দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বৈদিক বর্ণব্যবস্থা

Arindam
2




বর্ণপ্রথা গত ২ হাজার বছরের ভারতবর্ষের এক অনস্বীকার্য সামাজিক বিপর্যয়। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠা ভারতভূমির সুমহান বৈদিক সভ্যতার মূলমন্ত্র ছিল বেদের অমৃতস্য পুত্র বাণীতে বিশ্ব চরাচরের প্রতিটি প্রাণকে অমৃতের সন্তান বলে ঘোষণা দেয়া। এ মাটির নায়ক দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণের আপ্তবাক্য "আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি" (গীতা ৬.৩২) সকলের সুখ দুঃখকে নিজের আত্মার সম অনুভব করো। এই অপূর্ব সর্বপ্রাণীর জন্য ভালোবাসার ভূমি, সকল জীবের প্রতি শ্রদ্ধার ভূমিতে জেঁকে বসেছিল বিভেদের ঘন কুয়াশা। জন্ম থেকেই কেউ ব্রাত্য, কারো ছায়া মাড়ানোও পাপ, কারো হাতের ছোঁয়া খাবার আবশ্যক প্রায়শ্চিত্ত করণীয় পাপকর্ম। কেউ তার ভগবানের মন্দিরে ঢুকতে পারবে না, কেউ নিজের আরাধ্যের মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারবে না, নিজের শাস্ত্র পাঠ করতে পারবে না, সে এক বিভীষিকাময় অবস্থা! পেশোয়া শাসন আমলে মহারাষ্ট্রে মাহার এবং মঙ সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নবর্গের মানুষদের শুধু সকাল ৯টার পর এবং বিকাল ৩টার আগে পুনা গেটে আসার অনুমতি ছিল, কারণ এর আগে মানুষের ছায়া অনেক দীর্ঘ থাকে এবং কোনো ব্রাহ্মণ যদি সে ছায়া অতিক্রম করে তাহলে তার জাত নষ্ট হয়একসময় কেরালাতে একজন নায়ার একজন নামবুদারি ব্রাহ্মণের কাছে আসতে পারত, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারত না। একজনতিয়াএকজন ব্রাহ্মণ থেকে ৩৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলতে পারত এবং একজন পুলাইয়া একজন ব্রাহ্মণ থেকে ৯৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলতে পারত। এর চেয়ে কম দূরত্বে আসা যেত নাএমন ই ভয়ঙ্কর বেদ বিরুদ্ধ এই জাতপ্রথা! এটি মানুষের সাথে মানুষের, জীবের সাথে সাক্ষাৎ অমৃতের পুত্র অপর জীবের মধ্যে তুলে দিয়েছিল বৈষম্যের ইস্পাত প্রাচীর,আর এর ফায়দা লুটেছিল সমাজপতিরা,তাদের নিযুক্ত ধর্মপ্রধানগণ, যাদের পাপের, অত্যাচারের কালো ইতিহাস গঙ্গার জলেও বিশুদ্ধ হবার নয়।


পৃথিবীতে অনেক মধ্যযুগীয় সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি সীমাহীন বিদ্বেষ পোষণ করে এমন ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে বটে কিন্তু নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি এতটা অবহেলা, অত্যাচারের এরূপ বিরল দৃষ্টান্ত আর আছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। আর কীভাবে এই বর্ণপ্রথা এলো, কীভাবে গুণ ও কর্মভিত্তিক শাস্ত্রীয় বর্ণাশ্রম ধর্মের স্থলে জন্মভিত্তিক অযৌক্তিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব হলো তার আলেচনায় জাতি, বর্ণ ও পদবী এই তিনটি বিষয় সম্বন্ধে জানা আবশ্যক।




জাতি



'জাতি' শব্দটির দ্বারা শ্রেণিভুক্তকরণ বোঝায়। প্রাণীদের যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের দ্বারা তারা এক প্রজাতি অন্য প্রজাতি থেকে ভিন্ন এবং যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে একই প্রজাতির প্রাণীদের বুদ্ধি দ্বারা চিহ্নিত করা যাত তাকে জাতি বলে। ন্যায়দর্শনে (২.২.৭১) বলছে, "সমানপ্রসবাত্মিকা জাতিঃ" অর্থাৎ যারা সমান বুদ্ধি উৎপন্ন করে, এরূপ পদার্থ হলো জাতি৷



উদ্ভিদ ও প্রাণীবিজ্ঞানে যেভাবে প্রজাতিসমূহের শ্রেণিবিন্যাস করা হয় বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক তেমনি প্রাচীন ঋষিরাও গুরুত্বপূর্ণ জাতিসমূহের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসকরণ করেছিলেন চারভাবে– উদ্ভিজ (অর্থাৎ গাছপালা বা Plant), অণ্ডজ (অর্থাৎ ডিম থেকে যার উৎপত্তি যেমন পাখি এবং সরীসৃপ অর্থাৎ Oviparous), পিণ্ডজ (স্তন্যপায়ী বা Mammals), উষ্মজ (তাপমাত্রা বা পরিবেষ্টনকারী আবহাওয়ার জন্য যার জন্ম যেমন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি)।



এমনিভাবে নানাপ্রকার পশুসমূহ যেমন হাতি, সিংহ, খরগোশ, গোরু ইত্যাদি তৈরি করে এক একটি ভিন্ন ভিন্ন 'জাতি'। একইভাবে সমস্ত মানবকূল তৈরি করে একটি 'জাতি'।



একটি নির্দিষ্ট জাতির থাকবে একই ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য যারা সেই জাতি থেকে আরেক জাতিতে পরিবর্তিত হতে পারবে না এবং ভিন্ন জাতির সাথে সংগমের মাধ্যমে উর্বর সন্তানের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে Species  বা প্রজাতি। অর্থাৎ প্রজাতি বা জাতি হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্ট, নির্ধারিত।



ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রেরা কোনোভাবেই ভিন্ন জাতি নয় কারণ তাদের মধ্যে জন্মসূত্রগত বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্যই নেই যা তাদেরকে ভিন্ন করবে। তারা একে অপরের সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে কারণ তারা সবাই ই মানুষ। সুতরাং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এরা এক অভিন্ন প্রজাতি।



পরবর্তীতে 'জাতি' শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে যেকোনো প্রকার শ্রেণীভেদকরণের জন্য। তাই সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সমাজকেও ভিন্ন ভিন্ন 'জাতি' হিসেবে আখ্যা দেই। কিন্তু এ শুধু ব্যবহারের সুবিধার জন্য। আসলে আমরা মানবকূলের সকলে এক অভিন্ন জাতি।




কৌলীন্য প্রথা/পদবী প্রথা



কৌলীন্য কি ? কৌলীন্য শব্দটির অর্থ হচ্ছে বংশ বা কূল গৌরব। প্রত্যেকেরই বংশ-পদবি আছে এবং সেটা নিয়ে যে গৌরব, যে আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রথা, তাই কৌলীন্য প্রথা। সংস্কৃত প্রবাদে বলা হয় ''উপাধিঃ ব্যধিরেবচ'' অর্থাৎ উপাধির অহং ব্যধির ন্যায়। প্রশ্ন আসতে পারে যে, হিন্দু সমাজে কি সেই আদিযুগ থেকেই এ পদবি প্রচলন ছিল?



একটু লক্ষ্য করলেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, পরশুরাম, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, বিশ্বামিত্র, দুর্যোধন, দশরথ প্রমুখ মহামানবের নামের পেছনে কোন পদবি বা টাইটেল ছিল না। তাহলে আমাদের নামের শেষে কেন টাইটেল?



প্রাচীনকালে পিতা বা মাতার নামের অনুসারে নামকরণ হতো। নামের দুটো অংশ থাকত, প্রথম অংশ নিজ নাম, দ্বিতীয় অংশ পিতা বা মাতা হতে জাত এমন অর্থসূচক শব্দ। যেমন মাতা জবালা হতে জাত এর সংস্কৃত অর্থ জাবাল, আর সেই জাত সন্তানের নাম যদি সত্যকাম হয় তবে পুরো নাম দাঁড়ায় সত্যকাম জাবাল। অথবা পিতা অরুণ থেকে জন্ম নেয়া পুত্রকে সংস্কৃতে বলা আরুণি, আর সেই পুত্রের নাম যদি হয় উদ্দালক তবে পুরো নাম দাঁড়ায় উদ্দালক আরুণি।



কয়েকটি উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো–



১) ঋষি উপমন্যুর তনয়ের নাম প্রাচীনশাল ঔপমন্যব যে নামের আক্ষরিক অর্থ হলো উপমন্যুর পুত্র প্রাচীনশাল। অর্থাৎ এখানে পুত্রের নাম শুধু প্রাচীনশাল, ঔপমন্যক তার পিতৃপরিচয়।



২) পুলুষের তনয় সত্যযজ্ঞ পৌলুষি যার আক্ষরিক অর্থ পুলুষের পুত্র সত্যযজ্ঞ।



৩)ভাল্পবির পুত্র ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাল্ববেয়।



৪)শর্করাক্ষের পুত্র শার্করাক্ষ।



৫)অশ্বতরাশ্বের পুত্র বুড়িল আশ্বতরাশ্বি।



৬) ঋষি অরুণের পুত্র উদ্দালক আরুণি যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় অরুণের সন্তান উদ্দালক



৭) সত্যকাম জাবাল অর্থাৎ মাতা জবালার পুত্র সত্যকাম।



৮) মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস যিনি বিখ্যাত ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় আরণ্যকের লেখক, ঐতরেয় শব্দের অর্থ মাতা ইতরার পুত্র। মহীদাস শব্দের অর্থ হলো ধরণীর সেবক, এখানে দাস আজকের দিনের প্রচলিত পদবী দাস নয়।



ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ ভারতে এখনো অনেকটা এই নিয়মের অনুসরণ দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণভারতে অঞ্চলের নামই পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং পিতার নামও নিজ নামের সাথে যুক্ত হয়। যেমন সর্বপল্লী রামস্বামী ভেংকটরমণ, এখানে সর্বপল্লী হলো ব্যক্তিটি যে স্থানে জন্ম নিয়েছে সেই স্থানের নাম, রামস্বামী তার বাবার নাম বর ভেংকটরমণ হলো তার নিজের নাম। এখানে তার জন্ম অঞ্চল সর্বপল্লী নামক জায়গাট নামই তার পারিবারিক পদবি। আবার পশ্চিমভারতেও নিজের নাম, পিতার নাম ও জন্মঅঞ্চল তথা পরিবারের আদি বাসস্থানের নাম দিয়ে নাম গঠিত হয়৷ যেমন- দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর। এখানে দেবদত্ত ব্যক্তির নিজের নাম, রামকৃষ্ণ তার বাবার নাম আর ভাণ্ডারকর তার জন্মস্থানের নাম। পশ্চিম অঞ্চলে প্রায়ই তাদের জন্মস্থানের নামের শেষে 'কার' যুক্ত করে নামের পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন - বিজয় পারকার নামটির অর্থ হলো তার পরিবার বিজাপুর নামক অঞ্চলের আদি বাসিন্দা।



বর্ণ



প্রকৃত যে শব্দ ব্যবহার করা হতো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বোঝাতে তা হলো 'বর্ণ' ('জাতি' নয়)।



'বর্ণ' অর্থ হচ্ছে তা, যা বরণ করে নেওয়া যায় পছন্দের দ্বারা। 'বর্ণপ্রথা' বলে ধর্মগ্রন্থসমূহে কোনো শব্দ নেই। আছে ‘বর্ণাশ্রম’ বা 'বর্ণব্যবস্থা'। শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটির ধাতুগত অর্থ ‘বৃণোতে’, যার অর্থ ‘To Choose’ বা পছন্দ করা। অর্থাৎ পছন্দ অনুযায়ী আশ্রম বা পেশা নির্ধারণ করা। নিরুক্ত ২.৩ এ তাই বলা হয়েছে– 'বর্ণো বৃণোতেঃ' অর্থাৎ বর্ণ বরণ করে নেয়া হয় বা যে ব্রত নিজ ইচ্ছায় পছন্দ করে নির্বাচন করা হয় তাই বর্ণ। কালের পরিবর্তনে যোগ্যতাগুণে নির্ধারিত বর্ণাশ্রম আজ হয়ে গেছে জন্মভিত্তিক বর্ণ প্রথা! অথচ 'জাতি' ঈশ্বর দ্বারা পূর্বজন্মের কর্মফলের ভিত্তিতে প্রদত্ত হলেও 'বর্ণ' হচ্ছে আমাদের নিজস্ব পছন্দগত এবং গুণ ও কর্মানুসারে গৃহীত।


বর্ণের নির্ধারণ যে কর্মানুসারে সেটি "বর্ণ" শব্দের অর্থ এবং এর ব্যুৎপত্তি দ্বারাই সিদ্ধ হয়।



'বর্ণো বৃণোতেঃ' (নিরুক্ত ২।৩) অর্থাৎ বর্ণ শব্দটি 'বৃ' ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন৷



পাণিনীয় ধাতুপাঠের স্বাদিগণে 'বৃ' ধাতুর অর্থ দেওয়া সংবরণ (বৃ সংবরণে)। অর্থাৎ বৃ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বর্ণ শব্দটির ধাত্বার্থক ব্যূৎপত্তিগত অর্থ দেখলেই বোঝা যায় বর্ণ শব্দটি বরণ করে নেওয়া অর্থাৎ নিজে বেছে নেওয়া অর্থ প্রকাশ করে৷



অর্থাৎ নিজের ইচ্ছায় যে ব্রত পছন্দ করে বেছে নেয়া হয় তাই বর্ণ।



এই ব্রত বেছে নেয়াই কর্ম তা পুনরায় উক্ত হয়েছে-



ব্রতমিতি কর্ম্মনাম বৃণোতীতি সতঃ।

(নিরুক্ত ২।১৩)


'ব্রতম্' শব্দটি কর্মের নাম৷ যেহেতু 'বৃ' ধাতু দ্বারা আবৃত করা অর্থ প্রকাশ করে৷আর তা বেছে নেয়াই বর্ণ।




এই কারণেই বৈদিক ধর্মকে বলা হয় 'বর্ণাশ্রম ধর্ম'। বর্ণ শব্দটি ইঙ্গিত করে যে এটির ভিত্তি হচ্ছে নিজ পছন্দকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ও নিজ যোগ্যতা অনুসারে পরিচালিত ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া।অর্থাৎ নিজ পছন্দ অনুসারে কর্ম বা ব্রতকে বেছে নেয়াই বর্ণ।



যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত, অধ্যাপনা, গবেষণা পছন্দ করেন, তারা 'ব্রাহ্মণ বর্ণ'। যারা প্রতিরক্ষা, প্রশাসন যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করেন এবং পেশা হিসেবে বেছে নেন কর্মগুণে  তারা হন 'ক্ষত্রিয় বর্ণ'। যারা অর্থনীতি ও পশুপালনাদি পছন্দ করেন তারা হন 'বৈশ্য বর্ণ' এবং যারা নিয়োজিত আছেন অন্যান্য সেবামূলক কাজ-কর্মে, তারা হন 'শূদ্র বর্ণ'। এসব শুধু বোঝায় নানা ধরনের পছন্দ যেসব মানুষজন তাদের কর্মের জন্য নির্বাচন করেন এবং এর সাথে 'জাতি' বা জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই।



পবিত্র বেদ সনাতন ধর্মের সংজ্ঞাদাতা প্রধান ধর্মগ্রন্থ, এর সকল নীতিনৈতিকতা বোধের চরমতম উৎস। তাই পবিত্র বেদে চতুর্বর্ণ নিয়ে কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করা হয়েছে তা জানা প্রয়োজনীয়।



রুচং নো ধেহি ব্রাহ্মণেষু রুচꣳ রাজসু নস্কৃধি।

রুচং বিশ্যেষু শূদ্রেষু ময়ি ধেহি রুচা রুচম্॥

(যর্জুবেদ ১৮.৪৮)



অর্থাৎ হে ঈশ্বর ! আপনি আমাদের ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করুন, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করুন, বৈশ্যের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করুন, শূদ্রের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করুন এবং আমার মধ্যেও প্রতি স্থাপন করুন।



প্রিয়ং মা দর্ভ কৃণু ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ।

যস্মৈ চ কাময়ামহে সর্বস্মৈ চ বিপশ্যতে।।

(অথর্ববেদ ১৯.৩২.৮)


অর্থাৎ হে অজ্ঞান বিদারক পরমেশ্বর ! ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের জন্য, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্য, যাকে আমরা কামনা করি তার জন্য এবং সকলের জন্য আমাকে প্রিয় করো৷


অর্থাৎ সকল বর্ণের সকলের সাথে প্রীতিময় সম্পর্ক রাখার কথা বলছে পবিত্র বেদ।



ঋগ্বেদের ১০.১৩.১ নং মন্ত্রের সেই বিখ্যাত বাণী- "শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ" শোন হে বিশ্ববাসী, তোমরা সকলে অমৃতের সন্তান। অর্থাৎ পবিত্র বেদ বলছে আমরা সকলেই অমৃতের সন্তান। বেদ কোথাও বিভেদের কথা বলছে না।



ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫ বলছে– "অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতরো বাবৃধুঃ" অর্থাৎ তোমরা সকলে ভাই ভাই, কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়।



একে অপরকে ছোঁবেনা, অপরের ছোঁয়া খাবে না, ব্রাহ্মণ-শূদ্র অস্পৃশ্যতা এসবের কোন সুযোগ পবিত্র বেদে নেই। কারণ অথর্ববেদ ৩.৩০.৬ বলছে–



সমানী প্রপা সহ বোঽন্নভাগঃ সমানে যোক্ত্রে সহ বো যুনজ্মি। সম্যঞ্চোঽগ্নিং সপর্যতারা নাভিমিবাভিতঃ ॥

(অথর্ববেদ ৩.৩০.৬)


অর্থাৎ হে মনুষ্য ! তোমাদের জলের পান একসাথে এক হোক, খাদ্য গ্রহণ একসাথে এক হোক। তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে (বেদবাণীতে) যুক্ত করেছি, তোমাদের অগ্নিহোত্র একসাথে হোক ঠিক যেভাবে রথচক্রের কেন্দ্রের চারপাশে অর সজ্জিত থাকে।



অথর্ববেদ আরও বলছে–


সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং ব্রতং সহ চিত্তমেষাম্।

সমানেন বো হবিষা জুহোমি সমানং চেতো অভিসংবিশধ্বম্ ॥

(অথর্ববেদ ৬.৬৪.২)



অর্থাৎ তোমাদের চিন্তা-চেতনা এক হোক, তোমাদের মন এক হোক, তোমাদের সম্মেলন, আধ্যাত্মিকতা এক হোক, পান, ভোজন একসাথে হোক, সকলের লক্ষ্য এক হোক।



মূলত পবিত্র ঋগ্বেদের সংগঠনসূক্ত (১০.১৯০) ও পবিত্র অথর্ববেদের সংমনস্যম্ সূক্ত (৬.৬৪) পৃথিবীর প্রাচীনতম কোন লেখনী যাতে বলা হয়েছে সকল মানুষ সমান, সকলে যাতে একত্রে থাকে, সকলের মন এক হয়, সকলের সম্মিলন,।পান ভোজন একত্রে হয়, সকলের প্রার্থনা, যজ্ঞ যাতে একসাথে হয়, কারো মধ্যে যেন কোন ভেদাভেদ না হয়। অর্থাৎ পবিত্র বেদ অসংখ্য মন্ত্রে বারবার বলছে সকল মানুষ সমান, কোন অস্পৃশ্যতা, উঁচুনিচু ভেদাভেদ এসবের স্থান পবিত্র বেদে নেই।



ঋগ্বেদে (১.১১৩.৬) পরমাত্মা বলছেন–



ক্ষত্রায় ত্বং শ্রবসে ত্বং মহীয়া ইষ্টয়ে ত্বমর্থমিব ত্বমিত্যৈ।

বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ উষা অজিগর্ভুবনানি বিশ্বা।।


অর্থাৎ কেউ ক্ষাত্রবল, প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, কেউ মহাযজ্ঞাদি, ইষ্টকর্ম, কেউ অর্থ ব্যবস্থাপনা এভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবে গুণী জীবদের নিজ নিজ গুণ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের জন্য হে উষা, প্রতিনিয়ত জগতকে তুমি অন্ধকার হতে আলো দ্বারা জাগরিত করো।



অর্থাৎ এই মন্ত্রেও 'বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ' দ্বারা বলা হচ্ছে নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবগুণে কেউ ক্ষত্রিয় হয়ে প্রশাসক হয়, কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে মহাযজ্ঞাদি পরিচালনা করে, কেউ অর্থব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত থেকে বৈশ্য হয়, ভিন্ন ভিন্ন গুণের মানুষ এভাবে প্রতিদিন উষাকালে অন্ধকার দূর হলে নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়। এখানে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বা স্বভাব অনুসারে, বলা হয়নি জন্ম অনুসারে।



পবিত্র বেদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসহ প্রায় সব শাস্ত্রেই পদবি ভিত্তিক বর্ণপ্রথা অস্তিত্বহীন হলেও সমাজে বর্তমানে পদবী দিয়েই হিন্দুরা বর্ণ নির্ধারণ করে এবং মনে করে যে জন্ম ব্রাহ্মণের ঘরে হলেই ব্রাহ্মণ হয় এবং শূদ্রের ঘরে হলেই শূদ্র হয়। এর সমাধান কি ? অনেকেই নাথ , শীল এধরনের টাইটেলধারীদের খুব নিচুজ্ঞান করে, এরই বা কারণ কী?



সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ সংবিধান পবিত্র বেদ (ঋগ্বেদ ৯.১১২.১-৩) এ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বর্ণ হয় নিজের ইচ্ছে ও কর্ম অনুসারে।



৯.১১২.১ নং মন্ত্র স্পষ্ট বলে দিয়েছে–


"নানানাং বা উ ন ধিয়ো বি ব্রতানি জনানাম্।"


অর্থাৎ আমাদের নানা জনের চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি নানারকম। আর সেই অনুসারেই আমাদের ব্রত তথা কর্ম নির্ধারিত হয়।


আর আগেই নিরুক্ত থেকে দেখিয়েছি ব্রত তথা কর্ম ই বর্ণ।



৯.১১২.৩ নং মন্ত্রটি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার সুন্দর একটি রূপরেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এই তত্ত্বও প্রকাশ করেছে যে একজন মানব জন্ম থেকেই কারো দাস বা অধীন নয়, গুণ না থাকলেও সে সেই জন্মভিত্তিক বর্ণবাদীদের কথা অনুযায়ী সেই কাজ করতে বাধ্য নয়। বরং তার নিজ গুণ ও কর্মবলে সে সব উত্তরোত্তর উন্নতি করতে পারে  যা কিনা মহর্ষি মনু তার স্মৃতির ১০ম অধ্যায়ের ৬৫ নং শ্লোকেও বলেছেন।  মন্ত্রটির ভাবার্থ নিম্নরূপ–


কারুরহং ততো ভিষগুপলপ্রক্ষিণী ননা।
নানাধিয়ো বসুযবোঽনু গাইব তস্থিমেন্দ্রাযেন্দো পরি স্রব।।

অর্থাৎ আমি শিল্পবিদ্যার শক্তি রাখি, চিকিৎসকও হতে পারি, স্থাপত্যবিদও হতে পারি। আমার বুদ্ধি নম্র,নানা মেধা বা ভাব আমার কর্মের। তাই আমি যেখানে চাই সেখানেই যেন উত্তমভাবে আমার যোগ্যতা প্রয়োগ করতে ও সাফল্যলাভে সমর্থ হই।

অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তার নিজ মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম তথা ব্রত চয়ন করতে পারে।এটাই বর্ণব্যবস্থার প্রকৃত রূপ।পুরো মানবসমাজের শ্রমবিভাগের চিত্রটিই এই মন্ত্রে ফুটে উঠেছে। আমরা নিজ নিজ মেধা, কর্মদক্ষতা প্রভৃতির ভিত্তিতে আলাদা আলাদা বর্ণ বেছে নিই কিন্তু তা কখনো আমাদের মধ্যে বিভেদের কারণ হতে পারে না, আমরা দিনশেষে সবাই এক।



ছান্দোগ্য উপনিষদের ৪র্থ প্রপাঠকের ৪র্থ খণ্ডে আমরা দেখি পিতৃপরিচয়হীন সত্যকাম জাবালও নিজের গুণে হয়ে উঠেন অনেক বড় একজন ব্রাহ্মণ ঋষি। সত্যকামের মাতা যুবতী বয়সে ছিলেন একজন দেহকর্মী আর তারই ফলস্বরূপ পিতৃপরিচয়হীন এক সন্তান। তার ইচ্ছে নিজের সন্তানকে একজন ব্রাহ্মণ করে গড়ে তুলবেন। তাই সত্যকামকে পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত ঋষি গৌতমের আশ্রমে। মহর্ষি সত্যকামকে তার বংশপরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তখন সত্যকাম জাবাল বিন্দুমাত্র লজ্জা, সংকোচ না করে নির্ভয়ে নিজের জন্মের বিব্রতকর ইতিহাস ঋষি গৌতমের সকল শিষ্যদের সামনে না লুকিয়ে অকপটে বলে দিলেন। তাঁর এই অসামান্য সততা দেখে ঋষি গৌতম মুগ্ধ সুরে বললেন–



"তং হোবাচ নৈতদব্রাহ্মণো বিবক্তুমর্হতি সমিধং সোম্যাহারোপ ত্বা নেষ্যে ন সত্যাগদা..."


অর্থাৎ এরকম সত্য কথা নিঃসংকোচে অকপটে বলে ফেলা ব্রাহ্মণ গুণেরই পরিচয়। যাও হে বালক সমিধ নিয়ে এসো। আমি তোমাকে উপনয়ন দেবো।



কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়–


"অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত,

তুমি দ্বিজোত্তম,

তুমি সত্যকূলজাত।"


সত্যবাদী সত্যকাম অব্রাহ্মণ নন, তিনি দ্বিজেরও উত্তম, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,। শূদ্র কুলে নয়, তিনি সত্যকূলে জাত!



আমরা দেখতে পাই অব্রাহ্মণ কূলে, অজ্ঞাত কূলে জন্ম নেয়া এই সত্যকামকে তখন বিখ্যাত ঋষি গৌতম নিজে উপনয়ন দিলেন এবং পরবর্তীতে কালক্রমে সত্যকাম জাবাল হয়ে উঠলেন একজন ঋষি। তাঁর নামে লেখা হলো একটি উপনিষদও। যার নাম জাবাল উপনিষদ!



গীতা ৪.১৩ নং শ্লোক বলছে– "চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ" অর্থাৎ গুণ ও কর্মের অনুসারেই চার বর্ণের শ্রেণীবিভাগ হয়েছে।



তাহলে বুঝতেই পারছেন আমাদের প্রধান শাস্ত্র বেদ, উপনিষদ,গীতা সবকটি জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে।



যেহেতু পবিত্র বেদে বলা হয়েছে–


"অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতরো বাবৃধুঃ।" (ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫)

অর্থাৎ হে মনুষ্য ! তোমরা কেউ ছোট নও, কেউ বড় নও। সবাই ভাই ভাই।



বেদ হতে আমরা স্পষ্ট সংকেত দেখতে পারি, বর্ণ হবে গুণের ভিত্তিতে, কর্মের ভিত্তিতে, যোগ্যতার ভিত্তিতে, জন্মের ভিত্তিতে নয়। তাই বেদবিরুদ্ধ অযৌক্তিক অমানবিক বর্ণপ্রথা সমর্থনযোগ্য নয়।



সনাতন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানেই বরাবরই পবিত্র বেদের এই ঐশ্বরিক আদেশকে না জেনেই শূদ্র শব্দটাকে হীনজ্ঞান করা হয়। অর্থাৎ শূদ্ররা বেদ পাঠ বা শ্রবণ করতে পারবে না, তারা নিচু ইত্যাদি। যদি শূদ্র বেদপাঠ করে তার জিহ্বা কেটে নিতে হবে,বেদ শ্রবণ করলে কানে গরম সীসা ঢেলে দিতে হবে এরকম নানান শাস্তির প্রদর্শন পর্যন্ত মনুস্মৃতিতে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছে। 


অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যও এই অনুদার মতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি তার ব্রহ্মসূত্র ১।৩।৩৮ এর ভাষ্যে  বলেছেন  "শূদ্রের যে ব্রহ্মবিদ্যাতে অধিকার নাই তার অন্য কারণ দেখানো হচ্ছেঃ যেহেতু শূদ্রের বেদশ্রবণ, বেদাধ্যয়ণ, বেদার্থপরিজ্ঞান ও বৈদিক কর্মানুষ্ঠানে প্রতিষেধ আছে, অতএব শূদ্রের বেদাধিকার নাই। স্মৃতিতে লিখিত আছে যে, শূদ্র যদি বেদ শ্রবণ করে তাহা হইলে সীস ও লাক্ষাদ্বারা তার কান পূর্ণ করে দেবে। আর শূদ্রের কাছে বেদ অধ্যয়ণ করবে না, এমন নিষেধ আছে। এখন জানা যাচ্ছে যে যার নিকট বেদ অধ্যয়ণ করা নিষেধ আছে, সে নিজেও কোনো ভাবে বেদ অধ্যয়ণ করতে পারবে না। শ্রুতিতে এও লেখা আছে যে শূদ্র বেদ উচ্চারণ করলে তার জিহ্বা কেটে ফেলতে হবে এবং যে শূদ্র বেদ অধ্যয়ন করবে তার শরীর ছেদন করতে হবে। এভাবে যখন শ্রবণ ও অধ্যয়নে নিষেধ করা হল তখন যে অর্থ পরিজ্ঞান ও কর্মানুষ্ঠান নিষিদ্ধ হবে তাতে আর সন্দেহ কি? শ্রুতি প্রমাণ থেকে আরও জানা যায় যে, শূদ্রকে বেদ অধ্যয়ণের অনুমতিও দেবে না। বিদূর ও ধর্মব্যাধ প্রভৃতির যে মোক্ষ লাভ হয়েছিল তার কারণ পূর্বজন্মের জ্ঞান, যদি একবার জ্ঞানের উৎপত্তি হয় তাহলে সেই জ্ঞান অবশ্যই ফলের উৎপাদন করে। এইজন্যই বিদূর প্রভৃতির মোক্ষ লাভ হয়েছিল। ‘শ্রারয়েচ্চতুরো বর্ণান’ এই বচন প্রমাণে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে ইতিহাস ও পুরাণ চার বর্ণকেই শোনানো যায়। কেবল ইতিহাসেই চার বর্ণের অধিকার আছে। কিন্তু বেদপাঠ করে ব্রহ্ম আলোচনা করবে অতএব ব্রহ্মবিদ্যাতে শূদ্রের অধিকার নাই, এটাই জানা যাচ্ছে।”

[শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ১ম অধ্যায়, ৩য় পাদ, ৩৮ নং শ্লোক; সঙ্কলক ও প্রকাশকঃ শ্রীযুক্ত মহেশচন্দ্র পাল]



গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে একটি শ্লোক রয়েছে–


ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রানাঞ্চ পরন্তপ।

কর্ম্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ।। 

১৮/ ৪১



এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় শঙ্করাচার্য তার গীতাভাষ্যে বলেছেন, “ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণকে বোঝানোর জন্য একটি সমস্তপদ ব্যবহৃত হয়েছে আর শূদ্রদের বোঝানোর জন্য একটি অসমস্ত পদ ব্যবহার করা হয়েছে। এর তাৎপর্য এই যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য ছাড়া অন্য সকল মানুষই শূদ্রের সমান এবং তাদের মধ্যে কারো বেদ পাঠে অধিকার নেই।”



[গীতা ১৮/৪১ এর শঙ্করভাষ্য; সম্পাদক ও প্রকাশকঃ ঐ]



গীতার নবম অধ্যায়ের ৩২ নং শ্লোকে বলা হয়েছেঃ



মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেঅপি স্যু পাপযোনয়ঃ।স্ত্রিয়ো বৈশ্যস্তথা শূদ্রাস্তেঅপি যান্তি পরাং গতিম।। গীতা ৯/৩২



এর অর্থ অনেকে এভাবে করে থাকেন, ” হে পার্থ, আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী, শূদ্র, বৈশ্য এবং পাপযোনিরা পরমগতি লাভ করে থাকে।”



গীতার বিখ্যাত টীকাকার শ্রীধরস্বামীও স্ত্রী, শূদ্র, বৈশ্যকে নয় বরং অন্ত্যজ বা অচ্ছুৎদেরই পাপযোনি বলেছেন। যদিও এখানে পাপযোনী বলতে যাদের কথা বলা হয়েছে তা আমরা অন্যত্র আলোচনা করবো কিন্তু শ্রীধর বা অধুনাকালে জগদীশ চন্দ্র ঘোষ সহ অনেকেই এইস্থলে শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যার বিরোধী।



শংকরাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে বলেছেন, “আরও [ শুন] হে পার্থ- আমাকে আশ্রয় রূপে গ্রহণ করিয়া- যে সকল “পাপযোনি” অর্থাৎ পাপজন্মা অবস্থিতি করে, তাহারা কে? – স্ত্রীজাতি, বৈশ্য ও শূদ্র । [যেহেতু তাহারা আমাকে আশ্রয় করে , এই জন্য] তাহারাও প্রকৃষ্ট গতি লাভ করিয়া থাকে।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শঙ্কর ভাষ্যে শঙ্করাচার্য স্পষ্টভাবেই ‘স্ত্রী, শূদ্র ও বৈশ্যকে’ পাপযোনি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।



[শঙ্করভাষ্য সমেত ভগবদ্ভীতা; সম্পাদক- মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ তর্কভূষণ; প্রকাশক- ক্ষিরোদচন্দ্র মজুমদার]



এছাড়াও প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিগণের নামে প্রচলিত তথাকথিত স্মৃতিসমূহে এইসকল বিধান ব্রাহ্মণ্যবাদী স্মৃতিশাস্ত্রকাররা করেছেন। কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা মানুষ, পরমাত্মাকে এবং তার বিদ্যাকে জানার অধিকার আমাদের সবার রয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে এই ভেদজ্ঞান কেন?  পরমাত্মা তো ভেদজ্ঞান করেন নি। তিনি তো সবার জন্য বেদজ্ঞান উন্মুক্ত করেছেন। বেদে পরমেশ্বর বলছেন–



যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ ।

ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্য্যায় চ স্বায় চারণায় চ।।

প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ

ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপমাদো নমতু ।।

(যজুর্বেদ ২৬।২)



অর্থাৎ ঈশ্বর উপদেশ দিচ্ছেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র,বৈশ্য, পুরুষ, স্ত্রী, সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মানুষকেই আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করেছি, তোমরাও সেইরূপ অন্যদের উপদেশ করো।



তাহলে এটা স্পষ্ট যে, সকল বর্ণের জন্যই বেদে অধিকার সমান। শূদ্রের বেদে অধিকার নেই,এই বিভেদের সৃষ্টি মানুষরাই করেছে, পরমাত্মা করেন নি। এখন এ পর্যায়ে আমাদের এই শঙ্কার উপস্থিত হয়ে, যদি শূদ্রদেরও বেদে অধিকার তবে শাস্ত্রে তাদের উপনয়নের বিধান নেই কেন?।আসলে আমরা জানিনা বলেই এমনটা ভাবি। কেননা সংস্কার বিধি অনুযায়ী  প্রত্যেক শিশু বেদাধ্যয়নের জন্য গুরুর নিকটে গমন করবেন এবং গুরু তাদের উপনয়ন সংস্কারের পর গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষাপূর্বক বেদের অধ্যাপনা শুরু করবেন। সেই শিশু যে ঘরেই জন্ম নিক না কেন। কিন্তু, মনুস্মৃতি এবং গৃহ্যসূত্র আদি  গ্রন্থে তিনটি বর্ণের উপনয়নের উল্লেখ পাওয়া যায় যা নিয়ে অনেকে সংশয়ে ভুগেন। যথা -



গর্ভাষ্টমেব্দে কুর্ব্বীত ব্রাহ্মণস্যোপনায়নম্।

গর্ভাদেকাদশে রাজ্ঞো গর্ভাত্ত দ্বাদশে বিশঃ।। 

(মনু০ ২।৩৬)



অষ্টমে বর্ষে ব্রাহ্মণমুনেয়ৎ।গর্ভাষ্টমে বা।একাদশে ক্ষত্রিয়ম্।দ্বাদশে বৈশ্যমন।। (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১।১৯।১-৩ )



অর্থাৎ ব্রাহ্মণের অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়ের একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যের দ্বাদশ বর্ষে উপনয়ন বিধেয়।



তাহলে প্রশ্ন এই যে, শূদ্রের কি তবে উপনয়ন সংস্কার সংস্কার নেই? থাকলে এখানে শূদ্রের নাম নেই কেন? এই শঙ্কার মূল কারণ জন্মগত বর্ণবাদে বিশ্বাস। কিন্তু বর্ণব্যবস্থা তো জন্মানুসারে নয় বরং কর্মানুসারে হয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন -



"চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"

(গীতা ৪।১৩)


অর্থাৎ আমি গুণ কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি।


বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র বলছে-


প্রকৃতিবিশিষ্টং চাতুর্বণ্যং সংস্কারবিশেষাচ্চ

বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ৪।১

অর্থাৎ প্রকৃতি ও সংস্কার বিশেষ দ্বারা চাতুর্বর্ণ্য হয়ে থাকে।



বর্ণব্যবস্থা যে কর্মানুসারে সেটা ব্রাহ্মণগ্রন্থেও স্পষ্ট। যথা -



"সঃ (ক্ষত্রিয়ঃ) হ দীক্ষমাণ এব ব্রাহ্মণতামভ্যুপৈতি।।

(ঐতরেয় ৭।৩৪)"

অর্থাৎ ক্ষত্রিয় দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত করতে পারে।



তস্মাদপি (দীক্ষিতম্) রাজন্যং বা বৈশ্যং বা ব্রাহ্মণ ইত্যেব ত্রুয়ান্, ব্রাহ্মণো হি জায়তে যো যজ্ঞাজ জায়তে।।

শতপথ ব্রাহ্মণ (৩।২।১।৪০)


অর্থাৎ বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।



অর্থাৎ স্পষ্ট যে অন্য বর্ণের বংশে জন্ম নিয়েও কেউ নিজ কর্মগুণে নিজ নিজ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারেন।



এখন চারটি বর্ণ বিষয়ে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক -


১। ব্রাহ্মণঃ  'ব্রহ্মণ' প্রাতিপদিক দ্বারা 'তদধীতে তদ্বেদ' (অষ্টা০ ৪।২।৫৮) অর্থে "অপ" প্রত্যয় যোগে ব্রাহ্মণ শব্দ হয়।



 এর ব্যুৎপত্তি এই প্রকার -



"ব্রহ্মণা বেদেন পরমেশ্বরস্য উপাসনেন চ সহ বর্তমানো বিদ্যাদি উত্তমগুণযুক্তঃ পুরুষঃ"


অর্থাৎ বেদ এবং পরমাত্মার অধ্যয়ন এবং উপাসনাতে নিযুক্ত থেকে বিদ্যা আদি উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণ বলা হয়।



ব্রাহ্মণ গ্রন্থে - "ব্রাহ্মণো ব্রতভূত" (তৈ০ স০ ১।৬।৭।২) অর্থাৎ ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ ব্রতের আচরণকারী।



ঋগ্বেদ ৭.১০৩.১,৮,৯ নং মন্ত্রেও ব্রাহ্মণের গুণাবলী কী কী হতে হবে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। ব্রাহ্মণকে সারাবছর তপস্যারত হতে হবে, যজ্ঞকর্মাদি করতে হবে, সৌম্য, শান্ত হতে হবে, বৈদিক নিয়মাদি কঠোরভাবে পালন করতে হবে, প্রত্যহ ধ্যান, উপাসনাদি কর্ম করতে হবে ইত্যাদি।



ব্রাহ্মণের কর্ম হচ্ছে-

অধ্যাপনমধ্যয়নং য়জনং য়াজনং তথা।

দানং প্রতিগ্রহশ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।

(মনুস্মৃতি ১।৮৮)



- অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজ্ঞ করা ও করান, দান দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা এই ছয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম।


ভগবদগীতাতে ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম কী হতে হবে তার বর্ণনায় বলা হয়েছে-


শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।

জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।

(গীতা ১৮.৪২)


অনুবাদ– শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য-এগুলো ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম।




২। ক্ষত্রিয়ঃ "ক্ষণু" হিংসা অর্থযুক্ত (তনাদি) ধাতুর সাথে 'কতঃ' প্রত্যয় যোগে "ক্ষতঃ" শব্দের সিদ্ধি হয়, আর "ক্ষত" উপপদে ত্রৈঙ্ = পালন অর্থে  (ভ্বাদি) ধাতুর সাথে 'অন্বেষ্বপি দৃশ্যতে' (অষ্টা০ ৩।২।১০১) সূত্রের সাথে 'উ' প্রত্যয় পূর্বপদান্যকারলোপ হয়ে "ক্ষত্র" শব্দ হয়েছে। "ক্ষত্র এব ক্ষত্রিয়ঃ" স্বার্থে ইয়ঃ যোগে 'ক্ষত্রিয়'।



"ক্ষদন্তি রক্ষতি জনান্ ক্ষত্র" যিনি জনগণের রক্ষা কার্য করেন, অথবা "ক্ষয়তে হিংস্বতে নশ্যতে পদার্থো যেন স ক্ষত্রঃ" অর্থাৎ আক্রমণ, ক্ষতি হতে লোকদের রক্ষা করে তাকে ক্ষত্রিয় বলা হয়।



ব্রাহ্মণ গ্রন্থে - "ক্ষত্রং রাজন্যঃ" (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৮।৬) "ক্ষত্রস্য বা এতদ্রুপং যদ্ রাজন্যঃ" (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩।১।৫।৩) অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ক্ষত্রেরই রূপ, যিনি প্রজার রক্ষক।



অথর্ববেদ ৪.২২.১,৩ এ ক্ষত্রিয়ের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলা হচ্ছে ক্ষত্রিয়কে হতে হবে সাহসী, অনন্য, দানশীল, জনগণের প্রাণ ও বিত্তের রক্ষক,দক্ষ শাসক ও শত্রুর দমনকারী।



ক্ষত্রিয়ের কর্ম হচ্ছে -


প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।

বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ॥

(মনু০ ১।৮৯)



- ব্রহ্মচর্যপূর্বক বেদের অধ্যয়ন করা, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করা, সুপাত্রকে দান করা, প্রজার রক্ষা করা বিষয়ে অনাসক্ত হয়ে জীতেন্দ্রিয় থাকা ক্ষত্রিয়ের কর্ম।



ভগবদগীতায় বলা হয়েছে-



শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্।

দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্।।

(গীতা ১৮.৪৩)



অনুবাদ– শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান ও শাসন ক্ষমতা-এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম।




৩। বৈশ্যঃ বিশঃ মনুষ্যনাম (নিঘন্টু০ ২।৩) "বিশ প্রতিপদিক দ্বারা অপত্যার্থে "যঞ" ছান্দস প্রত্যয় যোগে "বৈশ্য" শব্দ হয়েছে।




"যো যত্র তত্র ব্যবহারবিদ্যাসু প্রবিশতি সঃ বৈশ্যঃ ব্যবহারবিদ্যাকুশলঃ জনো বা" যিনি বিবিধ ব্যবহারিক বিষয়ে প্রবিষ্ট থাকে এবং বিবিধ বিদ্যাতে কুশল,  তিনি বৈশ্য।



ব্রাহ্মণগ্রন্থে -  "এতদ্ বৈ বৈশ্যস্য সমৃদ্ধং যং পশবঃ" (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ১৮।৪।৬), "তস্মাদু বহুপশু বৈশ্বদেবো হি জগতো বৈশ্য" (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ৬।১।১০) অর্থাৎ পশুপালন দ্বারা বৈশ্যের সমৃদ্ধ হয়, এটিই বৈশ্যের কর্তব্য।



পবিত্র অথর্ববেদ ৩.১৫.১ এ বলা হয়েছে-



ইন্দ্রমহং বণিজং চোদয়ামি স ন ঐতু পুরএতা নো অস্তু।

নুদান্নরতিং পরিপন্থিতং মৃগং স ঈশানো ধনদা অস্তু মহ্যাম।।


অর্থাৎ বৈশ্যরা বাণিজ্যের কেন্দ্র,তারা অলসদের কর্মঠ হবার প্রেরণা দেবে,দানে অনাগ্রহীদের ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে তুলবে, বাণিজ্যে অন্যের সম্পদ মজুদকারী নির্মমদের শাস্তি প্রদান করবে,তারা হবে সবার জন্য দাতা ও সাহায্যকর্তা, গ্রহীতা ও লোভী নয়।



বৈশ্যের কর্ম হচ্ছে -


পশুনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।

বণিক্পথং কুসীদং চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।।

 (মনু০ ১।৯০)


- গবাদি পশুর পালন এবং বৃদ্ধি করা, বিদ্যা ও ধর্মের বৃদ্ধি করতে ও করাইতে ধনসম্পত্তি ব্যয় করা, অগ্নিহােত্রদি যজ্ঞ করা, বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করা, সর্বপ্রকার বাণিজ্য করা এবং বৃদ্ধির জন্য ধন প্রয়োগ করা এগুলো বৈশ্যের গুণ ও কর্ম।



ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে-


কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্।

(গীতা ১৮.৪৪)


অনুবাদঃ কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়েকটি বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম।



৪। শূদ্রঃ  শুচ্ - শোকার্থক (ভ্বাদি) ধাতুর সাথে "শুচের্দশ্চ" (উণা০ ২।১৯) সুত্রের সাথে "রক্" প্রত্যয়, উকারকে দীর্ঘ, চ কে দ করে শুদ্র অর্থ হয়েছে। শূদ্র = শোচনীয়ঃ শোচ্যাং স্থিতিমাপন্নো বা, সেবায়াং সাধুর্ অবিদ্যাদিগুণসহিতো মনুষ্যো বা" অর্থাৎ শুদ্র সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অজ্ঞানতার কারণে কোন প্রকারের উন্নত স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারে না  এবং  যিনি নিজের নিম্ন স্থিতির হওয়ার কারণে তথা নিজের উন্নতির চিন্তা করেন তথা নিজের প্রভূর ভরণ পোষণের চিন্তা করেন ওইরূপ সেবক মানুষ।



ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও এই ভাব দেখা যায় - "অসতো বা এষ সম্ভূতো যৎ শূদ্রঃ" (তৈ০ ৩।২।৩।৯) অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে যার নিম্ন জীবনস্থিতি, যে কেবল সেবা আদি কার্য করে, ওইরূপ মানুষ শূদ্র। শূদ্রের কর্ম হচ্ছে -



একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।

এতেষামেৰ বর্ণনাং শুশ্রষামনসূয়য়া।।

(মনু০ ১।৯১)


-নিন্দা, ঈর্ষা এবং অভিমানাদি দোষ পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, এবং বৈশ্যদিগকে যথােচিত সেবা করা শূদ্রের কর্তব্য এবং তদ্দ্বারাই জীবন যাত্রা নির্বাহ করা। এটিই শূদ্রের একমাত্র গুণ এবং কর্ম।



ভগবদগীতায় বলা হয়েছে-


পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।।

(গীতা ১৮.৪৪)


অনুবাদ– পরিচর্যাত্মক কর্ম শূদ্রের স্বভাবজাত।



মোটকথা  বেদজ্ঞানী এবং পরমাত্মার উপাসনাতে নিযুক্ত উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ।  জনগনের রক্ষা কার্য,প্রশাসন,যুদ্ধবিদ্যায় যারা দক্ষ তারাই ক্ষত্রিয়। আর যারা বিভিন্ন ব্যবহারিক বিদ্যাতে কুশল এবং ব্যবসায়ী তারাই বৈশ্য। যারা পড়াশোনা না করার কারণে জ্ঞান তথা বিদ্যাহীন তাদের গুণ ও কর্ম অনুসারে  শূদ্র বলা হয়, কারণ তারা বিজ্ঞান সম্বন্ধিয় কার্য করতে পারে না কিন্তু কায়িক পরিশ্রম করতে পারে। এজন্য তারা কায়িক পরিশ্রমূলক সেবামূলক কার্যে নিযুক্ত থাকেন। এভাবে রাষ্ট্রে কর্ম ও গুণ অনুসারে বর্ণবিভাগ করা হয়েছে ঠিক যেভাবে আধুনিক সকল রাষ্ট্রেই হয়। এই বর্ণ গুণ কর্মানুসারে,জন্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।কেউ ছোটবেলা হতে পড়াশোনা,বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে যে কোনটাই হতে পারেন।



বর্তমানকালে যেমন একজন বালক বা বালিকা শৈশবকালে স্কুলে ভর্তি হয়,এরওর ক্রমে ক্রমে কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে নিজ মেধা ও দক্ষতা অনুসারে তারা ভিন্ন ভিন্ন সার্টিফিকেট অর্জন করে সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যোগদান করে।আর যারা পড়ালেখা করেনা তারা বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমমূলক সেবাকার্যে যোগদান করে জীবিকা নির্বাহ করে।



ঠিক তেমনি বৈদিক যুগে শৈশবকালে উপনয়ন নিতে হতো,উপনয়ন নেয়ার অর্থ হলো গুরুগৃহে তথা গুরুকূলে ভর্তি হওয়া।ক্রমে ক্রমে গুরুকূলে বিভিন্ন স্তর পার হয়ে পূর্ণ যুবক অবস্থায় যখন শাস্ত্রীয় ও জাগতিক সকল পাঠ সম্পন্ন হতো তখন তারা নিজ নিজ গুণ,মেধা ও দক্ষতা অনুসারে ৩টি ভিন্ন বর্ণ লাভ করতো (ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) যা আজকের দিনের সার্টিফিকেটের সমতূল্য।এই তিনবর্ণকে বলা হয় দ্বিজ বা দুইবার জন্মগ্রহণকারী।একবার এরা মাতৃগর্ভ হতে জন্ম নিয়েছে,দ্বিতীয়বার বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে অজ্ঞানের অন্ধকার জঠর থেকে জ্ঞানের আলোকিত জগতে জন্ম নিয়েছে।



আর যারা উপনয়ন না নিয়ে গুরুগৃহে ভর্তি না হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরী শিক্ষা লাভ করতনা বলে কায়িক সেবামূলক শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা চতুর্থ বর্ণ তথা শূদ্র পরিচয়ে পরিচিত হতো।



কোন মানব শিশুই কোন নির্ধারিত বর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। প্রত্যেক শিশুই অজ্ঞানী হয়েই জন্মগ্রহণ করে, তারপর বিদ্যা অর্জনের পর নিজের মেধা অনুসারে নিজ নিজ পদ গ্রহণ করতে পারে।



কেউ বেদবিশারদ্, কেউ ভালো যোদ্ধা, কেউ ব্যবহারিক বিদ্যাতে নিপুণ হন আবার কেউবা এসবের কোনটাতেই দক্ষ না হয়ে অজ্ঞানীই রয়ে যান। এজন্য সন্তানের ইচ্ছায় অথবা পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী সেই বর্ণে সেই সন্তানকে উক্ত বর্ষে উপনয়ন সংস্কার করা হয়। যেমন মনু বলছেন -



ব্রহ্মবর্চসকামস্য কার্য বিপ্রস্য পঞ্চমে।

রাজ্ঞো বলার্থিন ষষ্ঠে বৈশ্যস্যেহার্খিনোষ্টমে।। (মনু ২।৩৭)



-এই সংসারে যার ব্রহ্মতেজ, বিদ্যা আদির শিঘ্র এবং অধিক প্রাপ্তির কামনাকারী ব্রাহ্মণ বর্ণের ইচ্ছুকের (মাতা পিতার ইচ্ছার আধারে প্রয়োগ) উপনয়ন সংস্কার পঞ্চম বর্ষে করা উচিৎ। এই সংসারে বল-পরাক্রম আদি ক্ষত্রিয় বিদ্যার অধিক প্রাপ্তির কামনাকারী ক্ষত্রিয় বর্ণের ইচ্ছুকের ষষ্ঠ বর্ষে এবং এই সংসারে ধন ঐশ্বর্যের শিঘ্র কামনাকারী বৈশ্য বর্ণের ইচ্ছুকের অষ্টম বর্ষে উপনয়ন সংস্কার দেয়া উচিত।



আর উপনয়নে শূদ্রের উল্লেখ না থাকাই প্রমাণ করে যে, জন্মগত শূদ্র বলে কিছু নেই। কারণ এই দ্বিজ দীক্ষার সংস্কার তিন প্রকারের। যে সন্তান যেই বর্ণে প্রবেশ করতে চায় সে সেই বর্ণে দীক্ষা গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ পিতামাতার সংকল্প ও ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণ লাভের জন্য উপনয়নে দীক্ষিত হন এবং শিক্ষালাভ করে এই তিন বর্ণের যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেন। আর এভাবে শিক্ষা দীক্ষার মাধ্যমে যারা এই তিন বর্ণের গুণকে ধারণ করতে পারে না বা করেনা তারা শূদ্র হয়ে থাকেন। আর কোন পিতা মাতাই চান না যে, তার পুত্র শূদ্রত্বে স্থিতি গ্রহণ করুক।বর্তমানেও তাই হয়।মাতাপিতা ইচ্ছা করেন সন্তানকে চিকিৎসক বানাবেন,প্রকৌশলী বানাবেন ইত্যাদি আর সেই অনুযায়ীই তারা তাদের সন্তানকে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন।কিন্তু তার মানে এই নয় যে কর্মগুণে শূদ্রত্বকে খাটো করার সুযোগ রয়েছে।কেননা পবিত্র বেদে প্রতিটি সৎ পেশাকেই প্রশংসিত করা হয়েছে।



এস্থলে বিখ্যাত আর্যসমাজী দার্শনিক পণ্ডিত স্বামী দর্শনানন্দ সরস্বতীর গবেষণামূলক বচনগুলি বাস্তবিকই প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্বীয় গ্রন্থমালার পূর্বার্ধে ব্রহ্মবর্চসকামস্য কার্যং- এই মনু বাক্য অনুসারে গৃহ্যসূত্রের অষ্টম বর্ষে ব্রাহ্মণমুপনয়েৎ- এই বচনের অর্থ এইরূপ লিখেছেন যে ব্রাহ্মণবালকের অর্থাৎ ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বালকের উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে হওয়া উচিত। এইরূপ মন্ত্র বেদ মন্ত্রের অনুকূল অথচ যুক্তিসিদ্ধ। ব্রাহ্মণ বালক বলতে ব্রাহ্মণের বীর্যোৎপন্ন বালক নয়, পরন্তু ব্রাহ্মণপদ লাভের যোগ্য যে বালক, তাকেই বুঝতে হবে। কারণ, বেদমন্ত্রের বিরুদ্ধার্থ করলে সমূহ সূত্র অপ্রামাণিক হয়ে যাবে। বালক যদি শূদ্র সন্তান হয়েও মেধাবী হয়, তাহলে ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বলে বিবেচিত হলে তার উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়পদের যোগ্য হলে একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যপদের যোগ্য হলে দ্বাদশ বর্ষে হবে। পরন্তু যেন স্মরণ থাকে যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য (পদের যোগ্য) হবার জন্যই উপনয়ন সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে থাকে, শূদ্র হবার জন্য উপনয়নের আবশ্যক হয় না। উপনয়নের পূর্ব সকলেই শূদ্রই থাকে, তৎকালে কারও দ্বিজ পরিচয় হয় না।উপনয়ন নিয়ে বিদ্যাশিক্ষা লাভ করার মাধ্যমে মানুষের দ্বিতীয়বার জন্মলাভ হয় এবং তখন সে দ্বিজ আখ্যা পেয়ে থাকে। প্রথম জন্ম হয় মাতৃজঠর হতে এবং দ্বিতীয় জন্ম বিদ্যারূপ মাতা ও গুরুরূপ-পিতা হতে হয়। যে বিদ্যারূপিণী মাতার গর্ভে প্রবেশ করেনি তাকে দ্বিজ বলা যাবে কিরূপে? যে দ্বিজই হয়নি, সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য হবে কিরূপে? কারণ, দ্বিজ হওয়া বলতে উপনয়ন সংস্কারের পর বেদারম্ভ সংস্কার দ্বারা ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বালকের দ্বিজত্বের পরিপক্কতা বুঝায়। বিদ্যাধ্যয়ন সমাপ্তির পর স্ব স্ব গুণ, কর্ম ও স্বভাবের যোগ্যতানুসারে কেউ ব্রাহ্মণপদ, কেহ ক্ষত্রিয়পদ, কেউ বা বৈশ্যপদ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। গীতাতেও এরূপ উক্তি আছে। যে ব্যক্তি ২৫ বৎসর বয়ক্রম পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন না করে এবং বৈদিক শিক্ষা প্রাপ্ত না হয়ে উপনয়ন হতে বঞ্চিত থাকে, সেই ব্যক্তিই শূদ্র এবং উপনয়ন সংস্কারের পূর্বে সকলে শূদ্রই থাকে।

(দর্শনানন্দ গ্রন্থমালা, পূর্বার্দ্ধ পৃ ১৫২-১৬৩)।



এক কথায় আমরা যেমন অজ্ঞানী বালক বালিকাদের জ্ঞানের আলোয় আলেকিত করার জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করি সেরূপ শূদ্ররূপী জ্ঞানহীন সকল মনুষ্য সন্তানকে তৎকালে উপনয়ন দিয়ে গুরুকুলে ভর্তি করা হতো।আমরা যেমন এখন শিক্ষাদীক্ষা শেষ করে নিজ নিজ মেধা অনুযায়ী কেউ চিকিৎসক,কেউ প্রকৌশলী,কেউ শিক্ষক এই ধরনের সনদপত্র পাই তখনও ব্রহ্মচর্য আশ্রম শেষ হবার পর গুরুকুল হতে মেধা ও দক্ষতা অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়,কেউ বৈশ্য এরূপ সনদপত্র তথা স্বীকৃতি দেয়া হতো।এখনো যেমন যারা শিক্ষিত হতে পারেনা তারা কঠোর জীবনসংগ্রামে পতিত হয়ে কঠিন সব সংগ্রাম মূলক কর্ম বেছে নেয় তখনও তাই হতো আর এটিই শূদ্র।



মহর্ষি মনুর কামান্মাতা পিতা চৈনং- এই বচন হতেই বুঝা যায় যে মনুষ্যেরা জন্মমাত্রই শূদ্র হয়ে থাকে এবং পিতামাতার কামনা বা ইচ্ছানুসারে তারা সন্তানকে শিক্ষা দেন।যে পিতামাতার ইচ্ছা তারা সন্তানকে ব্রাহ্মণ হিসেবে গড়ে তুলবেন তারা ৮ বছর বয়সের মধ্যে,যে পিতামাতার ইচ্ছা সন্তানকে ক্ষত্রিয় বানানোর তারা ১১ বছর বয়সের মধ্যে এবং যে পিতামাতার ইচ্ছা সন্তানকে বফশ্য হিসেবে দেখার তারা ১২ বছর বয়সের মধ্যে সন্তানকে গুরুকুলে ভর্তি করবেন অর্থাৎ উপনয়ন দেবেন।



পণ্ডিতেরাও বলেন- জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ অর্থাৎ জন্মের সময় সবাই শূদ্রই থাকে,সে ব্রাহ্মণ পুত্রই হোক বা শূদ্র পুত্রই হোক। সকলে পরবর্তীকালে স্ব স্ব মেধা, বলবিক্রম বা ব্যবহার অনুযায়ী যথাযথকালে বৈদিক দীক্ষা প্রাপ্ত হয়ে বিদ্যার্জনের জন্য বৈদিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। তথায় অধ্যয়ন সমাপনান্তে সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ স্নাতকেরা ব্রাহ্মণ, দ্বিতীয় বিভাগে ক্ষত্রিয় এবং তৃতীয় বিভাগে বৈশ্য আখ্যা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। অনুত্তীর্ণ যুবকেরা শূদ্র থেকে যায়, বিদ্যালাভে অসমর্থ হওয়ায় তৎকালে তারা বিদ্যাচিহ্ন (পৈতা বা যজ্ঞোপবীত) পরিত্যাগ করে।



পৈতা বা যজ্ঞোপবীত হলো বর্তমান যুগের গ্র্যাজুয়েশন রোব বা গ্র্যাজুয়েটদের বিভিন্ন রং এর গাউনের বৈদিক রূপ।  ডক্টরেট বা পিএইচডি হোল্ডারদের গাউনের রং হয় কালো এবং লাল, মাস্টারস ডিগ্রীধারীদের গাউনের রঙ হয় নীল এবং গাঢ় নীল,স্নাতক ডিগ্রীধারীদের গাউনের প্রতিটি সেটে চারটি অংশ রয়েছে: স্নাতকের টুপি, ঝুলানো ফুল, ব্যাচেলর গাউন এবং দুল কাপড়। অর্থাৎ একেক পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করলে একেক রং ও ডিজাইনের গাউন।একইভাবে বৈদিক নিয়মে ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীত কার্পাস সুতা দ্বারা,ক্ষত্রিয়ের যজ্ঞোপবীত শণ সূত্রের দ্বারা ও বৈশ্যের যজ্ঞোপবীত মেষলোম দ্বারা প্রস্তুত করতে হয়,তিন ভিন্ন ডিগ্রীর জন্য তিন ভিন্ন যজ্ঞোপবীত।



আবার শাস্ত্রে একশ্রেণীর প্রবচনে জন্মকালে সকল অমৃতের সন্তানকেই  ব্রাহ্মণ ধরা হয়।যেমন মহাভারত শান্তিপর্ব ১৮৮ নং অধ্যায়ে ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদে বলা হয়েছে-



কামঃ ক্রোধ ভয়ং লোভঃ শোকস্থিত তুধা শ্রমঃ

সর্বৈষাং ন প্রভবতি কস্মাদবর্ণো বিভজ্যতে।।


অর্থাৎ কাম,ক্রোধ,ভয়,লোভ এইসব আমাদের সব মনুষ্যেই সমান।তাহলে বর্ণ বিভাজন কীভাবে হয়?





তখন মহর্ষি ভৃগু জবাব দিলেন-



না বিশেষোঃস্তি বর্ণানাং সর্ব ব্রাহ্মমিদং জগৎ।

ব্রহ্মণা পূর্বে সৃষ্টা হি কর্মভির্বর্ণতাঙতম্।।


অর্থাৎ ঈশ্বর সকল মনুষ্যকেই ব্রাহ্মণ হিসেবে সৃষ্টি করে।এরপর নিজ নিজ কর্মগুণে একেকজন একেক বর্ণে বিভক্ত হয়।





মনুস্মৃতিতেও দ্বিজত্ব বা ২য় বার জন্মের বিষয়ে বলা  হয়েছে -


ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।

চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।

(মনু০ ১০।৪)



-অর্থাৎ বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করার কারণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য দ্বিজ। এই প্রকার বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্ত না করার কারণে চতুর্থ একজাতি শূদ্র।



আর যে কেউ জ্ঞান অর্জন না করলে,নিজ নিজ কর্তব্য শাস্ত্রানুসারে পালন না করলে সে ওই বর্ণের পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ওই বর্ণের অধিকারী হয়না।অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়ে যদি ব্রাহ্মণের গুণ অর্জন করতে না পারে,ব্রাহ্মণের কর্তব্য পালন করতে না পারে সে আর ব্রাহ্মণ থাকেনা,শূদ্রত্বে পতিত হয় যে কথাটি মনুসংহিতা স্পষ্ট বলছে-


যোহনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রমম্।

স জীবন্নেব শূদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ।।

(মনু ২.১৬৮)



অর্থাৎ যে দ্বিজরা বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য শাস্ত্র অধ্যায়ন সহ নিজ কর্তব্য পালন না করেন তারা শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।




বুঝতেই পারছেন আমরা যারা নিজেদেরকে বড় বংশের দাবী করে অন্যদেরকে ছোট করি আমাদের অধিকাংশ ই বর্তমান যুগে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছি কারণ আমরা কেউই শাস্ত্র অধ্যায়ন,যজ্ঞ,ধ্যান সহ দ্বিজের যত গুণ আছে তার অধিকাংশই পালন ও ধারণ করিনা।



একইভাবে মনুসংহিতা ১০.৬৫ তে বলা হয়েছে,



শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চেতি শূদ্রতাম্।

ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবস্তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ।।


অর্থাৎ নিজগুণে শূদ্রজাত কেউ ব্রাহ্মণে পরিণত হতে পারে,ব্রাহ্মণজাত কেউ শূদ্রে পরিণত হতে পারে,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যও এভাবে বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে।



মহাভারতে বলা হচ্ছে-


যস্তু শূদ্র দমে সত্যে ধর্মং চ সততংস্থিত।

ন ব্রাহ্মণমহং মন্যে ত্রতেম হি ভবেদ দ্বিজঃ।।

(মহাভারত,বনপর্ব,অধ্যায় ২১৬)



অর্থাৎ শূদ্র যদি শম,দম,সৎ ,ধর্মে স্থিত থাকে তবে সে ই ব্রাহ্মণ মান্য করার মতো ব্রাহ্মণ হয় কর্ম ও স্বভাব গুণে।




একারণেই ছান্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ প্রপাঠকে আমরা দেখি ঋষি গৌতম হরিদ্রামূত পিতৃ পরিচয় হীন, গোত্রহীন স্বৈরিণী সন্তান সত্যকাম জাবালকে এক মুহূর্তে ব্রাহ্মণ বলে মেনে নিয়েছিলেন কারণ তিনি দেখেছিলেন সত্যকাম ছিলেন অত্যন্ত সৎ,সত্যবাদী,স্পষ্টভাষী।




মহাভারতে যক্ষ-যুধিষ্ঠির সংবাদ,বনপর্ব ৩১৩ নং অধ্যায়ের ৮৮ নং শ্লোকে যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন-



 রাজন্ কূলেন বৃত্তেত স্বাধ্যায়েন শ্রুততে বা।

ব্রাহ্মণ্যং কেন ভবতি প্রবুহোততে সুনিশ্চিতম্।


অর্থাৎ হে রাজন,জন্মসূত্রে,নাকি আচরণ দ্বারা,বা বেদশাস্ত্র পাঠ দ্বারা,কীভাবে একজন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হন?



তখন যুধিষ্ঠির জবাব দিলেন-


শৃণু যক্ষ কূলং তাত ন স্বাধ্যায়ো ন চ শ্রুতম্।

কারণং হি দ্বিজত্ব চ বৃত্তমেব ন সংশয়।।



অর্থাৎ শোন যক্ষ,জন্মকূলের কারণে নয়,কেবল বেদাদি শাস্ত্র পাঠের কারণেও নয়,দ্বিজত্ব লাভ হয় একমাত্র স্বভাব ও আচরণ দ্বারা।



অর্থাৎ বারংবার স্পষ্ট হচ্ছে জন্মের সাথে,বংশের সাথে বর্ণের বা দ্বিজত্বের কোন সম্পর্ক নেই।




অনেকেই বলেন নারী ও শূদ্ররা বেদ পাঠের অধিকার রাখেনা।তারা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রচিত পরবর্তীকালের অসংখ্য নকল শ্লোক তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।কিন্তু বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগ।এখন ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অসংখ্য আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞরা ঠিক ই বের করে ফেলেছেন মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেখা নকল শ্লোকের কৃত্রিমতা ও আধুনিকতা।যেমন স্বয়ং মনুসংহিতার ই ২৬৮৫  শ্লোকের মধ্যে ১৪৭১ টি শ্লোক পরবর্তীকালে রচিত নকল শ্লোক তথা প্রক্ষিপ্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।মহাভারতের ৮৮ হাজার শ্লোকের মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার শ্লোক মূল মহাভারতের,বাকী সব শ্লোক পরবর্তীকালের রচিত প্রক্ষিপ্ত শ্লোক।এভাবে প্রতিটি স্মৃতিশাস্ত্রের মধ্যে থাকা এইসব নকল হাতিয়ারের রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে।আর বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ পবিত্র বেদের মতো বিজ্ঞানভিত্তিক অসামান্য গাণিতিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত হয়নি বলে এগুলো যে বিকৃত হয়ে যাবে তা স্মৃতিশাস্ত্রের লেখকরা নিজেরাই জানতেন।মহর্ষি মনু তাই নিজেই মনুসংহিতায় বলে গিয়েছিলেন-





যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুহষ্টয়ঃ।

সর্বাস্তা নিষ্ফলাং প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাং স্মৃতা।।

(মনু ১২.৯৫)


অনুবাদঃ বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে প্রেত্য বা নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিকর বলে প্রতিভাত হয়।



উৎপদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোন্যানি কানিচিত।

তান্যর্বাককালিকতয়া নিষ্ফলান্যনুতানি চ।।

(মনুস্মৃতি ১২।৯৬)


অনুবাদঃ  বেদ ব্যতিত যত মানবসৃষ্ট শাস্ত্র আছে তা কালক্রমে উৎপন্ন হয় ও বিনষ্টও হয়।


অর্থাৎ মানবরচিত সকল স্মৃতিশাস্ত্রই এক সময় কালের ক্রমে বিকৃত হয়ে পড়ে।একমাত্র বেদ ই অনিত্য,শাশ্বত।যেসকল শাস্ত্র বেদবিরুদ্ধ অথবা বিকৃত হয়ে যাবার কারণে বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রসমূহের যে সকল শ্লোকসমূহ বেদবিরুদ্ধ সেগুলো বর্জন করতে হবে।



আর তাই “পিতৃদেব মনুষ্যাণাং বেদশ্চক্ষু সনাতনম” অর্থাৎ মানুষ,ঋষি সকলের কাছেই বেদ ই সনাতন ধর্মের পরম বা শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

(মনু ১২.৯৪)



এবং আরও বলা হয়েছে-ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতি অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে কোন জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নে বেদ ই সর্বোচ্চ প্রমাণ।

(মনু ২.১৩)



একইভাবে পূর্বমীমাংসার ১ম অধ্যায়ের দ্বিতীয় অধিকরণের অন্তর্গত ৩য় পাদের ৩য় সূত্রে মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন-



বিরোধে ত্বেনপেক্ষ্যং স্যাদসতি হ্যনুমানম্ ।।

পূ০মী০ ১।৩।৩


- শ্রুতি ও স্মৃতিতে বিরোধ হলে  স্মৃতি আদরণীয় নয় , অর্থাৎ অপ্রমাণ হবে ।



দুটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে এই মানবরচিত স্মৃতি ও পুরাণ শাস্ত্রসমূহের কালক্রমে প্রক্ষিপ্ত হবার প্রমাণ উপস্থাপন করা যাক।




১. আমরা সবাই মহাভারতের একটি বিখ্যাত কাহিনী জানি।সেটা হলো দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় কর্ণ যখন ধনুক তুলে নিল লক্ষ্যভেদের জন্য তখন দ্রৌপদী বলে উঠেছিলেন আমি কোন সূতপুত্রকে বিয়ে করবনা।তাই কর্ণ লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন এরকম সামর্থ্য থাকলেও তিনি বর্ণপ্রথার স্বীকার হয়ে তার সুযোগ ই পাননি।অনেকেই এও বলেন তার মানে দ্রৌপদীরাও বা তৎকালীন যুগেও বর্ণপ্রথা ছিল! আবার অনেকে বলেন সেখানে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন উপস্থিত, তিনিও কোন প্রতিবাদ করলেন না! তার মানে কি তিনিও মানতেন বর্ণপ্রথা? মহাভারতের সিরিয়ালসমূহতে এই কাহিনীকে অনেক অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয় চিত্তবিনোদনের জন্য।অথচ মজার বিষয় হলো এই ঘটনাটি মূল মহাভারতে নেই ই।



নাহমি বরেয়ামি সূতম্,আমি এই সূতপুত্র বিয়ে করবনা,মহাভারতের আদিপর্বের ১৭৮ নং অধ্যায়ের ১৭ নং এই শ্লোকটি আদতে মূল মহাভারতে নেই ই।ভারতের রাষ্ট্রীয় পাণ্ডুলিপি সংস্থা ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(BORI) অর্ধ শতকের গবেষণালব্ধ মহাভারতের ক্রিটিকাল ইডিশনে দেখা গেছে এই নকল শ্লোকটি কেবল নেপালের N2 পাণ্ডুলিপি ও তিনটি পরবর্তীকালের দেবনগরী পাণ্ডুলিপি এবং নীল কণ্ঠের অনেক পরবর্তীকালের ভবদ্বীপ পাণ্ডুলিপি ব্যতিত মহাভারতের বিশুদ্ধ কোন পাণ্ডুলিপিতে নেই।সবচেয়ে বিশুদ্ধ সারদা লিপি,দক্ষিণ ভারতীয় ও বঙ্গ প্রদেশীয় কোন প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতেই শ্লোকটি নেই।বরং সেখানে আছে কর্ণ রোমবশিষ্টংকরোধঃ অর্থাৎ চুল পরিমাণ দূরত্বে লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হন বলেই তিনি দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় বিজয়ী হতে পারেন নি।ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পরবর্তীকালে নিজেদের জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার পক্ষে শ্লোক দেখানোর জন্য এই নকল শ্লোকটি মহাভারতের নতুন ৪ টি অর্বাচীন পাণ্ডুলিপিতে ঢুকিয়ে দেয় এবং সিনেমাটিক ইফেক্টের কারণে এটি খুব লোকপ্রিয়তা পায়। BORI এর ক্রিটিকাল ইডিশন অব মহাভারত এর ভূমিকায় বিখ্যাত প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ও সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ Vishnu Sitaram Sukhtankar এই নকল শ্লোকটিকে কীভাবে সনাক্ত করা হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যখ্যা দেন।



২. আবার ধরুন বর্তমানে মনুসংহিতায় শ্লোকসংখ্যা ২৬৮৫ টি।এই সংস্করণে অনেক বর্ণবাদী ও বেদবিরোধী শ্লোক রয়েছে যা অন্ধ হিন্দুবিদ্বেষীদের অন্যতম হাতিয়ার।কিন্তু ভারতখ্যাত গুরুকুল কাংড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. সুরেন্দ্র কুমার তাঁর বিখ্যাত বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ভাষ্যে প্রমাণ করেছেন যে বর্তমান মনুস্মৃতির ২৬৮৫ টি শ্লোকের মধ্যে ১৪৭১ টিই প্রক্ষিপ্ত বা পরবর্তীকালের নকল শ্লোক! তাঁর এই বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি বিদ্বৎ সমাজে সাদরে গ্রহণীয় ও প্রশংসনীয় হয়।বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি পড়লে আমরা দেখতে পাই মূল মনুস্মৃতিতে বেদবিরোধী বা বর্ণবাদী কোন শ্লোক নেই।তাই সনাতনীদের উচিত প্রচলিত মনুস্মৃতি দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি অনুসরণ করা।



যজুর্বেদ ২৬.২ নং মন্ত্রে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেদে ঈশ্বর বলছেন ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র স্ত্রী,পুরুষ

এবং অন্যান্য সকল জনগণের জন্যই এই পবিত্র

বেদবাণী ।সুতরাং বেদ মন্ত্র উচ্চারণে সকলেরই

সমান অধিকার রয়েছে।আর ধর্মের জিজ্ঞাসায় বেদ ই পরম বা সর্বোচ্চ প্রমাণ।তাই বেদের কথার উপরে কোন অর্বাচীন নকল শ্লোকের কথার কোন গুরুত্ব সনাতন ধর্মে নেই।



কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তবে দ্বিজত্ব ও দ্বিজত্বের অভাব তথা শূদ্রত্বের মধ্যে পার্থক্য কী? পার্থক্য হলো দ্বিজগণ যজ্ঞের পৌরহিত্য,অধ্যাপনা,যজন যাজন করতে পারার অধিকারী হন।অর্থাৎ আপনি যদি বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যাপনা,যজ্ঞের পৌরহিত্য করার যোগ্যতা অর্জন করতে চান অবশ্যই আপনাকে উপনয়ন নিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন পূর্বক নিজেকে দ্বিজ করে গড়ে তুলতে হবে।এটি বর্তমান সময়ে চাকরিতে এপ্লাই করার মিনিমাম কোয়ালিফিকেশনের সাথে তুলনীয়।কিন্তু বেদপাঠে, শাস্ত্রচর্চায়,যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার সকলের ই আছে।




পবিত্র ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৫ বলছে-

পঞ্চ জনা মম হোত্রং যুষধ্বম্


অর্থাৎ ঈশ্বর উপদেশ প্রদান করছেন  আমার যজ্ঞে অংশ নেবে তোমরা পঞ্চজন=মানবগণ সবাই অর্থাৎ আর্য চারবর্ণ (ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র)  এবং অনার্যগণ

 [ নিরুক্ত ৩.৮ সূত্রে ]।




এখানে মনে রাখতে হবে আর্য কোন জাতিসত্তা নয়,আর্য শব্দের অর্থ হলো মহৎ ব্যক্তি।পবিত্র বেদে সমগ্র মানবজাতিকে দুইভাগে দেখা হয়েছে।যারা ভালো মানুষ তারা সকলেই আর্য বর্ণ নির্বিশেষে।আর যারা খারাপ মানুষ তারা অনার্য,এই অনার্যদেরকেই চরিত্র অনুসারে দস্যু,রাক্ষস,পিশাচ ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে।



তাহলে আমরা দেখতে পারছি জাতপাতবাদীরা তাদের লেখা নকল শ্লোক দিয়ে দাবী করে যে চারবর্ণের নারীরা এবং শূদ্র নারীপুরুষ কেউই যজ্ঞে অংশ নিতে পারবেনা,বেদ উচ্চারণ করতে পারবেনা। অথচ বেদ বলছে সকলেই বেদপাঠ করবে আর আর্য তে বটেই , শুদ্ধাচারী হয়ে অনার্যরাও যজ্ঞে অংশ নিতে পারবে।এটাই পবিত্র বেদে ঈশ্বরের তার সকল সৃষ্টির প্রতি সার্বজনীন ভালোবাসা।



পুরুষ সূক্ত পবিত্র বেদের একটি বিখ্যাত সূক্ত যা চারবেদের মধ্যে ৩ টিতেই পাওয়া যায়।যথাক্রমে ঋগ্বেদ ১০.৯০,যজুর্বেদ ৩০ নং অধ্যায়,অথর্ববেদ ১৯.৬।এই মন্ত্রে সমগ্র জগৎকে পরমাত্মার(যার অপর নাম পুরুষ) শরীররূপ হিসেবে রূপক ধরে জগতের সকল সৃষ্টির বিভূতি প্রকাশ করা হয়েছে।


অনেকেই অপপ্রচার করেন বেদের পুরুষ সূক্তে নাকি বলা হয়েছে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি ঈশ্বরের মুখ থেকে,ক্ষত্রিয়ের সৃষ্টি ঈশ্বরের পা থেকে, বৈশ্যের সৃষ্টি ঈশ্বরের উরু থেকে আর শূদ্রের সৃষ্টি ঈশ্বরের পা থেকে। তাই ব্রাহ্মণ মর্যাদায় বড় আর শূদ্র ছোট।



এই যুক্তিটি সবদিক থেকেই হাস্যকর ও মিথ্যা তথ্যে পরিপূর্ণ।প্রথমত পবিত্র যজুর্বেদ ৪০.৮ নং মন্ত্র স্পষ্ট করে দিয়েছে ঈশ্বর নিরাকার,তার কোন সুক্ষ্ম বা স্থূল দেহ নেই তাই ঈশ্বরের হাত,পা,মাথা,উরু থাকার প্রশ্নই আসেনা। দ্বিতীয়ত যদি ঈশ্বর সাকারও হতেন তবে ঈশ্বরের মাথাও যেমন পবিত্র, পদও তো তেমন ই পবিত্র। ঈশ্বরের পা তো আর অপবিত্র হতো না , জগৎস্রষ্টার সবকিছুই তো মহাপবিত্র । তাহলে পা থেকে জন্ম নিলেই সেটা নিচু হবে কেন?



আসলে পবিত্র বেদের বিখ্যাত পুরুষ সূক্তে এমন কোন কথাই বলা হয়নি।পুরুষ সূক্তে সমগ্র জগৎকে নিরাকার ঈশ্বরের শরীর হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে রূপকার্থে।মন্ত্রগুলো দেখলেই তা বুঝতে পারবেন।



যৎ পুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন্।

মুখং কিমস্য কৌ বাহু কা উরু পাদা উচ্যেতে।।১১।।



সরলার্থঃ যখন সেই পুরুষকে [ঋষিগণ] বিশেষরূপে বর্ণনা করেন তখন কী প্রকারে  বিশেষরূপে কল্পনা করেন? এই পুরুষের মুখ কোন টি? বাহু কোনটি? উরু কোনটি? এবং পা কোনটি বলিয়া উক্ত হয়?।। ১১।।



ব্রাহ্মণোস্য মুখমাসীদ্ বাহূ  রাজন্যঃ কৃতঃ।

ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভাংশূদ্রো অজায়ত।।১২।।


সরলার্থঃ ব্রাহ্মণ [জ্ঞানী পুরুষ] এই পুরুষের মুখস্বরূপ হয়, ক্ষত্রিয় [পরাক্রমীব্যক্তি] এই পুরুষের বাহুস্বরূপ।  যাহা  এই পুরুষের উরুস্বরূপ তাহা বৈশ্য [পোষনশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি] এবং পা শূদ্ররূপে [সেবাধর্মী ব্যক্তিরূপে] প্রকট হয়।



চন্দ্রমা মনসো জাতশ্চক্ষোঃ সূর্য্যো অজায়ত।

মুখাদিন্দ্রশ্চাগ্নিশ্চ প্রাণাদ্বায়ুরজায়ত।। ১৩।।


সরলার্থঃ চন্দ্র মনস্বরূপ [মননকারী সামর্থ স্বরূপ] উৎপন্ন হয়েছে, সূর্য নেত্রস্বরূপ [রূপ দর্শনকারী সামর্থ স্বরূপ]  উৎপন্ন হয়েছে।ইন্দ্র ও অগ্নি  মুখস্বরূপ [মুখ্য স্বরূপ সামর্থ দ্বারা] ও বায়ু প্রাণস্বরূপ  [বায়ুরূপ সামর্থ দ্বারা]  উৎপন্ন হয়েছে।


নাভ্যা আসীদন্তরিক্ষংশীর্ষ্ণো দৌঃ সমবর্ত্তত।

পদ্ভাং ভূমির্দিশঃ শোত্রাৎ তথা

লোকাঁঅকল্পয়ন।।১৪।।


সরলার্থঃ  অন্তরিক্ষ নাভীস্বরূপ[সুক্ষ সামর্থ স্বরূপ] হয়, দুল্যোক শিরস্বরূপ [সর্বোত্তম সামর্থ স্বরূপ] (সমবর্ত্তত) হয়। পৃথিবী পা স্বরূপ [পরমাণু কারণরূপ সামর্থ দ্বারা], দিশা শোত্রস্বরূপ [অবকাশরূপ সামর্থ দ্বারা] এবং এই প্রকার অন্য লোক কল্পিত হয়।


অর্থাৎ সমগ্র জগৎকে রূপকার্থে ঈশ্বরের শরীর কল্পনা করে দ্যূলোক,ভূলোক,চন্দ্র,সূর্য,পৃথিবী,অন্তরীক্ষ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবকিছুকে ঈশ্বরের সেই রূপক শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের স্বরূপ বলে তুলনা দেয়া হয়েছে।ব্রাহ্মণ মুখ স্বরূপ কারণ ব্রাহ্মণের কাজ বাণী তথা বেদের প্রচার, অধ্যাপনা।ক্ষত্রিয় বাহুস্বরূপ কারণ ক্ষত্রিয়ের কাজ বাহুবল,প্রশাসন।বৈশ্য উরুস্বরূপ কারণ উরুর ন্যায় বৈশ্যও অর্থনীতির হাল ধরে সকল কিছুর ধারণ,লালন পালন করে।শূদ্র পদ স্বরূপ কারণ পা যেমন সকল ভার বহন করে শূদ্রও তেমনি সকলের সেবা করে সকল পরিশ্রম বহন করে।আবার একইভাবে ১৪ নং শ্লোকে শির বা মুখকে দ্যূলোকস্বরূপ ও পৃথিবীকে পা স্বরূপ উৎপন্ন বলা হয়েছে ঠিক যেভাবে ১১ নং শ্লোকে ব্রাহ্মণকে মুখ আর শূদ্রকে পা বলা হয়েছিল।অর্থাৎ স্পষ্ট যে এখানে কোন উঁচুনিচু প্রভেদস্বরূপ বক্তব্য নেই বা জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার প্রশ্নই আসেনা।



বৈদিক ইতিহাসে বর্ণপ্রথা


বর্ণাশ্রম ধর্ম হচ্ছে নির্ভেজাল, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মবন্টন ব্যবস্থা। চিকিৎসকের ছেলে যেমন চিকিৎসক ই হবেই এমন কোন কথা নেই।ডাক্তারের ঘরে জন্ম নিলেই এম.বি.বি.এস এর সার্টিফিকেট যেমন পাওয়া যায়না, ঠিক তেমন ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিলেই ব্রাহ্মন হওয়া যায়না। বৈদিক বর্ণাশ্রম ও একই। বৈদিক ইতিহাসে এবং পৌরাণিক কিংবদন্তীতে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে এ ধরনের-


১. সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র,যার পিতৃপরিচয় ই ছিলনা, তিনি পরবর্তীতে নিজগুণে একজন বিখ্যাত ঋষি ও ব্রাহ্মণে পরিণত হন ঋষি গৌতমের কাছে উপনয়ন নিয়ে।ঋষি গৌতম ঘোষণা দেন জন্ম যে ঘরেই হোক না কেন সত্যকাম জাবাল একজন প্রকৃত ব্রাহ্মণ কারণ তিনি নির্ভীক সত্যবাদী।

(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৪.৪-৪.৯)


২. ছান্দোগ্য উপনিষদের ৪র্থ অধ্যায়ের প্রথম ৩ খণ্ডে পাওয়া যায় রাজা জানশ্রুতি পৌত্রায়ন এর কাহিনী যিনি নিজের অর্থ ও দানধ্যানের অহংকারে অন্ধ ছিলেন এবং এজন্য নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন।কিন্তু যখন শুনেন ঋষি রৈক্ব তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও জ্ঞানী তখন তিনি ঋষি রৈক্বের সন্ধান করেন এবং তাঁকে অনেক ধনসম্পদ পুরস্কার দিয়ে তাঁর কাছে জ্ঞান চান যাতে তিনিও ঋষি রৈক্বের সমান হতে পারেন।এ শুনে ঋষি রৈক্ব অত্যন্ত বিরক্ত হন কারণ জ্ঞান কখনো অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায়না এবং তখন তিনি জানশ্রুতি পৌত্রায়ণকে তার অজ্ঞানতা ও অহংকারের জন্য শূদ্র ঘোষণা করেন, "তমু হ পরঃ প্রত্যুবাচাহ হারেত্বা শূদ্র"।

ঋষি রৈক্বের কাছে তিনি তার জ্ঞানহীনতার কারণে শূদ্র বলে ঘোষিত হলেন ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম নিয়েও।কিন্তু সেই শূদ্রে পরিণত জনশ্রুতি পৌত্রায়নকে পরবর্তীতে ঋষি রৈক্ব ব্রহ্মবিদ্যা দান করে দ্বিজত্বে উন্নীত করেন।


৩. বাল্মিকী রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে ৩.৭৪.২১ নং শ্লোকে পাওয়া যায় শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসকালে তাঁর ঋষি মাতঙ্গের আশ্রমে যাবার কথা এবং সেখানে সিদ্ধ যোগী শবরীর সাথে সাক্ষাতের কথা।মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ২৮ নং অধ্যায়ের ১৬ নং শ্লোকে আমরা পাই এই ঋষি মাতঙ্গের উপাখ্যান যিনি ছিলেন জন্মসূত্রে একজন শূদ্র নাপিত পিতা ও ব্রাহ্মণ বংশীয় মাতার সন্তান।কিন্তু কৃষিকাজ করতে গিয়ে পশুর প্রতি নির্মম আচরণের কারণে তাকে চণ্ডাল ঘোষণা করা হয়,জাতস তবম্ অসি চণ্ডালৌ ব্রাহ্মণ্যং তেন তে নশত্,তোমার আচরণ চণ্ডাল চরিত্রে চালিত,একজন ব্রাহ্মণের কখনো এমন আচরণ হয়না।এই কথা শুনে তিনি তার ভুল বুঝতে পারেন এবং বনে গমন করেন,দীর্ঘকাল ধরে কঠোর তপস্যা করে বিখ্যাত ঋষিতে পরিণত হন নিজ তপস্যাগুণে যার প্রমাণ রামায়ণে পাওয়া যায়।আরও শিক্ষণীয় বিষয় হলো জন্মগত বর্ণবাদীরা নারীদের ব্রহ্মবিদ্যা, যোগসিদ্ধি এসবে বিশ্বাস করেনা।তাদের মতে নারী ও শূদ্রের এসবের অধিকার নেই। অথচ আমরা রামায়ণে দেখতে পাই ঋষি মাতঙ্গের আশ্রমে শ্রী রামচন্দ্র গেলে সেখানে শবরীকে বলা হচ্ছে সিদ্ধ যোগী হিসেবে(৩.৭৪.৬) এবং সিদ্ধদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ হিসেবে- রামেণ তাপসী পৃষ্ঠা সিদ্ধা সিদ্ধ সম্মতা।অর্থাৎ এখানে নারীদেরও সন্ন্যাস ও যোগসিদ্ধির উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে।


৪. ঋষি কবষ ঔলুষ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগ্বেদের উপর গবেষণা করেন এবং কঠোর তপস্যা করেন। তিনি তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন যজ্ঞে শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২.১৯)



৫. রাজা যুবনাশ্বের বংশের ই অপর রাজা পুরুকুৎসের বংশধর রাজা ত্রিশংকু ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা।কিন্তু এক মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে অপহরণের অপরাধে অবনমন হয়ে তিনি চণ্ডালে পরিণত হন।তস্য সত্যব্রতঃ পুত্রস্ত্রিশংকুরিতি বিশ্রুতঃ। প্রাপ্তশ্চণ্ডালতাং শাপাদ্ অর্থাৎ সত্যব্রতের পুত্র এই অপরাধে অভিশাপ প্রাপ্ত হয়ে চণ্ডালে পরিণত হলেন।

(ভাগবত পুরাণ ৯.৭.৫-৬)


৬. মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে আমরা সবাই বিখ্যাত ব্রাহ্মণ হিসেবেই চিনি অথচ তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ক্ষত্রিয়,কান্যকুব্জের চন্দ্রবংশীয় রাজা।পরবর্তীতে কঠোর তপস্যাবলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। তার পুত্রদের অনেকেই কর্মদোষে পিতার অভিশাপ প্রাপ্ত হন এবং শূদ্রে পরিণত হন। ব্রহ্মক্ষত্রিয় নামে বিভিন্ন শাস্ত্রে একটি শব্দ পাওয়া যায় যার দ্বারা ব্রাহ্মণ হতে ক্ষত্রিয়ে এবং ক্ষত্রিয় হতে ব্রাহ্মণ বর্ণে বর্ণ পরিবর্তনকারীদেরকে বুঝায়।এরকম কয়েকজন প্রখ্যাত ব্রহ্মক্ষত্রিয় ছিলেন বিশ্বামিত্র, রাবণ(ব্রাহ্মণ বংশে জন্মে ক্ষত্রিয় এবং পরে রাক্ষস),পরশুরাম,পূষ্যমিত্র শৃঙ্গ।


বাল্মীকি রামায়ণে বিশ্বামিত্র নিজেই বলেছেন তাঁর ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্তির কথা-


ব্রাহ্মণ্যম্ যদি মে প্রাপ্তং

(বাল্মীকি রামায়ণ,১.৬৫.২২)


পরের শ্লোকে ঋষি বশিষ্ঠও স্বীকার করছেন ক্ষত্রিয় হতে বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণ ঋষিতে পরিণত হবার কথা।


ব্রহ্মর্ষিরেবমস্ত্বিতি চাব্রবীৎ।

(১.৬৫.২৪)

অর্থাৎ বশিষ্ঠ বললেন,"তুমি এখন ব্রহ্মর্ষি বা ব্রাহ্মণ ঋষি।"


৭. ব্রহ্মপুরাণের কাহিনীতে আমরা পাই-

“উষদ্রথ পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। উষদ্রথের ফেন নামে এক পুত্র হয়। ফেনের পুত্র সুতপা। সুতপার পুত্র বলি। এই বলি মহাযোগী ছিলেন। বলির পাঁচটি পুত্র হয়, তাদের নাম- অঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র, কলিঙ্গ ও বঙ্গ। এদের মধ্যে অঙ্গ বড় ও বঙ্গ ছোটো। এরা বালেয় নামে বিখ্যাত ছিলেন।তার বংশধরদের মধ্যে একটি অংশ বালেয় নামক ব্রাহ্মণ গোত্র হয়ে বলি রাজার বংশধর বলে পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।“

[ ব্রহ্মপুরাণ,১১ তম অধ্যায়,শ্লোক ৩০-৩৬] 

অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বংশ হতে ব্রাহ্মণ গোত্রের উৎপত্তি হয়।উল্লেখ্য যে রাজা বলির পুত্রদের রাজত্বের ইতিহাস হতেই অঙ্গ,বঙ্গ,পুণ্ড্র, কলিঙ্গ এসব মহাজনপদের নামকরণ হয়।


৮. লংকার রাজা রাবণ রাক্ষস নামে কুখ্যাত। রাক্ষস হলো চরিত্রহীনতা ও অপকর্মের কারণে আর্য চতুর্বর্ণে স্থান না হওয়া অনার্য একটি বর্ণ।অথচ রাবণ জন্মেছিলেন বিখ্যাত আর্য মহাঋষি ব্রাহ্মণ পুলস্ত্যের ঘরে। কিন্তু পরে নিজ চরিত্রদোষে অনার্য রাক্ষস হিসেবে পরিগণিত হন অর্থাৎ কর্মের দোষে তিনি চতুর্বর্ণের ই বাইরে চলে যান। এই ঘটনাকে আড়াল করার জন্য পদ্ম পুরাণে পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা একটি নতুন গল্প রচনা করে।


সেখানে লেখা হয় শ্রীরাম রাবণ বধের পর ব্রাহ্মণ হত্যার জন্য অত্যন্ত বিচলিত হন। প্রকৃতপক্ষে বাল্মীকি রামায়ণে এমন কিছুই লেখা নেই।বরং বাল্মীকি রামায়ণে শ্রীরাম বিভীষণকে রাবণের জন্য শোক করতে দেখে বলেন-

নৈবং বিনষ্টা শোচ্যন্তে ক্ষত্রধর্মব্যবস্থিতা
তার জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই,তিনি যুদ্ধ করতে গিয়ে গত হয়েছেন।
(বাল্মীকি রামায়ণ ৬.১০৯.১০)

আরও বলেছেন-
পরৈর্বা হন্যতে বীরঃ পরান্বা হন্তি সংযুগে।
যুদ্ধে নিহত বীরদের জন্য শোক করা উচিৎ নয়,এটাই শাস্ত্রের কথা।
(বাল্মীকি রামায়ণ ৬.১০৯.১৮)

অর্থাৎ শ্রী রামচন্দ্র কোন ব্রাহ্মণ হত্যার জন্য শোকে বিলাপ করেন নি।রাবণ একজন কুখ্যাত অনার্য রাক্ষস ছিলেন তবে বীর যোদ্ধা ছিলেন।আর শ্রীরাম এখানে বীর যোদ্ধার জন্য শোক করা কর্তব্য নয় এটাই বলেছেন।

৯. নাভাগের পুত্র ও অরিষ্টের পুত্র উভয়েই বৈশ্য ছিল। কিন্তু কালক্রমে তারা ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হন। [হরিবংশ ১.১১.৯]


১০. রাজা সুহোত্রের পুত্র রাজা গৃৎসমদ্। তার পুত্র রাজা শুনক।আর রাজা শুনকের পুত্র হয়ে উঠেন বিখ্যাত ঋষি শৌনক যাঁর কথা নৈমিষারণ্যে সেই বিখ্যাত যজ্ঞে আমরা পাই সৌতি থেকে মহাভারতের কাহিনী শুনছেন! আবার পূর্বকালের এই ক্ষত্রিয় রাজা শৌণকের সন্তানরা চতুর্বর্ণের আলাদা আলাদা বর্ণ গ্রহণ করেন বলে কথিত আছে ।এজন্য ঋষি শৌনককে পৌরাণিক কিংবদন্তীতে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রবর্তকও বলা হয়!

(বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.৮,ভাগবত পুরাণ ৯.১৭.১-৩) 


১১. রাজা ধৃষ্ট ও তার বংশ বিখ্যাত ক্ষত্রিয় গোত্র ধার্ষ্ট নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু তাদের গোত্রের সদস্যরাই পরবর্তীতে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করে নতুন ব্রাহ্মণ গোত্রের জন্ম দেয়।  ধৃষ্টাদ্ ধার্ষ্টমভূত ক্ষত্রং ব্রহ্মভূয়ং গতং ক্ষিতৌ।রাজা ধৃষ্টের ধার্ষ্ট ক্ষত্রিয় বংশের সদস্যরা ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করল।

(ভাগবত পুরাণ ৯.২.১৭)



আধুনিক যুগের কিছু উদাহরণ


১.মহারাষ্ট্রের চিৎপবন তথা কোকণস্থ ব্রাহ্মণ গোত্রের কিংবদন্তি কাহিনী পাওয়া যায় স্কন্দ পুরাণে।তারা আগে একসময় মৎস্যজীবি অর্থাৎ শূদ্র গোত্রের ছিল।কিন্তু পরশুরামের অধীনে তারা শাস্ত্রপাঠ করে ব্রাহ্মণ গোত্রে পরিণত হয়।


২. কর্ণাটকের সুরাটের মাট্টি ব্রাহ্মণ গোত্রেরও পূর্বপুরুষরা শূদ্র গোত্র ছিলেন বলে স্থানীয় লোককথায় জানা যায়।

৩. বঙ্গ প্রদেশের ব্যাসোক্ত ব্রাহ্মণ গোত্রের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঋষি ব্যাসদেবের মাতুলালয়ের আত্মীয়স্বজন মৎস্যজীবি যারা ব্যাসদেবের কাছে উপনয়ন নিয়ে ব্রহ্মচর্য সম্পূর্ণ করে ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত হন।


৪. কেরালার নম্বুথিরি ব্রাহ্মণ গোত্রেরও অংশবিশেষ প্রাচীনকালে অব্রাহ্মণ গোত্র ছিলেন বলে লোককথায় পাওয়া যায়।


এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে প্রাচীন ইতিহাস থেকে কর্মগুণে বর্ণ পরিবর্তনের যা বারবার বেদোক্ত গুণ ও কর্মভিত্তিক বর্ণাশ্রম ধর্মের স্বার্থকতাকেই ব্যক্ত করে।অত্যাচারী ধর্মব্যবসায়ীদের লোভের ফলবশত,উপমহাদেশে বহিরাগত দস্যুদের আক্রমণে শিক্ষাদীক্ষার মারাত্মক অবনতি ঘটায় ক্রমশ বেদবিরোধী অপপ্রথাসমূহ সমাজে বিস্তার লাভ করতে থাকে।নারী ও শূদ্রবংশে জন্মগ্রহণকারীরা তাদের অধিকার হারাতে থাকে অথচ শূদ্র বংশে জন্মগ্রহণকারী অনেক ঋষিই পবিত্র বেদের ঋষি ছিলেন,৩৩ জনের চেয়েও বেশী নারী ঋষি ধ্যানে ঐশ্বরিক বেদমন্ত্র প্রাপ্ত হয়েছিলেন।আর ঈশ্বরের কাছ থেকে সরাসরি ঐশ্বরিক বাণীপ্রাপ্ত ঋষিরাই হলেন সমাতন ধর্মের সর্বোচ্চ অভিভাবক।যেখানে নারী ও শূদ্র ঘরে জন্মে দ্বিজত্ব প্রাপ্ত ঋষিরা আমাদের সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সেখানে জাতপাতবাদী ও অহিন্দু বিধর্মীদের কথায় সনাতন ধর্মের কিছুই বর্তায় না।তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে নতুন করে পবিত্র বেদের আলোকে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে,প্রতিষ্ঠা করতে হবে বৈদিক যুগের ন্যায় সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ।


ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি 


বাংলাদেশ অগ্নিবীর

সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক

Post a Comment

2Comments
  1. বাংলাদেশের রায়ান চক্রবর্তী প্রচার করেন যে বর্ণ জন্মের উপর ভিত্তি করে। তিনি এই বিষয়ে একটি বইও লিখেছেন। তিনি ভুলভাবে স্লোকের ব্যাখ্যা করেছেন এবং এই ভুল তত্ত্বটি প্রচার করেছেন। দয়া করে তাকে বিতর্কের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং রায়ান চক্রবর্তীকে ভুল প্রমাণ করুন

    ReplyDelete
  2. পোস্ট টি সকল হিন্দুদের পাঠ করা উচিত।বিদগ্ধজন উপস্থাপিত তথ্য যাচাই করে মতামত পেশ করতে পারেন।

    ReplyDelete
Post a Comment