দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







শাস্ত্রে শূদ্রদের উপনয়নের উল্লেখ নেই কেন ?

অমৃতস্য পুত্রা
6


সনাতন সমাজে বরাবরই শূদ্রকে হীনজ্ঞান করা হয়। অর্থাৎ শূদ্ররা বেদ পাঠ বা শ্রবণ করতে পারবে না অথবা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারবে না ইত্যাদি। যদি যূদ্র বেদপাঠ করে তার জিহ্বা কেটে নিতে হবে এরকম নানান শাস্তির প্রদর্শন স্মৃতিশাস্ত্রকাররা করেছেন। কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা মানুষ, পরমাত্মাকে এবং তার বিদ্যাকে জানার অধিকার আমাদের সবার রয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে এই ভেদজ্ঞান কেন?  পরমাত্মা তো ভেদজ্ঞান করেন নি। তিনি তো সবার জন্য বেদজ্ঞান উন্মুক্ত করেছেন। বেদে পরমেশ্বর বলছেন -


যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানিজনেভ্যঃ। ব্রহ্ম রাজান্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্যায় চ স্বায় চারণায়।প্রিয়ো দেবানংদক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভুয়াসময়ং মে কামংসমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।। 
(যজুর্বেদ ২৬।২)


অর্থাৎ  ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র,বৈশ্য, স্বীয় স্ত্রীর ও সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মানুষকেই আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করেছি, তোমরাও সেইরূপ অন্যদের উপদেশ করো। 




তাহলে এটা স্পষ্ট যে, সকল বর্ণের জন্যই বেদে অধিকার সমান। শূদ্রের বেদে অধিকার নেই,এই বিভেদের সৃষ্টি মানুষরাই করেছে, পরমাত্মা করেন নি। এখন এ পর্যায়ে আমাদের এই শঙ্কার উপস্থিত হয়ে, যদি শুদ্রদেরও বেদে অধিকার তবে শাস্ত্রে তাদের উপনয়নের বিধান নেই কেন? কেননা সংস্কার বিধি অনুযায়ী  প্রত্যেক শিশু বেদাধ্যয়নের জন্য গুরুর নিকটে গমn করবেন এবং গুরু তাদের উপনয়ন সংস্কারের পর গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষাপূর্বক বেদের অধ্যাপনা শুরু করবেন। কিন্তু, মনুস্মৃতি এবং গৃহ্যসূত্র আদি  গ্রন্থে তিনটি বর্ণের উপনয়নের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা -

গর্ভাষ্টমেব্দে কুর্ব্বীত ব্রাহ্মণস্যোপনায়নম্।
গর্ভাদেকাদশে রাজ্ঞো গর্ভাত্ত দ্বাদশে বিশঃ।। (মনু০ ২।৩৬)
অষ্টমে বর্ষে ব্রাহ্মণমুনেয়ৎ।গর্ভাষ্টমে বা।একাদশে ক্ষত্রিয়ম্।দ্বাদশে বৈশ্যমন।। (অশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১।১৯।১-৩ )

অর্থাৎ ব্রাহ্মণের অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়ের একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যের দ্বাদশ বর্ষে উপনয়ন বিধেয়।



তাহলে প্রশ্ন এই যে, শূদ্রের কি তবে উপনয়ন সংস্কার সংস্কার নেই? কারণ উপনয়ন সংস্কার না হলে সে তো বেদপাঠ আরম্ভ করতে পারবে না, তাহলে শূদ্র বেদপাঠ করবে কিভাবে? এই শঙ্কার মূল কারণ জন্মগত বর্ণবাদে বিশ্বাস। কিন্তু বর্ণব্যবস্থা তো জন্মানুসারে নয় বরং কর্মানুসারে হয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন - 

"চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"(গীতা০ ৪।১৩) 

অর্থাৎ আমি গুণ কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি। 




বর্ণব্যবস্থা যে কর্মানুসারে সেটা ব্রাহ্মণগ্রন্থেও স্পষ্ট। যথা -



"সঃ (ক্ষত্রিয়ঃ) হ দীক্ষমাণ এব ব্রাহ্মণতামভ্যুপৈতি।। 
(ঐতরেয় ৭।৩৪)"

 অর্থাৎ ক্ষত্রিয় দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত করতে পারে।


"তস্মাদপি (দীক্ষিতম্) রাজন্যং বা বৈশ্যং বা ব্রাহ্মণ ইত্যেব ত্রুয়ান্, ব্রাহ্মণো হি জায়তে যো যজ্ঞাজ জায়তে।। 
শতপথ ব্রাহ্মণ (৩।২।১।৪০)" 

অর্থাৎ বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।


আর বর্ণব্যবস্থা যে কর্মানুসারে সেটি "বর্ণ" শব্দের অর্থ এবং এর ব্যুৎপত্তি দ্বারাই সিদ্ধ হয়। 

নিরুক্তে "বর্ণ" শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়ে বলা হয়েছে - "বর্ণো বৃণোতে" (২।৩) 

অর্থাৎ যা বরণ করা হয় তাই বর্ণ




 এখন এই চারটি বর্ণ বিষয়ে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক -

১। ব্রাহ্মণঃ  'ব্রহ্মণ' প্রাতিপদিক দ্বারা 'তদধীতে তদ্বেদ' (অষ্টা০ ৪।২।৫৮) অর্থে "অপ" প্রত্যয় যোগে ব্রাহ্মণ শব্দ হয়।




 এর ব্যুৎপত্তি এই প্রকার - 

"ব্রহ্মণা বেদেন পরমেশ্বরস্য উপাসনেন চ সহ বর্তমানো বিদ্যাদি উত্তমগুণযুক্তঃ পুরুষঃ" 


অর্থাৎ বেদ এবং পরমাত্মার অধ্যয়ন এবং উপাসনাতে নিযুক্ত থেকে বিদ্যা আদি উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণ বলা হয়। 

ব্রাহ্মণ গ্রন্থে - "ব্রাহ্মণো ব্রতভূত" (তৈ০ স০ ১।৬।৭।২) অর্থাৎ ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ ব্রতের আচরণকারী। 



ব্রাহ্মণের কর্ম হচ্ছে-

অধ্যাপনমধ্যয়নং য়জনং য়াজনং তথা। 
দানং প্রতিগ্রহশ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।(মনু০ ১।৮৮)
- অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজ্ঞ করা ও করান, দান দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা এই ছয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম

২। ক্ষত্রিয়ঃ "ক্ষণু" হিংসা অর্থযুক্ত (তনাদি) ধাতুর সাথে 'কতঃ' প্রত্যয় যোগে "ক্ষতঃ" শব্দের সিদ্ধি হয়, আর "ক্ষত" উপপদে ত্রৈঙ্ = পালন অর্থে  (ভ্বাদি) ধাতুর সাথে 'অন্বেষ্বপি দৃশ্যতে' (অষ্টা০ ৩।২।১০১) সূত্রের সাথে 'উ' প্রত্যয় পূর্বপদান্যকারলোপ হয়ে "ক্ষত্র" শব্দ হয়েছে। "ক্ষত্র এব ক্ষত্রিয়ঃ" স্বার্থে ইয়ঃ যোগে 'ক্ষত্রিয়'। 



"ক্ষদন্তি রক্ষতি জনান্ ক্ষত্র" যিনি জনগণের রক্ষা কার্য করেন, অথবা "ক্ষয়তে হিংস্বতে নশ্যতে পদার্থো যেন স ক্ষত্রঃ" অর্থাৎ আক্রমণ, ক্ষতি হতে লোকদের রক্ষা করে তাকে ক্ষত্রিয় বলা হয়। 


ব্রাহ্মণ গ্রন্থে - "ক্ষত্রং রাজন্যঃ" (ঐতরেয় ৮।৬) "ক্ষত্রস্য বা এতদ্রুপং যদ্ রাজন্যঃ" (শত০ ১৩।১।৫।৩) অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ক্ষত্রেরই রূপ, যিনি প্রজার রক্ষক। 

ক্ষত্রিয়ের কর্ম হচ্ছে -

প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ॥ (মনু০ ১।৮৯)
- ব্রহ্মচর্যপূর্বক বেদের অধ্যয়ন করা, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করা, সুপাত্রকে দান করা, প্রজার রক্ষা করা বিষয়ে অনাসক্ত হয়ে জীতেন্দ্রিয় থাকা ক্ষত্রিয়ের কর্ম।


৩। বৈশ্যঃ বিশঃ মনুষ্যনাম (নিঘন্টু০ ২।৩) " বিশ প্রতিপদিক দ্বারা অপত্যার্থে "যঞ" ছান্দস প্রত্যয় যোগে "বৈশ্য" শব্দ হয়েছে। 



"যো যত্র তত্র ব্যবহারবিদ্যাসু প্রবিশতি সঃ বৈশ্যঃ ব্যবহারবিদ্যাকুশলঃ জনো বা" যিনি বিবিধ ব্যবহারিক বিষয়ে প্রবিষ্ট থাকে এবং বিবিধ বিদ্যাতে কুশল,  তিনি বৈশ্য। 

ব্রাহ্মণগ্রন্থে -  "এতদ্ বৈ বৈশ্যস্য সমৃদ্ধং যং পশবঃ" (তা০ ১৮।৪।৬), "তস্মাদু বহুপশু বৈশ্বদেবো হি জগতো বৈশ্য" (তা০ ৬।১।১০) অর্থাৎ পশুপালন দ্বারা বৈশ্যের সমৃদ্ধ হয়, এটিই বৈশ্যের কর্তব্য। 



বৈশ্যের কর্ম হচ্ছে -

পশুনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদং চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। (মনু০ ১।৯০)
- গবাদি পশুর পালন এবং বৃদ্ধি করা, বিদ্যা ও ধর্মের বৃদ্ধি করতে ও করাইতে ধনসম্পত্তি ব্যয় করা, অগ্নিহােত্রদি যজ্ঞ করা, বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করা, সর্বপ্রকার বাণিজ্য করা এবং বৃদ্ধির জন্য ধন প্রয়োগ করা এগুলো বৈশ্যের গুণ ও কর্ম।


৪। শূদ্রঃ  শুচ্ - শোকার্থক (ভ্বাদি) ধাতুর সাথে "শুচের্দশ্চ" (উণা০ ২।১৯) সুত্রের সাথে "রক্" প্রত্যয়, উকারকে দীর্ঘ, চ কে দ করে শুদ্র অর্থ হয়েছে। শূদ্র = শোচনীয়ঃ শোচ্যাং স্থিতিমাপন্নো বা, সেবায়াং সাধুর্ অবিদ্যাদিগুণসহিতো মনুষ্যো বা" অর্থাৎ শুদ্র সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অজ্ঞানতার কারণে কোন প্রকারের উন্নত স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারে না  এবং  যিনি নিজের নিম্ন স্থিতির হওয়ার কারণে তথা নিজের উন্নতির চিন্তা করেন তথা নিজের প্রভূর ভরণ পোষণের চিন্তা করেন ওইরূপ সেবক মানুষ। 





ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও এই ভাব দেখা যায় - "অসতো বা এষ সম্ভূতো যৎ শূদ্রঃ" (তৈ০ ৩।২।৩।৯) অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে যার নিম্ন জীবনস্থিতি, যে কেবল সেবা আদি কার্য করে, ওইরূপ মানুষ শূদ্র। শূদ্রের কর্ম হচ্ছে -

একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ। 
এতেষামেৰ বর্ণনাং শুশ্রষামনসূয়য়া।। (মনু০ ১।৯১)
-নিন্দা, ঈর্ষা এবং অভিমানাদি দোষ পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, এবং বৈশ্যদিগকে যথােচিত সেবা করা শূদ্রের কর্তব্য এবং তদ্দ্বারাই জীবন যাত্রা নির্বাহ করা। এটিই শূদ্রের একমাত্র গুণ এবং কর্ম।


মোটকথা  বেদজ্ঞানী এবং পরমাত্মার উপাসনাতে নিযুক্ত উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ।  জনগনের রক্ষা কার্য যারা করেন তারাই ক্ষত্রিয়। আর যারা বিভিন্ন ব্যবহারিক বিদ্যাতে কুশল এবং ব্যবসায়ী তারাই বৈশ্য। এবং অজ্ঞান তথা বিদ্যাহীন মানুষদের শূদ্র বলা হয়, কারণ তারা বিজ্ঞান সম্বন্ধিয় কার্য করতে পারে না কিন্তু কায়িক পরিশ্রম করতে পারে। এজন্য তারা সেবামূলক কার্যে নিযুক্ত থাকেন। এভাবে রাষ্ট্রে কর্মানুসারে বর্ণবিভাগ করা হয়েছে। 

এখন পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, যদি বর্ণ জন্মগত না হয়  তাহলে উপনয়নের জন্য প্রত্যেক বর্ণের বালকের জন্য একেক বর্ষ নির্ধারিত কেন? আর শূদ্রের জন্যও কেন উপনয়নের দিন নির্ধারিত হলো না? 

এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু উপরের বর্ণনার মধ্যেই রয়েছে, শুধু বিচারের প্রয়োজন মাত্র। কোন ছোট শিশুই কোন বর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন না। প্রত্যেক শিশু তো অজ্ঞানী হয়েই জন্মগ্রহণ করেন তারপর বিদ্যা অর্জনের পর নিজের মেধা অনুসারে নিজ নিজ পদ গ্রহণ করতে পারে। কেউ বেদবিশারদ্, কেউ ভালো যোদ্ধা, কেউ ব্যবহারিক বিদ্যাতে নিপুন আবার কেউবা এসবের কোনটাতেই দক্ষ না হয়ে অজ্ঞানীই রয়ে যান। এজন্য সন্তানের ইচ্ছায় অথবা পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী সেই বর্ণে সেই সন্তানকে উক্ত বর্ষে উপনয়ন সংস্কার করা হয়। যেমন মনু বলছেন -

ব্রহ্মবর্চসকামস্য কার্য বিপ্রস্য পঞ্চমে।
রাজ্ঞো বলার্থিন ষষ্ঠে বৈশ্যস্যেহার্খিনোষ্টমে।। (মনু০ ২।৩৭)

-এই সংসারে যার ব্রহ্মতেজ, বিদ্যা আদির শিঘ্র এবং অধিক প্রাপ্তির কামনাকারী ব্রাহ্মণ বর্ণের ইচ্ছুকের (মাতা পিতার ইচ্ছার আধারে প্রয়োগ) উপনয়ন সংস্কার পঞ্চম বর্ষে করা উচিৎ। এই সংসারে বল-পরাক্রম আদি ক্ষত্রিয় বিদ্যার অধিক প্রাপ্তির কামনাকারী ক্ষত্রিয় বর্ণের ইচ্ছুকের ষষ্ঠ বর্ষে এবং এই সংসারে ধন ঐশ্বর্যের শিঘ্র কামনাকারী বৈশ্য বর্ণের ইচ্ছুকের অষ্টম বর্ষে উপনয়ন সংস্কার দেয়া উচিত।

আর উপনয়নে শূদ্রের উল্লেখ না থাকাই প্রমাণ করে যে, মহর্ষি মনু উপনয়ন এবং বেদারম্ভের দীক্ষার পূর্বে কাউকে জন্মগত শূদ্র মানতেন না। কারণ এই দ্বিজ দীক্ষার সংস্কার তিন প্রকারের। যে সন্তান যেই বর্ণের প্রবেশ করতে চায় সে সেই বর্ণে দীক্ষা গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ পিতামাতার সংকল্প অনুযায়ী সন্তান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণে দীক্ষিত হন। এভাবে শিক্ষা দীক্ষার পর যে এই তিন বর্ণের গুণকে ধারণ করতে পারে না তিনি শুদ্র হয়ে থাকেন। আর কোন পিতা মাতাই চান না যে, তার পুত্র শূদ্রত্বে দীক্ষা গ্রহণ করুক। কেননা শূদ্র বর্ণ তার যোগ্যতা অনুসারে পরবর্তীকালে আচার্য তা ঠিক করেন এজন্য উপনয়নে শুদ্রের উল্লেখ করা হয় নি। 

এস্থলে বিখ্যাত আর্যসমাজী দার্শনিক পণ্ডিত স্বামী দর্শনানন্দ সরস্বতীর গবেষণামূলক বচনগুলি বাস্তবিকই প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্বীয় গ্রন্থমালার পূর্বার্ধে ব্রহ্মবর্চসকামস্য কার্যং- এই মনু বাক্য অনুসারে গৃহ্যসূত্রের অষ্টম বর্ষে ব্রাহ্মণমুপনয়েৎ- এই বচনের অর্থ এইরূপ লিখিয়াছেন যে ব্রাহ্মণবালকের অর্থাৎ ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বালকের উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে হওয়া উচিত। এইরূপ মন্ত্র বেদ মন্ত্রের অনুকূল অথচ যুক্তিসিদ্ধ। ব্রাহ্মণ বালক বলতে ব্রাহ্মণের বীর্যোৎপন্ন বালক নহে, পরন্তু ব্রাহ্মণপদ লাভের যোগ্য যে বালক, তাহাকেই বুঝিতে হইবে। কারণ, বেদমন্ত্রের বিরুদ্ধার্থ করিলে সমূহ সূত্র অপ্রামাণিক হইয়া যাইবে। বালক যদি শূদ্র সন্তান হইয়াও মেধাবী হয়, তাহা হইলে ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইলে তাহার উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়পদের যোগ্য হইলে একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যপদের যোগ্য হইলে দ্বাদশ বর্ষে হইবে। পরন্তু যেন স্মরণ থাকে যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য (পদের যোগ্য) হইবার জন্যই উপনয়ন সংস্কারের প্রয়োজন হইয়া থাকে, শূদ্র হইবার জন্য উপনয়নের আবশ্যক হয় না। উপনয়নের পূর্ব সকলেই শূদ্রই থাকে, ততকালে কাহারও দ্বিজ সংজ্ঞা হয় না। দুইবার জন্মগ্রহণের পর দ্বিজ আখ্যা হইয়া থাকে। প্রথম জন্ম মাতাপিতা হইতে এবং দ্বিতীয় জন্ম বিদ্যা-মাতা ও গুরু-পিতা হইতে হয়। যে বিদ্যারূপিণী মাতার গর্ভে প্রবেশ করে নাই, তাহাকে দ্বিজ বলা যাইবে কিরূপে? যে দ্বিজই হয় নাই, সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য হইবে কিরূপে? কারণ, দ্বিজ হওয়া বলিতে উপনয়ন সংস্কারের পর বেদারম্ভ সংস্কার দ্বারা ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বালকের দ্বিজত্বের পরিপক্কতা বুঝায়। বিদ্যাধ্যয়ন সমাপ্তির পর স্ব স্ব গুণ, কর্ম ও স্বভাবের যোগ্যতানুসারে কেহ ব্রাহ্মণপদ, কেহ ক্ষত্রিয়পদ, কেহ বা বৈশ্যপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। গীতাতেও এরূপ উক্তি আছে। যে ব্যক্তি ২৫ বৎসর বয়ক্রম পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন না করিয়া এবং বৈদিক শিক্ষা প্রাপ্ত না হইয়া উপনয়ন হইতে বঞ্চিত থাকে, সেই ব্যক্তিই শূদ্র এবং উপনয়ন সংস্কারের পূর্বে সকলে শূদ্রই থাকে (দর্শনানন্দ গ্রন্থমালা, পূর্বার্দ্ধ পৃ ১৫২-১৬৩)। এক কথায় শূদ্রের যজ্ঞোপবীত সংস্কার মূর্খ বালককে বাল্যাবস্থায় বিদ্যাধ্যয়নের জন্য বৈদিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা বুঝায়।


মহর্ষি মনুর কামান্মাতা পিতা চৈনং- এই বচন হইতেও বুঝা যায় যে মনুষ্যেরা জন্মমাত্রই শূদ্র হইয়া থাকে। পণ্ডিতেরাও বলেন- জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ। দ্বিজ পুত্রই বা শূদ্র পুত্রই হোক, সকলে স্ব স্ব মেধা, বলবিক্রম বা ব্যবহার অনুযায়ী যথাযথকালে বৈদিক দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়া বিদ্যার্জনের জন্য বৈদিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। তথায় অধ্যয়ন সমাপনান্তে সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ স্নাতকেরা ব্রাহ্মণ, দ্বিতীয় বিভাগে ক্ষত্রিয় এবং তৃতীয় বিভাগে বৈশ্য আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অনুত্তীর্ণ যুবকেরা শূদ্র থাকিয়া যায়, বিদ্যালাভে অসমর্থ হওয়ায় তৎকালে তাহারা বিদ্যাচিহ্ন (পৈতা) পরিত্যাগ করে। প্রাচীনকালে বৈদিক পরীক্ষার রীতি বোধ হয় এইরূপই ছিল। এইরূপে বিদ্যাবিহীন মূর্খ শূদ্রের একজন্ম এবং বিদ্যাবান্ বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের দ্বিজন্ম প্রতিপাদিত হইয়া থাকে। 

মনুস্মৃতিতে এ বিষয়ে বলা  হয়েছে - 

ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ। (মনু০ ১০।৪)
-অর্থাৎ বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করার কারণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য দ্বিজ। এই প্রকার বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্ত না করার কারণে চতুর্থ একজাতি শূদ্র।
ইত্যোম্

তথ্যসূত্রঃ মনুস্মৃতি (ডাঃ সুরেন্দ্রকুমার)

©বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

6Comments
  1. অনুপ রায় মৃদুলApril 14, 2021 at 4:23 AM

    অনেক সুন্দর আলোচনা,,অনেক কিছু জানতে পারলাম

    ReplyDelete
  2. অনেক অজানা তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  3. I konown and understand so many things ...Thanks Bangladesh Agnibir

    ReplyDelete
  4. বিষয়টা পড়ে অনেক কিছু বঝতে পারলাম এবং শিখলাম!
    এই বিষয়টা একটু পরিস্কার করুন এখন যারা শূদ্র তারা কি উপনয়ন নিতে পারবে?
    সেই ক্ষেত্রে বয়স বা শাস্ত্রাদী জ্ঞানের আবশ্যকতা আছে কিনা?
    যদি না পারে শূদ্র দ্বিজ হওয়ার সুযোগ কোথায়?
    যদি হওয়াও যায় তাহলে সেটার ব্যাখা কি করে করতে হবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. উপরের উল্লেখিত তথ্যাবলিতে বলাই আছে যে যারা তিন বর্নের যোগ্যতাই অর্জন করে নাই তারা শূদ্য।শূদ্য ব্যক্তির তো কোন শিক্ষা জ্ঞানই নাই,নিজের উন্নতির চেষ্টা ও করেন নাই। এখন সে যদি পড়তে নাই পারে তবে বেদ পড়বে কিভাবে? যেহেতু বেদই পড়তে পারবে না তাহ্লে উপনয়নের তো আর ধরকার পড়ে না।তবে সে যদি ভবিষ্যতে শিক্ষার্জন করে নিজেকে উন্নীত পর্যায়ে নিয়ে আসে তবে সে শূদ্য থেকে উন্নীত বর্নে ধাবিত হতে পাড়বে।

      Delete
  5. রতন দাসJuly 7, 2023 at 8:46 AM

    বাংলাদেশ সরকার তার সরকারি কর্মচারীদেরকে ২০টি গ্রেডে বিভক্ত করেছে। এখানে যোগ্যতাই প্রধান কারণ। কাউকে ছোট বড় করার কিছু নেই। কিন্তু উচ্চতম ধাপের সম্মান সংরক্ষিত। ২০ গ্রেডের কেউ ৯ম-১০ম গ্রেডের চেয়ারে বসতে পারে না। আবার ১ম থেকে ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তারা নিম্নগ্রেডের সকলকে তুমি করে বললেও করার কিছু নেই। ২০ তম গ্রেড কখনই ১ম গ্রেডের অফিসারকে নাম ধরেও ডাকতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে কেউ কিন্তু বর্ণপ্রথার অজুহাত টানছে না। বা মানুষকে ছোট বড় করার অভিযোগও দিচ্ছে না। উপনয়ন প্রসঙ্গে বলি: ৯ম থেকে উপরের সরকারি চাকরীজীবিদেরকে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং দেয়া হয়। এই বিশেষ ট্রেনিংয়ে তারা ভাল খাবার ভাল বাসস্থান, ভাল ভ্রমণ, ভাল পোষাক সবকিছু পায়, অথচ ১০ম এর নিচের চাকরীজীবিদের কোন স্পেশাল ট্রেনিং নেই। এসব নিয়ে কারও কিন্তু মাথাব্যাথা নেই। মানুষকে জন্ম নয়, কর্ম দিয়ে বিচার করার ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণাশ্রমকে গ্রহণ করতে না পারা আসলে আমাদের অজ্ঞতা মাত্র। এছাড়াও বিদ্বেষপ্রবণতা তো আছেই। তবে হ্যাঁ, যারা জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথাকে মান্য মনে করে, তাদের জন্য করুণা ও ঘৃণা থাকল। ধন্যবাদ

    ReplyDelete
Post a Comment