দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







জন্মভিত্তিক জাতপাত ও স্বামী বিবেকানন্দ নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব-পর্বঃ ২

অমৃতস্য পুত্রা
0


  • নমস্কার ভ্রাতাভগ্নিগণ। এক বাওন লেখক, জন্মভিত্তিক জাতপাতকে প্রতিষ্ঠা করতে কতটা নিচে নেমে স্বামীজির বাণী দিয়ে মানুষকে চতুরতার সাথে ধোঁকা দিতে পারে তা আমরা প্রথম পর্বে দেখিয়েছি, লিংকঃ https://www.agniveerbangla.org/2019/06/blog-post_84.html


আজ বাকিটা তুলে ধরার প্রয়াস করছি।
বাওন মশায়ের দেওয়া প্রথম রেফারেন্সঃ
"ভগবদ্‌গীতা জন্ম ও অবস্থা (বর্ণাশ্রম)-গত কর্তব্যের কথা বার বার উল্লেখ করিয়াছেন।বিভিন্ন কর্মের প্রতি কোন্ ব্যক্তির মনোভাব কিরূপ হইবে, তাহা ঐ ব্যক্তির বর্ণ আশ্রম ও সামাজিক মর্যাদা অনুসারেই অনেকটা নিরূপিত হয়। এইজন্য আমাদের কর্তব্য, যে সমাজে আমরা জন্মগ্রহণ করিয়াছি, সেই সমাজের আদর্শ ও কর্মধারা অনুসারে এমন কাজ করা, যাহা দ্বারা আমাদের জীবন উন্নত ও মহৎ হয়।"
(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১ম খন্ড, পৃঃ৬৯)


এখানে শেষ লাইন টি খেয়াল করুন।
স্বামিজীর মতে আমাদের কর্তব্য, যে সমাজে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেই সমাজের *আদর্শ* ও *কর্মধারা* অনুসারে এমন কাজ করা উচিত। আর এই সমাজের *আদর্শ* কি? স্বামিজীর মতে, "আধ্যাত্মিক-সাধনসম্পন্ন ও মহাত্যাগী ব্রাহ্মণই আমাদের আদর্শ। ‘ব্রাহ্মণ আদর্শ’ বলিতে আমি কি বুঝিতেছি?—যাহাতে সাংসারিকতা একেবারে নাই এবং প্রকৃত জ্ঞান প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান, তাহাই আদর্শ ব্রাহ্মণত্ব। ইহাই হিন্দুজাতির আদর্শ।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৬।) অর্থাৎ এই আদর্শ হলো প্রকৃত জ্ঞানে জ্ঞানী ব্রাহ্মণ। আর আদর্শ কি জিনিস? আদর্শ হলো অনুকরণযোগ্য বিষয়। এখানে সবার অনুকরণীয় হলো প্রকৃত ব্রাহ্মণ, আদর্শকে অনুকরণ করে আদর্শ ব্রাহ্মণ হতে হবে। আর *কর্মধারা কি? স্বামিজীর কথায়,"যদি ভারতের ইতিহাস পড়, তবে দেখবে—এখানে বরাবরই নিম্নজাতিকে উন্নত করবার চেষ্টা হয়েছে। অনেক জাতিকে উন্নত করা হয়েছেও। আরও অনেক হবে। শেষে সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। এই আমাদের কার্যপ্রণালী।"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২) এই হলো কর্মধারার প্রণালী।জন্ম যেখানেই হোক, সকলকেই ব্রাহ্মণ করাই উক্ত ধারা, জন্মভিত্তিক কোন কিছু নয়।


লেখক, বাওন মশায় তুলে ধরেছেন, " জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ-কোটি লোক এখনও খাইবার জন্য এক টুকরা রুটি পাইতেছে। অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আজ আপনারা পড়িবার জন্য একখানিও সংস্কৃত বই পাইতেন না। এই জাতিবিভাগের দ্বারা এমন একটি দৃঢ় প্রাচীরের সৃষ্টি হইয়াছিল যে, জাতির উপর বহিরাক্রমণের শত প্রকার তরঙ্গাঘাত আসিয়া পড়িয়াছে, অথচ কোনমতেই উহাকে ভাঙিতে পারে নাই। এখনও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ২য় খন্ড, পৃঃ৩৫৮)

এখানে স্বামীজি জাতিভেদের প্রসংশা করেছেন বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু বাওন মশায় ২য় লাইনটিকে চোখেই দেখেন নাই, স্বামীজি বলেছেন,"অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।" জাতিবিভাগ নির্ধারিত হবে বৈদিক বর্ণাশ্রম অনুযায়ী, যদি এই নির্ধারণ হয় জন্মভিত্তিক তবে তা হবে অসম্পূর্ণ রীতি, যার পরিণতি ভয়াবহ।


স্বামীজির জন্মভিত্তিক প্রাপ্ত কর্ম পালন করার কথা দেখিয়ে বাওন মশায়, জন্মভিত্তিক প্রথা প্রমাণ করারও প্রয়াস করেছেন দক্ষ চতুরের মতো।

 বাওন মশায়, তুলে ধরেছেন,"জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলেই থাকবে, চাষা চাষই করবে। জাত-ব্যবসা ছাড়বে কেন? ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ’—এই ভাবে শিক্ষা পেলে এরা নিজ নিজ বৃত্ত ছাড়বে কেন? জ্ঞানবলে নিজের সহজাত কর্ম যাতে আরও ভাল করে করতে পারে, সেই চেষ্টা করবে।"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৮)

বাওন মশায় এটুকু তুলে দিয়েই লাপাত্তা! এর পরে স্বামীজি কি বলেছেন তা আমরা দেখে নিই। স্বামীজি এর পরেই বলেছেন,"দু-দশ জন প্রতিভাশালী লোক কালে তাদের ভেতর থেকে উঠবেই উঠবে। তাদের তোরা (ভদ্র জাতিরা) তোদের শ্রেণীর ভেতর করে নিবি। তেজস্বী বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণেরা যে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, তাতে ক্ষত্রিয় জাতটা ব্রাহ্মণদের কাছে তখন কতদূর কৃতজ্ঞ হয়েছিল—বল্ দেখি? ঐরূপ sympathy (সহানুভূতি) ও সাহায্য পেলে মানুষ তো দূরের কথা,পশুপক্ষীও আপনার হয়ে যায়।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৮) দেখুন,স্বামীজি বলেছেন যে, যদি কুমোর, জেলে,চাষা থেকে উপরে উঠে তবে তাদেরকেও নিজেদের ভেতর করে নিতে বলেছেন। উদহারন দিয়েছেন বিশ্বামিত্রের। যদি কুমোর, জেলে, চাষা থেকেও কেউ ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতে পারে তবে তাকে স্বামীজি ব্রাহ্মণ বলেই গ্রহণ করতে বলেছেন। স্বামীজির তুলে দেওয়া এই কথাগুলো জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাকে সাপোর্ট করে কিনা তা নিজেই বিচার করুন।

এরপর দেখুন সেই বাওনের আরেক নির্লজ্জ উপস্থাপন,"জান তো ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—‘ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নং’ ইত্যাদি১৮; সমধর্মীদের মধ্যেই বিবাহ-প্রচলনের কথা আমি বলে থাকি।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩)

আমি এই স্থলে স্বামিজীর কথা বলার পুরো প্রসঙ্গটিই তুলে দিলাম, "২৪ জানুআরী, ১৮৯৮। ১২ মাঘ, সোমবার। গত শনিবার যে-লোকটি প্রশ্ন করিয়াছিলেন তিনি আবার আসিয়াছেন। তিনি intermarriage (অন্তর্বিবাহ) সম্বন্ধে আবার কথা পাড়িলেন। বলিলেন, ‘ভিন্ন জাতির সহিত আমাদের কিরূপে আদান-প্রদান হতে পারে?" স্বামীজি এর উত্তরে বলেছিলেন,"বিধর্মী জাতিদের ভেতর আদান-প্রদান হবার কথা আমি বলি না। অন্ততঃ আপাততঃ তা সমাজ-বন্ধনকে শিথিল করে নানা উপদ্রবের কারণ হবে, এ কথা নিশ্চিত। জান তো ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—‘ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নং’ ইত্যাদি১৮; সমধর্মীদের মধ্যেই বিবাহ-প্রচলনের কথা আমি বলে থাকি।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩) দেখেছেনতো নির্লজ্জতা? এটা একরকম ধোঁকা দেওয়া, বিকৃত উপস্থাপন, মিথ্যাচার। এরকম একজন মিথ্যাচারী নিজেকে কি করে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করতে পারে? ব্রাহ্মণ কি মিথ্যাবাদ হতে পারে? কখনো নয়, মিথ্যাচারী হয় বাওনরা।

এবার আবার মজা নিন, দেখুন সেই বাওনের প্রতিবন্ধী অবস্থা! বাওন মশায় তুলে ধরেছেন,
"আমি সব জাতকে একাকার করতে বলি না। জাতিবিভাগ খুব ভাল। এই জাতিবিভাগ-প্রণালীই আমরা অনুসরণ করতে চাই।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২)


আপনারা পুরো কথাটা দেখুন, নিজেই ধরুন মিথ্যাচার, একজন বাওন কত নিচে নামতে পারে দেখেন। স্বামীজি বলেছিলেন,"আমি সব জাতকে একাকার করতে বলি না। জাতিবিভাগ খুব ভাল। এই জাতিবিভাগ-প্রণালীই আমরা অনুসরণ করতে চাই। জাতিবিভাগ যথার্থ কি, তা লাখে একজন বোঝে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে জাত নেই। ভারতে আমরা জাতিবিভাগের মধ্য দিয়ে ‘জাতির অতীত’ অবস্থায় গিয়ে থাকি। জাতিবিভাগ ঐ মূলসূত্রের উপরই প্রতিষ্ঠিত। ভারতে এই জাতিবিভাগ-প্রণালীর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে ব্রাহ্মণ করা—ব্রাহ্মণই আদর্শ মানুষ। যদি ভারতের ইতিহাস পড়, তবে দেখবে—এখানে বরাবরই নিম্নজাতিকে উন্নত করবার চেষ্টা হয়েছে। অনেক জাতিকে উন্নত করা হয়েছেও। আরও অনেক হবে। শেষে সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। এই আমাদের কার্যপ্রণালী।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২) কি বুঝলেন? যদি স্বামীজি জন্মভিত্তিক কিছু নির্দেশ করতেন তবে কি নিম্নজাতিকে ব্রাহ্মণ হবার কথা বলতেন? বাওন মশায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, তাই এসব মাথায় ঢোকেনা।
এরপর দেখেন, বাওন মশায় তুলে ধরেছেন,"আমাদের দৃষ্টিতে সদ্‌গুণ এবং সৎকুলে জন্মই জাতি নির্ধারণ করে, টাকা নয়।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১০ম খন্ড, পৃঃ৫২) কথা সত্য। কিন্তু বাওনের ঘরে জন্মালেই সে সৎগুণ তা এই মিথ্যাচারী বাওনকে দেখলেই বোঝা যায়। দেখেছেন তো, নিজেকে সৎগুণের দাবী করে কে? ঘোর কলি!


জন্মভিত্তিক জাতপাত প্রমাণ করতে, বাওন মশায় স্বামীজির এই কথা তুলে ধরেছেন, "আমরা অস্বীকার করিতে পারি না, শরীরমাত্রেই উত্তরাধিকারসূত্রে কতকগুলি প্রবণতা লাভ করে, কিন্তু সেগুলি সম্পূর্ণ দৈহিক। এই দৈহিক প্রবণতার মাধ্যমেই মনের বিশেষ প্রবণতা ব্যক্ত হয়। মনের এরূপ বিশেষ প্রবণতার কারণ পূর্বানুষ্ঠিত কর্ম। বিশেষ কোন প্রবণতাসম্পন্ন জীব সদৃশবস্তুর প্রতি আকর্ষণের নিয়মানুসারে এমন এক শরীরে জন্মগ্রহণ করিবে, যাহা তাহার ঐ প্রবণতা বিকশিত করিবার সর্বশ্রেষ্ঠ সহায় হয়। ইহা সম্পূর্ণ ভাবে বিজ্ঞান-সম্মত, কারণ বিজ্ঞান অভ্যাস দ্বারা সব কিছু ব্যাখ্যা করিতে চায়, অভ্যাস আবার পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠানের ফল। সুতরাং অনুমান করিতে হইবে, নবজাত প্রাণীর স্বভাবও তাহার পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠিত কর্মের ফল; এবং যেহেতু তাহার পক্ষে বর্তমান জীবনে ঐগুলি লাভ করা অসম্ভব, অতএব অবশ্যই পূর্ব জীবন হইতেই ঐগুলি আসিয়াছে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচন, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩)

এখানে স্বামীজি কি লিখেছেন তা বাওন মশায় বোঝার ক্ষমতা রাখেন নি। স্বামীজি বলেছেন, " শরীরমাত্রেই উত্তরাধিকারসূত্রে কতকগুলি প্রবণতা লাভ করে, কিন্তু সেগুলি সম্পূর্ণ দৈহিক।" আর ব্রাহ্মণ্যত্ব কি দৈহিক কোন ব্যাপার? এই কথাগুলো স্বামীজি পূর্বজন্মের প্রসঙ্গে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, জন্মভিত্তিক জাতপাত প্রমাণ করতে নয়। এটি আরও স্পষ্ট হবে এরে পরের কথা দিয়ে। এরপরেই স্বামীজি বলেছেন, "আর একটি প্রশ্নের ইঙ্গিত আছে। স্বীকার করা গেল পূর্বজন্ম আছে, কিন্তু পূর্ব জীবনের বিষয় আমাদের মনে থাকে না কেন? ইহা সহজেই বুঝান যাইতে পারে। আমি এখন ইংরেজীতে কথা বলিতেছি, ইহা আমার মাতৃভাষা নয়। বাস্তবিক এখন আমার চেতন-মনে মাতৃভাষার একটি অক্ষরও নাই। কিন্তু যদি আমি মনে করিতে চেষ্টা করি, তাহা হইলে উহা এখনই প্রবল বেগে মনে উঠিবে। এই ব্যাপারে বুঝা যাইতেছে, মনঃসমুদ্রর উপরিভাগেই চেতন-ভাব অনুভূত হয় এবং আমাদের পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতা সেই সমুদ্রের গভীরদেশে সঞ্চিত থাকে। চেষ্টা ও সাধনা কর, ঐগুলি সব উপরে উঠিয়া আসিবে, এমন কি পূর্বজন্ম সম্বন্ধেও তুমি জানিতে পারিবে। পূর্বজন্ম সম্বন্ধে ইহাই সাক্ষাৎ ও পরীক্ষামূলক প্রমাণ।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচন, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩-১৪, হিন্দুধর্ম)


বাওন মশায়ের যুক্তি স্বামীজির এই বাণী, "এই ‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্মই’ সকল দেশে সামাজিক কল্যাণের উপায়—মুক্তির সোপান। ঐ ‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্ম’ নাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশটার অধঃপতন হয়েছে....
আমি গুণগত জাতির কথা বলছি না, বংশগত জাতির কথা বলছি, জন্মগত জাতির কথা বলছি। গুণগত জাতিই আদি, স্বীকার করি; কিন্তু গুণ দু-চার পুরুষে বংশগত হয়ে দাঁড়ায়। সেই আসল জায়গায় ঘা পড়ছে, নইলে সর্বনাশ হল কেন? ‘সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।’" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ১২৪) 


 এখানে 'জাতিধর্ম' 'স্বধর্ম' কি? জন্মভিত্তিক জাতপাত? বাওন মশায় কচু বুঝেছেন, স্বামীজিরই কথায়, "কেমন করে এ ঘোর বর্ণসাঙ্কর্য উপস্থিত হল—সাদা রঙ কালো কেন হল, সত্ত্বগুণ রজোগুণপ্রধান তমোগুণে কেন উপস্থিত হল—সে সব অনেক কথা, বারান্তরে বলবার রইল। আপাততঃ এইটি বোঝ যে, জাতিধর্ম যদি ঠিক ঠিক থাকে তো দেশের অধঃপতন হবেই না। এ-কথা যদি সত্য হয়, তা হলে আমাদের অধঃপতন কেন হল? অবশ্যই জাতিধর্ম উৎসন্নে গেছে। অতএব যাকে তোমরা জাতিধর্ম বলছ, সেটা ঠিক উল্টো। প্রথম পুরাণ পুঁথি-পাটা বেশ করে পড়গে, এখনি দেখতে পাবে যে, শাস্ত্র যাকে জাতিধর্ম বলছে, তা সর্বত্রই প্রায় লোপ পেয়েছে। তারপর কিসে সেইটি ফের আসে, তারই চেষ্টা কর; তা হলেই পরম কল্যাণ নিশ্চিত।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচন, ষষ্ঠ খন্ড, স্বধর্ম বা জাতিধর্ম, পৃষ্ঠা ১৩-১৪) স্বামীজির মতে জাতিধর্ম উৎসন্নে গেছে। এখন টিকে আছে বাওন মশায়ের বাওনধর্ম, তাই তো আমাদের অধঃপতন। নতুবা অধঃপতন কেমন করে? স্বামীজির মতে এ থেকে উত্তরণের উপায় হলো," উপায় হচ্ছে বৈদিক উপায়—‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্ম’ যেটি বৈদিক ধর্মের—বৈদিক সমাজের ভিত্তি।" আর এই বেদিক উপায় জন্মভিত্তিক নয়, উপায় গুণকর্মানুসারে বৈদিক বর্ণাশ্রম।
বাওন মশায় স্বামীজির এই রেফারেন্স দিয়েছেন, কিন্তু মনে হয় ইংরেজিতে কি লেখা আছে তা দেখেন নি, "If there is inequality in nature, still there must be equal chance for all—or if greater for some and for some less—the weaker should be given more chance than the stronger. অর্থাৎ চণ্ডালের বিদ্যাশিক্ষার যত আবশ্যক, ব্রাহ্মণের তত নহে। যদি ব্রাহ্মণের ছেলের একজন শিক্ষকের আবশ্যক, চণ্ডালের ছেলের দশ জনের আবশ্যক। কারণ যাহাকে প্রকৃতি স্বাভাবিক প্রখর করেন নাই তাহাকে অধিক সাহায্য করিতে হইবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়া পাগলের কর্ম।"
(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, সপ্তম খন্ড, পৃঃ৭২)
/If there is inequality in nature, still there must be equal chance for all/ এটার অর্থ কি বাওন মশায় বুঝেন?বাওন মশায় কি প্রত্যেককেই ইকুয়াল চান্স দিতে পারবেন? প্রত্যেককেই ব্রাহ্মণ হবার চান্স দিবেন? এই বাওন মশায় মরে গেলেও দেবেন না। স্বামীজি বলেছেন,"যদি ব্রাহ্মণের ছেলের একজন শিক্ষকের আবশ্যক, চণ্ডালের ছেলের দশ জনের আবশ্যক।" এখন প্রশ্ন, চন্ডালের ছেলে তো চন্ডালগিরি করার কথা বাওনের মতে,কিন্তু স্বামীজি কেন পড়াতে বললেন? আর প্রকৃত ব্রাহ্মণের ছেলে মানসিক বিকাশের যে পরিবেশ পায়, চন্ডালের ছেলে কি তা পায়? স্বাভাবিকভাবেই চন্ডালের ছেলেকে শেখাতে বেশি শিক্ষকের প্রয়োজন হতেই পারে। এ দিয়ে কি জন্মভিত্তিক বর্ণবাদ প্রমাণ হয়? উদ্ভট সব উপস্থাপনা!

সবশষে বাওন মশায় স্বামীজির বর্ণ বিচার নিয়ে বলেছেন,"আরও একটি কথা। সেটি বর্ণ বিচার-সম্পর্কে। রক্তের বিশুদ্ধতার দিক্‌ থেকে বর্ণবিচারের কিছুটা অর্থ আছে। বংশ-ক্রমিকতা অনস্বীকার্য।.........তবে এটা আমরা জানি যে, রক্তের অবাধ মিশ্রণে জাতির অবনতি হয়।...
হিন্দুরা বর্ণবিভাগ পছন্দ করে। ঠিক বলতে পারি না, তবে হয়তো আমার মধ্যেও সে বর্ণবিভাগের ছোঁয়া লেগে থাকতে পারে পূবর্গ আচার্যগণের আদর্শে আমি বিশ্বাস করি। সে আদর্শ মহান্‌ আদর্শ।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, দশম খন্ড,পৃঃ১৮৮)


এটা কি জন্মভিত্তিক জাতপাত নির্ণয়ে বলা কথা? স্বামীজি এর পরেই যা বলেছেন, তাতেই স্পষ্ট,"কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ খুব সার্থক হয়নি এবং উত্তরকালে ভারতীয় জাতির অধঃপতনের সেটি অন্যতম কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এর ফলে আবার এক প্রচণ্ড সংমিশ্রণও সঙ্ঘটিত হয়েছিল। যেখানে নানাজাতির রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটেছে—কেউ শ্বেত, কেউ পীত, কেউ আমারই মত কৃষ্ণকায়—অর্থাৎ নানা বিপরীত বর্ণের সংমিশ্রণ, অথচ কোন জাতিই নিজ নিজ আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করছে না—সেখানে ধীরে ধীরে এক অভাবিত রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটছে এবং তার ফলে যথাকালে এক মহাবিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আপাততঃ সে মহাদৈত্য ঘুমিয়ে থাকবে, তার জাগরণের দেরী আছে। বিভিন্ন জাতির রক্ত-মিশ্রণের এই পরিণাম।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, দশম খন্ড,পৃঃ১৮৮)


এভাবেই বাওন মশায়, স্বামীজির বাণীকে আংশিকভাবে প্রকাশ করে মিথ্যাচার করেছেন, এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, অর্থই বদলে গেছে! স্বামীজি কোথাও জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাকে সঠিক বলে যান নি। আমরা দুই পর্বে শুধু বাওন মশায়ের তুলে দেওয়া রেফারেন্সগুলোরই যথার্থতা যাচাই করেছি। এরপর স্বামীজির আলোকে জাতপাত সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তুলে ধরার প্রয়াস করবো।
কৃণ্বন্তোবিশ্বমার্যম 🙏

লেখসত্ত্বঃ বাংলাদেশ অগ্নিবীর, সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক।

বিঃদ্রঃ যারা জন্মগুণে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে, সেই সকল তথাকথিত ব্রাহ্মণকে আমরা বাওন বলে সম্বোধন করলাম। প্রকৃত ব্রাহ্মণকে আমরা শ্রদ্ধা করি এবং বাওন বলিনা। আমরা অশাস্ত্রীয় অযৌক্তিক জন্মভিত্তিক জাতপাতে বিশ্বাসী নই, আমরা শাস্ত্রীয় যৌক্তিক বৈদিক বর্ণাশ্রমেে বিশ্বাসী।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)