পিথাগোরাসের উপপাদ্য সারা বিশ্বেই অত্যন্ত পরিচিত। আমরা উচ্চ বিদ্যালয়ে সকলেই এটি পড়েছি। উপপাদ্যটি ছিল এরকম-
"সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান।"
অর্থাৎ দুই বাহুর একটি যদি ক হয়, অপরটি যদি খ হয় আর অতিভুজ যদি গ হয় তবে-
ক^২+খ^২= গ^২ হবে, এটাই পিথাগোরাসের উপপাদ্যের হিসেব।
উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যায় এভাবে যে একটি সমকোণী ত্রিভুজের দুইটি বাহু যদি ৩ ও ৪ হয় তবে অতিভুজ হবে ৫। কারণ-
৩^২+৪^২= ৫^২
বা ৯+১৬ = ২৫
বা ২৫= ২৫।
পিথাগোরাস খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭২ অব্দের দিকে প্রাচীন গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে গ্রিস ছিলো দর্শন চর্চা ও বৈজ্ঞানিক বীজ রোপনের প্রাণকেন্দ্র। তবে আমরা এটি জানি না যে তারও পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের এই ভারতবর্ষেও ছিলো তেমন ই একটি উৎকৃষ্ট ও খ্যাতনামা সভ্যতা বিদ্যমান, যেখানে ইতোমধ্যে দর্শন ও বিজ্ঞান, উভয়ই উৎকর্ষতা লাভ করেছিলো।
তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় কয়েকটি শুল্বসূত্র থেকে, যেখানে "পিথাগোরাসের উপপাদ্য" নামক খ্যাত এই জ্যামিতিক সম্পর্কটির স্পষ্ট উল্লেখ ও ব্যবহার বর্ণিত হয়েছে!
"শুল্বসূত্র" নামটি হয়ত অনেকের কাছেই নতুন লাগছে। বেদকে সঠিক ভাবে জানতে, বুঝতে ও তদানুসারে ক্রিয়াকর্ম করতে ছয় প্রকারের শাস্ত্রের জ্ঞান প্রয়োজন হয়। এই শাস্ত্র গুলোকে একত্রে ষড় বেদাঙ্গ বলে।
নিরুক্ত,ছন্দ,ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, শিক্ষা ও কল্প এই ৬টি হলো বেদাঙ্গ। এই বেদাঙ্গের মধ্যে একটি হলো "কল্প"।
কল্প আবার চার ভাগে বিভক্ত–
- শ্রৌতসূত্র– যেখানে বিভিন্ন যজ্ঞ ও যজ্ঞের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে।
- গৃহ্যসূত্র– যেখানে দৈনন্দিন গৃহ কর্ম ও সংস্কারাদির নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে।
- ধর্মসূত্র– যেখানে বিভিন্ন সামাজিক বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতি বর্ণিত হয়েছে।
- শুল্বসূত্র– যেখানে যজ্ঞ বেদীর পরিমাপের পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে।
এখানে শুল্বসূত্র গুলোতে মূলত শ্রৌতযজ্ঞে ব্যবহৃত বিভিন্ন যজ্ঞবেদীর পরিমাপ পদ্ধতির গণিতবিদ্যা। প্রাচীনকালে এসব শুল্বসূত্রের পরিমাপ পদ্ধতি বা সমীকরণ ব্যবহার করে যজ্ঞের বিভিন্ন আকার ও আকৃতির নিখুঁত বেদী নির্মাণ করা হতো। এসব শুল্বসূত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- কাত্যায়ন শুল্বসূত্র
- বৌধায়ন শুল্বসূত্র
- আপস্তম্ব শুল্বসূত্র
গবেষকদের মতে, এই তিনটিসহ সকল শুল্বসূত্রের রচনাকাল পিথাগোরাসের পূর্ববর্তী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মূল সম্পর্কটি এই গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত রয়েছে এবং প্রাচীন কালে এই সম্পর্ক অনুসরণ করে ভারতবর্ষে যজ্ঞবেদি তৈরি করা হতো! আসুন দেখে নিই-
১. বৌধায়ন শুল্বসূত্র ১ম কাণ্ডিকা ৪৮ সূত্র, কাত্যায়ন শুল্বসূত্র ২য় কাণ্ডিক ১১সূত্র এবং আপস্তম্ব শুল্বসূত্র ১ম কাণ্ডিকা ৭ সূত্রে বলা আছে–
দীর্ঘচতুরস্রস্যাক্ষ্ণয়া রজ্জুস্তির্যঙ্মানী পার্শ্চমানী চ যৎ পৃথগ্ভূতে কুরুতঃ, তদুভয়ং করোতীতি ক্ষেত্রজ্ঞানম্।।
অর্থাৎ কোনো আয়তের কর্ণ বরাবর রশি টেনে তার বর্গ করা যায়, তবে সেই বর্গের ক্ষেত্রফল অপর দুই বাহু বরাবর রশির বর্গের যোগফলের সমান হবে!
এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, এটি মূলত পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মূল সম্পর্ককে নির্দেশ করছে। পিথাগোরাস সমকোণী ত্রিভুজ দিয়ে সম্পর্কটি প্রকাশ করেছিলেন আর বৌধায়ন শুল্বসূত্রে আয়তক্ষেত্রের কর্ণ দ্বারা গঠিত সমকোণী ত্রিভুজ দিয়ে একই উপপাদ্যটি প্রকাশ করা হয়েছে!
২. কাত্যায়ন শুল্বসূত্রের ২য় কাণ্ডিকার ৮ ও ৯ সূত্রে উপরের গণনার দুটি গাণিতিক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে বলা আছে–
পদং তির্যঙমানী ত্রিপদা পার্শ্বমানী তয়াক্ষণয়া রজ্জুর্দশকরণী।।
(সূত্র ৮)
অর্থাৎ
- যদি আয়তের প্রস্থ ১ পদ এবং দৈর্ঘ্য ৩ পদ হয়, তবে তার কর্ণ ১০ পদের বর্গমূলের(√১০) সমান হবে।
আসুন পিথাগোরাস অনুযায়ীও যদি মিলিয়ে দেখি-
১^২+৩^২= ১+৯= ১০= (√১০) এর বর্গ!!!
দ্বিপদা তির্যঙমানী ষটপদা পার্শ্বমানী তয়াক্ষণয়া রজ্জুঃ চত্বারিংশৎ করণী।।
(সূত্র ৯)
অর্থাৎ,
- যদি আয়তের প্রস্থ ২ পদ এবং দৈর্ঘ্য ৬ পদ হয়, তবে তার কর্ণ ৪০ পদের বর্গমূলের(√৪০) সমান হবে।
পিথাগোরাসের সাথে মিলিয়ে দেখি মিলে কিনা-
২^২+৬^২= ৪+৩৬= ৪০= (√৪০) এর বর্গ!!!
অর্থাৎ পিথাগোরাসের বহু পূর্বেই পিথাগোরাসের উপপাদ্য খ্যাত উপপাদ্যটির বাস্তবিক প্রয়োগ আমাদের মহান আর্যাবর্তে হতো বৈদিক গণিতের মাধ্যমে যজ্ঞবেদী নির্মাণকার্যে!
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি