সর্বাধিক দুঃখ কে দেয় ? যদি সংসারে সব থেকে অধিক দুঃখ দেওয়া জন্তু কেউ থাকে সে হল মনুষ্যই
_________________________________________
পরমেশ্বর তো পরমেশ্বরই :— অবৈদিক মতের সাথে বৈদিক ধর্মের একটি বিশেষ মৌলিক পার্থক্য হল যে বৈদিক
ধর্ম পরমাত্মাকে মনুষ্য মানে না এবং মনুষ্যকে পরমাত্মা মানে না । আমরা পরে এই কথাটিকে আরও স্পস্ট করার জন্য বলবো যে বৈদিক ধর্মে ঈশ্বরকে নর
অথবা নারী অথবা নর-পশু (যথা নরসিংহ) তৈরি করা
হয়নি এবং না তো মানুষকে পরমেশ্বর অথবা পরমেশ্বরের রূপে বর্ণিত করা হয়েছে । মানুষকে পরমেশ্বরের মত বলা, জানা এবং
মানা হল অত্যন্ত হাস্যম্পদ মান্যতা ।
আমরা কোন কোন মত, পন্থ বা গ্রন্থের বিবেচনার চর্চা
করব ? প্রবুদ্ধ পাঠক স্বয়ং পড়ে নিন, অম্বেষণ করে নিন, একটুখানি বিবেক বুদ্ধি
দিয়ে বিচার করে নিন — তাহলে অবৈদিক মতবাদের ঈশ্বর
বা মানুষের স্বরূপ বিষয়ক এইসব ভ্রমোৎপাদক মান্যতা চোখের সামনেই প্রকট হয়ে যাবে । তথাপি পাঠক সংকেতরূপে কিছু জানতে চান তাই আমরা সংক্ষেপে কিছু নিবেদন করছি,
—
পৌরাণিক হিন্দুরা অবতারবাদের মান্যতাকে সৃজন করে প্রভুকে নরদেহধারী রূপে
পরিলক্ষিত করেছে । পরমাত্মাকে পরমাত্মা থাকতে
দেয়নি।সর্বত্রকে এককে পরিনত করে দিয়েছে।সর্বব্যাপক,সর্বজ্ঞ
তথা সর্বশক্তিমান প্রভু যখন একটি দেহতে বন্ধ হয়ে গেল কখন সে সর্বব্যাপক থাকল কি ? ‘সর্বৈব’ — এই শব্দটির অর্থই তো থাকল না । উক্ত সম্বন্ধ বিষয়ক বিবেচনা পাঠক পুস্তকের অন্যত্র -ও পড়বেন। ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা কার্য নেওয়া বা ইন্দ্রিয় সমূহের উপর আশ্রিত অবতার তো
সর্বজ্ঞতাকে নিঃশেষ করেই দেয় ।
এই অতি বিচিত্র মান্যতার কারণে পৌরাণিকেরা মনুষ্যকে পরমাত্মা রূপে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছে । শ্রীরামকে, শ্রীকৃষ্ণকে
মহামানবের জায়গায় পরমাত্মা রূপে চিহ্নিত করে দিয়েছে । মহাত্মা
বুদ্ধকে অবতার মেনে ভগবান করে দিয়েছে । মহারাজ
রামচন্দ্র মাতা সীতার হরণের পর কতখানি ব্যাকুল হয়েছেন?বাল্মীকি
রামায়ন পড়ে দেখুন।অন্যের সহায়তা নিয়েই শ্রীরাম মাতা সীতাকে খুঁজেছেন এবং ফিরে
পেয়েছেন। পরমাত্মা তো সর্বদা পরমানন্দময়। তাঁর শোকাকুল হওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না । অন্যদের কাছে মাতা সীতার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা
করা বা জিজ্ঞাসা করানো ব্যক্তি রাম কি সর্বজ্ঞ ছিলেন ? তিনি কি সর্বশক্তিমান ছিলেন ?
উত্তরের আশায় ঘুরে মরছে প্রশ্ন। :— চওরা মুখ করে এই ধরনের অনেক প্রশ্ন যুগ যুগ শতাব্দী ধরে উত্তরের আশায়
যত্র তত্র ঘুরে মরছে । পৌরাণিকেরা এইসব
প্রশ্নের উত্তর কেন দেবে, কী দেবে ? এইসব ভালো লোকে বা ভগবানকে ভগবান থাকতে দেয়নি এবং মানবকে মানব থাকতে দেয়নি
।
‘অবতার’ শব্দ কে প্রয়োগে এনেছে ?
এমনিতে জানা দরকার যে ‘অবতার’ শব্দ কে তৈরি করেছে ? চার বেদ, ছয়টি দর্শন, এগারটি উপনিষদ, মনুস্মৃতি, বাল্মীকি
রামায়ন এবং মহাভারতে তথা গীতাতে তো অবতার শব্দই নেই ।অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা হল যে
ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞান বেদ বা কোন আর্য গ্রন্থে না থাকা সত্ত্বেও পৌরাণিকেরা কোটি
কোটি লোকেদের এই অবতারবাদের কল্পিত ভ্রমজালে ফাঁসিয়ে রেখেছে। এবার খ্রীস্টান মতের
দিকে চলুন!বাইবেলও পরমাত্মাকে মনুষ্য এবং মনুষ্যকে পরমাত্মা তৈরি করার চক্র উপলব্ধ
হবে । আমরাই বা কী বলব ? বাইবেল কেই জিজ্ঞাসা করি । বাইবেল এর Book
Of Genesis পুস্তকে স্পষ্টরূপে এসেছে —
“And God said, let us make man in our own image, after our
likeness.”
অর্থাৎ তখন ঈশ্বর বললেন— আমরা মনুষ্যকে আমাদের
স্বরূপে আমাদের মতো করে তৈরি করি । এবং পুনরায় পাঁচ লাইনের পশ্চাতে এই কথাটাই আবার বলা হল—
“And
God created man in his own image, in the image of God created he him ; male and
female created he them.”
(Book
Of Genesis 26.27)
অর্থাৎ তখন ঈশ্বর মনুষ্যকে নিজের স্বরূপে উৎপন্ন করলেন । সে তাঁকে ঈশ্বরের স্বরূপে উৎপন্ন করলেন। সে
তাঁকে নর বা নারী তৈরি করলেন।
এখন পাঠক বিচার করুন কি যখন পরমাত্মা নর বা নারীকে নিজেরই স্বরূপে উৎপন্ন
করলেন তখন জানা গেল যে পরমেশ্বর ও মানুষ্যেরই মতো এবং মনুষ্য পরমেশ্বরের মতো। এই
দুইটির মধ্যে কি পার্থক্য রইল ? এখানে এমন অনেক
প্রশ্ন দেখা দিল যে তাঁর উত্তর দেয়ার কোন পাদ্রী বা পোপের পক্ষে সম্ভব নয়। যে যে দুর্বলতাগুলি মনুষ্যদের মধ্যে আছে সেইগুলি God
এর মধ্যেও আছে একথা মানতে হবে । কারণ? মনুষ্য পরমাত্মার স্বরূপেই তো তৈরি
হয়েছে । লোকেরা এটা ভাবল না যে মনুষ্যের মধ্যে তো
পরমাত্মার গুণ পবিত্রতা, ন্যায়, দয়া, সর্বজ্ঞতা আসুক বা না আসুক, পরমাত্মাতে তো এঁরা মানবীয় দুর্বলতাগুলিকে চাপিয়ে দিয়েছে । এখন ঈশ্বর এই বোঝাকে বইতে থাকুক। এঁনার
যা করার ছিল তা তো করে দিয়েছেন ।
ইসলাম মতের মান্যতাও প্রায় উক্ত
প্রকারের। কোরাণের মতে স্রষ্টা অর্শতক্তে (আকাশস্থ
তক্ত) বিরাজমান আছেন । সেই
সিংহাসনকে ফেরেশতাগণ উপরে উঠিয়ে রেখেছে । এই
আল্লার ডানদিক আছে, বামদিক আছে, সম্মুখ আছে,পশ্চাৎ আছে । সে
মুখ দিয়ে বলে । শাসকগণের মতো তাঁর দূত আছে । তাঁর সৈনিক আছে এবং তাঁকে কর্জা-ও নিতে হয়। আল্লাহ
মিয়াঁর একটি উটনীও আছে ।এইসব পড়ে,শুনে কে সেই আল্লাহকে
সর্বব্যাপক,সর্বজ্ঞ এবং নিরাকার বলে স্বীকার করবে?
এই ধরণেরই প্রশ্ন স্বয়ং কোরাণকারের মনের মধ্যে জেগে থাকবে, তাই কোরাণের কোনো স্থানে আল্লাহর সম্বন্ধে এটাও বলা হয়েছে যে—
“তার মত কেউ নাই”
কোরাণের এই বেদোক্ত উদ্ঘোষ যুক্তিসঙ্গত এবং নিত্যসত্য। এই যুগে মহর্ষি দয়ানন্দজী বৈদিক ঘোষ করে, ঈশ্বরকে যেখানে সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বাধার, অজর, অমর, অনাদি, নিত্য, পবিত্র এবং
সৃষ্টিকর্তা বলেছেন সে খানে পরমেশ্বরকে ‘অনুপম’ও বলেছেন । দয়ালু দয়ানন্দের
এই উক্তিটি হল মৌলিক অবদান যাঁর দ্বারা জোর দিয়ে প্রভুকে ‘অনুপম’ বলেছে । কল্যাণীবাণী বেদে পরমেশ্বরের
জন্য বলা হয়েছে —
‘ন তস্য প্রতিমা অস্তি’ (যজুঃ ৩২/৩)
এই সূক্তির অর্থ তো এটাই যে তাঁর কোন প্রতিমা নাই । এই সুক্তির আরও একটি অর্থ হল যে পরমাত্মার সদৃশ্য কেউ -ই নাই ।
এখানে আমাদের শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায়ের একটি কথা বার বার
স্মরণ আসছে । তাঁর এই বচনকে আমরা গাগরে সাগর বলে
অভিহিত করব । তিনি ঋষি দয়ানন্দের অবদানের চর্চা
করে লিখেছিলেন-
“He has given us a bold philosophy of life. A
philosophy of the reality of God, reality of man and the reality of the
universe in which man has to live in his is a philosophy of bold actions and
not of ideal musings.”
অর্থাৎ ঋষি দয়ানন্দ আমাদেরকে বীরোচিত একটি জীবনদর্শন দিয়েছেন।এক প্রভুর
সত্যতার দর্শন, মনুষ্যের সত্যতার দর্শন এবং সেই
ব্রহ্মাণ্ডের সত্যতার দর্শন দিয়েছেন যাঁর মধ্যে মনুষ্যকে জীবন ব্যতীত করতে হয়। সেই ঋষির জীবন-দর্শন হল সাহসপূর্ণ কার্যের দর্শন, না কি নিরর্থক চিন্তনের ।
এই মর্মিক কথনের ভাব হল এই যে, বৈদিক
দর্শন এবং ধর্ম ঈশ্বরকে ঈশ্বর মানে । ঈশ্বরের
একটি পৃথক সত্তা আছে । এ হল একটি নিত্য সত্য। মানুষের নিজস্ব সত্তা আছে । এটিও একটি অনাদি
সত্য এবং এই জগৎটিও মিথ্যা নয়, প্রকৃতি থেকে উৎপাদিত এই জগৎটিও হল এক সত্য। এই সৃষ্টি হল প্রবাহতে অনাদি । ঈশ্বর, জীব এবং প্রকৃতি এই তিনটির নিজস্ব সত্তা রয়েছে । এই সত্যকে কে মিথ্যা করতে পারে ?
বৈদিক ধর্ম ঈশ্বরকে মানুষরূপে পরিগণিত করে না । মানুষকে পরমেশ্বর বলে না এবং পরমাত্মা থেকে প্রকৃতিকে উৎপন্ন মানে না /
অন্যান্য মতের সঙ্গে বৈদিক ধর্মের এটি হল মৌলিক পার্থক্য । এই পার্থক্যকে না বুঝতে পেরে মতবাদীরা ঈশ্বর এবং মনুষ্যের সত্তা, স্বরূপ তথা জগতের উৎপত্তির বর্ণনা করতে গিয়ে সব কিছুই গণ্ডগোল করে দিয়েছে । প্রভু কৃপা করুন যে, সমস্ত লোক
পূর্বাগ্রহ থেকে মুক্ত হয়ে এই মৌলিক পার্থক্যকে হৃদয়ঙ্গম করুক ।
অবলম্বন- মৌলিক পার্থক্য,প্রফেসর
রাজেন্দ্র জিজ্ঞাসু