দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







মহাকালের গল্পে গল্পে মানব বিবর্তনের ইতিহাস; পর্ব ৩

Arindam
10


 সেদিন ১৯৩৮ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর। দক্ষিণ আফ্রিকার চালুমনা নদীতে ট্রলার চালিয়ে মাছ ধরছেন Hendrik Goosen। মাছ ধরতে গিয়ে খুব অদ্ভুৎ এক মাছ জালে ধরা পড়ল।চারটি মাংসল ধরনের অস্থিযুক্ত পাখার ন্যায় রয়েছে মাছটির,যেন হাত পায়ের মতন!সাধারণত দেখবেন মাছের পাখনায় কিন্তু কোন হাড্ডি বা অস্থি থাকেনা,যা এই মাছটির রয়েছে!এই Goosen সাহেবের বন্ধু আবার দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লণ্ডন জাদুঘরের একজন কিউরেটর, তার নাম Marjorie Letimer.অদ্ভুৎদর্শন মাছটি দেখে সাথে সাথে Marjorie কে নিয়ে এসে দেখালেন মাছটি।কিন্তু মাছটিকে দেখে অবাক হলেও পরিচিত কোন মাছের সাথে মিল খুঁজে পেলেন না Marjorie। তাই নিরুপায় হয়ে জীবতত্ত্ববিদ বন্ধুবর প্রফেসর স্মিথের শরণাপন্ন হলেন।দেখামাত্রই প্রফেসর স্মিথ চিনে ফেললেন মাছটির পরিচয় এবং বিস্মিত হলেন।কেন বিস্মিত হলেন?এই মাছটি কি ছিল তা কি জানেন? জানলে আপনিও বিস্মিত হবেন।


গত পর্বে আমরা দেখেছি কিভাবে Ichthyostega নামক Tetrapod (চতুষ্পদী) মাছ তথা জলজ প্রাণীটি ডাঙ্গায় উঠে এল প্রথমবারের মত। আর কেই বা জানত এই চারপেয়ে মাছের মত প্রজাতি Ichthyostega  এর কোটি কোটি প্রজন্মের পরবর্তী প্রজন্ম হবে মানুষ নামক প্রজাতিটি! মাছের একসময়ের পরিণতি হবে মানুষ এ তো ভাবাও অসাধ্য!

Ichthyostega হল মাংসল,অস্থিযুুুুক্তক্ক(অনেকটা হাত পায়ের মত) চারটি পাখনাযুক্ত মাছের ন্যায় প্রজাতি,সেই চারটি মাংসল পাখনার বিবর্তনগতরূপ ই আজকের আমাদের এই হাত পা।১৯৩৮ সালে প্রফেসর স্মিথ যে মাছটি দেখে অবাক হয়েছিলেন সেই মাছটি ছিল ওই Ichthyostega এর ই এক বংশধর! অবাক না হয়ে উপায় আছে বলুন! প্রায় ৩৭ কোটি বছর আগের ডেভোনিয়ান যুগের একটি প্রজাতির বংশধর খুঁজে বের করে ফেলেছেন এক জেলে আর এক কিউরেটর মিলে এই বিংশ শতাব্দীতে! চালুমনায় ঘটে যাওয়া Marjarie Letimer এর স্মরণে এই মাছের নাম রাখা হল Latimeria Chalumnae!

Latimeria Chalumnae


এই মাংসল ও অস্থিযুক্ত পাখনাওয়ালা মাছের পরিবারসমগ্রকে বলা হয় Sarcopterygii বা Lobe Finned Fish যার মাত্র দুইটি প্রজাতি আজ জগতে অবশিষ্ট আছে।


তারা হল-

Latimeria Chalumnae যাকে বলা হয়, African Coelacanth,যার গল্প এতক্ষণ আপনাদের বললাম।

আর আরেকটি হল Indonesian Coelacanth,এটি আবিস্কারের ঘটনাটিও মজার।১৯৯৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রে হানিমুনে বেড়াতে যাওয়া এক দম্পতি আবিস্কার করেন এই প্রজাতিটি।

অপরদিকে Ichthyostega প্রজাতির মধ্যে জলের মৎস্যপ্রজাতি ও ডাঙ্গার চতুর্পদী উভয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল বলে এদের বলা হত Crossopterygii(দুই বৈশিষ্ট্যের ই ক্রস বা মিশ্রণ আছে তাই)।

বাকী সকল মাছ,অর্থাৎ ৯৯% মাছ ই এসেছে Ray Finned Fish বা পাতলা পাখনাওয়ালা,অস্থিহীন আদি মৎস্য প্রজাতি থেকে যাদের বলা হয় Actinopterygii.

Ray Finned বনাম Lobe Finned


আবার আগের গল্পে ফিরে আসি। Ichthyostega উঠে এল ডাঙ্গায়,রোদের তাপে তার গায়ের চামড়া শক্ত ও পুরু হতে লাগল,আঙ্গুলের চামড়া মাটির ঘর্ষণে আর তাপে শক্ত হয়ে হতে সৃষ্টি হতে লাগল শক্ত থাবার।Ichthyostega এভাবে ক্রমে ক্রমে পরিণত হল এক নতুন প্রজাতিতে,তার নাম Casineria.

Casineria


কিন্তু ভেজালটা হল অন্যখানে।আগে তারা থাকত পানিতে,পাড়ত ডিম,বাইরে চলে আসা সেই ডিমকে নিষিক্ত করত পুরুষরা।কিন্তু এখন তো নিবাস ডাঙ্গায়,সূর্যের তাপে আগের মত শক্ত আবরণহীন ডিম বাইরে থাকলে হয়ে যাচ্ছে শুষ্ক,নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অংকুরেই।এখন কি করণীয়?তাই সেই ডিমের চারপাশে তৈরী হল কঠিন আবরণ।আজও মানুষের বাচ্চা জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া যারা দেখেছেন তারা দেখবেন সদ্যোজাত শিশুটি মায়ের পেটে একটি কয়েকস্তরবিশিষ্ট আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে আছে যার নাম Amnion যার উল্লেখ প্রাচীন  সংস্কৃত গ্রন্থ গর্ভোপনিষদ ও ভগবদগীতায়(৩.৩৮) পাওয়া যায়।আমরা দেখতে পাচ্ছি আজ থেকে ৩৪ কোটি বছর পূর্বে Casineria নামক প্রজাতিটিতে নিজেদের ডিমের ভিতরের তরল অংশকে  সূর্যের তাপ থেকে শুকিয়ে যাওয়া হতে রক্ষা করার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছিল এই Amnion নামক আবরণের।

Amnion যুক্ত ডিমের লেয়ারসমূহ


কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছেন কি? পূর্বের জলজ জীবনে Casineria এর পূর্বপুরুষ Ichthyostega পানিতে ডিম পাড়ার পর আবরণহীন সেই ডিমকে পুরুষ Ichthyostega নিষিক্ত করত।কিন্তু এখন তো ডিম পাড়ার পর ডিমের চারপাশে শক্ত আবরণ আর এই শক্ত আবরণকে ভেদ করে তো আর নিষিক্তকরণ সম্ভব নয়! তখন প্রজাতির সংরক্ষণে,বেঁচে থাকার তাগিদে তারা ডিমকে শরীরের ভেতরেই নিষিক্ত করার এক পদ্ধতি খুঁজে বের করল।সেই পদ্ধতির নাম কি বলুন তো? Sex বা যৌনমিলন!


এখন আর বাইরে নয়,স্ত্রী প্রাণীর শরীরের ভিতরেই পুরুষ প্রাণীটি ডিমকে শক্ত আবরণে আবৃত্ত হয়ে যাবার আগেই নিষিক্ত করতে সক্ষম।এভাবেই আবিস্কৃত হয়েছিল যৌনমিলন পদ্ধতির।আর এভাবেই স্ত্রী ও পুরুষ বীজের মিলনে লক্ষ লক্ষ গুণে বেড়ে গেল জীনের আদান প্রদান ও মিউটেশনের হার,সৃষ্টি হতে লাগল অসংখ্য নতুন নতুন প্রজাতি।আর প্রথম এই Amnion নামক পর্দার কারণেই Casineria কে বলা হয় Earliest Aminotes.এই Aminote দের থেকেই একসময়  স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও পাখিদের সৃষ্টি হয়।এদের মোটাদাগে দুইটি ভাগ-


১)Synapsids-বাচ্চা দেয় যারা,মাথার খুলির দুইপাশে,কানের উপরে  দুইটি ছিদ্র আছে এদের যাকে বলে Bilateral Temporal Openingএই শাখা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে স্তন্যপায়ীদের।উদাহরণ -মানুষ।

 ২)Sauropsids-ডিম পারে যারা, এদের মূলত দুইটি ভাগ-পাখি ও সরীসৃপ।


Synapsida&Sauropsida



Lobe Finned জলজ প্রাণীদের হতে আসা Ichthyostega(Tetrapod) থেকে Casineria(Amniote) হয় আর তার Synapsid শাখার মাধ্যমে এক পর্যায়ে Thrapsid শাখার আবির্ভাব যা হতে সৃষ্ট Cynodont নামক উপশাখায় মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী এসেছে 



সেই Cynodont শাখার Theria উপশাখা হতেই এসেছে মানুষসহ আমাদের পরিচিত সব স্তন্যপায়ী প্রাণী,এরমধ্যে আমরাসহ গরু,ছাগল এরা হলাম Eutheria শাখা,ক্যাঙ্গারু আর কোয়ালারা হল Metatheria শাখা(যারা পেটের সামনের থলিতে বাচ্চা রাখে)

Casineria(Amniote) কিন্তু একা নয়,কোটি কোটি বছর পেরিয়ে গেছে,এতদিনে ডাঙ্গায় সৃষ্টি হয়ে গেছে অনেক নতুন নতুন প্রজাতি।খাদ্যের জন্যে চলছে অবিরত প্রতিযোগিতা।চাবানোর জন্য চাই শক্ত চোয়াল।দীর্ঘ কোটি বছর পারি দিতে দিতে Casineria একসময় রূপান্তরিত হতে হতে হল Varanops নামক মজবুত চোয়ালের মাংসপেশীযুক্ত প্রজাতিতে,আজ হতে প্রায় ২৭ কোটি বছর আগের কথা তা।

Museum Of Natural History,USA তে সংরক্ষিত Varanops এর কংকাল,২৭.২৯ কোটি বছরের প্রাচীন

 

এভাবে চলতে চলতে সময় এল মহাপ্রলয়ের।আজ হতে প্রায় ২৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগ সংগঠিত হল যা পারমিয়ান গণবিলুপ্তি(The Great Permian Extinction) নামে খ্যাত, পৃথিবীতে নেমে এল যেন নরক।সাইবেরিয়ায় শুরু হওয়া মারাত্মক অগ্ন্যুৎপাত গরম লাভা ছড়িয়ে দেয় পশ্চিম ইউরোপের আয়তনের সমান অঞ্চলে।লক্ষ লক্ষ জায়গায় অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে।বায়ু হয়ে উঠে অত্যন্ত উত্তপ্ত,দূষিত গ্যাসে পরিপূর্ণ,ব্যাহত হয় মহাসাগরের স্রোত,ক্ষতিকারক জীবাণুতে ভরে উঠে জলরাশি।সারা পৃথিবীতে জলরাশিির ৯৬% প্রজাতির ও স্থলের ৭০% প্রজাতির ই মৃত্যু হয়।একটাবার ভেবে দেখুন, যথাক্রমে ৯৬ শতাংশ ও ৭০ শতাংংশ প্রাণীই মারা গেল,কি বিশাল ছিল তাহলে সেই অগ্ন্যুৎপাত! দ্যা গ্রেট ডায়িং বা মহামৃত্যু নামে পরিচিত এই গণবিলুপ্তিতে যে অল্প কিছু প্রজাতি টিকে গিয়েছিল তাদের মধ্যে মূলত দুটি প্রজাতির বংশধররাই পরবর্তী ১৮ কোটি বছর(Mesozoic Era) ধরে দাপিয়ে চলেছিল বিশ্ব।সেই দুইটি প্রজাতি যাদের একদম সহজ ভাষায় আজ আমরা বলি ডায়নোসর(যার শাখা প্রশাখা থেকে পরবর্তীতে পাখি,কুমির,সরীসৃপ ইত্যাদির তৈরী)  এবং স্তন্যপায়ী(যাদের শাখাপ্রশাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের)।তাহলে পরবর্তী ১৮ কোটি বছর ধরে আমরা দেখব ডায়নোসরের দাপট আর দেখব কিভাবে ডায়নোসরের রাজত্বে টিকে থেকেছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা।

The Great Permian Extinction 


গণবিলুপ্তির পর শুরু হয়েছে নতুন যুগের,জীবন থেমে থাকেনা।দূর্যোগের পর নতুনভাবে সবকিছুকে গুছিয়ে নিতে লাগল প্রকৃতি।বেঁচে যাওয়া মাত্র ভাগ্যবান প্রজাতিগুলোর একটি আমাদের পূর্বপুরুষ,আর আরেকটি ডায়নোসর।গত কয়েক লক্ষ বছর ধরে চলেছে মহাদূর্যোগ।খাদ্যের খুব অভাব।তার উপরে জুটেছে সর্বভূক বিকটাকার ডায়নোসরদের জ্বালা।খাবারের অভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শরীর হয়ে পড়ল একদম ছোট্ট,দূর্বল।কিন্তু এটাই ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের জাদু।খাবারের অভাবে আমরা ছোট হয়ে পড়লাম ঠিকই,তখন আমাদের আকার একটি লোমযুক্ত ছোট বেড়ালের মত,তার নাম Actinion.কিন্তু এই ছোট হয়ে পড়াটা আমাদের একটা সুবিধা করে দিল,তা হল ডায়নোসররা আমাদেরকে আমাদের ছোট আকৃতির জন্য সহজে দেখতে পেতনা,তাই আমরা শিকারে পরিণত হতে লাগলাম অনেক কম।অর্থাৎ বিপদে পড়ে আমরা আকারে ছোট হলেও সেই ছোট আকার ই  উল্টো আমাদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য নির্বাচিত করল,এটাই ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব (Natural Selection Theory)।

অধিকতর নিরাপত্তার জন্য আমরা নিশাচর প্রাণীতে পরিণত হলাম,রাতের শীতল পরিবেশে আমাদের লোমকূপের মাংসপেশীগুলো সংকুচিত হত,এতে আমাদের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যেত এবং আমাদের বদ্ধ লোমকূপের গোড়ার মাধ্যমে শরীরে তাপ সংরক্ষিত থাকত,এই সামান্য জিনিসটি আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে আমাদের আদিপুরুষ সেই ছোট বেড়ালের মত প্রজাতিটিকে শীতের কবল থেকে বেঁচে থাকার এক বিশাল সহায়তা প্রদান করেছিল আর আমাদের পূর্বপুরুষ সেই প্রাণীগুলোর এই বৈশিষ্ট্য আজও আমাদের শরীরে রয়ে গেছে।শীত এলে বা ভয় অথবা উত্তেজনায় যখন আমাদের শরীরে শক্তির দরকার হয় তখন লোমকূপের এই সংকোচন বা গায়ের লোম খাড়া হবার (Pilorection) মাধ্যমেই আমরা আমাদের ২০ কোটি বছর আগের ছোট্ট বেড়াল আকৃতির পূর্বপুরুষদের মত তাপশক্তি সংরক্ষণ করি।


শিকারী কখন আসছে,কখন, কোথায়, কিভাবে বের হতে হবে সন্তর্পণে, বিপদ আসলে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে এইসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতে আমাদের মস্তিস্কে নতুন একটি অংশের সৃষ্টি হল যা জটিল চিন্তা,পরিস্থিতির অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করে,তার নাম  Neocortex.বর্তমানে মানুুষের মস্তিস্কের সবচেয়ে বড় অংশ এই Neocortex.

স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিস্ক


ডায়নোসরের ভয়ে আকারে ছোট হয়ে হয়েও এভাবে আমরা টিকে থাকতে লাগলাম। Juramaia Sinensis(Eutheria শাখা) নামক প্রজাতিতে রূপান্তরিত আমরা আজ থেকে ১৫ কোটি বছর আগে Jurassic Age যুগে ডায়নোসরদের থেকে নিজেদের প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।আজকের যে Jurassic নামটা আমাদের কাছে হলিউডের চলচিত্র মাত্র আজ থেকে ১৫ কোটি বছর আগে Jurassic যুগের Dinosaur রা পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছিল ত্রাসের।এই Juramaia Sinensis প্রজাতিটির অনেক ধাপ পর হতেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে সকল Placental Mammals দের(যেমন আমরা)যাদের জীবনধারণ হত পোকামাকড় খেয়ে(Insectivores,চাইনিজদের আর কি দোষ বলুন,আমাদের আদি প্রজাতির একটি একসময় পোকামাকড় খেতই!)

Juramaia Sinensis



৬.৬ কোটি বছর আগে আমরা হয়ে উঠলাম Megazostrodon নামের এক শুকনা পাতলা ইঁদুরের মত প্রাণী, যারা ডায়নোসর থেকে বাঁচার জন্য এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তারা এখন আর ডিম পারেনা,সরাসরি বাচ্চা দেয়,বাচ্চাদেরকে যেন বাইরে খেতে যেতে না হয় তাই তাদের ঘর্মগ্রন্থিগুলো খাবার সঞ্চয় করে রাখতে রাখতে অনেক বড় হয়ে উঠল,সেই ঘর্মগ্রন্থিই হল মায়ের স্তন।আর তখন তাদের নাম হল স্তন্যপায়ী।এই স্তন্যপায়ীদের ই বংশধর আজ আমরা মানুষ থেকে শুরু করে তিমি মাছ,কুকুর,বিড়াল,ইঁদুর সবাই।

একদিকে বিশাল বিশাল সব ডায়নোসরের ছড়াছড়ি,কেউ অন্য সব প্রাণীকে গিলে খাচ্ছে,মারাত্মক আক্রমণাত্মক,মাংসাশী(Spinosaurs,T-Rex),কোন ডায়নোসর আবার সাধু সন্ন্যাসী,কেবল গাছ লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে(Triceratop)।কোনটা আবার আকাশে উড়ছে আর ধরে ধরে খেয়ে ফেলছে খোদ মাটিতে চড়া ডায়নোসরদেরকেই(Pterosaur) !ভেবে দেখুন তো হলিউডের Jurassic Park চলচিত্রটি,আপনার চারপাশে দানবীয় শিকারি সব বিশালাকার প্রাণী, বিশাল বিশাল চোয়াল আর হিংস্র দাঁত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এদিকে আপনি পুঁচকে ইঁদুর আকৃতির Megazostrodon,ভবিষ্যৎ মানবজাতির অতীত নিদর্শন আপনি,একমাত্র আশা।বাঁচার লড়াইয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অহর্নিশ! এভাবেই চলতে লাগল ১৮ কোটি বছর! এই সময়ের  একটি অংশকে বলা হয় Jurassic যুগ যে নামটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে ডায়নোসরের ছবি।

ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর,আগ্রাসী শিকারী প্রাণী তথা মাংসাশী ডায়নোসর T-Rex

দেখতে বিশাল হলেও স্বভাবে নিরীহ,নিরামিষাশী ডায়নোসর Triceratop

উড়ন্ত শিকারী ডায়নোসর Pterosaur


প্রথম পর্ব থেকে এখন পর্যন্ত ক্রমে ক্রমে পাঠকগণ দেখতেই পাচ্ছেন কিভাবে আমরা আস্তে আস্তে প্রথমে জলজ মৎস্য Myllokunmingia ,তারপর স্থলজ চারপেয়ে প্রাণী Ichthyostega(Tetrapod), তারপর যৌনমিলনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করা Casineria(Amniote) , তারপর পারমিয়ান গণবিলুপ্তিকে পাশ কাটিয়ে বেড়াল আকৃতির ছোট Actinion থেকে আরও ক্ষুদ্র ইঁদুর আকৃতির Juramaia Sinensis(Eutheria) হলাম,আর এরপর জুরাসিক যুগ পেরিয়ে আজ থেকে ৬.৬ কোটি বছর আগে সবশেষে হলাম জগতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্তন্যপায়ী প্রাণী Megazostrodonআমরা এখন জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে রত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল রাজত্বের অধিকারী ডায়নোসরদের সাথে যারা গোটা পৃথিবী শাসন করেছিল প্রায় ১৮ কোটি বছর।কিন্তু কোথায় গেল এই ডায়নোসররা তাদের বিশাল সাম্রাজ্য ছেড়ে হারিয়ে?

আগামী পর্বেই আমরা পাব তার উত্তর, পৌঁছে যাব আমাদের আসল পরিচিত পর্যায়ে,আমরা দেখতে পাব ডায়নোসরদের হারিয়ে কিভাবে আমরা দুই হাত, দুই পা, দাড়িয়ে হেঁটে চলা চিরচেনা মানুষ রূপে পরিণত হতে লাগলাম।আজ এ পর্যন্তই থাক,দেখা হবে নতুন দিনের সূচনায়।


চলবে...

Post a Comment

10Comments
  1. দাদা পর্ব-৪ চাই,সবটা জানতে চাই।অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা নিবেন দাদা।

    ReplyDelete
  2. দাদা পর্ব-৪টা চাই দাদা।খুব তাড়াতাড়ি দিবেন দাদা।

    ReplyDelete
  3. Thanks for the informative post

    ReplyDelete
  4. খুব শীঘ্রই পর্ব-৪ চাই দাদা।

    ReplyDelete
  5. দাদা পর্ব ৪ চাই

    ReplyDelete
  6. দাদা পর্ব ৪ টা কোনদিন পাব?

    ReplyDelete
  7. পর্ব ৪ এর জন্য অপেক্ষায় আছি দাদা। ধন্যবাদ ��

    ReplyDelete
  8. এই বহুমুল্যবান জ্ঞানগর্ভে ভরা তথ্য জেনে সমৃদ্ধ হলাম। জীব সৃষ্টির এই তথ্যগুলো সত্যি সত্যিই অতুলনীয় ।

    ReplyDelete
Post a Comment