দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







সনাতন শাস্ত্রে সম্পত্তি বণ্টন পদ্ধতি

Arindam
1

 



বাংলাদেশে হিন্দু আইন সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে যে তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে তার ই অংশ হিসেবে আমরা ২ পর্বে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম এই বিষয়ে শাস্ত্রীয় ও ঐতিহাসিক মতামত কী তা জানিয়ে।

 ১ম পর্বঃ 

 

জাতীয় আইন কমিশন তাদের দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১০-১১ অনুযায়ী বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে UNHRC এর সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণাকে সামনে রেখে সংস্কারের চিন্তার বিষয়টি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।UNDP এর অর্থায়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আইন কমিশনকে এই পারিবারিক আইন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য সাহায্য করেছে বলে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই আইনের পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনা চললেও গঠনমূলক আলোচনা বিষয়টি তেমন পরিলক্ষিত না হওয়ায় বিষয়টি কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে পরিণত হয়েছে অনেকটা। আইনের পক্ষে বিপক্ষে উভয়পক্ষের উগ্রতায় ও প্রচারে সাধারণ সনাতনীরা বিভ্রান্ত। একটি আইনের সমর্থন করতে হলেও যেমন এটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সম্যক ধারণা প্রয়োজন, তেমনি এর বিপক্ষে বলতে গেলেও সম্যক ধারণা প্রয়োজন। বাংলাদেশ অগ্নিবীর বিদ্বৎ পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা ২ পর্বে এই আইনের আদ্যোপান্ত নিয়ে আলেচনার চেষ্টা করব।
প্রথম পর্বে আমরা দেখব যে এই আইনে আসলে কী কী আছে এবং তা কতটুকু যৌক্তিকতা রাখে বর্তমান প্রেক্ষাপটে।
আর দ্বিতীয় পর্বে আমরা হিন্দু শাস্ত্রে এই আইনসমূহ সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে, এই আইনসমূহের ইতিহাস, সনাতনী পরম্পরায় তারা কীভাবে এলো এবং আমাদের পক্ষ থেকে এই নিয়ে কী প্রস্তাবনা আছে তা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রস্তাবিত আইনের প্রারম্ভিকায় বলা হয়েছে আইন কমিশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এই ৩ শহরের মোট ২৫০ জন হিন্দুকে তারা প্রশ্নমালা প্রেরণ করেছিলেন। এদের মধ্যে বিচারক,আইনজীবী, ছাত্র, সুশীল সমাজ, গৃহিণী প্রমুখ রয়েছেন। এবং এদের ভোটাভুটির ভিত্তিতেই তারা এই আইন সুপারিশ করেছেন। আইনের প্রতিটি সুপারিশের নিচে এই ২৫০ জনের কত শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়েছেন, কত শতাংশ না ভোট দিয়েছেন তা উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণাগত পরিসংখ্যানে একটি কথা আছে যাকে আমরা বলি Sample Size. ধরুন আপনি একটি কোভিড ভ্যাক্সিন বানালেন। সেটি প্রথমে ২ ধাপ ট্রায়াল পেরিয়ে ২য় ধাপে মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীদের উপরে ট্রায়াল দিয়ে সেই ট্রায়ালে সে পাশ করলে ৩ য় ধাপে স্বেচ্ছাসেবক মানুষদের উপর ট্রায়াল চালাতে হবে।সেই ট্রায়ালে পাশ করলেই কেবল তাকে আপনি মার্কেটে আনতে পারবেন।এখন আপনি ধরুন আপনার বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য সব মিলিয়ে ১০ জন জোগাড় করলেন এবং তাদের উপর ট্রায়াল চালালেন, বাদ দিন ১০ জন না; ১০০ জনের ওপরেই চালালেন। তাতে সফল হলেও কি আপনার ভ্যাক্সিন পাশ করবে? উত্তর হলো না, করবে না। আর তার কারণ হলো স্যাম্পল সাইজ।
যে জিনিসটা আপনি সারাবিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের উপর দিতে চাচ্ছেন মাত্র ১০০ বা ১০০০ লোকের উপর ট্রায়াল চালালেই তাকে উত্তীর্ণ বলে ঘোষণা করা যাবেনা। মোট স্বেচ্ছাসেবক যাদের উপর ট্রায়াল চালানো হয়েছে তাদের সংখ্যাটা অনেক বেশী হতে হবে। আর শুধু বেশী হলেই হবে না, স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন করতে হবে সব মহাদেশে, সব অঞ্চল থেকেই। উপমহাদেশ থেকেও নিতে হবে স্বেচ্ছাসেবক স্যাম্পল, আফ্রিকা থেকে নিতে হবে,ক্যারিবিয় অঞ্চল থেকে নিতে হবে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল, বাল্টিক অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, নর্দার্ন ইউরোপ, সাউথ আমেরিকা, নর্থ আমেরিকা সকল সম্ভাব্য অঞ্চল থেকেই স্বেচ্ছাসেবক নিতে হবে, তাহলেই কেবল বোঝা যাবে সব অঞ্চলের মানুষের জন্যই এটা নিরাপদ ও কার্যকরী কি-না। কেননা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় কিছু ভেদ আছে।
ঠিক তেমনি দেড় কোটির বেশী হিন্দু জনগোষ্ঠীর এতগুলো বড় বড় সিদ্ধান্ত কোন যুক্তিতেই মাত্র ২৫০ জনের ভোটে নির্ধারিত হওয়া সম্ভব নয়। এই যে ২৫০ জন তাদেরকে কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হলো? তারা কে কে? ছাত্র যাদের কথা বলছেন তারা কারা কারা? হিন্দু শাস্ত্র ও আইন নিয়ে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সেই ছাত্র, গৃহিণী প্রমুখদের যোগ্যতা কী কী?
অনলাইন অফলাইনের সবচেয়ে সক্রিয় হিন্দুধর্ম নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিগণ প্রায় কেউই ব্যাপারটি জানতেনই না।এমন কী পদ্ধতিতে আপনারা সেই ২৫০ জন নির্বাচন করলেন যাদের মধ্যে অনলাইন অফলাইনের বিভিন্ন জনপ্রিয় হিন্দু সংগঠনগুলোর কোন কর্তাব্যক্তি, শাস্ত্রজ্ঞ কারোর ই উপস্থিতি নেই? যাদেরকে দেখা গেছে এই প্যানেলে তাদের প্রায় সবাই সরকারের আস্থাভাজন এবং কাছের মানুষ বলে প্রতীয়মান। একজন জাতীয় সংসদের বিশেষ আসনের নারী সদস্য বা একজন সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিন্দু হলেও শাস্ত্রীয় বিষয়ে তাদের যোগ্যতা কী? একটা সময় একজন অহিন্দুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির অধিকার থাকবে কিনা তা নির্বাচন করার প্যানেলে নিজেই থাকতে পারেন কী?
এখানে তো লস অব অবজেক্টিভিটির বা উনি আদৌ নিরপেক্ষ কিনা এই প্রশ্নে সেই ব্যাপারটা চলে আসবে। আর শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর ২৫০ জনকে কেন? বাংলাদেশের বাকি সব অঞ্চলে কি হিন্দুরা থাকেন না? এই আইন কি তাদের জন্য নয়? তাহলে তাদেরকে বাদ দেয়ার ভিত্তি কী? বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের হিন্দু নারীরা, যাদেরকে কেন্দ্র করেই মূলত এই আইন সংস্কারের প্রস্তাবনা তাদের ভোট না নিয়েই, তাদের মতামত না জেনেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আসীন গুটিকয়েক ব্যক্তির মতামতের আদৌ কি কোন প্রাসঙ্গিকতা আছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু খুব ই প্রাসঙ্গিক।
এবার আমরা একনজরে দেখব প্রস্তাবিত আইনে কী কী পয়েন্ট উত্থাপিত হয়েছে।
১) বিবাহ নিবন্ধন
২) বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ
৩) বহুবিবাহ
৪)অসবর্ণ বিবাহ
৫) দত্তক
৬) প্রতিবন্ধীদের সম্পত্তি দান
৭) সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার
এই ৭ টি পয়েন্টের সবগুলো নিয়েই আলোচনা করা উচিত। তা না করে কেবল ৭ নং পয়েন্টটি নিয়েই অধিকাংশ সনাতনীরা কথা বলছেন যা হতাশাজনক। নিরপেক্ষ ব্যক্তি এভাবে শুধু একপাক্ষিকভাবে কথা বলতে পারেন না, এটা দৃষ্টিকটূ।
আইন কমিশনের প্রস্তাবনায় একটি জিনিস খুব ভালো লাগার মতো আর তা হলো প্রতিটি ধারার আগেই তারা বৈদিক ধর্মের উচ্চ প্রশংসা করেছে। বলেছে বেদে বর্ণবাদ নেই, বৈদিক সমাজে সকল মানুষের সমতা ছিল, বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থান এতই উঁচুতে ছিল যে অন্য ধর্মের সেই জায়গাতে পৌঁছাতে শত শত বছর লেগেছে।
প্রথমেই আমরা একদম বিতর্কহীন ধারাগুলো নিয়ে বলব। যেমন ৩ নং ধারা বা বহুবিবাহ ধারা। পবিত্র বেদে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। ভারতেও হিন্দু বিবাহ আইনে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং একমাত্র মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়া বড় কোন সম্প্রদায়ের জন্যই বহুবিবাহ সেখানে শাস্তিযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের হিন্দু আইনে তা নিষিদ্ধ নয়। এটি খুব ই লজ্জাজনক ব্যাপার। এবং এই দফায় তারাই প্রশংসা করছে যে বহুবিবাহের অনুমতি বর্তমান আইনে থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা খুব কম ই বহুবিবাহ করে, তারা এও বলছে বেদে বহুবিবাহ নেই এবং বৈদিক যুগে মানুষ খুব ই সভ্য ছিল, নারীরা অনেক উঁচু অবস্থানে ছিল বলে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল না। তারা এখনকার আইনে যে বহুবিবাহের অনুমতি আছে তা বাদ দিতে চায়। এই পুরো দফাটাই অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং এটার জন্য আইন কমিশন প্রশংসার দাবিদার। দুঃখজনকভাবে এটাকে নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখলাম না।
এরপর আরেকটি ধারা অসবর্ণ বিবাহ বিয়ে। প্রস্তাবিত আইনে স্পষ্ট স্বীকার করা হয়েছে যে পবিত্র বেদে ও বৈদিক যুগে জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা ছিলনা যেটা আসলেই সত্য। পবিত্র বেদের বর্ণাশ্রম ধর্ম গুণ ও কর্মভিত্তিক। গীতাতেও তাই বলা আছে। তাই বর্তমানে আমরা যাকে অসবর্ণ মনে করি তা অসবর্ণ নয়। একজন ভট্টাচার্য টাইটেলের নারী প্রকৌশলী ও একজন ঘোষ টাইটেলের পুরুষ প্রকৌশলী উভয়ের বর্ণই এক, তারা সমবর্ণ। তাই টাইটেলের ভিত্তিতে অসবর্ণ ঘোষণা করে দিয়ে সেই বিয়েকে অবৈধ বলা বেদ অনুযায়ীই অপরাধ। সুতরাং অসবর্ণ বিবাহ অবৈধ এই কালো আইন বাদ করা উচিৎ, এ নিয়ে কোন বেদ মান্যকারী সনাতনী বা এমনকি কোন মানবতাবাদী মানুষের ই আপত্তি থাকতে পারেনা।
এরপরের ৫ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে দত্তক নিয়ে। প্রচলিত হিন্দু আইনে দত্তক প্রথা অত্যন্ত লিঙ্গবৈষম্যমূলক। হিন্দু পুরুষরাই কেবল দত্তক নিতে পারবে, নারীরা পারবেন না। আবার হিন্দু পুরুষরাও কেবল পুত্র সন্তানই দত্তক নিতে পারবেন, কন্যা সন্তান দত্তক নিতে পারবেন না। আধুনিক যুগে এসে এমন কুপ্রথা মানা যায়না। যেখানে ঋগ্বেদে স্পষ্ট বলা হচ্ছে-
যদী মাতরো জনযত্ন বহিমন্যঃ কর্তা সুকৃতীরন্য ঋন্ধন্।।
অর্থাৎ যখন পিতামাতার উজ্জ্বল পুত্র ও কন্যার জন্ম তখন পুত্র হয়, পরিবারের সুকৃতির কর্তা আর কন্যা হয় পরিবারের অলংকারের ন্যায়।
সেখানে পুত্র ও কন্যা সন্তান নিয়ে এরকম বিভেদ স্পষ্টত বেদের আদর্শ বিরুদ্ধ।
মহাভারতেও আমরা দেখতে পাই মাতা কুন্তীকে দত্তক নিয়েছিলেন রাজা কুন্তীভোজ।অর্থাৎ হিন্দুধর্মে পুত্র সন্তান,কন্যা সন্তান সবাইকেই দত্তক নেয়া যায়।তাহলে কেন বিদ্যমান হিন্দু আইনে কন্যা শিশুকে দত্তক নেয়া যাবেনা?
নিঃসন্তান পুরুষ বা স্ত্রী যেকোন কারো কাছেই সন্তান লালনপালন করা অনেক বড় একটা স্বপ্ন হতে পারে।এতে বাধা দেয়া অমানবিক। আবার প্রকারান্তরে দত্তক নেয়ার আইন পুরোদমে থাকলে সমাজের অনেক ছিন্নমূল শিশু নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে। পবিত্র ঋগ্বেদের ৮ম মণ্ডলের ৯ম সূক্তটির একটি বড় অংশই সমাজের অনাথ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে মানবজাতিকে নির্দেশনা দিয়েছে। একজন অনাথ শিশু কন্যাও হতে পারে, পুত্রও হতে পারে।
তাই এই দফাটিও যৌক্তিক না বলে উপায় নেই।
এরপরের দফায় এসেছে প্রতিবন্ধীদের কথা। আইন কমিশন বলছে প্রচলিত হিন্দু আইনে শারীরিক মানসিক প্রতিবন্ধীরা বর্তমানে সম্পত্তি পান না। এতে তাদের জীবন অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিভীষিকাময় হয়ে দাড়ায় অনেকখানে। ভারতে হিন্দু আইনের মিতাক্ষরা শাখার অনুসরণ হয় এবং সেখানে The Hindu Inheritance (Removal Of Disabilities Act), 1928 রদ হওয়ায় প্রতিবন্ধীরাও সম্পত্তি পান যা দায়ভাগ শাখার অনুসারী বাংলাদেশের হিন্দু আইনে পায় না। উচ্চ আদালতের সুরক্ষা বলয়ে প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের সম্পত্তির সুরক্ষা দেয়া হবে, এই শর্তে এই দফাটিও অত্যন্ত যৌক্তিক ও মানবিক বলেই মনে হয়েছে।
২য় দফায় বলা হয়েছে বিধবা বিবাহ নিয়ে। সনাতন ধর্মে বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন, বেদমন্ত্র উচ্চারণে সপ্ত প্রতিজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক।তাই সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অতি অল্প। আইন কমিশনের প্রস্তাবনাতেও এই কথাটি প্রশংসার সাথে বলা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে সনাতন ধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। দেশের দেড় কোটির অধিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন সংসারেই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট মর্মান্তিক কারণ নেই এই ধরনের দাবী করা একদম ইশপের গল্পের মতই কাল্পনিক।
এমনকি পরকীয়ারত স্ত্রী হিন্দু উকিল স্বামীকে খুন করে মাটি চাপাও দিয়ে দিয়েছে এমন ঘটনাও আছে। বিবাহিত পুরুষ বা নারী ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যের সাথে পালিয়ে গেলে তখন সেই বিয়ের কী হবে? সেই বিপত্নীক স্বামী অথবা বিধবা স্ত্রীর তো অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে পুনরায় বিয়ে করার অনুমতি থাকা অযৌক্তিক না। (এখানে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে মৃতের সমান ধরা হয়েছে মনুস্মৃতি ৯.২১১ এর পতিত ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির ২.১৪০ এর আশ্রমত্যাগী,পিতৃদ্বেষী সূত্র অনুসারে)।
আবার পরাশর স্মৃতিতেও শ্লোক পাওয়া যায় বিধবাবিবাহের প্রসঙ্গে যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ "বিবাহ বিবাহের প্রচলন হইতে পারে কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার" এর ১ম খণ্ডে উল্লেখ করেছিলেন এবং এই শ্লোকটি তৎকালীন ভারববর্ষে বিবাহ বিধবা আইন পাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল-
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যোবিধিরতে।”
(পরাশর স্মৃতি ৪.৩০)
অর্থাৎ স্বামী চরিত্রহীন হয়ে পাপ দ্বারা পতিত হলে, মারা গেলে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে (অনুমতি ব্যাতিরেকে) বা বহুবছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকলে বা ক্লীব হলে স্ত্রী পুনর্বিবাহ করতে পারে।
একই ধরনের বিধান পুরুষের জন্যও রাখতে হবে এই শর্তে আরও কিছু সংযোজন বিয়োজন করে, নির্দিষ্ট স্পষ্ট কী কী কারণে বিচ্ছেদ আইনসম্মত ধরা হবে তা উল্লেখপূর্বক পুনর্বিবাহের আইন, বিধবা বিবাহের আইন রাখা রাখা যেতে পারে।
বিপত্নীকরা যদি বিয়ে করতে পারেন তাহলে সঙ্গত কারণে বিধবারা কেন করতে পারবেন না?তবে হ্যাঁ দুই ক্ষেত্রেই কারণ অতি যৌক্তিক ও স্পষ্ট হতে হবে, একে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে না নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেকোন পুরুষ বা নারী যদি তার স্ত্রী বা স্বামী কর্তৃক অসহ্য নির্যাতনের বা প্রতারণার স্বীকার হয় তার শর্তসাপেক্ষে অধিকার থাকা উচিৎ বিচ্ছেদের। তবে অবশ্যই এইক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ম রাখতে হবে যাতে করে এই আইনের অপব্যবহার করার সুযোগ খুব সীমিত থাকে। তবে এটা জেনে রাখা ভালো যে বাংলাদেশের হিন্দু আইনে আগে থেকেই সেপারেশনের আইন আছে, সেটাও একপ্রকার ডিভোর্স ই। তাই ডিভোর্সের আইন নতুন করে করা হলেও নতুন কিছুই আদতে যোগ হচ্ছে না।
আর বিভিন্ন অবৈধ পুনর্বিবাহ এবং বিয়ে করেও পরিবার, সন্তানকে ফেলে অন্য ধর্মের কারো সাথে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরকে তাদের প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী আইনের আওতায় এনে বিচার করতে চাইলে সেই বিচ্ছেদের আগে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, লাগবে লিগ্যাল ডকুমেন্ট, বিয়ের প্রমাণ। সেই দোষী ধর্মান্তরিতকে আইনিভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে এবং এরকম আইনি জটিলতায় সাহায্যের জন্য বিয়ের দালিলিক প্রমাণ রাখা যেতে পারে। তবে আইন কমিটি যে সুপারিশ করেছে যে রেজিস্ট্রেশনের সাথে হিন্দু বিয়ের বৈধতার কোন সম্পর্ক থাকবেনা সেটা অবশ্যই বলবৎ রাখতে হবে। কেননা হিন্দু বিয়ে কোন চুক্তিনামা নয় যে রেজিস্ট্রেশনের উপর এর বৈধতা নির্ভর করবে। একমাত্র বেদমন্ত্রের উচ্চারণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাই এর বৈধতানামা। তাই বিয়ে রেজিস্ট্রেশনকে ঐচ্ছিক এবং কেবলমাত্র বিপদে আপদে আইনি কাজে সহযোগিতার জন্য দেয়া পত্র হিসেবে বিবেচনায় রাখা হলে তাতে তেমন সমস্যা হবার কারণ দেখি না।
সর্বশেষ এবং সর্বপ্রধান যে দফা সেটা হলো নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার। এই বিষয়ে একটা কথা বহুল প্রচলিত যে আমাদের দেশে কি হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি পায় না? হয়তো প্রায় সবাই উত্তর দেবে না,পায় না।
কিন্তু এই কথাটাকে পুরোপুরি সত্য মানা যায়না। কেননা মেয়েরা স্থাবর সম্পত্তি না পেলেও অস্থাবর সম্পত্তি যেমন অর্থ,অলংকার ইত্যাদি রূপে অস্থাবর একটা ভাগ বিয়ের সময় পায় যেটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।সমস্যা হলো বর্তমানে সেই জিনিসটা মেয়ের সম্পত্তি হিসেবে নয় বরং পাত্রপক্ষের অন্যায় এবং বাধ্যতামূলক "দিতেই হবে" এমন আবদার হিসেবে ব্যয়িত হয়।ফলে দেখা যায় ঠিকই পিতা সম্পত্তির ভাগ অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে দিচ্ছে কিন্তু তা তার মেয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অধিকার বা সামর্থ্য প্রতিষ্ঠায় কোন কাজে লাগছে না। প্রাচীন সনাতনী পরম্পরায় মেয়েদেরকে বিয়ের সময় পিতৃকূল থেকে এভাবে অস্থাবর সম্পত্তির রূপেই পৈতৃক সম্পত্তি দেয়া হতো। এই সম্পত্তিকে বলা হতো স্ত্রীধন। এই স্ত্রীধনে অধিকার ছিল কেবল মেয়ের একার,স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোক তা চাইলেই ভোগ করতে পারত না। ফলে মেয়েটি তার নিজেরও একচ্ছত্র যথেষ্ট সম্পত্তি আছে এই অর্থনৈতিক ও মানসিক শক্তিতে বলীয়ান থাকতো। কিন্তু বর্তমানে যৌতুক প্রথার কারণে যে স্ত্রীধন স্বামীর ভোগ করা নিষিদ্ধ তা উল্টো স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি হয়ে গেছে,মেয়ের ই তাতে তেমন দখল থাকে না। ফলে পিতা স্ত্রীধন রূপে সম্পত্তি দিলেও তা মেয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগে খুব কম, হয়ে যায় যৌতুক।
অর্থাৎ আপনি আপনার মেয়েকে সম্পত্তি দেবেন কিনা সেটা তো পরের বিষয়, তাকে আপনি যাই দেন না কেন সেটা যে উদ্দেশ্যে দিচ্ছেন অর্থাৎ মেয়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য সেটা না হয়ে যদি সেটা পাত্রপক্ষের বস্তুগত লোভ চরিতার্থ করার উপায় হিসেবেই কেবল ব্যবহৃত হয় তাহলে তা দিয়ে কিন্তু কোন উপকার হচ্ছেনা।
এছাড়া বর্তমান সমাজে আমরা মেয়েদের শিশুকাল থেকেই সুশিক্ষা, আত্মনির্ভরশীলতা ও জাগতিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে সমানভাবে টিকে থাকার শিক্ষা ছেলেদের মতন করে সমানভাবে দিতে পারি নি। এখনো বিশাল একটি অংশে মেয়েদের শিক্ষার ভালো সুযোগ নেই, তাদেরকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘরের পুতুল করেই বড় করছে। যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘরের ছেলে সন্তানটি প্রতিযোগিতামূলক জগতে যতটা জায়গা করে নিতে পারছে মেয়েটি তা পারছে না। তার পদচারণা ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এমনকি একজন শিক্ষিত চাকুরীজীবি মেয়েও যাতে একটি ছেলের মতো সমানভাবে সবখানে পদচারণা রাখতে পারে, সেই পরিবেশ গত শত শত বছরে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এর ফলে হঠাৎ করেই এখন রাতারাতি আইন পরিবর্তন করেই আমরা তার ক্ষতিপূরণ করতে পারব না। কেননা মনের অজান্তেই আমরা মেয়েদেরকে পুতুল বানিয়ে রাখতে গিয়ে ছেলেদের উপর পিতামাতার ভরণপোষণ সহ বিভিন্ন দায়িত্বের অসম চাপ দিয়ে ফেলেছি যাকে সমাজ তথাকথিত পৌরুষের অংশ মনে করলেও বাস্তবে এটি পুরুষদের নিজেদের ই সৃষ্ট অসমতা যা পৌরুষত্বের মিথ্যা মোহে আমরা বুঝতে পারি না। তাই আমাদের এত শত বছরের সামাজিক যে অসম কাঠামো আমরা গড়ে তুলেছি তা আগে ভাঙতে হবে। শতভাগ দূর করতে হবে যৌতুক নামের কুপ্রথা, ছেলেরাই কেবল ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নেবে এই মিথকে ভাঙতে হবে, মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই বিদ্যমান সমাজে ছেলেদের মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হবে। তার আগে হঠাৎ করেই এই আইন আমাদের এত শতকের করা এতগুলো ভুলকে একদিনে শুধরে দিতে পারবে না। এতে বরং ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ছেলেটি ভাববে ভরণপোষণের দায়িত্ব তো প্রায় জায়গায় আমাকেই নিতে হচ্ছে, তাহলে আমি কেন সমান পাবো? মেয়েটি সম্পত্তি পেলেও তার স্ত্রীধন তার লোভী শ্বশুরবাড়ির খপ্পরে পড়ে পরিণত হবে যৌতুকে। আর সেই মেয়েটিকে আমরা পুরুষরাই ছোটবেলা থেকে তার সম্পত্তি কীভাবে রক্ষা করতে হবে সেই ক্ষত্রিয় শিক্ষা দিই নি। আবার তাকে কীভাবে তার ভাইটির মতো করে সমানভাবে প্রভাব খাটাতে হবে পরিবারে, দায়িত্ব নিতে হবে সেই শিক্ষাও দেয়নি পরিবার শৈশবে, তাকে বড় করেছে পুতুলের মতো করে। এই নির্মম সমাজিক বাস্তবতাগুলো মাথায় না রেখে কোন কার্যকর আইন করা কঠিন ব্যাপার।
তবে এই কথা অস্বীকার করলে চলবেনা অনেক পরিবার ই বর্তমানে আছে যেখানে মেয়ে সন্তানটিই তার পরিবারকে দেখে, ছেলে সন্তান নেই বা থাকলেও উচ্ছৃঙ্খল বা বয়সে বোনদের চেয়ে অনেক ছোট। আর এই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে যা প্রশংসনীয়। এসব ক্ষেত্রেও কিন্তু বাবা মাকে মোহশূন্য হয়ে সেই দায়িত্ব পালনকারী মেয়েকে নিজ উদ্যোগে উইলের মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে যথাযোগ্য সম্পত্তির মর্যাদা দিতে হবে। সবখানেই মুখস্থ নিয়ম মেনে চললেই হবে না।
যৌতুককে অবশ্যই অবশ্যই দূর করতে হবে, একদম শতভাগে নির্মূল করতে হবে। যৌতুক যতক্ষণ পর্যন্ত দূর করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত আইনের সঠিক ব্যবহার কোনভাবেই সম্ভব না। আমরা যতই নীতিকথা বলি না কেন, একটি পরিবারে ৩ বোন ১ ভাই হলে সেই ৩ বোনের বিয়েতে যৌতুক দিতে দিতেই বাবা মায়ের সম্পত্তির বিশাল অংশ খরচ হয়ে যায়। তারপরে যা বাকি থাকে তাও সমান অংশ তাদেরকে আবার দিলে ছেলে সন্তানটিই বরং বৈষম্যের স্বীকার হবে।
আর এখানে কিন্তু সেই ৩ মেয়ের কোন দোষ ই নেই। কেননা যৌতুকটা তারা মনের ইচ্ছায় দিচ্ছে না, দিচ্ছে পাত্রপক্ষের চাপে অর্থাৎ পুরুষদের চাপে। তাই পুরুষরা এই দায় এড়াতে পারেন না। পুরুষরা যৌতুক না নিলে এই সমস্যার সিংহভাগ ই দূর হয়ে যেতো।
এই প্রস্তাবিত আইনটির আরও বড় একটি সমস্যা হলো এখানে সম্পূর্ণভাবে পরিস্কার করা হয়নি যে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি কীভাবে সম্পত্তি পাবেন। বলা হয়েছে কোন হিন্দু সম্পত্তি পাবার পূর্বে ধর্মান্তরিত হলে সে আর সম্পত্তি পাবে না। কিন্তু ধরুন একটি ছেলে বা মেয়ে সম্পত্তি পাবার পরে ধর্মান্তরিত হলো। তাহলে কী হবে?
এই আইনটি যারা খসড়া করেছেন তারা খুব কাঁচা বাংলায় তাড়াহুড়ো করেই খসড়াটি করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। ভাষা ও যতিচিহ্ন ব্যবহারে প্রচুর ভুল এবং ভাষা অস্পষ্ট। যেমন এই আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে-
"কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) যদি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি গ্রহণ করার পূর্বে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা ধর্মান্তরিত না হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির অংশটি তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সমান অংশ পাবেন।"
সমস্যাটা খেয়াল করুন। ধরুন একটি ছেলে তার নাম "ক"। সে বিয়ে করলো একটি হিন্দু মেয়েকে, তার ছেলেমেয়েও হলো কিন্তু এখনো তার বাবা বেঁচে আছে বলে সম্পত্তি ভাগ হয় নি। এই অবস্থায় সে ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে সে কোন সম্পত্তি পরবর্তীতে পাবে না, তবে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে হিন্দুধর্মে থেকে গেলে তারা সেই সম্পত্তি পাবে। খুব ভালো কথা।
কিন্তু খেয়াল করুন "তারা হিন্দু থেকে গেলে" এরকম কোন কথা স্পষ্ট করা হয়নি এই আইনে। এমনও তো হতে পারে সে সম্পত্তি ভাগ হবার আগে বিয়েই করেছে অহিন্দু কাউকে নিজে ধর্মান্তরিত হয়ে। তো তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েও সবাই তখন অহিন্দু এবং সেই স্ত্রী ছেলেমেয়ে তো আর নিজেদের ধর্ম পরিবর্তন করেনি,তারা জন্ম থেকেই অহিন্দু। তাহলে কী সম্পত্তি সেই অহিন্দু স্ত্রী, ছেলেমেয়ে পাবে? তাহলে তো উল্টো সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেলো হিন্দুদের কাছ হতে!আবার একটা হিন্দু মেয়ে তার হিন্দু স্বামী, হিন্দু সন্তানকে ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে চলে গেলে তার হিন্দু স্বামী এবং সন্তানরা কী সম্পত্তি পাবে কিনা তাও পরিস্কার করা হয়নি কারণ ধারায় শুধু "স্ত্রী" শব্দটা আছে, স্বামী শব্দটা নেই।
এখানে অবশ্যই এই ধারা থাকতে হবে যে "ক" নামক ছেলে বা মেয়েটি সম্পত্তি বাবা থেকে পাবার শুধু আগে নয়, এমনকি সম্পত্তি ধরুন পেয়ে গেছে। পেয়ে যাবার ২০ বছর পরেও যদি সে ধর্মান্তরিত হয়ে যায় সরকার তার সেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তার নিকটস্থ সপিণ্ড ও সগোত্র যে হিন্দু আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিবে। আর এরইমধ্যে সে যদি সেই সম্পত্তি বিক্রয় করে ফেলে তাহলে তাকে ঋণখেলাপি আইনের আওতায় তার কাছ থেকে সমমূল্যের টাকা বা অন্য বিকল্প সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তা নাহলে হিন্দুরা অনেক সম্পত্তি হারাবে। এই কথা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কেননা ধর্মান্তরিত শুধু মেয়েরা হন না, ছেলেরাও হন প্রচুর পরিমাণে। তাই এই দায় শুধু মেয়েদের উপর চাপানো অযৌক্তিক। মূল কথা হলো এটা স্পষ্ট উল্লেখ করতে হবে যে এই সম্পত্তির মালিক কখনোই কোন অহিন্দু হতে পারবে না। কেউ ধর্মান্তরিত হলেই তার সেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো হিন্দুরা তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেননা।দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে হিন্দুরা বর্তমানে খুবই লোভী।জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি অতিমাত্রায় লোভের কারণে তারা তাদের সন্তান ৫ মিনিটও ধর্মশিক্ষার পিছনে ব্যয় করুক তা চাননা।এমনকি শিশু নিজে থেকে ধর্মশিক্ষা নিয়ে আগ্রহ দেখালেও তারা ধমক দেন এবং বলেন স্কুলের পড়ার বই পড়তে কারণ তাতে ভালো রেজাল্ট হবে,ভালো চাকরি পাবে।আবার সেই তারাই এখন কান্নাকাটি করছেন ধর্মান্তরিতদের জায়গা জমি হারানো নিয়ে।এই কথাগুলো যখন টাকাপয়সার লোভে লালায়িত হয়ে সন্তানকে দিনরাত টাকা বানানোর মেশিন তৈরী করতে ব্যয় করেছেন তখন আপনাদের মনে থাকেনা? আপনি ধর্মের জন্য জীবনে এমন কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন যে আপনার সন্তান ধর্মান্তরিত হবেনা? কর্ম করলে সেই ফল ভোগ করতেই হবে। আপনার নিজের ব্যর্থতার দায়,লোভের দায় এখন সম্পত্তির উপরে দিচ্ছেন কেন?
যাই হোক,শাস্ত্রে স্পষ্ট লেখা আছে পতিত বা মৃত বা আশ্রমত্যাগী ব্যক্তির সম্পত্তি তার সপিণ্ড-সগোত্রদের কাছে ফেরত চলে যাবে
(মনু ৯.২১০-২১১,যাজ্ঞবল্ক্য ২.১৪০)।
একজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি অর্থাৎ আশ্রমত্যাগী ব্যক্তি বা তার অহিন্দু স্বামী বা স্ত্রী ও অহিন্দু সন্তান সন্ততি কোনভাবেই যেন সম্পত্তি না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে,এই ব্যাপারে কঠোর আইন ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নিশ্চিত না করলে এই নতুন আইন বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো একটি অহিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যেখানে সরকার হিন্দুদের নিজেদের জমিজমার ই নিরাপত্তা দিতে পারছে না, বরং অর্পিত সম্পত্তি আইনের নানা জটিলতায় সরকারের কারণেই অনেক হিন্দু নিজের জমি হারাচ্ছেন, সেখানে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়া একজন অহিন্দুর জমি সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন, এটা কি বাস্তবে সম্ভব?
পুত্র ও কন্যা উভয়েই পিতামাতার জন্য সমান আদরের, সমান মর্যাদার। তাই অবশ্যই দুজনের ই পিতামাতার সবকিছুতে সমান অধিকার রয়েছে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাজের বিকৃত কাঠামো সেই অধিকারের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে নারী কি তার অধিকার পাবেনা হিন্দুধর্মে? সম্পত্তির অধিকার কি শুধুই পুরুষের? সনাতন ধর্ম সর্বদাই মানবিকতার, সমতার ধর্ম। তাই নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই এখানে সবকিছুর সমান অধিকার প্রাচীন আইনবিদ ঋষিগণ নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু কী উপায়ে তারা উভয়ের জন্য সম্পত্তির সমবন্টন নিশ্চিত করেছেন তা আমরা কেউ না জেনেই তুমুল তর্ক বিতর্ক করে চলেছি গত কয়েকদিন ধরে। আর আগামী পর্বে সেই রহস্যের ই উন্মোচন হবে।
আগামী পর্ব যেটা এই প্রবন্ধ সিরিজের আসল পর্ব,মূল পর্ব, সেখানে আমরা দেখব শাস্ত্রীয়ভাবে আসলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার, নারী পুরুষের অধিকার শাস্ত্র অনুযায়ী কেমন,হিন্দু আইনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং সম্পত্তি নিয়ে এই বিবাদের শাস্ত্রীয় ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে আমাদের বিশদ গবেষণা ভিত্তিক প্রস্তাবনা।এই পর্বটি ছিল মূলত আমাদের আগামী মূল পর্বের একটি ভূমিকা মাত্র।তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আগামী পর্বটি না পড়েই কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য না করার।

 

২য় পর্বঃঃ

 

আমরা আলোচনা করব হিন্দু আইনে সম্পত্তির বন্টনে শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও ইতিহাস নিয়ে।আমরা দেখবো হিন্দু শাস্ত্রসমূহে আসলে পুত্র,কন্যা,বিধবা নারী এদের সম্পত্তি কীভাবে বন্টন করতে বলা হয়েছে।


যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।


মহর্ষি মনুর এই অমর বচনটি অনেকাংশেই সনাতন ধর্মে নারীর অবস্থানের রূপক।যেখানে নারী পূজিত হয় সেখানে দিব্যশক্তি বিচরণ করে। যে সমাজে নারী পূজিত হন না, তাদের সর্বক্রিয়াই নিস্ফল হয়ে যায়।


আমাদের সনাতন ধর্মের চতুরাশ্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হল গার্হস্থ্য। গার্হস্থ্য জীবনের তথা পারিবারিক বলয়ের  একটি আবশ্যিক পর্যায় হলো বয়সকালে সন্তানাদির মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তির বন্টন-বিভাজন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক ঘটনাটিকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যই রাষ্ট্রীয় কিছু সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে যার বড় একটি অংশের উৎস মূলত ওই সম্প্রদায়সমূহের ধর্মীয় রীতিনীতি হতে আগত। এই প্রশ্নটি খুব ই জনপ্রিয় যে সনাতন পরম্পরায় পৈতৃক সম্পত্তির বন্টন কী উপায়ে হয়। সময়ের আরও একটি স্পর্শকাতর জিজ্ঞাসা হলো মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাওয়া উচিত কিনা। মেয়েদের ব্যাপারে প্রশ্নটি এজন্যই আসে যে সাধারণত বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে স্থানান্তরিত হন,‌ ছেলেটি নিজের বাবা মায়ের সাথেই রয়ে যান। তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বাবা মায়ের অবর্তমানে ছেলেটি সেই বসতভিটায় মালিকানা প্রাপ্ত হলেও মেয়েটি বাংলাদেশের প্রচলিত হিন্দু আইনে তা হন না। এখন প্রশ্ন আসে ভারতে হিন্দু মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অংশীদার হন, তবে বাংলাদেশে নয় কেন। নারীদের সর্বোচ্চ মূল্য দেয়া সনাতন ধর্মের নারীদের নিয়ে এই ক্রমশ প্রকট হতে থাকা প্রশ্নটিরই উত্তর আজ খোঁজার চেষ্টা করব সনাতন ধর্মের ঐশ্বরিক গ্রন্থ পবিত্র বেদসহ প্রাচীন সনাতন আইনশাস্ত্র ও বাংলাদেশের বিদ্যমান হিন্দু সমাজের বাস্তবতার নিরিখে।


যেহেতু সনাতন ধর্মের একমাত্র ঐশী ধর্মগ্রন্থ, সর্বোচ্চ সংবিধান পবিত্র বেদ তাই বেদের আলোকে আমরা যখন প্রথমেই ব্যাপারটিকে দেখি আমরা দেখতে পাই পবিত্র বেদে পুত্র ও কন্যা সন্তান উভয়েই সমান স্নেহ, মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।


পবিত্র ঋগ্বেদের ৩.৩১.২ এ পরমেশ্বর জ্ঞানদান করছেন-


যদী মাতরো জনযত্ন বহিমন্যঃ কর্তা সুকৃতীরন্য ঋন্ধন্।।


অর্থাৎ যখন পিতামাতার উজ্জ্বল পুত্র ও কন্যার জন্ম তখন পুত্র হয় পরিবারের সুকৃতির কর্তা আর কন্যা হয় পরিবারের অলংকারের ন্যায়।




বৈদিক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত শাস্ত্র নিরুক্তের ৩য় অধ্যায়ের ৪র্থ খণ্ডের প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে, "কন্যা পুত্রের ভাব অর্থাৎ কন্যা পুত্র হয়ে থাকে।" 


৭নং শ্লোকে বলা হয়েছে-

অবিশেষেণ মিথুনাঃ পুত্রা দায়াদা ইতি।


অর্থাৎ যেহেতু পুত্রজন্ম ও কন্যাজন্মে প্রজননযজ্ঞ ও রেতঃসেক একই তাই দৌহিত্র ও পৌত্রে মানুষের মনোবৃত্তি একই প্রকারের। সেই জন্য অনেক ধর্মবেত্তা মনে করেন পুত্র ও কন্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, উভয়েই নির্বিশেষে পিতৃধনের অধিকারী। মিথুনাঃ পুত্রা- স্ত্রীরূপ ও পুরুষরূপ পুত্র। কন্যাও পুত্র, পুত্রও পুত্র, একজন স্ত্রীরূপ, আরেকজন পুরুষরূপ।




৮নং শ্লোকে বলা হয়েছে-

তদেতদৃকশ্লোকাভ্যামভূক্তম

তৎ এতৎ ঋক্ শ্লোকাভ্যাং অভ্যূক্তম্।


অর্থাৎ পুত্র ও কন্যা উভয়েই যে পিতৃধনের অধিকারী তা একটি বৈদিক ছন্দবদ্ধ শ্লোক দ্বারা সমর্থিত।



কিন্তু কোন সেই বৈদিক শ্লোক? বলা হচ্ছে অঙ্গাদঙ্গাৎ সৎভবসি নামক সেই ছন্দবদ্ধ শ্লোকটি জৈমিনি গৃহ্যসূত্রের শ্লোক, যা দিয়ে পুত্র কন্যা উভয়েরই পিতৃধনের অধিকার সমর্থিত।


৯নং শ্লোকে জৈমিনি গৃহ্যসূত্রের সেই বৈদিক শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে-

অঙ্গাদঙ্গাৎ সৎভবসি হৃদয়াদধিজায়সে।

আত্মা বৈ পুত্রনামসি স জীব শরদঃ শতম্।।

(জৈমিনি গৃহ্যসূত্র ১।৮)


অর্থাৎ জনকের রেতই সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়।রেত জনকের সর্বাঙ্গসম্ভূত (সর্ব অঙ্গ হতে সম্ভূত) এবং হৃদয়াধিজাত (হৃদয় হতে অধিজাত)। সন্তান জনকেরই অবয়ব, দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। একজন পিতা ও অপরজন পুত্র। পুত্র হোক বা কন্যা হোক উভয়েই জনকের সর্বাঙ্গসম্ভূত ও হৃদয়াধিজাত, উভয়েই একই বস্তু, এদের মধ্যে পার্থক্যের লেশ মাত্র নাই। একজন পিতৃধনের অধিকারী হলে অপরজন পিতৃধনের অধিকারিণী হবে না কেন? এজন্যই অবিশেষেণ মিথুনাঃ পুত্রা দায়াদা ইতি- এই কথা সম্পূর্ণ সঙ্গত।







১০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে পুত্র ও কন্যা উভয়ের ই পিতৃধনের অধিকার সমর্থনে ধর্মসূত্রের শ্লোক উদ্ধৃত করা হচ্ছে-


অবিশেষেণ পুত্রানাং দায়ো ভবতি ধর্ম্মতঃ।

মিথিনানাং বির্গাদৌ মনুঃ স্বায়ম্ভুবোহব্রবীৎ।।


অর্থাৎ পুত্র ও কন্যা অবিশেষে পিতৃধনের অধিকারী এর সমর্থনে এক্ষণে ধর্মশাস্ত্রের শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি। সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বায়ম্ভূব মনু বলিয়াছেন- পিতৃধনে পুত্র ও কন্যার সমান অধিকার, এ বিষয়ে পুত্র ও কন্যার মধ্যে কোন ভেদ নাই।


(উল্লেখ্য, নিরুক্তে উপর্যুক্ত শ্লোকটি মনুর নামে উদ্ধৃত হলেও মনুসংহিতার বর্তমান সংস্করণে এই শ্লোকটি পাওয়া যায় না। নিরুক্তের এরকম অসংখ্য জায়গায় দেখা যায় প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রসমূহ থেকে বিভিন্ন শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে যা সেই ধর্মশাস্ত্রসমূহের বর্তমান সংস্করণে নেই।এটিও একটি প্রমাণ যে স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিশাস্ত্রে নানা মাত্রায় পরিবর্তন ঘটেছে।)




অর্থাৎ সংস্কৃততে পুত্র বলতে পুরুষ ও স্ত্রী এই দুইপ্রকার সন্তানকেই বোঝানো হয়। দুই ই পুত্র তথা সন্তান সমান মর্যাদার, উভয়েই জনকের অঙ্গ হতে উৎপন্ন, হৃদয় হতে অধিজাত। দুজনের ই সমান অধিকার ও সমান দায়িত্ব রয়েছে। পিতৃধনে পুত্র ও কন্যার সমান অধিকার তা স্বয়ম্ভূ মনু বলে গেছেন।


আবার ঋষি যাস্ক নিরুক্তে পবিত্র ঋগ্বেদের ৩.৩১.১ নং মন্ত্রের ব্যখ্যায় অনেক আচার্যের মত উল্লেখ করে বলেছেন-


শাসদ্বহ্নির্দুহির্তুনপ্ত্যং গাদ্বিদ্বা ঋতস্য দীধিতিং।

পিতা যত্র দুহিতুঃ সেকমৃঞ্জন সংশগ্ম্যেন মনসা দধন্বে।।


অর্থাৎ পুত্র ও কন্যার প্রজনন যজ্ঞ এবং তাহার বিধান একই প্রকারের অর্থাৎ পুত্রের জন্মেও যে মন্ত্রে ও যে বিধানে গর্ভাধান করিতে হয় কন্যার জন্মেও সেই একই মন্ত্রে,একই বিধিতে গর্ভাধান করিতে হয়।যে বিধানে পুত্রজন্মে রেতঃসেক করে সেই বিধানেই কন্যা জন্মেও রেতঃসেক করে। কন্যার গর্ভে পুত্র জন্মিলে সেই পুত্রকে পুত্রের পুত্রই মনে করে, দৌহিত্র ও পৌত্রের যে কোন পার্থক্য আছে তা মনে করে না।এ ই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করলে এটিই কী স্পষ্টভাবে প্রতীত হয় না  যে কন্যা ও পুত্র একই বস্তু? পুত্র ও কন্যার মধ্যে যে ভেদ তা কাল্পনিক মাত্র, তার কোন যথার্থতা নাই। তাই পুত্র যদি পিতৃধনের অধিকারী হয়, তবে কন্যা হবে না কেন?




শাস্ত্রের প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ উক্তিগুলো আমরা দেখলাম। এখন আমাদের জানতে হবে স্মৃতিশাস্ত্র সম্পর্কে। স্মৃতিশাস্ত্র কী জিনিস তা জানলেই আমাদের কাছে এর প্রয়োগটাও পরিস্কার হবে। স্মৃতিশাস্ত্র হলো বেদের নির্দেশনার অনুকূলে বিভিন্ন যুগে ঋষিদের প্রণীত শাস্ত্র। বেদাদি শাস্ত্রে যে আদর্শ উদ্ধৃত বাস্তবে তার প্রয়োগকারী নীতিমালা প্রণয়ন করাই স্মৃতিশাস্ত্রের কাজ। পবিত্র বেদ বলছে কন্যা ও পুত্র সন্তান সমান মাহাত্ম্যপূর্ণ। কিন্তু পবিত্র বেদে ঈশ্বর কোথাওই আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির বন্টন নিয়ে কোন আদেশ দেননি। কেন? 


এর করণ হলো পবিত্র বেদে শুধু সেইসব প্রসঙ্গই উল্লেখিত যা শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়। যেমন ধরুন বেদ বলবে অগ্নিসংযোগ অন্যায় কর্ম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ,এই আদর্শটি শাশ্বত বলেই বেদে এর উল্লেখ আছে। সব যুগে,সব কালেই অগ্নিসংযোগ করা খারাপ কাজ।

কিন্তু অগ্নিসংযোগের শাস্তি কী হবে তা বেদ বলবে না। কেননা অগ্নিসংযোগের শাস্তির মাত্রা দেশ,কাল,পাত্র, পরিস্থিতিভেদে পরিবর্তনীয়। আর যা পরিবর্তনীয় তা কখনো বেদে উল্লেখিত থাকবে না।


ঠিক তেমনি পৈতৃক সম্পত্তির বন্টন কীভাবে হবে, কোন অনুপাতে হবে ইত্যাদি দেশ, কাল, পাত্র, পারিবারিক অবস্থা, পরিস্থিতি ইত্যাদি ভেদে পরিবর্তনীয়। ধরা যাক একটি পরিবারে এক ছেলে, এক মেয়ে।ছেলেটি মাদকাসক্ত বা পিতামাতার অবাধ্য বা দুশ্চরিত্র বা জুয়াড়ি। এখন সেই পরিস্থিতিতে বাবা যদি দেখেন আমি এই ছেলেকে সম্পত্তি দিলে সে এটাকে ছারখার করে ফেলবে তবে তিনি ছেলেকে তার উইল থেকে বাদও দিতে পারেন।


আবার ধরুন পরিবারের মেয়েটি অনেক সচ্ছল, উচ্চশিক্ষিতা চাকুরীজীবী এবং তার স্বামীও অনেক স্বচ্ছল ধনী পরিবারের। তারা অনেক দূরে থাকে এবং মেয়েটি তার বাবা মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে না। অপরদিকে তার ভাই অতটা পড়াশেনা করেনি, সে একদম গরীব। এক্ষেত্রে বাবা চাইতেই পারেন সবটুকু সম্পত্তি ছেলেটিকে দিয়ে যেতে।


ধনকুবের বিল গেটস ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি তার সন্তানদের জন্য কোন সম্পত্তি রেখে যাবেন না, তার সন্তানরা যেন নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হন। তার বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি তিনি দাতব্য সংস্থায় দান করে দেবেন।


অর্থাৎ আমরা দেখছি সম্পত্তির বন্টন পরিস্থিতিভেদে পরিবর্তনশীল। আর তাই অপরিবর্তনীয় বেদে এটি নিয়ে নির্দেশনা দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।কিন্তু বেদে সবসময় পুত্র ও কন্যা সন্তানকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে।আর এটাই হল ঈশ্বরের ঈঙ্গিত।এই ইঙ্গিতকে ভিত্তি করে সমাজের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা মাথায় রেখে ঋষিগণ বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র যেখানে এই সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিস্তারিত নিয়মাবলী পাওয়া যায়। আর এমন ই দুটো স্মৃতিশাস্ত্র হলো মনুস্মৃতি ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি। আর এই দুটি শাস্ত্রের ওপর করা দুটি বিখ্যাত ভাষ্যের ওপর ভিত্তি করেই আজ সমগ্র ভারত ও বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মালম্বীদের পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়।


বাংলা ও আসাম ব্যাতীত সমগ্র ভারতে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির উপরে লিখিত কর্ণাটকে জন্ম নেয়া আইনবিদ বিজ্ঞানেশ্বরের মিতাক্ষরা নামক ভাষ্যের অনুসরণে সম্পত্তি বন্টন করা হয়।


অপরদিকে বাংলা ও আসামে মনুস্মৃতির উপরে লিখিত জীমূতবাহনের দায়ভাগ নামক ভাষ্যের অনুসরণে সম্পত্তির বণ্টন করা হয়।


মূলত মিতাক্ষরা শাখা তুলনামূলক রক্ষণশীল হওয়ায় এর মধ্যে প্রগতিশীল কিছু পরিবর্তন এনে মনুস্মৃতির উপর ভিত্তি করে দায়ভাগ ভাষ্য রচনা করেন জীমূতবাহন।


যেহেতু বাংলা ও আসাম অঞ্চলে দায়ভাগ শাখাই প্রতিষ্ঠিত এবং স্মৃতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে মনুস্মৃতি যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির উপর অগ্রাধিকার পায় তাই বাংলাদেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনায় একমাত্র দায়ভাগ শাখাই প্রাসঙ্গিক। তাই আমরা এখন আলোচনা করব দায়ভাগ শাখা অনুযায়ী সম্পত্তির উত্তরাধিকার বণ্টন কীভাবে সম্ভব।


দায়ভাগ কী তার ব্যখ্যায় জীমূতবাহন বলছেন-

বিভাগোহর্থস্য পিত্রাস্য পুত্রৈর্যত্র প্রকল্প্যতে।দায়ভাগ ইতি প্রোক্তং

(দায়ভাগ ২)


অর্থাৎ পিতার ধনের যে ভাগ পুত্রগণ করে তাই দায়ভাগ।


আমরা আগেই দেখিয়েছি যে পুত্র দুই প্রকার, স্ত্রীপুত্র ও পুরুষ পুত্র। তবে এখানে পুত্র বলতে জীমূতবাহন কেবল পুত্র ও কন্যাকেই বুঝাননি, পরের শ্লোকে লিখেছেন-


পিত্রস্যতি পুত্রৈরিতি চ দ্বয়মপি সম্বন্ধিমাত্রোপলক্ষণং।

(দায়ভাগ ৩)


অর্থাৎ এখানে পিত্র ও পুত্র এই দুইটি শব্দ উপলক্ষ মাত্র,এর দ্বারা যাবৎ সম্পর্কীয় সমস্ত অধিকারীকে বুঝায়।অর্থাৎ যারা যারা অধিকারীর সম্পত্তি পেতে পারে সবাইকেই এই পদ দ্বারা নির্দেশ করা হয়।শেষ লাইনে লিখেছেন-


"দায়ভাগ বিবাদ পদ উদ্ধৃত করিয়া নারদও মাতৃ প্রভৃতির ধন বিভাগ প্রদর্শন করিয়াছেন।" অর্থাৎ এখানে পুত্র না পিত্র পদ দ্বারা কন্যা,পুত্র,মাতাসহ যারা যারা সম্পত্তি পেতে পারেন তাদের সবাইকেই বুঝায়।


এখন দায়ভাগ শাখা অনুসারে কারা কারা এই সম্পত্তি পেতে পারে? যারা সপিণ্ড ও যারা সগোত্র তারা।আর এই সপিণ্ড কে আর সগোত্র কে এই দুটো শব্দের সঙ্গা নিয়ে মতভেদ ই আলাদা দুটো শাখা দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা সৃষ্টি হবার অন্যতম কারণ।


দায়ভাগ শাখা অনুসারে মোট ৫৩ জন ব্যক্তি আছেন যারা একজন ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন।তাদের মধ্যে প্রথম ১০ জনের নাম প্রাসঙ্গিক হওয়ায় উল্লেখ করলাম।


১। পুত্র

২। পুত্রের পুত্র

৩। পুত্রের পুত্রের পুত্র

৪। স্ত্রী, পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের পুত্রের স্ত্রী।

৫। কন্যা

৬। কন্যার পুত্র

৭। পিতা

৮। মাতা

৯। ভাই, সহোদর ভাই না থাকলে বৈমাত্রেয় ভাই।

১০। ভাই এর পুত্র, সহোদর ভাই না থাকলে বৈমাত্রেয় ভাই এর পুত্র।


অর্থাৎ পিতার অবর্তমানে পুত্র পাবে সম্পত্তি, পুত্র জীবিত নেই কিন্তু নাতি আছে এমন হলে নাতি, নাতি জীবিত নেই কিন্তু নাতির ছেলে আছে জীবিত তাহলে সে, তাও না থাকলে নিজের বিধবা স্ত্রী অথবা পুত্রের বিধবা স্ত্রী…, তাও না থাকলে কন্যা, তা না থাকলে কন্যার পুত্র, তারপরের সিরিয়ালে যিনি মারা গিয়েছেন তার পিতা,তারপর মাতা, এরাও না থাকলে ভাই/সৎ ভাই, এরাও মা থাকলে ভাই/সৎ ভাইয়ের ছেলে।


খেয়াল করলে দেখবেন দায়ভাগ শাখার আইনেও কন্যা পিতার সম্পত্তি পাবার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ৫ম ক্রমে অবস্থান করেন। মূলত ৫৩ জন অধিকারীর মধ্যে ৫টি স্থানে নারী আধিকারিক রয়েছেন। এই ৫টি স্থান হলো-


স্ত্রী/পুত্রের স্ত্রী/পৌত্রের স্ত্রী/প্রপৌত্রের স্ত্রী, কন্যা, মা, পিতামহী এবং প্রপিতামহী।


দায়ভাগমিতাক্ষরা টীকা পড়লেই আপনারা দেখতে পাবেন সম্পত্তি বণ্টনের বিভিন্ন নিয়মে তৎকালীন স্মৃতিকারদের মধ্যে অনেক মতভেদ ছিলো। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বিষ্ণু একেকস্থানে অনেক বিষয়েই নিয়ম লেখা ছিলো ভিন্ন ভিন্ন। যেমন ধরুন পিতার সম্পত্তিতে পুত্রদের স্বত্ব কখন জন্মাবে? এর উত্তরে মনু ও যাজ্ঞবল্ক্যের দুইধরনের মত। মনু তথা দায়ভাগ মতে পিতা যে পর্যন্ত জীবিত থাকবেন সে পর্যন্ত পিতাই সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিকারী। সেখানে পুত্রদের কোন অধিকার নেই। অপরদিকে মিতাক্ষরা তথা যাজ্ঞবল্ক্যে পুত্রদের জন্ম মাত্রই সেই সম্পত্তিতে পুত্রদের স্বত্ব জন্মে, পিতার একচ্ছত্র অধিকার নেই। পিতা চাইলেও নিজ সিদ্ধান্তে সম্পত্তির বিক্রয় ইত্যাদি করতে পারবেন না। এছাড়া মাতার সম্পত্তি কেমন হবে, বিধবাদের সম্পত্তি, ক্ষেত্রজ পুত্রের সম্পত্তির বিভাগ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই স্মৃতিশাস্ত্র সমূহের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।


এই ভিন্নতার কারণ আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। একমাত্র বেদই অপরিবর্তনীয় ও সর্বজনীন। স্মৃতিশাস্ত্র সমূহ সর্বকালীন নয়, অপরিবর্তনীয় কোন সংবিধান নয়। যুগ, কাল, সমাজ, প্রয়োজন ভেদে নতুন স্মৃতিকার তথা বেদজ্ঞ আইনবিদদের দ্বারা নতুন আইন প্রণয়ন হতে পারে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে বর্তমানে যে হিন্দু আইন রয়েছে তা অতীতেও পরিবর্তিত হয়েছে অনেকবার, ভবিষ্যতেও তা প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে।


এখন আমরা কিছুটা বাস্তবিক প্রয়োগের দিকে যাব, কিভাবে হিন্দু সমাজে স্মৃতি শাস্ত্রকারগণ কন্যা সন্তানকে তৎকালীন সময়ে সম্পত্তি দেবার উপায় বলে গেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল পৈতৃক ভিটেবাড়ি একটি অখণ্ড একক হিসেবে রাখা এবং এতদসত্ত্বেও বিয়ের পর কন্যা ও জামাতার সাথে কোন ধরনের সম্মুখ মোকাবেলা ছাড়াই সম্পত্তির উত্তরাধিকার  কন্যার হস্তগত হয় এবং কোনভাবেই যাতে জামাতা শুধু সম্পত্তির লোভে কন্যাকে অত্যাচার করতে না পারে, কন্যার সম্পত্তিকে ভোগ করতে না পারে তার বিধান রেখে যাওয়া।


আর তৎকালীন এই উপায়কে বলা হতো স্ত্রীধন। স্ত্রীধন হলো বিয়ের সময় এবং বিয়ের পর পিতৃকূল ও শ্বশুরালয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে দেয়া কন্যাকে উত্তরাধিকার সম্পত্তির অস্থাবর রূপ। এখন আমরা বিস্তারিতভাবে  স্ত্রীধন নিয়ে জানব।


রামায়ণের আদি পর্বে দেখা যায় রাজা জনক মাতা সীতাকে বিয়ের সময় পৈতৃক উত্তরাধিকার হিসেবে স্ত্রীধন দিচ্ছেন-


হিরণ্ময় সুবর্ণস্য মুক্তানাম বিদ্রুমস্য চ।

দদৌ রাজা সুসংহৃষ্ট কন্যা ধনম অনুত্তমম।।

(বাল্মীকি রামায়ণ আদিপর্ব ১.৭৪.৫,৬)


অর্থাৎ রাজা জনক হৃষ্টচিত্তে কন্যাকে স্বর্ণ,রৌপ্য, মুক্তা,কোরালখচিত আদর্শ কন্যা ধন(স্ত্রীধন) বা Bridal Rich প্রদান করলেন।




আর আমরা মোটামুটি সবাই জানি এই স্ত্রীধন বা কন্যা সন্তানের বিয়ের সময় পিতা হতে প্রাপ্ত সম্পত্তি প্রচলিত আইনে পরবর্তীকালে কেবল সেই কন্যার কন্যাসন্তানরাই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হন।মূলত মনুসংহিতা ৯.১৩১ নং শ্লোক অনুসারে মায়ের পিতৃকূল হতে প্রাপ্ত যত সম্পত্তি তার আইনত উত্তরাধিকারী মেয়ে সন্তান।


স্ত্রীধন হল বিয়ের সময় কন্যা বিভিন্ন উৎস থেকে যে ধন প্রাপ্ত হয়, তা কী কী?


অধগ্নধ্যাবাহনিকং দত্তঞ্চ প্রীতিকর্মণি।

ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়বিধং স্ত্রীধন স্মৃতম।।

(মনু ৯.১৯৪)


অর্থাৎ ৬ ভাবে কন্যা স্ত্রীধন প্রাপ্ত হয়– অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, প্রীতিদত্ত, পিতৃ, মাতৃ, ভ্রাতৃ কর্তৃক যা দেয়া হয়।একই কথা নারদস্মৃতি ১৩.৮ এও পাওয়া যায়।




এর মধ্যে অধ্যগ্নি হলো সেই অংশ যা অগ্নি সন্নিধানের সময় কন্যা উপহার হিসেবে পায়। বর অধ্যাবাহনিক হলো যা বিয়ের পর শ্বশুরালয়ে যাবার সময় পিতৃকূল থেকে সম্পত্তির অংশ হিসেবে এর সমমানের কোন অস্থাবর উপহার মেয়েকে দিয়ে দেন। এদের উৎসগুলো নিম্নরূপ–


১। অধ্যগ্নি - বিবাহের সময় অগ্নি সন্নিধানকালে প্রদত্ত অস্থাবর সম্পদ।

২। অধ্যাবাহনিকম্ - পতিগৃহে যাওয়ার সময় পিতৃ ও মাতৃকূল থেকে যে ধন উপহার হিসেবে নিয়ে যায়।

৩। প্রীতিকর্মণি - প্রসন্নতার ফলে পতি কর্তৃক প্রদত্ত।

৪। ভ্রাতৃ প্রাপ্তম্ - ভাই থেকে প্রাপ্ত।

৫। মাতৃ প্রাপ্তম্ - মাতা অথবা মাতৃস্থানীয় সম্পর্কযুক্ত কারো থেকে থেকে প্রাপ্ত।

৬। পিতৃ প্রাপ্তম্ - পিতা অথবা পিতৃস্থানীয় সম্পর্কযুক্ত কারো থেকে প্রাপ্ত।


এরমধ্যে অধ্যগ্নিভাগ এবং অধ্যাবাহনিকম্ ভাগকে কাত্যায়নসহ বিভিন্ন স্মৃতিতে আলাদাভাবে স্ত্রীধন বলা হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে এই ২টি স্ত্রীধন কেবল মাতার মৃত্যুর পর কন্যারাই পাবে এমনটিই মনুসংহিতা ৯.১৩১ শ্লোকে প্রবচন করা হচ্ছে। দায়ভাগ ২২ শ্লোকেও সেটাই বলা হয়েছে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে। বাকি ৪ প্রকারের ধনকে বলা হয় মাতৃধন বা অন্বাধেয়, যা পুত্র ও অবিবাহিত কন্যা সন্তানের মধ্যে বণ্টিত হবে যা বলা হচ্ছে মনুসংহিতা ৯.১৯২ ও ৯.১৯৫ এ। আবার গৌতম ধর্মসূত্র অবিবাহিত কন্যার সাথে বিবাহিত কিন্তু দরিদ্র কন্যাসন্তানকেও এই ৪ প্রকারের ধনে বা অন্বাধেয়তে অগ্রাধিকার দিয়েছে (গৌতম ধর্মসূত্র ২৮.২৪, সংস্করণভেদে ২৯.৫)।






দায়ভাগ শাখার আইন অনুসারেও মায়ের সম্পত্তি পাবে কেবল কন্যারাই।


মাতৃর্দুহিতরঃ শেষমৃণাৎ তাভ্যঋতেহন্বয়ঃ।।

(দায়ভাগ ২২)

অর্থাৎ মায়ের যদি কোন ঋণ থাকে কারো কাছে তা শোধ করে বাকি যে মাতৃধন থাকবে সেই সম্পত্তি কন্যারা পাবে।




একইভাবে নারদ স্মৃতি ১৩.২ এও বলা হয়েছে

মাতুর্দুহিতরোঃভাবে দুহিতৃণাং তদত্বয়।


অর্থাৎ মাতার মৃত্যুর পর কন্যারা আর কন্যারা না থাকলে তাদের সন্তানেরা স্ত্রীধন প্রাপ্ত হবে।




একইভাবে পিতার সম্পত্তিও ছেলেরা ভাগ করে নেবার আগে পিতার যদি কোন ঋণ থাকে তা আগে শোধ করে নিতে হবে।


তাহলে আমরা দেখছি একজন নারী বিবাহের সময়ে ২ প্রকারে (অধ্যগ্নি, অধ্যাবাহনিকম্) এবং বিয়ের পর ৪ প্রকারে উত্তরাধিকার সম্পত্তি লাভ করছে। আবার তার কন্যা সন্তানও তার মা থেকে অধ্যগ্নিভাগ ও অধ্যাবাহনিকম্ ভাগ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করছে যা মূলত তার মায়ের বিয়ের সময় তার দাদুর দেয়া উত্তরাধিকার সম্পত্তির অস্থাবর রূপ। আবার বিয়ের সময় ও বিয়ের পরবর্তীতে সে নিজেও উপরোক্ত ৬ প্রকারে সম্পত্তি অর্জন করছে। এটাই ছিল পরম্পরাগতভাবে নারীকে উত্তরাধিকার দেয়ার প্রচলিত রূপ যা বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধির কারণে সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে না।


আর পূর্বেও ব্যক্ত করেছি যে স্ত্রীধনে অধিকার কেবলমাত্রই নারীর। এটি স্বামী বা কেউ ভোগ করতে পারবেনা স্ত্রীর অনুমতি ব্যাতিরেকে কারণ এটা পরোক্ষ উত্তরাধিকার সম্পত্তি, অধিকারীকের অনুমতি ব্যাতিরেকে এর ভোগদখলের কোন সুযোগ নেই। একমাত্র স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থাতে মারা গেলেই কেবল স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী তার আধিকারিক হবেন (মনুসংহিতা ৯.১৯৬ এবং নারদ স্মৃতি ১৩.৯)।


এছাড়া স্মৃতিশাস্ত্রে আরও বলা হচ্ছে যে-

অনপতস্য পুত্রস্য মাতা দায়ম্বাপ্নুয়াৎ

(মনুসংহিতা ৯.২১৭)


অর্থাৎ যদি মাতার পুত্র নিঃসন্তান (এবং স্ত্রীও নেই) এমন হয় হয় এবং পুত্রের মৃত্যু যদি মায়ের আগে হয় তাহলে তার সম্পত্তিও মা পাবেন, মা যদি না থাকেন তাহলে দিদা বা বোন পাবেন। এটিও নারী উত্তরাধিকারের একটি রূপ।


কিন্তু যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে স্ত্রী জীবিত থাকেন, তখন সম্পত্তি কে পাবেন? তখন স্ত্রী সম্পত্তি পাবেন বলে বলছে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ২.১৩৯।




আর যদি কন্যা অবিবাহিত হয় এবং তার নিজস্ব কোন ভরণ পোষণ করতে হবে এমন কোন পরিবার (স্বামী , পুত্র, কন্যা) না থাকে, সে যদি পিতৃলয়ে থাকে তাহলে সে স্থাবর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না।


মনু ৯.১১৮ অনুযায়ী তখন প্রতি ভাই বোনকে স্বাদংশচ্চতুর্ভাগং অর্থাৎ নিজ সম্পত্তির ৪ ভাগের ১ ভাগ করে দিতে বাধ্য থাকবেন,না দিলে পতিত হবেনকিন্তু ভাইবোন ১ জন করে হলে এবং বোন মায়ের কোন স্ত্রীধন না পেলে অর্থাৎ ১ ভাই,১ বোন হলে এবং বোন কোন স্ত্রীধন পায়নি এমন পরিস্থিতিতে বোন ভাইয়ের ৪ ভাগের ১ ভাগ পেলে বৈষম্য হতে পারে।




সেক্ষেত্রে বিষ্ণুস্মৃতি ১৮.৩৪-৩৫ নং শ্লোককে প্রবিধান মানা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, পিতা মারা গেলে মাতা, ভাই ও অবিবাহিত বোন তিনজনই সমান সম্পত্তি পাবে। এখানেও বিধবা নারীর এবং অবিবাহিতা কন্যার স্থাবর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।




আবার মনুসংহিতা ৯.১৩১ মতে স্ত্রীধনেও অগ্রাধিকার অবিবাহিত কুমারী কন্যার। আবার ইতিমধ্যে গৌতম ধর্মসূত্র থেকে দেখিয়েছি

বিবাহিত গরীব কন্যাও এই স্ত্রীধনে অধিকার রাখবে যে কিনা ইতিমধ্যেই অধ্যাবাহনিক ও অধ্যগ্নি হিসেবে অস্থাবর সম্পত্তি পেয়েছে। অর্থাৎ কোন কন্যা অবিবাহিতা হলে তিনি যেমন বাবার স্থাবর সম্পত্তির অংশও ভাইদের কাছ থেকে পাবেন আবার মায়ের স্ত্রীধনও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন।


অর্থাৎ বিবাহিত বা অবিবাহিত কন্যার আর্থিক নিরাপত্তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে নিশ্চিত করেছিলেন তৎকালীন স্মৃতিকারগণ।


আরেকটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা আমাদের চোখে পড়ে প্রায়শই। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে স্বামী মারা গেলে সম্পত্তি সব পুত্রেরা নিয়ে নেয়, অনেকসময় মাকে দেখাশোনা করে না,তাই মা বিপদে পড়ে যান, অত্যাচারিত হন, অসহায় হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ২.১২৩ এ কিন্তু স্পষ্ট বলা হচ্ছে পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগ হলে তাতে পুত্ররা যে ভাগ পাবে তার সমান ১ ভাগ পাবে মাতা অর্থাৎ বিধবা নারী। অর্থাৎ ধরুন পুত্র ৩ জন হলে সম্পত্তিকে ৪ ভাগ করে ৩ ভাগ ৩ পুত্র নেবে আর ১ ভাগ মাতা পাবে।




যাজ্ঞবল্ক্য ২.১১৭ শ্লোকেও বলা হচ্ছে– 

যদি কুর্যাত্মমাতংশান্পত্য কার্যা সমাংশিকা।

অর্থাৎ যদি মায়ের স্ত্রীধন না থাকে বা তার পতি তাকে প্রীতিকর্মাণি প্রভৃতিরূপে ধন দিয়ে না যান তবে মাতাও পুত্রদের সমান ভাগ পাবে।




দায়ভাগ ১১।২ এ জীমূতবাহন বৃহস্পতি স্মৃতির বিলুপ্ত একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে বলেছেন, পত্নীকে বলা হয় পতির অর্ধাঙ্গী যে তার সব ভালোমন্দের ফলাফল ভোগ করে। কোন ব্যক্তির পত্নী বেঁচে থাকা মানে তার অর্ধেক অঙ্গ বেঁচে থাকা। কারো অর্ধেক অঙ্গ বেঁচে থাকতে কীভাবে অন্য কেউ সম্পত্তি নেবে? স্ত্রী সতী হলে (অর্থাৎ পুনরায় বিয়ে না করলে) স্বামীর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি প্রাপ্য।




বিষ্ণুস্মৃতি ১৮.৩৪-৩৫ শ্লোকদ্বয়েও একই কথা বলা হয়েছে-

মাতরঃ পুত্র ভাগানুসারেণ ভাগহারিণ্যঃ। অনূঢ়াশ্ব দূহিতরঃ।।

অর্থাৎ পিতার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি মাতা (বিধবা) ও পুত্র সমানভাগে পাবেন, অবিবাহিত কন্যাগণও সমান পাবেন। 






The Hindu Women's Right To Property Act,1937 এ ঠিক এই শ্লোক অনুযায়ীই বিধবা হিন্দু নারীকে সম্পত্তিতে পুত্রদের সমান ১ ভাগ দেয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সমস্যা হলো সেই আইনে এই অধিকার জীবনস্বত্ব হিসেবে। মানে বিধবা নারীটি এই সম্পত্তি ভোগদখলই কেবল করতে পারবে, ক্রয়বিক্রয় করতে পারবে না। তার মৃত্যুর পর তার স্বামীর পুরুষ উত্তরাধিকারীর কাছে সেটা হস্তান্তরিত হবে। এই জীবনস্বত্ব নামক শর্তের কথা যেহেতু হিন্দুশাস্ত্রের কোথাও বলা নেই তাই এই শর্ত বাতিল করে বিধবা হিন্দু নারীকে পূর্ণ অধিকার দেয়ার যে প্রস্তাব আইন কমিশন করেছে তা অযৌক্তিক নয়।


বরং কাত্যায়ন স্মৃতি ৯০১,৯০৫ নং শ্লোকে বলছে, নারী তার স্বামী বা শ্বশুরালয় থেকে Loving Gift রূপে যে সম্পত্তি বা উপহার বিভিন্ন সময়ে পাবে, তা অস্থাবর হোক (স্বণালংকার, অর্থ) বা স্থাবর হোক (জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি) তা বিক্রি, দান সবকিছু করাতে সেই নারী স্বাধীন থাকবে।




এই Loving Gift-কে আমরা স্ত্রীধনের ৩ নং উৎস প্রীতিকর্মাণি ধরি প্রায়শই। কিন্তু দায়ভাগের ৫৩ নং শ্লোকে জীমূতবাহন বলছেন যে, স্ত্রীধনের মাতৃ, পিতৃ এই ৫ এবং ৬ নং উৎস বলতে কন্যা বিয়ের পর শুধু তার মাতা পিতা থেকে যেসব উপহার বিভিন্ন সময় পেয়ে থাকেন তাকেই মাতৃ পিতৃ এই শব্দ দুটো দিয়ে বুঝানো হচ্ছে না। বরং এর দ্বারা মাতা পিতার সম্পর্কস্থানীয় যে কোন কারো কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তিকেও বুঝায়। অর্থাৎ শ্বশুর শ্বাশুড়ি যারা মাতা পিতার সম্পর্কস্থানীয় তাদের দেয়া কোন উপহারও এর আওতায় পড়বে।


আবার আমরা আগেই বলেছি বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরালয় থেকে যা যা উপহার তথা সম্পত্তি প্রাপ্তি হয় তার সবই Loving Gift. তাহলে প্রীতিকর্মাণি, মাতৃ ও পিতৃ (যেটুকু শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেন) তার সবগুলোই Loving Gift এবং কাত্যায়ন ৯০৫ শ্লোক অনুযায়ী এই সম্পত্তিগুলো সেই নারী ভোগদখলও করতে পারবে, বিক্রি দান ইত্যাদিও স্বাধীনভাবে করতে পারবে। বাংলাদেশের আইনে যেভাবে শুধুই জীবনস্বত্ব হিসেবে ভোগদখল ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না, কাত্যায়ন স্মৃতিসূত্র অনুযায়ী কিন্তু তা নয়।


এখন প্রশ্ন চলে আসে, প্রচলিত সনাতন পরম্পরায় দেখা যাচ্ছে কন্যাকে উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেয়া হচ্ছে ঠিকই তবে তা পুত্র সন্তানের ন্যায় স্থাবর সম্পত্তির রূপে নয়, অস্থাবর সম্পত্তি রূপে, বিশেষত স্ত্রীধনরূপে। তবে কাত্যায়ন ৯০৫ শ্লোক অনুযায়ী কিন্তু আমরা দেখেছি এই Loving Gift অর্থাৎ প্রীতিকর্মাণি Immovable বা স্থাবর সম্পত্তিও অর্থাৎ জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদিও হতে পারে।


এখন তাহলে প্রশ্ন বাকী থাকছে একটাই আর তা হলো অধ্যগ্নি বা অধ্যাবাহনিকম্ এ কেন পিতৃকূল থেকে স্থাবর কিছু দেয়া হচ্ছে না বর্তমানে। কেন শুধু অস্থাবর দেয়া হবে? বর্তমানে প্রস্তাবিত হিন্দু আইনে কিন্তু বিতর্কটা মূলত এখানেই।


এর পেছনে কারণটা মূলত সামাজিক ও ঐতিহাসিক।

কন্যার অপর নাম দুহিতা। কেন? নিরুক্ত ৩য় অধ্যায়ের ৪র্থ খণ্ড বলছে-

দোহনার্থক দুহ ধাতুর সাথে তৃন প্রত্যয় যোগে দুহিতা শব্দের প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ যে সন্তান সর্বদা বিয়ের আগে বা পরেও পিতৃকূল থেকে সর্বদাই বস্ত্র অলংকারাদি পেয়ে থাকেন, যাঞ্ছা করে থাকেন, তিনিই দুহিতা। এটিও কিন্তু উত্তরাধিকারের একটি পরোক্ষ পদ্ধতি।


আবার বলছে-

দূরে গিয়ে হিতা এই অর্থেও দুহিতা শব্দ প্রযোজ্য। দূরে থেকে পিতৃকূলের হিত করেন যে সন্তান তিনি দুহিতা।


আর এটাও অন্যতম কারণ স্থাবর সম্পত্তির বদলে নানাপ্রকারে অস্থাবর সম্পত্তি প্রদানের মাধ্যমে সনাতন পরম্পরায় নারীদের উত্তরাধিকার দেয়ার। কেননা সনাতন সমাজে পিতৃভিটাকে তথা স্থাবর সম্পত্তিকে একটি বংশগত একক অখণ্ড ইউনিট হিসেবে দেখা হয় যা অবিভাজ্য। একটি নির্দিষ্ট বসতভিটা, জমি একটি নির্দিষ্ট পরিবারের বা বংশের এই সামাজিক প্রথা এখানে প্রচলিত।

মিতাক্ষর শাখায় এই মতটি এতই দৃঢ় যে সম্পত্তির মালিক থাকা অবস্থায়ও পিতা ইচ্ছে করলেই কোন সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারেন না। সেটা বিক্রয় করতে হলে তাকে তার পুত্রদের যারা এখনো সম্পত্তির মালিক নন তাদের অনুমতি নিতে হয়। অর্থাৎ নামে পিতা সম্পত্তির মালিক হলেও মূলত সম্পত্তির মালিকানা পরিবারের বা বংশের হয়,কোন ব্যক্তির নয়।তাই এর কোন অংশ ক্রয়, বিক্রয়, ধার প্রভৃতি করতে হলে পুত্র ও ভাই থাকলে ভাইদেরও অনুমতি নিতে হয় মিতাক্ষরা শাখায়।


এখন যেহেতু কন্যা হলো দুহিতা বা দূরে বসবাসকারী এবং ভিন্ন বংশে স্থিত। তাই তাকে স্থাবর সম্পত্তি দিলে ওই বসতভিটায় বসবাস করছে এমন ব্যক্তিদের বা বংশের সামগ্রিক অখণ্ড সম্পত্তিরূপে তা একক ইউনিট হিসেবে বজায় থাকে না, সেই সম্পত্তির ভাগীদার অন্যত্র বসবাসকারী কেউও (দুহিতা) হয়ে যাচ্ছে। সেই কন্যার মৃত্যুর পর অন্য বংশের কেউ (নাতি নাতনী প্রভৃতি) এই বংশের প্রতীক যে স্থাবর সম্পত্তি তার অংশবিশেষের অধিকারী হয়ে যাচ্ছে, তা এই বংশের একক সম্পত্তি হিসেবে আর থাকছে না, বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে।


তাই দুহিতাকে বিবাহের সময় এবং বিবাহের পরেও অস্থাবর সম্পত্তিরূপে পৈতৃক সম্পত্তির উপহার দেয়া এবং বিপদে আপদে নারীর স্বাবলম্বীতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাখা, দুটোই বজায় রাখা হতো, কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি দেয়া হতো না। বিয়ের পরেও পিতৃ, মাতৃ, ভাতৃ অর্থাৎ স্ত্রীধনের ৪, ৫, ৬নং উৎসের মতো করে কন্যাকে সবধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়া পিতৃকূলের দায়িত্ব ছিলো।


তবে আগেও কিন্তু দেখেছেন ৫৩ জন স্থাবর সম্পত্তির প্রাপক হতে পারেন এমন অধিকারীদের তালিকায়  দায়ভাগ শাখায় কন্যা, স্ত্রী, মাতা, নাতনীর ইত্যাদি ৫ জন নারীর নাম রয়েছে। তবে সেটা উত্তরাধিকারী ক্রমতালিকায় কিছুটা পিছনের দিকে।


এটাই সারকথায় হিন্দু সমাজে কন্যাসন্তানকে উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেবার রীতি যার পেছনে কেবল শাস্ত্রীয় নয় বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। বিয়ের পর অন্যান্য সমাজে দেখা যায় কন্যা ও তার স্বামী বারংবার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সম্পত্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মনোমালিন্যতে পড়ে যান, এই ব্যাপারটিও এই রীতিতে সহজেই এড়ানো যেতো। এটাও একটা বড় কারণ স্থাবর সম্পত্তিরূপে উত্তরাধিকার না দিয়ে অস্থাবর সম্পত্তিরূপে, স্ত্রীধনরূপে উত্তরাধিকার দেয়ার।


তবে সমস্যা হলো বর্তমান সমাজে নানা পুরুষতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে কাগজে কলমে এই অস্থাবর সম্পত্তিরূপে উত্তরাধিকার কন্যা পেলেও বাস্তবে তা জোরপূর্বক যৌতুক প্রথাতে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এখন বৈদিক নিয়মে কন্যার পিতা কন্যাকে স্নেহ করে অস্থাবর সম্পত্তিরূপে অলংকারাদি দেন না, বরং পাত্রপক্ষের চাপ,চাহিদার ভিত্তিতে দিতে বাধ্য হন। যার ফলে এখন বিষয়টা এমনভাবে দৃষ্টিগোচর হয় যে হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি পান না। অথচ আসলে পান, কিন্তু সেটা অবৈধ সামাজিক পদ্ধতিতে পান বলে তা কন্যাসন্তানটির অর্থনৈতিক সুরক্ষায় কাজে না লেগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের উদরপূর্তিতেই কেবল কাজে লাগে। এক্ষেত্রে কঠোর আইনের মাধ্যমে যৌতুক প্রথা বন্ধ করা এবং স্ত্রীধনকে অন্যদের জোরপূর্বক ভোগ দখলকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় এনে নতুন আইন করা সময়ের দাবী। এই দুটি আইনকে সফল করা গেলে নারীদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি বর্তমান অবস্থাতেই নিশ্চিত হবে।


পবিত্র বেদ একটি মন্ত্রে উপদেশ প্রদান করছে-


অশ্লীল তনুর্ভবতি রুশতী পাপয়ামুয়া।

পতির্যদদ্ভোঃ বাসসঃ সমঙ্গমভ্যুর্ণূতে।।

অথর্ববেদ ১৪.১.২৭


ভাবানুবাদ-যে পতি স্ত্রীর পোশাক/সম্পত্তি/অর্থ ব্যবহার করতে চান, গ্রহণ করতে চান; তিনি অপবিত্র, পাপী বলে গণিত হন (তার এহেন কাজ অশ্লীল, পাপযুক্ত বলে মনে করা হয়)।

[বেদো কা দিব্য সন্দেশ গ্রন্থে উক্ত মন্ত্রের ব্যখ্যায় রাম শর্মা]





মনুস্মৃতির তৃতীয় অধ্যায়ের ৫২ নং শ্লোকে বলা দ হচ্ছে-

স্ত্রীধনানি তু যে মোহাদুপজীবন্তি বান্ধবঃ। নারীযানান বস্ত্রং বা তে পাপ যান্ত্যধোগতিমূ।।


অর্থাৎ স্ত্রীধনকে যদি পতি বা অন্যরা ব্যবহার করতে চায়, জোর করে ভোগ করতে চায় সেই পাপাচারীগণ চূড়ান্ত অধোগতি লাভ করেন।




বরং উল্টো বলা হয়েছে শ্বশুরালয়ে যাবার পরেও স্বামী ও অন্যরা পুত্রবধুকে Loving Gift দেবে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য,পুত্রবধুর সম্পত্তির লোভ তারা করবেনা-


"একজন পিতা, ভাই, পতি বা দেবর তাদের কন্যা, বোন, স্ত্রী বা ভ্রাতৃবধুকে মৃদুবাক্য, ভদ্র ব্যবহার ও উপহারাদি বস্ত্র-অলংকার,ধন,উত্তম ভোজনাদি দ্বারা খুশি ও সন্তুষ্ট রাখবেন যদি তারা যথার্থ কল্যাণ ও উন্নতি চান। "

(মনুস্মৃতি ৩.৫৫)




অর্থাৎ বেদ, মনুসংহিতা কোথাওই স্ত্রীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পত্তিকে বর্তমান সমাজের প্রচলিত যৌতুক প্রথার যৌতুকের মতো ব্যবহারের সুযোগ নেই।


তাহলে আমরা একদম যদি এককথায় বলি তবে তৎকালীন সময়ে সম্পদ বন্টনের পরম্পরা ছিল এমন যে, সম্পত্তি কন্যা ও পুত্র উভয়েই পাবে। পুত্র পাবে পিতার স্থাবর সম্পত্তি (ক্ষেত্রবিশেষে কন্যাও পেতে পারে), কন্যা পাবে পিতৃকূল হতে অস্থাবর সম্পত্তি এবং মাতার সম্পত্তি এবং শ্বশুরালয়ে পাবে স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি। তাই কেউ যদি বলে সনাতন আইনে কন্যারা বাংলাদেশে সম্পত্তি পায়না সেটা হবে ভুল। সমস্যাটা সম্পত্তি পাওয়াতে নয়, সমস্যাটা হলো সম্পত্তি পাবার মূল উৎস বা স্ত্রীধনকে আমরা এখন পাত্রপক্ষ কর্তৃক জোরপূর্বক যৌতুকপ্রথায় রূপান্তরিত করে ফেলেছি। অথচ মনুসংহিতায় স্পষ্ট বলা আছে স্ত্রীধন পতি ভোগ করলে সে পাপাচারী চূড়ান্ত অধোগতি প্রাপ্ত হবে। পবিত্র অথর্ববেদেও তা বলা হয়েছে।


আমরা যদি শেষ করার আগে একবার সারাংশ দেখি তাহলে আমরা দেখছি প্রাচীনমতে-


১) নারী সম্পত্তি পেতো মোট ৬ প্রকারে স্ত্রীধনরূপে যার অধিকাংশই অস্থাবর, তবে স্থাবর ভাগও আছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন বিবাহিত নারী স্বামী থেকে ভালোবাসার স্বরূপ হিসেবে প্রাপ্ত প্রীতিকর্মাণি নামক স্ত্রীধন স্থাবরও হতে পারে। 


২) প্রীতিকর্মাণি নামক স্ত্রীধনে বিবাহিত নারী অস্থাবর এবং স্থাবর উভয় সম্পত্তি ই পেতো  স্বামী ও শ্বশুরালয় থেকে।


৩) নারীর এই স্বামী ও শ্বশুরালয় থেকে পাওয়া Loving Gift তার বিক্রি করা, দান করা ইত্যাদির স্বাধীনতা ছিলো, বর্তমান আইনের মতো কেবল ভোগ করতে পারবে কিন্তু বিক্রি বা অন্যকিছু করতে পারবে না এমন ছিলো না।


৪) স্ত্রীধনের সবচেয়ে বড় দুটো উৎস অধ্যগ্নি এবং অধ্যাবাহনিক্ এই দুটো উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল বিবাহিত কন্যা সন্তানরাই পাবেন। অপর চারটিতে(যাদের একত্রে অন্বাধেয় বলা হয়) অবিবাহিত কন্যা ও পুত্র সন্তান উভয়েরই অধিকার আছে,বিবাহিত কন্যার সচরাচর নেই।তবে কোন বিবাহিত কন্যা দরিদ্র হলে সেই কন্যা সন্তানও স্ত্রীধনের এই চারটি উৎসের ভাগ পাবে(কাত্যায়ন ৯০৫)।


৫) অবিবাহিত কন্যা এই স্ত্রীধন ছাড়াও ভাইয়ের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশও পাবেন এমন নিয়ম ছিলো মনুসংহিতায়। তবে জীমূতবাহন বিভিন্ন পরিস্থিতিভেদে অবিবাহিত কন্যার অংশ কত হবে তা ভিন্ন ভিন্ন হবে এমন মত ব্যক্ত করেছেন তার দায়ভাগ টীকায়। আবার বিষ্ণুস্মৃতি ১৮.৩৫ অনুসারে অবিবাহিতা নারী ভাইয়ের সমান ভাগ পাবেন (পুত্রভাগানুসারে)। অর্থাৎ এখানে বিষ্ণু স্মৃতি, মনুস্মৃতি এবং দায়ভাগ টীকায় জীমূতবাহন অনুসারে এখানে মতভিন্নতা রয়েছে। ঠিক কত অংশ পাবে তা নিয়ে কেউ একমত নন।


৬) বিধবারা তাদের পুত্রদের সমান ভাগ সম্পত্তি পাবেন এই আইন ছিলো।


৭) বিয়ের পরেও পিতা, মাতা, ভ্রাতা এদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন সময়ে পিতৃধন, মাতৃধন, ভ্রাতৃধনরূপে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত করা।


৮) একই দায়িত্ব নারীর স্বামীরও আছে স্ত্রীর জন্য প্রীতিকর্মাণি নামক স্ত্রীধনের ব্যবস্থা করে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমৃদ্ধ করার।



তবে মূল কথা হলো একমাত্র ঐশ্বরিক গ্রন্থ ও অপরিবর্তনীয় সংবিধান বেদে কিন্তু এই ব্যাপারে সরাসরি কিছু লেখা নেই। এই নিয়ে বিদ্যমান যত মতামত আছে তা স্মৃতিশাস্ত্রের। আর স্মৃতিশাস্ত্র হলো যুগের, সমাজের প্রয়োজনে সেই সেই সময়ের বেদজ্ঞ আইনবিদ ঋষিগণ যে সব আইনের প্রচলন করেছেন তা। আর এই স্মৃতিশাস্ত্রগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পৃথক মতবাদ পাওয়া যায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে। আর এগুলো যুগ, কাল ও সমাজের ভিত্তিতে পরিবর্তনযোগ্য।


এগুলো সব স্মৃতিশাস্ত্রের শ্লোক হওয়ায় সেগুলোর নিয়মসমূহ ধ্রুব নয় বরং সমাজভেদে, সময়ভেদে, পরিস্থিতিভেদে পাল্টাবে, তখনকার সমাজবিজ্ঞানী মহর্ষি মনু এই নিয়মগুলো করে গিয়েছিলেন বেদের আদেশ অনুসরণ করে সমাজের অবস্থা বুঝে, ঠিক তেমনি বর্তমান আইনজ্ঞরাও ভারতে বেদের আইন মেনেই নারী পুরুষ এর সমান সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছেন ১৯৫৬ Hindu Succession Law এর মাধ্যমে, তাই ভারতে হিন্দু নারী-পুরুষ সকলেই পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান ভাগ পান। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন আর্থসামাজিক দিক থেকে হিন্দুদের দুর্বল অবস্থান, সুযোগসন্ধানী শ্রেণীর উপস্থিতি, ধর্মান্তরকরণের প্রবণতা ইত্যাদি সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় হিন্দু মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে কঠোর আইনে যৌতুক প্রথাকে বন্ধ করা গেলে এবং স্ত্রীধন শ্বশুরালয় জোর করে ব্যবহার করলে তা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী এই আইন প্রণয়ন করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করলে বিদ্যমান ব্যবস্থাতেও নারীর সম্পত্তির সমঅধিকার নিশ্চিত করা যাবে জমি দখলের ভয় ব্যতীতই।


আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অবশ্যই নারীশিক্ষার অগ্রগতি ঘটাতে হবে, নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে যার বিনা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেবল সম্পত্তি দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ কোন নারী শিক্ষাদীক্ষায় শক্তিশালী না হলে তার দুর্বল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে তাকে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করে তার কাছ হতে সম্পত্তি জোরপূর্বক ভোগদখল করা সম্ভব যা আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখা যায়। এজন্যই পবিত্র অথর্ববেদ বলেছে-


চিত্তিরা উপবর্ধণম্ চক্ষুরা অভ্যঞ্জনম্।

অর্থাৎ স্বামীর গৃহে যাবার পূর্বে তাকে জ্ঞান ও দর্শন, নৈতিকতার আলোয় আলোকিত করে দেয়া উচিত পিতৃকূলের।

(অথর্ববেদ ১৪.১.১৬ এর ব্যখ্যায় প্রিয়ব্রত বেদ বাচস্পতি)


অথর্ববেদের ব্রহ্মচর্য সূক্ত ১১.৫.১৮ তেও আমরা দেখি একমাত্র যুবতী বিদ্যাশিক্ষা, ব্রহ্মচর্য সম্পূর্ণ করলেই তার বিয়ে হওয়া উচিত।


অর্থাৎ নারীদের ক্ষমতায়নে তাদের শিক্ষার আলো দেয়া, বহির্জগতের সাথে প্রতিযোগিতায় সমর্থ করে গড়ে তোলাই হলো মূল চাবিকাঠি। তার আগে কোনভাবেই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।


স্মৃতিশাস্ত্রের নিজেদের মধ্যেই অনেক আইনি নিয়মে ভিন্নমত রয়েছে তা আমরা দেখিয়েছি। আবার এটাও দেখছি ধর্মশাস্ত্রসমূহে যে আইন লেখা তার সাথে বর্তমানে প্রচলিত হিন্দু আইনেরও অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। তাই নারদ স্মৃতির প্রারম্ভিক অধ্যায়ের ৪০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-


ধর্মশাস্ত্রবিরোধে তু যুক্তিযুক্তো বিধি স্মৃতঃ।

ব্যবহারো হি বলবান্ ধর্মস্তৈনাবহীয়তে।।


অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রসমূহের মধ্যে বিরোধ থাকলে অথবা ধর্মশাস্ত্রের সাথে প্রচলিত প্রথার অমিল থাকলে যুক্তিতর্ক, আলোচনা করে যা বিবেকের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় তাই করবে আর অযৌক্তিকতাকে ত্যাগ করবে। এইসব ক্ষেত্রে স্মৃতিশাস্ত্রের চেয়ে লোক ব্যবহারের পক্ষই অধিক বলবান।




তাহলে বুঝতেই পারছেন স্মৃতিশাস্ত্র নিজেই বলছে লোক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার বল স্মৃতিশাস্ত্র হতে বেশি। আর ভিন্নমত থাকলে তা যুক্তিতর্ক, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। যেটা যৌক্তিক মনে হবে সেটাই গ্রহণ করা উচিত। তাই হিন্দুসমাজ যেন তার প্রয়োজনের সাপেক্ষে ধর্মশাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা আলোচনা করে, যুক্তিতর্ক করে নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে সেজন্য আমরা আপনাদের সম্মুখে শাস্ত্রীয় সব মতবাদ সবিস্তারে উপস্থাপন করলাম। 


এখন প্রচলিত আইনের সমস্যাগুলি নিয়ে এবং অগ্নিবীর বিদ্বৎ পরিষদ কর্তৃক আইনের নানা ধারা ও তার ভেতরের ফাঁকফোকর (Loophole) সম্বন্ধে গবেষণার পর আমরা যেসব সিদ্ধান্ত গত দুই পর্বে উপস্থাপন করেছি, তার সারসংক্ষেপ এখানে উপস্থাপন করছি-


১. আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল প্রস্তাবিত আইনের করা সমীক্ষার স্যাম্পল সাইজ নিয়ে ও হিন্দু ধর্মগুরু বা সংগঠনসমূহের সাথে আলোচনা না করে, সকলের মতামত না নিয়ে খুব কম সংখ্যক মানুষের(২৫০জন) মতামতের ওপর ভিত্তি করে দেড় কোটি লোকের ওপর প্রযোজ্য আইনের পরিবর্তন নিয়ে। 


আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত আইনের সাতটি দফার মধ্যে (বহুবিবাহ নিরোধ, বিধবাদের বিনাশর্তে সম্পত্তি দান, দত্তক নেবার সময় পুত্র-কন্যা শিশুর বৈষম্য বিলোপ করা, অসবর্ণ বিয়েকে বৈধ ঘোষণা, অগ্নিসাক্ষীই বিয়ের একমাত্র বৈধ স্বীকৃতি এটি মেনে নিয়ে কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য বিবাহ নিবন্ধন ইত্যাদি) ভেতর ছয়টি দফা প্রায় শতভাগ সমর্থনযোগ্য। কেবল কন্যার পিতার সম্পত্তিতে অধিকার কী উপায়ে সুনিশ্চিত করা যায় এই নিয়ে আরো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। 


আমাদের প্রস্তাবনা থাকবে হিন্দু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী, ধর্মগুরু সহ সকলকে নিয়ে ভারতে বিদ্যমান মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এর মতো একটি কমিশন গঠন করে শাস্ত্রজ্ঞ, আইনজ্ঞ নানা পক্ষের সাথে যৌক্তিক আলোচনা করে ও সকলের মতামত নিয়ে, সকল সনাতনীদের আস্থা অর্জন করে, তারপর এই আইনের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করার।


২. এই আইনে

ক) ধর্মান্তরিত ব্যক্তি কোনোভাবেই সম্পত্তি পাবে না, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি সম্পত্তি পাওয়ার আগে ধর্মান্তরিত হলে তার প্রাপ্য সম্পত্তি তার ধর্মান্তর না হওয়া ভাই,বোন হিন্দু স্ত্রী/ স্বামী, সন্তান পাবে। সম্পত্তি পাবার পরে ধর্মান্তরিত হলেও সরকার তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তার মাতা-পিতা বা ভাই-বোন বা হিন্দু স্বামী-স্ত্রী বা হিন্দু সন্তানদের ফেরত দেবে।


খ) ধর্মান্তর না হয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে বা স্পেশাল ম্যারেজ এক্টে অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিবাহ করলে চাইলে পিতামাতা যদি ত্যাজ্যপুত্র-কন্যা ঘোষণা করেন  বা পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে সপিণ্ড ও সম্পত্তির হিন্দু অধিকারীগণ যদি দ্বিমত পোষণ করেন, সেক্ষেত্রে পৈতৃক সম্পত্তিতে তাদের কোনো দাবি থাকবে না।


গ) ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যদি স্ত্রী, সন্তান সহ সম্পত্তি ভাগের পর ধর্মান্তর হন, সেক্ষেত্রে শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে আশ্রমত্যাগী বলে বিবেচনা করতে হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তার হিন্দু ভাই-বোন বা তাদের সন্তানদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হবে।


ধর্মান্তর বিষয়ক এই সংশোধনীগুলো আবশ্যক। নাহলে এই আইন একটি মরণফাঁদে রূপান্তরিত হতে পারে।


৩. এই খসড়া আইনে যেখানে কন্যা তার প্রাপ্য উত্তরাধিকার পেয়েই যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে আলাদা করে যৌতুক নিষিদ্ধ করতে হবে‌ এবং তা কেবল কাগজে কলমে নয়, বাস্তবেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা নাহলে উল্টো পুত্র সন্তানই বৈষম্যের স্বীকার হবে।


তাছাড়া আমরা দেখতে পাই, অনেক হিন্দু পিতা-মাতা আছেন, যারা দরিদ্র। অথবা অনেক হিন্দু পিতামাতার কেবল একটি বসতবাড়ি বা এপার্টমেন্ট আছে। সেসব ক্ষেত্রে কন্যাকে স্থাবর সম্পত্তি প্রদান করা অসম্ভব। 


যদি দরিদ্র ও স্থাবর সম্পত্তি প্রদানে অক্ষম পিতা তার কন্যাকে বিবাহের সময় উপযুক্ত পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ দান করেন, সেক্ষেত্রে তার স্থাবর সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার থাকার গাণিতিক কারণ নেই।


অর্থাৎ, পিতা চাইলে তার কন্যাকে স্থাবরভাবে বা অস্থাবরভাবে উভয়ভাবেই সম্পত্তি প্রদান করতে পারেন। তবে যদি সমমূল্যের অস্থাবর সম্পদ কন্যা পায় বিবাহের সময় বা পরে, তাহলে স্থাবর সম্পদের ওপর তার আলাদা অধিকার থাকবে না।


৪. আমরা মনে করি, নারীদের শিক্ষাই তাদের সাবলম্বী করার প্রধান উপায়। সেজন্য নারীদের শিক্ষার সুযোগ আরো বাড়াতে হবে। সংখ্যালঘু নারীদের শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই আপাতভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু নারীদের পূর্ণ মর্যাদা সম্ভব।


একজন প্রতিমন্ত্রীর অধীনে সংখ্যালঘু বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় রেখে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য এমন বিশেষ কল্যাণমূলক কাজগুলো করতে হবে ও সেই মন্ত্রণালয়ে আনুপাতিক হারে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।যেখানে ভারত,পাকিস্তান, শ্রীলংকা সব দেশেই সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে,যেখানে শ্রীলংকাতে শুধু অল্প সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যই আলাদা মন্ত্রণালয় আছে সেখানে ২ কোটিরও বেশী হিন্দুধর্মাবলম্বী সহ খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ভাইবোনদের জন্য এতবার দাবী করা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা না করা উদ্বেগজনক।


৫. একইসাথে এই আইনে অনেক জায়গাতেই নিরীহ মানুষের বুঝার অভাবে প্রভাবশালীদের দ্বারা হয়রানি হবার সম্ভাবনা আছে। সংখ্যালঘুরা এদেশে প্রশাসনিক ও আইনি দিক থেকে অনেকসময় উপযুক্ত অধিকার পেলেও বাস্তবে গ্রাউন্ড লেভেলে তার থেকে বঞ্চিত হয়, সেজন্য সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রবর্তন করা ও তার প্রয়োগ আবশ্যক যেন প্রান্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নির্যাতিত না হয় প্রভাবশালীদের দ্বারা। আর সম্পত্তি পাবার পর ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির অধিকার হারানোর আইনটি শুধু Civil Law হিসেবেই নয় বরং এর প্রতিষ্ঠা সাংবিধানিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা দরকার অন্যান্য সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের ধারার সাথে। 


কেননা কেবল Civil Law হিসেবে থাকলে উচ্চতর আদালতের আদেশে যেকোন সময় সেই Law উল্টে যেতে পারে যা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একদমই অসম্ভব কিছু নয়।কেননা ধর্মীয় সংবেদনশীল ব্যাপারে আমাদের দেশে বিচার বিভাগও অনেক সময় অসহায়। রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ক ৭২ এর মূলনীতি বিরোধী ধারাটিও কেবল এই কারণেই আইনের হাতে ধরা পড়ছে না এমনটাই প্রতীয়মান। তাই ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তি হারাবে এমনটা শুধু আইন করলেই হিন্দু জনগোষ্ঠী ভরসা পাবে না, সংবিধানে ধারা অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় রূপ দিতে হবে।



ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি 




Post a Comment

1Comments
  1. সঠিক সিদ্ধান্ত।আমি সহমত।

    ReplyDelete
Post a Comment