এক্ষণে যে মহাত্মার কল্যাণে প্রথমে বঙ্গদেশের অক্ষর সাধারণ আবালবৃদ্ধবণিতা মহাভারতের মর্মাবগত হতে সমর্থ হয়েন, যে মহাত্মা অতি কঠোর যবন-শাসন সময়েও বঙ্গভাষায় মহাভারতের মর্মানুবাদ দ্বারা ক্ষুদ্রান্তঃকরণেও আলোকসঞ্চার করিয়া গিয়াছেন, আমার সেই ভূতপূর্ব সহযোগ্য কবিবর কাশীরাম দেবের সুনিশ্চিত জীবন-বৃত্তান্ত অবগত হওয়া অতীব দুরূহ এবং তিনি কোন্ সময় কি প্রকারে পদ্যানুবাদ সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন, তাহারও নিশ্চয় করা সহজ নহে। উক্ত অনুবাদক যেরূপ আত্মপরিচয় প্রদান করিয়া আদিপর্ব্বের উপসংহার করিয়াছেন, পাঠকবর্গের অবগতির নিমিত্ত তাহা নিম্নে অবিকল উদ্ধৃত করিলাম।
“ইন্দ্রাণী নামেতে দেশে পূর্বাপর স্থিতি।
দ্বাদশতীর্থেতে যথা গতা ভাগীরথী।
কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিদ্ধি গ্রামে।
প্রিয়ঙ্কার দাস পুত্র সুধাকর নামে।
তনুজ কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা।
কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।।
কাশীদাস কহে সাধুজনের চরণে।
হইবে নির্মল জ্ঞান শুন একমনে।।”
কিন্তু এই পদ্যময় রচনাতেও পরিষ্কাররূপে কাশীরাম দেবের কোনও বিশেষ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। ইহাতে যে কয়েক ব্যক্তির নাম বর্ণিত হইয়াছে, কাশীরামের সহিত যে তাহাদিগের কোন্ ব্যক্তির কিরূপ সম্বন্ধ, তাহাও সংশয়শূন্য হইয়া স্থির করা কঠিন। ফলতঃ তিনি যে কোন্ শকে জন্মগ্রহণ করিয়া কত বয়সে ভারতানুবাদ-কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন ও কতদিনে তাহা শেষ করেন, এ বিষয়ে কোনও নির্দেশ নাই। পদ্যানুবাদিত সমস্ত মহাভারত কাশীরামকৃত নহে বলিয়াও কেহ কেহ অনুমান করেন এবং সেই অনুমান সপ্রমাণ করণার্থ লোকপরম্পরাগত এই উভয় কবিতার প্রয়োগ হইয়া থাকে। যথা,
“আদি, সভা, বন, বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর ।।
ধন্য হইল কায়স্থকুলেতে কাশীদাস।
তিন পর্ব্ব ভারত যে করিল প্রকাশ।।”
এই কবিতা প্রামাণিক হইলে আদি, সভা, বন ও বিরাটের কিয়দংশ মাত্র কাশীরামের রচিত বলিয়া অঙ্গীকার করিতে হয়; কিন্তু পদ্যানুবাদিত গ্রন্থের অষ্টাদশ পর্ব্বের পরিশেষেও কাশীরাম দাসের ভণিতা দৃষ্ট হইয়া থাকে ; অতএব এই পরস্পর-বিরুদ্ধ বাক্যের সমন্বয়সাধন করা সহজ ব্যাপার নহে। যাহা হউক, আদি, সভা ও বন পৰ্ব্ব যে প্রণালীতে রচিত দৃষ্ট হয়, অবশিষ্ট পৰ্ব্বগুলি অবিকল সে প্রণালীতে রচিত নহে ; বিশেষ অভিনিবেশ পূৰ্ব্বক পাঠ করিলে অনেক বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হয়, সন্দেহ নাই। এক্ষণে সেই বৈলক্ষণ্য বিবেচনা করিয়া যতদূর পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে, আমাদিগকে অগত্যা তাহাতেই তৃপ্ত থাকিতে হইয়াছে।
যা হউক, কাশীরাম যে কথকদিগের মুখে মহাভারত শ্রবণ করিয়া তাহার পদ্যময় গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, তাহা রচনাভাব ও মূলের সহিত অনৈক্য দেখিয়া অনেকে অনুভব করিয়া থাকেন এবং কাশীরাম তাঁহার গ্রন্থে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। যথা বিরাটপর্ব্বে;—
“মহাভারতের কথা কে বর্ণিতে পারে।
যেন ভেলা বান্ধি চাহে সিন্ধু তরিবারে।।
শ্রুতিমাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার।
সাধুজন-চরণেতে বিনয় আমার।।”
পুনরায় শল্যপর্ব্বে;—
“মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
আমার কি শক্তি ইহা বর্ণিবারে পারি ।।
শ্রুতিমাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।”
আর তিনি গ্রন্থ রচনা করিবার সময় যে তৎকালীন দুই একজন কৃতবিদ্য পৌরাণিক বা শাস্ত্রব্যবসায়ীর সাহায্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, নিম্নের কবিতায় তাহা প্রকাশিত হইতেছে। যথা উদ্যোগপর্ব্বে –
“হরিহরপুর গ্রাম সর্বগুণধাম।
পুরুষোত্তমনন্দন মুখটি অভিরাম ।।
কাশীদাস বিরচিল তাঁর আশীর্ব্বাদে।
সদা চিত্ত রহে যেন দ্বিজপাদপদ্মে।।”
মৃত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ বহুযত্নে হস্তলিখিত পুস্তক ঐক্য করিয়া কাশীদাসের ভারত মুদ্রিত করেন তাহাতে ভারত সম্পূর্ণ হইবার বিষয়ে কেবল এই মাত্র আছে। যথা আদিপর্ব্বে;-
"সাধুময় এ ভারত ব্যাস বিরচিত।
ফাল্গুনের বিংশদিনে সমাপ্তবিহিত।।”
এই কবিতা দ্বারা অবগত হওয়া যাইতেছে যে, কাশীদাস ২০-এ ফাল্গুন আদিপর্ব্ব সম্পূর্ণ করিয়াছেন, কিন্তু কোন্ সালের ২০-এ ফাল্গুনে যে ঐ আদি-পৰ্ব্ব সম্পূর্ণ হয়, তাহা কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না। বাজারে বহুকালাবধি যে কাশীরামদাস দেবের মহাভারত বিক্রীত হইয়া আসিতেছে, তাহাতে এবং শ্রীরামপুরে মুদ্রিত পুস্তকে নিম্নের পদ্যগুলি নাই। পৌরাণিক কথক ও পাঠক কথকতা ও পাঠের পূর্ব্বে সংস্কৃত ভাষায় ব্যাসদেবের যে বন্দনাটি পাঠ করিয়া থাকেন, নিম্নের পদ্যটি তাহার সর্ব্বাঙ্গসুন্দর অনুবাদ। তর্কবাগীশ মহাশয় শ্রীযুক্ত রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের নিকট কাশীরামের হস্তলিখিত যে মূল পুস্তক আছে, তদ্দৃষ্টে ইহা প্রচার করিয়াছেন। যথা—
“বন্দে মহামুনি ব্যাস তপস্বিতিলক।
মহামুনি পরাশর যাঁহার জনক ।।
বেদশাস্ত্রপরিনিষ্ঠ শুদ্ধবুদ্ধি ধীর।
নীলপদ্ম আভা জিনি কোমল শরীর।।
কনকাভ জটাভার শিরে শোভা করে।
প্রচণ্ড শরীর পরিহিত বাধাম্বরে ।।
নয়ন যুগলে দীপ্ত উজ্জ্বল মিহির।
পদযুগে কত মণি শোভে ইন্দ্রশির।।
ভাগবত ভারতাদি যতেক পুরাণ।
যাঁহার কোমল মুখে সবার নির্ম্মাণ।।
শ্রীকৃষ্ণের লীলা আর বেদ চারিখান।
ঋক্, যজু, সাম আর অথর্ব বিধান।।
প্রণতি কবীন্দ্র মুণি-চরণ পঙ্কজে।
পরম আনন্দে কাশীদাস সদা ভজে ।
বেদে রামায়ণে আর পুরাণে ভারতে।
লিখিত যতেক তীর্থ আছে বিজগতে।
সর্বশাস্ত্র বিচারিয়া বুঝ পুনঃ পুনঃ।
আদি অন্ত অভ্যন্তরে গাঁথা হরিগুণ ।।”
এই অনুবাদটি পাঠ করিলে বিলক্ষণ প্রতীতি হয় যে, কাশীরাম কতকথা শুনিয়া শুনিয়া বহুদিনে তাহার পদ্যময় মহাভারত প্রস্তুত করেন। পূর্ব কালাবধি পৌরাণিক কথকেরা লোকরঞ্জনার্থ অন্যান্য পুরাণ ও জৈমিনি ভারত হইতে যে সকল প্রস্তাব কথকতার সময় কহিয়া আসিতেছেন, কাশীরাম দাসের পুস্তকে সেই সমস্তই প্রাপ্ত হওয়া যায়।
পূর্ব্বে কাশীরামের পদ্যময় মহাভারত উৎসব সময়ে, পুণ্যাহ মাসে ও সময়ে সময়ে গৃহস্থের ভবনে কবিকঙ্কণের চণ্ডী, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং বাঙ্গালা ভাষার আদি বৃন্দাবন দাস ও মুরারি দাসের চৈতন্যমঙ্গলাদি গ্রন্থ সকলের ন্যায় সঙ্গীত হইত। কথকথার বহুল প্রচার ও সুলভতা হওয়াতে সেই সঙ্গীতসম্প্রদায় এক্ষণে তিরোহিত হইয়া গিয়াছেন। বাস্তবিক পূর্ব্বে মুদ্রাযন্ত্রের প্রচার না থাকাতে স্থানে স্থানে গান করা ভিন্ন নুতন বিষয় সাধারণকে অবগত করিবার কোন প্রকার উপায় ছিল না। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর ও অন্নদামঙ্গলও গান হইয়া গিয়াছে এবং কোন কোন মুদ্রিত পুস্তকে অদ্যাপিও পালা বাঁধা আছে।
যাহা হউক, আমার ভূতপূর্ব্ব সহযোগী মৃত কাশীরাম দেব যে সাহিত্য সমাজের শত শত ধন্যবাদের পাত্র, তাহার আর সন্দেহ নাই। বাঙ্গালা পদ্যের প্রায় সমস্ত পূর্ব্বতন কবি অপেক্ষা তাহার রচনাপ্রণালী যেরূপ সরল ও প্রাঞ্জল, তেমনি প্রসাদগুণ পরিপূর্ণ। উহা এমনি অপূৰ্ব্ব কৌশলে লিখিত যে অদ্যাপি অনেক কৃতবিদ্য লোকে ঐরূপ সরল পদ্য লিখিতে চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। অল্প কথায় অনেক ভাব প্রকাশ করাও কাশীরামের একটি অদ্বিতীয় ক্ষমতা। প্রায় দুই শত বৎসর হইল, অদ্যপি অন্য কেহই ঐরূপ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়েন নাই। ফলে কাশীরামের পদ্যগ্রন্থে স্থানে স্থানে তাহার বাঙ্গালা ভাষা লিখিবার চমৎকার কৌশল ও অনুপম কবিত্ব দেখা যায়। তাহার সমকালীন অন্যান্য বাঙ্গালা ভাষার গ্রন্থকারদিগের গ্রন্থে সেরূপ অতি বিরল।
[ মহাভারতের উপসংহার - মহাত্মা শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ ]
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর