দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







ভারতবর্ষের কোন কোন স্থানে শ্রীরামের পদধূলি পড়েছিল?

অমৃতস্য পুত্রা
0




আজ রামনবমী।সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত আবেগের একটি দিন,ভালোবাসার একটি দিন।আজ সনাতন সভ্যতার প্রাণপুরুষ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের আবির্ভাব তিথি।চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথির এমন ই একদিনে যেদিন পূনর্বসু নামক নক্ষত্রের সাথে চাঁদ এক সমান্তরালে ছিল,সেদিন শ্যামবর্ণের, লম্বা লম্বা শাখার ন্যায় হাত ছিল যার,লাল পদ্মের ন্যায় চোখ, রক্তের ন্যায় ওষ্ঠ, দুন্দুভির ন্যায় কণ্ঠের ইক্ষাকু শিরোমণি যার কন্ঠাস্থি দেখা যেতনা এমন উন্নত ঘাড়,চওড়া কাঁধ আর অশেষ বীরত্ব ছিল,সেই সত্যজ্ঞ,ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ দশরথতনয় জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর মহিমা সম্বন্ধে যত লিখব ততই কম পরে যাবে।না তাঁর পর্যাপ্ত গৌরবগাঁথা লেখা কোন মনুষ্যের পক্ষে সম্ভব না তাঁর জীবনকে একজীবনে পুরো আয়ত্ত্ব করা সম্ভব।গত বছর আমরা মাসব্যাপী রামনবমী উপলক্ষে শ্রী রামচন্দ্রের জীবনীর নানা বিষয়ে আলোকপাত করি,রামনবমীতে একাডেমিক সেমিনার এর মাধ্যমে সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস চালাই।এ বছর প্রতিকূল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হয়নি।কিন্তু তাও আজ রামনবমীতে আমরা তাঁর বিশেষ একটি দিক যা অতটা আলোচিত হয়নি কখনো সেটা নিয়ে আলোচনা করব।তা হল রামচন্দ্র ভারতবর্ষের কোন কোন স্থানে গিয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। কোন কোন স্থানে তাঁর পূণ্য পদধূলি পড়েছিল?


 আজ তা আমরা বাল্মিকী রামায়ণের ছত্রে ছত্রে অনুসন্ধান চালাব এটা মনে রেখেই যে বর্তমানে প্রাপ্ত রামায়ণে সত্য ইতিহাসের সাথে মিশ্রিত রয়েছে কাব্যিক পরাবাস্তবতা।

শ্রী রামচন্দ্রের জীবনের প্রথম রাজ্যের বাইরে ভ্রমণ ছিল বিবাহ সংস্কারের জন্য।বাল্মিকী রামায়ণের আদিকাণ্ড ১.৩২ এ আমরা দেখতে পাই বিদেহ সম্রাজ্যের রাজধানী মিথিলা যা বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব নেপাল ও উত্তর পূর্ব বিহার অঞ্চলে অবস্থিত সেখানে গিয়ে সেখানকার রাজা জনকের কন্যা 'মাতা সীতার' সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।



প্রথমবারের বিদেশ ভ্রমণ যতটা মধুর ও আনন্দের তাঁর পরবর্তীবারের  বিদেশ ভ্রমণ ততটাই বেদনার অশ্রুতে সজল ছিল।

পরবর্তীবার তাঁকে রাজ্যত্যাগ করতে হল পিতৃসত্য পালনের জন্য।এবার শুরু হল তাঁর সমগ্র ভারত ভ্রমণের পালা।

বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের ২.৪০.১৮ তে সুমন্ত্রের রথে চড়ে শ্রীরাম দেশত্যাগ করছেন, প্রয়াতে তু মহা অরণ্যম্ চির রাত্রায় রাঘবে,হে রাঘব তুমি তো মহাঅরণ্যে প্রস্থান করলে আর আমাদের চির অন্ধকার রাত্রিতে ফেলে গেলে।

রথ চলতে লাগল। পেছনে হারিয়ে যেতে লাগল  সবল-বৃদ্ধ পরম পীড়িত অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস।

চলতে চলতে রথ থামল তমসা নদীর তীরে,রাজ্য হতে(অযোধ্যা,বর্তমান উত্তর প্রদেশ) বহুদূরে,বর্তমান উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের সীমান্তে এই নদীটি অবস্থিত যার একটি শাখা বর্তমান বারাবাংকি হয়ে অযোধ্যার সীমানায় প্রবাহিত হত।রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের ২.৪৬ এ বলা হচ্ছে রাম তমসা নদীর পাড়ে এসে যাত্রাবিরতি করলেন।সেদিন রাতে এই আজো বহমান নদীর তীরেই তিনি শয়ন করেছিলেন।

এরপর শ্রীরাম যাত্রা করলেন আরও গভীর অরণ্যের দিকে।একদম চলে আসলেন নিজেদের রাজ্যের সীমানায়।অযোধ্যা কাণ্ড ২.৪৯ এ আমরা দেখি নিজের কোসল সাম্রাজ্যের সীমানায় চলে এলেন,পার হলেন তিনটি নদী,গঙ্গার শাখা নদী গোমতী, বেদশ্রুতি ও সান্দিক্য নদী।এই সান্দিক্য নদীই রামচন্দ্রের সাম্রাজ্যের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত ছিল।

নিজের রাজ্য পার হয়ে শ্রী রাম এলেন নিষাদ রাজ বন্ধু গুহের রাজ্যে।পরম মিত্রকে পেয়ে আলিঙ্গন করলেন।বর্তমানের বড় বড় সনাতনী উচ্চবর্ণীয় শয়তানরা তো এই নিষাদ জাতিদের অচ্ছ্যুৎ বলে ছায়াও মাড়াতেন না।কিন্তু শ্রীরাম কি করলেন? সম্পরিষজ্য গুহো রাঘবম অব্রবীত,বন্ধুকে আলিঙ্গন করলেন,তার ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন ওহ গুহ! দ্বিষ্টয়া ত্বাম পশ্যামি আরোগম্ সহ বান্ধবৈঃ, তোমাকে এমন নিরোগ সুস্থ্য সবান্ধবে দেখে আমি যেন স্বর্গ দেখলাম!

নিষাদরাজ তার মিত্রের জন্য কত ভালো ভালো খাদ্য,পালংক,আরামের ব্যবস্থা করলেন।রাম উত্তর দিলেন-

ফলমূল অশনম চ মাম বিদ্ধি প্রণিহিতম ধর্মৈ
হে বন্ধু,আমি এখন সন্ন্যাসী, কেবল ফলমূল খেয়ে থাকব,সুখভোগ আমার চলবেনা।

অশ্বানাম খাদনেন অহম অর্থী ন অন্যেন কেনচিৎ
বন্ধু তুমি শুধু আমাদের অশ্ব দুটোকে একটু খাবার দাও,আমার আর কিছুই চাইনা।

এই বলে নিজে আর লক্ষ্মণ চলার পথে যে ফলমূল সংগ্রহ করেছিলেন তাই তারা তিনজন মিলে খেলেন,পালংকও গ্রহণ করলেন না,মাটিতেই শয়ন করলেন।সমগ্র আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ ছিলেন যিনি ধর্মরক্ষার্থে সেই তিনি খাদ্য ও শয়নও ত্যাগ করে দিয়েছিলেন বিনা দ্বিধায়।

এরপর সারথি সুমন্ত্রের বিদায়ের পালা,যেতে নাহি দিতে চায়... চলে গেলেন সুমন্ত্র।রাম-লক্ষ্মণ গাছের আঠা দিয়ে চুলের জটা করলেন।নিষাদরাজের দেয়া একটি নৌকা করে তিনি গঙ্গা পার হলেন।শুরু হল তাদের বনবাস।পদব্রজে হাঁটতে লাগলেন।হঠাৎ শ্রীরাম দূর হতে টের পেলেন জলধারার ভারী পতনের শব্দ।বুঝে উঠতেই বললেন- প্রয়াগ অভিতঃ পশ্য,লক্ষ্মণ আমরা গঙ্গা-যমুনা নদীর সংগম প্রয়াগরাজে চলে এসেছি।পাঠক মনে পড়ছে তো?কিছুদিন আগে যোগী আদিত্যনাথ যে এলাহাবাদের নাম সেই আগের প্রয়াগরাজে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই প্রয়াগরাজ।আজকের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ তথা এলাহাবাদে শ্রীরাম।

প্রয়াগরাজ, উত্তরপ্রদেশ 



আর শ্রীরাম জানেন এই প্রয়াগের অতি নিকটেই ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রম।তাই তিনি ঠিক করলেন সবাই মিলে সেখানেই যাবেন এখন।আপাতত লক্ষ্য তাহলে ঋষি ভরদ্বাজ কুটির। 

গঙ্গা যমুনার মিলনস্থল, প্রয়াগরাজ, উত্তরপ্রদেশ 


মহর্ষি ভরদ্বাজের কুটিরে আসলেন,মহর্ষি তখন অগ্নিহোত্র রত।তাঁকে নমস্কার করলেন,ফলমূল আহার করলেন।জানতে চাইলেন-
এক অন্তে পশ্য ভগবন্ আশ্রম স্থানম্ উত্তমম্
হে ভগবান,আশ্রম স্থাপন করার জন্যে একটি স্থান এখান হতে কিছু দূরে আমাকে বলে দিন।

উত্তরে ঋষি 
দশক্রোশেন তাত গিরির যস্মিন নিবৎসসি
চিত্র কুটিত খ্যান...
সেখান হতে দশ ক্রোশ দূরে,যমুনা নদী পার হয়ে চিত্রকুট নামক এক পার্বত্য অঞ্চলের কথা বললেন।বিদায় নিয়ে শ্রীরাম চলে এলেন চিত্রকুটে।

কাষ্ঠসমাগতম্ সম্বৃতম শুস্কবংশৈ উষীরৈ
(২.৫৫.১৪)
নিজেরা কাঠ,বাঁশ সংগ্রহ করে একটি ভেলা বানালেন আর তাতে ঘাস দিয়ে বসার ব্যাবস্থা করলেন।সেই ভেলায় করে তারা যমুনা নদী পার হলেন।

আমরা  উত্তর প্রদেশ থেকে বের হয়ে এলাম,এখন আমরা আজকের মধ্য প্রদেশের সাতনা জেলার চিত্রকুটে।




চিত্রকূটের রামঘাট, মধ্যপ্রদেশ


কিন্তু সমস্যা হল কিছুদিন পর।ভরত, মাতা কৌশল্যা সহ অনেকেই আসলেন সেই চিত্রকুটে শ্রী রামের সাথে দেখা করতে।উদ্দেশ্য দশরথের মৃত্যু সংবাদ দেয়া আর শ্রী রামকে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করা।

শ্রীরাম-সীতার স্মৃতি বিজড়িত মন্দাকিনী 




মন্দাকিনী 


সৈন্য নিয়ে আসায় চারপাশের অনেক গাছ পালা ই নষ্ট হয়ে গেল,স্থানটিও হয়ে গেল মায়ের স্মৃতিবিজড়িত।রাম পীড়িত হলেন তাতে,স্বিদ্ধান্ত নিলেন চিত্রকুটও ত্যাগ করবেন।এর ই মধ্যে একদিন মধ্য প্রদেশের মন্দাকিনী নদীও ঘুরতে গেলেন(২.৯৪)।

তো চিত্রকুট থেকে একদিন বের হয়ে পড়লেন,বাক্সপেটরা কিছু নেই,ভিখারি মানুষ থাকবেই বা কি করে।পথে যেতে যেতে পৌঁছালেন ঋষি অত্রির কুটিরে।ঋষি অত্রির সাথে সেখানে থাকেন তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত ঋষিণী অনসূয়া(২.১১৭)।তাঁদের কাছ থেকেই খবর পেলেন আরেকটি সুন্দর থাকার জায়গার।সেটিই হল সেই খ্যাতনামা দণ্ডকারণ্য।মধ্য প্রদেশ থেকে চলে এলাম আমরা আজকের ছত্তিশগড় প্রদেশে যেখানে এই দণ্ডকারণ্য অবস্থিত।

দণ্ডকারণ্য, ছত্তিশগড়




দণ্ডকারণ্য এলেন,প্রথম কয়েকদিন শরভঙ্গ মুনি,সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে থাকলেন,তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ করলেন।এরপর ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন মহারাষ্ট্রের রামটেকে যেখানে ছিল বিখ্যাত ঋষি অগস্ত্যর আশ্রম।ঋষি অগস্ত্য উপদেশ দিলেন -

ইতো দ্বি যোজনে তাত বহু মূলফল উদকঃ
... পঞ্চবটী অভিবিশ্রুতঃ(৩.১৩.২৩,অরণ্যকাণ্ড)।
এখান হতে দুই যোজন(২৬ কিলোমিটার প্রায়) দূরে পঞ্চবটী নামক ফলমূল্র পরিপূর্ণ এক স্থান রয়েছে।সেই পঞ্চবটীতেই হল তাদের নিবাস,এখানেই হয়েছিল সীতাহরণ।মহারাষ্ট্রের সীমানার একদম শেষপ্রান্তে  আমরা চলে এলাম মহারাষ্ট্র, পঞ্চবটীতে।

পঞ্চবটী, নাসিক, মহারাষ্ট্র সরকার নির্মিত ভাস্কর্য 


এর পরের ঘটনাক্রম কিন্তু আমরা সবাই জানি।সীতাহরণের পর সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে মহারাষ্ট্র হতে হাঁটতে হাঁটতে দুইভাই এসে পৌঁছালেন কর্ণাটকের পম্প সরোবরে,সেখানেই দেখা হয় উপজাতীয় গোত্র বানর সম্প্রদায়ের সাথে।(অরণ্য কাণ্ড,৩.৭৫)

পম্প সরোব, কর্ণাটক 

পম্প সরোবর 



সীতার খোঁজ তো হনুমান গুপ্তচরবৃত্তি করে নিয়ে এলেন।এবার সেনাবাহিনী নিয়ে শ্রীলংকায় যাবার পালা।হনুমানের উড়াল দিয়ে সমুদ্র পার হবার গল্প তো পরবর্তীকালের বানানো এটা আমরা সবাই জানি।কিন্তু আমরা খুব মজার দুইটা ঘটনা কখনো খেয়াল করিনা।

যুদ্ধ কাণ্ডে(৬.১৭) তে আমরা দেখতে পাই সেতু তৈরীর আগেই বিভীষণ ভারতে এসে শ্রী রামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।আবার সেতু বানানোর আগেই সুগ্রীবকে শ্রীরাম পাঠিয়েছিলেন রাবনের কাছে যুদ্ধ না করে শান্তির সাথে সব মিটমাটের প্রস্তাব দিয়ে(৬.২০)।তাহলে পাঠক আপনারাই ভেবে দেখুন,তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম থেকে শ্রীলংকার মান্নার উপদ্বীপ,এইটুকু পথ পাড়ি দেয়া মোটেও অলৌকিক কোন কার্য নয়।এই পথের মধ্যে থাকা পক প্রণালীর চেয়েও অনেক বড় বড় প্রণালী(ইংলিশ চ্যানেল) আমরা বাঙালীরাও পাড়ি দিয়েছি।ইতিমধ্যেই আপনারা দেখেছেন অযোধ্যাকাণ্ডে যে রাম-লক্ষ্মণ নিজে নৌকা বানিয়ে স্রোতস্বিনী যমুনা নদী পাড়ি দিয়েছেন।তাই বিভীষণ বা সুগ্রীবের পক্ষেও এই পথ পাড়ি দেয়া সেতু ছাড়াই সম্ভব হয়েছিল।কিন্তু সে তো মাত্র একজন ব্যাক্তির ক্ষেত্রে।কিন্তু পুরো একটা সেনাবাহিনীর অগভীর এই জলপথ পাড়ি দেয়ার জন্য এতগুলো নৌকা বানানো কঠিন ছিল।আর তখন ই এগিয়ে এলেন প্রযুক্তিতে দক্ষ নল।পাথর,গাছের গুঁড়ি,বাঁশ,বালু প্রভৃতি দিয়ে ৫ দিনের ভিতর সমস্ত সেনাবাহিনীর পেশীশক্তি ব্যবহার করে আগে থেকেই অবস্থিত এক অগভীর স্থলরেখার উপরে বানালেন এক সেতু যা আজ রামসেতু নামে খ্যাত।(যুদ্ধকাণ্ড ৬.২২)

রামেশ্বরম্, তামিলনাড়ু 


রাম সেতু নামক প্রবাল,পাথর ও বালুর সমন্বয়ে গঠিত সেই সমুদ্রপথ আবিস্কারের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যে সমুদ্রের মাঝেও একটি স্থলপথ ছিল।সম্ভবত পরবর্তীতে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়ায় সেটি নিমজ্জিত হয় তবে অগভীর সেই অংশের উপরের শ্রী রামচন্দ্র ও তাঁর বানর সৈন্যরা এই সেতুটি নির্মাণ করে।
ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ হিসেবে Carbon Dating এ সেখানে ৪২০০ বছরের প্রাচীন প্রবাল পাথর খুঁজে পাওয়া গেছে যা রামায়ণের বয়সের সাথে কাছাকাছি মিলে যায়।ভারতিদসন বিশ্ববিদ্যালয়ের Central Remote Sensing Team এর প্রফেসর এস এম রামস্বামী এই সেতুকে অন্তত ৩৫০০ বছরের আগে বলেছেন।Geological Survey Of India এর বিশেষজ্ঞ S. Badrinarayan বলেন "এটা নিশ্চিত যে এটা মনুষ্যকৃত কেননা পুরোটা অংশেই কোরালের নিচে বালির একটা আলাদা স্তর আছ এখানে।যদি এটা প্রাকৃতিক হত তবে এই কোরালের স্তর পাথরের উপর স্থিত হত,বালির উপরে নয়।"।

১৩ দিন ধরে চলল ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের, আলোর সাথে অন্ধকারের সেই মহাযুদ্ধ।জয় হল সত্যের,শুদ্ধতার।লংকা হতে অযোধ্যা ফিরে আসার পথেও শ্রীরাম ঋষ্যমুখ পর্বত(কিষ্কিন্ধা,কর্ণাটক),তুঙ্গাভদ্রা নদী(কর্ণাটক),জনস্থান বন(মহারাষ্ট্র),পঞ্চবটী(মহারাষ্ট্র),গোদাবরী নদী(মহারাষ্ট্র),চিত্রকুট পর্বত(মধ্যপ্রদেশ),যমুনা নদী(মধ্য প্রদেশ-উত্তর প্রদেশের সীমান্ত) হয়ে আবারও সেই প্রয়াগরাজে বা আজকের উত্তর প্রদেশ এলাহাবাদে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে পৌঁছালেন।
যুদ্ধকাণ্ডের ৬.১২৩ নং সর্গে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।আর শেষে গঙ্গা পার হয়ে সরযু নদী ফেলে আবার পৌঁছে গেলেন নিজের জন্মভূমিতে।অযোধ্যায় ঢুকার পথে আজকের ফয়জাবাদের নন্দীগ্রামে ভরত ও শত্রুঘ্ন সমগ্র রাজ্যবাসী সহ তাঁকে মহাসমারোহে বরণ করে নিলেন।

তখন,

ততো হর্ষসমুদ্ভূতো নিস্বনো দিবমস্পৃশৎ।
স্ত্রীবালোযুববৃদ্ধানাং রামো অয়ম ইতি কীর্তিতে।।

রাম রাম ধ্বনিতে আবালবৃদ্ধবণিতার উল্লাসে সমগ্র নগর,আকাশ,বাতাস কীর্তিত হইয়া উঠিল।

এভাবেই বিবাহের সময় নেপাল,বিহার আর বনবাসের কালে উত্তর প্রদেশ,মধ্যপ্রদেশ,ছত্তিশগড়,মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক,তামিলনাড়ু(রামেশ্বরম),শ্রীলংকা হয়ে আবার অযোধ্যায় ফেরত এসেছিলেন দশরথ নন্দন।ছবিতে মানচিত্রের মাধ্যমে আপনাদের সেইসব স্থান বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে দেখানো হল।


যত্র রামঃ ভয়ম্ নত্র নাস্তি তত্র পরাভবঃ
যেখানে রাম আছেন না সেখানে ভয় আছে না আছে দুঃখ।

যার হৃদয়ে রামের বাস তার কোনকিছুতেই ভয় নেই।

জয় মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের জয়
রঘুপতি রাঘব রামচন্দ্র কি জয়
সিয়াপতি রাঘব রামচন্দ্র কি জয়
জয় শ্রী রাম

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক

রামনবমী
২০২০ 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)