মহাভারতের শান্তিপর্বের বিখ্যাত ভৃগু-ভরদ্বাজ সংলাপের কথা আপনারা অনেকেই জানেন।বর্ণপ্রথা আসলে জন্মভিত্তিক নয়,কর্মভিত্তিক,সনাতন ধর্মে কোন বর্ণ ই বড় ছোট নয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে মহর্ষি ভৃগু ও মহর্ষি ভরদ্বাজের মধ্যেকার এই রুপক কথোপকথন টি প্রসিদ্ধ।
John Murdoch তাঁর মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় এই কথোপকথন এর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছিলেন যে বর্ণপ্রথা জন্মভিত্তিক নয়। John Muir ও তাঁর লেখায় মত দেন যে অনুশাসন পর্বের সঙ্গী শান্তি পর্বে বুঝা যায় যে শ্রেণী,গোত্র,জন্ম,রং নয় বরং কাজ এবং চরিত্রের ভিত্তিতেই বর্ণ নির্ধারিত হয়।আমরা আজ মহাভারতের শান্তি পর্বের মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়ে অবস্থিত সেই বিখ্যাত কথোপকথন টি দেখব।
ভৃগু বললেন,
অসৃজদ্ব্রাহ্মণানেব পূর্বং ব্রহ্মা প্রজাপতীন্।
আত্মতেজোভিনির্বৃত্তান্ভাস্করাগ্নিসমপ্রভান্॥
পূর্বে(সৃষ্টি বা
সভ্যতার শুরুতে) প্রজাপতি ব্রহ্মা ব্রাহ্মণ এর সৃজন করলেন যারা ছিলেন সূর্যের মত
তেজোময়।
(মহাভারত ১২.১৮১.১)
ততঃ সত্যং চ ধর্মং চ তপো
ব্রহ্ম চ শাশ্বতম্।
আচারং চৈব শৌচং চ সর্গাদৌ বিদধে প্রভুঃ॥
আচারং চৈব শৌচং চ সর্গাদৌ বিদধে প্রভুঃ॥
তিনি সৃজন করলেন চিরন্তন
বেদের,সত্যের,ধর্মের,তপস্যার,শুদ্ধতার যাতে আমরা পরম
প্রাপ্তির আচার শিক্ষা করতে পারি।
(১২.১৮১.২)
দেবদানবগন্বর্গা
দৈত্যাসুরমহোরগাঃ।
যক্ষরাক্ষসনাগাশ্চ পিশাচা মনুজাস্তথা॥
যক্ষরাক্ষসনাগাশ্চ পিশাচা মনুজাস্তথা॥
সৃষ্টি করলেন দেব দানব
রাক্ষস পিশাচ যক্ষ এবং মানুষদের
(১২.১৮১.৩)
ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া
বৈশ্যাঃ শূদ্রাশ্চ দ্বিজসত্তম।
যে চান্যে ভূতসঙ্ঘানাং সংঘাতাস্তাংশ্চ নির্মমে॥
যে চান্যে ভূতসঙ্ঘানাং সংঘাতাস্তাংশ্চ নির্মমে॥
মানুষ বিভক্ত হল
ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য, শুদ্র এই চার দ্বিজবর্ণে(দ্বিজ মানে যাদের দুইবার জন্ম
হয়,যাদের উপনয়ন হয়।খেয়াল করুন পাঠক ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শুদ্র সবাইকে দ্বিজ বলা হচ্ছে।অর্থাৎ সবার ই উপনয়ন হয়)।
(১২.১৮১.৪)
ব্রাহ্মণানাং সিতো বর্ণঃ ক্ষত্রিয়াণাং তু লোহিতঃ।
বৈশ্যানাং পীতকো বর্ণঃ শূদ্রাণামসিতস্তথা॥
বৈশ্যানাং পীতকো বর্ণঃ শূদ্রাণামসিতস্তথা॥
ব্রাহ্মণ হল সাদা,ক্ষত্রিয় হল লাল,বৈশ্য হল হলুদ আর শুদ্র হল কাল।
(১২.১৮১.৫)
ভরদ্বাজ উবাচ।চাতুর্বর্ণ্যস্য বর্ণেন যদি বর্ণো বিভজ্যতে।
সর্বেষাং খলু বর্ণানাং দৃশ্যতে বর্ণসংকরঃ॥
সর্বেষাং খলু বর্ণানাং দৃশ্যতে বর্ণসংকরঃ॥
ভরদ্বাজ বললেন,
কিন্তু এই শরীরের বর্ণ দিয়ে বর্ণ কি করে হয়?সব বর্ণেই তো সব রং এর মানুষ পাওয়া যায়।
(১২.১৮১.৬)
কামঃ ক্রোধো ভয়ং লোভঃ শোকশ্চিন্তা ক্ষুধা শ্রমঃ।
সর্বেষাং নঃ প্রভবতি কস্মাদ্বর্ণো বিভজ্যতে॥
সর্বেষাং নঃ প্রভবতি কস্মাদ্বর্ণো বিভজ্যতে॥
সবার মধ্যেই(চার বর্ণের)
দেখি কাম,ক্রোধ,ভয়,লোভ,শোক,দুশ্চিন্তা,ক্ষুধা,শ্রম আছে।তাহলে কিভাবে শুধু শরীরের
বৈশিষ্ঠ্যের ভিত্তিতে বর্ণ আলাদা হবে?
স্বেদমূত্রপুরীষাণি
শ্লেষ্মা পিত্তং সশোণিতম্।
তনুঃ ক্ষরতি সর্বেষাং কস্মাদ্বর্ণো বিভজ্যতে॥
তনুঃ ক্ষরতি সর্বেষাং কস্মাদ্বর্ণো বিভজ্যতে॥
সবার ই ঘাম
হয়,মল-মূত্র,কফ,শ্লেষ্মা,পিত্ত হয়,সবার শরীরেই একই রক্ত বাহিত হয়।তাহলে কিভাবে
মানুষ এর মধ্যে বিভাজন করা যায়?
(১২.১৮১.৮)
জঙ্গমানামসঙ্খ্যেয়াঃ
স্থাবরাণাং চ জাতয়ঃ।
তেষাং বিবিধবর্ণানাং কুতো বর্ণবিনিশ্চয়ঃ॥
তেষাং বিবিধবর্ণানাং কুতো বর্ণবিনিশ্চয়ঃ॥
(১২.১৮১.৯)
স্থাবর জঙ্গম সকল কিছুর
ই এত বেশী প্রকার রয়েছে যে কিভাবে এদেরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা সম্ভব?
ভৃগুরুবাচ। ন বিশেষোঽস্তি বর্ণানাং সর্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ।
ব্রাহ্মণাঃ পূর্বসৃষ্টা হি কর্মভির্বর্ণতাং গতাঃ।।
ব্রাহ্মণাঃ পূর্বসৃষ্টা হি কর্মভির্বর্ণতাং গতাঃ।।
ভৃগু বললেন,
আসলেই এই জগতে সকল
বর্ণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।প্রথমে জগতে সবাই ই ব্রাহ্মণ ছিল।কিন্তু পরে কর্ম
বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই কর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন বর্ণে ভাগ হয়ে গেল।
(১২.১৮১.১০)
কামভোগপ্রিয়াস্তীক্ষ্ণাঃ
ক্রোধনাঃ প্রিয়সাহসাঃ।
ত্যক্তস্বধর্মা রক্তাঙ্গাস্তে দ্বিজাঃ ক্ষত্রতাং গতাঃ॥
ত্যক্তস্বধর্মা রক্তাঙ্গাস্তে দ্বিজাঃ ক্ষত্রতাং গতাঃ॥
যারা যারা
কামভোগপ্রিয়,রাগী কিন্তু তীক্ষ্ণ ও সাহসী স্বধর্মের কর্তব্যপালক হল সেই দ্বিজরা
ক্ষত্রিয় হল।
(১২.১৮১.১১)
গোষু বৃত্তিং সমাধায় পীতাঃ
কৃষ্যুপজীবিনঃ।
স্বধর্মান্নানুতিষ্ঠন্তি তে দ্বিজা বৈশ্যতাং গতাঃ॥
স্বধর্মান্নানুতিষ্ঠন্তি তে দ্বিজা বৈশ্যতাং গতাঃ॥
যারা এসব না করে
অধ্যাবসায়ী ও ভালো হৃদয়ের অধিকারী হল,পশু চরানো এবং কৃষিকাজে যোগ দিল তারা বৈশ্য
হল।
(১২.১৮১.১২)
হিংসানৃতপ্রিয়া লুব্ধাঃ
সর্বকর্মোপজীবিনঃ।
কৃষ্ণাঃ শৌচপরিভ্রষ্টাস্তে দ্বিজাঃ শূদ্রতা গতাঃ॥
কৃষ্ণাঃ শৌচপরিভ্রষ্টাস্তে দ্বিজাঃ শূদ্রতা গতাঃ॥
আর যারা কোন কর্তব্য
করতে চাইলনা,হিংসা,লোভ নিয়ে পরে থাকল,অপরের ক্ষতি করল তারা শুদ্র হল।
(১২.১৮১.১৩)
ইত্যেতৈঃ কর্মভির্ব্যস্তা দ্বিজা বর্ণান্তরং গতাঃ।
ধর্মো যজ্ঞক্রিয়া চৈষাং নিত্যং ন প্রতিষিধ্যতে॥
এভাবে কর্মের মাধ্যমে
আলাদা হ্যে সব দ্বিজ বাকী ৩ বর্ণে বর্ণান্তরিত হল।তাই এই সব বর্ণের ই
ধর্ম,যজ্ঞক্রিয়া সকল কিছু নিত্যকর্মের(বেদ পাঠাদি) সমান অধিকার আছে।
(১২.১৮১.১৪)
ইত্যেতে চতুরো বর্ণা যেষাং
ব্রাহ্মী সরস্বতী।
বিহিতা ব্রহ্মণা পূর্বং লোভাত্ৎবজ্ঞানতাং গতাঃ॥
বিহিতা ব্রহ্মণা পূর্বং লোভাত্ৎবজ্ঞানতাং গতাঃ॥
এভাবে চতুর্বর্ণ সবাই
প্রথমে ব্রাহ্মণ হিসেবেই সৃষ্টি হয়েছিল এবং ব্রহ্ম তাঁর বাণী বেদ এদের সবার জন্যেই
ব্যাক্ত করেছেন।
(১২.১৮১.১৫)
পিশাচা রাক্ষসাঃ প্রেতা বিবিধা ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।
প্রনষ্টজ্ঞানবিজ্ঞানাঃ স্বচ্ছন্দাচারচেষ্টিতাঃ॥
যারা দ্বিজত্বের গুণ থেকে
বিচ্যুত হল তারা রাক্ষস,পিশাচ,প্রেত,স্লেচ্ছ এসব হল(খেয়াল করুন রাক্ষস,পিশাচ এরা কোন উদ্ভট প্রাণী
নয়।এরাও আমাদের মতই মানুষ,রাবণ কোন ১০ মাথাওয়ালা জন্তু নয়।)
(১২.১৮১.১৮)
প্রজা ব্রাহ্মণসংস্কারাঃ স্বকর্মকৃতনিশ্চয়াঃ।
ঋষিভিঃ স্বেন তপসা সৃজ্যন্তে চাপরে পরৈঃ॥
তপস্যাবান ঋষিরা যারা
সৃষ্টিকে বর্ধিত করলেন এবং সনাতন বেদে দেয়া বিধান অনুসারে মানবজাতিকে শিক্ষা
দিলেন।
(১২.১৮১.১৯)
আদিদেবসমুদ্ভূতা ব্রহ্মমূলাক্ষয়াব্যযা।
সা সৃষ্টির্মানসী নাম ধর্মতন্ত্রপরায়ণা॥
তাই এই সৃষ্টি ব্রহ্ম
হতেই উদ্ভুত আর ধর্মের উপরেই এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।
(১২.১৮১.২০)
আর এজন্যেই মহর্ষি ব্যাসদেব এবং রাজা জনক মহাভারতে বলেছেন-
ভবন্তো বেহুলাঃ সন্ত বেদবিস্তার্যতাময়ম
(মহাভারত ১২.৩৩৫.৪৪)
অর্থাৎ তোমরা বহুগুণে বর্ধিত হও,সকলের মধ্যে বেদের বিস্তার কর।
আরও বলেছেন শ্রাবয়েচ্চতুরো বর্ণান কৃত্বা ব্রাহ্মণমগ্রত
(১২.৩৩৫.৪৮)
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ অগ্রে বেদচর্চা করলেও চতুর্বর্ণের সবাইকে বেদশিক্ষা দাও,বেদ শোনাও।
সকলে বেদের চর্চা করুন,বেদের বিস্তার করুন।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
আর এজন্যেই মহর্ষি ব্যাসদেব এবং রাজা জনক মহাভারতে বলেছেন-
ভবন্তো বেহুলাঃ সন্ত বেদবিস্তার্যতাময়ম
(মহাভারত ১২.৩৩৫.৪৪)
অর্থাৎ তোমরা বহুগুণে বর্ধিত হও,সকলের মধ্যে বেদের বিস্তার কর।
আরও বলেছেন শ্রাবয়েচ্চতুরো বর্ণান কৃত্বা ব্রাহ্মণমগ্রত
(১২.৩৩৫.৪৮)
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ অগ্রে বেদচর্চা করলেও চতুর্বর্ণের সবাইকে বেদশিক্ষা দাও,বেদ শোনাও।
সকলে বেদের চর্চা করুন,বেদের বিস্তার করুন।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি