বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মকে হেয় করার জন্য সনাতন ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে অপপ্রচার চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন ধরে অপপ্রচারকারীরা বেদ, মনুসংহিতা, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে নারী নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বেদ ও মনুসংহিতার অপপ্রচারের জবাব ইতিমধ্যে অগ্নিবীর দিয়েছে। এই পর্বে মহাভারতে নারী নিয়ে করা অপপ্রচারের জবাব দেওয়া হবে।
অপপ্রচারকারীর দাবী : মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভীষ্ম বলেন (১৩/৩৮), "উহাদের (স্ত্রীলোকদের) মত কামোন্মত্ত আর কেহই নাই। ... কাষ্ঠরশি যেমন অগ্নির, অসংখ্য নদীর দ্বারা যেমন সমুদ্রের ও সর্বভূত সংহার দ্বারা অন্তকের তৃপ্তি হয় না, তদ্রুপ অসংখ্য পুরুষ সংসর্গ করিলেও স্ত্রীলোকের তৃপ্তি হয় না।"
অপপ্রচারের জবাব : কেউ যদি মহাভারত পড়ে থাকেন তবে লক্ষ্য করবেন যে, মহাভারত পর্ব, অধ্যায় ও শ্লোকে বিন্যাস্ত। তাই মহাভারতের রেফারেন্স হবে তিন পর্যায় বিশিষ্ট। মহাভারতে যদি রেফারেন্স কেউ ১/২/৩ দেন তবে বুঝতে হবে এখানে ১ম পর্ব অর্থাৎ আদি পর্বের ২য় অধ্যায়ের ৩য় শ্লোকের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু উপরের দেওয়া রেফারেন্স রয়েছে ১৩/৩৮ যা দ্বারা মহাভারতে সঠিক কোনো রেফারেন্স নির্দেশ করে না। অর্থাৎ এটা মহাভারতের নামে একটি অপপ্রচার।
অপপ্রচারকারীর দাবী: ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও গুরু ভীষ্মের মতোই, তাঁর মুখেও শোনা যায় তীব্র নারীনিন্দা, “উহারা (নারীরা) ক্রিয়া-কৌতুক দ্বারা পুরুষদিগকে বিমোহিত করে। উহাদিগের হস্তগত হইলে প্রায় কোনো পুরুষই পরিত্রাণ লাভ করিতে পারে না। গাভী যেমন নূতন নূতন তৃণভক্ষণ করিতে অভিলাষ করে, তদ্রুপ উহারা নূতন নূতন পুরুষের সহিত সংসর্গ করিতে বাসনা করিয়া থাকে” (১৩/৩৯)।
অপপ্রচারের জবাব: প্রথমত যিনি এইসব অপপ্রচার যুক্ত লেখা প্রচার করেছেন তার মধ্যে একদমই মহাভারত জ্ঞান নেই। কারণ যুধিষ্ঠিরের গুরু হচ্ছেন দ্রোণাচার্য। আর তাঁর পিতামহ হচ্ছে ভীষ্ম। কিন্তু উপরের অপপ্রচারে ভীষ্মকে যুধিষ্ঠিরের গুরু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১ নং অপপ্রচারের মতোই এই অপপ্রচারে ১৩/৩৯ রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। যা একটি অসম্পূর্ণ রেফারেন্স। এসব অসম্পূর্ণ রেফারেন্স দেখে বোঝা যায় এগুলো নিতান্তই অপপ্রচার।
অপপ্রচারকারীর দাবী: আবারো পঞ্চপাণ্ডবের মহাজ্ঞানী পিতামহ ভীষ্মের উপলব্ধি, “মানুষের চরিত্রে যত দোষ থাকতে পারে, সব দোষই নারী ও শূদ্রের চরিত্রে আছে। জন্মান্তরীয় পাপের ফলে জীব স্ত্রীরূপে (শূদ্ররূপেও) জন্মগ্রহণ করে” (ভীষ্মপর্ব ৩৩/৩২)
অপপ্রচারের জবাব: মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায় এই ১৮ টি অধ্যায় শ্রীমদ্ভগবতগীতা নামে পরিচিত। গীতায় শুধু যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন, সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্র এই চার জনের উক্তি রয়েছে। তাই ভীষ্মপর্বের ৩৩ তম অধ্যায়ে ভীষ্মের কোনো উক্তি থাকা অস্বাভাবিক। ভীষ্ম পর্বের ৩৩ তম অধ্যায়টি গীতার নবম অধ্যায় তথা "রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগ" নামে পরিচিত।
অপপ্রচারকারীর দাবী: “স্ত্রীগণের প্রতি কোন কার্য বা ধর্ম নেই। (কারণ) তারা বীর্যশূণ্য, শাস্ত্রজ্ঞানহীন।” (অনু, ১৩/৩৯) এরপরেও নাকি মহাভারতের কথা অমৃতসমান!
অপপ্রচারের জবাব: তাদের উল্লেখিত রেফারেন্সে অনুশাসন পর্বের ১৩/৩৯ এ কী বলা আছে,
সাবিত্রী ব্রহ্মবিদ্যা চ ঋতবো বৎসরাস্তথা।
ক্ষণা লবা মুহূর্ত্তাশ্চ নিমেষা যুগপর্য্যাযাঃ।।
অনুশাসন পর্ব ১৩/৩৯
অনুবাদ: সাবিত্রী, ব্রহ্মবিদ্যা, ঋতু, বৎসর, ক্ষণ, লব, মুহূর্ত, নিমেষ, যুগসমূহ ইহারা সর্ব্বত্রগত তোমাকে রক্ষা করুন ও সুখ সম্পাদনের নিমিত্ত হউন।
অপপ্রচারকারীর দাবী: “তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, দাবানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করিলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান-সমান হবে” (অনুশাসনপর্ব ৩৮)।
অপপ্রচারের জবাব: এখানে উল্লেখিত রেফারেন্সে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র 'অনুশাসনপর্ব ৩৮' লেখা। এটি অনুশাসন পর্বের কততম অধ্যায়ের ৩৮ নং শ্লোক তা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এটিও মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।
অপপ্রচারকারীর দাবী: হিন্দু মুনি-ঋষিরা ভালো নারী-ধর্মচারী নারীর বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন! তাদের দৃষ্টিতে সতী-সাধ্বী-ধর্মচারিণী হচ্ছে—“ন চন্দ্রসূর্যৌ ন তরুং পুন্নাুো যা নিরীক্ষতে/ভর্তৃবর্জং বরারোহা সা ভবেদ্ধর্মচারিণী॥ (মহাভারত, ১২/১৪৬/৮৮) অর্থাৎ “যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনো পুংলিঙ্গান্ত (নামের বস্তু), চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন কওে না, সে-ই ধর্মচারিণী।” ওরেবাব্বা! দেখলেন তো! ধর্মচারিণী হতে হলে কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন? এতো দেখি পর্দাপ্রথা থেকেও চূড়ান্ত ও উন্মত্ত সংস্করণ! সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এরপরেও কোন মুখে দাবি করেন, তাদের ধর্ম প্রগতিশীল, তাদের ধর্মে নারী সম্পর্কে কোনো বাজে ধারণা নেই?
অপপ্রচারের জবাব: এখানে সতী সাধ্বী নারীর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে মহাভারতের ১২/১৪৬/৮৮ রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই উক্তিটি মহাভারতের ১২তম পর্বের ১৪৬ তম অধ্যায়ের ৮৮ শ্লোকে থাকার কথা। চলুন দেখে নেওয়া যাক ওখানে কী রয়েছে। প্রথমত মহাভারতের ১৮ টি পর্বের ১২ তম অধ্যায়টি হচ্ছে শান্তি পর্ব।
এবার দেখে নেওয়া যাক শান্তি পর্বের ১৪৬ অধ্যায়ে কতটি শ্লোক রয়েছে।
একী! শান্তি পর্বের ১৪৬ অধ্যায়ে যে শুধুমাত্র ১৯ টি শ্লোক রয়েছে। তাহলে এতক্ষণ যারা 'ওরেবাব্বা! দেখলেন তো!' ইত্যাদি বলে চিৎকার করছিলেন তাদের ৮৮ নং শ্লোকটি কোথায় গেলো। তাদের সত্য প্রচারের নামে এসব ভণ্ডামির কী হবে?
অপপ্রচারকারীর দাবী: অহরহই যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ক্ষত্রিয় রাজা বা ঠাকুর-পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের মনোরঞ্জনের জন্য নারীদের দান করা হতো, দেখুন পবিত্র মহাভারতের কিছু নমুনা : মহাভারতের কথিত শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নিজেও যজ্ঞে-দানে-দক্ষিণায় বহুশত নারীকে দান করে দিতেন অবলীলায় অতিথিরাজাদের আপ্যায়নে (আশ্বমেধিকপর্ব ৮০/৩২, ৮৫/১৮)!
অপপ্রচারের জবাব: এখানে দুটি রেফারেন্স দেওয়া আছে। এর প্রথমটি আশ্বমেধিক পর্বের ৮০ অধ্যায়ের ৩২ শ্লোকের। কিন্তু এখানেও গতানুগতিক ভাবে আশ্বমেধিক পর্বের ৮০ অধ্যায়ে মাত্র ২০টি শ্লোক রয়েছে। আর ওনারা রেফারেন্স দিচ্ছেন ৩২নং শ্লোকের।
মনেহয় ওনারা নারী অধিকার নিয়ে খুবই চিন্তিত। তাই ওনাদের ধর্মে নারীকে যেভাবে সম্মানিত (!) করা হয়েছে, সেভাবে সনাতন ধর্মেও সম্মানিত করার লক্ষ্যে নতুন মহাভারত লিখেছেন। তাতে নিশ্চয়ই আশ্বমেধিক পর্বের ৮০ অধ্যায়ে ৩২ নং শ্লোক উপস্থিত আছে।
এরপর তারা আশ্বমেধিক পর্বের ৮৫ অধ্যায়ের ১৮ নং শ্লোকে একই কথা উল্লেখ থাকার দাবী করেছেন।
মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বের ৮৫/১৮ তে উল্লেখ আছে,
প্রভাবজ্ঞাস্মি তে কৃষ্ণ! তস্মাত্ত্বাং যাচয়াম্যহম।
কুরুষ্ব পাণ্ডুপুত্রাণামিমং পরমনুগ্রহম।।
আশ্বমেধিক পর্ব ৮৫/১৮
অর্থাৎ কৃষ্ণ! আমি তোমার প্রভাব জানি ; সেই জন্যই তোমার নিকট প্রার্থনা করিতেছি যে, তুমি পাণ্ডবগণের উপর এই পরম অনুগ্রহ করো।
এই শ্লোকটি মুলত উত্তরা ও অভিমুন্যুর মৃত সন্তানকে যোগ বলে জীবিত করার জন্য শ্রী শ্রীকৃষ্ণের কাছে অনুরোধ করা হচ্ছে।অর্থাৎ এবারও তাদের দেওয়া রেফারেন্স অনুসারে তাদের আকাঙ্ক্ষিত নারীকে দানকারী শ্লোক খুঁজে পেতে আমরা ব্যর্থ হলাম।
অপপ্রচারকারীর দাবী: ব্রাহ্মণদের নারী দান করার বিধান রয়েছে, দেখুন : আশ্রমবাসিকপর্ব ১৪/৪, ৩৯/২০, মহাপ্রস্থানপর্ব ১/৪, স্বর্গরোহণপর্ব ৬/১২,১৩।
অপপ্রচারের জবাব: আশ্রমবাসিক পর্বের ১৪/৪ এ বলা হয়েছে,
ইদং মদবচনাৎ ক্ষত্তঃ! কৌরবং ব্রূহি পার্থিবম।
যাবদিচ্ছতি পুত্রাণাং দাতুং তাবদদদাম্যহম।।
আশ্রমবাসিক পর্ব১৪/৪
অর্থ: বিদুর! আপনি আমার বাক্যানুসারে কুরুরাজ জ্যেষ্ঠ তাতকে বলুন যে, 'প্রভু! আপনি পুত্রগণ এবং ভীষ্মপ্রভৃতি সমস্ত উপকারী বন্ধুগণের শ্রাদ্ধ করিবার জন্য যত ধন ইচ্ছা করেন, তত আমি আমার কোশ হতে দিব ; কিন্তু ভীম যেন অত্যন্ত দুঃখিত চিত্ত না হন। ' (৪-৫)
এখানে অর্জুন তাঁর জ্যেষ্ঠ তাত অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর মৃত পুত্র ও ভীষ্মের শ্রাদ্ধের জন্য নিজ কোশ হতে দান করতে চেয়েছেন। অথচ অপপ্রচারকারীরা এখানে নারী দান খুঁজে পাচ্ছেন!
আবার আশ্রমবাসিক পর্বের ৩৮/২০ নং শ্লোকেও একই কথা উল্লেখ থাকার দাবী তারা করে। কিন্তু এখানে বলা আছে,
ভো ভো বিদুর! রাজাহং দযিতস্তে যুধিষ্ঠিরঃ।
ইতি ব্রুবন নরপতিস্তং যত্নাদভ্যধাবত।।
আশ্রমবাসিক পর্ব ৩৮/২০
অর্থ: 'বিদুর! বিদুর! আমি তোমার প্রিয় রাজা যুধিষ্ঠির' এই কথা বলতে বলতে যুধিষ্ঠির যত্নপূর্বক তাঁহার দিকে ধাবিত হইলেন।
এখানে বলা হয়েছে কী, আর মিথ্যার আবরণে চোখ বাঁধা অপপ্রচারকারীরা দেখছে কী!এর পরে তারা দাবী করে মহাপ্রস্থানপর্বের ১/৪ এ শ্রাদ্ধে নারী দানের কথা আছে। কিন্তু মূল মহাভরতে যা আছে দেখে নিন,
ইত্যুক্তঃ স তু কৌন্তেয়ঃ কালঃ কাল ইতি ব্রুবন।
অন্বপদ্যত তদ্বাব্যং ভ্রাতুর্জ্যেষ্ঠস্য ধীমতঃ।।
মহাপ্রস্থানপর্ব ১/৪
অর্থঃ যুধিষ্ঠির এই কথা বলিলে, অর্জুন 'কালই কাল' এইরূপ বলিয়া বুদ্ধিমান জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বাক্য স্বীকার করিলেন।
এখানে বৃষ্ণিবংশীয়দের বিনাশের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, কালের (সময়ই) আবর্তনে সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। তাঁর একথা শুনে অর্জুন স্বীকার করলেন কালই (সময়ই) কাল (মৃত্যু)।
এরপরে তারা স্বর্গারোহণ পর্বের ৬ ষ্ঠ অধ্যায়ের ১২ ও ১৩ শ্লোকের কথা উল্লেখ করেছে শ্রাদ্ধে নারী দানের উদ্ধৃতি দিতে। কিন্তু মজার ব্যাপার স্বর্গারোহণ পর্বে মাত্র ৫ টি অধ্যায় রয়েছে।
অপপ্রচারকারীর দাবী: যাহোক, এই ইহজগতে না হয় দুদর্মনীয় কামভোগের একটা ব্যবস্থা করা গেল, কিন্তু মৃত্যুর পর কী হবে? মরণের পরেও তো সুখ-শান্তির ব্যবস্থা থাকা চাই। চিন্তা নেই, তারও রেডিমেড ব্যবস্থা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো যুদ্ধ করে মারা গেলে স্বর্গে পাওয়া যাবে অসংখ্য সুন্দরী নারী। প্রমাণ চাই তো নিশ্চয়ই! দেখুন : বনপর্ব ১৮৬-১৮৭, কর্ণপর্ব ৪৯/৭৬-৭৮, শান্তিপর্ব ৬৪/১৭, ৩০; ৯৬/১৮, ১৯, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৬
অপপ্রচারের জবাব: অপপ্রচারকারীদের এই পয়েন্টটা দেখে 'ভুতের মুখে রাম নাম' এই প্রচলিত কথাটা খুব মনে পড়ছে। যারা সারা জীবন মিথ্যা প্রচার করে বেড়ায় মৃত্যুর পর ৭২ হুরের লোভে তারাই আবার আজ স্বর্গে সুন্দরী নারীর সমালোচনা করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সনাতন ধর্মগ্রন্থে এমন কোনো স্বর্গে সুন্দরী নারীর উল্লেখ নেই। এগুলো হচ্ছে হুর লোভীদের সনাতন ধর্মকে কলুষিত করার জন্য তাদের তৈরি মহাভারতের কথা। আমি তাদের তৈরি মহাভারত বললাম এজন্য যে, ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে এরকম কোনো কথা নেই। প্রমাণ দেখতে চান, তাহলে চলুন তাদের দেওয়া রেফারেন্স গুলোয় ঘুরে আসি। প্রথমে বনপর্ব ১৮৬-১৮৭ যে রেফারেন্স দেওয়া, এটা একটি অসম্পূর্ণ রেফারেন্স। কারণ মহাভারতের রেফারেন্স তিনটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। এখানে দেওয়া রেফারেন্সে অধ্যায় অনুপস্থিত। তাই ওনারা নিশ্চয়ই এটা নিজের লেখা মহাভারতে পেয়েছেন। এরপরের রেফারেন্স দেওয়া কর্ণপর্ব ৪৯/৭৬-৭৮। এই রেফারেন্সে যা আছে, দুঃখিত উক্ত রেফারেন্সে খুঁজে কেউ কোনো দিন একটা শ্লোকও পাবেন না। কারণ কর্ণ পর্বের ৪৯ অধ্যায়ে শ্লোক রয়েছে ৭০ টি। তাই এই অধ্যায়ের ৭৬-৭৮ শ্লোক খুঁজে এনে দেওয়া ও ঘোড়ার ডিম এনে দেওয়া একই কথা।
এরপরে তারা শান্তিপর্বের ৬৪/১৭ ও ৩০ শ্লোকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে নাকী বলা আছে যুদ্ধে বীরগণ মৃত্যুবরণ করতে স্বর্গে সুন্দরী নারী সঙ্গ পান।
চলুন এবারও তাদের মিথ্যাচারের প্রমাণ দেখি,
অজিহ্মমশঠং মার্গং বর্ত্তমানস্য ভারত।
সর্ব্বদা সর্বভূতেষু ব্রহ্মাশ্রমপদং ভবেৎ।।
শান্তিপর্ব ৬৪/১৭ ও ৩০
অর্থ: ভরতনন্দন! যিনি সর্বদা সকল প্রাণীর উপর সরল ও শঠতাবিহীন ব্যবহার করেন তাঁহারা সন্ন্যাশ্রম হইতে পারেন।
এখানে সকল প্রাণীর প্রতি সরল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আর হুর লিপ্সুরা এখানে সুন্দরী নারী খুঁজে পাচ্ছে!এরপরের রেফারেন্স শান্তিপর্ব ৬৪/৩০। এখানে রয়েছে,
কালে বিভূতিং ভূতানামুপহারাংস্তথৈব চ।
অর্হয়ন পুরুষব্যাঘ্র! সাধুনামাশ্রমে বসেৎ।।
শান্তিপর্ব ৬৪/৩০
অর্থ: পুরুষশ্রেষ্ঠ! যিনি যথাসময়ে সাধুজনের উন্নতি সাধন ও সম্মানপূর্বক তাঁহাদেরকে উপহার দান করেন, তিনি যে কোনো আশ্রমেই বাস করিতে পারেন।
তাহলে দেখা গেলো এখানেও আমরা স্বর্গীয় হুর খুঁজে পেতে ব্যর্থ।
এরপরে হুরপ্রেমীরা স্বর্গে সুন্দরী নারী খুঁজে পেতে যে সকল রেফারেন্স দিয়েছেন সেগুলো হলো শান্তিপর্ব ৬৪/১৭, ৩০; ৯৬/১৮, ১৯, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৬। এই রেফারেন্স গুলো দেখার আগে শান্তিপর্বের কোন অধ্যায়ে কতটি শ্লোক রয়েছে সেটা আগে দেখে নেই। এখানে দেখা যাচ্ছে ৯৬ অধ্যায়ে মাত্র ১৮ টি শ্লোক রয়েছে।
কিন্তু ওনারা ৯৬ অধ্যায়ের ১৯, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৬ এই শ্লোক গুলোর। এর অর্থ হচ্ছে যারা সত্য প্রচার করছি বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, তারা মূলত মিথ্যা প্রচার করে সনাতন ধর্মকে কলুষিত করার পায়তারা করছে।
এবার দেখে নেই শান্তিপর্বের ৯৬/১৮ শ্লোকে কী আছে,
নহি শৌর্য্যাৎ পরং কিঞ্চিন্ত্রিষু লোকেষু বিদ্যতে।
শুরঃ সর্ব্বং পালয়তি সর্ব্বং শুরে প্রতিষ্ঠিতম।।
শান্তিপর্ব ৯৬/১৮
অর্থ: এই ত্রিভুবনে বীরত্ব অপেক্ষা উত্তম গুণ আর কিছুই নাই। কারণ বীর সমস্তকিছু রক্ষা করেন এবং বীরের উপরেই সমস্তকিছু প্রতিষ্ঠিত থাকে।
এখানে বীরের গুণগান করা হয়ে বলে হুর লোভীরা মনে করেছেন তাদের যেমন নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে বেহেস্তে সেইসব নপুংসক তথাকথিত বীরগণ হুর পায়, তেমনি বুঝি সনাতন ধর্মেও রয়েছে।
অপপ্রচারকারীর দাবী: দ্রোণপর্ব (৬৫/৬) ভগীরথও সুসজ্জিত সুন্দরী নারী হাজারে হাজারে দান করেছিলেন।
অপপ্রচারের জবাব : দ্রোণ পর্বের ৬৫/৬ এ যুদ্ধের বর্ণনা আছে।
স তথা চোদিতোহস্মাভিঃ সদদ্ধ ইব বীর্য্যবান।
অসন্থমপি তং ভারং বোঢ়ুমেকঃ প্রচক্রেম।
দ্রোণ পর্ব ৬৫/৬
অর্থ: আমরা সেইভাবে আদেশ করিলে, সুশিক্ষিত অশ্বের ন্যায় বলবান অভিমন্যু একাকী সেই অসহ্য ভারও বহন করিবার উপক্রম হইলেন
অপপ্রচারকারীর দাবী: মহাভারতের ১২/৪০/১ এ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিকে বলছেন, নারীর চেয়ে অশুভ আর কিছুই নেই। নারীর প্রতি পুরুষের কোনো মায়া মমতা স্নেহ থাকা উচিৎ নয়।
অপপ্রচারের জবাব: ৬ নং অপপ্রচারের জবাবে দেখানো হয়েছে মহাভারতের ১২ তম পর্বটি হচ্ছে শান্তি পর্ব।
শান্তি পর্বের ৪০ অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে উল্লেখ আছে,
বৈশম্পায়ন উবাচ-
ততঃ কুন্তীসুতো রাজা গতমন্যুর্গতজ্বরঃ।
কাঞ্চনে প্রাঙমুখো হৃষ্টো ন্যষীদৎ পরমাসনে।
শান্তিপর্ব ৪০.১
অর্থ: বৈশম্পায়ন বলিলেন- তাহার পর যুধিষ্ঠির দৈন্যশূন্য, সন্তাপবিহীন ও আনন্দিত হইয়া, অতি উৎকৃষ্ট স্বর্ণময় আসনে পূর্বমুখে উপবেশন করিলেন।
এখানে দেখা যাচ্ছে উক্ত রেফারেন্সের উক্তিটি হচ্ছে বৈশম্পায়নের এবং যুধিষ্ঠির কীভাবে যজ্ঞ করেছিলেন তার বর্ণনা আছে। এখানে নারী সংক্রান্ত কোনো কথা নেই
অপপ্রচারকারীর দাবী: (১২/২০/২০) পৃথিবীতে কোনো নারী স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়। এবং (১২/৪/৮) যুধিষ্ঠির বলেন, নারীর দ্বারা বংশ কলঙ্কিত হয়।
অপপ্রচারের জবাব: এখানে যে দুটো রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে উভয়ই ১২ তম পর্বের অর্থাৎ শান্তি পর্বের। শান্তি পর্বের ২০ অধ্যায়ে শ্লোক মাত্র ১৪ টি থাকায় এর অনুবাদ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
এরপরে যে শান্তিপর্বের ৪/৮ এর রেফারেন্স দেওয়া সেই রেফারেন্স অনুসারে মহাভারতে খুঁজলে কী পাওয়া যায় সকলে দেখুন,
এতে চান্যে চ বহবো দক্ষিণাং দিশমাশ্রিতাঃ।
ম্লেচ্ছাশ্চার্য্যাশ্চ রাজানঃ প্রাচ্যোদীচ্যাস্তথৈব।।
শান্তিপর্ব ৪/৮
অর্থ: দক্ষিণ দেশীয় অন্য বহু রাজা এবং পূর্বদেশীয় ও উত্তর দেশীয় ম্লেচ্ছ ও আর্য্যবংশসম্ভূত রাজারা আগমন করিলেন।
এখানে নারী বিষয়ে কোনো কথা নেই। এমনও হতে পারে এখানে ম্লেচ্ছ লেখা দেখে যবনরা তাদের ধর্মে যেভাবে নারীকে সম্মানিত (!) করা হয়েছে সেই কথা গুলো এখানে কাল্পনিক ভাবে অনুপ্রবেশ করিয়েছে
...চলবে
দাদা ফেস বুক এর একটি প্রেজ এ মনুসংহিতা নিয়ে অপ্রচার করছে, আপনি যদি তাদের জবাব দেন তাহলে ভালো হয়।
ReplyDelete