দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







উপনয়ন বা যজ্ঞোপবীত ধারণ কি কেবল ব্রাহ্মণের জন্য?

Arindam
0



সনাতন ধর্ম মতে মানব জীবনের ষোড়শবিধ সংস্কার মনুষ্য জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করে গড়ে তোলার লক্ষে পবিত্র বেদে ঐশ্বরিক প্রেরণায় ঋষিরা অনেক ধর্মীয় আচার-আচরণ ও মাঙ্গলিক কর্মের নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলোকে হিন্দু ধর্মের ধর্মাচার ও সংস্কার বলা হয়। এই সকল আচার-আচরণের বিস্তারিত বিবরণ ‘মনুসংহিতা’, ‘যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা’, ‘পরাশরসংহিতা’, প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রে (হিন্দু বিধি বিধানের গ্রন্থ) পাওয়া যায়।


 ‘উপনয়ন’ শব্দের অর্থ ‘নিকটে নিয়ে যাওয়া’। যে অনুষ্ঠানের পর ছাত্রকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুর নিকটে নিয়ে যাওয়া হত তার নাম ছিল উপনয়ন।উপনয়ন শব্দের সহজ অর্থ যজ্ঞপবীত বা পৈতা ধারণ। বর্তমানে এই উপনয়ন সংস্কারটি আমাদের সমাজে ভিন্ন রূপে আছে। আগের মত আজকাল আর গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রেরণ না করা হলেও শিক্ষা জীবনের শুরুতে হাতেখড়ি বলে একটি অনুষ্ঠান আজও প্রচলিত আছে।

নারীর উপনয়ন (পৈতা )

ওম্ অগ্নে ব্রতপতে ব্রতং চরিষ্যামি তচ্ছকেয়ং তন্মে রাধ্যতাম্। ইদমহমনৃতাৎ সত্যমুপৈমি।।
 (যজুর্বেদ ১.৫.)

অনুবাদঃ— হে ব্রতপতে অগ্নে! আমি ব্রত ধারণ করছি যে, আমি যেন অসত্যকে ছেড়ে সত্যকে জানি, সত্যকে মানি ও সদা সত্য ব্যবহার করি। হে প্রভু! তুমি আমাকে এমন সামর্থ্য প্রদান করো যেন আমার এই সত্যব্রত সদা সত্য সিদ্ধ হয়।

"স্মৃতিচন্দ্রিকা" স্মৃতিকার হারিত বলছেন—
"দ্বিবিধা স্ত্রীযো ব্রহ্মবাদিন্যঃ সদ্যঃবদ্ধশ্চ তত্র তত্র ব্রহ্মবাদিনীনাম্ অগ্নিণ্বধনম্ বেদাধ্যয়ম্ স্বগৃহে চ ভিক্ষাচর্যা ইতি।।

পুরাকালে কুমারীদের মোউংজি বন্ধন (উপনয়ন ) হত,তাদের বেদ পাঠ শিক্ষা দেওয়া হত, এবং গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের পদ্ধতি শেখানো এবং গুরুগৃহ হতে সমাবর্তনও হত।

সপ্তম শতকে মহাকবি বানভট্ট দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন কাদম্বরী ও হর্ষচরিত কাদম্বরী গ্রন্থে কাদম্বরীর উল্লেখ্য চরিত্র হল মহাশ্বেতা। মহাশ্বেতার বর্ণনা দেখি-তিনি যখন তপশ্চর্যায় রত তখন ব্রহ্মসূত্র বা যজ্ঞোপবীত ধারণ করায় তাঁর শরীর পবিত্র হয়ে উঠেছিল। হর্ষচরিতে সরস্বতী সম্বন্ধে একইভাবে বলা আছে কাঁধ থেকে লম্বমান যে যজ্ঞ উপবীত, তার দ্বারা সরস্বতীর দেহ পবিত্র হয়ে উঠেছিল।

(ঋগ্বেদ ১০.০৫.৪১) মন্ত্রে বিবাহ সংস্কারে স্পষ্ট বলা হয়েছে পতির সামনে যজ্ঞোপবীত ধারিণী কন্যা।

দুঃখের বিষয় এখন শুধু ব্রাহ্মণরা পূজা করার জন্য উপনয়ণ গ্রহন করেন।

নারীর যজ্ঞোপবীত সংস্কার ক্ষেত্রে বেদ বলছে-

"ব্রহ্মচর্যেণ কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্ ।"
(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)

অনুবাদঃ— ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিবার পর (বেদাদিশাস্ত্র অধ্যয়নপূর্বক বিদ্যা লাভ করিয়া), কুমারী কন্যা যৌবনকালে বিদ্বান পতিকে লাভ করিবে।

আর, সকলেই জানি যে, ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের পূর্বশর্ত হচ্ছে উপনয়ন সংস্কার বা গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যজ্ঞোপবীত(পৈতা) ধারণ। সুতরাং, বেদ অনুযায়ী নারীর যজ্ঞোপবীত ধারণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

প্রাবৃতাং যজ্ঞোপবীতিনীমম্যুদানয়ন্ জপেৎ।
"সোমোহদদদ্ গন্ধর্বায়েতি ।।"
(গোভিল গৃহ্যসূত্রঃ ২.১.১৯)

অনুবাদঃ— সুবস্ত্রশোভিতা (যজ্ঞোপবীতিনীম্) যজ্ঞোপবীত পরিহিতা কন্যাকে দান করিয়া "সোমদদদ্" আদি মন্ত্র জপ করিবে।

সকল কুমারী কন্যার উচিত বেদজ্ঞ আচার্য্যের নিকট উপনীত হয়ে যজ্ঞোপবীত (পৈতা) ধারণ করা এবং ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করা।

বৈদিক যুগে নারীদের পবিত্র ব্রহ্মসূত্র দিয়ে দীক্ষিত করা হত, অর্থাৎ তাদের উপনয়ন হত, তারা গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, পবিত্র অগ্নিযজ্ঞে আরাধনা করতেন। যা একজন পুরুষের সমান, কোন অংশে কম নয়, যা আজ আমরা চিন্তাই করতে পারিনা। ব্রহ্মবাদিনী নারী আর সদ্যবধু নামে নারীদের দুইটি ভাগ ছিল, প্রথমটি পবিত্র উৎসবের মাধ্যমে ব্রহ্মসূত্রের দ্বারা উপনীত করে যাদের বিয়ে হত তারাই সদ্য বধু । ব্রহ্মবাদিনী নারীরা বিয়ে করতেন না তারা পুরুষের ন্যায় ব্রহ্মচর্য পালন করতেন।

উপকুরবান ব্রহ্মচারীরা গুরুগৃহে অধ্যয়ন শেষে পিতৃগৃহে গিয়ে বিয়ে করে গার্হস্থ্যধর্ম পালন করতেন। মহাভারতের পাণ্ডব মাতা কুন্তিও ব্রহ্মসূত্র দিয়ে ভূষিত হয়েছিলেন। এই রকম অনেক উদাহরণ আছে সনাতনে সকলে এই ষোড়শ সংস্কার  পালন করে যথাযথ জ্ঞান অর্জন না করলে ভবিষ্যৎ এ অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে সনাতন সমাজ। তাই একটা কথাই বলব শুধু ছেলেরা নয় মেয়েরা ও এই বিধান পালন করুন।


উপনয়ন ও যজ্ঞোপবীত-

উপ = নিকটে, নয়ন = চোখ। উপনয়ন একটি হিন্দু শাস্ত্রানুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু বালক-বালিকারা ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে দীক্ষিত হয়। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে, উপনয়ন হিন্দু বালক-বালিকাদের শিক্ষারম্ভকালীন একটি অনুষ্ঠান।

উপনয়নের পর সনাতনীদের দ্বিজ বলা হয়, দ্বিজ শব্দের অর্থ দুইবার জাত। বৈদিক দর্শন অনুযায়ী, প্রথমবার ব্যক্তির জন্ম হয় মাতৃগর্ভ থেকে এবং দ্বিতীয়বার জন্ম হয় উপবীত ধারণ করে। ঈশ্বরকে পাবার জন্য যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য গায়ত্রীমন্ত্র সাধনের অধিকার লাভ করবার অনুষ্ঠানকে উপনয়ন বলে৷


 যজ্ঞোপবীতে ৩টি সুতো ও ৫টি গিঁট বা "ব্রহ্মগ্রন্থি" থাকে। এই সূত্রত্রয় কর্তব্যপরায়ণ মানুষকে তিনটি ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

কি সেই তিনটি ঋণ যা প্রত্যেকটি মানুষকে শোধ করতে হয়?

ওঁ স সূর্যস্য রশ্মিভিঃ পরিব্রুথম তন্তু তন্বস্ত্রিব্রুথ ম যথাবিদে।
প্রশিশো নবিয়সি পথিরজনীনমুপা যথি নিষ্কৃতম।।
 (ঋগ্বেদ ৯.৮৬.৩২)

 অনুবাদ: এই তিনসূত্র পরিধান করতে হয় জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য জানতে।

সেই ঋণত্রয় হল-

১) দেবঋণ- ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য এ পৃথিবী,পরিবেশ ও প্রানীকুলের প্রতি দায়িত্ব।পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলা,পরিবেশ শুদ্ধ করা ও জীবে সেবা করা দেবঋণের অন্তর্গত।

২) পিতৃঋণ- পিতামাতার প্রতি ঋন। নিঃস্বার্থভাবে এই দুই জীবন্ত দেবতা আমাদের মানুষ করেন, তাদের যথাসাধ্য সেবাযত্ন করা আমাদের কর্তব্য।

৩) ঋষিঋণ- প্রাচীন বৈদিক ঋষিগন থেকে শুরু করে নিজের গুরু-শিক্ষক,এরাই আমাদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তোলেন।এদের সেবা, অনুস্মরণ করা ই ঋষিঋণ।

উপনয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার। আমরা দেখব প্রাচীন বৈদিক সমাজে নারীশিক্ষার ও নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য জীবন পালনের একটি সংস্কার।

পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন -

"মাতুলাচার্যাণামানুক্ত" (পাণিনি ৪.১.৪৬) এবং "ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্" (পাণিনি ৬.২.৭৬)। ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় (ঋগ্বেদ ১.৩.১১) ও ( ঋগ্বেদ ১০.১৫৬.২) প্রভৃতিতে।

অথচ ভন্ড পৌরাণিক পুরোহিতগণ পুরুষতন্ত্র কায়েম করতে একসময় নারীদের শাস্ত্রপাঠ বন্ধ করে দিয়েছিল, সতীদাহের মত জঘন্য প্রথা চালু করেছিল।

সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামণিষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগণ ছিলেন যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন (ধর্ম একটিই, বৈদিক ধর্ম, বাকীগুলো মার্গ) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব। চলুন দেখে নিই পবিত্র বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে কিছু শ্রদ্ধেয় নারী ঋষিকার নাম -

১) ঘোষা (ঋগ্বেদ দশম মন্ডলের ৩৯-৪১ নং সুক্তের দ্রষ্টা, ঋষি কক্ষিবান এর কন্যা), ২) লোপামুদ্রা, ৩) মৈত্রেয়ী, ৪) গার্গী,৫) পৌলমী, ৬) রোমশা, ৬) অপালা, ৭) বাক (ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা), ৮) অপত, ৯) কত্রু, ১০) বিশ্ববর, ১১) জুহু, ১২) ভগম্ভ্রীনি (মহর্ষি অম্ভ্রন এর কন্যা, ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের ১২৫ নং সুক্তের দ্রষ্টা), ১৩) যরিতা, ১৪) শ্রদ্ধা, ১৫) উর্বশী,১৬) স্বর্ণগা, ১৭) ইন্দ্রানী, ১৮) সাবিত্রী, ১৯) দেবায়নী, ২০) নোধা, ২১) আকৃষ্ভাষা, ২২) শীকাতনবাবরি, ২৩) গণ্পায়নী,২৪) মন্ধত্রী, ৫) গোধ, ২৬) কক্ষিবতী, ২৭) দক্ষিনা, ২৮) অদিতি, ২৯) রাত্রি (মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা, ৩০) শ্রীলক্ষ।

নিজেকে ব্রাহ্মন দাবীকারিরা কি প্রকৃত ব্রাহ্মণ?
চলুন যে শাস্ত্র পুজি করে এরা পেটে ভাত ও সম্মান জোগায় সেই শাস্ত্র কি বলে দেখি!

এই ক্রমে যেইরুপে শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়, তদ্রুপ ব্রাহ্মণ এর ও শূদ্রত্ব প্রাপ্তি হয়, ক্ষত্রিয়ও বৈশ্য সম্বন্ধে ও ঐ রুপ জানিবে।
(মনুসংহিতা দশম অধ্যায়,৬৫ নং শ্লোক)

এখন ব্রাহ্মণ দাবীকারিগণ হাজার অযোগ্য হলেও সে ব্রাহ্মণই! আর শূদ্র হাজার গুনে যোগ্য হলেও সে শূদ্রই! ব্রাহ্মনত্ব,শূদ্রত্ব জন্মগত হয়ে দাড়িয়েছে!

ব্রহ্ম বলিয়াছেন যে শূদ্রও যদি পবিত্র কার্যাদির দ্বারা বিশুদ্ধাত্মা ও জিতেন্দ্রিয় হয়, তবে তাকে ব্রাহ্মণদের ন্যায় সমাদর করা কর্তব্য, ফলত আমার মতে (ঋষি শৌনক) শুদ্ধ,সচ্চরিত্র ও সৎ কর্মান্বিত হলে ব্রাহ্মণ অপেক্ষা প্রসংশনীয় হয়,কেবল জন্ম ও কূল ব্রাহ্মণত্বের কারণ নহে। সদাচার দ্বারা সকলেই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতে পারে।
(মহাভারত - অনুশাসন পর্ব ১৪ অধ্যায়)



"জম্মনা জায়তে শুদ্র, সংস্কারং দ্বিজ উচ্যতে। বেদ পাঠাৎ ভবেদ্ বিপ্র ব্রহ্ম জান্যতি স ব্রাহ্মণ"

অর্থাৎ কেবল ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেই উপনয়নের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ হন। উপনয়নের অধিকার সকলের আছে । এমনকি চারবর্ণের সকলেরই উপনয়নের অধিকার আছে। সেরূপে শুদ্র থেকে ব্রাহ্মণ হবার অধিকারও সকলের আছে।

অর্থাৎ ব্রহ্ম'কে যিনি জানেন তিনিই কেবল ব্রাহ্মণ, কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে জম্মগ্রহণ করেন না। ব্রহ্মগায়ত্রী মন্ত্রজপ করলে তবেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে দেখা যায় অনেক নিম্নবর্ণের সাধু-- পুরুষ নিজ যোগ্যতা বলে ব্রাহ্মণ হয়েছেন। পুরুষের যদি গায়ত্রীমন্ত্র পাঠপূর্বক উপনয়ন হয়।

শ্রুতির নির্দেশ এই যে, দ্বিজাতি প্রথমে মাতৃজঠর থেকে জন্মগ্রহণ করে; মৌঞ্জীবন্ধন অর্থাৎ উপনয়ন হলে হয় তার দ্বিতীয় জন্ম হয়।

যজ্ঞোপবীত

যজ্ঞোপবীত বা পৈতার অপরনাম প্রতিজ্ঞাসূত্র বা ব্রতসূত্র। আটবছর থেকে বার বছর বয়সের ভেতর প্রতিটি বৈদিক ধর্মালম্বীর উপনয়ন আবশ্যক এবং উপনয়নের মাধ্যমে এই পবিত্র সুত্রটি সে গুরুকর্তৃক প্রাপ্ত হয়।যদিও বর্তমানে পুরুষশাসিত ঘুণে ধরা সমাজ নারীদের থেকে এই অধিকার কেড়ে নিয়ে বেদের বিরুদ্ধাচরণ করছে।

প্রতিটি পৈতা তিনটি আলাদা সূত্রকে গিট দিয়ে বেঁধে তৈরী।এই গিট বা বন্ধনকে ব্রহ্মগ্রন্থি বা ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত গ্রন্থি বলা হয়। এই তিনটি সূত্র ঈশ্বর কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি মানুষের তিনটি ব্রত বা ঋণ বা দায়িত্বের প্রতীক।কি সেই তিনটি ঋন যা প্রত্যেকটি মানুষকে শোধ করতে হয়?
                                       
আচার্য ব্রহ্মচারীকে উপনয়ন দিয়া নিজের সাহচর্যে রাখেন। আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক এই তিন অবিদ্যা অন্ধকার দূর করিতে নিজের বিদ্যার বেষ্টনীর মধ্যে তাহাকে ধারণ করেন। যখন ব্রহ্মচারী বিদ্যালাভ করিয়া দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে তখন তাহাকে দেখিবার জন্য সব দিক হইতে বিদ্বানেরা আসিয়া সমবেত হন। (অথর্ববেদ ১১/৫/৩)
                                           
এই তিনসূত্র পরিধান করতে হয় জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য জানতে। যে ব্যক্তি যজ্ঞোপবীত ধারন করেন তিনি গুরুর কাছে এটা অবগত হন যে তিনটি ঋণ তার শোধ করতে হবে- দেব, পিতৃ, ঋষি। (ঋগ্বেদ ৯/৮৬/৩)

যজ্ঞোপবীত সনাতনীদের কেন ধারন করা উচিৎ

ও৩ম্ যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং প্রজাপতের্যৎ সহজং পুরস্তাত্।
আয়ুষ্যমগ্রয়ং প্রতিমুঞ্চ শুভ্রং যজ্ঞোপবীতং বলমস্ত তেজঃ।।

ও৩ম্ যজ্ঞোপবীতমসি যজ্ঞস্য ত্বা যজ্ঞোপবীতেনোপনহ্যামি।।

(পারস্কর অধ্যায় ২। কন্ডিকা ২। সূত্র ১০-১১)

অর্থাৎ যজ্ঞোপবীত পরম পবিত্র,প্রজাপতি হতেই এর উদ্ভিব,এই শুভ্র পবিত্র সূত্র আয়ু,বল ও গৌরবের বর্ধক । 

যজ্ঞোপবীত ধারণ না করলে সনাতনীদের ক্ষতি কি?

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য শুদ্রের উপনয়ন সংস্কার হওয়া অতি আবশ্যক, কেননা উপনয়ন সংস্কার না হলে মানুষ বৈদিক কর্মকান্ডে অধিকারী হয় না। উপবীতহীন ব্যক্তি মন্ত্রপাঠ এবং বৈদিক ক্রিয়া করবার যোগ্য নয়। এই অধিকার প্রাপ্ত হেতু যজ্ঞোপবীত ধারণ করানো হয়।
যজুর্বেদে বলা হয়েছে -
"তদেতৎ সর্বমাপ্নোতি যজ্ঞে শ্রোত্রামণি সুতে
(যজুর্বেদ ১৯.৩১)

অর্থাৎ গ্রন্থিযুক্ত যজ্ঞোপবীত সূত্র ধারণ করিয়া যজ্ঞ করলে যজ্ঞের সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায়।

যজ্ঞোপবীত বা প্রতিটি পৈতা তিনটি আলাদা সূত্রকে গিট দিয়ে বেঁধে তৈরী। এই গিট বা বন্ধনকে ব্রহ্মগ্রন্থি বা ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত গ্রন্থি বলা হয়। এই তিনটি সূত্র ঈশ্বর কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি মানুষের তিনটি ব্রত বা ঋন বা দায়িত্বের প্রতীক। কি সেই তিনটি ঋন যা প্রত্যেকটি মানুষকে শোধ করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে দেবঋণ, পিতৃঋণ ও ঋষিঋণ।

উপনয়ন পঞ্চগিট- যজ্ঞোপবীত বা পৈতাতে মোট পাঁচটি গিট থাকে। এই পাঁচটি গিট উপরোক্ত ঋনসমূহ পরিশোধে পাঁচটি বাঁধার কথাকে স্মরন করিয়ে দেয়-কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা, মোহ। অবস্থান- যজ্ঞোপবীত বাঁম কাধ থেকে ঝুলিয়ে ডান দিকের কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে কেননা এত সূত্রটি ঠিক হৃদপিন্ডের উপর দিয়ে যায় যার মাধ্যমে প্রতীকিভাবে বোঝানো হয় নিজের দায়িত্বগুলো হৃদয় থেকে পালন করতে।

তাই আসুন বৈদিক সাম্যবাদের পথ অনুসন্ধান ও অনুসরণ করি, বেদোক্ত বৈষম্যহীন সনাতন সমাজ গঠন করি।

ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)