দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







Natal Chart বা কোষ্ঠী,বিজ্ঞানের অপবিজ্ঞানে রূপান্তরের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত; পর্ব ২

Arindam
5

 



আমরা গত পর্বে দেখেছি কোষ্ঠী বা জন্ম কুণ্ডলী তৈরিতে ব্যবহৃত ৬ টি অতি বিজ্ঞানসম্মত গাণিতিক পদ্ধতির সঙ্গা।সেগুলো হল বার,তিথি,নক্ষত্র,রাশি,করণ ও যোগ


আজকে চলুন আমরা শিখব কিভাবে কোষ্ঠী দেখতে হয়,কোষ্ঠী গণনা করতে হয়।এই লেখাটি পড়ার পর আপনারাই হয়তো হয়ে উঠবেন এক একজন ক্ষুদে জ্যোতিষী!


একটি কোষ্ঠী কিভাবে বানাতে হয়? প্রথমে একটি আয়তাকার চতুর্ভূজ আঁকুন।চতুর্ভূজটির ভিতরেই আঁকুন বাঁকা করে আরেকটি বর্গাকার চতুর্ভূজ।প্রথম চতুর্ভূজের চারকোণার চারটা বিন্দুকে যুক্ত করে আঁকুন দুটি রেখা বা কর্ণ।তাহলেই দেখবেন মোট ১২ টি প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট একটি ঘর তৈরী হয়েছে।এটিই হল কোষ্ঠী


১২ প্রকোষ্ঠের কোষ্ঠীছক



এখন আসুন কোন ঘরে কি আছে তা দেখব,আরও দেখব ঘরটির নিচে ও আশেপাশে কোষ্ঠী তৈরীর সময় বেশকিছু সংখ্যা লেখা থাকে সেগুলোর ই বা মানে কি।


এই যে ১২ টি ঘর এই ১২ টি ঘর হল সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথকে যে ১২ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে সেই ১২ টি ভাগ,অর্থাৎ ১২ টি রাশির উপস্থাপনকারী।একদম উপরের ঘরটাকে ১ নং ধরা হয়,এর বামপাশের ঘরটাকে ২, তারপরেরটাকে ৩, এভাবে ক্রমশ ১ থেকে ১২ পর্যন্ত যাওয়া হয় বামদিকে বা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে(Anti-ClockWise)


১ম রাশির নাম মেষ,২ য় রাশি বৃষ,তৃতীয় মিথুন,৪র্থ কর্কট,৫ম সিংহ,৬ষ্ঠ কন্যা,৭ম তুলা,৮ম বৃশ্চিক,৯ম ধনু,১০ম মকর,একাদশ কুম্ভ,দ্বাদশ বা ১২ নংটি মীন





এখন প্রশ্ন করতে পারেন এই যে সূর্যকে আবর্তনকালে পৃথিবীর কক্ষপথের যে ১২ টি ভাগ বা রাশি তাদের নামগুলো এরকম কেন? বৃষ,মেষ,মীন,তুলা,কন্যা অর্থাৎ পশু,মাছ,ফসল,কন্যা এসবের নামে কেন?


এর পেছনেও রয়েছে প্রাচীন ঋষিদের খুবই বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণ।এই যে ১২ টি ভাগ বা রাশি, ইংরেজিতে এদের বলা হয় Constellation বা তারাদের মেলা। অর্থাৎ রাতের আকাশে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে দেখা যায় এই ১২ টি এলাকায় রয়েছে ১২ টি তারাপুঞ্জ।যেমন রাশিচক্রের প্রথম রাশিটি হল মেষরাশি।আকাশে মেষরাশি ভাগে যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা হয় দেখবেন ৪ টি উজ্জ্বল তারা সজ্জিত হয়ে আছে,সাথে ক্ষুদ্র আরও দুটি তারা। তারাগুলোকে সরলরেখা দিয়ে যোগ করুন,দেখা যাবে দেখতে একদম মেষ বা ভেড়ার শিং এর মত মনে হবে! আর তাই প্রাচীনকালে কক্ষপথের এই ভাগের নাম দেয়া হয়েছিল মেষরাশি(Aries)।এই চারটি তারার নাম আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে যথাক্রমে Alpha Arietis,Beta Arietis,Gamma Arietis,41 Arietis. ছবিতে আপনাদের জন্য দেয়া হয়েছে এই চারটি তারা কিভাবে একসাথে দেখতে মেষের শিং এর ন্যায়।


মেষরাশি বা Aries Constellation এর তারাপুঞ্জগুলোর আকৃতি দেখতে মেষের শিং এর মত



আবার কক্ষপথের Gemini Constellation বা মিথুন রাশির তারাপুঞ্জের দিকে তাকালে দেখবেন ১৭ টি উজ্জ্বল তারাপুঞ্জ এমনভাবে সজ্জিত দেখলে মনে হবে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।তাই এর নাম ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেয়া হয়েছিল মিথুন রাশি।প্রবন্ধের সাথে দেয়া ছবিতে দেখুন কি অদ্ভুত দক্ষতার সাথে এই পর্যবেক্ষণসমূহ করা হয়েছিল প্রাচীনকালে।


মিথুন রাশি বা Gemini Constellation এর তারাপুঞ্জগুলো একত্রে দেখতে একটি Couple এর মত


একইভাবে ৮ টি বৃহৎ ও অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর তারাপুঞ্জের সম্মেলনে গঠিত ধনুরাশি তারাপুঞ্জ বা Sagittarius Constellation কে দেখলে মনে হয় একজন ধনুর্ধারী যেন তীর নিক্ষেপ করছেন।

ধনুরাশির তারাগুলোর সম্মিলিত আকৃতি



আবার তুলারাশির তারাপুঞ্জ বা Librae Constellation খেয়াল করে দেখলে মনে হয় দুটো তুলাদণ্ড বা বাটখারা।

তুলারাশির তারাগুলোকে একত্রে দেখলে দেখায় তুলাদণ্ডের মতন



রাশির আলোচনা আপাতত শেষ।কোষ্ঠীর যে ছক তাতে ১২ টি প্রকোষ্ঠ তা আপনারা ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন।সেই কোষ্ঠীর ছকের নিচে বেশকিছু কথা ও সংখ্যা লেখা থাকে।


কোষ্ঠীর ছকে কী কী লেখা থাকে তার নমুনা



প্রথমে লেখা থাকে ধরুন এরকম-


শকাব্দ ১৯১৪|৯|৬|২১|১৬


এই কথাটির অর্থ কী? শকাব্দ একটি প্রাচীন ভারতীয় ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জিকা যা রাজা শালিবাহন প্রবর্তন করেছিলেন।আচ্ছা বলুন তো ইংরেজি সন থেকে বাংলা সন বের করে কীভাবে? এখন ২০২১ সাল,এই ২০২১ থেকে যদি আপনি ৫৯৩ বিয়োগ দেন তাহলেই বাংলা সন বের হয়ে আসবে অর্থাৎ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।ঠিক একইভাবে শকাব্দ থেকে বাংলা সন বের করারও একটি পদ্ধতি আছে আর তা হল ৫১৫ বিয়োগ দিতে হয়।


দেখুন প্রথমেই লেখা আছে ১৯১৪, এর থেকে ৫১৫ বিয়োগ দিন, বের হয়ে গেল বাংলা সন ১৩৯৯,অর্থাৎ যে ব্যক্তির কোষ্ঠী এটা তার জন্ম বাংলা ১৩৯৯ সালে,ইংরেজিতে ১৯৯৩ সাল।এর পর আছে ৯, অর্থাৎ ৯ম মাস বা পৌষ মাস গত হয়ে গিয়েছে,অর্থাৎ ১০ম মাস বা মাঘ মাসে তার জন্ম।এরপর আছে ৬ মানে মাঘমাসের ৬ দিন গত হয়ে গিয়েছে অর্থাৎ ৭ ই মাঘ তার জন্ম। এরপর আছে ২১|১৬।এর অর্থ কী তা একটু বলি।


আমরা বর্তমান যুগে সময় মাপতে ব্যবহার করি ঘন্টা,মিনিট, সেকেন্ড ইত্যাদি।প্রাচীনকালেও সময় মাপার এরকম বেশকিছু একক ছিল।তারই মধ্যে দুইটি একক হল দণ্ড ও পল।২১ হল এখানে দণ্ড আর ১৬ হল পল।অর্থাৎ মাঘ মাসের ৭ তারিখ সূর্যোদয় হবার পর ২১ দণ্ড ১৬ পল সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরের মুহুর্তেই সেই ব্যক্তির জন্ম হয়েছে।


আধুনিক সময়ের হিসেবে-


১ দণ্ড=২৪ মিনিট

১ পল=২৪ সেকেন্ড 


তাহলে ২১ দণ্ড= ২১×২৪ মিনিট=৫০৪ মিনিট বা ৮ ঘন্টা ২৪ মিনিট


এবং ১৬ পল= ১৬×২৪ সেকেন্ড=৩৮৪ সেকেন্ড বা ৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড।


তাহলে মোট দাড়াল ৮ ঘন্টা ২৪ মিনিট+ ৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড= ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড


এখন ধরি ওই ৭ ই মাঘ সূর্যোদয় হয়েছিল ভোর ৬ টায়।তাহলে ২১|১৬ মানে হল ভোর ৬ টার ঠিক ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড পর ওই ব্যক্তিটির জন্ম হয়েছিল অর্থাৎ দুপুর ২ টা ৩০ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে ব্যক্তিটির জন্ম।


তাহলে ওই ব্যক্তির কোষ্ঠীতে লেখা শকাব্দ ১৯১৪|৯|৬|২১|১৬ অর্থ হল ব্যক্তিটি বাংলা ১৩৯৯ বঙ্গাব্দের(ইংরেজি ১৯৯৩ সালে) ৭ ই মাঘ,শুক্লপক্ষে, দুপুর ২.৩০ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে জন্মগ্রহণ করেছিল।একদম ছোট একটি লাইনেই কোষ্ঠীতে এভাবেই বিশাল একটি ইনফরমেশন লিখে রাখা হয় অর্থাৎ অনেকটা কোড ল্যাঙ্গুয়েজের মত।



এরপর লেখা থাকে দেখবেন এরকম কিছু সংখ্যা-


৩০|০


৭ ৬ ৫

৯ ৮ ৫০

৩৯ ১৫ ৪৩

২৫ ২ ৮

জাতাহঃ



এখন এটা কী বুঝায়? একদম সহজ কারণ আপনারা প্রথম পর্ব পড়েছেন। ৭ হল বার(শনিবার), এর নিচে ৯ হল তিথি(মানে শুক্লপক্ষের নবমী তিথি),এর নিচে ৩৯ হল দণ্ড ২৫ পল বা ১৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট,অর্থাৎ নবমী তিথি সেদিন সূর্যোদয় থেকে ১৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।


এরপর ৬ হল নক্ষত্র(৬নং নক্ষত্রের নাম আর্দ্রা,অর্থাৎ চাঁদ সেদিন আর্দ্রা বা Betelgeuse/Alpha Orionis নামক নক্ষত্রটির সমান্তরালে ছিল),এরপর ৮ ও ১৫ হল দণ্ড ও পল(৩ ঘন্টা ১৮ মিনিট অর্থাৎ সেদিন সূর্যোদয়ের ৩ ঘন্টা ১৮ মিনিট পর পর্যন্ত চাঁদ আর্দ্রা নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে ছিল),তারপর ২ হল করণ(অর্থাৎ সেই ব্যক্তি নবমী তিথির দ্বিতীয় ভাগে,চাঁদ যখন কক্ষপথের সেদিনের পরিভ্রমণের ৭-১২ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করছিল তখন তার জন্ম হয়েছিল,এই ২ নং করণের নাম বালব করণ)।


এরপর ৫ হল যোগ(আমরা গত পর্বেই বলেছি যোগ হল চন্দ্রের সূর্যসাপেক্ষে গতিশীল অবস্থায় ২৭ টি নক্ষত্র বা ১৩.৩৩ ডিগ্রী করে অতিক্রম করা এবং এদের প্রতিটির আলাদা নাম রয়েছে,৫ নং যোগের নাম হল শোভন।)





তারপর ৫০ ও ৪৩ হল দণ্ড ও পল,অর্থাৎ ব্যক্তিটির জন্মের দিন সূর্যোদয়ের সময় হতে ৫০ দণ্ড ৪৩ পল বা ২০ ঘন্টা ১৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত চন্দ্র এই শোভন যোগ অতিক্রম করছিল।

এরপর সর্বশেষ ৮ হল ইংরেজি তারিখ।অর্থাৎ সেদিন ইংরেজি ৮ তারিখ ছিল।



আর একদম উপরে লেখা ছিল ৩০|০

আমরা জানি এক দিনরাত=২৪ ঘন্টা বা ৬০ দণ্ড।তাহলে শুধু একদিন=১২ ঘন্টা বা ৩০ দণ্ড।এটাই এখানে লেখা হয়েছে ৩০|০ দিয়ে অর্থাৎ সেদিন দিনের দৈর্ঘ্য ৩০ দণ্ড।


আর একদম শেষে লেখা জাতাহঃ শব্দের অর্থ হল জন্মদিন।অর্থাৎ ব্যক্তির জন্মদিনের সব গাণিতিক ডিটেলস এখানে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আকারে দেয়া আছে।


তাহলে দেখুন কোষ্ঠীতে উল্লেেখিত এই সংখ্যাগুলো দিয়ে নিতান্তই গাণিতিক কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।এখন পর্যন্ত এখানে কোন অলৌকিকত্ব বা রূপকথা নেই।ব্যক্তিটি যেদিন জন্ম নিয়েছিলেন সেদিন কতসাল,কী বার,কোন সময়,কোন মাস,সেদিন পৃথিবীর অবস্থান তার কক্ষপথের কোথায় ছিল,চন্দ্রের অবস্থান তার কক্ষপথে কোথায় ছিল ইত্যাদি এই সংখ্যাগুলো দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।তাহলে কোষ্ঠীর এই পর্যন্ত আমরা কোন অবৈজ্ঞানিক বা অবৈদিক তত্ত্ব খুঁজে পাইনা।



এখন আগেই বলেছি কোষ্ঠীতে ১২ প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট যে ছকটি আঁকা হয় তাতে একদম সবচেয়ে উপরের প্রথম ঘরটা মেষরাশি ভাগের,বামপাশে দ্বিতীয়টা বৃষ,তারপর মিথুন,তারপর কর্কট এভাবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চলতে থাকবে।ছবিতে সেই তালিকাটা দিয়ে দেয়া হয়েছে।যেহেতু এটা পূর্বনির্ধারিত যে কোন ঘরে কোন রাশি, তাই কোষ্ঠীর ঘরে রাশির নাম লেখা বাধ্যতামূলক নয়।এই ঘরগুলোতে লেখা থাকে গ্রহের নাম।কেরকম?


১২ টি ঘরে লেখা আছে একটি করে গ্রহের নাম ও তার পাশে নক্ষত্রসূচক সংখ্যা 



আমরা তো সূর্যের যে গতিপথ বা Ecliptic নামক অয়নবৃত্ত তাতে পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং সেই বৃত্তটাকে ১২ টি ভাগ করে দিলাম যার প্রত্যেকটি ভাগের নাম দিলাম রাশি।কিন্তু পৃথিবী তো একা নয়,সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।আবার চাঁদও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।তার মানে পৃথিবীর সাথে সাথে এরাও কিন্তু তাদের ঘূর্ণনের সময় ১২ ভাগের কোন না কোন ভাগের সমান্তরালে থাকে,সূর্য নিজেও যেহেতু ঘূর্ণায়মান সূর্যও কোন না কোন একভাগে থাকে।


এখন ধরুন যে ব্যক্তির কোষ্ঠী আঁকা হচ্ছে সে ব্যক্তি যেদিন জন্ম নিয়েছিল সেদিন বুধ গ্রহটি তার কক্ষপথে মেষরাশির যে এলাকা তার সমান্তরালে ছিল।তাহলে কোষ্ঠীতে মেষরাশির ঘরটাতে লেখা থাকবে বুধ।আবার ধরুন সেদিন শনিগ্রহ ছিল তার কক্ষপথে ধনু রাশির এলাকার ভাগের সমান্তরালে অবস্থিত,তাই কোষ্ঠীর ছকে ধনুরাশির ঘরে লেখা থাকবে শনি।


ধরুন মেষরাশির যে ঘরটা সেখানে লেখা ম৫, এর মানে কি? এর মানে হল ওই ব্যক্তি যেদিন জন্ম নিয়েছিল সেদিন মঙ্গল গ্রহ কক্ষপথে মেষরাশির যে এলাকা সেখানে অবস্থিত ছিল এবং ৫ নং নক্ষত্র বা মৃগশিরা(Delta&Omega Orionis) নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে অবস্থিত ছিল।


যেমন আপনাদেরকে একটি কোষ্ঠীর ছবি দিলাম নিচে।




এখানে মেষরাশির ঘরে লেখা আছে SUN 1, অর্থাৎ সূর্য সেদিন মেষরাশির ভাগে অবস্থিত ছিল এবং ১নং নক্ষত্র বা অশ্বিনী নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে ছিল।আবার মীনরাশির এলাকায় লেখা আছে Sat 12 অর্থাৎ শনিগ্রহ(Saturn) নিজ কক্ষপথে সেদিন মীনরাশির ভাগে অবস্থিত ছিল এবং ১২ নং নক্ষত্র বা উত্তর ফাল্গুনী নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে ছিল।


এভাবেই ব্যক্তির জন্মদিনের দিন চন্দ্র,সূর্য ও গ্রহগুলো কে কক্ষপথের কোন স্থানে অবস্থিত ছিল তা যে ছকে পাওয়া যাচ্ছে তাই কোষ্ঠী ছক।তবে এখানে একটা জিনিস জানার আছে।


গ্রহ বলতে আমরা কী বুঝি? International Astronomical Union অনুযায়ী গ্রহ ৮ টি।পবিত্র বেদেও ৮ টি গ্রহের উল্লেখ রয়েছে ঋগ্বেদ ১০.৫৫.৩ এ। পৃথিবী ও অপর সপ্তগ্রহ(বুধ,শুক্র,মঙ্গল,বৃহস্পতি,শনি,ইউরেনাস,ন্যাপচুন) সহ সকল স্থানে ঈশ্বরকে ব্যপ্ত বলা হয়েছে সেই মন্ত্রে।কিন্তু এই কোষ্ঠীর ছবিটিতে দেখবেন ২ ও ৩ নং ঘরে কেতু(Ket)ও রাহুর(Rah)কথা বলা আছে।এগুলো কি?


রাহু ও কেতুর বৈজ্ঞানিক নাম হল Ascending Lunar Node এবং Descending Lunar Node. আমরা জানি কাগজে একই জায়গায় দুইটি বৃত্ত আঁকলে তারা পরস্পরকে দুইটি বিন্দুতে ছেদ করে।ঠিক তেমনে চাঁদ ও সূর্যের উপবৃত্তাকার কক্ষপথদুটিও পরস্পরকে দুইটি বিন্দুতে ছেদ করে।এই দুইটি বিন্দুই হল Ascending Solar Node& Descending Solar Node বা রাহু ও কেতু


Ascending ও Descending Solar Node



পূর্ণ চাঁদ যখন এই দুইটি বিন্দুর একটিতে অবস্থিত থাকে তখন তার উপর পৃথিবীর ছায়া পড়ায় চাঁদকে দেখা যায়না অর্থাৎ চন্দ্রগ্রহণ হয় আর নতুন চাঁদ যখন এই দুটি বিন্দুর একটিতে থাকে তখন চাঁদের ছায়া সূর্যের উপর পড়ায় সূর্যকে দেখা যায়না অর্থাৎ সূর্যগ্রহণ হয়।বিজ্ঞানের এই চমকপ্রদ আবিস্কারটির উল্লেখ সর্বপ্রথম পৃথিবীর যে গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছিল তা হল সনাতন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদ(৫.৪০.৫)।


তাহলে পৃথিবী ছাড়াও ৭ টি গ্রহ (যার মধ্যে আসলে ৫টি গ্রহ,একটি উপগ্রহ চাঁদ ও একটি নক্ষত্র সূর্য) অবস্থান এবং রাহু ও কেতুর অবস্থান আমরা কোষ্ঠীর ছকে পেলাম।এই ৭টি গ্রহ এবং রাহু ও কেতুকে একত্রে বলা হয় নবগ্রহ যদিও আগেই বলেছি রাহু ও কেতু দুটি গাণিতিক বিন্দুমাত্র,কোন গ্রহ নয়।এছাড়াও পরবর্তীকালে বরুণ,প্রজাপতি ও যম নামের ৩ টি গ্রহকেও কোষ্ঠী তৈরীতে ব্যবহার করা শুরু হয় যেগুলো হল যথাক্রমে Uranus,Neptune ও Pluto। তবে এগুলো আকারে একদম ছোট হওয়ায় এবং অনেক দূরবর্তী হওয়ায় বেদাঙ্গ জ্যোতিষে এগুলোকে যৌক্তিকভাবেই ব্যবহার করা হতনা।


আর এর পর দুটি জিনিস অবশিষ্ট।গ্রহস্ফূট ও ভাবস্ফূট।এই দুটো জিনিস দেখলেই বুঝা যায় প্রাচীনকালে ভারতীয় ঋষিরা গণিত ও বিজ্ঞানে কি পরিমাণে দক্ষ ও জটিল ছিলেন।স্ফূট শব্দের অর্থ হল স্পষ্ট অবস্থান।এতক্ষণ তো আমরা দেখলাম গ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে ১২ ভাগের কোন ভাগে অবস্থিত তার কথা বলা আছে কোষ্ঠীতে।কিন্তু না,আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আছেন এটুকুই তাদের কাছে যথেষ্ট ছিলনা,ঢাকা মেডিকেলের কোন বিল্ডিং এর,কোন তলার কত নং রুমে আছেন এরকম একদম স্পেসিফিক তথ্য তারা দিতে চান।আর গ্রহস্ফূট হল একটি গ্রহ ১২ ভাগের যে ভাগে অবস্থিত সেই ভাগের ঠিক কোন বিন্দুতে সে অবস্থিত তার পরিমাপ।আমরা আগেই দেখেছি ১২ ভাগের প্রতিটি ভাগ ৩০ ডিগ্রী করে,মোট ৩৬০ ডিগ্রী।প্রতিটি ভাগকে আবার প্রথমে সমান ৩০ টি অংশে ভাগ করা হয়েছে,অর্থাৎ প্রতি অংশে ১ ডিগ্রী করে।সেই প্রতি অংশকে আবার সমান ৬০ কলায় ভাগ করা হয়েছে,সেই প্রতিটি কলাকে আবার ৬০ বিকলায় ভাগ করা হয়েছে।


এখন ধরুন লেখা আছে ম ২|২৫|২৯|৩৭ এর মানে হল ব্যক্তিটির জন্মের সময় মঙ্গল গ্রহ তার কক্ষপথে বৃষ রাশি এলাকায়(২ য় রাশি বৃষ রাশি) ২৫ তম অংশের ২৯ নং কলার ৩৭ নং বিকলা অংশে অবস্থিত,অর্থাৎ একদম সুপার স্পেসিফিক অবস্থান যাকে বলে,বিল্ডিং নং,তলা নং,রুম নং সব বলে দেয়া।


গ্রহস্ফুটের কিছু উদাহরণ


এরপর সর্বশেষ ধাপ,তা হল ভাবস্ফূট।ভাবস্ফূট কি তা জানতে হলে আমাদেরক্র জানতে হবে খুব পরিচিত একটি শব্দ আর তা হল লগ্ন


লগ্ন কী?
লগ্ন হল কোন একজন ব্যক্তি যে সময় যে স্থানে জন্ম নিয়েছেন,তার জন্মস্থানের যে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ঠিক সেই অংশটি কক্ষপথের ১২ টি ভাগের কোন অংশের সমান্তরালে ছিল তাই তার লগ্ন।অনেকেই রাশি আর লগ্নের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে।রাশি হল জন্মের মুহুর্তে চন্দ্র তার কক্ষপথে ১২ ভাগের কোন ভাগে ছিল তা।আর লগ্ন হল জন্মের মুহুর্তে ব্যাক্তির জন্মস্থানটি কক্ষপথের ১২ ভাগের কোন ভাগে অবস্থিত ছিল তা।

রাশি ও লগ্নের মধ্যে পার্থক্য।চাঁদের অবস্থান কোন ভাগের সমান্তরালে তা হল রাশি।আর ব্যক্তির জন্মস্থানের অবস্থান কোন ভাগের সমান্তরালে তা হল লগ্ন


ধরুন কলকাতায় জন্ম নেয়া কোন ব্যক্তির ভাবস্ফূটে লেখা হল লং ৩|৫|১১|৭ 
এর অর্থ হল ওই ব্যক্তির জন্মের সময় কলকাতা শহর পৃথিবী পৃষ্ঠে মিথুনরাশির ভাগের ৫ম ভাগের,১১ নং কলার ৭ নং বিকলার সমান্তরালে অবস্থিত ছিল।আর তাই লগ্ন ও ভাবস্ফূট পরিমাপ করতে হলে ব্যক্তির জন্মস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ কত তা জানা থাকতে হয়।

ভাবস্ফূট



অর্থাৎ এতটুকু পর্যন্ত কিন্তু কোষ্ঠীর ছকটি একদম গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মেনেই তৈরীকৃত হয়েছে।এখান পর্যন্ত এখানে কেবলই বিজ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে,আর কিছু নয়।এখন প্রশ্ন হল বার,তিথি,রাশি,নক্ষত্র,করণ,যোগ,গ্রহ,উপগ্রহ,চন্দ্র,সূর্য এসবের অবস্থান,গতিপথ এগুলোর কাজ কী? এগুলো কেন চর্চা করা হত?


উত্তরটা হল এই গাণিতিক বিষয়গুলো ব্যক্তির জন্মতারিখ,মৃত্যুতারিখ,গুরুত্বপূর্ণ উৎসবসমূহের বার্ষিকী পালন,ঋতু পরিবর্তনের সময় নির্ণয়,ফসল উৎপাদন,কর সংগ্রহ,খরা,বন্যা,ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগাম সম্ভাব্যতা নির্ণয় ইত্যাদি কাজে এই গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা বা গাণিতিক জ্যোতিষ ব্যবহার করা হত।আধুনিক বিজ্ঞানে এটার অধিকতর বিস্তৃত ধারাকেই বলা হয় Astronomy বা জ্যোতির্বিজ্ঞান।


এভাবে হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেল।গ্রীকরা,শকরা উপমহাদেশে এল।আর তারপর থেকেই শুরু হল সমস্যা।আগের গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা বা Astronomy যা কিনা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত তার সাথে নানা রং, রূপ মিশিয়ে প্রচলিত হতে লাগল গ্রীকদের কাছ থেকে শেখা ফলিত জ্যোতিষ বা Astrology. এতকাল যে গাণিতিক জ্যোতিষের(Astronomy) জ্ঞান ব্যবহার করা হল গাণিতিক উপায়ে এখন তা বাদ দিয়ে ফলিত জ্যোতিষের(Astrology) নামে শুরু হল ভবিষ্যৎ বলা,শুভ-অশুভ নির্ণয়,সৌভাগ্য-দূর্ভাগ্য,বিয়ে-জন্ম-মৃত্যুর ভালোমন্দ নির্ণয়ের এক অবাস্তব,কাল্পনিক ধারা।এই ফলিত জ্যোতিষ আসলে কী,কাদের কাছ থেকে ভারতীয়রা কীভাবে শিখল,এরমধ্যে কী কী আছে,কোন শাস্ত্রে এসবের অস্তিত্ব আছে কিনা,প্রাচীন ভারতীয় কোন বইতে এসবের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সনাতনী সমাজে কী কী তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব আগামী শেষ পর্বে।


সে পর্যন্ত বিদায়।


ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি 

Post a Comment

5Comments
  1. চমৎকার।
    এগিয়ে যাক অগ্নিবীর

    ReplyDelete
  2. অনেকদিন ধরে পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় আছি।

    ReplyDelete
  3. মানে যা হোক কিছু একটা ভারী ভারী জিনিস লিখে দিলেই হল। মানুষের ব্যক্তিগত চার্ট এ কোন গ্রহ কি অবস্থানে মানে কোন কোন রাশি তে রয়েছে এটা থেকে ভূমিকম্প, খরা, বন্যা ইত্যাদিই শুধু কাজে লাগানোর জন্য।
    মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাব নেই।
    সত্যি বলছি অগ্নিবিরের এই লেখা দেখে তাদের বিজ্ঞানী সাজার প্রবণতা আর বিশেষ করে মুসলিম দের মত হুজুর বিজ্ঞানীর প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।
    যেই শাস্ত্রের জন্য পণ্ডিত রা বছর এর পর বছর অধ্যয়ন, অনুশীলন করেও নিজেকে পণ্ডিত মনে করছেন না সেই ,শাস্ত্র কে আপনারা একটি প্ল প্রবন্ধে জানিয়ে পণ্ডিত করে ফেলছেন, এবং নিজেরাও দক্ষ পণ্ডিত হয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের মত করে তথ্য বার করছেন আর , বাদ বাকি বহিরাগত আক্রমণ কারীদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। বাঃ

    ReplyDelete
  4. জ্যোতি বাচস্পতির কোষ্ঠী দেখা বই থেকে হুবহু তুলে দিয়েছেন দেখছি।

    ReplyDelete
Post a Comment