দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







অলৌকিক সমুদ্রসরণের আড়ালে লৌকিক রামসেতু

Arindam
0

 



তিনি মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র, হিন্দু হৃদয়সম্রাট। তিনি সমস্ত জগতের কাছে আদর্শ রাজার, আদর্শ পুত্রের, আদর্শ মানবের, আদর্শ স্বামীর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি ঘটনাই আজও, এত হাজার বছর পরেও প্রতিটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু সকল আগ্রহের মধ্যেও যে আগ্রহটি প্রায় সবার আগে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে জেগে উঠে তা হল কিভাবে শ্রীরামচন্দ্র পাড়ি দিয়েছিলেন সমুদ্র, কিভাবে তৈরী হয়েছিল ঐতিহাসিক রামসেতু। রামসেতু বলতে কি আদৌ কিছু ছিল? নাকি এটি নিতান্তই রূপকথা? এত সহস্র বছর আগে কি করে মানুষ সমুদ্র পাড় হয়েছিল!একটি বানরের পক্ষে কিভাবে এক লাফে উড়ে সমুদ্র পাড় হওয়া সম্ভব?এসব কি কোনভাবেই বাস্তব? ভাবতেই কেমন অবাক লাগেনা? আজ সেই অবাক করা ভাবনাগুলোর অন্তরালের রহস্যই আপনাদের সামনে তুলে ধরব।


আপনারা কি জানেন এশিয়ায় এবং ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ কিভাবে এসেছিল?কখন হয়েছিল Homo Sapiens এর প্রথম Mass Habitation বা ব্যাপক সংখ্যায় বসতি স্থাপন? আজ হতে প্রায় ৭০০০০ বছর পূর্বেও আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব খুব ই সীমিত ছিল। অন্য কিছু আদিম মানুষ প্রজাতি(Hominids) যেমন Homo Erectus, Homo Heidelbergensis,Homo Neanderthals প্রজাতিগুলোর অনেক সদস্য তখন এখানে বসবাস করলেও আধুনিক মানুষের তথা আমাদের প্রজাতি Homo Sapiens তখনও সর্বত্র আবাস গড়েনি, তাদের বাস তখনও অধিকাংশই আফ্রিকা মহাদেশে।


আজ থেকে প্রায় ৭০,০০০ বছর পূর্বে একদল Homo Sapiens আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ সমুদ্র উপকূল ধরে উন্নত শিকার, সমুদ্রের মাছ ও আবহাওয়ার খোঁজে বের হয়ে পড়ল নতুন বসতির সন্ধানে, তারা হাজার বছর ধরে ঘুরে ঘুরে বাবা-এল-মান্দেব প্রণালী ও কিছু সদস্য লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে এসেছিল আরব উপসাগরীয় অঞ্চল, তুরস্ক, ইরাক ও উপমহাদেশে, এখানে এসে নতুন বসতি গড়ল। তারা কিভাবে এসেছিল সেই সত্তর হাজার বছর পূর্বে সাগর পাড়ি দিয়ে? উত্তরটা হল সমুদ্র উপকূলবর্তী  বর্তমানের অনেক অগভীর জলপথ যা আগে সমূদ্রপৃষ্ঠের উপরেই ছিল এবং পরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নিমজ্জিত হয়ে যায় তাতে পদব্রজে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।এছাড়াও সহজেই পায়ে হেঁটে পার হবার মত জায়গায় পদব্রজ ব্যতীতও গাছের ভেলায় ভেসে স্থানান্তরও মানুষের নতুন বসতি গড়ে তোলার ক্ষুদ্র হলেও উল্লেখযোগ্য অংশ। অর্থাৎ অগভীর, সংকীর্ণ সমুদ্রপথ পাড়ি দেবার ইতিহাস মানুষের অনেক অনেক পুরনো, এটি কোন অসম্ভব অলৌকিকতা নয়।ভেবে দেখুন আজ থেকে প্রায় ৪৬ হাজার বছর পূর্বে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যাত্রা করা এক মনুষ্যদল পৌঁছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে! তাহলে সেখানে সামান্য রামেশ্বরম থেকে শ্রীলঙ্কা তাও মাত্র ৭ হাজার বছর পূর্বে তা কি খুব কঠিন কিছু?গবেষকরা খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৭০০০ বছর পূর্বের  একদম বড় নৌকার(Sailing Boat) সন্ধান চীনদেশে পেয়েছেন যা দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়া যেত।

Homo Erectus(উজ্জ্বল হলুদ),Homo Neanderthals(গাঢ় হলুদ) ও Homo Sapiens(আধুনিক মানুষ,লাল) এর Southern Dispersal এর মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার চিত্র



ঠিক তেমনি ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যে জলপথ তার বিশ্লেষণ যখন আমরা দেখব আমরা দেখতে পাব এই জলপথের চরিত্র কেমন আর তা পাড়ি দেয়া কেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা।


বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধ কাণ্ডের  ১৭ নং সর্গে আমরা দেখতে পাই, সেতু তৈরীর আগেই বিভীষণ ভারতে এসে শ্রীরামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। আবার যুদ্ধ কাণ্ডের ২০ নং সর্গে দেখা যায়, সেতু বানানোর আগেই রাবণের গুপ্তচর শার্দূল রামেশ্বরমে এসে সুগ্রীবের সৈন্যদল পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছিলেন।সুগ্রীবের সৈন্যসামর্থ্য গুপ্তচর শার্দূল ফেরত গিয়ে রাবণকে জানালে রাবণ ভয়ে ভীত হন এবং তার দূত শুককে পুনরায় পাঠান সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুগ্রীবের সাথে দেখা করে তাকে শ্রী রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় প্রলুব্ধ করার জন্য।অর্থাৎ শার্দূল ও শুক উভয়েই সেতু ব্যতীতই বা অলৌকিক কোন লাফ ছাড়াই সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন।তাহলে পাঠক আমরা রামায়ণে রামসেতু তৈরীর আগেই কয়েকটি ঘটনা পাচ্ছি সমুদ্রপাড়ি দেবার। এদিকে গুপ্তচর হিসেবে এরই আগে হনুমানের সাগর পাড়ি দেবার কথা তো সর্বজনবিদিত।


ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যে যে জলপথের ব্যবধান ছিল অর্থাৎ ভারতের পবমান দ্বীপ থেকে শ্রীলংকার মান্নার উপদ্বীপ, এইটুকু পথ যা প্রায় ৩০ মাইল তা পাড়ি দেয়া মোটেও অলৌকিক কোন কার্য নয়। এই পথের মধ্যে থাকা পক প্রণালীর চেয়েও অনেক স্রোতস্বিনী কঠিন প্রণালী(যেমন ইংলিশ চ্যানেল তথা এর সরুতম অংশ ডোভার প্রণালী)আমরা বাঙালীরাও(ব্রজেন দাস) স্রেফ সাঁতার কেটেই পাড়ি দিয়েছি।ব্রজেন দাস এমনকি ঢাকায় টানা ৪৮ ঘন্টা ধরে ৬০ মাইল জলপথ সাঁতার দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন।এমনকি অপর বাঙালী মিহির সেন ১৯৬৬ সালে এই পক প্রণালীই পাড়ি দিয়েছিলেন মাত্র ২৫ ঘন্টা ৩৬ মিনিটে।একই বছর আরও দীর্ঘতর পানামা প্রণালী(৪০ মাইল প্রায়) পাড়ি দেন ৩৪ ঘন্টা ২৫ মিনিট সময় নিয়ে।আমরা দেখেছি অযোধ্যাকাণ্ডে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ নিষাদরাজ গুহের বানানো নৌকা দিয়ে স্রোতস্বিনী গঙ্গা নদী পাড়ি দিয়েছেন।


তত সপ্রাঞ্জলীর্ভূত্বা গুহো রাঘবমব্রবীৎ।

উপস্থিতৈয়ম নৌদৈব ভূয়ঃ কিম্ করবাণি নৈ।।

(রামায়ণ, অযোধ্যা কাণ্ড, অ০ ৫২, শ্লো০ ৮)

অর্থাৎ কৃতাঞ্জলিপূর্বক শ্রীরামের সামনে নিষাদরাজ গুহ বললেন, হে রাঘব! আপনার জন্য নৌকা প্রস্তুত করা হয়েছে, আপনার সেবার জন্য আমি আর কি করতে পারি, আমায় আজ্ঞা দিন।


তাই মা সীতার খোঁজের সময় গুপ্তচর হনুমানজীর পক্ষে,  শ্রীরামের আশ্রয় নেবার সময় বিভীষণের পক্ষেও এই পথ পাড়ি দেয়া সেতু ছাড়াই সম্ভব হয়েছিল নৌকার মাধ্যমে। তবে হনুমানজী যেহেতু গুপ্তচর হিসেবে গিয়েছিলেন তার পক্ষে সাঁতারের মাধ্যমেও তা পাড়ি দেয়ার একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে কেননা নৌকায় গেলে চোখে পড়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। এটি নিশ্চিত করার উপায় নেই যে, তিনি নৌকা ব্যবহার করেছিলেন নাকি অগভীর জলপথটি সাঁতরেই পার হয়েছিলেন, কেননা পুরো জলপথটির মাঝখানে মাঝখানে বেশকিছু উত্থিত স্থলপথ ছিল যেখানে বিশ্রাম নেয়া যেত, আর রামায়ণেও পথিমধ্যে হনুমানজীর যাত্রাবিরতির এই কথা উল্লেখিত আছে(বাল্মীকি রামায়ণ ৫.১.১৩১)। এই সমুদ্র পাড়ি দেবার ঘটনাগুলো তো কেবল মাত্র একজন ব্যাক্তির ক্ষেত্রে। কিন্তু লঙ্কায় আক্রমণের সময় পুরো একটা সেনাবাহিনীর অগভীর এই জলপথ পাড়ি দেয়ার জন্য এতগুলো নৌকা বানানো কঠিন ছিল।এত বিশাল সৈন্যদলের সাঁতরে পার হওয়াও অসম্ভব।আর তখনই এগিয়ে এলেন সুগ্রীবের সেনাদলের দক্ষ প্রকৌশলী "নল"। পাথর, গাছের গুঁড়ি, বাঁশ, বালু প্রভৃতি দিয়ে ৫ দিনের ভিতর সমস্ত সেনাবাহিনীর পেশীশক্তি ব্যবহার করে, আগে থেকেই অবস্থিত সমুদ্রজলে নিমজ্জিত এক অগভীর স্থলভূমির উপরে বানালেন এক সেতু যা আজ রামসেতু নামে খ্যাত। (রামায়ণ, যুদ্ধকাণ্ড অ০ ৬, সর্গ ২২ দ্রষ্টব্য)




"রামসেতু" নামক প্রবাল, পাথর ও বালুর সমন্বয়ে গঠিত সেই সমুদ্রপথ আবিস্কারের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যে সমুদ্রের মাঝেও একটি স্থলপথ ছিল, পবমান দ্বীপ(ভারত) ও মান্নার দ্বীপের(শ্রীলঙ্কা) মাঝে। এটি এখনো অনেক জায়গায় একদম অগভীর, ১ মিটার বা ৩ ফুটেরও কম গভীরতার। গবেষকদের ধারণা আজ থেকে ৫০০ বছর আগেও, ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অংশটি সমুদ্রের উপরে ভাসমান ছিল যা এরপর সাইক্লোনের ফলশ্রুতিতে জলরেখার নিচে চলে যায়। এর মাধ্যমেই বুঝা যায় এই স্থানটি সময়ের ব্যবধানে সমুদ্রস্তরের উচ্চতার হ্রাসবৃদ্ধির ব্যবধানে কখনো জলরেখার নিচে থাকে, কখনো উপরে। শ্রী রামচন্দ্রের সময়ে এই স্থানটি জলরেখার নিচে অবস্থিত ছিল, আর অগভীর সেই অংশের উপরে শ্রী রামচন্দ্র ও তাঁর বানর সৈন্যরা খুব স্বাভাবিক উপায়েই এই সেতুটি নির্মাণ করেন।

NASA Satellite Imagery তে রামসেতু



ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ হিসেবে Carbon Dating এ সেখানে ৪২০০ বছরের প্রাচীন প্রবাল খুঁজে পাওয়া গেছে। ভারতীদাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের Central Remote Sensing Team এর প্রফেসর এস এম রামস্বামী এই সেতুকে অন্তত ৩৫০০ বছর আগের বলেছেন। National Remote Sensing Agency (NRSA) ২০০৭ সালে একই মত ব্যক্ত করে। সেই সময়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী Muthuvel Karunanidhi ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেতুসমুদ্রম প্রজেক্টের পক্ষ নিয়ে রামসেতুকে ভেঙে ফেলে সমুদ্রপথের গভীরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একনাগাড়ে শ্রীরামের অস্তিত্ব ও রামসেতুর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন, কটুক্তি করছিলেন, হিন্দুদের প্রাণে আঘাত দিচ্ছিলেন। আর ঠিক তখনই NRSA এর ২০০৭ সালে দেয়া এই গবেষণা প্রবন্ধ তৎকালীন ক্ষমতাশীল দল কংগ্রেসকে একইসাথে পশ্চিমবঙ্গে CPM ও তামিলনাড়ুতে DMK কে খুব লজ্জায় ফেলে দেয়। সুপ্রিম কোর্টে সুব্রামণিয়াম স্বামী Geological Survey Of India এর রিপোর্ট পেশ করে দেখান যে, এই সেতু কোনভাবেই পুরোপুরি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা হতেই পারেনা, কেননা এত বড় বড় কোরাল পাথর কখনো সমুদ্রের মাঝখানে এভাবে সাজানো থাকে না।

পবমান দ্বীপ ও মান্নার দ্বীপের মধ্যবর্তী রামসেতু



বিরোধীপক্ষ সবসময়ই বলে এসেছে ক্ষয়প্রাপ্ত বালুর স্তুপ (Sand Bar) সমূহ নিশ্চিতভাবে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা। কিন্তু এখানেই আছে একটি রহস্য যা ২০১৭ সালের ১১ই ডিসেম্বর Science Channel এর প্রচারিত রামসেতু নিয়ে এক গবেষণামূলক ডকুমেন্টারিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে।


সাধারণত যে কোন ভূস্তরের বৈশিষ্ট্য এরকম— যে স্তর যত নিচের তার বয়স তত বেশী, যত উপরে তার বয়স তত কম। ভূতত্ত্ব, ফসিলবিদ্যা এই নিয়মের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। সায়েন্স চ্যানেলের সেই ডকুমেন্টারিতে প্রখ্যাত জিওলজিস্ট ডক্টর এলেন চেস্টার বলেন "এই পাথরগুলো (বালুর ঢিবির উপরে অবস্থিত) অন্য কোন জায়গা থেকে এনে এখানে বসানো হয়েছে, মনে হচ্ছে গলার মালার মুক্তোর মত একটি রেখা।"

মুক্তোর মালার মত রামসেতুর বালির স্তম্ভসমূহের উপরে সজ্জিত পাথর



অপর আর্কিওলজিস্ট চেলসি রোস বলেন, "আসলে এই পাথরগুলোর বয়স বরং এই বালুর ঢিবিগুলোর বয়সের চেয়ে বেশী। বালির ঢিবিগুলো প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো কিন্তু পাথরগুলো প্রায় ৭০০০ বছরের পুরনো।"


আর আগেই বলেছি, কখনোই প্রাকৃতিকভাবে অধিকতর পুরনো পদার্থের তলানি নতুন পদার্থের উপরে পড়তে পারেনা, তলানিতে থাকা জিনিসটিই অধিকতর পুরনো হয় যদি তা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে এই পাথরখণ্ডগুলো অধিকতর পুরনো হওয়া সত্যেও এই কারণেই বালুর স্তুপের উপরে অবস্থিত কারণ মানুষেরাই অন্য কোন স্থান থেকে এগুলোকে এনে বালুর ঢিবির উপর দিয়ে এই পথটি তৈরী করেছিল। অর্থাৎ বালির স্তুপগুলো প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট নয় কিন্তু তার উপর পাথরগুলোর স্থাপন মানুষের ই কাজ। আর এজন্যেই বয়সে বেশী হবার পরেও সেই পাথরগুলোর অবস্থান বালুর উপরে, নিচে নয়।

সায়েন্স চ্যানেলের জিওলজিস্টদের মতে এই রামসেতু তৈরী হয়েছিল প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে।


আর বাল্মীকি রামায়ণও আর্কিওলজিস্টদের সেই কথাটিই বলছে—


"বভঞ্জুর নগান্ বানরাস্ তত্র প্রচকর্ষুশ্চ সাগরম্"

(রামায়ণ যুদ্ধকাণ্ড, অ০ ২২, শ্লো০ ৫৩)

অর্থাৎ বানর সৈন্যদল পাথরসমূহ ভেঙে সেই পাথরখণ্ড সমুদ্রে নিয়ে চলল।


তবে এখানে একটি কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে রামসেতু তথা রামায়ণ নিয়ে বিভিন্ন অলৌকিক রূপকথা ছড়িয়ে পড়াতে এটা নিয়ে জনমনে বহুবছর ধরেই নানা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিল সাধারণ মানুষ।আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে মূল বাল্মিকী রামায়ণের কাণ্ড মাত্র ৫ টি,আদি কাণ্ড ও উত্তর কাণ্ড মূল রামায়ণের অংশ ই নয়।এছাড়াও বাকী ৫ কাণ্ডেও পরবর্তীকালে রচিত প্রচুর প্রক্ষিপ্ত শ্লোক রয়েছে যা দিয়ে একচোখা সমালোচকগণ রামায়ণকেই বিতর্কিত করে ফেলার চেষ্টা করেন।তাই আমাদের মনে রাখতে হবে প্রক্ষিপ্ত শ্লোক নয় বরং মূল বাল্মীকি রামায়ণের শুদ্ধ শ্লোকসমূহকেই কেবল গ্রহণ করতে হবে ঐতিহাসিক হিসেবে।


এর পরের শ্লোকগুলোতে দেখা যায়, কিভাবে বিভিন্ন গাছের গুঁড়ি, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে সেই সেতুকে শক্তিশালী করা হয়েছিল। সেই সেতু হয়ে উঠল ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধের, আলো-আঁধারের লড়াইয়ের মহাসেতু।

১৩ দিন ধরে চললো সেই মহাযুদ্ধ, কীর্তিত হল শ্রীরামচন্দ্রের জয়গাঁথা। শ্রীরাম ন্যায় স্থাপন করে বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন অযোধ্যায়।


তখন,

ততো হর্ষসমুদ্ভূতো নিস্বনো দিবমস্পৃশৎ।

স্ত্রীবালোযুববৃদ্ধানাং রামো অয়ম ইতি কীর্তিতে।।


"রাম রাম" ধ্বনিতে আবালবৃদ্ধবণিতার উল্লাসে সমগ্র নগর, আকাশ, বাতাস কীর্তিত হইয়া উঠিলো।


প্রবন্ধটি শেষ করার আগে একটি বহুল প্রচলিত মিথ ও সেই মিথটিকে ঘিরে জমে থাকা অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ করব।রামসেতুকে নিয়ে একটি বিখ্যাত গল্প লোকমাঝে জনশ্রুতি রয়েছে যে বানরসেনারা নাকি শ্রীরামের পবিত্র নাম লিখে পাথরগুলোকে ছেড়ে দিত সাগরে আর শ্রীরামের নামের মহিমাতেই সেই পাথরগুলো ভেসে থাকত আর এভাবেই নাকি তৈরী হয়েছিল রামসেতু।বিষয়টা কি আসলেই সত্যি?


উত্তর হল বাস্তবে বাল্মিকী রামায়ণে এমন কোন অলৌকিক পরাবাস্তব কাহিনী নেই।আপনারা এতক্ষণ দেখেছেন কিভাবে বাল্মিকী রামায়ণে খুব বাস্তব,বিজ্ঞানসম্মতভাবে রামসেতু তৈরীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।তাহলে এই ভাসমান পাথরের কাহিনীর উৎস কি?


বিখ্যাত বৈষ্ণব ভক্তিধারার কবি তুলসীদাস গোস্বামী খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকে লিখেন বিখ্যাত ভক্তিমূলক গ্রন্থ রামচরিতমানস যেখানে তিনি তাঁর প্রিয় আরাধ্য রামচন্দ্রের মহিমা কীর্তন করার জন্য লিখেন অনেক মনোহর ভক্তিমূলক গল্প যার অস্তিত্ব আসলে মূল রামায়ণে বা বাস্তবে নেই।আর সেই রামচরিতমানসের ই সৃষ্টি এই রামের নামের মহিমায় জলে ভাসমান পাথর দ্বারা সেতু তৈরীর কাহিনী বাস্তবে যা ঘটেনি।


খুব সম্ভবত এই গল্পের উদ্ভব ঘটেছে রামেশ্বরমের সমুদ্রতটে পাওয়া যাওয়া প্রচুর ভাসমান পাথর হতে।আপনারা জানেন যে রামেশ্বরমে এরকম ভাসমান পাথর পাওয়া যায় যা পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র।এই পাথরগুলো হল মূলত আগ্নেয়গিরি লাভা উদগীরণের খণ্ডাংশসমূহের ক্রমাগত শীতল হয়ে হয়ে কঠিন অথচ ভেতরে ফাঁপা ও পাতলা পাথরে রূপান্তরিত হওয়া পাথর বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় Pumice Stone.



"যত্র রামঃ ভয়ম্ নত্র নাস্তি তত্র পরাভবঃ।"

যেখানে রাম আছেন না সেখানে ভয় আছে, না আছে দুঃখ।


যার হৃদয়ে রামের বাস তার কোনকিছুতেই ভয় নেই।


মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের জয়


জয় শ্রীরাম

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)