কীভাবে সঞ্জয় দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের কথোপকথন?
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, আমাদের অতি পরিচিত,বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ। ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের প্রাক্কালে শোকাকূল অর্জুনকে এই কালজয়ী জ্ঞান প্রদান করেন বলে কথিত। গীতা সম্বন্ধে আমরা সবাই মোটামুটি ধারণা রাখি। কিন্তু এই গীতা সম্বন্ধেই খুব মৌলিক কিছু প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনে থাকে। আমরা সেগুলো সম্বন্ধে পরিস্কার জানিনা।
যেমন গীতা কীভাবে বলা হলো এবং কীভাবে সঞ্জয় তা ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন? আমাদের অধিকাংশের ধারণা কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন কথা বলছিলেন এবং তার থেকে অনেক দূরে হস্তিনাপুরের রাজ্যমহলের একটি কক্ষে বসে সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টিতে তা দেখতে পাচ্ছিলেন আর সরাসরি লাইভ টেলিকাস্ট করছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে এ কীভাবে সম্ভব! আসলে বাস্তবে এটা হয় ই নি! মূল মহাভারতের ইতিহাস সত্য ও বাস্তব ইতিহাস,দুই রাজবংশের যুদ্ধের স্বাভাবিক ইতিহাস। ইতিহাস আর পৌরাণিক রূপকথা এক নয়।
মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেদিন যুদ্ধের ১০ম দিন। হঠাৎ করে বিনা মেঘের মতো বজ্রপাত হয়ে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমি হতে ছুটে এলেন হস্তিনাপুরে।
এসেই ঝড়ের বেগে ধৃতরাষ্ট্রের সাথে দেখা করতে গেলেন। দেখা হতেই বললেন-
অথ গাবল্পনির্বিদ্বান্ সংযুগাদেত্য ভারত।
ধ্যায়তে ধৃতরাষ্ট্রায় সহসোৎপত্য দুঃখিত।
আচষ্ট নিহতং ভীষ্ম ভরতানাং পিতামহং।
( ভীষ্মপর্ব, ভগবতগীতা পর্বাধ্যায়, অধ্যায় ১৩,শ্লোক ১,২)
অনুবাদ- গাবল্গনের বিদ্বান পুত্র(সঞ্জয়) দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র হতে রাজসভায় এলেন এবং দুঃখভরাক্রান্ত মনে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন ভরতবংশের পিতামহ ভীষ্ম নিহত হয়েছেন।
বিলাপ করে সঞ্জয় বললেন-
তব দূর্মনত্রিতে রাজন যথা...
ককুদং সর্বযোদ্ধানাম্ ধাম সর্বধনুষ্মদাম্
আপনার পুত্রদের দূর্মতির কারণে হে রাজা আজ...সকল যোদ্ধার মধ্যে শ্রেষ্ঠ,সকল ধনুর্ধারীর মিলিত শক্তি সেই পিতামহ ভীষ্ম পতিত হয়ে গেলেন।
( অধ্যায় ১৩, শ্লোক ১৩)
এই শুনে ধৃতরাষ্ট্রের মাথায় যেন বাজ পড়ল।
আর্তিঃ পরা মাবিশতি যতঃ শংসসি মে হতম্
তার হৃদয় যেন শূলবিদ্ধ হলো, তিনি যেন নিজের মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করলেন।
( অধ্যায় ১৪, শ্লোক ৪)
বিলাপ করে সঞ্জয়কে বললেন-
কথং রথাৎ সে নিপতত পিতা মে বাসপোমহ্
আমার পিতা, বাসবের ন্যায় বীর, কীভাবে তিনি রথ থেকে নিপতিত হলেন।
(অধ্যায় ১৪, শ্লোক ১)
এরপর ধৃতরাষ্ট্র গত ১০ দিনে কী কী হয়েছে সব জানতে চাইলেন সঞ্জয়ের কাছে।
তখন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে গত ১০ দিনের যুদ্ধের সবকিছু প্রত্যক্ষদর্শী সঞ্জয় যার চোখে অতীত,বর্তমান সব ঘটনা ভাসছিল এবং যুদ্ধের ভবিষ্যতও যেন তিনি দেখেছেন তিনি গত ১০ দিনের সকল ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রকে শোনালেন-
প্রত্যক্ষদর্শী সর্বস্য ভূতভব্য ভবিষ্যবিৎ।
( অধ্যায় ১৩, শ্লোক ১)
অর্থাৎ যুদ্ধের ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে সঞ্জয় হস্তিনাপুরে আগমন করেছেন এবং এসে ভীষ্মের মৃত্যুসংবাদ প্রদান করলেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করলেন কীভাবে পিতামহের পতন হল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এই ১০ দিন কী কী হল তা আমাকে বর্ণনা করো।
এবং তখন তিনি নিজের চোখের সামনে ভাসতে থাকা গত ১০ দিনের ঘটনা বর্ণনা করা শুরু করলেন ভীষ্মপর্বের ১৫ তম অধ্যায় থেকে। ১৫ থেকে ২৪ নং অধ্যায় পর্যন্ত চলল কীভাবে দুই পক্ষ প্রথম দিন থেকে সৈন্য সজ্জিত করেছিলেন ইত্যাদির বর্ণনা। ২৫ তম অধ্যায়ে গিয়ে বললেন অর্জুনের মনে যুদ্ধ নিয়ে হতাশা তৈরীর, মনোদুঃখ আবির্ভাবের ঘটনা এবং তখন তাকে ক্ষত্রিয়ধর্ম মনে করিয়ে দেয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের দেয়া উপদেশবাণী। ২৫ হতে ৪২ নং অধ্যায়ে সঞ্জয় এই কৃষ্ণ-অর্জুনের কথোপকথন বর্ণনা করলেন। এই কথোপকথন ই হলো গীতা।
অর্থাৎ গীতার কথাগুলো সরাসরি দিব্যদৃষ্টিতে দেখে সঞ্জয় লাইভ টেলিকাস্ট করেন নি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেই উপস্থিত ছিলেন এবং স্বচক্ষে যা দেখে এসেছেন এবং নিজে যা শুনেছেন তাই এসে বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে।
সংবাদ সংরক্ষণের কৌশল একদম স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন সময়ে যা হতো তাই হয়েছে এখানেও।
সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঠিক বর্তমান যুগের সাংবাদিকদের মতো। তাঁর সাথে ছিল সৌতি বা কবিকথকের দল। সৌতিদের কাজ ছিল কারও কথাকে কবিতার আকারে হুবহু স্মরণ রাখা। যতদিন পর্যন্ত লিখিত আকারে সংবাদ পরিবহনের চল ছিল ততদিন এই পেশাটি মানব সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজকে যে মহাভারত সেই সহস্র সহস্র বছর আগে থেকে এখনো আমাদের মাঝে প্রবাহিত হয়েছে তা এই সৌতি নামক কবিদের স্মরণশক্তির কারণেই।
সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন সহকারী সৌতিদেরকে নিয়ে। তিনি যুদ্ধের সকল ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শন করতেন, তিনি ও সৌতিরা যোদ্ধাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো কবিতার আকারে মুখস্থ করতেন।
১০ ম দিনে ভীষ্ম পতিত হলে তিনি হস্তিনাপুরে যান এবং ধৃতরাষ্ট্রকে শেষ ১০ দিনের সব সংবাদ প্রদান করেন। আরে সেই সংবাদের ই একটি অংশ ছিল গীতা। এরপর আবার যুদ্ধক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ চলে যান তিনি।
আরও ৪ দিন পর, যেদিন যুদ্ধের চতুর্দশ দিন, সেদিন গুরু দ্রোণ নিহত হলে সঞ্জয় আবার কুরুক্ষেত্র থেকে রথযোগে হস্তিনাপুরে আগমন করেন এবং সেই ৪ দিনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা ধৃতরাষ্ট্রকে দেন। দ্রোণপর্বের ১.৬২ ও ৮.৩০ নং শ্লোকে আমরা দেখি দ্রোণাচার্য নিহত হবার পর সঞ্জয় হস্তিনাপুরের ফিরে আসেন এবং সমগ্র দ্রোণপর্ব বর্ণনা করেন।
আবার তার ৩ দিন পর কর্ণ নিহত হলে তিনি আবার হস্তিনাপুরে আসেন এবং সেই ৩ দিনের সব ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রকে খুলে বলেন যা কর্ণপর্ব নামে পরিচিত।
অর্থাৎ প্রতিটি পর্ব শুরু হয়েছে শেষ থেকে, সিনেমাতে যেভাবে শেষ দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শুরু হয় সেভাবে। কোন বীর মহারথী মারা গেলে সেই সংবাদ নিয়ে সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হস্তিনাপুর ফিরে গেছেন এবং সেই সংবাদ ধৃতরাষ্ট্রকে দিয়েছেন। সাথে গত কয়েকদিনের যুদ্ধের সব ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
যেমন কর্ণের মৃত্যুর পর যুদ্ধের ১৭ তম দিনে সঞ্জয় পুনরায় হস্তিনাপুরে আগমন করেন এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বিগত দুইদিনের যুদ্ধের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন।
কর্ণ পর্বের ১ম অধ্যায় শুরুই হয়েছে এভাবে-
ততঃ শত্রুক্ষয়ং কৃত্বা সুমহান্তেং রণে বৃষঃ।
পশ্যতাং ধার্তরাষ্ট্রানাং ফল্গুণেন নিপাতিত।।
ততস্তৎ সঞ্জয় সর্বং গত্বা নাগাভ্যং পুরম্।
আচখ্যো ধৃতরাষ্ট্রায় যদ্বৃত্তং কুরুজংগলে।।
( মহাভারত, কর্ণপর্ব, অধ্যায় ১, শ্লোক ১৬-১৭)
অনুবাদ-প্রচুর শত্রু সৈন্য সংহার করে রণে বৃষের ন্যায় বীর কর্ণ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের চোখের সামনেই অর্জুনের হাতে নিহত হলেন। কর্ণ নিহত হলে তখন শোককাতর সঞ্জয় বেগে বায়ুতুল্য-ঘোটকগণ-চালিত রথে রাত্রিতে হস্তিনানগরে গমন করলেন এবং কুরুজংগলে কী ঘটেছে, কর্ণের মৃত্যুসহ সব ধৃতরাষ্ট্রকে বর্ণনা করতে লাগলেন।( কর্ণপর্ব বর্ণিত হলো)
এবার আপনারা বুঝতেই পারছেন সঞ্জয় পুনরায় কবে হস্তিনাপুরে আগমন করেছেন। হ্যাঁ, যুদ্ধের শেষ তথা ১৯ তম দিনের সকালে। শল্য এবং দুর্যোধনের মৃত্যুর পরে। শল্যপর্বের বর্ণনা শুরু হয়েছে এভাবে-
চোখে জল নিয়ে, বাষ্প রুদ্ধ কণ্ঠে সঞ্জয় বললেন-
অদ্রাধিপো হতঃ শল্য শকুনি সৌবলস তথা।
শল্য,শকুনি ও সৌবল(শকুনিপুত্র) নিহত হয়েছেন।
( শল্যপর্ব, অধ্যায় ১, শ্লোক ২৫-২৬)
এরপর দূর্যোধনসহ সকলের মৃত্যুর কথাও ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করলেন সঞ্জয়।(শল্যপর্ব বর্ণিত হলো)
এভাবেই কর্ণ, শল্য প্রতি সেনাপতির পতনের পর সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হস্তিনাপুর গমন করতেন এবং গত কয়েকদিনের সব কাহিনী বিবৃত করতেন। তৎকালীন সময়ে সংবাদবাহকরা নিজে এবং সৌতিদের দ্বারা যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন কথোপকথন স্মরণ করে রাখতেন কবিতার ছন্দে। সেগুলোই বিবৃত করা হতো। ভগবদ্গীতার ক্ষেত্রেও সঞ্জয় যুদ্ধের ১০ম দিন এসে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সেই কথোপকথন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করেন যা আমরা এখন গীতা নামে পড়ি।
তবে Bhandarkar Oriental Research Institute এর মহাভারতের Critical Edition এ ড. বলভেলকর দ্রোণপর্বের জয়দ্রথবধ পর্বাধ্যায়ের ৫-২০ নং শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে জয়দ্রথ বধের দিনও সঞ্জয় হস্তিনাপুরে এসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধের আপডেট দেবার জন্য। এ থেকে তিনি ধারণা করেছেন এমনটাও হতে পারে যে সঞ্জয় প্রায় সময় ই দিনের যুদ্ধ শেষে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যেতেন যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জানানোর জন্য। যদিও কুরুক্ষেত্র থেকে হস্তিনাপুর, এত দূরত্ব প্রায় সময় ই ভ্রমণ করা বাস্তবসম্মত কিনা সেই প্রশ্ন থাকে। তবে প্রতিদিন ই হোক বা কয়েকদিন পর পর, লাইভ টেলিকাস্ট যে হতো না তা মহাভারত থেকেই স্পষ্ট।
এভাবেই খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ সহকারে পড়লেই আমরা দেখি ১ লক্ষ শ্লোকের আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব,কাল্পনিক মহাকাব্য মহাভারতের ভিতরেই প্রোথিত আছে মহর্ষি ব্যাসদেবের লেখা ২৪ হাজার শ্লোকের প্রকৃত ইতিহাস ভিত্তিক ভারত সংহিতা।