হিন্দুদের জন্য শাস্ত্র সচেতনতা, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ঐক্য তিনটাই জরুরী। আর্য সমাজ বৈদিক শাস্ত্র প্রচারের জন্য বিখ্যাত হলেও, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ঐক্যের পিছনে এর অবদানের কথা অনেকেই জানে না। আজ হায়দারাবাদের মুক্তিতে আর্য সমাজের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজের অধীনে রাজা শাসিত ৫৬৬টি রাজ্য ছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল হায়দারাবাদ। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় রাজা শাসিত রাজ্যগুলোর প্রায় সব ক’টি ভারতের অংশ হতে রাজি হয়। কিন্তু বেঁকে বসে নিজাম শাসিত হায়দারাবাদ। রাজ্যটি নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
৮২ হাজার ৬৯৮ বর্গমাইলের হায়াদারাবাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, মুদ্রা, বিমানব্যবস্থা, রেলওয়ে, রেডিও, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী, রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ। সে রাজ্যে তখন হিন্দু ৯৩% আর মুসলিম ৭%। কিন্তু শাসক নিজাম মুসলিম ধর্ম্যালম্বি হওয়ায় হিন্দুদের উপর নেমে আসে অত্যাচার। যেমন সেনাবাহিনীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতি ছিল ৫ শতাংশ। ১৯৪৪ সালে হায়দারাবাদের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কাসেম রিজভীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘রাজাকার’ নামে একটি অনিয়মিত বাহিনী। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। এই রাজাকাররাই হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালায়।
১৮৯২ সালেই হায়দারাবাদে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালের ভিতর এক হায়দারাবাদেই ২৫০ টি শাখা খুলে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৩০ সালের দিকে রাজ্যে হিন্দুদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে আন্দোলনে নামে আর্য সমাজ। এর সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ দেয় হিন্দু মহাসভা। আর্য সমাজের এই আন্দোলনের ফলে হিন্দুদের ভিতর চেতনা জাগ্রত হয়। নিজামের স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে হিন্দু জনতা সচেতন হতে শুরু করে। নিজাম সরকার মাসুফা এবং গায়ের মাসুফা নামের দুইটি ফরমান জারি করে। প্রথম ফরমানে নও মুসলিমদের সম্পত্তি ভোগের অধিকার দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ফরমানে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করার অধিকার দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আর্য সমাজ আন্দোলন চালাতে থাকে। নিজামের আদেশ উপেক্ষা করে আর্য সমাজ বিজয়া দশমীর দিন ওম খচিত পতাকা নিয়ে মিছিল করে।
আর্য সমাজের একটি আন্দোলন আছে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন। এখানে অন্য ধর্ম্যালম্বিদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা হয়। নিজাম নবহিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। যেমন বেদ প্রকাশ নামের একজন নওমুসলিমকে আর্য সমাজে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনে। তাঁকে ১৯৩৮ সালে নিজামের পাণ্ডারা হত্যা করে। নিজামের এই রাজাকারবাহিনির অত্যাচার প্রতিরোধ করতে আর্য সমাজ হিন্দুদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। একই সাথে আর্য সমাজ প্রকাশ্যে যারা হিন্দু ধর্মকে অবমাননা করে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে। যেমন ১৯৩০ এর দশকে সিদ্দিক দিনদার নামে একজন নিজেকে অবতার দাবি করে শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বলা শুরু করে। আর্য সমাজ প্রকাশ্যে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে। রামচন্দ্র দাহাল্ভি আর মঙ্গলা দেবীর মত বক্তার সামনে সিদ্দিক দিনদার পলায়ন করতে বাধ্য হয়। রামচন্দ্র দাহাল্ভির বক্তব্যকে অনেক প্রগতিশীল মুসলিম সমর্থন দেন। ১৯৩৭ সালে নিজাম আর্য সমাজের কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি আর্য সমাজকে হায়দারাবাদ দিবস পালন করে নির্দেশ দেন। যখন নিজাম আর্য সমাজ এর দাবি মানলেন না তখন ১৯৩৮ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে সত্যাগ্রহ পালন শুরু করে। পুলিশি বাঁধা উপেক্ষা করে ১৯৪২ সালে পণ্ডিত বিনোদ রায় বিদ্যালংকার বার্ষিক সম্মেলন শুরু করেন। সেখানে হিন্দুদের নিজামের অত্যাচারের বিপক্ষে সচেতন করা হয়। ১৯৪৩ সালে গণপতি কৃষ্ণ শাস্ত্রী বার্ষিক সম্মেলন করেন। নিজামের অত্যাচারে অনেক আর্য সমাজী নিহত হন। কিন্তু তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। বেদ প্রকাশ, কৃষ্ণ প্রকাশজী, বিষ্ণু ভগবানজী, শিবচন্দ্রজীসহ অনেক আর্য সমাজী মুক্তির মন্দিরের বেদিমূলে নিজেদের উৎসর্গ করেন। ১৯৪২ এর বাঁচো কিংবা মরো আন্দোলন, ১৯৪৬ এর ভারত ইউনিয়নে যোগদানের আন্দোলন, ১৯৪৭-৪৮ এর সীমান্ত আন্দোলন আর্য সমাজের দ্বারা শুরু হয়। হায়দারাবাদের স্বদেশী আন্দোলনের ৭০% কর্মী আর্য সমাজী। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিন হায়দারাবাদের সেকান্দারাবাদ, গলিগুদা আর সুলতান বাজারে কংগ্রেসের কর্মী এবং আর্য সমাজী তেরঙ্গা উত্তোলন করে। পরে রাজাকাররা এসে অত্যাচার শুরু করে। এই একই মুভমেন্টের সময় সেখানে কমিউনিস্ট পার্টিও কৃষক বিদ্রোহ করে।
এইসব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে রাজাকাররা হিন্দু বাসিন্দাদের ওপর অত্যাচার করে। তারা নারী নির্যাতন করে, জমি দখল করে এবং পুরুষদের হত্যা করে। কয়েক লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু হয়। অবশেষে ভারত সরকার ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে হায়দারাবাদে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন পোলো। ১৩ সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দারাবাদ আক্রমণ করে। পাঁচদিনের যুদ্ধেই নিজাম বাহিনী পরাজিত হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পন করেন হায়দারাবাদের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল এল ইদরুস। হায়দারাবাদে উঠে তেরঙ্গা পতাকা। গণহত্যা আর জাতিগত নির্মূলকরণের হাত থেকে রক্ষা পায় সেখানকার হিন্দুরা।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
বেশ তথ্যসমৃদ্ধ।
ReplyDelete🕉️ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্
ReplyDelete