একটা অঞ্চলকে যদি উন্নত ধরা হয় তার আর্থিক কাঠামোর মজবুতি আর নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রাচুর্যের ভিত্তিতে, একটা জাতির সভ্যতাকে উন্নত ধরা যায় সে জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাচীনতা ও তত্পরবর্তী বিকাশের ভিত্তিতে। প্রথমটির সংজ্ঞায় আমরা এখনো সংগ্রামমুখর হলেও দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বাঙালি জাতি অত্যন্ত শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে নিঃসন্দেহে। আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির ইতিহাস প্রাচীন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সাহিত্যের ধমনীতেও প্রাচীন রক্তধারা প্রবাহিত। এ কথা খুব কম সাংস্কৃতিক সভ্যতাই গর্ব করে বলতে পারে যে, তারা প্রাচীন মহাকাব্যের উত্তরাধিকারী। বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক সভ্যতার ইতিহাসে ইলিয়াড, ওডিসি, গিলগামেশ কিংবা বেউলফের পাশাপাশি বা তাদের চাইতেও সমৃদ্ধ মহাকাব্য এবং পুরাণের উত্তরাধিকার আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। আমাদের ভাষা বাংলা আজ যে রূপে এসে দাঁড়িয়েছে, তার উত্পত্তি ও ব্যুত্পত্তি গবেষণা করতে গেলে আমরা এতে হাজার বছর আগেকার বৈদিক, সংস্কৃত ও আর্য প্রাচীনতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের শব্দের প্রাচুর্যও লক্ষ করি। কবিগুরুর ভাষায়—
‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার
স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায়
আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-
শক-হুন-দল
পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।’
সত্যিই যেন তাই। বিভিন্ন দেশ ও জাতীয়তার কৃষ্টি আর ভাষার মিথস্ক্রিয়ায় সংস্কৃতপুত্রী বাংলা ভাষা বহুবার বিবর্তিত হয়েছে আর তার সঙ্গেই নব নব রূপে পল্লবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য।
আর আজকের বাংলা সাহিত্য যে কাল অতিক্রম করছে তার পিছনে যদি সাফল্যের বরপুত্র হন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থাকুর সেই মহীরুহের বীজ ছিলেন বাঙালীর আদি কবি, মৈথিলী ব্রাহ্মণ শ্রী শ্রী কৃত্তিবাস উপাধ্যায় যিনি আমাদের মানসপটে কৃত্তিবাস ওঝা নামেই সমাদৃত।উল্লেখ্য যে মৈথিলী ব্রাহ্মনদের অসমিয়া ভাষায় ‘ওঝা’ বলা হয়।
মাইকেল মধুসুদন দত্তের ভাষায় তিনি বাংলার জাতীয় কবি।কেনই বা নয়?হিন্দি ভাষাভাষীদের আছে রঘুবংশ,দক্ষিন ভারতের আছে কম্বনরামায়ন,পেরিয়া পুরান,কিন্তু সমগ্র বাঙ্গালী সমাজের প্রতিমূর্তি,বাঙালীর ঘরোয়া জীবনের সুখদুঃখ হাসিকান্না সমস্ত রাগ অনুরাগ বিরাগের গাঁথা কি যার সাথে আমরা একসাথে হাসব গাইব?তখন ই বাংলার আকাশে তৎকালীন রাজশাহী জেলার অন্তর্গত প্রেমতলী গ্রামে আবির্ভূত হলেন তিনি,মূল বাল্মীকি রামায়নের উত্তর ভারতের দেবোপম পুরুষোত্তম শালপ্রাংশু মহাভুজ,অসীম শক্তির শ্রী রামচন্দ্রকে পাল্টে দিলেন প্রেমময় আরাধ্য অবতারে,বাঙ্গালী ঘরের ছেলে হিসেবে তাকে তুলে ধরে লিখলেন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে আলাদা একটি গ্রন্থ,জানকী সীতা সেখানে আসল সীতার ন্যায় সবলা সাহসিনী আর্য নারী নন বরং চিরকালীন বাঙ্গালী বধু যে রাবনের ভয়ে “কাঁপে যেন কলার বাগুড়ি”। রাম ও রাবণের ভীষণ যুদ্ধের দামামা রোলকে করলেন ভক্তিবাদের গৈরিক-রেণু-রঞ্জিত গীতকাব্য,তাই হল বিখ্যাত শ্রীরাম পাঞ্চালি(পাঁচালী) যা আমরা কৃত্তিবাসী রামায়ন নামেই চিনি।
কয়েকপর্বে আমরা দেখব বাঙ্গালী এ কবি কিভাবে মূল রামায়ণকে অবলম্বন করে নিজস্ব মনোজগতের প্রতিভার স্বাক্ষরে নতুন নতুন কাহিনীযুক্ত একটি রামায়ন লিখেছিলেন।
পর্ব ১
রামায়ণ এর সৃষ্টি প্রসঙ্গে বাল্মীকি
রামায়নের মূল ঘটনা এবং কৃত্তিবাস ওঝার কবিকল্পিত কাব্যকাহিনী
বাল্মীকি রামায়ণে আছে, কোন একদিন মুনিবর বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সাথে নিয়ে তমসা-তীর্থযাত্রা
পথে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক শোভা সন্দর্শনে বিমুগ্ধ হয়ে ইতস্তত বিচরণ করছেন। এক
ব্যাধ বাল্মীকির সম্মুখেই এক ক্রীড়ারত ক্রৌঞ্চযুগলের মধ্যে পুরুষ ক্রৌঞ্চকে
তীরবিদ্ধ করে । স্ত্রী ক্রৌঞ্চটি করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে । এই দৃশ্য দেখে
ক্রুদ্ধ বাল্মীকির মুখ থেকে অভিশাপ বাণীর আকারে উচ্চারিত হয় সৃষ্টির প্রথম শ্লোক :
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
বাল্মীকি রামায়ণ; ১.২.১৫
এ পংক্তিটিকে সংস্কৃত সাহিত্য সৃষ্টিধারার আদি কবিতা ভেবে বাল্মীকিকে ‘আদি-কবি’ও বলা হয়ে থাকে ।
এরপর মুনিবর শিষ্যগণকে নিয়ে আশ্রমে
উপবিষ্ট আছেন এমন সময়ে সেখানে
একজন ঋষি উপস্থিত হলেন। তিনি শ্রদ্ধেয় সেই ঋষিকে ব্যাধ-বৃত্তান্ত বলে
স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। ঋষি বললেন,
“শোকের সময় এটি তোমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অতএব, এটি শ্লোক নামে অভিহিত হউক। তুমি এরূপ শ্লোকে রামচরিত্যাখ্যায়ক রামায়ন গ্রন্থ রচনা কর।রাম যিনি এই লোকে ধর্মাত্মা,গুণবান,ধিরস্থির,জ্ঞানী বলে প্রসিদ্ধ তার ইতিহাস বর্ণনা কর।"
সেই অনুসারে মুনিবর বাল্মীকি ওই ছন্দে রামায়ণ রচনা করেন।
“শোকের সময় এটি তোমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অতএব, এটি শ্লোক নামে অভিহিত হউক। তুমি এরূপ শ্লোকে রামচরিত্যাখ্যায়ক রামায়ন গ্রন্থ রচনা কর।রাম যিনি এই লোকে ধর্মাত্মা,গুণবান,ধিরস্থির,জ্ঞানী বলে প্রসিদ্ধ তার ইতিহাস বর্ণনা কর।"
সেই অনুসারে মুনিবর বাল্মীকি ওই ছন্দে রামায়ণ রচনা করেন।
শোক থেকে উৎপন্ন এই সংস্কৃত সাহিত্যের
প্রথম শ্লোক। পরবর্তীকালে এই শ্লোকের ছন্দেই বাল্মীকি সমগ্র রামায়ণ রচনা করেন। এই
কারণে এই শ্লোকটিকে হিন্দু সাহিত্যের প্রথম শ্লোক, রামায়ণকে প্রথম কাব্য ও বাল্মীকিকে আদিকবি নামে অভিহিত করা হয়।
অপরদিকে কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ সৃষ্টির
বিখ্যাত গল্পটি সবাই জানেন।তারপরেও
আপনাদের সুবিধার্থে উপস্থাপন করছি।
কৃত্তিবাস রামায়নে বাল্মীকি
ছিলেন দস্যু রত্নাকর।যে জঙ্গলে তারা বাস করতেন তার মধ্যে
দিয়ে পথিকদের যাতায়াতের জন্য একটি পথ ছিল। রত্নাকর সারাদিন সেই পথের ধারে গাছের
আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন। কোনও পথিক সেই পথ দিয়ে এলেই তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে প’ড়ে সর্বস্ব লুঠ ক’রে তাঁকে হত্যা করতেন। একদিন তমস্যা নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন নারদ মুনি।
নারদমুনির সঙ্গে ছিলেন ব্রহ্মা। তাদের দেখে রত্নাকর আক্রমন করে এবং তাদের বেঁধে
ফেলে।
রত্নাকর বললেন, “তোমাদের কাছে যা ধনসম্পদ আছে, তা এখনই বের ক’রে দাও। তারপর তোমাদের হত্যা করবো। তার আগে ভগবানের কাছে
প্রার্থনাটুকু সেরে নাও।”
রত্নাকরের সঙ্গে এই পথে যাঁরই একবার দেখা হত তাঁকে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে হত
না।
ঐ ৭ ঋষির মধ্যে ঋষি অত্রি রত্নাকরকে বললেন, “শোনো দস্যু, আমাদের হত্যা করার আগে আমার দু’টো কথা তোমাকে শুনতে হবে। দেখো, আমরা তীর্থযাত্রী। আমাদের কাছে খুব
সামান্যই ধনসম্পদ আছে। এই সামান্য ধনের জন্য তুমি ঋষি হত্যার পাপ বহন করবে কেন...?”
রত্নাকর অবজ্ঞাভরে বললেন, “দেখুন, আমি পাপকে
মোটেও ভয় পাই না। তার কারণ, এই বৃত্তি পালন ক’রে আমি আমার সংসার প্রতিপালন করি। কেবলমাত্র আমার নিজের জন্য একাজ করি না।”
ঋষি অত্রি বললেন, “তাহলে কার জন্য তুমি এপথ বেছে নিয়েছ...?”
দস্যু বললেন, “আমি পথিকদের হত্যা ক’রে যে ধনসম্পদ লুঠ করি তা দিয়ে আমার পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণ করি। অতএব তাঁরাও নিশ্চয়ই এই পাপের
দায় বহন করবেন।”
ঋষি অত্রি বললেন, “তুমি ভুল করছো। এই পাপের দায় একান্তই তোমাকে বহন করতে হবে। তোমার সংসারের আর
কেউই এই পাপের দায় বহন করবেন না।”
দস্যু এর প্রতিবাদ করলে ঋষি অত্রি বললেন, “ঠিক আছে, তুমি আমাদের গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে বাড়িতে গিয়ে তোমার
পিতা-মাতা ও স্ত্রী-পুত্রকে জিজ্ঞাসা ক’রো যে, তাঁরা তোমার এই পাপের বোঝা বহন করতে স্বীকার করছেন কি...?”
রত্নাকর বাড়িতে এসে সবাইকে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু একজনও তার
পাপের ভাগী হতে রাজি হল না।তখন রত্নাকর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন।তিনি ফিরে ঋষিদের
কাছে ক্ষমা চাইলেন।মুক্তির পথ জিজ্ঞেস করলেন।
তখন নারদ বললেন, তাকে ৬০ হাজার বার ‘রাম’ নাম জপ করতে হবে। তবেই সে
মুক্তি পাবে। রত্নাকর যত বার চেষ্টা করল রাম বলার,
তার মুখ দিয়ে শুধু মরা বেরুলো, 'মরা'। কারণ এতো খুন সে করেছে,এত পাপ তার জমেছিল।
রত্নাকরের চিত্ত
চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আত্মশুদ্ধি কীভাবে হবে এই তখন তাঁর একমাত্র চিন্তা।
একটা গাছের নীচে একাসনে ব’সে তিনি রাম নাম জপ করে চললেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে একমনে জপ ক’রে চলেছিলেন।
এভাবে জপ করতে করতে তাঁর চারপাশে নানা আগাছা গজিয়ে উঠল। তাঁর সারা শরীর ঢেকে
গেল বল্মীক বা উইপোকায়। বল্মীকে তাঁর দেহ ঢেকে গিয়েছিল ব’লে তাঁর নাম হয়েছিল ‘বাল্মীকি’।
রত্নাকর ‘রাম-নাম’ জপ করে
আত্মজ্ঞান লাভ করলেন এবং মহর্ষি হিসেবে বরণীয় হলেন। তাঁর দস্যুবৃত্তির নৃশংসতা
বল্মীকের মতোই ঝড়ে পড়ে গেল।
প্রিয় পাঠকগন তাহলে বুঝতেই পারছেন এই
যে রত্নাকর দস্যুর বাল্মীকি হয়ে উঠার বিখ্যাত গল্প টি তা একদম ই বাস্তব নয় বরং
মানুষ কে নৈতিক শিক্ষা দেবার জন্যে কবি কৃত্তিবাস ওঝার এক মহান সাহিত্যিক
প্রচেষ্টা।মুলত ঋষি বাল্মীকি খুব বিখ্যাত একজন ঋষি ছিলেন যিনি আজীবন বেদবিধি
অনুসারে জীবনযাপন করেছেন এবং রঘুকুল শিরোমণি সর্বকালের মহামানব শ্রীরামচন্দ্রের
জীবনী দেখে যাতে মানুষ শিক্ষাগ্রহন করতে পারে সেই মর্মেই রামায়ণ রচনা করেছিলেন।
চলবে…
তথ্যসূত্র-
তথ্যসূত্র-
- Ramayana,Three Hundred Version by A K Ramanujan
- The Rama Story,Origin and Development,Camille Bulcke
- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা- প্রফেসর সৌমিত্র শেখর