সৃষ্টি হল স্রষ্টার অপরূপ মাহাত্ম্যের প্রকাশ, আর সৃষ্টির কারণেই চারদিকটা এত সুন্দর,বিচিত্র।আর সেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই জীবজগত।আর জীবের সৃষ্টির রহস্য তাই সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ।
ছবি ১ |
ছবি ২ |
ছবি ৩(ক) |
ছবি ৩(খ) |
ছবি ৪ |
মন্দিরের দেয়ালে ভ্রুণের বিবর্তনের আরও কিছু চিত্র |
প্রথম ও দ্বিতীয় ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন?অবশ্যই চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা চিনে ফেলেছেন।আচ্ছা ঠিক আছে তৃতীয় ও চতুর্থ ছবিটি দেখুন।তৃতীয় ছবিটিতে দেখতে পাচ্ছেন আধুনিক বিজ্ঞানের মডেল অনুযায়ী শুক্রানু ও ডিম্বাণু মিলিত হচ্ছে,এর মাধ্যমের হবে নতুন একটি প্রাণীর সৃষ্টি মাতৃজঠরে।পরের ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন আধুনিক বিজ্ঞানের ইমেজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখার কল্যাণে মাতৃজঠরে থাকা একটি শিশুকে।এবার আবার ফিরে আসুন প্রথম ও দ্বিতীয় ছবিটিতে।কি দেখতে পাচ্ছেন? একদম হুবহু তৃতীয় ও চতুর্থ ছবিগুলোকেই নয় কি? হ্যাঁ, তবে পার্থক্য হচ্ছে এই ছবিগুলো আধুনিক নয় বরং অন্তত ১০০০ বছরের প্রাচীন।
এই খোদাই করা চিত্রগুলি তামিলনাড়ুর ভারমুর্তীশ্বর (Varamurtheeswarar) মন্দির,কালা ভৈরব মন্দির ও গর্ভরক্ষম্বিকা শ্রী মুল্লায়বান নাথার মন্দিরের দেয়াল থেকে প্রাপ্ত।মন্দিরের কিছু সূত্র বলে মন্দিরগুলো ৬০০০ বছরের পুরানো।তবে যুক্তিসঙ্গত সূত্র এই যে ৯৮৫-১০১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অর্থাৎ আজ হতে প্রায় ১০০০ বছর আগে রাজা কুঞ্জারা চোলানসহ চোলা রাজারা মন্দিরগুলো র্নির্মাণ করেছিলেন।
এই অভূতপূর্ব ছবিগুলোর খোদাই দেখে বিজ্ঞানমনস্ক মনমাত্রই অবাক হতে বাধ্য।কিভাবে এত বছর আগে প্রাচীন ভারতে ভিজুয়ালাইজেশন,ইমেজিং টেকনোলজি ছাড়াই(মাইক্রোস্কোপ,আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি) কিভাবে শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর ফিউশন(ফারটিলাইজেশন) এর মত আণুবীক্ষণিক প্রক্রিয়া বা মাতৃজঠরে শিশু কিভাবে থাকে তার অবস্থান সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল তা আশ্চর্যের বিষয় বটে।
বলা হয়ে থাকে ভারতমূর্তীশ্বর মন্দিরের এই খোদাইসমূহ গর্ভ উপনিষদ নামক একটি তুলনামূলক নবীন উপনিষদে বর্ণিত বিজ্ঞানভিত্তিক ভ্রুণবিদ্যার আলোকে করা হয়েছিল।গর্ভ উপনিষদ হল এমন একটি উপনিষদ যা প্রধান ১১ টি বৈদিক উপনিষদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং নামে উপনিষদ হলেও এটি মূলত তৎকালীন একটি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ।এর মূল পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ ই এখন আর পাওয়া যায়না।তবে যতটুকু পাওয়া যায় তাতেই খুব চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে।এছাড়াও অন্যতন প্রধান বৈদিক উপনিষদ মহর্ষি মহিদাস কর্তৃক লিখিত ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় উপনিষদেও আছে ভ্রুণবিদ্যা সম্বন্ধে অবাক করা কিছু তথ্য যা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।এছাড়াও আমরা দেখব দক্ষিণ ভারতীয় একাদশ শতকের শৈব স্বিদ্ধান্তের একটি গ্রন্থ "থিরুমন্তিরাম" এর কিছু শ্লোকও।আমরা দেখব কিভাবে মানবসৃষ্টির কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গিয়ে উপনিষদসমূহ ও "থিরুমন্তিরাম" অলৌকিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছে জড়ায়ুতে একটি ভ্রুণের বিবর্তন প্রক্রিয়া,এর লিঙ্গ
নির্ধারনের নিয়ামকসমূহকে।এরকম কিছু তথ্য আজ আমরা দেখব।
কিভাবে মানবভ্রুণ সৃষ্টি হয়? অনেক সভ্যতাতেই পুরুষ বীর্যকেই মানবভ্রুণ বা শিশু সৃষ্টির উৎস ধরা হত।কিন্তু উপনিষদ বলছে-
শুক্রশোণিতসংয়োগাদাবর্ততে গর্ভো
(শ্লোক ২,গর্ভোপনিষদ)
"শুক্র(পুরুষ বীর্য তথা শুক্রাণু) ও শোনিতের(স্ত্রী হতে আসা ডিম্বাণু) মিলনেই গর্ভের সৃষ্টি হয়।"
একটা সময় নারীরা অত্যাচারিত হত পুত্রসন্তান না হবার দোষে।এখনো গ্রামেগঞ্জে নারীদেরকে অত্যাচার করা হয় ছেলেসন্তান জন্ম না দেবার অপরাধে।কারণ আমরা মনে করতাম সন্তান ছেলে বা মেয়ে হলে তার দায় মায়ের।কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে সন্তান পুত্র হবে না কন্যা তা নির্ভর করবে পিতার শুক্রাণুতে Y Chromosome এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপর।এখানে মায়ের কোন ভূ্মিকা নেই।উপনিষদ বলছে-
"পুরুষে হ বা অয়মাদিতো গর্ভো ভবতি যদতদ্রেতঃ। ।"
(ঐতরেয় উপনিষদ অধ্যায় ২,শ্লোক ১)
অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই শিশু(প্রকৃতি) রেতাত্মক বা পুরুষের শুক্রাণুরূপ অনুযায়ী
স্থাপিত হয়।
গর্ভ উপনিষদ বলছে-
"পিতু রেতোঃনিরিন্কাত পুরুষো ভবতি"
অর্থাৎ পিতার রেত বা শুক্রাণুর বৈশিষ্ট্যেই গর্ভরূপ জন্ম নেয়।
অর্থাৎ শ্লোক দুইটি স্পষ্টত ব্যখ্যা করছে শুক্রাণুর
মাধ্যমেই সন্তানের প্রকৃতি অর্থাৎ তা ছেলে
হবে না মেয়ে হবে তা নির্ধারিত হয়।
এরপর আমরা নজর দেব মাতৃজঠরে ভ্রুণের বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে।আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী নিষেকের ১-৩ তম দিনে নিষিক্ত ভ্রুণ একটি ছোট অর্ধতরল দানাদার(zygote) পদার্থের ন্যায় থাকে।সেখানে ক্লিভেজ বা বিভাজন হতে থাকে।সবগুলো কোষ একসাথে থাকে কম্প্যাক্টেড অবস্থায় যাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি Morula(মরুলা)।এরপর ৫-৭ম দিনে মরুলার ভিতরের কোষসমূহ একপাশে সরে যায় এবং ভিতরে একটি ফাঁপা গহ্বরের সৃষ্টি হয়।একে আমরা বলি ব্লাস্টুলা।এরপর ১৪-২১ তম দিনে এতে তিনটি লেয়ার তৈরী হয়(Embryonic Disc) এবং এটি একটি দলার মত থাকে।এরপর সেই তিনটি স্তর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন টিস্যু,অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী হয় পরবর্তীতে।
গর্ভ উপনিষদ বলছে-
"ঋতুকালে সংপ্রয়োগাদেকরাত্রোষিতং কলিলং ভবতি"
শুক্রাণু ডিম্বাণুর মিলনের পর প্রথম দিন ভ্রুণ অর্ধতরল(Zygote) অবস্থায় থাকে।"
এরপর বলছে-
"সপ্তরাত্রোষিতং বুদ্বুদং ভবতি"
৭ দিনের সময় তা একটি বুদ্বুদ এর মত হয়।
খেয়াল করে দেখুন আমরা আগেই বলেছি ৫-৭ম দিন ভ্রুণ ফাঁপা ঠিক যেমন বুদ্বুদ এর ন্যায় Blastula থাকে।
এরপর বলছে
"অর্ধমাসান্তরেণ পিণ্ডো ভবতি"
অর্থাৎ ১৫ দিন পর তা একটি পিণ্ডে পরিণত হয়,ঠিক Embryonic Disc এর মত।
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে জাইগোট তৈরীর ৩২ দিনের মাথায় ভ্রুনে মাথা এবং মুখের সমন্বিতরুপ
Stomodium দেখা যায়।
পঞ্চম সপ্তাহে(৩৫ দিন) অলফ্যক্টরি
প্ল্যকোড অর্থাৎ ঘ্রানসম্পর্কিত ইন্দ্রিয় এর
উৎপন্ন হয়।এরইমধ্যে মুখের মধ্যে
পেলেট,টাঙ(জিহ্বা),ভোকাল কর্ড(স্বরতন্ত্রী) তৈরী হয়।
আধুনিক ভ্রুণবিদ্যা অনুসারে এই সময়ে ১২মি.মি.
দীর্ঘ ভ্রুণে মুখ,নাসারন্ধ্র দেখা গেলেও
কোন চোখের উৎপত্তি হয়না।ভ্রুণ বৃদ্ধি
পেয়ে ১৪ মি.মি. হলে তখন তাতে চোখ দেখা যায়
তবে কান এর উৎপত্তি হয় আরো পরে।
এইসব ই হয় দ্বিতীয় মাসের মধ্যে।
৮-৯ম সপ্তাহে Integumentary system অর্থাৎ ত্বকীয়
তন্ত্রের এপিডার্মিস এর উৎপত্তি শুরু হয়।
আবার ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যন্ডের
গ্লাসগোতে অবস্থিত কুইনস মাদার হসপিটালের
ডা.রবিনসন "ডায়াসোনার এপারেটাস" এর সাহায্যে
প্রমান করেন যে উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের
অব্যবহিত পরেই দ্বিতীয় মাসের শেষে
জড়ায়ুস্থ সন্তানের হৃদপিন্ডের সঞ্চালন শুরু হয়।এজন্যেই চিকিৎসকরা মায়ের গর্ভবতী হবার সাথে সাথে আল্ট্রাসাউন্ড না করে দুইমাস পরে করতে বলেন যাতে শিশুর হৃদযন্ত্রের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের বর্ণনা অনুযায়ী অঙ্গ সৃষ্টির ক্রমটা দাড়াচ্ছে নিম্নরূপ-
মুখ>ভোকাল কর্ড>নাক>চোখ>কান>
ত্বক>হৃদপিন্ড।
ঐতরেয় উপনিষদ এর প্রথম অধ্যয়ের প্রথম
খন্ডের চার নং মন্ত্রে বলা হয়েছে-
"....যথান্ডম মুখাদ্বাগ(মুখাত্ বাক) বাচোহগ্নির্নাসি
কে নিরভিদ্যেতাং নাসিকাভ্যাং প্রাণঃ প্রানাদ্বায়ুরক্
ষিনী নিরভিদ্যেতামক্ষিভ্যাং চক্ষুশ্চ্ক্ষুষ আদিত্যঃ
কর্ণৌ নিরভিদ্যেতাং কর্ণাভ্যাং শ্রোত্রং নিরভিদ্যত
ত্বচো....হৃদয়ং নিরভিদ্যত হৃদয়া..."
অর্থাৎ,প্রথম মুখ বেরিয়ে এল,মুখ থেকে বাক্
(Vocal cord) এর উৎপত্তি।এরপর নাসিকার দুটি ছিদ্র
হল(নাসারন্ধ্র,অলফ্যাক্টরি এপারেটাস),পরে চক্ষুর দুটি ছিদ্র প্রকট হল।
তারপর কর্ণের দুটি ছিদ্র বেরিয়ে এল এবং
এরপরেই চর্ম প্রকটিত হল।তারপর হৃদয়(হৃদপিন্ড)
প্রকট হয়।
তাহলে মন্ত্রটি অনুযায়ী আমরা পেলাম,
মুখ>বাক(Vocal cord)>নাকে>চক্ষু>কান>ত্বক>হৃদপিন্ড!
এরচেয়ে অদ্ভুত অলৌকিক মিল আর কি হতে পারে!
আমরা জানি সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থায় শিশু একটি তরলময় থলিতে আবৃত থাকে যে তরল তাকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।একে বলা হয় Amniotic Fluid,এটি কমে গেলে আমরা প্রচলিত ভাষায় "বাচ্চার পানি কমে গেছে" বলি।তামিল থিরুমন্তিরাম গ্রন্থের ২য় অধ্যায়ের ৪৬৩ নং শ্লোক এ বলা হয়েছে "প্রভু পানির থলেতে আবৃত করে শিশুকে রক্ষা করে থাকেন"!
আমরা জানি মা যে খাদ্যপুষ্টি গ্রহণ করেন তা মা হতে Umbilical Cord এর ধমনীর মাধ্যমে শিশুর শরীরে পুষ্টি সরবরাহ করে।গর্ভ উপনিষদ বলছে-
অথোঃমাত্রাশিতপীতনাড়িসূত্রগতেন প্রাণ আপ্তায়তে।
(শ্লোক ৩)
মা যা খায়,যা পান করে তা হতে নাড়ির মাধ্যমে শিশু পুষ্টি প্রাপ্ত হয়।
এছাড়াও গর্ভোপনিষদ কিভাবে মায়ের দুশ্চিন্তা ও অন্যান্য রোগ,আঘাত এর কারণে শিশুর জন্মগত শারীরিক ত্রুটি হয় তা নিয়েও আলোচনা করেছে।এছাড়া আলোচনা করেছে কিভাবে দুইটি আলাদা শুক্রাণু দুইটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করলে জমজ শিশুর জন্ম হয়,চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে আমরা বলি Dizygotic Twin!
এরপর নবম মাসে
অথ নবমে মাসি সর্বলক্ষণসম্পূর্ণো ভবতি
(গর্ভোপনিষদ শ্লোক ৩)
শিশুটি জন্ম নেবার জন্য শারীরিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।চিকিৎসা বিজ্ঞানেও আমরা জানি ২৭০(+-)৭ দিন বা ৯ মাসের সময় একটি বাচ্চার সকল গঠন পরিপূর্ণ হয় এবং তা জন্ম নেবার জন্য প্রস্তুত হয়।
এভাবেই প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থসমূহে ছড়িয়ে আছে তৎকালীন ঋষিবিজ্ঞানীদের অসাধারণ সব গবেষণার ফসল।তারা কেবল জপধ্যান করেন নি,নিজের পরিত্রাণের জন্য অবতারের মিথ্যা আশায় বসে থাকেন নি,আমাদের ন্যায় করোনা দূর করার জন্য কাল্পনিক করোনা দেবীর পূজা করেন নি,তারা নিজেদের মেধা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির অপার রহস্যসমূহ ভেদ করেছেন আর এভাবেই হয়ে উঠেছেন কালোত্তীর্ণ!
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
তথ্যসূত্রঃ
1)Garbhopanishada Translation&Notes By Subhash Kak
2)Thirumantiram and Garbhopanishada;an Overview By Leelavathy Naanjappa3)Embryology in Ayurveda By Dr Bhuvesh Gupta&Prof. D G Thatte
4)Wikipedia