গুরু ছাড়া কি মুক্তি হবে না
তে পূতাসো বিপশ্চিতঃ সোমাসো দধ্যাশিরঃ ।
সূরাসো ন দর্শতাসো জিগত্নবো ধ্রুবা ঘৃতে ॥
[ সামবেদ ১১০২ ]
সরলার্থঃ যারা পবিত্র, বিদ্বান, জ্ঞানের ধারণকর্ত্তা ও পরিপক্ব, পরমাত্মাতে আশ্রিত, সূর্যের ন্যায় দর্শনীয় অর্থাৎ কান্তিমান অধ্যাত্ম সত্যের মার্গ তথা দৃষ্টি প্রদানকারী, গতিমান্ ও কর্মণ্য, ধীর এবং বিবেকবান তারাই বিনয় , বিদ্যা, ধর্ম, আদির প্রেরণা দানকারী বিনয়স্বভাবযুক্ত গুরু হবেন ।
তথাকথিত গুরুরা বর্তমানে জটিল জটিল কৃত্তিম পদ্ধতি প্রবর্তন করেন এবং নিজ নিজ সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলেন। আমরা আগেই দেখলাম গুরু হতে হবে বেদবিৎ। শিক্ষার্থীদেরও গুরু সম্পর্কে ধারণা এমন হবে যেন তারা পরস্পরকে বলে -
প্র মন্দিনে পিতুমদর্চতা বচো য়ঃ কৃষ্ণগর্ভা নিরহন্নৃজিশ্বনা।
অবস্যবো বৃষণং বজ্রদক্ষিণং মরুত্বন্তং সখ্যায় হুবেমহি ॥
সামবেদ ৩৮০
সরলার্থঃ হে সহপাঠীগণ ! তোমরা আনন্দদাতা তথা বিদ্যার ঐশ্বর্যযুক্ত আচার্যের জন্য উৎকৃষ্ট অন্নের সাথে আদরপূর্ণ প্রিয়বচন উচ্চারণ করো, যে আচার্য সরল শিক্ষাপদ্ধতি দ্বারা অন্ধকার অজ্ঞান যার গর্ভে আছে, এমন অবিদ্যা রূপ রাত্রিকে নষ্ট করেন। বিদ্যার আকাঙ্ক্ষাকারী তোমরা আমরা সদ্গুণের বর্ষণকারী, কুপথ দূরকারী বিদ্যা আর বিদ্যাযজ্ঞের ঋত্বিক প্রশস্ত বিদ্বান অধ্যাপক যার কাছে আছেন, তেমন আচার্যকে মিত্রতার জন্য স্বীকার করি।
গুরু কে হবেন - https://www.agniveerbangla.org/2022/06/blog-post_13.html?m=1
যোগদর্শনে ভগবান্ পতঞ্জলি বলেছেন -
স এষ পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ।
[ যোগদর্শন ১।২৬ ]
শব্দার্থ - (সঃ এষঃ) সেই ঈশ্বর (পূর্বেষাম্) পূর্বে উৎপন্ন গুরুদের (অপি) ও (গুরুঃ) গুরু অর্থাৎ বিদ্যা দাতা (কালেন-অনবচ্ছেদাৎ) সময় দ্বারা মৃত্যুকে প্রাপ্ত না হওয়ায়।
সূত্রার্থ - সেই ঈশ্বর পূর্বে উৎপন্ন গুরুদেরও গুরু অর্থাৎ বিদ্যা দাতা, তার কারণ হল কালের দ্বারা তিনি কখনো মৃত্যুকে প্রাপ্ত হননা।
এই সূত্রে ঈশ্বরের স্বরূপকে বর্ণনা করা হয়েছে।পূর্ববর্তী গুরুরা সময় দ্বারা নষ্ট হয়ে গেছেন কিন্তু ঈশ্বরকে নষ্ট করার জন্য কালের প্রবৃত্তি দেখা যায় না। এই জন্য তিনি সকল গুরুদেরও গুরু। যেমন এই সৃষ্টির আরম্ভে জ্ঞান দিয়েছেন, সেই রকম অতীত সৃষ্টিতেও দিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতেও দেবেন, এরকম জানা উচিৎ ।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী 'আর্যোদ্দেশ্যরত্নমালা' গ্রন্থের ৬১ সংখ্যক রত্নে বলেছেন -
বীর্যদান হতে আরম্ভ করে ভোজনাদি দিয়ে পালন করেন বলে পিতাকে "গুরু" বলা হয় । যিনি স্বীয় সত্যোপদেশ দ্বারা হৃদয়ের অজ্ঞানরূপী অন্ধকারকে দূর করে দেন, তিনি ''গুরু'' অর্থাৎ "আচার্য"।
সত্যার্থ প্রকাশের স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশঃ অংশেও বলেছেন -
মাতা এবং পিতা ‘গুরু’; তদ্ব্যতীত যাঁর উপদেশে সত্যগ্রহণ এবং অসত্য বর্জন করা হয় তাঁকেও ‘গুরু’ বলে ।
গুরু কে হতে পারে, সৎ গুরু চেনার উপায় কী ? গুরু কে ভগবান বলা যায়? সৎ গুরুর লক্ষণ সমূহ কী কী? লোকমুখে শোনা যায় গুরু ত্যাগ করলে নাকি পাপ হয়? আসলেই কী গুরু ত্যাগ করলে পাপ হয় ?
ইত্যাদি প্রশ্নসমূহ প্রায়ই আমাদের মনে প্রায়ই উঁকি দেয়। গুরু সম্পর্কে আমরা উপরে আলোচনা করেছি। শিষ্যদেরও উচিত গুরু চয়নের পূর্বে সেই গুরু আদতে বেদাদি শাস্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী গুরু পদবাচ্য কিনা তা অনুসন্ধান করা। শিষ্য গুরুর লক্ষণ কীভাবে বুঝবে তা নিয়ে বেদে বলা হয়েছে -
ভ্রাজন্ত্যগ্নে সমিধান দীদিবো জিহ্বা চরত্যন্তরাসনি।
স ত্বং নো অগ্নে পয়সা বসুবিদ্রয়িং বর্চো দৃশেঽদাঃ ॥
সামবেদ ৬১৫
সরলার্থঃ আচার্য রূপ অগ্নিতে নিজেকে আহুতি দেবার জন্য সমিধ হাতে গুরুকুলে আগত শিষ্য আচার্যের উদ্দেশ্যে বলছেন—হে স্বয়ং জ্ঞানদীপ্ত, তথা শিষ্যদের জ্ঞান দ্বারা প্রদীপ্তকারী, বিদ্বান আচার্যদেব! আপনার মুখের ভেতর, শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা উপদেশ প্রদানের ফলে প্রাপ্ত যশ দ্বারা দীপ্তিমান জিহ্বা, শব্দসমূহের উচ্চারণের জন্য তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থানে বিচরণ করে। সেই মহিমান্বিত, বিবিধ বিদ্যা রূপ ধনের দাতা, হে আচার্য্যদেব! আপনি আমাদের কর্তব্য-দর্শনের জন্য বেদজ্ঞান রূপ দুধের সাথে সদাচারের সম্পদ এবং ব্রহ্মবর্চস তথা ব্রহ্মতেজ আমাদেরকে প্রদান করুন।
আমাদের কেমন গুরুর কাছে যাওয়া উচিৎ?
প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছে মুণ্ডক উপনিষদও। বলেছে -
পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো নির্বেদমায়ান্নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন।
তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ সমিৎপাণিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্॥
মুণ্ডকোপনিষদ্ ১.২.১২
সরলার্থঃ ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী মনুষ্য কর্ম দ্বারা প্রাপ্ত অবস্থাকে (কর্মফল বা ভোগসমূহকে) পরীক্ষা করে বৈরাগ্য অবলম্বন করবেন, কারণ সাংসারিক অনিত্য কর্ম দ্বারা নিত্য পরমাত্মাকে লাভ করা যায় না। এজন্য তাঁকে জানার জন্য সেই ব্রহ্মজিজ্ঞাসু ব্যক্তি সমিধা (যজ্ঞকাষ্ঠ) হাতে নিয়ে বেদজ্ঞ, ব্রহ্মপরায়ণ গুরুর নিকট উপস্থিত হবেন।
একইভাবে গুরুরও কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে -
তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্ প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়।
য়েনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং প্রোবাচ তাং তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্॥
মুণ্ডকোপনিষদ্ ১.২.১৩
সরলার্থঃ যথাবিধি শরণাগত, শান্তচিত্ত এবং শম-দমাদি সাধন-সম্পন্ন (সংযতেন্দ্রিয়) সেই শিষ্যকে উক্ত বেদবিদ্ এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরু সেই ব্রহ্মবিদ্যার যথার্থরূপে উপদেশ প্রদান করবেন, যে বিদ্যা দ্বারা সেই অবিনাশী নিত্য পূর্ণ পরমাত্মাকে জানা যায়।
কঠ উপনিষদ (১.২.৭) বলছে— নিপুণ আচার্যের কাছে কেউ আত্মজ্ঞান লাভ করেছে, এই রকম ব্যাক্তিও সচরাচর পাওয়া যায়না। কথাটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে সম্পূর্ণ সত্যতা নিজেই উপলোব্ধি করতে পারবেন।
মহাভারতের গীতায় (২.৭) শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ব্রহ্মবিদ্যা সহ নানা প্রকার জ্ঞান দান করেছিলেন। কিন্তু সেটি অর্জুন শিষ্যত্ব গ্রহণের পর। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত ছিলেন। সমর্পণ, শ্রদ্ধা এবং ভক্তি সহকারে জ্ঞান অর্জন করা উচিৎ।
এজন্য শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬/২৩) বলছে, পরমেশ্বরের প্রতি যার ভক্তি আছে, তার পক্ষেই গুরুর দানকৃত বিদ্যা প্রকাশিত হয় ।
গুরুকে ভগবান বলা যায় ?
এই প্রশ্নেরও স্পষ্ট উত্তর রয়েছে উপনিষদে। ভগবান ঈশ্বরকে যেমন বলা যায় তেমনি গৌণরূপে গুরুদেবকেও বলা যায়। মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম মুণ্ডক প্রথম খণ্ডের তিন নাম্বার শ্লোকে দেখা যায় গৃহস্থ শৌনক ঋষি অঙ্গিরার কছে জ্ঞান অর্জন করতে এসে “ভগবান” শব্দে সম্বোধন করছেন। বিস্তারিত পড়ুন - http://back2thevedas.blogspot.com/2022/10/blog-post_27.html
সুতরাং ঈশ্বর হলেন পরমগুরু। সুতরাং আসলেই মূখ্যভাবে পরমাত্মারূপী গুরু ছাড়া গতি নেই, কেননা তিনিই মূল লক্ষ্য । আর সামবেদে বলা হয়েছে কোন গুরুর কাছে শিষ্য যাবে না। সেখানে বলা হয়েছে -
অতীহি মন্যুষাবিণং সুষুবাংসমুপেরয়।
অস্য রাতৌ সুতং পিব ॥
সামবেদ ২২৩
সরলার্থঃ হে বিদ্যুতের ন্যায় তীব্র বুদ্ধিমান বিদ্যার্থী ! ক্রোধ, দ্বেষ প্রভৃতি যুক্ত বিদ্যাদানকারী গুরুকে তুমি ত্যাগ করো, তার কাছে বিদ্যা পাঠের জন্য যেও না। প্রেমের সাথে বিদ্যাদানকারীর কাছে পৌঁছে বিদ্যালাভের জন্য প্রার্থনা করো। এই গুরু বিদ্যাদানে প্রবৃত্ত হওয়ার পর জ্ঞানরসকে গ্রহণ করো।
গুরু-শিষ্য বরং পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে অধ্যাপন-অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হবেন। বেদে বলা হচ্ছে -
ব্রাহ্মণাদিন্দ্র রাধসঃ পিবা সোমমৃতূং রনু।
তবেদং সখ্যমস্তৃতম্ ॥
সামবেদ ২২৯
সরলার্থঃ হে বিদ্যুতের ন্যায় তীব্র বুদ্ধিমান বিদ্যার্থী ! তুমি অধ্যয়ন-অধ্যাপন যজ্ঞের সাধক ব্রহ্মবেত্তা, বেদবেত্তা এবং ব্রাহ্মণ স্বভাবের আচার্যের থেকে প্রত্যেক ঋতুতে জ্ঞান রস পান করো। তোমার এই গুরুশিষ্য সম্বন্ধরূপ মিত্রতা অবিনশ্বর থাকুক।
আপনি শাস্ত্র বা ধর্মীয় গ্রন্থ যা-ই পড়ুন না কেন কারো না কারো ব্যাখ্যা পড়ছেন, শুধুমাত্র মূল অনুবাদ পড়ে তাৎপর্য বোঝা সম্পূর্ণরূপে কখনোই সম্ভব না। অর্থাৎ আপনি পরোক্ষভাবে হলেও একজন গুরু বা আচার্যের উপর নির্ভর করছেন নিজের অজান্তেই। কেননা তিনি যদি যে শাস্ত্র আপনি পড়ছেন তার অনুবাদ / ব্যাখ্যা / আলোচনা না করতেন তার সম্যক রূপে উপলব্ধি সম্ভব ছিলো কি? মোটেও না।
বেদেও গুরুকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে শিষ্যকে সে কী বলবে -
ইমমিন্দ্র সুতং পিব জ্যেষ্ঠমমর্ত্যং মদম্।
শুক্রস্য ত্বাভ্যক্ষরন্ধারা ঋতস্য সাদনে ॥
সামবেদ ৩৪৪
সরলার্থঃ শিষ্যের প্রতি আচার্যের উক্তি - হে জিজ্ঞাসু এবং বিদ্যুতের মতো তীব্রবুদ্ধিসম্পন্ন আমার শিষ্য ! তুমি আমার প্রদানকৃত এই শ্রেষ্ঠ, চিরস্থায়ী, তৃপ্তিপ্রদ, অধ্যয়ন-অধ্যাপন-বিধি দ্বারা নিষ্পাদিত জ্ঞানরস পান করো। পবিত্র অধ্যয়ন-অধ্যাপন-রূপ যজ্ঞের গৃহে, অর্থাৎ গুরুকুলে আমার বাণী সেই জ্ঞানরসকে তোমার প্রতি ক্ষরণ করে।
সুতরাং আপনি যে রাস্তাতেই যান না কেন আপনার গুরু বা আচার্যের শরণাপন্ন হতেই হচ্ছে। হোক তা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ রূপে। গুরুবাদ এবং আচার্যদের গুরুত্ব দুটোকে এক করা যাবে না।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর