দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







Natal Chart বা কোষ্ঠী, বিজ্ঞানের অপবিজ্ঞানে রূপান্তরের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত;পর্ব ১

Arindam
0




টেনিস মানেই যেন মাথায় রজার ফেদেরার শব্দটা,ফুটবল কথাটা আসলেই যেমন মেসি-রোনালদো কথাটা,বাস্কেটবল মানেই যেমন লেব্রন জেমস শব্দটা চোখে ভেসে উঠে তেমনি বিয়ে শব্দটা কানে আসলেই আর কিছু মাথায় আসুক না আসুক কোষ্ঠী শব্দটা অভিভাবকদের মাথায় আসবেই।


কোষ্ঠী শব্দটি এমন একটি শব্দ যা প্রায় প্রতিটি সনাতন ধর্মালম্বী ব্যক্তি জীবনের এই একটি সময়ে এসে শুনবেন ই,ভাইয়ের বিয়ে,বোনের বিয়ে,বন্ধুর বিয়ে,ছেলেমেয়ের বিয়ে এলেই কোষ্ঠী নিয়ে অভিভাবকদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায় জ্যোতিষীদের কাছে,আকাশের নক্ষত্রের গণক জ্যোতিষীরা সেই সময় নিজেরাই হিন্দু অভিভাবকদের মনে হয়ে উঠেন একেকটা জীবন্ত নক্ষত্র,তাদের পাইয়ে দেন সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধির রহস্যময় চাবির সন্ধান।


কিন্তু এই কোষ্ঠী কি জিনিস তা আমাদের অধিকাংশই জানেন না,এর জন্যে আমাদের ভুগতেও কম হয়না।পছন্দের পাত্র পাত্রীর সাথে কোষ্ঠী মেলেনা,নাম মেলেনা,নক্ষত্র মেলেনা,আরও কত কী!কী আছে আসলে এই কোষ্ঠীতে? তা জানার উদ্দেশ্যেই আমাদের কোষ্ঠী নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন।


জাতক-জাতিকার জীবনে কোন সময়ে কী ঘটছে, বর্তমানে কী ঘটছে, ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, তা যে ঘর আকৃতির চারকোণা ছক থেকে জানা যায় তাকেই কোষ্ঠী বলে। কোষ্ঠ শব্দের অর্থ গৃহ অর্থাৎ ঘর। কোষ্ঠ শব্দ হতেই কোষ্ঠী কথার উদ্ভব। প্রচলিত জ্যোতিষবিদ্যার মতে মানবের সমগ্র জীবন কালের ভূত-ভবিষৎ-বর্তমান ঘটনা প্রবাহ  বারো রাশি রূপ কোষ্ঠ বা ঘর আকারের আঁকা একটি ছকে তার জন্মের সময়কালীন গ্রহনক্ষত্র সমূহের অবস্থানের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়। অর্থাৎ শিশুর জন্মের সময়ক্ষণ দিয়ে এমন একটি চারকোণা ঘর(কোষ্ঠ) আকৃতির ছক প্রস্তুত করা হয় যার মাধ্যমে তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক তথ্য বলে দেয়া যায়,এটিই কোষ্ঠী।ভারতীয় মতে কোষ্ঠীকে জন্ম পত্রিকা বা জন্ম কুণ্ডলী নামেও অভিহিত করা হয়।


এখন প্রশ্ন হল কোষ্ঠী কি শাস্ত্রসম্মত?এরকম একটা ছক দেখেই কি মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দেয়া সম্ভব? আমরা জানি পবিত্র বেদের ৬ টি বেদাঙ্গ রয়েছে আর সেগুলো হল শিক্ষা,কল্প,নিরুক্ত,ব্যাকরণ,ছন্দ ও জ্যোতিষ।এই জ্যোতিষ নামক বেদাঙ্গ ই পৃথিবীতে Astronomy বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক।কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত এই জ্যোতিষশাস্ত্র কি বেদাঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে আসলে কোষ্ঠীতে কী থাকে।


আমরা সবাই পঞ্জিকা চিনি।পঞ্জিকা দেখে দেখেই আমরা পূজা পার্বণ করি।এই পঞ্জিকার আসল সংস্কৃত নাম হল পঞ্চাঙ্গ অর্থাৎ ৫ টি অঙ্গ যার।৫ টি অঙ্গ অর্থ হল এই পঞ্জিকা তৈরীতে পাঁচটি উপকরণ ব্যবহার করা হয়।আর এই ৫ টি উপকরণ কোষ্ঠীতেও ব্যবহার করা হয়।কি সেই ৫ টি উপকরণ তা জেনে নেয়াই হবে আমাদের কোষ্ঠী সম্পর্কে জানার মূল ও প্রথম ধাপ।এর মাধ্যমে একইসাথে আমরা পেয়ে যাব পঞ্জিকা বা পঞ্চাঙ্গ সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য।


পঞ্চাঙ্গ কী কী


বার
তিথি
নক্ষত্র
করণ

যোগ




বার

আমরা সবাই জানি বার কী।বার হল পৃথিবীর নিজ অক্ষে একবার আবর্তন করতে যে সময় লাগে সেই সময়ের(২৪ ঘন্টাকে) একটি নামকরণ।বার ৭ টি এবং ভারতীয় জ্যোতিষ বিদ্যায় বার শুরু হয় রবিবার দিয়ে-

১)রবি ২) সোম ৩)মঙ্গল ৪)বুধ ৫)বৃহস্পতি ৬)শুক্র

৭)শনি



তিথি

এই শব্দটি আমরা সবাই বহুবার শুনেছি গুরুজনদের মুখে।পূর্ণিমা তিথি,অমাবস্যা তিথি,একাদশী তিথি ইত্যাদি কতই না তিথি! কিন্তু এর অর্থ কি তা আমাদের অধিকাংশ গুরুজনরাও জানেন না।তিথি বিষয়টি খুব ই বিজ্ঞানসম্মত একটি হিসেবনিকেশ।


আমরা জানি চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ যা উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।আবার এও জানি পৃথিবীও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহসমূহের মতই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।অর্থাৎ পরোক্ষভাবে চাঁদও সূর্যকে কেন্দ্র করে নিজ উপবৃত্তাকার অক্ষে ঘুরছে।


চাঁদ সূর্যের সাপেক্ষে নিজের অক্ষে কেন্দ্র করে এইযে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে তার মোট কৌণিক দৈর্ঘ্য ৩৬০ ডিগ্রী।আর সূর্যের সাপেক্ষে নিজ অক্ষপথে একই চান্দ্রকলায় ফেরত আসতে আধুনিক বিজ্ঞানের হিসেব অনুযায়ী চাঁদের মোট লাগে ২৯.৫৩ দিন(এখানে দিন বলতে সৌরদিন বা ২৪ ঘন্টা)।এই ২৯.৫৩ দিনকে সুবিধার জন্য ৩০ দিন ধরা হয় যাকে বলা হয় Synodic Month। তাহলে চাঁদ সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় ৩০ দিন,এই প্রতিটি দিনকে বলে ১ টি তিথি। আর খেয়াল করুন এই ৩০ তিথিতে চাঁদ মোট ৩৬০ ডিগ্রী পথ পাড়ি দেয়।তাহলে একটি তিথিতে চাঁদ পাড়ি দিচ্ছে ১২ ডিগ্রী। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় চাঁদ সূর্যের প্রেক্ষিতে ১২ ডিগ্রী পথ পাড়ি দিতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয় ১ তিথি


কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করুন। চাঁদ নিজেই একটা বিশাল পিণ্ড, পৃথিবী এবং সূর্যও তাই,এদের ওজন লক্ষ লক্ষ কেজি।মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে তাই এরা একে অপরকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে ঠিক যেন চুম্বকের মত।একটি চুম্বক আরেকটি চুম্বকের যত কাছে আসে ততই সে চুম্বকটির নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে পড়ে আকর্ষণের কারণে আর ভারী চুম্বক হলে তো কথাই নেই। চাঁদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। সে নিজ কক্ষপথে পৃথিবী ও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় যখন তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকে তখন পৃথিবীর আকর্ষণ বলের কারণে তার চলাফেরা করতে কষ্ট হয়, সে তুলনামূলক ধীরে চলে। আবার যখন দূরে থাকে তখন সে তুলনামূলকভাবে দ্রুত চলে। তাই দেখা যায় প্রতি ১২ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করতে তার সবসময় সমান লাগেনা, কখনো ১৯ ঘন্টা তো কখনো ২৬ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগে।অর্থাৎ এক চান্দ্রদিন বা ১ তিথি কিন্তু ফিক্সড ২৪ ঘন্টা নয় যেমনটা আমরা সাধারণ ইংরেজি দিন হিসেব করি। এক চান্দ্রদিন বা তিথি ১৯ ঘন্টা থেকে ২৬ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। আর বিজ্ঞানের এই সুক্ষ্ম বিষয়টাই বৈদিক ভারতের অসামান্য একটি প্রাচীন আবিস্কার। আজ তাই এখনো দেখবেন পঞ্জিকায় হিসেব করা হয় প্রথমা বা প্রতিপদ তিথি দিনের এই সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত, এরপর দ্বিতীয়া তিথি অমুক সময় থেকে অমুক সময় পর্যন্ত,এরপর তৃতীয়া, তারপর চতুর্থী। দেখবেন একটি তিথির স্থায়িত্বকাল আরেকটি তিথির সমান নয়।কোনটা ১৯ ঘন্টা তো কোনটা ২০ ঘন্টা, কোনটা ২২ ঘন্টা ইত্যাদি! মাসের এই ৩০ টি তিথির প্রথম ১৫ তিথিতে সূর্যের সাপেক্ষে চাঁদের যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে তা পৃথিবী পৃষ্ঠের বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে অর্থাৎ ক্রমশ চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠটি আমাদের চোখে পড়তে থাকে বা অমাবস্যা হয়,তাই এই ১৫ টি তিথিকে বলা হয় কৃষ্ণপক্ষ।আর পরের ১৫ টি তিথিতে সূর্যালোক চাঁদের যে পৃষ্ঠে পড়ে সেই পৃষ্ঠটি ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দিকে আসতে থাকে বা পূর্ণিমা হতে থাকে, তাই তাকে বলা হয় শুক্লপক্ষ


৩০ টি তিথি,১৫ টি অমাবস্যা তিথি,১৫ টি পূর্ণিমা তিথি।প্রতিটি তিথির স্থায়িত্বকালও আলাদা
 


নক্ষত্র

রাতের আকাশে ঝিকিমিকি তারা গুলো যা আমরা খালিচোখে দেখি তার অপরূপ দৃশ্যে ভুললেই চলবেনা।এদের অনেকের ই জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্ব আছে।আমরা আগেই বলেছি চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে একটি উপবৃত্তাকার গোল পথ ধরে।এই গোল পথটির সমান্তরালে ২৭ টি উজ্জ্বল নক্ষত্র রয়েছে।এই নক্ষত্রগুলোর সবার নিজস্ব নাম আছে।যেমন অশ্বিনী,ভরণী,কৃত্তিকা,রোহিণী,মৃগশিরা,আর্দ্রা,পুনর্বসু,

পুষ্যা ইত্যাদি।


এই নক্ষত্র নিয়ে জানতে হলে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার জানতে হবে আর তা হল রাশি।রাশি শব্দটি সম্ভবত জ্যোতিষ বিদ্যার সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দ।ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে রাশিফল খুব জনপ্রিয় একটা ব্যাপার।কিন্তু রাশি আসলে কি বস্তু তা খুব কম মানুষ ই জানেন।


সূর্য বিশাল আয়তনের একটি গতিময় নক্ষত্র,এর একটি গতিপথ আছে যাকে বলা হয় Ecliptic বা অয়নবৃত্ত।এই গতিপথে পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান।বিজ্ঞানের এই অসাধারণ আবিস্কারটি সর্বপ্রথম মানবসভ্যতার যে বইটিতে উল্লেখিত হয়েছিল তা হল সনাতন ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ,এছাড়াও উল্লেখিত হয়েছিল যজুর্বেদেও। এখন এই উপবৃত্তাকার বা আপাতদৃষ্টিতে গোল বা চক্রাকার কক্ষপথটিকে(যার মোট কৌণিক দৈর্ঘ্য ৩৬০ ডিগ্রী) আমরা যদি সমান ১২ টি ভাগে ভাগ করি তাহলে আমরা যে ১২ টি সমান সমান ভাগ পাব তাদের প্রত্যেককে বলা হয় রাশি,আর এই পুরো গোল চক্রটিকে বলা হয় রাশিচক্র,ইংরেজিতে Zodiac.তাহলে প্রতিটি রাশির ভাগে পড়ল ৩০ ডিগ্রী করে,১২ টি রাশিতে মোট ৩৬০ ডিগ্রী।আর আমরা জানি সূর্যের চারদিকে এই পথটিকে অতিক্রম করতে পৃথিবীর মোট ৩৬৫দিন বা ১২ মাস সময় লাগে যাকে আমরা ১ বছর বলি।তাহলে ১২ মাসে ১২ টি রাশি অতিক্রম করলে প্রতিমাসের ভাগে নিশ্চয় ১টি করে রাশি পড়বে।


সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর আবর্তন পথের এই সমান ১২ টি ভাগকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।ভারতবর্ষে এই বারটি ভাগকেই মেষ,বৃষ,মিথুন,কর্কট,সিংহ,মকর ইত্যাদি নামে ডাকা হয় ইংরেজিতে যা Aries,Taurus,Gemini,Cancer ইত্যাদি।


তাহলে ভেবে দেখুন ধরুন আপনার জন্ম ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ বিকাল ৪ টায়,সে মাসে,সেদিন সেসময়ে পৃথিবী সূর্যের চারপাশের ওই কক্ষপথের কোন একটি জায়গায় ছিল অর্থাৎ ওই ১২ টি ভাগের ১ টি ভাগে তো সে ছিলই।সেদিন,ফেব্রুয়ারি মাসের সেসময়ে পৃথিবী সূর্যের চারপাশের উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ১২ টি ভাগের যে ভাগে অবস্থিত ছিল তাই হল আপনার রাশি,একে সূর্যরাশিও বলা হয়।এজন্যেই আমাদের রাশি আমাদের জন্মমাস অনুযায়ী হয়।আপনি যে মাসে জন্মেছেন সে মাসে পৃথিবীর অবস্থান তার কক্ষপথের ১২ ভাগের যে ভাগটিতে ছিল আপনার রাশি সেই ভাগটি

অর্থাৎ রাশি একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেশন,এখানে অলৌকিকত্ব বা রূপকথার কিছু নেই।


তবে এখানে একটি কথা আছে।আমরা এতক্ষণ যে রাশির কথা বললাম তা কিন্ত সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর আবর্তন এর উপর ভিত্তি করে গণনা করা অর্থাৎ এটি সূর্যের উপর নির্ভরশীল।তাই একে সৌরদশাও বলে।কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে এটি খুব ই কম ব্যবহৃত হয়।ভারতীয় উপমহাদেশের জ্যোতিষ ব্যবস্থায় মূলত ব্যবহার করা হয় চন্দ্ররাশি।চন্দ্র রাশি হল একজন ব্যক্তির জন্মের সময় চাদ তার কক্ষপথের ১২ টি ভাগের যে ভাগে অবস্থান করে তাই সে ব্যক্তির চন্দ্ররাশি।অপরদিকে সূর্যরাশি মূলত ইউরোপ অঞ্চলে ব্যবহৃত হত।তাই যখন ই কেউ উপমহাদেশে আপনাকে রাশির কথা বলবে আপনি বুঝে নেবেন সেটা হল চন্দ্ররাশি।


চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে কক্ষপথে এবং মকর রাশিভাগের সমান্তরালে আছে,এই সময়ে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির রাশি মকর রাশি

চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে কক্ষপথে এবং কন্যা রাশিভাগের সমান্তরালে আছে,এই সময়ে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির রাশি কন্যা রাশি



এখন আবার আসি নক্ষত্রে।আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ৩৬০ ডিগ্রী চক্রাকার পথটিকে ১২ টি ভাগে ভাগ করা হল এবং এদের প্রত্যেকটির নাম রাশি, আবার এই চক্রাকার পথেই আছে ২৭ টি নক্ষত্র যা আমরা বর্তমানে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে পাই।তাহলে ১২ টি ভাগের প্রতিটি ভাগেই দেখা যাচ্ছে (২৭÷১২=২.২৫ টি) করে নক্ষত্র পড়ছে।আশ্চর্যের বিষয় হল আজ থেকে বহু সহস্র বছর পূর্বে যখন টেলিস্কোপ ছিলনা তখন একটি প্রাচীন গ্রন্থে এই ২৭ টি নক্ষত্রের কথা বলা হয়েছিল।গ্রন্থটির নাম অথর্ববেদ(১৯.৭),সনাতন ধর্মালম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।





ধরুন একটি মানুষ,তার জন্ম হল ভাদ্র মাসে,তিনি মাসের প্রথম অর্ধেক ১৫ দিন অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের ৮ নং তিথিতে জন্ম নিলেন।তিনি যখন জন্ম নিলেন ঠিক সেই সময় চন্দ্র তার কক্ষপথের ১২ ভাগের যে ভাগটিতে অবস্থিত ছিল তার নাম Taurus বা বৃষরাশি।আর  ধরুন ঠিক সেই সময় চাঁদ ওই ২৭ টি নক্ষত্রের মধ্যে যে নক্ষত্রটির সমান্তরালে ছিল তার নাম Aldebaran,এটি এমন একটি বিশাল নক্ষত্র যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।এই নক্ষত্রটির সংস্কৃততে নাম হল রোহিণী নক্ষত্র।


তাহলে দেখুন,ব্যক্তিটির জন্ম ভাদ্র মাসে,কৃষ্ণপক্ষে,

৮ম তিথিতে,তার জন্মের মুহুর্তে চন্দ্র তখন পৃথিবীর চারপাশে তার কক্ষপথের ১২ ভাগের Taurus বা বৃষ রাশির ভাগে অবস্থিত,

চাঁদ তখন তার কক্ষপথে রোহিণী বা Aldebaran নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে অবস্থিত।এরকম একজন ব্যক্তি আসলেই আছেন যার ঠিক এই সময়েই জন্ম হয়েছিল আর সেই ব্যক্তিটির নাম হল শ্রীকৃষ্ণ,নাম তো শুনা ই হোগা না?একইভাবে শ্রীরাম জন্ম নিয়েছিলেন কর্কট রাশিতে।


একটি ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন পৃথিবী,চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থান।পৃথিবী কক্ষপথের ১২ ভাগের কর্কটরাশির ভাগে,চন্দ্র পুষ্য নক্ষত্রের সমান্তরালে



করণ

আমরা আগেই জেনেছি চাঁদ নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ১২ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয় ১ তিথি। আর এই এক তিথিকেই আবার ২ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে করণ।অর্থাৎ চাঁদের সূর্যের চারপাশে ৬ ডিগ্রী পথ অতিক্রমের সময়কে বলা হয় করণ।এই করণগুলোর নির্দিষ্ট নাম রয়েছে,যেমন কিন্তঘ্ন,বব,বালব,কৌলব ইত্যাদি।


যোগ

আমরা দেখলাম চাঁদের কক্ষপথের সমান্তরালে ২৭ টি নক্ষত্র রয়েছে যেমন অশ্বিনী, ভরণী,কৃত্তিকা,রোহিণী,বিশাখা ইত্যাদি।প্রতিটি নক্ষত্র কিন্তু চাঁদের চেয়ে আয়তনে অনেক বড়।ঘূর্ণনের সময় এই প্রতিটি নক্ষত্রকে অতিক্রম করতে চাঁদের যে সময় লাগে তাকে বলা হয় যোগ।প্রতিটি যোগ ১৩.৩৩ ডিগ্রীর সমান,তাই ২৭ টি যোগ বা ২৭ টি নক্ষত্র অতিক্রম করলে চাঁদের ২৭×১৩.৩৩ ডিগ্রী বা ৩৬০ ডিগ্রী পথ(সম্পূর্ণ কক্ষপথ) অতিক্রম করা হয়।এই ২৭ টি যোগেরও নিজস্ব আলাদা আলাদা নাম আছে,যেমন বিষ্কুম্ভ,প্রীতি,আয়ুষ্মান্,সৌভাগ্য ইত্যাদি।





তাহলে আমরা জানলাম একটি শিশু যে মুহুর্তে জন্মগ্রহণ করে সেই মুহুর্তে মহাজগতের গুরুত্বপূর্ণ সকল গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র তাদের কক্ষপথের কোন কোন স্থানে অবস্থিত ছিল,কত ডিগ্রী কোণে অবস্থিত ছিল,দ্রাঘিমা কত ছিল এইসব তথ্য দিয়েই বা কোষ্ঠী তৈরী করা হয় যা পঞ্চাঙ্গ বা পঞ্জিকাও তৈরীতেও ব্যবহৃত হয়।আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক আর এদের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় বা Astronomical ইংরেজি নামও রয়েছে।পবিত্র বেদ সহ জ্যোতিষ নামক বেদাঙ্গে এসব আশ্চর্য বিজ্ঞানের উল্লেখ সহস্র বছর আগেই আবিস্কৃত হয়েছে।কিন্তু এগুলোর সাথে জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে,শুভ, অশুভ, ভবিষ্যৎ, রোগশোক এসবের কী সম্পর্ক? কোষ্ঠীতে এগুলো ছাড়াও আর কী কী আছে সেসবের বিস্তারিত নিয়ে আমরা আসব আগামী পর্বে।সে পর্যন্ত বিদায়।সবাই ভালো থাকবেন,সুস্থ্য থাকবেন,নিরাপদে থাকবেন।


ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি





Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)