দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







সাংখ্যদর্শন কি আসলেই নিরীশ্বরবাদী ? - পর্ব ২

অমৃতস্য পুত্রা
3


নমস্কার! ওম্ তৎ সৎ।।



এই পোস্টে আরো বিতার্কিক আলোচনা বাড়ানো হবে আজ। অনেকের মনে সন্দেহ ও ভুল ব্যাখ্যার কারনে যে প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে, তার নিরাকরণ ই এখানে করা হবে। বিষয়গুলো অনেকটা পয়েন্ট আকারে করা হবে। 

পয়েন্ট এক: 

অনেকে সাংখ্যের ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ (১.৯২) সূত্রের প্রসঙ্গ এনে বলছে সাংখ্য ঈশ্বর মানে না। অথচ তারা ভাষ্য সহ ছবি দেয় নি। কারণ তাতে তাদের উদ্দেশ্য মিথ্যা প্রমাণিত হবে। আমি পূর্বের পোস্টে বিস্তারিত দিয়েছি যে, কোন কারণে এই সূত্রে ঈশ্বরকে অসিদ্ধ বলা হয়েছে। তবুও আরো স্পষ্টতার জন্য এখানে আলোচনা করবো।

সূত্রটির পূর্ব থেকে সংক্ষেপে আলোচনা করলে  পাওয়া যায়, সাধারণ মনুষ্য ইন্দ্রিয় গোলকের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করছে এবং যােগিগণ সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ে সাহায্যে প্রত্যক্ষ করে থাকে।কারণ, উভয়ের ইন্দ্রিয়াদি রয়েছে স্থুল কিংবা সূক্ষ্ম। 
কিন্তু ঈশ্বরের স্থুল এবং সূক্ষ্ম কোন ইন্দ্রিয় না থাকায় তাঁহার পক্ষে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ হওয়া সম্ভবপর নয় বা দরকার হয় না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের এই বিষয়ে উনি জীবাত্মা এবং যোগীগনের মতো যে প্রত্যক্ষের কথা উঠেছে সেটা উনার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়, সিদ্ধ নয় অর্থাৎ  অসিদ্ধ, বিষয়টা অনেকটা এমনঃ- জীবাত্মা পাপকার্য করেন, কিন্তু ঈশ্বর তা করেন না। তাই জীবাত্মার এই আলোচনার বেপারে ঈশ্বর অসিদ্ধ, সিদ্ধ নয়। ব্যাস্ এটাই।  আর এটা সূত্রগুলোকে ক্রমানুসারে পড়লে সহজে বুঝা যায় এবং ভ্রান্তি সহজে দূর হয়ে সন্দেহ দূর হবে। সেটাকে কয়েকজন সঠিক প্রকরণ বা আলোচনা বিষয়বস্তু না বুঝে ঈশ্বর অসিদ্ধ বা সাংখ্য ঈশ্বরকে মানে না ইত্যাদি প্রচার করে থাকেন যা একেবারেই অনুচিত ও অহেতুক।

তবুও অনেকে সাংখ্যের এই সূত্রের পরে সূত্রগুলো( ১.৯৩+১.৯৪)  দিয়েও বলে যে, ওই গুলোতে নাকি ঈশ্বরকে অসিদ্ধ প্রমাণ করা হয়েছে। তাহলে ওগুলো নিয়েও একটু আলোচনা করা যায়।
পূর্বের সূত্রে যে ইন্দ্রিয়াদির জন্য অসিদ্ধ বলা হয়েছে তার জন্য শঙ্কার উৎপন্ন হয় যে,  

মুক্তবদ্ধয়ােরণ্যতরাভাবান্নতৎসিদ্ধিঃ।।৯৩। 

সরলার্থ—ঈশ্বরকে মুক্ত কিংবা বদ্ধ কোন আখ্যাই দেওয়া যাইতে পারে না । কারণ যদি মুক্ত বলা যায় তাঁহার সৃষ্টি করিবার কোন প্রয়ােজন পাওয়া যায় না । আর যদি বদ্ধ মানা যায় পরাধীন একদেশী হইয়া যাওয়ায় তাঁহার সৃষ্টি কর্তৃত্ব ঘটিতে পারে না।  মুক্ত এবং বদ্ধ দুই অবস্থাতেই ঈশ্বরে দোষ আসিয়া পড়ে। 

সং—উক্ত আশঙ্কার সমাধান তাই পরের সূত্রে  করছেন।
উভয়থাপ্যসৎকরত্বম্।।৯৪। 

সরলার্থ—ঈশ্বর নিত্য, সত্য, একরস, সর্বব্যাপক, জ্ঞানস্বরূপ আপ্তকাম, অনাসক্ত ও সদামুক্ত বলিয়া এবং বন্ধন ও মুক্তি অবস্থা বিশেষ বলিয়া তাঁহাতে এই দুই দোষের কোনটিই ঘটিতে পারে না।
এই দুই সূত্রেও বলা হয়েছে যে, জীবাত্মার যেমন মুক্ত এবং বদ্ধ ইত্যাদি অবস্থা প্রাপ্ত হয় তা ঈশ্বরের হয় না। তাই ঈশ্বরের জন্যও জীবাত্মার মতো এই চিন্তন সঠিক না বা যদি বলেন সিদ্ধ নয়। 

অর্থাৎ এই যে সাংখ্যের কিয়দসূত্র ধরে সাংখ্য ঈশ্বরকে অসিদ্ধ বা মানে না, এই বলে আমরা আওয়াজ তুলি। তা কি একবারো ভেবে দেখি, কেনো উক্ত সূত্রগুলোতে এই কথা বলা হয়েছে?? বা এই কথা কি কপিল মুনি ভুল বলেছেন??

পয়েন্ট দুই: 

অনেকেই সাংখ্য খণ্ডন করা শুরু করলেন। কিন্তু উনারা জানেন না যে, সাংখ্য খণ্ডল করলে সাংখ্য সূত্র উদ্ধৃত করে খণ্ডন করা উচিৎ। সাংখ্যের ভুল কি এবং সাংখ্যের মধ্যে যে বাস্তবতা ও যোক্তিকতা বিবর্জিত কিছু আছে, তারতো আলোচনা সাংখ্য থেকে দেখাতে হবে। কিন্তু তারা তা না করে শঙ্করাচার্যের বেদান্ত ভাষ্য মোতাবেক খণ্ডন করার প্রয়াস করেছে। যেখানে বেদান্তের যে অনেকরকমের ভাষ্য আছে তারা তা জানে না হয়তো। তাই অন্য শাস্ত্রের শুধুমাত্র ভাষ্যের আলোচনার দ্বারা অপর গ্রন্থকে ভুল বলা কতটুকু যৌক্তিক সেটাই বিবেচনার বিষয়।

পয়েন্ট তিন: 

তাদের দাবি প্রকৃতি নিজ থেকে সৃষ্টি রচনা করতে পারে এমন কথা নাকি সাংখ্যে আছে। মানে এর মাধ্যমে তারা দেখাতে চায় সাংখ্যে নাকি ঈশ্বরের দরকার নাই, প্রকৃতি নিজেই নাকি এগুলো করতে পারে, এমন কথা নাকি সাংখ্যে আছে।

কিন্তু এ নিয়ে সাংখ্য থেকে কোন সূত্র দেখাতে চাইলে দিতে পারেন না, বরং বেদান্ত থেকে শঙ্করাচার্যজীর ভাষ্যের নমুনা দিয়ে এড়িয়ে যায়। তাহলে কিসের উপর বেইজ করে সাংখ্যের উপর এমন অপবাদ দেওয়া হয়? তাই এ নিয়ে তাদের দাবি ভুল এবং অহেতুক। এটার আর কি খণ্ডনইবা করা যায় আপনারাই বলুন। 

তবুও আমরা হালকা আলোচনা করি সাংখ্য থেকে ভাষ্যসহঃ-

সত্তরজস্তমসাংসাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ প্রকতের্মহামহতােহহঙ্কারঃ। অহঙ্কারাৎপঞ্চতন্মাত্রাণভয়মিন্দ্রিয়ং তন্মাত্রেভ্যঃস্থূলভূতানিপুরুষঃ ইতি পঞ্চবিংশতিগণঃ।। সাংখ্য ১.৬১। 

সরলার্থ – সত্বঃ, রজঃ ও তমঃ স্বরূপ তিন প্রকারের অনাদি নিত্য কারণ সমান সংখ্যক ও সমান শক্তি বিশিষ্ট থাকায় পরম্পর মুক্ত হইতে না পারিয়া পৃথক পৃথক থাকা অবস্থায় নাম প্রকৃতি যাহা এই সমস্ত সৃষ্ট পদার্থের মূল কারণ। উহা জড় ও ত্রিগুণাত্মক বলিয়া সংযােগ বিয়ােগের উপযােগী। যদি কোন জ্ঞাতা নিজ শক্তি দ্বারা সৃষ্টি ও প্রলয় না করিতেন, তবে এই সমস্ত প্রকৃতি বা মূল কারণ নিজ নিজ কারণ বা স্বরূপ অবস্থায় চিরকাল পড়িয়া থাকিত। এই সমস্ত প্রকৃতি বা পরমাণু হইতে প্রথম যে তত্ত্ব উৎপন্ন হয় অর্থাৎ প্রকৃতির যাহা প্রথম কাৰ্য্য তাহার নাম মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ত হইতে অহঙ্কার হইতে পঞ্চ তন্মাত্র অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এবং উভয় ইন্দ্রিয়—পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এবং পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা—পাণি, পাদ, বাক পায়ু ও উপস্থ। পঞ্চ তন্মাত্র হইতে পঞ্চ স্থুল ভূত অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, আগ্নি, জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে এবং এতদ্ব্যতীত অন্য একটি তত্ত্ব অর্থাৎ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। এই পঞ্চবিংশতি তত্ব বিদ্যমান আছে। এই প্রকৃতি  হইতে সমস্ত স্থুল পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে এবং প্রলয় প্রাপ্ত হইলে এই সমস্ত স্থুল পদার্থ মূলতত্ত্ব প্রকৃতিতে পরিণত হইবে। আবার সৃষ্টির সময় ইহা হইতে উৎপন্ন হইবে। যতদিন না প্রলয় হয় স্থুল পদার্থ সমূহ নষ্ট হহয়া নিজ নিজ কারণে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় তাহাদের হতে উৎপন্ন হবে।এই তত্ত্ব সমূহের মধ্যে পুরুষ অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্ম কোন পদার্থের উপাদান বা কার্য্য নয়। জড় প্রকৃতি স্বয়ং কার্যকরী হয়ে আবার  সৃষ্টি রচনা করিতে পারে না। সৃষ্টি রচনার প্রয়োজনসিদ্ধি পুরুষ অর্থাৎ  জীবাত্মা ও পরমাত্মা ভিন্ন হতে পারে না বলে সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে পুরুষকে গণনা করিয়াছেন এবং উভয়েই চেতন স্বরূপ বলে এক পুরুষের গণনা করেছেন বা এক পুরুষ বলে নির্দেশ করেছেন। যেমন উভয় ইন্দ্রিয় বললে দুই ইন্দ্রিয় না বুঝাইয়া দশ ইন্দ্রিয় বুঝায় সেইরূপ পুরুষ বললে জীব ও ব্রহ্ম দুই পদার্থ বুঝিতে হইবে।

অকাৰ্য্যত্বেপিতদ্যোগঃ পারবশ্যাৎ।। সাংখ্য ৩.৫৫।। 

সরলার্থ—জীব ও প্রকৃতি স্বরূপতঃ নির্গুণ ও পরতঃ প্রকাশ বলিয়া তা প্রলয় অবস্থায় জীবাত্মা সুষুপ্ত অবস্থায় এবং প্রকৃতি কারণ অবস্থায় থাকিলেও জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার অধীনে ও সন্নিধানে প্রকৃতির বৈষম্যের দ্বারা পরমাণু সমূহের সংযােগ হইয়া সৃষ্টিরূপ কার্য আরম্ভ হইয়া থাকে। অনাদি জীবের অনাদি কর্মের ভােগ ও মােক্ষের সংস্কার জন্য এবং প্রকৃতির সংযুক্ত হইবার ভাব বর্তমান থাকা প্রযুক্ত সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর এই বিচিত্র সৃষ্টির রচনা করিয়া অনাদি জীবের ও অনাদি প্রকৃতির সার্থকতা সম্পাদন করিয়া থাকেন।

তিনি এসব কার্য কি প্রকারে নিজের অধীনে রেখে করেন, এই শঙ্কায় বলেন, 

স হি সর্ববিৎসর্বকৰ্ত্তা।।৩.৫৬।।

সরলার্থ—ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, এক রস ও অমূর্ত বলিয়া সমস্তই তাঁহার অধীনে রাখিতে পারেন। তিনিই সৃষ্টির একমাত্র কর্তা। জ্ঞানই কর্তৃত্ত্বের মূল। তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র নিরপেক্ষ কর্তা।

এর পরে সূত্রে উক্ত আলোচনার ঈশ্বর সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা দেয়, 

ইদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা।।৩.৫৭। 

সরলার্থ—যিনি সর্বব্যাপক অমূর্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, একরস, নিত্যমুক্ত আনন্দস্বরূপ তিনিই সৃষ্টিকর্তা হইতে পারেন। সৃষ্টির রচনাকৌশল ও পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়া বিচারের দ্বারা এইরূপ ঈশ্বরই সিদ্ধ হইয়া থাকে এবং বেদাদি শাস্ত্রে ও সর্বত্র এইরূপ ঈশ্বরেরই সিদ্ধি পাওয়া যায়। 

অর্থাৎ সর্ববিৎ  সর্বকর্ত্তাতো আর জড় হবে না, ঈশ্বর ই হবেন। তা উনারা না বুঝলেও সাংখ্য ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছে এবং সাধারণ মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবলেও তা বুঝবেন সাংখ্যের জ্ঞান কারো না থাকলেও। আর তাই পরের সূত্রেই ঈশ্বরকে এই গুণের সিদ্ধ করেছেন। এর মানে পূর্বের সূত্রগুলো থেকে ধারাবাহিকতায় বুঝা যায় ঈশ্বরই এই সৃষ্টিকার্যের  সর্বকর্তা।

আরো দেখি, 

প্রকৃতিবাস্তবে চ পুরুষস্যাথ্যাসসিদ্ধিঃ।। সাংখ্য ২.৫।।

সরলার্থ—বস্তুতঃ প্রকৃতিই সৃষ্টির উপাদান কারণ, পরমাত্মা অধিষ্ঠাতা ও প্রসিদ্ধ নিমিত্ত কৰ্ত্তা বলিয়া প্রধানতার জন্য তাহা হইতে এই সৃষ্টির উৎপত্তির কথা শাস্ত্রকারগণ কথন করিয়াছেন যেমন যােদ্ধাগণের নিজ নিজ শক্তির দ্বারা যুদ্ধে জয় পরাজয় হইলেও রাজারই জয় পরাজয় বলা হয়। যদি কেহ তরবারিদ্বারা কাহাকেও হত্যা করে হত্যাকারীকে হত্যার কর্তা বলা হয়, তরবারি হত্যা করিয়াছে বলা হয় না এবং যখন বিচার হয় কিসের দ্বারা হত্যা করিয়াছে—তরবারি, বন্দুক কিংবা লাঠি ইত্যাদি বলিবার প্রয়ােজন হয়। সেইরূপ সৃষ্টির প্রসিদ্ধ কৰ্ত্তা ঈশ্বরকেই শাস্ত্রে সৃষ্টির কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। তবে উপাদান হিসেবে প্রকৃতিই মূল কারণ। 

শাস্ত্রে যেখানে সৃষ্টিতত্বের বিচার করা হইয়াছে সেখানে সৃষ্টির কৰ্ত্তা কে, কাহার দ্বারা তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন ইত্যাদি বিষয় দেখিতে পাওয়া যায় এবং সেখানে সৃষ্টির উপাদান কারণ অনাদি নিত্য এবং অসংখ্য প্রকৃতি, সাধারণ কারণ অনাদি অসংখ্য জীবাত্মা ও নিমিত্ত কারণ ঈশ্বরকে একমেবাদ্বিতীয়ম বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। এইভাবে শাস্ত্রকারগণ পরমাত্মা হইতে আকাশাদি ক্রমে সৃষ্টির বর্ণনা করিয়াছেন। 

একজন প্রকৃতির উপর ঈশ্বরের অধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তার আলোচনায়ঃ-

দেখুন, অধীনতার দ্বারা সৃষ্ট পদার্থের গুণ এবং উপাদানকে বুঝায় না। এটা সাধারণ বিষয়টা যদি না বুঝে তাহলে আর বুঝায় কিভাবে?

যেমনঃ- আমার একটি রোবট আছে, সেটিকে আমি বানিয়ে আমার কথামতো চলতে প্রোগ্রাম দিয়েছি। তাই সে এখন সর্বদায় আমার অধীনে মানে আমার নির্দেশিত(নিয়মে) পথেই চলবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ওই রোবট আর আমার উপাদান একই বা গুণগত উপাদান সব এক বা আমার শরীর থেকে আমি রোবট বানিয়েছি । তাই অধীন বললেই যে, প্রকৃতি ব্রহ্মের অধীন তাই প্রকৃতি আর ব্রহ্ম এক উপাদানে গড়া এবং এবং ব্রহ্মের দেহ থেকে এই প্রকৃতি করেছেন এসব মানায় না। আশা করি এই অধীনটাইপ কথার মানে উনি বুঝবেন।

পয়েন্ট চার: 

তারা দাবি করছে কঠোপনিষদে অব্যক্ত বলতে প্রকৃতি নয়, বরং শরীরকে বুঝিয়েছে।
আচ্ছা ওদের কথাই মানলাম অব্যক্ত শরীর। এবার ভাবুনতো এই অব্যক্ত শরীরের উপাদান কি? শরীর পঞ্চমহাভূতে তৈরি। আর পঞ্চমহাভূত প্রকৃতিরই উপাদান। অর্থাৎ প্রকৃতির বিকারেই শরীর তৈরি। সুতরাং অব্যক্ত=শরীর=প্রকৃতির সূক্ষ্ম উপাদান।

পয়েন্ট পাঁচঃ-

সমান নিয়ে - ১.৬৯ নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে এখানে প্রকৃতিকে সমপ্রকৃতির বলা হয়েছে। তাই প্রকৃতির ও পুরুষের মতো চেতন ধরা হবে। তা কি হয়? তাই সাংখ্য ভুল, ভালা না। আসলে বিষয়টা কি সেটা নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক।

সমানঃ প্রকৃতেয়ােঃ।।৬৯ পদঃ-সমানঃ। প্রকৃতেঃ। দ্বয়ােঃ।।
পূর্বোক্ত সূত্রে আলোচনা হচ্ছিল মূল কারণ নিয়ে। আর মূল কারণ (নিমিত্ত,সাধারণ এবং উপাদা) যে অনাদি, নিত্য তা নিয়ে। সেই হিসেবে এখন প্রকৃতির মূল যে উপাদান কার,  তাও যে ঈশ্বরের নিমিত্ত কারণের মত অনাদি ও নিত্য। তা বুঝাতেই এই সমান বুঝালো। তা উনি না বুঝে সবকিছুর জন্যই সমান ধরে নিয়েছেন। 
এ নিয়ে একটি বেদমন্ত্রও দেখি চলুন,

দ্বা সুপর্ণা সয়ুজা সখায়া #সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজতে। তয়ােরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভি চাকশীতি৷৷৷৷
ঋ০ ম০ ১১।৬৪।২০ 

ভাষার্থঃ- (দ্বা) ব্ৰহ্ম ও জীব উভয়ে (সুপর্ণা) চেতনত্ব, পালকত্ব প্রভৃতি গুণবশতঃ সদৃশ; (সয়ুজা) ব্যাপ-ব্যাপকভাবে সংযুক্ত (সখায়া) পরস্পর মিত্রতাযুক্ত ; সনাতন এবং অনাদি (সমান) তদ্রপই (বৃক্ষ) অনাদি মূলস্বরূপ কারণ এবং শাখারূপ কাৰ্যযুক্ত বৃক্ষ ; অর্থাৎ যাহা স্থল হইয়া পুনশ্চ প্রলয়ে ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়, সেই তৃতীয় অনাদি পদার্থ; — এই তিনের গুণ কর্ম, স্বভাবও অনাদি। (তয়ােরন্যঃ) এই জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে প্রথম জীব এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পূণ্যরূপ ফলসমূহ (স্বাত্তি) উত্তমরূপে ভােগ করে। আর দ্বিতীয় পরমাত্মা, কর্মফল (অনশন) ভােগ না করিয়া চারিদিকে অর্থাৎ অন্তরে বাহিরে সর্বত্র প্রকাশমান হইয়া আছেন। জীব অপেক্ষা ঈশ্বর, ঈশ্বর অপেক্ষা জীব এবং উভয় হইতে প্রকৃতি ভিন্ন-স্বরূপ এবং তিনটিই অনাদি ৷৷

এখন খেয়াল করলে এখানেও দেখা গেল সমান শব্দটি আছে এবং তা বেদ এ যা ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতির জন্য ব্যবহার করা । তাই একে এড়ানো অসম্ভব সাংখ্যকে এড়ালেও। তবে এখানে আমরা সমান দেখলেই সবগুণে সমান এই কথা বলবোওনা সাংখ্যেও তেমন না। তাই সমান শব্দ দেখলেই যে দুইয়ের মধ্যে সবগুণের সমানতা হবে তা নয়। জীব ও পরমাত্মা উভয়েই চেতন, নিত্য, তাই এই গুণের দ্বারা উভয়ে সমপ্রকৃতির কিন্তু তার মানে এই না যে তারা সব বিষয়েই সমপ্রকৃতির হবে। কারণ ভিন্নতাও যে রয়েছে উভয়ে।
আশা করি, উনার এই কথাটিও উনি বুঝে নিবেন। 

পয়েন্ট ছয় : 

সাংখ্য প্রকৃতিকে একমাত্র না, বরং উপাদান কারণ রূপেই বর্ণনা করেছে। কারণ সাংখ্যে পুরুষের কথাও স্পষ্ট আছে।   অদ্বৈতবাদীদের মতে ব্রহ্মই একমাত্র কারণ। অর্থাৎ ব্রহ্মই নিমিত্ত কারণ আবার উপাদান কার। ব্রহ্ম  নিজেই চেতন আবার জড় এই দুই উপাদান। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতেই নাকি ব্রহ্ম এই জড় জগতে রুপান্তরিত হয়। 

দেখুন, আমরা জানি যখন কোন উপাদান দিয়ে কোনকিছু তৈরি করা হয় তখন সেই বস্তুর বিকার ঘটে। তাহলে কি ব্রহ্মের বিকার ঘটে? ব্রহ্মের বিকার দোষ ঢাকতে অদ্বৈতবাদীরা বিবর্ত নামের এক শব্দের আমদানি করেছে। যা বেদ উপনিষদের কোথাও দেখা যায় না। তারা বলে মায়া শক্তি দ্বারা জগত সৃজিত হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায় জগতের উপাদান কারণ ব্রহ্মের বিবর্ত রূপ মায়া। উপনিষদ মতে প্রকৃতিই মায়া। 

অর্থাৎ সাংখ্য যে দাবি করছে প্রকৃতি উপাদান কারণ তা অদ্বৈতবাদীরাও পরোক্ষভাবে স্বীকার করছে মায়া দ্বারা। যখন প্রশ্ন করা হয়, এই যে আমরা এই জগত দেখতে পাই, মেনে নিলাম সেটা অনিত্য। কিন্তু তার উপাদান কি? মানে ব্রহ্ম কি উপাদান দিয়ে এইটা করলো? সেই উপাদান কি নিত্য না অনিত্য?  তখন তারা কিছুই বলতে পারে না। 

এতে আরো প্রশ্ন জুড়ে দেই-  এই যে বর্তমানের প্রকৃতি দেখা যায় তা হল, জড় পদার্থ কিন্তু ব্রহ্ম হল চেতন। তাহলে ব্রহ্ম থেকে যে উপাদান হবে তা কি চেতন হবে নাকি জড়?? এর ব্যাখ্যায় উনারা তুলে আনেন, মাটি আর ঘটের কাহিনি। অর্থাৎ মাটি হল নিত্য কারণ এবং ঘট হল সেই অনিত্য কার্য্যরুপ। এখন একটা বিষয় খেয়াল করুন। এই যে মাটি এবং ঘট তার মধ্যে গুণগত কি পার্থক্য আছে? উভয়ের মূল উপাদান কিন্তু একই এবং তা জড় উপাদান। তাই, এই সৃষ্টি যেমন জড় তাই তার  মূল ও জড় গুণাবিশেষ ই হবে। তাই তো? তাদের হিসেবমতে ব্রহ্ম যদি এই মাটির মূল উপাদান কারণ হয়, তাহলে উনিও মাটির মতো জড় হবেন নিশ্চয়। কিন্তু ব্রহ্মতো জড় নয় বরং চেতন। তাই উনাকে মাটি মূল কারণের সাথে মিলালে কি হবে? নাকি কুমার চেতনের সাথে মিলাতে হবে তা সবার বিবেচনার জন্য রেখে দিলাম। তারা মনে করেন, যা নিত্য তাই ব্রহ্ম! অর্থাৎ উনারা নিত্যতা স্বীকার করছেন উপাদানের। উপাদান এখানে প্রকৃতি আর ব্রহ্ম ও প্রকৃতির পার্থক্য নিত্যতায় না, বরং চেতনায়। তাই সৃষ্টির পরে যেমন পার্থক্য বিধ্যমান তেমনি সৃষ্টির পূর্বেও এই জড়-চেতনের পার্থক্য বিধ্যমান থাকবেই। জড় চেতন হয় না আবার চেতন জড় হবে না। 

আর তারই ব্যাখ্যায় দর্শন শাস্ত্র বলে,

কাৰ্য্যদর্শনাৎতদুপলৰূেঃ।।১.১১০।।

সরলার্থ–সৃষ্টিরূপ কাৰ্য্য দেখিয়া প্রকৃতি ও পুরুষের জ্ঞান অনুমানের দ্বারা হইয়া থাকে। কারণ বিনা কোন কাৰ্যই উৎপন্ন হইতে পারে না এবং কার্যে  কারণের ভাব প্রকাশিত হইয়া থাকে তাহার বিপরীত হইতে পারে না।

'কারণগুণপূর্বকঃ কার্যগুণো দৃষ্টঃ' [বৈ০ অ০ ২, অ০ ১, সূ০ ২৪] ।

ভাষার্থ- কারণগুণের অনুসরণেই কার্যগুণ প্রকাশিত হয়। 

অর্থাৎ যেভাবে কর্তা কুমারের গুণ ঘটিতে, কামারের গুণ কুঠারে, বস্ত্রাকারের গুণ বস্ত্রে এবং  স্বর্ণকারের গুণ স্বর্ণে থাকে না এবং যেভাবে ঘটিতে উপাদান কারণ মাটির গুণ, কুঠারে লোহার গুণ, বস্ত্রে সুতা-কার্পাসের গুণ, তথা স্বর্ণালঙ্কারে স্বর্ণের গুণ বিদ্যমান, সেভাবে এই সৃষ্টিতে(প্রকৃতি) ঈশ্বরের চৈতন্যতা, সর্বব্যাপকতা, সর্বজ্ঞতা আদি গুণ বিদ্যমান নেই, বরং জড়তা, একদেশিতা আদি প্রকৃতির গুণ বিদ্যামান। কারণ, উপাদানকারণের(মূলরুপ) গুণই কার্যরুপে(বাস্তবিকরুপ) অবশ্যই বিদ্যমান হয়।

কাৰ্য্যস্তৎসিদ্ধেঃ।।সাংখ্য ২।৬। |
 
সরলার্থ—এই সৃষ্টিরূপ কাৰ্য্য দেখিয়া জড়, সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ রূপ তিন প্রকারের প্রকৃতিরই প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। চৈতন্য আত্মা জগতের উপাদান কারণ হইলে উপাদান কারণের সদৃশ জগৎ ও চৈতন্যময় হওয়া উচিত ছিল।কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। সেজন্য জগতের উপাদান কারণ প্রকৃতিই হইতেছে, জীবাত্মা সাধারণ কারণ ও পরমেশ্বর নিমিত্ত কারণ।

আশা করি এবার এই ব্রহ্মের উপাদান কারণ না হওয়ার পিছনে আপনার আলোচনা স্পষ্ট হবে এবং প্রকৃতিই যে উপাদান কারণ তাও ক্লেয়ার হবে। আর সেই কারণেই হয়তো অদ্বৈতবাদিরা সাংখ্যকে খণ্ডন বা ভুল হিসেবে মনে করে। কার,  সাংখ্য শ্রুতির পক্ষে থাকলেও তাদের অদ্বৈতের পক্ষে থাকে না বরং ত্রৈতের পক্ষেই থাকে। 

এর জন্য আবার দেখলাম একজন সাংখ্যের ১.১১৭ সূত্রকে দিয়েছেন   , 
দেখি কি আছে??

শক্তস্যশ্যকরণাৎ।।১১৭।।

সরলার্থ—কারণে যে শক্তি বর্তমান থাকে কার্য্যে সেই শক্তিরই প্রকাশ দেখা যায় যেমন একই মৃত্তিকা, জল, বায় ও সূর্যের সাহায্যে বীজের পার্থক্য হেতু বিভিন্ন বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম উৎপন্ন হইয়া থাকে। যে যে বীজের মধ্যে যে যে বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম রূপ কাৰ্য্যশক্তি বর্তমান থাকে, মৃত্তিকা, জল, বায়ু ও সূর্যের সমবায় সম্বন্ধের দ্বারা সেই সেই বীজ হইতে সেই সেই বৃক্ষ লতা বা গুল্ম। উৎপন্ন হইয়া থাকে তাহার বিপরীত হয় না।। 
আর একে আরো বর্ধিত করে বললে বলা যায়, ব্রহ্ম যেহেতু চেতন তাই তার থেকে জড় প্রকৃতির সৃজন না হয়ে বরং উপাদান কারণ প্রকৃতি থেকেই কার্যরুপ প্রকৃতির উৎপন্ন মানলেই বরং গুণের দিক দিয়েও যৌক্তিক হয়। কারণে যে গুণ বিদ্যমান হবে কার্যেও সেইরুপ গুণই প্রকাশ পাবে। 

সবিশেষে উপনিষদ লক্ষ্য করলেও দেখা যায়, 
নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানামেকো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্।
তৎ কারণং সাংখ্যযোগাধিগম্যং জ্ঞাতা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ।। শ্বেতাশ্বতর ৬.১৩।।

সরলার্থঃ যিনি নিত্যের মধ্যে নিত্য চেতনের মধ্যে চেতন, একাই অনেক জীবের কামনা কে সিদ্ধ করেন, তিনিই এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ এবং সাংখ্য ও যোগ দ্বারা অধিগম্য সেই পরমাত্মদেবকে জেনেই মনুষ্য সমস্ত পাশ অর্থাৎ জন্ম-মরণের বন্ধন থেকে মুক্ত হয় অর্থাৎ মোক্ষ কে প্রাপ্ত করে।।৬.১৩।।

বিঃ দ্রঃ - এখানে সাংখ্য+যোগ বলতে গ্রন্থকে নয়, এ বিষয়ক জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। আর সেটাই সাংখ্য এবং যোগ দর্শনেও বর্ণিত।
অর্থাৎ সাংখ্যের বিদ্যাও যে মুক্তিতে প্রয়োজন তাও স্পষ্ট। তাই যে বা যারা সাংখ্যের এই জ্ঞানকে নিরীশ্বরবাদ বলে, তাদের সাংখ্যের সিদ্ধান্তিক জ্ঞান কি প্রয়োজন নেই? আর সাংখ্য কিভাবে ঈশ্বরমূখী হয় না, তাও বিবেচনার জন্য রাখা হল।

যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো বিশ্বানি রূপাণি যোনীশ্চ সর্বাঃ ।
ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে জ্ঞানৈর্বিভর্তি জায়মানং চ পশ্যেৎ ।। শ্বেতাশ্বতর ৫/২।।

শব্দার্থঃ (যঃ) যে পরমাত্মা (যোনিম্ যোনিম্) প্রত্যেক যোনির [প্রাণীকুলের] (একঃ) একমাত্র (অধিতিষ্ঠতি) অধিষ্ঠাতা বা নিয়ামক, (বিশ্বানি) সকল (রূপাণি) জীব বা পদার্থের রূপ (চ) এবং (সর্বাঃ) সকল (যোনীঃ) যোনীর উৎপত্তিকর্তা (চ) এবং (যঃ) যিনি (অগ্রে) পূর্বে (প্রসূতম্) উৎপন্ন (কপিলম্) কপিল (ঋষিম্) ঋষি হয়েছিলেন (তম্) তাঁকে (জ্ঞানৈঃ) জ্ঞান দ্বারা (বিভর্তি) পূর্ণ করেছিলেন (জায়মানম্) সৃষ্টিতে প্রকটিত (তম্) সেই পরমাত্মাকে (পশ্যেৎ) মুমুক্ষুগণ দর্শন করেন [সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন] ।। ২।। 

সরলার্থঃ যে পরমাত্মা প্রত্যেক যোনির [প্রাণীকুলের] একমাত্র অধিষ্ঠাতা বা নিয়ামক, সকল জীব বা পদার্থের রূপ তথা সকল যোনীর উৎপত্তিকর্তা এবং যিনি পূর্বে উৎপন্ন কপিল নামক ঋষি ছিলেন, তাঁকে যেই পরমেশ্বর জ্ঞান দ্বারা পূর্ণ করেছিলেন, সৃষ্টিতে প্রকটিত সেই পরমাত্মাকে মুক্তিকামী সাধকেরা দর্শন করেন অর্থাৎ সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন ।। ২।।

অশ্বখঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবীণাং চ নারদঃ
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলাে মুনিঃ।। গীতা ১০.২৬।।

অনুবাদ : সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বখ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি।। 

অর্থাৎ উপনিষদে, যাকে উনারা শ্রুতি বা বেদজ্ঞান করে, সেখানেই সাংখ্যের গুণগান এবং  গীতায়ও কপিল মুনির গুণগান নিশ্চয় কপিল মুনিকে একজন নাস্তিক হিসেবে প্রতিপাদন করে না! বরং বেদভিজ্ঞ ও যথার্থ জ্ঞানীর হিসেবেই প্রকাশ করে। নয়তো উপনিষদ এবং শ্রী কৃষ্ণ জী অন্তত এমন বক্তব্য তথা জ্ঞান দিতেন না।

তাদের সাংখ্যে এলার্জি বা ভাষ্যের প্রতি সমস্যা মনে হলে আমাদের কিছু করার নেই। নিজ মান্যতায় সমস্যা হলে তারা শাস্ত্রকে নিষেধ করতেও পারে। তাই আমাদের যতটুকু রেফারেন্স দেওয়ার দরকার দিলাম, বাকিটা উনাদের যুক্তি দিয়ে বিবেচনার বিষয়।

ধন্যবাদ।
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
বাংলাদেশ অগ্নিবীর।।


Post a Comment

3Comments
  1. আমার প্রশ্ন হলো, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "সিদ্ধদের মধ্যে আমিই কপিল মুনী" এই কথার দ্বারা কি প্রকৃতির অংশকে বলা হয়েছে, নাকি পরমাত্মাকে? কারন পরমাত্মার তো কোনো রুপই নেই। তাহলে কপিলমুনী তো তার রুপ নয়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রকৃতির কোনো অংশ হয় না। প্রকৃতি জড় এবং সত্ত্ব রজঃ তমঃ গুনের সাম্যবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। আপনার প্রশ্নের উত্তর: মায়াকে বোঝানো হয়েছে। কারণ ঈশ্বর প্রকৃতিতে গতির সৃজন করে থাকে বা গতিশক্তি দান করে থাকে কিন্তু স্বয়ং নিজে গতিতে আসে না।।

      Delete
  2. আপনারা নিজেরাই তো স্বীকার করে নিলেন গীতা ১৩।২০ প্রকৃতি=ঈশ্বর, পুরুষ=জীবাত্মা। যেহেতু হওয়া উচিৎ ছিলো প্রকৃতি=মায়া, পুরুষ=জীবাত্মা ঠিক একইভাবে পরের শ্লোকে কার্য বলতে জীবদেহকে বোঝানো হয়েছে এবং জীবদেহের ইন্দিরাগণকে প্রকৃতি বা মায়া বা অমূর্ত বা অব্যক্তকে বোঝানো হয়েছে।।

    ReplyDelete
Post a Comment