দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বৈদিক ঈশ্বর -দ্বিতীয় পর্ব

অমৃতস্য পুত্রা
2
প্রশ্নঃ অনেক পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যাক্তি বলে থাকেন যে ঈশ্বর কিছুই করেন না এবং তার কোন গুনই নেই। যা কিছু ঘটছে তা তিনি কেবলই দেখছেন এবং তাঁর সৃষ্ট নিয়ম বা নকশা দ্বারা এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ড নিয়ম তান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

উত্তরঃ



১) প্রকৃত পক্ষে ঈশ্বর হচ্ছেন সবচেয়ে শক্তিশালী ও গতিশীল সত্ত্বা। তাঁর গুন ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অগণিত । যাই হোক না কেন তাঁর এই গতিশীলতা মানে এই নয় যে তাঁর তিনি নিজে নিজেকে পরিবর্তন করেন। তিনি অপরিবর্তিত কিন্তু সকল কর্মের উৎস।

২) নিয়ম বলতে আসলে আমরা বুঝিয়েছি ঈশ্বর সকল কর্ম সবচেয়ে নির্ভূল ভাবে করেন। এতটাই নির্ভূল ভাবে করেছেন যে আমরা সেগুলো সব সময় দেখতে সমর্থ হই। তাঁর কিছু কর্মকান্ডকে আমরা গাণিতিক সমাধানও করতে পারি। পুনঃ পুনঃ নির্ভূল ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো যা আমি দেখি তাকে আমরা "নিয়ম" বলে সংজ্ঞায়িত করি কারন কিভাবে ঘটছে তা জানার বাইরে আর বেশী দূর যেতে পারি না।

বিষয়টি এই রকম যে এক অন্ধ বোবা কালা সন্তানকে তার মা খাওয়াচ্ছে যখন সে কেঁদে ওঠে। এবং তার পরে সে বাচ্চা ভেবে নেয় যে এটাই নিয়ম যখন সে কাঁদবে তখনই তাকে খাওয়াবে!
যদি কোন কারন বা হেতু না থাকে সেখানে কোন ফলাফল (Effect) হতে পারে না। এবং ঈশ্বরই হচ্ছে চূড়ান্ত হেতু।

৩) শ্বেতাশ্বর উপনিষদ ৬.৮ এ বলা হয়েছেঃ ঈশ্বর কোন বাহ্যিক সমর্থন ছাড়াই তাঁর কর্ম পালন করতে পারেন। তিনি অতুলনীয় এবং কেউ তার চাইতে শ্রেয়তর নয়। তিনি তাঁর অসীম শক্তি ও অসীম গতিশীলতা গুনধারী সর্ব শ্রেষ্ট। যদি তিনি গতিশীল ও বলশীল না হতেন তাহলে তাঁর পক্ষে সৃষ্টি, পালন ও বিনাশ করা অসম্ভব হতো। তিনি জাগ্রত, সর্বব্যাপি ও সক্রিয়।

৪) যখন তিনি কর্ম করেন তখন তিনি সেই কর্মের স্থান ও কাল বিবেচনা করে সবচেয়ে যথাযথ ভাবে করেন - একটু বেশীও নয় কমও নয়। কারন তিনি হচ্ছে সম্পূর্ন ত্রুটিহীন।

প্রশ্নঃ তাহলে শ্রী কৃষ্ণের মত অবতাররা কি? শ্রী কৃষ্ণ পরিষ্কার ভাবে শ্রীমাদ্ভাগবত গীতায় চতুর্থ অধ্যায়ে ৭ম শ্লোকে বলেছেন যে যখনই ধর্মের ক্ষয় এবং অধর্ম জেগে ওঠে তখনই আমি পৃথিবীতে অবর্তীণ হই।

উত্তরঃ

১) বেদে হুবুহ বা এই রকম কাছাকাছি অর্থের কোন মন্ত্রই উল্লেখ নেই যেখানে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর জন্ম নেন। যেহেতু বেদ হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রমান, তাই শ্রীমাদ্ভাগবত গীতাকে বেদানুসারে ব্যাখ্যা করতে হবে।

২) শ্রী কৃষ্ণ ছিলেন একজন পুণ্যবান যোগী। স্বভাবতই পুণ্যবান মানুষ ধর্মকে রক্ষা এবং অধর্মকে নাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। নিঃস্বার্থপরায়নতা হচ্ছে এই পুণ্যবান আত্মাদের প্রকৃতিজাত লক্ষণ। তাই শ্রী কৃষ্ণ ধর্মকে সেবা করার জন্য তিনি বার বার জন্ম গ্রহন করতে চেয়েছিলেন। শ্রী কৃষ্ণের মত মহানদের এই রকম উদার চিন্তার জন্য আমরা প্রণাম জানাই এবং এ জন্য তিনি আমাদের রোল মডেল।

৩) কেউ কেউ বলবে রাবণ এবং কংসের মত দুষ্কৃতি মানুষের জন্য ঈশ্বরকে অবতার রূপে মর্তে আসতে হয়। তাহলে নিঃসন্দেহে এই ধারণা বেদকে ভুল প্রমান বা বেদ ত্রুটিযুক্ত বলে দাবী করে এবং তাতে ঈশ্বরকে ছোট করা হচ্ছে। যেখানে তিনি এই সমস্ত বিশ্ব ব্রক্ষান্ডকে সৃষ্টি, পালন, বিনাশ করতে পারেন এবং প্রতিটি আত্মার কর্ম চক্রকে চালাতে পারেন তাহলে কেন তিনি এই রকম ছোট খাটো কাজের জন্য জন্ম নিবেন? অধিকন্তু রাবণ ও কংসের দেহেও তিনি বাস করেন এবং তাদের সকল কর্মকে নিতন্ত্রন করছেন। তিনি তাকে সহজেই ধ্বংস করতে পারেন যখনই তিনি ঠিক সময় মনে করবেন।

৪) এবং যদি কেউ বলে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তার জন্ম গ্রহন করা প্রয়োজন তাহলে সেটা ভুল হবে। কারন ঈশ্বর আমাদের এবং এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ডকে এত নিখুঁত ভাবে পালন করে তিনি ইতিমধ্যেই সব চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ড পালনের চেয়ে আর কোন বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে কি? ভক্ত তাঁর দয়ালুতা, মহানুভবতাকে এই ভাবে উপলদ্ধি করতে পারে। তিনি আমাদের অন্তঃ স্বর (Inner Voice) দ্বারা আমাদের পথ দেখান। এবং তার দৃষ্টান্ত দৃষ্টিকারী চরিত্রগুলোর যাদের কর্মকান্ড আমাদের আরও অনুপ্রাণিত করে।

৫) অধিকন্তু ঈশ্বর ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুঃখ, আনন্দ, অজ্ঞতা, নশ্বর কর্ম, কর্মফল, জীবন, মৃত্যু এই সকলের উর্দ্ধে ( যোগ দর্শন ১.২৪) যদি আপনি এই সকল অবতার গনের গল্পগুলো পাঠ করেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে এই সকল পুণ্যবান ব্যক্তিত্ব যাদের অবতার বলা হচ্ছে তাদের প্রবণতা গুলো শুধুমাত্র আপনার আত্মাকে প্রভাবিত করবে ঈশ্বরকে নয়। যদি ধরে নেয়া হয় ঈশ্বর এই সকল নশ্বর বৈশিষ্ট্যের অধীন বা অধিকারী তাহলে তা হবে সমস্ত দিক থেকে নিঁখুতধারী (all-perfect ) ঈশ্বরের প্রতি অবমাননা কর হবে।

৬) কেউ যদি বলে যে এই সকল বৈশিষ্ট্য দ্বারা ঈশ্বর প্রভাবিত হন না কিন্তু তিনি প্রভাবিত হবার ভান করেন মনুষ্যত্বকে প্রকট করার জন্য, তাহলে এটাও ঈশ্বরের প্রতি আবারও অপমানজনক হবে।কারন ঈশ্বর নিজেই সত্য। তিনি নাট্য অভিনেতা নন এবং কখনই ভান করেন না। তিনি কেবলই সত্য প্রকাশ করেন। তিনি আমাদেরকে ভণ্ডামি থেকে সত্যের দিকে ধাবিত করেন (যর্যুরবেদ ৩১.১৮) ।

৭) আমরা যদি শ্রী রাম ও শ্রী কৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে সেখানে এমন কিছু নেই যা তারা তাদের জীবনে অর্জন করেছেন। ঈশ্বর যিনি এই সমগ্র বিশ্ব ব্রক্ষান্ড সৃষ্টি, পালন এবং নাশ করেন সেই তিনি এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে অবতরণ করেন নগণ্য তুচ্ছদের হত্যা করতে তাও আবার অনেক নির্যাতন ও ব্যার্থতার পরে, আসলে এগুলো তাঁর ক্ষমতাকে উপহাস করা হচ্ছে মাত্র।

কিন্তু আমরা যদি রাম,কৃষ্ণের মত যারা ছিলেন তাদেরকে ঈশ্বর দ্বারা অনুপ্রাণিত তেজস্বী পুরুষ হিসেবে বিবেচনা ্করি তাহলে তারা যা কিছু অর্জন করেছেন তা বিস্ময়কর এবং আমাদের জন্য উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। তারা সকলেই তাদের কর্ম দ্বারা একটি উচ্চতার চিহ্ন (Benchmark) স্থাপন করে গেছেন সত্যিকারে ঈশ্বর আরাধনা মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন ও চরিত্রকে গঠন করার জন্য।

৮) এভাবেই বেদে অবতারগনের গল্পের কোন স্থান নেই। অবতারবাদ হচ্ছে সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম। এবং যখন থেকে এই ধারণার আবির্ভাব হয়েছে তখন থেকে আমরা দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়েছি। সমস্ত পৃথিবীর শাসনকর্তার অবস্থান থেকে আমরা আমাদেরকে এমন এক অবস্থায় নামিয়ে এনেছি যেখানে আমাদের নিজের দেশেই আমাদের যর্থাত অধিকার নেই।
৯) এটা বড়ই দুঃখের বিষয় যে আমরা এই সকল অবতারগনের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিমাকে অশুদ্ধ উপায়ে পূজা করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ নষ্ট করছি কিন্তু এই সকল কালজয়ী তেজস্বী পুরুষ যাদের আমরা অবতার বলি তাদের অনুসরণ করে বিশুদ্ধ ঈশ্বর আরাধনার জন্য সম্পদ ও শক্তিকে একত্র করছি না। সেজন্যই আমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সদ্বিচ্ছা এবং ঈশ্বরের প্রতি খাঁটি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে রয়েছে জন্ম ভিত্তিক বর্ন প্রথা এবং লিঙ্গ বৈষম্যের মত নির্বোধ সমাজ ব্যাবস্থা। আমাদেরকে জঙ্গি যবন সম্প্রদায়ের মত আক্রমণকারীরা আক্রমণ করে, খ্রীষ্টান্তরকরন, দূর্নীতি, অনৈতিকতা ইত্যাদি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। লড়াই করে এই সকল দূর করার পরিবর্তে আমরা ঈশ্বরের দান আমাদের শক্তি ও সামর্থকে নষ্ট করছি অনুত্পাদক কর্মকান্ডে ( non-productive activities)।

১০) রাম, কৃষ্ণ, হনুমান, ইত্যাদি জনদের প্রতি প্রাপ্য ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হতো যদি তাদেরকে প্রধান অথবা অপ্রধান ঈশ্বর না ভাবা হত এবং তাদেরকে ঈশ্বর জ্ঞান করে তাদের উপর ফুল, জল, দুধ না ঢালা হতো এবং তাদের নামজপ করে ভজন সংগীত না গাওয়া হতো। কিন্তু তারা যা করেছিলেন তা করে আমরা আমাদের দেহকে বলশালী করতে পারি, চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি। ধ্যান, নিয়ামানুবর্তিতা, উন্নত চরিত্র গঠন করতে পারি। জ্ঞান বৃদ্ধি ও শুদ্ধ ধর্ম অথবা বেদকে বুঝতে পেরে আমরা চারিদিকের সকল রাবণ ও কংসের সাথে লড়াই করতে পারি এবং সবর্ত্র মাতৃ শক্তির মর্যাদাকে রক্ষা করে আমরা সত্যিকারের রাম রাজ্য গড়তে পারি।
এটাই হচ্ছে সত্যিকারের ঈশ্বর উপাসনা এবং এখানে কোন খণ্ডিত সংক্ষিপ্ত পথ নেই।

১১) যে সকল সংস্থা এবং গোষ্ঠী সমস্বরে অবতারবাদকে রক্ষা করছেন তাদের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ পারলে আপনারা মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্যন্যা বিপক্ষ গোষ্ঠীদের সাথে সক্রিয় ও ফলপ্রদভাবে যুক্তির লড়াইয়ে পরাজিত করে তাদের প্রতিহত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। ধর্মকে রক্ষা করা নামে মন্দিরে যে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা চাঁদার (Donation) মাধ্যমে আয় করেন সেই অর্থ দিয়ে তথাকথিত অজ্ঞদের দ্বারা সৃষ্ট দলিত ও অস্পৃষ্পাদের জন্য কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। গন শুদ্ধি অনুষ্ঠান করে আবার বৈদিক সনাতনে ফিরে এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন এবং তার জন্য শ্রী রাম ও শ্রী কৃষ্ণের সত্যিকারের উদাহরণ অনুসরণ করুন।

আদি শংকরাচার্য তার পরা-পূজাতে লিখেছেনঃ

" কিভাবে আমরা সর্বব্যাপি ঈশ্বরকে ডাকিতে অথবা তাহাতে ডুবিতে (আসন ও বিসর্জন) পারি? যিনি আমাদের সকলকে ধারণ করিয়া আছেন তাহার জন্য আসনের কি আবশ্যকতা ? তাহার মুখমন্ডল ও চরণ ধৌত করিবার জন্য জলের কি আবশ্যকতা যেখানে তিনি সবচাইতে বিশুদ্ধ ও খাঁটি? তাহাকে আমরা কি করিয়া স্নান করাইবো? সমস্ত বিশ্ব ব্রক্ষান্ড তাহারই মধ্যে অবস্থিত তাহলে আমরা তাহাকে কি করিয়া কাপড় পড়াইবো? কিভাবে আমরা তাহার উপর যাজনাপাবিত (পবিত্র সূতা) পড়াইবো যেখানে তিনি শ্রেণী ও বর্নহীন? কিভাবে আমরা তাহার শারীরিক অবয়বের উপাসনা করিব যিনি অভঙ্গুর, সর্বজ্ঞ, সর্ব শক্তিমান, অদ্বিতীয়, নিরাকার ও সর্বব্যাপী?"

প্রশ্নঃ বুঝতে পেরেছি। সুতরাং আপনি বলতে চাচ্ছেন অবতারের পরিবর্তে ঈশ্বর নবী, রাসুল, দূত ও ধর্ম প্রবক্তাদের পাঠিয়েছেন, তাই না?

উত্তরঃ

ঈশ্বর কর্তৃক নবী-রাসূল প্রেরণের ধারণাটি হচ্ছে সব চাইতে মূর্খ ধারণা পোষণ। উদাহরণ স্বরূপ মুসলিমরা মনে করে যে আল্লাহ্‌ সর্ব শক্তিমান কিন্তু আবার নবী রাসূলের উপর বিশ্বাসী। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হচ্ছে যে ঈশ্বর সরাসরি মানব জাতিকে দিক নির্দেশনার দেবার ক্ষমতা রাখেন না তাই তিনি তার কতগুলো দালাল পাঠিয়েছেন তাঁকে সাহায্য করার জন্য। লক্ষ্য করুন এখানে ঈশ্বর নবী রাসূলের মধ্য দিয়া তাঁর কাজ করছেন আর এখানেই রয়েছে গলদটা। যীশুকেও ধারণা করা হয় নবী হিসেবে অথচ তিনি নিজে যথাযথভাবে বাইবেলের প্রামানিক দলিল সংরক্ষণ করতে পারেননি। তিনি (যীশু) যা কিছু করেছিলেন তা সবই ব্যার্থ হলো কারন বর্তমানে প্রকৃত বাইবেলের কোন অস্তিত্ব নেই। একই ভাবে মুহাম্মদকেও নবী বলা হয় এবং সেও কিন্তু তার জীবদ্দশায় কুরআনকে যথাযথ ভাবে দালিলিক করতে পারেননি। এমনকি তিনি এও জানতেন না তার এই বইকে কুরআন বলে ডাকা হবে। তার মৃত্যুর ২০ বছর পরে কুরআনকে পুনরায় নতুন করে সব চেয়ে বিতর্কিত ভাবে সংকলন (রচনা) করা হয়। আজকের পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন কুরআন সেটা মুহাম্মদের মৃত্যুর ৩০০ বছর পরের এবং বলা হয় যে কুরাআনের এই কপিটি মুহাম্মদের মৃত্যর ২০ বছর পরে সংকলিত করা হয়। এই ভাবেই এই সকল কুসংস্কারাচ্ছন্নরা নবী রাসূলদের বিশ্বাস করে।

কিন্তু বৈদিক ঈশ্বর যিনি সত্যিকারের অর্থেই সর্ব শক্তিমান এবং সে জন্য তিনি কোন দালালের মাধ্যমে নয় সরাসরি আত্মার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি মনুষ্যত্বের প্রারম্ভেই বেদকে প্রকাশ করেছেন এবং তারপরে তিনি নিয়মিতভাবেই সকল প্রাণীকুলকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন বেদের জ্ঞানকে যথাযত ভাবে রক্ষার করা জন্য। এমনকি আমরা যদি বেদের জ্ঞানের সাথে পরিচিত নাও থাকি তারপরেও তিনি অন্তঃ স্বর (Inner Voice) এর মধ্য দিয়ে আমাদের পালন ও দেখা শোনা করবেন যেমন করে একজন মা তার সন্তানকে করেন।

বৈদিক ঈশ্বর আমাদের ভেতরে বাহিরে সর্বত্রই আছেন। সুতরাং আমাদের দিক নির্দেশনা দেবার জন্য তাঁর বাইরে থেকে তৃতীয় পক্ষের কোন প্রয়োজনই নেই। তাই একমাত্র সেই সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরকেই মান্য করে এবং শুধু মাত্র তাঁকেই আমরা সকলে আরাধনা করবো। নবী রাসূলের ধারণা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং ঈশ্বরের মহিমার প্রতি চরম অসম্মানকর। সেজন্য যাদের ঈশ্বর, আল্লাহ্‌ ও God এর প্রতি নূন্যতম সম্মান, ভক্তি, শ্রদ্ধা রয়েছে তারা তাৎক্ষনিক ভাবে এই সকল মিথ্যাচারকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

প্রশ্নঃ ঈশ্বরকি তার ভক্তদের ক্ষমা করন না?

উত্তরঃ

১) হ্যাঁ তিনি করেন। কিন্তু শুধুমাত্র ভবিষ্যতের পাপের। কারন ঈশ্বরের প্রকৃত সেবক হলে আমাদের মন শুদ্ধ হয় এবং সেজন্য আমরা ভবিষ্যতে কম পাপ করবো। ঈশ্বর এই শুদ্ধিকরণের ধারা নিশ্চিত করেছেন।

২) কিন্তু অতীতের পাপের কোন ক্ষমা নেই। আমাদের প্রতিটি ভালো, মন্দ কাজের যথাযথ ফল পাবো। কোন দলিলই মুছে ফেলা হবে না। যে ভাবেই হোক না কেন সেই কৃতকর্মের ফলগুলো হবে এমন ভাবে যা আমাদের জন্য মঙ্গল স্বরূপ হয়ে পরম সুখের দিকে অগ্রসর হবে। এবং তা হবে তাঁর শর্তহীন কৃপার জন্য।

৩) তাই যারা বিশেষ ধর্মীয়নুষ্ঠান, উপোস, তীর্থযাত্রা, পুণ্যস্নান ইত্যাদি পালন করে পাপ মোচন করার জন্য উদ্যোগী হয় তাদের সকল প্রচেষ্টাই বৃথা এবং তারা নিজেই নিজেদের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। আমরা এমন প্রবণতা একটু বেশী দেখতে পাই ভণ্ড প্রতারক রাজনীতিবিদ, অভিনেতা-অভিনেত্রী, অসাধু ব্যাবসায়ী, দূর্নীতিবাজ ইত্যাদি জনের মাঝে। দেখা যায় যে কোন অশ্লীল চলচিত্র শুরু হয় কোন দেব দেবীর নয়ত কোন তীর্থস্থানের ছবি অথবা কোন ধর্মীয় মন্ত্রের বা আয়াতের মাধ্যমে। এই ধরনের মানুষেরাই দেখা যায় বড় ধুমধাম করে ধর্মীয়নুষ্টান পালন করে এবং মন্দির, দরগাহ্‌, মসজিদে ঘন ঘন যায়। তারা নিয়মিত যে ঘৃণ্য পাপগুলো করে সেই পাপগুলো মোচন করে একটা ভারসাম্য করা জন্য তারা এই কাজ গুলো প্রকাশ্যে করে থাকে।

৪) কিন্তু যেমন করে মেদযুক্ত শরীর শুধু মাত্র ঔষধ সেবন করে কমানো যায় না তেমনি শুধু মাত্র ক্ষমা চেয়ে সাথে সাথে পাপ মোচন এবং পাপ করার প্রবণতাও দূর করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন নিরলস প্রচেষ্টা যতক্ষণ না পর্যন্ত সে অবস্থানে গিয়ে পৌঁছায়। প্রতিটি কৃত কর্মের পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখানে কোন Deletion অথবা Accounting Balancing নেই।

৫) প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করেন না। যখনই আমরা কোন ভাল অথবা মন্দ কাজ করি তখনই তিনি এর ফল দিতে শুরু করেন। তবে এর শরীরী প্রভাব (tangible effects) গুলো আমরা লক্ষ্য করতে পারি সাথে সাথে অথবা কিছু সময়ের পরে এবং সেটা নির্ভর করে কৃতকর্ম এবং সংবেদনশীলতার মাত্রার উপর। যখন কোন কৃতকর্ম ফল দেরীতে হচ্ছে তখন আমরা বলে থাকি যা এটা পূর্ব কর্মের ফল হিসেবে হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে যখনই কর্মটি করা হয়েছিল ঠিক তখন থেকে অবিরাম ভাবেই প্রক্রিয়ার ধারাটি চলছে। এটা বহুমূত্র রোগের মত যার প্রক্রিয়াটি হয় অবিরাম ভাবে আমাদের খাদ্যের মধ্য দিয়ে যা আমরা খাচ্ছি অথবা শরীর চর্চার করা না করার মধ্য দিয়ে অথবা কঠিন চাপ (stress ) নেয়া ও না নেয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এর সুফল ও কুফলের প্রভাব হয়তো একটা সময়ের পরে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাবে।

৬) অধিকন্তু যদি ঈশ্বর পূর্বের পাপের তালিকাকে মুছে ফেলতেন তাহলেতো তিনি আর ন্যায় বিচারক হতে পারলেন না। কারন তাতে করে যে কারোরই ঠিক এখন থেকেই পাপ করার প্রবানতা আসবে এবং পরবর্তীতে উপরোক্তদের ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যাবার চেষ্টা করবে। এবং ঈশ্বর তাদের আহবানে যদি সাড়া দেন তাহলে তিনি তাদেরকে আরও মূর্খামী করার জন্য উৎসাহিত করলেন। এমনকি যারা কখনই পাপ করেনি তারাও পাপ করার জন্য উৎসাহিত হবে। সেজন্য ঈশ্বর দয়ালু ও ন্যায়কারী হয়ে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন যে প্রতি কৃতকর্মের প্রাপ্য ফল লাভ করবে এবং সেটা কমও না আবার বেশীও না কিন্তু তা হবে আমাদের মঙ্গলেরই জন্য।

তাই ঐ সকল বিশ্বাসী গোষ্ঠী বা CULTS ( উদাহরণ স্বরূপ আধুনিক ইসলাম এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়) যারা মানুষকে প্রলুব্ধ করে যে যদি তুমি পাপ স্বীকার কর অথবা নবী রাসুলকে স্বীকার করে নাও তাহলে তিনি তোমাদের অতীতের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন এবং এই ভাবে তারা ঈশ্বরকে অপমান করছে। সাথে সাথে তারা নিজেরা যেমন বোকা তেমনি অন্যদেরও বোকা বানাচ্ছে। তাই যে কোন জ্ঞান বিবেক সম্পন্ন ব্যাক্তি মাত্রই কাল ক্ষেপণ না করে সাথে সাথে এই ধরনের আহবানকে ফিরিয়ে দেবে অথবা বর্জন করবে।

প্রশ্নঃ আমরা শুনেছি যে ঈশ্বর অতীত বর্তমান, বর্তমান এবং এমনকি ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা সব তিনি আগে থেকেই জানেন। তাই তিনি যা জানেন প্রতিটি আত্মা সেভাবেই সে অনুসারেই কাজ করে। সুতরাং প্রতি আত্মা মুক্ত নয় কর্ম করার ক্ষেত্রে এবং তারা ঈশ্বরের চাবি দেয়া পুতুল মাত্র। তার পরেও ঈশ্বর আত্মাকে শাস্তি দেবেন এটাতো অন্যায়।

উত্তরঃ এই ধরনের অভিযোগ ঐ সকল সম্প্রদায়ের (CULTS) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কারন তারা মনে করে সকলের ভাগ্য, অদৃষ্ট সবই নাকি তার জন্মের আগে লিখিত হয়ে গেছে। উদাহরন স্বরূপ অনেক মুসলিম কুরআন এবং হাদিসের উপর ভিত্তি করে দাবী করে যে আল্লাহ্‌ ইতমধ্যে লোহে মেহ্‌ফুজে ভবিষ্যতের সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এবং তার সিংহাসনের নিচে রেখে দিয়েছেন। এভাবেই তারা আল্লাহ্‌কে একজন psychopathic dictator বা স্বৈরাচারী বানিয়ে ফেলেছে যিনি আত্মা সৃষ্টি করেন আবার তাদেরকে বাধ্য করে তার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে। সে কাউকে শাস্তি দেয়, পাপ করার জন্য প্ররোচিত করে এবং বৈধহীন ভাবে কাউকে সুবিধা প্রদান করেন। যদি এই ধরনের পুস্তক আসলেই থাকত তাহলে তা হতো ঈশ্বরের প্রতি চরম অপমান জনক। কারন এই পুস্তকে ঈশ্বরকে উন্মত্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে!!!

অধিকন্তু যদি আল্লাহ্‌, সবই জানে তাহলে এই ধরনের পুস্তক ( লোহে মেহ্‌ফুজ) সৃষ্টি করার কারন কি যা কেবল তিনিই পড়তে পারেন? তিনি হয়তো ভুলে যেতে পারেন, এই ভয় থেকে তিনি এই কাজটি করেছেন? নাকি আল্লাহ্‌ যে পুস্তকটি লিখেছেন সেটি তিনি ভবিষ্যতেও লিখবেন? এই রকম ধারণা একেবারেই ছেলে মানুষ এবং স্থূল সমস্যায় পূর্ণ।
কিন্তু এই ধরনের কাল্পনিক ধারণা বৈদ্যিক ঈশ্বরে পাওয়া যাবে না।

অতীত বলতে বুঝায় যা বর্তমা্নে কোন অস্তিত্ব নেই এবং ভবিষ্যৎ হচ্ছে যা এখন নেই। কিন্তু ঈশ্বরের জ্ঞান সর্বদা এক, অভিন্ন এবং সত্য। অন্যভাবে বলা হয় যা কিছু অস্তিত্বহীন তা ঈশ্বরের জ্ঞানের রাজ্যে ও অস্তিত্বহীন।

ভবিষ্যৎ ও অতীত এই দুটো বিষয় শুধু মাত্র আত্মার জন্য ঈশ্বরের জন্য নয় যিনি সময়ের সীমারেখায় আবদ্ধ নন। শ্রদ্ধার সাথে কেউ বলতে পারে যা আত্মার সকল কর্মের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তিনি জানেন কিন্তু তা অসংলগ্ন ভাবে নয় বা প্রকৃতিজাত নয়। অন্য ভাবে বলা যায় যে আত্মা যে কর্ম করেন এবং যথাযথভাবে কি ফল হবে তা ঈশ্বর জানেন। কিন্তু ইতিহাস জানার জন্য ঈশ্বরকে অতীতে যেতে হবে আবার কি ঘটতে যাচ্ছে তা জানার জন্য তাকে ভবিষ্যতেও যেতে হবে না। তিনি সকল সময়ই বর্তমান এবং সকল কর্ম ও কর্মফলের ব্যাপারের তিনি সর্বদা সত্য স্বাধীন জ্ঞান ধারন করেন।

আমরা পরবর্তীতে আত্মার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো। লক্ষ্য করুন যে বর্তমানে কর্ম করার ক্ষেত্রে আত্মা কিছুটা স্বাধীন (বর্তমান অতীতে কর্মের অধীন। আত্মার বর্তমান সংস্কার অথবা প্রবণতা অতীত কর্মের ফলস্বরূপ) কিন্তু ঐ সকল কর্মের ফলাফল সম্পূর্ন ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। এখন ঈশ্বর সুনিশ্চিত করে দিচ্ছেন যে এই ফলাগুলো আত্মার সংস্কারগুলোকে তিনি একটি নির্দিষ্ট ধরন বা Modified করেন যাতে করে আত্মা তার সীমিত স্বাধীনতাকে সর্বোৎকৃষ্ট ভাবে ব্যবহার করে তার স্বাধীনতার সীমা আরও বাড়াতে পারে এবং সর্বোচ্চ পরম সুখ অর্জন করতে পারে। বিষয় প্রতিনিয়ত প্রতি মূহুর্তে বিরামহীন ভাবে ঘটছে। সমস্ত যোগক্ষেত্রের ভিত্তি হচ্ছে ঈশ্বরের অমোঘ নিয়ম আমাদের সর্বাঙ্গীন মংগলের জন্য।

প্রশ্নঃ তাহলে আত্মাও ঈশ্বর এবং মুক্তিলাভ (মকশা) এর পরে কি ঈশ্বর হয়ে যায়? যদি তা হয় তাহলে অদ্বৈত কি?

উত্তরঃ আমরা পরবর্তী কোন এক সময় আত্মার প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপক ভাবে আলোচনা করবো। কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে উত্তরটি হচ্ছে না ঈশ্বর আত্মা নয়। যদি ঈশ্বর আত্মা হত তাহলে সেটা ইতিমধ্যেও ঈশ্বর। তাহলে কেন আমরা এখন থেকে সমস্ত বিশ্ব ব্রক্ষান্ডকে পরিচালিত করতে পারছি না এবং এক আত্মা (ঈশ্বর) আরেক আত্মার সাথে যুদ্ধে মত্ত হয় যখন দুজনেই হচ্ছে এক? যদি আপনি বলেন তা হয় কেবল মায়া ও ভ্রমের কারনে তার মানে হচ্ছে ঈশ্বরও তাহলে অজ্ঞতা দ্বারা জর্জরিত হয়। এখন এটা সম্পূর্ন বেদ বিরোধী কারন বেদে স্পষ্টই বলা হয়েছে ঈশ্বর অজ্ঞতার সীমার অধীন নয় এবং সর্বদা তাই থাকবেন।

অধিকন্তু যদি আমি ঈশ্বর হই এবং তা অনুধাবন করতে ব্যার্থ হই তাহলে এখন এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ড কে নিয়ন্ত্রণ করছে? যদি আপনি বলেন যে আমি সর্বব্যাপী ঈশ্বর অথবা ব্রক্ষার মত অথৈ কুলহীন সাগরের তুলনায় এক বিন্দু জল মাত্র তাহলে এই ব্রক্ষান্ডকে কে চালাচ্ছেন তারপরে আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন ঐ সর্ব বৃহৎ ঈশ্বরের ব্যাপারে যে তিনি অজ্ঞতা ও পাপমোহ দ্বারা আক্রান্ত হবেন না এবং তিনি সঠিক ভাবেই এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ড লালন পালন করবেন? কারন আপনিই বলছেন আমি নিজেও ঈশ্বর কিন্তু বর্তমানে আমি অজ্ঞ! এই ধরনের যুক্তি দ্বারা সুন্দর কাব্যিকতা করা যা উক্তি হিসেবে সমাদৃত হবে কিন্তু তা কখনই যুক্তি সঙ্গত হবে না।

বেদে কোথাও এমন স্বয়ং ঈশ্বরবাদ নেই এবং সেখানে স্পষ্টই বলা আছে আত্মা এবং ঈশ্বর দুটি পৃথক সত্ত্বা।

বিঃ দ্রঃ অদ্বৈতবাদ বেদে একেশ্বর ধারনাকে বুঝায়। এর অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নন।

প্রশ্নঃ যদি তাই হয় তাহলে কেন শংকরাচার্য ঈশ্বর ও আত্মার অভিন্নতার সম্পর্কে বলেছেন?

উত্তরঃ শংকরাচার্য এখন বেদজ্ঞ ছিলেন এবং ঐ যুগে নাস্তিক্যবাদ বিস্তার লাভ করছিল। তিনি অঈশ্বরবাদকে এই যুক্তি দিয়ে বিরোধিতা করেছিলেন যে অঈশ্বরবাদ বা নাস্তিক্যবাদ যা কিছু প্রমাণ করতে পারে তা আরও বিশ্বাস যোগ্যভাবে প্রমাণ করতে পারে যদি আত্মাকে স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি তিনি না করতেন তাহলে তিনি বেদের প্রজ্ঞা, ধীশক্তিকে রক্ষা করতে নাও পারতেন। তার এই মহান উদ্দেশ্যের জন্য আমরা তার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।

যখন শংকরাচার্য জন্মেছিলেন তখন ইতমধ্যে বেদ থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান গ্রহন করার প্রথা প্রায় মৃত হয়ে পড়েছিল। তখন বেদকে কেবলই পূজা অর্চনার গ্রন্থ হিসেবে ভাবা হতো। এই ভাবে এমনকি শংকরাচার্য বেদকে আশ্রয় না করে তিনি বেদান্ত, গীতা এবং উপনিষদের উপর বেশী মনযোগী ছিলেন যা ঐ সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাই তিনি ঐ সকল মহান দর্শন সম্পন্ন গ্রন্থের আলোকে নাস্তিক্যবাদকে বিরোধীতা করেছেন। তিনি তা করেছিলেন ন্যায় দর্শনের শিক্ষার আলোকে।এই ন্যায় দর্শন বেদান্ত অথবা অন্যন্যা দর্শন দ্বারা যুক্তি স্থাপন করেছিলেন স্বল্প স্থায়ী বিপদ জনক মতকে বিরোধীতা করার জন্য। উল্লেখ্য যে বেদান্তের পরিসীমা ন্যায় সঙ্গত যুক্তিদ্বারা সীমাবদ্ধ কোন গল্প বা Facts দিয়ে নয়।

এখানে বেদান্তের একটি উদাহরণ দেয়া হলো।

প্রারম্ভিক রীতিনীতি বা দেশাচারঃ সকল ধর্মত্যাগীরা যারা ইসলাম অস্বীকার করেছে এবং এর বিরুদ্ধে প্রচার করেছে তাদের সবাইকে হত্যা করতে হবে- জাকির নায়েক

বেদান্ত যুক্তিঃ ধর্মত্যাগী দৃষ্টিকোণ থেকে , তারা বাদে অবশিষ্ট জনসংখ্যা তার (ধর্মত্যাগী) ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইসলামের প্রচারণা চালিয়েছে , সেজন্য তাদের হত্যা করতে হবে তাকে নয়।

প্রারম্ভিক রীতিনীতি বা দেশাচারঃ কিন্তু এটা মুসলিম রাষ্ট্র। সেজন্য একজন ধর্মত্যাগী যদি সমস্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তাকে হত্যা করা উচিত রাষ্ট্রের অবশিষ্ট জনসংখ্যা নয়। - জাঁকির নায়েক

বেদান্ত যুক্তিঃ এই যুক্তি অনুসারে মুহাম্মদকে সবার আগে হত্যা করতে হবে কারন সে ইসলামের প্রচারণা চালিয়েছে এবং তিনিই ছিলেন এক মাত্র ইসলাম সম্পর্কে জানা লোক এবং সমস্ত রাষ্ট্র ইসলামে বিশ্বাস করত না।

উল্লেখ্য যে আমরা এসব বলে এটা বোঝাতে চাইছি না যে সব মানুষকে হত্যা করতে হবে অথবা মুহাম্মদকে হত্যা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা এই ধরনের তর্কের যুক্তি প্রদর্শন করি মূর্খ যুক্তিকে খণ্ডানোর জন্য। এই রকম মূর্খতা পূর্ন যুক্তি আমাদের আশেপাশে অনেক অনেক মূর্খরা দিয়ে থাকে।

এই অদ্বৈতবাদের বিতর্কের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটে। শংকরাচার্য এই সকল ব্যাবহার করেছিলেন ঈশ্বরবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং অঈশ্বরবাদকে প্রতিহত করার জন্য। এবং তিনি সকল বেদ বিরীধী নাস্তিক মতবাদকে পরাজিত করেছিলেন কিন্তু তার পরে তিনি আমাদের তার জ্ঞানভাণ্ডারে থেকে আমাদের আরও কিছু দেবার আগেই তিনি মাত্র ৩২ বছর বয়সে দেহ ত্যাগ করেন। সেজন্য আমরা তাকে নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করি যে তিনি আত্মা= ঈশ্বর এই মতবাদে বিশ্বাসী।

মূলত তার মন্তব্যে বেদান্ত, উপনিষদ এবং শ্রীমাদ্ভাগবত গীতা থেকে তিনি অনেক শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি আত্মা ও ঈশ্বরের ভিন্ন সত্ত্বায় বিশ্বাসী ছিলেন। এটা একটা ভিন্নধর্মী ব্যাপক গবেষণার বিষয় হতে পারে এবং এর ভিত্তি হবে সকল আলোচনাগুলো। আমরা পশ্চিমাদের বিশ্বাসের বিশ্বাসীদের আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কয়েক বছরে বৈদ্যিক ধারায় আনতে পারি।

কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা বাদে আমরা শুধু কল্পনা করি কি বিষ্মকর কাজটি তিনি করেছিলেন এর অল্প সময়ে! গুরুকুলের শিক্ষায় প্রাথমিক বিষয়গুলো জানতেই নূন্যতম ২৫ বছর লেগে যায় সেখানে তিনি মাত্র ৩২ বছর বয়সে এর বড় পণ্ডিত হয়ে গিয়েছেন যিনি ভবিষ্যতে দেশ ও পৃথিবীকে পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন! তার জ্ঞান তাপসকে প্রণাম করি এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন একই ধীশক্তি জ্ঞান আমাদের সকলের উপহার দেন।

প্রশ্নঃ ঈশ্বর কি রাগী ( আবেগ পূর্ন, ক্রোধ) অথবা বিরক্ত ( আবেগহীন) ?

উত্তরঃ কোনটাই নয়। তিনি এ সকল প্রবণতার উর্দ্ধে। কারন রাগ বা ক্রোধ হচ্ছে সে সকল জিনিস, বস্ত, ও বিষয়ের প্রতি যা আমাদের অংশ নয়। এবং কোন কিছুর জন্য আত্মাত্যাগ, পরিত্যাগ করা হয় যা আমাদের অধীনে ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের যা কিছু প্রয়োজন তা সবই আছে এবং তিনি কোন কিছু পরিত্যাগ করেন না কারন তিনি সর্বব্যাপী।

প্রশ্নঃ ঈশ্বরের কি কোন কামনা আছে?

উত্তরঃ ঈশ্বরের কোন রকম কামনা নেই যা আমরা আত্মার মাঝে দেখতে পাই। আত্মা সেই জিনিসই কামনা করে যা তার নেই। তাই কিভাবে একজন যিনি সব কিছুর অধিকারী তার কামনা থাকবে? এবং পরম সুখ ভোগী হওয়ার কারনে তার সুখের জন্যও কোন কামনা নেই। সমস্ত আত্মার সুখের জন্য তিনি এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ডকে সৃষ্টি, পালন এবং ধ্বংস করে থাকেন। একে বলা হয় ঈশ্বরের "ইস্খানা" অথবা তাহার সকল কর্মই হেতুপুর্ন। যারা মনে করে (জাকির নায়েকের মত) যে ঈশ্বর আত্মার কাছ থেকে পূজা,, প্রশংসা, উপাসনা, আরাধনা ইত্যাদি আশা করে তারা আসলে ঈশ্বরকে একজন প্রশংসা আকাঙ্ক্ষী বা প্রত্যাশী অথবা প্রশংসা তুষ্ট স্বৈরাচার রূপে উপস্থাপন করে তাকে অপমান করছেন। আমরা পূজা উপাসনা যাহাই করি না কেন তা আমাদের নিজেদের উন্নত করার জন্য এবং এতে ঈশ্বরের উপর কোন প্রভাব ফেলে না।
আমরা পর্যায়ক্রমে পরবর্তীতে আত্মতা ( own Self) নিয়ে আলোচনা করবো।

টীকাঃ আমরা সমস্ত ধারণাগুলো সরাসরি বেদ থেকে দিয়েছে যা আমাদের মধ্যে অনেকের পার্থক্য হতে পারে এবং এই কারনে অনেকে বিভিন্ন দিকে বিশ্বাসী হয়েছে। এসবের মূল কারনই হচ্ছে ধর্ম ব্যাবসায়ীরা বেদকে সব সময়ে তাদের অনুকূলে রাখার জন্য নিজের মত ব্যবহার করছে।

ঈশ্বর আমাদের সবাইকে প্রজ্ঞা দিক যাতে আমরা আমাদের অনুসরনীয় শ্রী রাম চন্দ্র ও শ্রী কৃষ্ণের মত ধর্মের পথে চলতে পারি এবং আমাদের ঐ সকল ভাই বোনদের অনুপ্রাণিত করুক যারা বিদেশী প্রথা (Foreign Cults) যা কুসংস্কারে পূর্ন এবং অন্ধ বিশ্বাসে ভরা তারা যেন তাদের আসল বৈদিক গৃহে ফিরে আসে। আমরা যেন একতবদ্ধ হয়ে জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বিশ্ব নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে পারি। আর এর জন্য একমাত্র পথই হচ্ছে সত্যিকারের ঈশ্বরের সত্যিকারের আরাধনা মাধ্যমে এবং প্রার্থনা করি তা যেন শ্রীঘই ঘটে।



ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি

Post a Comment

2Comments
  1. ভালো হতো রেফারেন্সসহ ব্যাখ্যা করা হলে।

    ReplyDelete
  2. Join our facebook group https://www.facebook.com/groups/agniveerbangladesh/

    ReplyDelete
Post a Comment