দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







পহেলা বৈশাখ;১৪ ই এপ্রিল নাকি ১৫ ই এপ্রিল?

Arindam
1





ধরুন সমগ্র উত্তর গোলার্ধের সব দেশের মানুষরা মিলে জাতিসংঘে স্বিদ্ধান্ত নিল আমরা সব দেশ একসাথে একটা উৎসব পালন করব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আর তা হল বাসন্ত বিষুব(মহা বিষুব)।বাসন্ত বিষুব হল এমন একটি দিন যেদিন পৃথিবী তার অক্ষের ওপরে একেবারে সোজা হয়ে অবস্থান করে এবং তার ফলে সূর্যরশ্মি বিষুবরেখার ওপরে লম্বভাবে এসে পড়ে।এরকম সারাবছরে দুইটি দিন থাকে যেদিন বিষুব রেখার উপর সূর্যরশ্মি একদম লম্বভাবে পতিত হয় দেখে সেদিন  দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য প্রায় সমান সমান হয়।এই দুটি দিন হল ২৩ শে সেপ্টেম্বর ও ২০ শে মার্চ।আমরা উত্তর গোলার্ধের মানুষেরা ২৩ শে সেপ্টেম্বরকে শারদ বিষুব ও ২০ শে মার্চকে বাসন্ত বিষুব বলি।

Equator বা বিষুব রেখার সাথে সূর্য লম্বালম্বিভাবে অবস্থান নেয়ায় এবং পৃথিবী সারাবছরের মত কাত না হয়ে সোজাসুজি থাকায় দিন ও রাত সমান হয় বছরের ২ দিন


এই দিন পৃথিবী একদম ঠিক সূর্যের নিচ বরাবর থাকে।কিন্তু এখন সেটা কোনদিন পালন করা হবে?পৃথিবী যেদিন আবর্তন করতে করতে ঠিক সূর্যের নিচে আসবে( Subsolar Point) সেটা দেখা গেছে ১৯,২০ বা ২১ শে মার্চ এই ৩ দিনের যে কোন একদিন ই হতে পারে,আবার ধরুন ২০ শে মার্চ হল সেটাও কোন বছর সকালে আবার কোন বছর রাতে হতে পারে।তাহলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে কিভাবে সাড়া বিশ্ব মিলে প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সেই মহাবিষুব উৎসব পালন করবে?উত্তর হল সঠিকভাবে সূর্যের নিচে ঠিক যখন পৃথিবী অবস্থা করবে সেই অনুযায়ী কোনভাবেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে পালন করা সম্ভব নয় কারন এতে দেয়া থাকেনা পৃথিবীর অবস্থান কখন কোথায়।এটা মানুষ কর্তৃক স্থির করে দেয়া একটি সুবিধাজনক বর্ষপঞ্জি,এখানে সায়েন্টিফিক একুরেসির কোন স্থান নেই।আর যদি এমন কোন বর্ষপঞ্জি খুঁজতে যাওয়া হয় যেটা অনুযায়ী পুরো বিশ্ব একদম ঠিক সময়ে প্রতিবছর এই উৎসব পালন করতে পারবে তাহলে তা হল বৈদিক বর্ষপঞ্জি।

বসন্ত বিষুব হতে পারে ১৯/২০/২১ মার্চের যে কোন একদিন



শুরুতেই জানা দরকার বাংলা দিনপঞ্জিকা আসলে কি বা এটি তৈরীর ভিত্তিটা কি?

প্রতিটি দিনপঞ্জিকা তৈরী হয় কিছু বিশেষ ভিত্তিতে। ভিত্তিগুলোকে এভাবে ভাগ করা যায়-

১)চান্দ্র

২)চান্দ্র-সৌর 

৩)সৌর


যেমন হিজরী ক্যালেন্ডার হল এমন একটি ক্যালেন্ডার যেটি ১২ টি চান্দ্র মাসের সমন্বয়ে গঠিত। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিন করতে ২৯.৫৩ দিন সময় নেয় তাই এক চান্দ্রমাস=২৯.৫৩ দিন তাই এক হিজরী বছর হচ্ছে ১২ চান্দ্রমাস=৩৫৪.৩৬ দিন। অর্থাত্‍ এটি একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকা। এর সাথে সূর্যের গতি বা অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। এটি বর্তমানে আরবদেশসমূহে শুধুমাত্র ধর্মীয় কার্যে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যেহেতু একবছর=৩৬৫ দিন অর্থাৎ পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে পুরোটা ঘুরে আসতে ৩৬৫ দিন সময় লাগে সেহেতু এই ক্যালেন্ডারে প্রায় ১১ দিন তা থেকে কম হয়ে যায়। ফলস্বরুপ হিজরী ক্যালেন্ডার এর সাথে ঋতুসমূহের যে আবর্তন তা পুরোপুরি মেলেনা কেননা ঋতুসমূহের পরিবর্তন ঘটার পেছনে পৃথিবীর কোন অংশে সূর্য কতটা কাছে বা কতটা দূরে তার সম্পর্ক রয়েছে।এই পরিবর্তনগুলো ৩৬৫ দিন জুড়ে হয়।অপরদিকে হিজরি ক্যালেন্ডার সূর্যের অবস্থানের তথা ঘূর্ণন গতির হিসেব অনুযায়ী তৈরীকৃত নয়,এটি চন্দ্রের ঘূর্ণন গতির অনুযায়ী তৈরীকৃত যা ৩৫৪.৩৬ দিন।তাই এটি অনুযায়ী ঋতু পরিবর্তন হয়না,ঋতুবছর বা ৩৬৫ দিন যাকে আমরা বলি সৌর ফসলী বর্ষপঞ্জিকা তা হতে এই হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকার গরমিল হয় ১১ দিন। অর্থাৎ ধর্মীয় উৎসবাদি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী করা গেলেও ঋতুগত উৎসবাদি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকা দিয়ে হুবহু পালন করা সম্ভব নয়।আগে দেয়া উদাহরণের বাসন্ত উৎসবের মতই তাতে ১ থেকে ৩ দিন পর্যন্ত বেশকম হয়ে যাবে বছরভেদে। আর এই ব্যপারটিতেই নিহিত পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস। তবে তাতে একটু পরে 

আসছি।


আরো আছে সৌর দিনপঞ্জিকা অর্থাত্‍ সূর্যের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর অবস্থান অনুসারে যে দিনপঞ্জিকা তৈরী করা হয় যেমন গ্রেগরিয়ান বা ইরানিয়ান দিনপঞ্জিকা। এই ধরনটাই বর্তমান যুগে অফিসিয়াল কাজের জন্য সমধিক প্রচলিত কেননা এর কোন বিশেষ দিন ঠিক করার বা ফসল উৎপাদনের বা আবহাওয়া নির্ণয়ের তাগিদ নেই। পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের জন্য প্রয়োজনীয় ৩৬৫.২৫ দিনকে ৩৬৫ টি ভাগে ভাগ করে এই ক্যালেন্ডারটিকে তৈরী হয়। বাকী ০.২৫ দিনকে ব্যলেন্স করার জন্য প্রতি ৪ বছর পরপর(০.২৫*৪=১) দিন ফেব্রুয়ারী মাসে অতিরিক্ত যোগ করা হয়।অর্থাৎ সৌর বর্ষপঞ্জিকা হলেও এটা শতভাগ ফসলী নয় কেননা এটি ধ্রুব,প্রতিবছর সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যেকার যে কৌণিক পরিবর্তন তা এটি বিবেচনায় না নিয়ে একটি সুবিধাজনক ফিক্স করা দেয়া ধ্রুব দিনপঞ্জিকা।তাই এতে একটি নির্দিষ্ট দিবস প্রতিবছর ই ওই নির্দিষ্ট দিনেই পালিত হয়,কৌণিক পরিবর্তনে যে দিবসটির পরিবর্তন হয় তা এতে আমলে নেবার সুযোগ নেই।


কিন্তু যদি এমন একটি দিনপঞ্জিকা আপনি বানাতে চান যেটা দিয়ে সঠিকভাবে বছর গণনার পাশাপাশি আপনি নির্দিষ্ট বা পবিত্র দিনসমূহ আগে থেকেই সনাক্ত করে রাখতে চান এবং সাথে সাথে ঋতুসমূহ ও নির্দিষ্ট ফসলের জন্য উপযুক্ত সময় এবং আবহাওয়া এর অবস্থাও জেনে রাখতে চান? সেক্ষেত্রে আপনাকে পৃথিবীর সাপেক্ষে চন্দ্র ও সূর্য উভয়ের তো বটেই এমনকি  নক্ষত্রসমূহের গতিপথ ও অবস্থানও বিবেচনা করেই দিনপঞ্জিকা বানাতে হবে । এবং পৃথিবীর সর্বপ্রথম এবং বিশদ চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা হল বৈদিক হিন্দু বর্ষপঞ্জিকা যার প্রভাব তখনকার যুগে চীন,গ্রীস এবং ইসলামপূর্ব আরবেও ব্যপ্ত ছিল।


কিভাবে তৈরী করা হয় এই ক্যালেন্ডারটি? আমরা সকলের জানি যে চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ  করে আবার পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে এবং সূর্যও তার নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।সূর্যের চারপাশে পৃথিবী যে উপবৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করে এই উপবৃত্তাকার পথকে বলা হয় ক্রান্তিবৃত্ত বা অয়নবৃত্ত।এই পরিভ্রমণ পথের মধ্যে মোট ২৮টি নক্ষত্র রয়েছে।প্রতিটি নক্ষত্রের ব্যাসার্ধকে চাঁদ তার গতিপথ বরাবর প্রায় একদিনে(একদিনের কিছু কম সময়ে) পরিভ্রমণ করে। এই ২৮টি নক্ষত্রকে পরিভ্রমণ করতে চাঁদের মোট ২৭.৩২ দিন সময় লাগে অর্থাৎ প্রতিটি নক্ষত্রের মেয়াদ প্রায় ১ দিন।এই ২৭.৩২ দিনের সময়টিকে বলে এক চান্দ্রমাস। প্রতিটি নক্ষত্রের পরিধিকে আবার সমান চারভাগে ভাগ করা হয় যার প্রত্যেকটিকে একটি করে পদ বলা হয়। এই আটাশটি নক্ষত্রের নাম প্রথম পাওয়া যায় পবিত্র অথর্ববেদের নক্ষত্র সূক্তে(১৯.৮)।

মাঝখানে পৃথিবী,চারদিকের কক্ষপথের ২৮ টি ভাগে অবস্থিত ২৮ টি নক্ষত্র





এখন আসি সূর্যের কাছে। পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে এই পরিভ্রমণ পথে যেমন ২৮টি নক্ষত্র দেখা যায় ঠিক তেমনি সূর্যের পরিভ্রমণ পথে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি অবস্থান বা বস্তু অবস্থিত। এদেরকে নবগ্রহ বলা হয়। এরা হল- "মঙ্গল,বুধ,বৃহস্পতি,শুক্র,শনি,রবি(সূর্য),সোম(চন্দ্র),রাহু,কেতু।" এখানে উল্লেখ্য যে রাহু এবং কেতু কি? এই দুইটি শব্দ আমরা হয়তো অনেকবার শুনেছি বিশেষ করে চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণের সময়।দুইটি বৃত্ত বা উপবৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করলে এরা দুইটি বিন্দুতে একে অপরকে ছেদ করে,একটি উপরের দিকে,আরেকটি নিচের দিকে।রাহু ও কেতু হল সেই দুটি বিন্দু যেখানে চন্দ্রের এবং সূর্যের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ পরস্পরকে ছেদ করে।ওই দুটি বিন্দুকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় যথাক্রমে এসেন্ডিং(আরোহী বিন্দু বা রাহু) এবং ডিসেন্ডিং(অবরোহী বিন্দু বা কেতু) সোলার নোডিউলস বলে। এই বিন্দুদ্বয়ে চন্দ্র ও সূর্য একত্রে অবস্থান করলে চন্দ্রের কারনে আমরা পৃথিবী থেকে সূর্যের আলো অথবা সূর্যের কারনে চাঁদকে দেখতে পাইনা অর্থাত্‍ চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয়। ভারতবর্ষীয় এ দিনপঞ্জিকার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হল যে এখানে একটি দিন শুরু হয় তখন ই যখন পৃথিবী ০.৯৮৬৩ ডিগ্রি পথ অতিক্রম করে,প্রতি ০.৯৮৬৩ ডিগ্রিতে ১ দিন হয়,এভাবে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে তার উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ৩৬০ ডিগ্রি পথ বছরে ৩৬৫ দিনে অতিক্রম করে অর্থাৎ প্রতি ১ দিনে ০.৯৮৬৩ ডিগ্রী (৩৬৫ দিন*০.৯৮৬৩ ডিগ্রী=৩৬০ ডিগ্রী)।এই ৩৬০ ডিগ্রি উপবৃত্তাকার পথকে মোট ১২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার প্রতিটা ভাগ ৩০ ডিগ্রি করে আর এই প্রতি ৩০ ডিগ্রি পথকে রাশি বলা হয়(মকর,কুম্ভ,ধনু,তুলা,বৃশ্চিক ইত্যাদি)। অপরদিকে ইংরেজী ক্যলেন্ডার এত বৈজ্ঞানিক হিসেবের মধ্যে দিয়ে যায় না,এটাকে নির্দিষ্ট  করে দেয়া হয়েছে যে মধ্যরাত ১২ টা বাজলেই তাকে দিনের শুরু বলে ধরা হয়। এখন তাহলে আমরা বৈদিক বর্ষপঞ্জিকায় একই সাথে চন্দ্র,সূর্য,নবগ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের সাথে পৃথিবীর তূলনামুলক অবস্থান জানতে পারি যা আর কোন বর্ষপঞ্জিকাতেই জানা সম্ভব নয়।


প্রতি ৩০ ডিগ্রী কক্ষপথে যা ১ মাসের সমান তার জন্য একটি করে রাশি,এভাবে ৩৬০ সম্পূর্ণ বৃত্ত বা ৩৬০ ডিগ্রী পথের জন্য(১২ মাস) ১২ টি রাশি


রাশিসমূহের ভারতীয় নাম



এইজন্য দেখা যায় যে হিন্দুদের পঞ্জিকায় আগে থেকেই গাণিতিক এই পদ্ধতিতে বিজয়া দশমী,ঈদ,বুদ্ধপূর্নিমা প্রভৃতির তারিখ অনেক আগে থেকেই বলে দেয়া থাকে,চাঁদ দেখা কমিটির অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়না।


একটা উদাহরন দেই। বাল্মীকি রামায়নের ১.৮.৮-১০ এ শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিনের বিবরন দেয়া আছে এভাবে-


১.রবি অশ্বিনীতে(Sun in aries) অর্থাত্‍ সেদিন সূর্য এবং অশ্বিনী বা Aries নামক নক্ষত্রটি একই সরলরেখায় অবস্থিত ছিল।

২.সোম বা চন্দ্র ছিল Pollux বা পূনর্বসু নামক নক্ষত্রের সাথে একই সরলরেখায়।

৩.শনি ছিল বিশাখা বা Librae নামক নক্ষত্রের সরলরেখায়।

৪.বুধগ্রহ ছিল রেবতী বা Pisces নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে।


অর্থাৎ নিখুঁতভাবে সেদিন সৌরজগতের কোন কোন গ্রহ,উপগ্রহ,নক্ষত্র কোন কোন অবস্থানে ছিল তার বর্ণনা দেয়া থাকায় বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই এই বর্ণনা দেখে বের করেছেন যে তারিখটি ছিল ১০ ই জানুয়ারী। অর্থাত্‍ চন্দ্র,সূর্য,গ্রহ ও নক্ষত্র প্রত্যেকটির অবস্থানেরই নিখুঁত বর্ণনা থাকায় এই চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সহজেই যেকোন দিন আগে থেকেই বের করে ফেলতে পারি। ধরুন আপনি যদি জানতে চান ২০৩০ সালে বিজয়া দশমী কয় তারিখ পড়বে বা ২০৩৫ সালে ঈদ উল আযহা কয় তারিখ তা জানার উদ্দেশ্যে আপনাকে চাঁদ দেখার জন্য বসে থাকতে হবেনা। আপনি সহজেই তা জেনে নিতে পারবেন চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা পদ্ধতির মাধ্যমে।


এক্ষনে কথা হল পহেলা বৈশাখ কখন? 


  প্রাচীন সূর্যস্বিদ্ধান্তীয় বর্ষপঞ্জিতে পৃথিবী যেইদিন Elliptic(উপবৃত্তাকার পরিভ্রমণ পথ) এ তুলা রাশির(Librae) এর ২০ ডিগ্রী অক্ষাংশ হতে বৃশ্চিক রাশি(Scoepion) এর ৩ ডিগ্রী ২০মিনিট অক্ষাংশে থাকবে তখন চন্দ্র বিশাখা  নামক নক্ষত্রের সাথে এক সরলরেখায় অবস্থান নেবে। আর সেই অবস্থানের প্রথম ক্ষণ থেকে নতুন বছর শুরু হবে। আর চন্দ্র বিশাখা নক্ষত্রের সরলরেখায় বলে নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী সেই চান্দ্র মাসের নাম হবে বৈশাখ মাস।কিন্তু বর্তমানে যেহেতু বসন্ত বিষুব(মার্চ মাসে) এর শুরুতে পৃথিবী তুলা রাশির (Librae) ৩০ ডিগ্রী এলাকায় নয় বরং মীন রাশির(Pisces) ৩০ ডিগ্রী এলাকায় অবস্থান করে(Precission of Equinox তথা মহাকর্ষ এর প্রভাবে কক্ষপথ বিচ্যুতি এর কারণে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে গেছে তাই) আর তার প্রথম মাস বিশাখা নয় বরং রেবতি নক্ষত্র অতিক্রম দ্বারা শেষ হয় তাই-


১)সূর্য Ecliptic(অয়নবৃত্ত) উপবৃত্তের মীন রাশির ৩০ ডিগ্রী এলাকা অতিক্রম করে মেষরাশির ৩০ ডিগ্রী এলাকাতে প্রবেশ করবে(অর্থাৎ মেষরাশির সূচনা হবে এজন্য পহেলা বৈশাখের আগে চৈত্রের শেষ দিনটিকে মেষসংক্রান্তি তথা চৈত্রসংক্রান্তিও বলা হয়) এবং

২)সূর্য মীন রাশির ৩০ ডিগ্রী এলাকা থেকে মেষ রাশির ৩০ ডিগ্রী প্রবেশের প্রাক্কালে চন্দ্র উপবৃত্তাকার কক্ষপথে যে নক্ষত্রটির সমান্তরালে ছিল সেই নক্ষত্রকে অতিক্রম করে যে মুহুর্তে নতুন নক্ষত্রের সমান্তরালে প্রবেশ করবে।

 ঠিক এই দুইটি ঘটনা যখন ঘটবে তখন ই কেবল নতুন বছরের(বৈশাখ মাসের) শুরু হবে যাকে আমরা পহেলা বৈশাখ বলছি।এই অতিক্রমটি হয়ে থাকে ১৪ ই এপ্রিল বিকাল বা রাত বা মধ্যরাতের পর(১৫ই এপ্রিল) যা উত্তর গোলার্ধে অবস্থানের কারণে গণনা করা হবে ১৫ ই এপ্রিল সূর্যোদয়ের সময় থেকে।


 অর্থাৎ  জ্যোতির্বিজ্ঞান ‍অনুযায়ী ই বৈশাখ মাসের শুরু তথা পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল , ১৪ এপ্রিল নয়। তাহলে বাংলাদেশে কেন তা ১৪ এপ্রিল পালন করা হচ্ছে?


আনুষ্ঠানিকভাবে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক প্রথম বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে লিপিবদ্ধ করান যদিও রাজা শালিবাহনের সময় থেকেই তা শকাব্দ নামে চালু হয়ে আসছিল। মোঘল শাসন শুরু হলে মোঘলরা তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় শশাঙ্কের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ না করে হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে দেশ চালাতে লাগলেন ।কিন্তু ওই যে আগেই বললাম,তারা এতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হলেন। কেননা হিজরী ক্যালেন্ডারের সাথে ঋতু, ফসল ফলনের দিনক্ষণ মেলেনা যার কারণে কর সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা সমস্যার শিকার হতে হয়।


এমতাবস্থায় মোঘল সম্রাট আকবর চান্দ্র হিজরি বর্ষপঞ্জির পরিবর্তে একধরনের সৌর বর্ষপঞ্জিকা চালু করেন যাকে ফসল উৎপাদনের সময় নির্দেশ করতে পারার গুণের কারনে "ফসলি সন" বলা হত পরবর্তীতে যা বঙ্গাব্দ বলে পরিচিত হয়। পাকিস্তান ভাগের পর এই ক্যালেন্ডারটিতে ভারতবিরোধীতার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা হিন্দুবিরোধী স্রোতের কারনে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করা হয়।


ব্রিটিশ রাজত্ব অবসানের পর ভারতে সারা দেশের জন্য একটি একই ধরনের পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বরে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ড.মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সরকারের কাছে মেঘনাদ সাহা কমিটির সুপারিশ ছিল— 

১. নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকার (Sidereal Calendar) পরিবর্তে ক্রান্তীয় পঞ্জিকা (Tropical Calendar) চালু করা,

২. বছরের শুরু বৈশাখের পরিবর্তে চৈত্র থেকে শুরু করা

৩. চৈত্র মাস ছয়/সাতদিন দেরি করে শুরু করা (Tropical Year),

৪. শকাব্দকে(প্রাচীন হিন্দু ক্যালেন্ডার) জাতীয় পঞ্জিকা ঘোষণা করা।


পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের জন্য অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করা হয়। শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ ছিল—

১. মোগলদের সময় থেকে চালু বাংলা পঞ্জিকাকে জাতীয় পঞ্জিকা করা।

২. বছরের হিসাব হিজরি বছরের গণনা হিসেবে গ্রহণ করা। 

৩. বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনের এবং পরের ৭ মাস ৩০ দিনের করা। 

৪. অধিবর্ষের (Leap year) জন্য চৈত্র মাসে একটি অতিরিক্ত দিন হিসাব করা।


মেঘনাদ সাহা কমিটির অন্য সব সুপারিশ ভারতীয় সরকার গ্রহণ করলেও নাক্ষত্রীয় ক্যালেন্ডার বাদ দেয়ার সুপারিশ ঐতিহ্যবিরোধী হওয়ায় পরে তা বাতিল হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা পঞ্জিকার ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে, তবে ১৪ এপ্রিল বছর শুরুর দিন এবং খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষের বছরে চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুন মাসে একদিন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।


এর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে দিয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আদলে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করিয়ে নেয় পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দেয়াল তৈরি করতে। পাকিস্তান আমলে সেটা সম্ভব না হলেও এরশাদ সেটা সফল করে দেন। বাংলা একাডেমিতে রক্ষিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সেই ক্যালেন্ডার এরশাদকে সাহায্য করে ‘পহেলা বৈশাখ’ পাল্টে দিতে। এ জন্য বাংলা একাডেমি কম দায়ী নয় এবং বাংলা একাডেমি এর দায় এড়াতে পারে না।


এরশাদের অপকর্মের ফলে এখন একদেশে দু’দিন বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। ১৪ এপ্রিল হয় সাড়ম্বরে, ১৫ এপ্রিল অনাড়ম্বরে। প্রশ্ন ওঠে, এরশাদ কি পারতেন ‘হিজরি ক্যালেন্ডারে’ হাত দিতে?


আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮। বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, ২১শে ফেব্রুয়ারি কিন্তু ৮ ই ফাল্গুন নয় বরং ৯ ই ফাল্গুন হয়! কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে গৃহীত হওয়ায় ৮ ফাল্গুন উদযাপনের কথাও আছে। আবার ঐতিহাসিক ১৬ ই ডিসেম্বর ছিল ১লা পৌষ,এরশাদের ভুতুরে ক্যালেন্ডারে এখন তা হয়ে গেল ২ রা পৌষ! বাংলাদেশের এই ভুতুরে পঞ্জিকাটি তাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বা পৃথিবীর অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলে গৃহীত হয়নি। সেখানে ঐতিহ্যবাহী বাংলা পঞ্জিকাই চলে। সেখানে ১৪ ই এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ ই এপ্রিল নববর্ষ উদযাপিত হয়। তাই বাংলা পঞ্জিকার ঐতিহ্য মেনে ১ লা বৈশাখ ১৪ ই এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ ই এপ্রিল করা এখনই দরকার। এর ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি ৮ ই ফাল্গুন হবে, দুই বাংলায় একই দিন নববর্ষ হবে,সবকিছু ফিরে আসবে সুন্দর সমীকরণে। আমাদের দেশের মেয়েরা ফাল্গুনের প্রথম দিনে শখ করে হলুদ শাড়ি পরে যে বসন্ত উৎসব করে, এ সংস্কারের ফলে ১ লা ফাল্গুন হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি, যা কিনা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’ও বটে!


এভাবে জোর করে বাংলা ক্যালেণ্ডার পরিবর্তন করাতে যখন ৮ ই ফাল্গুন ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে না পড়ে পড়ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি,১৬ ই ডিসেম্বর পহেলা পৌষ না হয়ে ২রা পৌষ হয়ে গিয়েছিল! রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী ২২ শে শ্রাবণের সাথে মিলছিল না,মিলছিল না নজরুল জন্মবার্ষিকীও!এভাবে যখন নানা গুরুত্বপূর্ণ দিবসে হেরফের হচ্ছিল তখন লজ্জাতে পড়ে যায় বাংলা একাডেমি।তাই ২০১৯ সালে তারা নিজেদের এই ভুল ঢাকতে আবার একদফা বাংলা ক্যালেন্ডারে চেঞ্জ করে এবং বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস ৩১ দিনে,ফাল্গুন মাস ব্যাতিত অন্য ৫ মাসকে ৩০ দিনে এবং ফাল্গুন মাসকে ২৯ দিনের ঘোষনা করে তারা।এরফলে অন্তত জোর করে হলেও ওই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখকে ঠিকমত আনতে সক্ষম হয় তারা।দেখা যাবে আগামীবছর আবার কোম গুরুত্বপূর্ণ তারিখ না মিললে আবারও পরিবর্তন করতে হবে এই মানুষের বানানো মনগড়া ক্যালেন্ডার!  এ যেন এক সার্কাস! 


যেখানে হাজার বছর ধরে বাঙ্গালীরা সূর্যের ০.৯৮৬৩ ডিগ্রি পথ অতিক্রমের সাথে সাথে ১ দিন অতিক্রান্ত হিসেব করছিল সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সেটিকে জোর করে পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট দিন ফিক্স করে দেয়া হল ইংরেজি ক্যালেন্ডার এর মত করে।ফলশ্রুতিতে ১৪ ই এপ্রিল রাতের আগ পর্যন্ত নক্ষত্র প্রবেশ না করা সত্ত্বেও  বাংলাদেশের হিন্দুদের দুবার এই পহেলা বৈশাখ পালন করতে হয়। একবার বাংলাদেশী/বাঙালী হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে নক্ষত্র প্রবেশের পরের সূর্যোদয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ১৫ ই এপ্রিল আরেকবার এরশাদীয় ইংলিশ ফ্যাশনের বাংলাদেশী হিসেবে হিসেবে নক্ষত্র প্রবেশের আগেই ১৪ তারিখ সকালে, যা প্রকৃতপক্ষে অন্যায়ভাবে,অবৈজ্ঞানিকভাবে এবং গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির নিয়মে তৈরী করা হয়েছে। অবশ্য কয়টা জাতি ই বা নববর্ষ দুদিন পালনের দূর্লভ সুযোগ পায়!


সবাইকে  পহেলা বৈশাখ এর শুভেচ্ছা!


প্রথম প্রকাশ ১৫ ই এপ্রিল,২০১৩

Post a Comment

1Comments
  1. বসন্ত বিষুব ২১ মার্চ না?

    ReplyDelete
Post a Comment