বৈদিক
ধর্ম এবং অন্যান্য মত - মতান্তরগুলির
মধ্যে কী পার্থক্য ? এঁর উপর অনেক দিন ধরে
বিচার -বিমর্শ করে আসছি । আমি যা কিছু বুঝেছি বা পেয়েছি তা আমি বিচারশীল সজ্জনদের কাছে তুলে ধরছি ।
প্রথম মৌলিক পার্থক্য হল যে মত - মতান্তরবাদীরা
তাঁদের নিজস্ব মান্যতাগুলিকে তো মানে কিন্তু সেই মান্যতাগুলির উপর কখনও মনন করতে
চায় না । মনন করার
মনোবৃত্তিও নাই । অবৈদিক মতবাদীদের মধ্যে মনন করার কোন মহত্ত্বই নেই । মতবাদীদের মতগুলির মধ্যে হৃদয়ের স্থান তো রয়েছে কিন্তু মস্তিষ্কের জন্য
কোন স্থান নেই ।
ঈশ্বরের
স্বরূপ :— ঈশ্বরের স্বরূপ-কেই ধরুন না ! মতমতান্তরগুলি ঈশ্বরের পূজার উপর তো বেশ জোর দিয়েছে পরন্তু ঈশ্বরের
স্বরূপটি কী— এঁর উপর বিচার করা হয়ই নি । পরিণামে মূলের মধ্যেই ভুল রয়ে গেছে এবং মানব সমাজের প্রচুর অহিত এবং
অনিষ্ট হয়ে চলছে ।
ইসলাম এবং খ্রীস্টান মতের মধ্যে ঈশ্বরকে একদেশী বলে স্বীকার করা হয়েছে । পৌরাণিক বিশ্বাসও এই ধরনের মান্যতা রাখে । এই ধরনের বিচার রাখা সত্ত্বেও সমস্ত মতবাদী লোকেরা সংসারে ঈশ্বর প্রাপ্তির
জন্য পূজা, উপাসনার উপর বল.দেন । উক্ত মতবাদীরা ভগবানকে চতুর্থ বা সপ্তম আকাশে, ক্ষীরসাগরে
বা কৈলাশ পর্বতে অবস্থিত বলে বিশ্বাস করে । যদি তাই হয়, তাহলে এখানে
ভগবান কি করে পাওয়া যাবে ? তিনি তো অনেক
দূরে।অভাব থেকে ভাব বা ভাব থেকে অভাব হতে পারে না । এ হল দর্শন এবং বিজ্ঞানের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত । অতএব মতবাদীদের দ্বারা জগতে প্রভু - প্রাপ্তির
চেষ্টা করা তাঁদের নিজেদের মান্য করা মান্যতানুসারে হল ব্যর্থ । যখন মত মতান্তরের ঈশ্বর এখানেই নেই তাহলে জগতের মধ্যে তাকে কি করে
পাওয়া যাবে ? সমস্যা হল এই মতবাদীরা
প্রশ্নকর্তাকে প্রশ্নের দ্বারা উত্তর চাওয়ার অধিকার দেয় না ।
পৌরাণিকেরা ঈশ্বর পূজার ঢোল তো খুব পিটান কিন্তু করেন মূর্ত্তিপূজা । এঁর নামই হল মূর্ত্তিপূজা । এ কি করে ঈশ্বর
পূজা হবে ? এধরনের শঙ্কা করবে না ।
বেদের অনাদিবাণী পরমেশ্বরের স্বরূপকে নিম্ন শব্দে ব্যক্ত করেছে —
‘ব্যপ পুরুষঃ’— (অথর্ব বেদ ২০/১৩১/১৭) — অর্থাৎ প্রভু
হলেন সর্বব্যাপক ।
“সৎ ওত প্রোতশ্চ বিভুঃ প্রজাসু —
(যজুঃ ৩২/৮)
অর্থাৎ ঈশ্বর প্রাণীদের মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে রয়েছেন । সর্বব্যাপক ঈশ্বরকে এই জগতেই পাওয়া যেতে পারে । যিনি এখানে নেই তাঁকে পাবো কি করে ? উপরে
বলা হয়েছে যে পুরাণী (পৌরাণিক) , কিরাণী (খ্রীস্টান) , কুরাণী (মুসলমান) ঈশ্বরকে ক্রমশঃ ক্ষীরসাগর, কৈলাশ পর্বত, চতুর্থ অথবা সপ্তম আকাশে বিরাজমান আছেন বলে মনে করে । অতএব উক্ত মতবাদীদের ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য সেখানেই যাওয়া উচিৎ যেখানে ঈশ্বর
বিরাজমান রয়েছেন। বৈদিক ধর্ম ঈশ্বরকে দুরের
সিংহাসনে বসে থাকা একদেশী মানেন না ; ঈশ্বর হলেন
সর্বব্যাপক, সবদেশী। এই
বৈদিক মান্যতাকে স্বীকার করলে মতবাদীদের পূজা উপাসনা করা নিরর্থকই হবে ।
বেদ ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ, সর্বব্যাপক এবং
নিরাকার বলে । ঈশ্বর সাকার হতেই
পারে না । বায়ুতে, জলেতে, লোক - লোকান্তরে অনেক ছোট বড় প্রাণী আছে । এমনই অনেক জীবজন্তু আছে যাঁকে চোখে দেখা যায় না । যদি ঈশ্বরকে সাকার ভাবা যায় তাহলে ছোট ছোট কীট -পতঙ্গের শরীর নির্মাণ সাকার ঈশ্বর কি করে করেছেন। নিরাকার ঈশ্বর বড় থেকে
বড় এবং ছোট থেকে ছোট শরীর অথবা পদার্থের নির্মাণ বিনা কষ্টে করতে পারেন বলেই তিনি
হস্তিনী বা প্রজাপতির গর্ভে ব্যাপক রয়েছেন।
ঈশ্বর পরাশ্রিত নন :— মতমতান্তরের লোকেরা ঈশ্বরকে সৃষ্টির রচয়িতা তো মানেন পরন্তু ঈশ্বরকে পর -আশ্রিত করে দেন । তাঁর সৃষ্টি তাঁর অধিনে নয় । তাঁদের দূতগণের বা পুতগণের দয়ার উপর এবং কোথাও কোথাও এটাও মানেন যে ঈশ্বর হলেন সবকিছু, ঈশ্বর যা চান তাই করেন ; ঈশ্বরই সবকিছু করেন এবং কখনও এটাও বলেন যে ঈশ্বরই সব কিছু করান।
ঈশ্বর হলেন নিয়ন্তা :— অনাদি বেদ ঈশ্বরকে “ঋতস্য যোনি” রূপে বর্ণিত করে । এই বিশ্ব নিয়মে
বাঁধা রয়েছে। নিয়ন্তা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর যা চান তাই করেন— এটা বৈদিক
মান্যতা নয়। ঈশ্বর যা চাইবেন তাই করতে পারবেন এটি
হল একটি চাটুকারিতা ; দার্শনিক সত্য নয় । চাপলুসী এবং সত্যের মধ্যে কি সম্বন্ধ ? মতবাদীরা ঈশ্বরের উপাসনা করে না, চাপলুসী
করে । এই চাটুকারিতা প্রত্যেক প্রবুদ্ধ ব্যক্তিকে চিন্তিত করে তোলে। এক মুসলমান কবি নজীর আকবর ইলাহাবাদী এই মনোবৃত্তির উপর ব্যঙ্গ করে একটি বড়
ধরনের কবিতা লিখেছেন —
জো খুশামদ করেখল্ক উসসে সদা রাজী হ্যায়।
সচতো ইহ হ্যায় কি খুশামদ সে খুদা রাজী
হ্যায়।।
অর্থাৎ যে খুশামদ করে তাঁর উপর সমস্ত প্রাণী প্রসন্ন থাকে কিন্তু
সত্য তো এটা, যে খুশামদ করে তাঁর উপর
খুদা প্রসন্ন থাকে ।
ঈশ্বর না তো সবকিছু করেন, না
সবকিছু করান :— বেদ এটা মানে না যে ঈশ্বরই সবকিছু করেন, না সবকিছু তিনি করান। ঈশ্বর এবং জীবের
কর্তৃত্বের উপর পরে কিছু বিচার করা হবে । এখানে এটি জানা উচিৎ যে ঈশ্বরের নিয়মগুলিকে কখনও ভঙ্গ করা যেতে পারে না । ঈশ্বর স্বয়ং ও তাঁর নিজের নিয়মগুলিকে ভাঙ্গেন না । সৃষ্টির নিয়মকে ভেঙ্গে দেওয়ার জীবের কুচেষ্টার পরিণাম দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর
অন্য কিছু হতে পারে না। ঈশ্বর তাঁর সামর্থের
দ্বারা সৃষ্টির সঞ্চালন করেন তিনি পরের আশ্রিত নন । বেদ বলছে— “বিশ্বস্য মিষতো বশী” অর্থাৎ এই বিশ্ব তাঁর বশে রয়েছে । দূতগণের দ্বারা, বা পূতগণের দ্বারা বিশ্ব-সঞ্চালনের প্রশ্নই উঠে না । বিভিন্ন মত-মতান্তরের সাথে বৈদিক ধর্মের এটি হল একটি
মৌলিক ভেদ ।
ঈশ্বরের জ্ঞান এবং কর্ম :—
বেদের সাথে অন্যান্য মতাবলম্বীদের মৌলিক পার্থক্য হল যে মতবাদীরা
ঈশ্বরের জ্ঞান এবং কর্মের মধ্যে সঙ্গতি, সামঞ্জস্যকে
স্বীকার করে না।মতবাদীদের মধ্যে সৃষ্টি - নিয়মের বিরুদ্ধ কথাবার্তা, চমৎকারকের
নমস্কার, এবং আদি সৃষ্টিতে ঈশ্বরীয় জ্ঞানের
আবির্ভাবে অবিশ্বাস অথবা আজ সেই জ্ঞানকে (আদি সৃষ্টির
সময় প্রাপ্ত হওয়া ঈশ্বরীয় জ্ঞান) অনুপযোগী মানা— এগুলি সব ঈশ্বরের জ্ঞান এবং কর্মের মধ্যে সঙ্গতি না মানার পরিণাম নয় তো আর
কি?
ঈশ্বরের রচনা, ঈশ্বরের ঋত এবং সত্যের দর্শন— এগুলো মতবাদীদের কাছে ঈশ্বরের মহানতার প্রমাণ নয়। সেই প্রভুর নিয়ম ভঙ্গ বা
নিয়মকে ভেঙ্গে দেখানো অর্থাৎ চমৎকার-ই হল কোন ব্যাক্তিকে কোন
মতের মধ্যে নিয়ে আসার মুখ্য যুক্তি । মতাবলম্বীদের মধ্যে সৃষ্টি-নিয়মগুলিকে
ভেঙ্গে বা বদলে দিয়ে দেখানোর দাবি করা ব্যক্তি ধার্মিক বা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে বড়
হয় । বৈদিক ধর্মে মহানতার
কষ্টিপাথর হল নিয়মের পালন, উলঙ্ঘন নয়। বৈদিক ঋষি ঈশ্বরের নিয়মগুলির পালন করেন, প্রভুর
শাশ্বত নিয়মগুলির প্রচার করেন, ঈশ্বরীয় জ্ঞানের
প্রকাশ এবং প্রসার করেন। তাঁরা কখনও নিয়ম -ভঙ্গ করেন না । বেদ এই পথকে কল্যাণ-পথ বলে মান্যতা দেয় । বেদের বচন হল—
“সুগা ঋতস্য পন্থাঃ” (ঋক্ ৮/৩১/১৩) অর্থাৎ ঋতের মার্গ
সরল হয়। বেদের আজ্ঞা হল — “ঋতস্য পথ্যা অনু”
(সামবেদ ১/৫/৭/৭) অর্থাৎ ঋতের রাস্তায় চল।
যারা মিরাকলে বিশ্বাস করেন তাঁদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হল যে
চমৎকার(মিরাকল)সৃষ্টি নিয়মের অনুকুল বা প্রতিকুল ? মহান আর্য দার্শনিক পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় লিখেছেন—
The
occurrence of an un-natural phenomenon is a contradiction of terms. If it is
natural, it must occur. Then,is it anti-natural ? Who can defy
nature success fully?”
(Superstitions;Page 13)
অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটা পরস্পর-বিরোধী তত্ত্ব।যদি ঘটনা টা প্রকৃত হয় তাহলে তা প্রকৃতির বিরুদ্ধে হয় কি করে?আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে হলে প্রকৃত হয় কি করে?তাহলে তো তা অবাস্তব! সৃষ্টির নিয়মকে পরিবর্তন করতে কে ই বা সফল হতে পেরেছে?
বেদের সিদ্ধান্ত হল যে ঈশ্বর হলেন নিত্য,তাঁর জ্ঞান
নিত্য এবং তাঁর কর্মও নিত্য।যেখানে ঈশ্বরের নিয়ম ভাঙবে, মনে করবে সেখানে তাঁর সত্তার অভাব আছে । একজন বিদ্বান
বলেছেন— নিয়মের অভাবে আমি এটাও জানতে পারিনা যে ক্ষুধা কি করে মিটে?লোকে তখন বলবে এও তো সম্ভব যে আজ খাওয়াতে মিটেছে,কাল
গান গাইতে মিটবে,পরশু হয়তো কাঁদলে।কিন্তু নিয়ম আছে বলেই
আমরা জানি তা সম্ভব নয় মোটেই!
চলবে...
অবলম্বন- মৌলিক পার্থক্য,প্রফেসর
রাজেন্দ্র জিজ্ঞাসু
পর্ব ২ এর লিংক https://www.agniveerbangla.org/2018/05/blog-post_16.html