত্সর্বং দেবা ইদং বিদুঃ।।১৩।।
(অথর্ব ৪।১৬।১)
ভাবার্থঃ হে সর্বব্যাপক বরণীয় পরমাত্মা! তুমি প্রাণী মাত্রেরই নিয়ন্ত্রক আর তাদের সকলের কর্ম সকল প্রকারে জান। তোমার কাছে কারো কোনো কাজই গোপন নেই। দূরের, নিকটের, চর, অচর, স্থূল, সূক্ষ্ম এই সকল ব্রহ্মাণ্ডস্থ পদার্থমাত্রের জ্ঞাতা সর্বত্র ব্যাপ্ত, সকলের শ্রেষ্ঠ, সকলের উপাসনার যোগ্য তুমি।।
 
য়স্তিষ্ঠতি চরতি য়শ্চ বঞ্চতি য়ো নিলায়ং চরতি য়ঃ প্রতঙ্কম্।
দ্বৌ সংনিষদ্য য়ন্মন্ত্রয়েতে রাজা তদ্বেদ বরুণস্তৃতীয়ঃ।।
(অথর্ব ৪।১৬।২)
ভাবার্থঃ হে বরণীয় পরমাত্মা! যারা স্থির বা চলমান, যারা বঞ্চনাকারী বা লুকিয়ে চলে বা দুঃখে জীবন যাপন করে, তাদের সকলকেই তুমি জান। যেকোনো দুই ব্যক্তি মিলে যে সব ভালো বা মন্দ গুপ্ত পরামর্শ করে, এই দুইজনের পর তৃতীয় তুমি বরণীয় পরমাত্মা তাদের সকলকে জানো।।
 
ব্রহ্ম সর্বত্রই আছেন, তিনি সাক্ষীরূপে সবকিছুই দেখছেন। জগতের উঁচু, নিচু, দুর্গম কোনো স্থানই তাঁর আজ্ঞার বাইরে নয়। এই কথাটি সর্বদা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত। তাহলেই আমরা কর্মে, চিন্তায়, আচরণে সংযমী হব ও লোকহিতের জন্য কর্ম করব। সবকিছুই ব্রহ্মের দৃষ্টির অধীন থাকায় পাপকার্য করতে একবার হলেও‌ আমাদের দ্বিধা বা সংকোচ জাগবে।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)