অথত্রিবিধদুঃখ্যাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্তপুরুষার্থঃ ।। ১.১ ।।
সরলার্থঃ- ত্রিবিধ দুঃখের (আধ্যাত্মিক, আদিভৌতিক, আদিদৈবিক দুঃখের) অত্যন্ত নিবৃত্তিই অত্যন্ত পুরুষার্থ।
সাংখ্যের এই প্রথম সূত্রটি থেকেই বুঝা যায়, সাংখ্য প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে এক পার্থক্য তথা দ্বৈতাবস্থা এনে দিচ্ছে। কারণ, সুখ-দুঃখ হয় জীবাত্মার, জড় প্রকৃতির না। আর তার থেকে নিবৃত্তিও আত্মার ই হয়, জড় প্রকৃতির না। তাই এদের মধ্যে যে একটা পার্থক্য রয়েছে তা স্পষ্টতই বুঝা যায়।
তবে সব থেকে বড় সমস্যা বাধে নিম্নোক্ত সূত্রটি নিয়ে,
প্রকৃতি পুরুষয়োরন্যৎ সর্বমনিত্যম্ ।। ৫.৭২ ।।
সরলার্থঃ- প্রকৃতি ও পুরুষ ভিন্ন সমস্তকিছুই অনিত্য।
এখানে প্রকৃতি ও পুরুষ বাদে সব কিছুকেই অনিত্য বলা হয়েছে, কিন্তু এদের নিত্য বুঝিয়েছে এবং তা খুবই স্পষ্ট। আর সে কারণেই হয়তো অদ্বৈতবাদিরা স্পষ্ট সুরেই সাংখ্য তথা কপিল মুনিকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ তথা নিরীশ্বরবাদি অর্থাৎ নাস্তিক হিসেবেই অ্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সেই হিসেবেই সাংখ্যের খণ্ডন করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ভারত তথা এই বঙ্গের অনেকেই এই ধারণা পোষণ করে যে, সাংখ্য আসলেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাতিল করে দেয়।
কিন্তু বাস্তবতা কি এবং এই শঙ্কার নিরাকরণ আশা করি আমাদের এই লেখা থেকে আপনারা বুঝে নিবেন।
সাংখ্য স্পষ্টত প্রকৃতি ও চেতন এই দুই সত্তাকে মেনেছে এবং তা সূত্র পড়লেই জানা যায়। তবে অদ্বৈতমান্যকারীগণ, উপনিষদ এবং বেদান্ত দর্শন বিশ্লেষণে একমাত্র ব্রহ্মকে প্রতিপাদন করে, উনাকেই উপাদান কারণ হিসেবে তত্ত্ব দেন এবং এই থিউরি বা বিশ্বাস প্রদান করেন যে, শ্রুতি একমাত্র ব্রহ্মকেই স্বীকার করে অর্থাৎ অদ্বৈতবাদকে। ফলে যখন কোন গ্রন্থ নির্দিষ্টভাবে প্রকৃতি এবং চেতনসত্তাকে অনাদি ও নিত্য এবং পৃথক বলে। তখন সেই গ্রন্থকে নিরীশ্বরবাদী বলে অ্যাখ্যায়িত করতে পারলে মান্যতার লাভ। আর সেই কারনেই সাংখ্যের খণ্ডনে বা আলোচনায় অদ্বৈতবাদিরা একে নিরীশ্বরবাদী হিসেবেই বর্ণনা করেন।
কিন্তু একটা গ্রন্থে যখন স্পষ্টত ঈশ্বরের বর্ণনা এবং ঈশ্বর অস্থিত্বের লক্ষণ বর্তমান থাকে তখন কিভাবে সেই গ্রন্থকে নিরীশ্বরবাদী হিসেবে বলা যায় সেটাই চিন্তনের বিষয়।
এবার, কেনো সাংখ্য নিরীশ্বরবাদ হতে পারে না, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক,
১/- সাংখ্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীবাত্মার এবং প্রকৃতির সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্থাৎ বিবেকজ্ঞান লাভ করা এবং জীবের বন্ধনের মূল কারণ কি এবং তার থেকে মুক্তির উপায় কি এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। অর্থাৎ জীবের মূল লক্ষ্য যে মোক্ষলাভ ( দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি ), তারই বর্ণনা এতে রয়েছে। আর এই মুক্তি যে বিবেকজ্ঞান লাভের মাধ্যমে তা সাংখ্যে স্পষ্টভাবেই আছে,
জ্ঞানান্মুক্তিঃ।। ৩.২৩।।
অর্থাৎ জ্ঞানেই মুক্তি।
আর এ নিয়ে যজুর্বেদ ৩১.১৮ এর মন্ত্রে দেখা যায়,
তমেব বিদিৎবাতি মৃত্যুমৈতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায় ॥৩১.১৮॥
ভাবার্থঃ- তাকে জানা এবং অনুধাবন করা ছাড়া এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে উর্দ্ধে উঠে মোক্ষলাভের আর অন্য কোন পন্থা নেই।
অর্থাৎ সাংখ্য দর্শন বেদ এরই মান্যতাকে বরং সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছে এবং সাংখ্যের মূল তত্ত্বকে বুঝানোর জন্য শ্রুতির বিবেচনা নিয়েছেন অনেকক্ষেত্রে । সাংখ্যেই ৩০ টিরও অধিক সূত্রে যেমনঃ- ১.৩৬, ১.৫১, ১.৫৪, ১.৭৭, ১.৮৩, ১.১৪৭, ২.২০-২২, ৩.১৫, ৩.৮০, ৫.১, ৫.১২ ইত্যাদিতে শ্রুতির নাম এবং মান্যতাকে তুলে ধরে বিভিন্ন শঙ্কার সমাধান করেন। যে শ্রুতির মূল তত্ত্বই ঈশ্বরকে প্রতিপাদন এবং উনাকে প্রাপ্তি নিয়ে। আর সেই শ্রুতির মান্যতাকেই বার বার টেনে আনা সাংখ্য কিভাবে নিরীশ্বরবাদ হয়? কপিল মুনি যদি সত্যিই নিরীশ্বরবাদী হতেন, তাহলে সাংখ্যকে বুঝানোর জন্য তিনি কি শ্রুতির সহায়তা নিতেন? এর থেকেই স্পষ্টও বুঝা যায় যে কপিল মুনি এবং উনার সাংখ্য কখনো নিরীশ্বরবাদ নয় বরং সাংখ্যের আলোচনার বিষয়বস্তুর ধরুন এমন মনে হতে পারে। এর বাইরে কিছু নয়।
২/- ষড়দর্শনের মধ্যে প্রতি দুইটা করে জোড়াভিত্তিক প্রায় সম থিউরির দর্শন রয়েছে। সেই দৃষ্টিকোন থেকে সাংখ্য এবং যোগ দর্শনকে জোড়া হিসেবে মানা হয়। সাংখ্যকে সিদ্ধান্তিক এবং যোগ দর্শনকে প্রায়োগিক হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ প্রায় একই মান্যতা ও তত্ত্বকে এই সাংখ্য যখন সিদ্ধান্তিকরুপে প্রতিপাদন করে, ঠিক তেমনি যোগ দর্শন প্রায়োগিক দিক দিয়ে প্রতিপাদন করে। তার কারনেই এই দুই দর্শনকে সমদর্শন জোড় বলা হয়। সেই জন্য যোগ দর্শন যেখানে স্পষ্টত ঈশ্বরকে মান্য করে,
ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা ।।১.২৩।।
পদার্থ+ ভাবার্থঃ- বা এছাড়া ঈশ্বরপ্রণিধানাৎ-ঈশ্বর প্রণিধানের দ্বারাও (নির্বাজ সমাধিতে সিদ্ধি শীঘ্র হতে পারে)। ব্যাখ্যাঃ- ঈশ্বরে ভক্তি অর্থাৎ শরণাগতির নাম ঈশ্বর প্রণিধান (ঈশ্বনােপাসনা) (দ্রষ্টব্য যােগ, ২১)।
তাই সাংখ্যও তেমনি ঈশ্বরকে মান্য করবে, এটাই স্বাভাবিক।
তারই ধারাবাহিকতায় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাই,
নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানামেকো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্।
তৎ কারণং সাংখ্যযোগাধিগম্যং জ্ঞাতা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ।।৬.১৩।।
সরলার্থঃ যিনি নিত্যের মধ্যে নিত্য চেতনের মধ্যে চেতন, একাই অনেক জীবের কামনা কে সিদ্ধ করেন, তিনিই এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ এবং সাংখ্য ও যোগ দ্বারা অধিগম্য সেই পরমাত্মদেবকে জেনেই মনুষ্য সমস্ত পাশ অর্থাৎ জন্ম-মরণের বন্ধন থেকে মুক্ত হয় অর্থাৎ মোক্ষ কে প্রাপ্ত করে।।৬.১৩।।
বিঃ দ্রঃ - এখানে সাংখ্য+যোগ বলতে গ্রন্থকে নয়, এ বিষয়ক জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। আর সেটাই সাংখ্য এবং যোগ দর্শনেও বর্ণিত।
অর্থাৎ সাংখ্যের বিদ্যাও যে মুক্তিতে প্রয়োজন তাও স্পষ্ট। তাই যে বা যারা সাংখ্যের এই জ্ঞানকে নিরীশ্বরবাদ বলে, তাদের সাংখ্যের সিদ্ধান্তিক জ্ঞান কি প্রয়োজন নেই? আর সাংখ্য কিভাবে ঈশ্বরমূখী হয় না, তাও বিবেচনার জন্য রাখা হল।
৩/- সাংখ্য দর্শনে,
বিদ্বান পুরুষের উপদেশ এবং প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ এই তিন প্রমাণের দ্বারা সমস্ত পদার্থের জ্ঞান হইতে পারে, বেদের কি প্রয়ােজন?
এর উত্তরে সূত্রঃ-
ন ত্রিভিরুপৌরুষেয়ত্বাদ বেদস্য তদর্থস্যাতীন্দ্ৰিয়ত্বাৎ।। ৫.৪১।।
সরলার্থ—এই তিন প্রমাণের দ্বারা সম্পূর্ণ জ্ঞান হইতে পারে না। বেদ অপৌরুষেয় বলিয়া উহার অর্থ অতীন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় সাপেক্ষ পৌরুষেয় শিক্ষার দ্বারা অতীন্দ্রিয় জ্ঞান সম্ভব নহে। সেই কারণ বেদের প্রয়ােজন।
এবং বেদ অনিত্য ও মনুষ্যকৃত হতে পারে, এমন শঙ্কার সমাধানে বলেন,
ন পৌরুষেয়ত্বং তৎকর্ত্তুঃ পুরুষস্যাভাবাৎ।।৫.৪৬।।
সরলার্থ—বেদের কর্তা কোন মনুষ্য নহে। বেদ ঈশ্বরীয় অভ্রান্ত জ্ঞান।জীবের জ্ঞান অভ্রান্ত নহে বলিয়া জীবে বেদপ্রণয়ন শক্তির অভাবই দেখিতে পাওয়া যায়।
বেদের কর্তা মনুষ্য কেন নহে ? এমন শঙ্কায় বলেন,
মুক্তামুক্তয়ােরযােগ্যত্ত্বাৎ।।৫.৪৭।।
সরলার্থ—বদ্ধ ও মুক্ত কোন পুরুষেরই বেদ প্রণয়নের যােগ্যতা দেখায় না বলিয়া বেদ কোন মনুষ্যকৃত হইতে পারে না।
উপর্যক্ত সূত্রগুলো থেকে বুঝা যায়, সাংখ্য বেদকে অপৌরষেয় বলে বর্ণনা দেয়। আর অপৌরষেয় মানে যে কোন মনুষ্য দ্বারা নয় বরং ঈশ্বরের দ্বারা প্রদত্ত বুঝায় তা আমরা অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ থেকেও সহজে জানি। আর সেটাই সাংখ্য বুঝিয়ে দেয়।
তাছাড়া, দর্শন শাস্ত্রগুলোকে বেদ এর উপাঙ্গ বলা হয়। তাহলে বেদ এর উপাঙ্গ হিসেবে সাংখ্য দর্শন কিভাবে বেদ এর বিরুদ্ধে কোন মত দিবে??
এর থেকেই বুঝা যায় সাংখ্য কোন নিরীশ্বরবাদী গ্রন্থ নয়। তবুও আমরা এখন সাংখ্য থেকে দেখবো সেখানে ঈশ্বরের অস্থিত্ব আছে কিনা??
সাংখ্য ঈশ্বরের সর্বকর্তৃত্ব ও সর্বজ্ঞাতৃত্ত্ব সিদ্ধ করিতেছেন।। এই শঙ্কায় বলেন ,
সাক্ষাৎসস্বন্ধাৎ সাত্বিম্।।১.১৬১।।
সরলার্থঃ- ঈশ্বর জ্ঞান স্বরূপ, সর্বব্যাপক ও অমূর্ত বলিয়া সকলের মধ্যে ও বাইরে ওতপ্রোতভাবে ব্যাপ্ত থাকিয়া কাহারও সাহায্য ব্যতীত সাক্ষাৎ সম্বন্ধের দ্বারা স্বয়ং সকলের সাক্ষীস্বরূপ হইয়া রহিয়াছেন।
-পরমাত্মা নিত্য মুক্ত ও স্বতন্ত্র কেন ?এই শঙ্কায়,
নিত্যমুক্তত্বম্।।১.১৬২।।
সরলার্থঃ- পরমাতা সর্বজ্ঞ ও এক রস বলিয়া স্বতন্ত্র ও সদামুক্ত।।
ঔদাসীন্য চৈতি।।১.১৬৩।।
সরলার্থঃ- পরমাত্মা নির্লিপ্ত, প্রবৃত্তি রহিত, অভােক্তা ও পর্যাপ্ত কাম বলিয়া সদামুক্ত ও স্বতন্ত্র।
জীবাত্মা ও তাহাদের অসংখ্য কর্মের ফল বিধানের ব্যবস্থা কি প্রকারে ঈশ্বর নিজের অধীনে রাখিতে পারে, এই শঙ্কায় লিখেন,
স হি সর্ববিৎসর্বকৰ্ত্তা।।৩.৫৬।।
সরলার্থ—ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, এক রস ও অমূর্ত বলিয়া সমস্তই তাঁহার অধীনে রাখিতে পারেন। তিনিই সৃষ্টির একমাত্র কর্তা। জ্ঞানই কর্তৃত্ত্বের মূল। তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র নিরপেক্ষ কর্তা।
উক্ত সূত্রগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় এগুলো ঈশ্বরকেই ইঙ্গিত করে, জীবাত্মাকে নয়( অনেকের মনে জীবাত্মাকে নিয়ে সন্দেহ আসতেও পারে)। কারণ, এই সর্বজ্ঞ সাক্ষীদাতা, নিত্য মুক্ত, নির্লিপ্ত, সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা, এসব গুণ অবশ্যই কোন জীবাত্মার হবে না বরং ঈশ্বরকে সিদ্ধ করতেই ব্যবহার করেছেন কপিল মুনি।
তবে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ শব্দে অনেকের মনে সন্দিহান আসে যে, পুরুষ শব্দ দিয়ে কি ঈশ্বরকে বুঝিয়েছে নাকি জীবাত্মাকে। তাদের জন্য,
শ্রুতিতে পুরুষকে অনেক স্থলে অদ্বৈত প্রতিপন্ন করিয়াছেন। মানে জীবাত্মাকেও পুরুষ আবার ঈশ্বরকেও পুরুষ বলা হয়েছে, তাই একই মনে করে নিয়ে অদ্বৈত ভাবা হয়। তাই অনেকে শঙ্কা করেন যে, পুরুষ বহু মানিলে এতে শ্রুতি বিরোধ উপস্থিত হইবে।। তাদের জন্য,
নাদ্বৈতশ্রুতিবিরােধে জাতিপৱত্বাৎ।।১.১৫৪।।
সরলার্থঃ-বেদে যে স্থলে অদ্বৈত পুরুষের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায় সেখানে জীব ও পরমাত্মা উভয়ই চৈতন্যজাতীয় বলিয়া একই পুরুষ শব্দ বলতে করিয়াছেন।
আবার অনেক স্থলে অসংখ্য প্রজা অর্থাৎ জীবাত্মা বহু, নিতা ও অবিনাশী এরূপও বলিয়াছেন। ঠিক তেমনি সাংখ্যেও বলা আছে। যেমন,
নাম্বৈতমাত্মনাে লিঙ্গাত্তদ্ভেদপ্রতীতেঃ।। ৫.৬১।।
সরলার্থ–সুখ দুঃখ আদি অসংখ্য চিহ্ন দ্বারা একাত্মতত্ত্বের খণ্ডন হইতেছে। সেই কারণ জীবাত্মা এক নহে। সংসারে কেহ সুখী, কেহ দুঃখী, কেহ জ্ঞানী, কেহ অজ্ঞান, কেহ ধনী, কেহ নির্ধন, কেহ মানুষ কেহ পশু, ইত্যাদি অসংখ্য ভেদ দেখিয়া নিশ্চয় হইতেছে যে জীবাত্মা এক নহে, বহু।
পুরুষবহুত্বংব্যবস্থাতঃ।। ৬.৪৫।।
সরলার্থ—পুরুষের বিচিত্র জন্ম ও সুখ দুঃখের বিচিত্র ভেদ প্রত্যক্ষ করিয়া জীবাত্মারূপ পুরুষ যে বহু তাহার কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না।
এতেই স্পষ্ট হয় যে, সাংখ্যতেও জীবাত্মা এবং ঈশ্বরের মধ্যে ভেদ দেখানো হয়েছে। কারন, ঈশ্বরতো আর বহু হতে পারেন না। অর্থাৎ ঈশ্বরসিদ্ধ সূত্রগুলো আসলেই ঈশ্বরকেই সিদ্ধ করে, তা প্রমাণিত।
আরো দেখি,
পূর্বের সূত্রের সর্বকর্ত্তা প্রসঙ্গে আরো বলেন,
ইদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা।।৩.৫৭।
সরলার্থ—যিনি সর্বব্যাপক অমূর্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, একরস, নিত্যমুক্ত আনন্দস্বরূপ তিনিই সৃষ্টিকর্তা হইতে পারেন। সৃষ্টির রচনাকৌশল ও পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়া বিচারের দ্বারা এইরূপ ঈশ্বরই সিদ্ধ হইয়া থাকে এবং বেদাদি শাস্ত্রে ও সর্বত্র এইরূপ ঈশ্বরেরই সিদ্ধি পাওয়া যায়।
বেদ অনুকূল কর্তব্য পালন করিলে যদি ফলসিদ্ধ হয় তবে কর্মফল দাতা "ঈশ্বর" মানিবার প্রয়ােজন কি ? না মানলেওতো চলে। এই শঙ্কায় বলেন,
ন ঈশ্বরাধিষ্ঠিতেফলনিষ্পত্তিঃ কর্মতৎসিদ্ধেঃ।। ৫.২।।
সরলার্থঃ- ঈশ্বরের অধিষ্টাতুত্বে জীবের কর্মফল ব্যবস্থা হইয়া থাকে। কর্ম জড় এবং তাহার ফলও জড়। বিচার করিয়া জন্ম জন্মান্তরের কর্ম সমূহের ক্রম পূর্বক ফলবিধান করিবার শক্তি কর্মের সয়ং থাকিতে পারে না এবং কর্মফলের উপর জীবাত্মারও কোন কর্তৃত্ত দেখা যায় না। ন্যায় অনুসারে সমূহ জীবের তানাদি আনন্ত কর্মের ফলবিধান সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক ও সমস্ত জীবের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধ রাখিবার শক্তিবিশিষ্ট পরমেশ্বর ভিন্ন আর কে করিতে সমর্থ ? কেহ নহে। সেই কারণ “কর্মফলদাতা' ঈশ্বর মানিতেই হইবে। অন্য কেউ নয়।
পৃথক ঈশ্বর না মেনে যদি জড় প্রাকৃতিক শক্তির যােগে চৈতন্যের উৎপত্তি অর্থাৎ এই কর্তৃত্ত ও অধিষ্টাতৃত্ব মানা যায় তাতে কি দোষ হয় ?
প্রধানশক্তিযােগাচ্চেৎসঙ্গাপত্তিঃ।। ৮
সরলার্থ-যদি জড় প্রাকৃতিক শক্তির সংযােগে চৈতন্যের উৎপত্তি অর্থাৎ কর্তৃত্ব ও অধিষ্ঠাতৃত্ব মানা যায় তা হলে কারণ ও কার্যের বিরােধ উপস্থিত হয়। জড় কারণ হতে চৈতন্যের উৎপত্তি হওয়া অসম্ভব। প্রাকৃতিক গুণপর্ব ব্যতীত চেতন ও অচেতন, ভােগ্য ও ভােক্তা, কর্ম ও কর্তা ইত্যাদি বিরুদ্ধ ধর্ম যাহা প্রত্যক্ষ হচ্ছে সে সমস্ত কিছুই দেখতে পাওয়া যেত না। সেই কারণ জড় ও চেতন আলাদা সত্ত্বার কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। জড় প্রকৃতিকে একমাত্র কারণ ধরে তার যােগে কর্তৃত্ত সিদ্ধ করলে কাৰ্য্য ও কারণের মধ্যে সঙ্গদোষ উৎপন্ন হয় অর্থাৎ কারণ ও কাৰ্য্য পৃথক থাকে না এবং প্রত্যক্ষেরও বাধা উপস্থিত হয়।
-জড় ছাড়িয়া দিয়া যদি চৈতন্যকেই জগতের একমাত্র সত্ত্বা ও কারণ ধরা যায় তাহাতে কি দোষ হয় ?
সত্তামাত্রাচ্চেৎসর্বৈশ্বর্য্যম্।। ৯
সরলার্থঃ- যদি চৈতন্যকে জগতের একমাত্র কারণ ধরা যায় তাহা হইলে কাৰ্য্য জগৎ সমস্তই চৈতন্যের ঐশ্বৰ্য্যযুক্ত অর্থাৎ চেতনময় হইত কিন্তু বস্তুতঃ তা হয় না । তাই, প্রকৃতি এবং চেতন উভয়েই জগতের মূল কারণ।
অর্থাৎ এখানে প্রকৃতি এ চেতন এর মধ্যে পার্থক্য এবং জগতের মূল কারণ সম্পর্কেও স্পষ্ট হয়েছে । সাথে আমরা আরো জানি, চেতন দুইয়ের মধ্যে আবার জীবাত্মা অল্পজ্ঞানী ও অবিদ্যাগ্রস্থ হওয়ার ধরুন, সৃষ্টিকর্ম তার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই, এই জগতের কর্তৃত্ত্বে এবং অধিষ্টাতৃত্বে একমাত্র ঈশ্বর ই আছে।
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে সাংখ্যে ঈশ্বরবাদ স্পষ্ট হয়, এটা প্রমাণিত । এখন যে সূত্র দ্বারা মানুষের মনে সন্দেহ প্রকাশ হয়, তার প্রকৃত অর্থ বিচার করা যাক,
সবচেয়ে যে সূত্রটি নিয়ে আলোচনা হয় তা হলো,
ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ।।১. ৯২।।
অর্থাৎ ঈশ্বর অসিদ্ধ। মানে সাংখ্য ঈশ্বরকে সিদ্ধ করে না বা মানে না।
তবে এর যথার্থ আলোচনায় বুঝা যাবে সূত্রটি আসলে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে অসিদ্ধ বলেছে।
সাংখ্যের ১.৮১-৮৬ পর্যন্ত কিভাবে জীবাত্মা মুক্তি পেতে পারে আর পেতে পারে না, তা নিয়ে শঙ্কার সমাধান দিয়েছেন। পরে ১.৮৭-৮৯ এ উক্ত আলোচনার( জীবাত্মা ক্ষেত্রে) সপক্ষে প্রমাণাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারপরই ১.৯০-৯১ এ যোগীগণের প্রত্যক্ষ প্রমাণাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হলোঃ- সাধারণ মনুষ্য ইন্দ্রিয় গোলকের সাহায্যে প্রত্যয় করছে এবং যােগিগণ সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ে সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকে।
কিন্তু ঈশ্বরের স্থুল এবং সূক্ষ্ম কোন ইন্দ্রিয় না থাকায় তাঁহার পক্ষে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ হওয়া সম্ভবপর নয়। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের এই বিষয়ে উনি অসিদ্ধ, আর এটা সূত্রগুলোকে ক্রমানুসারে পড়লে সহজে বুঝা যায় এবং ভ্রান্তি সহজে দূর হয়ে সন্দেহ দূর হবে।
এবার পুরো সূত্রটি অর্থসহ দেওয়া হল।
ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ। ৯২
সরলার্থ—ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ কোন দোষ ঘটতে পারে না। ঈশ্বরের পক্ষে এ দোষ অসিদ্ধ কারণ ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপক বলিয়া সকল পদার্থের মধ্যে ও বাহিরে ওতপ্রােত ভাবে ব্যাপক থাকিয়া সমস্ত পদার্থ সাক্ষাৎ সম্বন্ধের দ্বারা স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যক্ষ করে আছেন, কিন্তু জীবাত্মা একদেশী ও তার জ্ঞান সাধন সাপেক্ষ এবং যে পদার্থ প্রত্যক্ষ করিবে তাহও দূরে অবস্থিত বলিয়া তার সহিত সম্বন্ধ করবার জন্য তার সাধনের ইন্দ্রিয় গােলকাদির সাহায্য আবশ্যক হয়। ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ ও সর্বব্যাপক বলিয়া তাঁহার পদার্থ প্রত্যক্ষ করিবার জন্য কোন ইন্দ্রিয়াদির বা সাধনের তাপেক্ষা করে না এই কারণ ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে কোন দোষ ঘটিতে পারে না। যেমন জীবাত্মা হৃদয়ের মধ্যে অর্থাৎ সূক্ষ্মশরীরের মধ্যে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ করিয়া আছে বলিয়া বুদ্ধি ও অহঙ্কারাদিকে চালাইবার জন্য তাহার ইন্দ্রিয় গোলকের প্রয়ােজন হয় না স্বয়ং চালাইয়া থাকেন সেইরূপ ঈশ্বর ও প্রত্যেক পদার্থ ও প্রত্যেক জীবের মধ্যে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ করিয়া আছেন বলে তাহার প্রত্যক্ষের জন্য কোন সাধনের প্রয়ােজন হয় না। আর এই বিবেচনায় উক্ত বিষয়ে অসিদ্ধ বলেছে উক্ত সূত্রে।
কিন্তু অদ্বৈতভাষ্যকার ক্রমান্বয়ে বিবেচনা না করেই উক্ত সূত্রে ঈশ্বরকে অসিদ্ধ তথা সাংখ্যে ঈশ্বর অসিদ্ধ এভাবে প্রচার শুরু করেন যা একেবারেই যে অনুচিত তা আমরা সম্পূর্ণ আলোচনায় বুঝেছি।
সাংখ্য নিয়ে আরো শঙ্কা নিয়ে সামনে আরো আলোচনা চলবে______
ধন্যবাদ
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
বাংলাদেশ অগ্নিবীর।