প্রশ্নঃ জীবাত্মা অঙ্গুষ্ঠ বা অণু পরিমাণ বলতে কী বোঝায় ?
উত্তরঃ জীবাত্মা আসলে কেমন ? এটি কি সর্বব্যাপক ? ঋষি জীবাত্মার সূক্ষ্মতার স্পষ্টিকরণের জন্য উদাহরণ দিয়ে বলেছেন -
অঙ্গুষ্ঠমাত্রো রবিতুল্যরূপঃ সংকল্পাহংকারসমন্বিতো য়ঃ।
বুদ্ধের্গুণেনাত্মগুণেন চৈব আরাগ্রমাত্রো হ্যপরোঽপি দৃষ্টঃ॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৫.৮
পদার্থঃ (য়ঃ) যিনি [জীবাত্মা] (অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ) অঙ্গুষ্ঠমাত্র (সংকল্প অহংকার সমন্বিতঃ) সংকল্প এবং অহংকারযুক্ত (রবিতুল্যরূপঃ) সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ (আরাগ্রমাত্রঃ) সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম (অপি) এবং (অপরঃ) অপর [পরমাত্মা থেকে ভিন্ন] (বুদ্ধেঃ) বুদ্ধির (গুণেন) উৎকৃষ্ট গুণ [জ্ঞান] (চ) এবং (আত্মগুণেন) আত্মগুণ [চেতনা] (এব হি) দ্বারাই (দৃষ্টঃ) তিনি দৃষ্ট হন।
সরলার্থঃ জীবাত্মা অঙ্গুষ্ঠমাত্র, সংকল্প এবং অহংকারযুক্ত, সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ। তিনি সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরমাত্মা থেকে ভিন্ন। বুদ্ধির উৎকৃষ্ট গুণ (জ্ঞান) এবং আত্মগুণ (চেতনা) দ্বারাই তাঁকে (জীবাত্মাকে) জানা যায়।
এই শ্রুতিতে জীবাত্মার স্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে। জীবাত্মাকে অঙ্গুষ্ঠমাত্র বলার অভিপ্রায় এই নয় যে, তিনি আঙ্গুলের ন্যায়! অঙ্গুষ্ঠ-পরিমিত হৃদয়পুরীতে অবস্থান করেন বলেই জীবাত্মাকে ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র’ বলা হয়েছে। এই কারণে পুনরায় বলা হয়েছে, তিনি ‘আরাগ্রমাত্র’ অর্থাৎ সূঁচের অগ্রভাগের ন্যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম। আত্মার এই সূক্ষ্মতাকে কোনো জড় বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়। শুধু বোঝানোর সুবিধার্থে এই লৌকিক দৃষ্টান্ত অবলম্বন করা হয়েছে। জীবাত্মা সংকল্প (Determined will) এবং অহংকার (Ego) সমন্বিত, তিনি সূর্যের ন্যায় প্রকাশস্বরূপ অর্থাৎ জড় শরীরে চেতনা প্রদানকারী। যেরূপ সূর্য সমগ্র জগৎকে প্রকাশিত করে, তদ্রূপ জীবাত্মা স্বীয় চেতন-ধর্ম দ্বারা সম্পূর্ণ দেহকে প্রকাশিত করেন। নিজের গুণানুসারে তিনি ‘অপর’ অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন। বুদ্ধির উৎকৃষ্ট গুণ (জ্ঞান) ও আত্মগুণ (চেতনা) দ্বারাই, নিজের আত্মাকে সূক্ষ্মদর্শী যোগিগণ জানতে পারেন। এই বিষয়ে গীতায় (১৫।১০) বলা হয়েছে, “দেহ ত্যাগের সময় অথবা দেহে অবস্থানপূর্বক বিষয়-ভোগকালে বা প্রকৃতির গুণত্রয়ের সঙ্গে সংযুক্ত রূপে এই জীবকে অজ্ঞ ব্যক্তিরা দেখতে পায় না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্র দ্বারা তাকে দর্শন করেন”।
এরপর ঋষি বলছেন -
বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে॥
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৫.৯
পদার্থঃ (বালাগ্রশতভাগস্য) একটি কেশের অগ্রভাগের শতভাগকে (চ) পুনরায় [তার একটি ভাগকে] (শতধা) শতভাগ রূপে (কল্পিতস্য) কল্পনা করলে (ভাগঃ) যে সূক্ষ্ম এক ভাগ হয়
(জীবঃ) জীবাত্মাকে (সঃ) সেই পরিমাণ সূক্ষ্ম বলে (বিজ্ঞেয়ঃ) জানবে (চ) এবং (সঃ) তিনি (আনন্ত্যায়) পরমপদ [মোক্ষ] লাভের জন্য (কল্পতে) সমর্থ, যোগ্য॥৯॥
সরলার্থঃ একটি কেশের অগ্রভাগের শতভাগকে পুনরায় তার একটি ভাগকে শতভাগ রূপে কল্পনা করলে যে সূক্ষ্ম এক ভাগ হয়, জীবাত্মাকে সেই পরিমাণ সূক্ষ্ম বলে জানবে এবং তিনি পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্তির যোগ্য॥৯॥
এই শ্রুতিতে জীবাত্মার অতি সূক্ষ্মতার নিরূপণ করে বলা হয়েছে— একটি কেশের অগ্রভাগকে দশ হাজার ভাগ করলে, তার একভাগ যে পরিমাণ সূক্ষ্ম হয়, জীবাত্মাও তদ্রূপ অতি সূক্ষ্ম। ত্রস-রেণুর তুল্য পরিমাণ কেশের অগ্রভাগের দশ হাজার টুকরো করা সম্ভব নয়। এজন্য এখানে শব্দার্থের প্রধানতা গ্রন্থকারের অভিপ্রেত নয়, বরং বাক্যের মুখ্য আশয় গ্রহণই অভীষ্ট। জীবাত্মা এতটা সূক্ষ্ম হয়েও অনন্ত সামর্থ্য বা পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্তির জন্য সমর্থ॥৯॥
বেদশাস্ত্রে জীবের অণুত্ব সম্বন্ধে একই সিদ্ধান্ত প্রতিপাদিত হয়েছে, যথা— “বালাদেকমণীয়স্কমুতৈকং নেব দৃশ্যতে। ততঃ পরিষ্বজীয়সী দেবতা সা মম প্রিয়া॥ (অথর্ব০ ১০।৮।২৫)” অর্থাৎ জীবাত্মা কেশ থেকেও সূক্ষ্মতর অর্থাৎ অণু-পরিমাণ। প্রকৃতিও দৃষ্টির অগোচর হওয়ার কারণে অব্যক্ত হয়ে আছে। জীবাত্মা ও প্রকৃতি উভয়ের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে এদেরকে আলিঙ্গনকারী দেবতা হলেন পরমাত্মা; তিনিই আমার প্রীতির কারণ হন।
উপর্যুক্ত শ্রুতি পাঠের পর স্বভাবতই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে যে, জীবাত্মা সাকার না কি নিরাকার? জীবাত্মার স্বরূপ বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন— “ঈশ্বরের উপাসনার্থে ভক্তদের পক্ষে তাঁর কোনো না কোনো প্রকারের আকার হওয়া উচিত, এরূপ কথা অনেকের মুখে শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এরূপ বলাও যথার্থ নয়। কারণ এই যে, শরীরে যে জীব রয়েছেন, তিনিও আকার-রহিত— এরূপ সকলে স্বীকার করেন। আকার না থাকলেও আমরা একে অপরকে চিনতে পারি এবং মানুষ প্রত্যক্ষ রূপে কখনো কাউকে না দেখলেও কেবল গুণানুবাদ দ্বারাই [অদৃষ্ট] ব্যক্তির সম্বন্ধে সদ্ভাবনা ও পূজ্যবুদ্ধি পোষণ করে। এই ভাবের কথা ঈশ্বর সম্বন্ধে খাটেনা, এ কথা বলাও সঠিক নয়।” ন্যায়শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে পঞ্চাবয়ব দ্বারাও এই বিষয় প্রস্তুত করা যেতে পারে—
প্রতিজ্ঞা— আত্মা নিরাকার।
হেতু— চেতন হওয়ার কারণে।
উদাহরণ— যেমন, ঈশ্বর।
উপনয়— ঈশ্বর নিরাকার এবং চেতন, তদ্রূপ জীবও চেতন হওয়ার কারণে নিরাকার।
নিগমন— ঈশ্বরের ন্যায় চেতন হওয়ার কারণে জীবও নিরাকার।
এখন এই বিষয়কে শাস্ত্রের প্রমাণ দ্বারা বিচার করা যাক। যোগদর্শনের সূত্র অনুসারে— “ভোগাপবর্গার্থং দৃশ্যম্” (যোগ০ ২।১৮) যা কিছু দৃশ্য (প্রকৃতির বিকার বা কার্য), তা আত্মার ভোগ এবং অপবর্গের (মোক্ষের) সিদ্ধির জন্য। এজন্য ভোক্তা অর্থাৎ আত্মা কখনো দৃশ্য হতে পারে না, নতুবা তিনি ভোগ্য হয়ে যাবেন। দৃশ্য মাত্র সাকারই হয়ে থাকে, অতএব আত্মা সাকার নয়। যোগদর্শনে বলা আছে, “দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধঃ” (যোগ০ ২।২০) অর্থাৎ দ্রষ্টা জ্ঞানস্বরূপ আত্মা সর্বথা শুদ্ধ (নির্বিকার)। এ বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সত্যার্থ প্রকাশের দ্বাদশ সমুল্লাসে লিখেছেন— “দ্রষ্টা দ্রষ্টাই থাকে, কখনো দৃশ্য হয় না। যদি দ্রষ্টা ও ভোক্তা জীবাত্মাকে সাকার মানা হয়, তাহলে তিনি দৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং ভোগ্য হয়ে যাবেন”।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর