দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







জন্মভিত্তিক জাতপাত ও স্বামী বিবেকানন্দ নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব-পর্বঃ ১

অমৃতস্য পুত্রা
0

বর্ণবাদীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, অশাস্ত্রীয় জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাকে শাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, নতুন করে বই রচনা করেছে, নাম দিয়েছে 'চতুর্বর্ণতত্ত্বলহরী'। সেই বইয়ে, চতুরতার সাথে কাটছাট করে ব্যবহার করেছে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী, স্বামীজির কথা দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাকে। আমরা লেখকের ঘৃণ্য প্রচেষ্টাকে পর্বাকারে তুলে ধরব।


আমরা যারা শাস্ত্র অধ্যয়ন করি তারা সহজেই বুঝতে পারি যে, বর্ণাশ্রম জন্মগুণে নয়, হয় কর্মগুণে। তাই আমরা জন্মভিত্তিক বর্ণ প্রথার বিরোধ করি, সত্য প্রকাশ করার চেষ্টা করি। এতে যখন কিছু তথাকথিত ব্রাহ্মণের স্বার্থে আঘাত লেগেছে তখনই তারা বোঝাতে শুরু করেছেন যে, স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রথার বিরোধ করতে বলেন নি, এটা প্রমাণ করতে গিয়ে উক্ত বইয়ের লেখক বাঊন মশায় তুলে ধরেছেন, **"যতই বয়োবৃদ্ধি হইতেছে, ততই এই প্রাচীন প্রথাগুলি আমার ভাল বলিয়া বোধ হইতেছে। একসময় আমি ঐগুলির অধিকাংশই অনাবশ্যক ও বৃথা মনে করিতাম। কিন্তু যতই আমার বয়স হইতেছে, ততই আমি ঐগুলির একটিরও বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সঙ্কোচ বোধ করিতেছি। কারণ শত শত শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলে ঐগুলি গঠিত হইয়াছে। গতকালের শিশু—যে আগামীকালই হয়তো মৃত্যুমুখে পতিত হইবে—সে যদি আসিয়া আমাকে আমার অনেক দিনের সংকল্পিত বিষয়গুলি পরিত্যাগ করিতে বলে এবং আমিও যদি সেই শিশুর কথা শুনিয়া তাহার মতানুসারে আমার কার্যপ্রণালীর পরিবর্তন করি, তবে আমিই আহাম্মক হইলাম, অপর কেহ নহে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ২২।)**


কিন্তু স্বামীজি এখানে প্রাচীন প্রথা বলতে জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার কথা বলেন নি। বরং স্বামীজি পূর্বের প্যারাতেই বলেছেন, "আমাদের জাতিভেদ ও অন্যান্য নিয়মাবলী আপাততঃ ধর্মের সহিত সংসৃষ্ট বলিয়া বোধ হইলেও বাস্তবিক তাহা নহে।"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ২১-২২।) সেই বাঊন মশায় স্বামী বিবেকানন্দের দোহাই দিয়ে আমাদের চুপ রাখার ব্যার্থ প্রয়াস করেছেন, নতুন করে বর্ণবাদী বিবেকানন্দকে চেনাচ্ছেন, তিনি ভেবেছেন আমরা চালাকি ধরতেই পারবোনা! যে কথাটি বাঊন মশায় দেখিয়েছেন তা স্বামীজি যাদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন, যাদেরকে গতকালের শিশুর তুলনা করেছেন,তা স্বামীজীর পরের কথাতেই স্পষ্ট, "ভারতের বাহিরে নানাদেশে হইতে আমরা সমাজ-সংস্কার সম্বন্ধে যে-সকল উপদেশ পাইতেছি, তাহারও অধিকাংশ ঐ ধরনের। তাহাদিগকে বল—তোমরা যখন একটি স্থায়ী সমাজ গঠন করিতে পারিবে, তখন তোমাদের কথা শুনিব।'

বাঊন মশায় তুলে ধরেছেন,**"যদি আমার সময় থাকিত, তবে আমি তোমাদিগকে আনন্দের সহিত দেখাইয়া দিতাম যে, এখন আমাদিগকে যাহা করিতে ইহবে, তাহার প্রত্যেকটি আমাদের প্রাচীন স্মৃতিকারগণ সহস্র সহস্র বৎসর পূর্বেই বলিয়া গিয়াছেন, এবং এখন আমাদের জাতীয় আচার-ব্যবহারে যে-সকল পরিবর্তন ঘটিতেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটিবে, সেগুলিও তাঁহারা যথার্থই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহারাও জাতিভেদলোপকারী ছিলেন, তবে আধুনিকদিগের মত নহে। তাঁহারা জাতিভেদরাহিত্য অর্থে বুঝিতেন না যে, শহরের সব লোক মিলিয়া একত্র মদ্যমাংস আহার করুক, অথবা যত আহাম্মক ও পাগল মিলিয়া যখন যেখানে যাহাকে ইচ্ছা বিবাহ করুক, আর দেশটাকে একটা পাগলা-গারদে পরিণত করুক; অথবা তাঁহারা ইহাও বিশ্বাস করিতেন না যে, বিধবাগণের পতির সংখ্যা দ্বারা কোন জাতির উন্নতির পরিমাণ নির্ণয় করিতে হইবে। এরূপ করিয়া উন্নত হইয়াছে—এমন জাতি তো আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই।
ব্রাহ্মণই আমাদের পূর্বপুরুষগণের আদর্শ ছিলেন। আমাদের সকল শাস্ত্রেই এই ব্রাহ্মণের আদর্শ চরিত্র উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৫-৬৬।)**


এ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, সেই লেখক বাঊন মশায়ও আমাদের আদর্শ! কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের কথা অনুসারে কি তিনি আদর্শ ব্রাহ্মণ? স্বামীজি আদর্শ ব্রাহ্মণ বলতে কি বুঝিয়েছেন? তা স্বামীজির কথাতেই দেখা যাক, স্বামিজী বলেছেন,"আমাদের আভিজাত্যের আদর্শ অন্যান্য জাতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। আধ্যাত্মিক-সাধনসম্পন্ন ও মহাত্যাগী ব্রাহ্মণই আমাদের আদর্শ। ‘ব্রাহ্মণ আদর্শ’ বলিতে আমি কি বুঝিতেছি?—যাহাতে সাংসারিকতা একেবারে নাই এবং প্রকৃত জ্ঞান প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান, তাহাই আদর্শ ব্রাহ্মণত্ব। ইহাই হিন্দুজাতির আদর্শ।তোমরা কি শোন নাই যে, শাস্ত্রে লিখিত আছে—ব্রাহ্মণের পক্ষে কোন বিধিনিষেধ নাই, তিনি রাজার শাসনাধীন নহেন, তাঁহার মৃত্যুদণ্ড নাই? এ-কথা সম্পূর্ণ সত্য। স্বার্থপর অজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে-ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছে, অবশ্য সে-ভাবে বুঝিও না; প্রকৃত মৌলিক বৈদান্তিকভাবে ইহা বুঝিবার চেষ্টা কর। যদি ব্রাহ্মণ বলিতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি স্বার্থপরতা একেবারে বিসর্জন দিয়াছেন, যাঁহার জীবন জ্ঞান ও প্রেম লাভ করিতে এবং উহা বিস্তার করিতেই নিযুক্ত—কেবল এইরূপ ব্রাহ্মণ ও সৎস্বভাব ধর্মপরায়ণ নরনারী দ্বারা যে-দেশ অধ্যুষিত, সে-জাতি ও সে-দেশ যে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধের অতীত হইবে, ইহাতে আর আশ্চর্য কি! তাঁহাদের শাসনের জন্য আর সৈন্য- সামন্ত পুলিস প্রভৃতির কি প্রয়োজন? তাঁহাদিগকে শাসন করিবার কি প্রয়োজন? তাঁহাদের কোন প্রকার শাসনতন্ত্রের অধীনে বাস করিবারই বা কি প্রয়োজন?" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৬।)


এই হলো স্বামীজির আদর্শ ব্রাহ্মণ, এই ব্রাহ্মণ কখনোই জন্মের ভিত্তিতে নয়। এখন প্রশ্ন,সেই বাউন মশায় কি, আধ্যাত্মিক-সাধনসম্পন্ন ও মহাত্যাগী, উনার মাঝে কি সাংসারিকতা একেবারে নাই এবং প্রকৃত জ্ঞান প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান? কদাপি নহে। সুতরাং স্বামীজি কোন ভন্ড বাউনকে আদর্শ ব্রাহ্মণ বলেন নি। স্বামীজি কাদেরকে আদর্শ ব্রাহ্মণ বলেছেন তা পরের কথাতে আরও স্পষ্ট।


স্বামীজি বলেছেন, "তাঁহারা সাধুপ্রকৃতি মহাত্মা—তাঁহারা ঈশ্বরের অন্তরঙ্গস্বরূপ। আর আমরা শাস্ত্রে দেখিতে পাই—সত্যযুগে একমাত্র এই ব্রাহ্মণ-জাতিই ছিলেন। আমরা মহাভারতে পাঠ করিঃ প্রথমে পৃথিবীর সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন; ক্রমে যতই তাঁহাদের অবনতি হইতে লাগিল, ততই তাঁহারা বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হইলেন; আবার যখন যুগচক্র ঘুরিয়া সেই সত্যযুগের অভ্যুদয় হইবে, তখন আবার সকলেই ব্রাহ্মণ হইবেন।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৬।) স্বামীজি বলেছেন, পূর্বে সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলাম,আবার সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। যদি সকলেই আবার ব্রাহ্মণ হয়, তবে যেকোন পরিবারের জন্ম নিলেই হতে পারবে, এটি আরও পরিষ্কার হবে আলোচনার শেষের দিকে। স্বামিজী বলেছেন, আবার সকলেই ব্রাহ্মণ হবে, এটা কি বাঊন মশায় মান্য করেন?


এরপর বাঊন মশায় স্বামীজির কথাকে কেটে অল্প অংশ তুলে ধরেছেন, "সুতরাং উচ্চবর্ণকে নিম্ন করিয়া, আহার-বিহারে যথেচ্ছাচার অবলম্বন করিয়া, কিঞ্চিৎ ভোগ-সুখের জন্য স্ব স্ব বর্ণাশ্রমের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া জাতিভেদ-সমস্যার মীমাংসা হইবে না;"

আমি এইস্থলে পুরো অংশই তুলে দিলাম,"সম্প্রতি যুগচক্র ঘুরিয়া সত্যযুগের অভ্যুদয় সূচিত হইতেছে—আমি তোমাদের দৃষ্টি এ বিষয়ে আকর্ষণ করিতেছি। সুতরাং উচ্চবর্ণকে নিম্ন করিয়া, আহার-বিহারে যথেচ্ছাচার অবলম্বন করিয়া, কিঞ্চিৎ ভোগ-সুখের জন্য স্ব স্ব বর্ণাশ্রমের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া জাতিভেদ-সমস্যার মীমাংসা হইবে না; পরন্তু আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই যদি বৈদান্তিক ধর্মের নির্দেশ পালন করে, প্রত্যেকেই যদি ধার্মিক হইবার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই যদি আদর্শ ব্রাহ্মণ হয়, তবেই এই জাতিভেদ-সমস্যার সমাধান হইবে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৬-৬৭।)


কি দেখলেন? চালাকি বুঝেছেন? বাঊন মশায় চালাকি করে মিমাংসা না হবার কথা তুলে দিয়েছেন, কিন্তু কিসে এই সমস্যার সমাধান হবে, তা তুলে দেন নি। স্বামীজি বলেছেন, প্রত্যকেই যদি আদর্শ ব্রাহ্মণ হয়, তবেই এই জাতিভেদ সমস্যার সমাধান হবে, এ কথাটি বাঊন মশায় লুকিয়েছেন, কারণ একথাতেই স্বামীজির অবস্থান স্পষ্ট।


স্বামীজি আরও বলেছেন,"তোমরা আর্য, অনার্য, ঋষি, ব্রাহ্মণ অথবা অতি নীচ অন্ত্যজ জাতি—যাহাই হও, ভারতবাসী সকলেরই প্রতি তোমাদের পূর্বপুরুষগণের এক মহান্ আদেশ রহিয়াছে। তোমাদের সকলের প্রতিই এই এক আদেশ, সে আদেশ এইঃ ‘চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না, ক্রমাগত উন্নতির চেষ্টা করিতে হইবে। উচ্চতম জাতি হইতে নিম্নতম পারিয়া (চণ্ডাল) পর্যন্ত সকলকেই আদর্শ ব্রাহ্মণ হইবার চেষ্টা করিতে হইবে।’ বেদান্তের এই আদর্শ শুধু যে ভারতেই খাটিবে, তাহা নহে—সমগ্র পৃথিবীকে এই আদর্শ অনুযায়ী গঠন করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমাদের জাতিভেদের ইহাই লক্ষ্য। ইহার উদ্দেশ্য—ধীরে ধীরে সমগ্র মানবজাতি যাহাতে আদর্শ ধার্মিক হয়—অর্থাৎ ক্ষমা ধৃতি শৌচ শান্তিতে পূর্ণ হয়, উপাসনা ও ধ্যান-পরায়ণ হয়। এই আদর্শ অবলম্বন করিলেই মানবজাতি ক্রমশঃ ঈশ্বর লাভ করিতে পারে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৭।)



এখানে স্বামীজি বলেছেন, উচ্চতম জাতি হতে নিম্নতম পারিয়া (চণ্ডাল) পর্যন্ত সকলকেই আদর্শ ব্রাহ্মণ হবার চেষ্টা করতে হবে। জন্মভিত্তিক বাঊন প্রথা এতে আরও স্পষ্টভাবে খন্ডিত হয়ে গেল। সেই বাঊন মশায়ের মন এতই কলুষিত যে, এসব চোখে দেখেন নি, চালাকি করে তথ্যও লুকিয়েছেন!

বাউন মশায় আরও তুলে ধরেছেন, "আমাদের এই পরম পবিত্র মাতৃভূমির কালজীর্ণ আচার ও প্রথাসকলের নিন্দা করিও না; অতি কুসংস্কারপূর্ণ ও অযৌক্তিক প্রথাগুলির বিরুদ্ধেও একটি নিন্দাসূচক কথা বলিও না, কারণ সেগুলি দ্বারাও অতীতে আমাদের কিছু না কিছু কল্যাণ সাধিত হইয়াছে। সর্বদা মনে রাখিও, আমাদের সামাজিক প্রথাগুলির উদ্দেশ্য যেরূপ মহৎ, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই সেরূপ নহে। আমি পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জাতিভেদ দেখিয়াছি, কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য যেরূপ মহৎ, অন্য কোথাও সেরূপ নহে। অতএব যখন জাতিভেদ অনিবার্য,তখন অর্থগত জাতিভেদ অপেক্ষা পবিত্রতা কৃষ্টি ও আত্মত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ বরং ভাল।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খন্ড, পৃঃ ৬৭।) বাউন মশায় এখানে, //অর্থগত জাতিভেদ অপেক্ষা পবিত্রতা কৃষ্টি ও আত্মত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ// এই কথাটা বোঝার ক্ষমতা রাখেন নি, তার লালিত ঘৃণ্য জন্মগত জাতিভেদকে স্বামীজি ভাল বলে যান নি। বাঊন মশায় কর্মগুণ আশ্রিত বৈদিক বর্ণাশ্রমকে বোঝার ক্ষমতা রাখেন না।

বাউন মশায়, তুলে ধরেছেন,"আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রমধর্ম মানবজাতিকে প্রদত্ত ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সম্পদসমূহের অন্যতম।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খন্ড, পৃঃ২৯৭) এখানে শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলতে বাঊন মশায় জন্মভিত্তিক ঘৃণ্য বাঊন প্রথাকে ধরে নিয়েছেন, কিন্তু পরের দুটি প্যারা পড়লেই আমরা স্বামীজির মনোভাব বুঝতে পারব।

পরের প্যারাতেই স্বামীজি তথাকথিত ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্য বলেছেন,"যিনি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলিয়া দাবী করেন, তিনি নিজের সেই পবিত্রতার দ্বারা এবং অপরকেও অনুরূপ পবিত্র করিয়া নিজের দাবী প্রমাণ করুন। ইহার বদলে বেশীর ভাগ ব্রাহ্মণই ভ্রান্ত জন্মগত গর্ব লালন করিতেই ব্যস্ত; স্বদেশী অথবা বিদেশী যে-কোন পণ্ডিত এই মিথ্যাগর্ব ও জন্মগত আলস্যকে বিরক্তিকর কুতর্কের দ্বারা লালন করেন, তিনিই ইহাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় হইয়া দাঁড়ান।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খন্ড, পৃঃ২৯৭)

এখানে স্বামীজি স্পষ্টভাবেই, জন্মগত গর্বকে ভ্রান্ত বলেছেন, বলেছেন এটি মিথ্যা গর্ব ও জন্মগত আলস্য।
স্বামিজী একথা বলেই থেমে যাননি,বলেছেন,

"ব্রাহ্মণগণ, সাবধান, ইহাই মৃত্যুর চিহ্ন। তোমাদের চারিপাশের অব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত করিয়া তোমাদের মনুষ্যত্ব—ব্রাহ্মণত্ব প্রমাণ কর, তবে প্রভুর ভাবে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দূষিত গলিত অহঙ্কারের দ্বারা নয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উদ্ভট সংমিশ্রণের দ্বারাও নয়—শুধু সেবাভাবের দ্বারা। যে ভালভাবে সেবা করিতে জানে, সে-ই ভালভাবে শাসন করিতে পারে।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খন্ড, পৃঃ২৯৭) স্বামিজীর এই সাবধান করা বাণী বাঊনটার কানে পৌছায়নি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দূষিত গলিত অহঙ্কারের দ্বারা বাঊনের বিচারবুদ্ধি আচ্ছন্ন। বাঊন মশায় স্বামিজীর কথা আমাদের শোনাচ্ছেন, কিন্তু নিজে শুনবেন না! আশা করি, সেই বাঊন মশায় স্বামীজির এইসব বাণীও গ্রহণ করবেন এবং নিজেকে শুধরিয়ে নেবেন।


বিঃদ্রঃ যারা জন্মগুণে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে, সেই সকল তথাকথিত ব্রাহ্মণকে বাঊন বলে সম্বোধন করা হলো। প্রকৃত ব্রাহ্মণকে আমরা ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করি। আমরা বৈদিক বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী।

পরের পর্ব - https://www.agniveerbangla.org/2019/06/blog-post_19.html\

লেখসত্ত্বঃ বাংলাদেশ অগ্নিবীর।
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)