দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







বেদ কেন সনাতন ধর্মের মূল ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ ?

অমৃতস্য পুত্রা
2

 

সনাতন বৈদিক ধর্মের মূল উৎস বেদ । 'সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ' অর্থাৎ সর্বজ্ঞানময়ত্ব বেদের বেদত্ব । বেদ ঈশ্বরীয় শাশ্বত কল্যাণকারিণী বাণী । পরম পিতা পরমাত্মা অনাদি কাল হতে বারংবার - সগৌরবে জীব মাত্রের কল্যাণের নিমিত্তেই ঋষিদের শুদ্ধন্তঃকরণে বেদজ্ঞান প্রকাশিত করেন । সনাতন আইনশাস্ত্র তথা মানবজাতির প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদ । কয়েকশতক আগেও বেদ শব্দটি ছিল প্রতিটি সনাতনিদের প্রাত্যাহিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত । কিন্তু সময়ের বিবর্তনে,অজ্ঞানতা ও তার কলাগ্রাসে ঔপনিবেশিকদের চক্রান্তে, তথাকথিত বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত ধর্মপ্রচারক তথা স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা আজ মহান বেদের পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছি । ফলস্বরূপ আমরা আজ জাতি হিসেবে এক ক্রান্তিলগ্নে দাড়িয়ে । জ্ঞানের অভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে অপমানের স্বীকার তো হতে‌হচ্ছে বটেই, এবং নিজেদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনেও অজ্ঞতার গ্লানিবয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে নিরন্তর । 


বেদোহখিলো ধর্মমূলম্ । "অর্থাৎ বেদই সমস্ত ধর্মের মূল" । সনাতন ধর্মের মূল বেদ । বেদ স্বতঃপ্রমাণ । পার্থিব বস্তু প্রত্যক্ষ বা অনুমান প্রভৃতির দ্বারা জানা যায়, কিন্তু যাহা অপার্থিব, অচিন্তনীয় , অনুমানের অতিত, তাহা জানতে হলে বেদই একমাত্র অবলম্বন । বেদ কোন মনুষ্য দ্বারা রচিত নহে, তাহা অপৌরষেয় এবং নিত্য । অপৌরুষেয় বলেই বেদ নিত্য ।

"তস্মৈ নূনমভিদ্যবে বাচা বিরূপ নিত্যয়া"

ঋগবেদ ৮.৭৫.৬

হে যবিষ্ঠ্য=জগতো মিশ্রণকারিন্ ! হে সহসঃ+সূনো=সহসা বলেন যদুৎপাদ্যতে তৎ সহো জগৎ। সূতে জনয়তীতি সূনুর্জনয়িতা। হে জগতো জনয়িতঃ ! হে আহুত=সংসারপ্রবিষ্ট ! যদ্=যস্মাৎ। ত্বং+হ। তাবা=সত্যবান্। যজ্ঞিয়শ্চ=পূজ্যশ্চ। ভুবঃ=ভবসি। অতঃ সর্বত্র প্রার্থ্যসে ॥৩॥





"সদকারণবন্নিত্যম্" (বৈ০ দ০ ৪।১।১)
=> কারণ রহিত ভাবরূপ পদার্থ হলো নিত্য ৷
 
 
যে বস্তু সদা বিদ্যমান ও কখনো নিজের সত্তার জন্য অপর বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয় তাকেই নিত্য বলে ৷ নিত্য বস্তু উৎপত্তি রহিত, নিরবয়ব ও ত্রিকালবর্তী হয় ।

বেদান্ত দর্শন-
অতএব চ নিত্যত্বম্।।
বেদান্ত দর্শন ১/৩/২৯
পদার্থঃ এই (বেদ) থেকে শুধুমাত্র নিত্যতা হয় ।

সৃষ্টির আদি থেকে বেদ যা ছিল, তাই আছে । তাই সত্যযুগ আসুক, কি ত্রেতা, দ্বাপর, কলিযুগ আসুক । বেদ তো বেদই, কোন কল্পে বা মতান্তরে তার পরিবর্তন হয় না এবং সদা সর্বদা বর্তমান । বেদ ঈশ্বরের নিত্য বিদ্যা, তার উৎপত্তি বা অনুৎপত্তি হতেই পারে না । অতএব তার বৃদ্ধি, ক্ষয় অথবা তাতে কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না । এইসব কারণে বেদ প্রতিপাদিত বৈদিক ধর্ম শ্বাশত, সত্য ও সনাতন । 

যেখানে পরমাত্মা বেদে বলেই দিয়েছেন -

অংতি সন্তং ন জহাত্যন্তি সন্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি।
(অথর্ববেদ ১০.৮.৩২)

সরলার্থঃ মনুষ্য সমীপবর্ত্তী পরমাত্মাাকে দেখেও না, তাহাকে ছাড়িতেও পারে না । পরমাত্মাার কাব্যকে (বেদকে) দেখ, তাহা মরেও না, জীর্ণও হয় না ।

অর্থাৎ বেদ সকল যুগ ও কালের জন্য প্রযোজ্য । এর বাণী কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়না,অচল হয়না । বেদ মন্ত্র কলিযুগে নিষ্ক্রিয়-এ ধরনের অহেতুক প্রলাপ অনর্থক । বেদ সর্বযুগেই সমানভাবে প্রযোজ্য এবং তা সর্বদা আধুনিক । যেখানে বেদ বলছে এটা সব যুগের জন্য প্রযোজ্য সেখানে কতিপয় বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত অজ্ঞানীদের এহেন আচরন হাস্যজনক ।

তাছাড়া এসব অবান্তর যুক্তি যারা পেশ করেন তারা নিজেরা কি আদৌও কখনো বেদ পড়েছেন তাদের কথার সত্যতা যাচাই এর জন্য ? তাদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি,পারলে বেদের এমন কোন নিয়ম দেখান যা বর্তমান যুগের জন্য প্রযোজ্য নয় । বরং এটা কলি যুগে আরও বেশি প্রয়োজন কারন বেদের কর্মকাণ্ড প্রতিদিনের নিত্যকর্মাদি, বিজ্ঞান,আইন, অর্থনীতি, রাজনীতি জ্ঞান কর্ম উপাসনা অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সহ মানব জাতির প্রয়োজনীয় সকল কিছু আছে যা সত্য যুগের তুলনায় কলি যুগেই বেশী দরকার ।

সৃষ্টির প্রথম হতে আরম্ভ করে আজও সেই বেদ জগতে প্রচারিত । বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান, তাই ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান তিন কালেই সমানভাবেই একই অবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত।এ জ্ঞানের নাশ নাই —কারণ ঈশ্বর অবিনাশী । এ জ্ঞান কল্যাণকারী—কারণ ঈশ্বর কল্যাণময়। বেদ নিত্য, সনাতন ‌‌—কারণ ঈশ্বর নিত্য ও সনাতন । 

তারা আরেকটি প্রশ্ন করেন বেদের বৃহৎ কলেবর নিয়ে যেটা সম্পূর্ন ভিত্তিহীন‌ । কারণ বৈদিক যুগেও এমন খুব কম লোকই ছিলেন যারা কিনা সব কটা বেদ জানতেন । কেউ বা একটা,কেউ বা দুটা,কেউ তিনটা,কেউবা চারটাই জানতেন যাদের যথাক্রমে একবেদী,দ্বিবেদী,ত্রিবেদী ও চতুর্বেদী বলা হত‌ । তবে ত্রিবেদী ও চতুর্বেদী ছিল হাতে গোনা । একবেদীরাই ছিল সর্ব্বোচ্চ। আর তাছাড়া কেউই আমাদের বেদ মুখস্ত করতে বলছেনা । আর এ ধরনের প্রচারকারীদের মধ্যে অনেকেই বলেন পুরাণ পড়ার কথা ‌! এখন আপনারা ই বলুন,যেখানে চার বেদের মন্ত্রসংখ্যা ২০৩৭৯ সেখানে এর বদলে এর কয়েকগুন বড় একটা পুরাণ পড়তে বলাটা কতটুকু যৌক্তিক ?

এখন আসি পবিত্রতার বিষয়ে । অনেকেই বলেন বেদপাঠ করার মত পবিত্রতা কলিযুগের মানুষের নেই এবং নারী তথা শূদ্রদের বেদাধিকার নেই‌‌ । তাহলে একটা বিষয় চিন্তা করুন- বেদের মতো পবিত্র গ্রন্থ যদি পাঠ করার মতো পবিত্রতা না থাকে তাহলে তাদের হরিনাম যা সবচেয়ে পবিত্র তা জপ করার পবিত্রতা সবার থাকবে কি করে ? সবচেয়ে খারাপ,অপবিত্র লোকটিও নিজেকে বেদপাঠের মাধ্যমে নিজেকে জ্ঞান দ্বারা শুদ্ধ করতে পারে‌‌ন । আর বেদ পাঠে অধিকার সবার সমান্য । বেদ পাঠে কোন মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা হয় নি‌ । তাই তো পবিত্র বেদ ঘোষনা করছে - 

যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানিজনেভ্যঃ। ব্রহ্ম রাজান্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্যায় চ স্বায় চারণায় ।প্রিয়ো দেবানংদক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভুয়াসময়ং মে কামংসমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।। 
(যজুর্বেদ ২৬।২)

সরলার্থঃ পরমেশ্বর সকল মনুেষ্যর প্রতি উপদেশ দিচ্ছেন - ব্রহ্মণ,ক্ষত্রিয়,শুদ্র,বৈশ্য,স্বীয় স্ত্রীর ও সেবকাদি এবংঅন্যান্য সকল মনুষ্যকেই যেমন আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করিয়াছি, তোমরাও সেরূপ করো ।

বেদের এই মন্ত্র থেকে স্পষ্ট যে বেদপাঠে সবার অধিকার সমান । গত কয়েকশবছরে,যখন বেদজ্ঞান এর অভাবকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী ও তথাকথিত ব্রাহ্মণ পরিচয় ধারী যারা তৈরী করেছিল অস্পৃশ্যতা নামক জঘন্য প্রথা‌‌ । একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া তো দুরের কথা,অনেকেই একে অপরকে নিজেদের বানানো ছোট জাত বিবেচনা করে ছুঁতও না‌ । অথচ পবিত্র বেদ বলেছে-

সমানী প্রপা সহ বোরন্নভাগঃ সমানে যোক্তো সহ বো যুনজমি।
সমঞ্চোহগ্নিং যপর্যতারা নাভি মিবাভিতঃ।।
(অথর্ববেদ ৩.৩০.৬)

সরলার্থঃ তোমাদের পান একসঙ্গে হোক, ভোজনও একসঙ্গে হোক । তোমাদিগকে এক সঙ্গে একই প্রেমবন্ধনে যুক্ত করিয়াছি । সকলে মিলিয়া পরমাত্মাকে পূজা করো । রথচক্রের কেন্দ্রের চারিদিকে যেমন অর থাকে তোমরা সেইভাবে থাকো । 

ঋগবেদের শেষ মন্ত্রে মানব জাতির প্রতি ঈশ্বরের আদেশ -

সমানী বঃ আকুতি সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্তু বো মনো য়থা বঃ সুসহাসতি।।
(ঋগবেদ ১০।১৯১।৪)

সরলার্থঃ হে মানুষ‌্য্ ! তোমাদের সকলের লক্ষ্য এক হোক, তোমাদের অভিপ্রায় এক হোক, তোমাদের মন এক হোক । এই ভাবে ভাবিত হয়ে তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হোক ।

পরমেশ্বর আমাদের বেদ বাণীর দান করেছে সমগ্রবিশ্বের জন্য,সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য, বিশেষ কোন জাতি বা ধর্মের জন্য নয়‌ ।
বেদপাঠে সবার অধিকার রয়েছে । তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ,আপনারা সত্যের পথে ধাবিত হউন । বেদ অধ্যায়ন করুন, কুসংস্কার থেকে সমাজকে রক্ষা করুন ।

" ধর্ম জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং
শ্রুতিঃ।।"
(মনু০ ২।১৩ )
অর্থাৎ যে ধর্মের বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত
করতে চায় তাহার জন্য বেদই মূখ্য প্রমাণ ।

বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।
তস্মদেতৎপরং মন্যে যজ্ঞন্তোরস্য সাধনম্।।
(মনু০ ১২।৯৯)
অর্থাৎ সনাতন বেদশাস্ত্র সম্পূর্ণ জীবের
সর্বদা ধারণ তথা পোষণ করেন এইজন্য ইহা
প্রাণীবর্গের পরম সাধন ।
 
সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে বড় যেমন কোন শিক্ষক নেই তেমনি কোন ব্যাক্তির জন্য বেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন গ্রন্থ নাই ।
(অত্রি সংহিতা ১৫১)

শ্রুতি=বেদ এবং স্মৃতি- এই দুটিকে ব্রাহ্মণের চোখ বলা হয়েছে যদি এই দুটির মধ্যে যে কোনো একটি না থাকে তবে সেই ব্রাহ্মণ কাণা বলে বিবেচিত হবে এবং দুটোই যদি না থাকে তবে সে অন্ধ বলে বিবেচিত হবে ।
(অত্রিসংহিতা ৩৫১)

যজ্ঞের বিষয়ে,তপস্যার বিষয়ে,শুভ কর্মের জ্ঞানার্থ দ্বিজের জন্য বেদ পরম কল্যাণের সাধন ।
- (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ১/৪০)

বেদের অধ্যায়ন করে মানুষ শীঘ্রই দুঃখ থেকে মুক্তি পায়,সে পবিত্র ধর্মের আচরন করে ও সুখ প্রাপ্ত হয় । 
-(বৃহস্পতি সংহিতা ৭৯)

পবিত্র বেদই হল ধর্মের উৎস । সেইসাথে স্মৃতি ও যারা বেদজ্ঞ তাদের অনুকরণ করা ।
-(গৌতম ধর্মশাস্ত্র ১/১,১/২)
 
 
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।

ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ॥ ১৬-২৩॥ 
(গীতা )

যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় না, সুখ প্রাপ্ত হয় না ও পরম গতি প্রাপ্ত হয় না ।

সাংখ্য দর্শনে কপিল মুনি বলেছেনঃ -

️“শ্রুতিবিরোধাত্রকুতর্কাপসদস্যাত্মলাভঃ।”
(৬/৩৪)

ভাষ্যার্থ—বেদবিরোধী কুতর্কে আসক্তিযুক্ত পুরুষের আত্মতত্ত্ব লাভ হইতে পারে না । তর্ক অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজন । কুতর্কের দ্বারা ও বেদবিরোধী তর্ক বা বিতণ্ডার দ্বারা মনুষ্য প্রকৃত তত্ত্ব জ্ঞান হইতে দূরে চলিয়া যায় । সে কারণ বেদ ও আপ্ত পুরুষের উপদেশ শ্রবন, মনন ও নিদিধ্যাসন দ্বারা উপদেশের প্রকৃত মর্ম চিন্তা করিতে করিতে তবে তত্বজ্ঞান লাভ হইয়া থাকে । চিন্তার স্রোতকে স্বকপোলকল্পিত অদ্ভূত অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের আবিষ্কার করিবার আশায় প্রকৃত উদ্দেশ্য ভ্রষ্ট হইয়া মনুষ্য জীবন ব্যর্থ করিও না ।

ভিন্ন একটি সূত্রে বলা হয়েছে-

“ন পৌরুষেয়ত্বং তত্কর্তুঃ পুরুষস্যাভাবাত্।”
(৫/৪৬)
অর্থাৎ- বেদের কর্তা কোন মনুষ্য না । বেদ ঈশ্বরীয় অভ্রান্ত জ্ঞান । জীব অভ্রান্ত না বলে জীবের বেদ প্রনয়ণ শক্তির অভাবই দেখিতে পাওয়া যায় ।

এবং বেদের কর্তা কেন মনুষ্য নয় ? এমন শঙ্কায় বলেন -

মুক্তামুক্তয়োরযোগ্যত্ত্বাৎ ।।(৫/ ৪৭)

সরলার্থ—বদ্ধ ও মুক্ত কোন পুরুষেরই বেদ প্রণয়নের যোগ্যতা দেখা যায় না বলিয়া বেদ কোন মনুষ্যকৃত হইতে পারে না । মুক্ত পুরুষ সূক্ষ্ম শরীর লইয়া মুক্তাবস্থায় ব্রহ্মানন্দে অবস্থান করে, গোলকের অভাবে বাক্যের দ্বারা কিংবা লেখনীর দ্বারা কোন প্রকারেই বেদ প্রণয়ন করিতে পারে না এবং বদ্ধ জীব অজ্ঞ বলিয়া অভ্রান্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার বেদের কর্তা হইতে পারে না । সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ও স্বয়ংসিদ্ধ বলিয়া ঈশ্বরই বেদের কর্তা ।
.
শেষ আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে➙

️নিজশক্ত‍্যভিব্যক্তেঃ স্বতঃ প্রমাণ্যম্।” (৫/৫১)

সরলার্থ—ঈশ্বরের স্বাভাবিক শক্তি বেদরূপে প্রকাশিত বলিয়া বেদ স্বতঃপ্রমাণ । ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ বলিয়া তিনিই বেদরূপে প্রকাশিত । ব্রহ্মই বেদ । এই কারণ বেদ স্বতঃপ্রমাণ অর্থাৎ উহার প্রমাণের জন্য কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না । সূর্য যেমন সমস্ত পদার্থকে প্রকাশ করিয়া স্বয়ং প্রকাশিত হইয়া আছে তদ্রুপ বেদ জ্ঞানস্বরূপ বলিয়া স্বতঃ প্রকাশমান এবং সমস্ত বিদ্যার কারণ ও ভাণ্ডার ।


.

যোগদর্শনের সমাধিপাদে পতঞ্জলি মুনির বলেছেনঃ - 

️“তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্।।”
(যোগ ১/২৫)

অর্থাৎ, ঈশ্বরের কাছে অতিশয় সর্বজ্ঞতার বীজ রয়েছে ।

️“স এষ পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ।।” 
(যোগ ১/২৬)
অর্থাৎ,সেই ঈশ্বর পূর্বে উৎপন্ন গুরুদেরও শুরু অর্থাৎ বিদ্যা দাতা, তার কারণ হল কালের দ্বারা তিনি কখনো মৃত্যুকে প্রাপ্ত হননা ।

এখন আমরা দেখি যে, সৃষ্টির আদিতে চার ঋষি ঈশ্বর থেকে চার বেদরূপ জ্ঞান লাভ করেছেন ও প্রচার করেছেন । সে হিসেবে তাদের গুরু হলেন ঈশ্বর । অর্থাৎ তিনি জগতের প্রারম্ভে বেদরুপী জ্ঞান দিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করেছেন । তাহলে এই দর্শনও এটাই সিদ্ধ করে যে,বেদ হলো ঈশ্বরীয় জ্ঞান । বেদজ্ঞান দান করায় পরমেশ্বর কে আদি গুরু মানা হয়েছে ।

ন্যায় দর্শনে গৌতম মুনি বলেছেনঃ - 

️“মন্ত্রায়ুর্ব্বেদ প্রামাণ্যবচ্চ তৎপ্রমাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাৎ " (২/১/৬৮)

অনুবাদ- মন্ত্র ও আয়ুর্ব্বেদের প্রামাণ্যের ন্যায় আপ্ত ব্যক্তির অর্থাৎ বেদবক্তা আপ্ত ব্যক্তির প্রামাণ্যবশতঃ তাহার ( বেদরূপ শব্দের ) প্রামাণ্য ।

বিস্তারিত ভাষ্যে শুধু সারাংশ উল্লেখ করেছি মাত্র!

[ সূত্রঃ ফণিভূষণ তর্কভূষণ মহাশয়ের কর্তৃক ভাষ্যানুবাদ ]
.
এই সূত্রে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষ্যঃ বেদকে নিত্য বলিয়াই স্বীকার করা কর্তব্য, কারণ সৃষ্টির আদি হইতে আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাদি যত আপ্ত পুরুষ জন্ম গ্রহণ করিয়া আসিয়াছেন তাঁহারা সকলেই বেদকে নিত্য বলিয়াই স্বীকার করিয়া থাকেন । আপ্তগণের প্রমাণ অবশ্যই স্বীকাৰ্য্য। যেহেতু যে ধর্মাত্মা কপট ছলাদি দোষরহিত, সমস্ত সত্যবিদ্যাযুক্ত ও মহাযোগী পুরুষ, যিনি সকল মনুষ্যের সুখবৃদ্ধির হেতু নিঃস্বার্থে সত্যোপদেশ করিয়া থাকেন, যাঁহাতে লেশমাত্রও পক্ষপাত বা মিথ্যাচার নাই, এরূপ লোককেই আপ্ত বলা হয় এবং এইরূপ আপ্ত পুরুষেরাই বেদশাস্ত্রকে নিত্যগুণযুক্ত বলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন । এই সমস্ত আপ্তপুরুষরাই আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রণয়ণ কর্তা । আয়ুর্বেদের এক স্থানোক্ত ঔষধ ও পথ্যাদি সেবন দ্বারা রোগ নিবৃত্তি হইলে সুখোদয় হয় ও তজ্জন্য উহার অপর ভাগেরও প্রমাণিকতা স্বীকার করা যায়, তদ্রূপ সকল মনুষ্যের বেদোক্ত অর্থের প্রত্যক্ষ দ্বারা, তদ্ভিন্ন অন্যান্য (অদৃষ্টার্থ) ভাগের ও প্রামাণিকতা স্বীকার করা উচিত । বেদের এক স্থানের লিখিত বাক্যের অর্থ সত্য স্বরূপ বিদিত হইলে তদ্ভিন্ন বেদের অপরাপর যে সকল ভাগ বা অংশ আছে, যাহার অর্থ প্রত্যক্ষীভূত হয় নাই, তাহাকেও সত্য ও নিত্য বলিয়া অবশ্য গ্রহণ করা উচিত । যেহেতু আপ্তপুরুষদিগের উপদেশ কদাপি মিথ্যা হইতে পারে না ।

উপরোক্ত ন্যায়সূত্রের ভাষ্যে বাৎসায়ণ মুনি বেদ নিত্য সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, আপ্তগণই বেদের সত্যার্থ স্বয়ং দর্শন ও অপরকে দর্শন করাইয়া থাকেন। যে সকল আপ্তগণ বেদশাস্ত্রের দ্রষ্টা ও প্রবক্তা, তাঁহারাই আয়ুর্বেদাদির রচয়িতা । অতএব “যেরূপ ইহাদিগের কথিত বা লিখিত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সত্য ও প্রমাণীয়, তদ্রূপ বেদশাস্ত্র নিত্য,” তাঁহাদিগের এরূপ কথন ও ব্যবহার অবশ্যই বিশ্বাস যোগ্য ও সত্য বলিয়া সকলেরই স্বীকার করা কর্তব্য । পুনরায় যেরূপ আপ্তোপদেশ বা আপ্তবচন প্রমাণ স্বরূপ হইয়া থাকে, সেইরূপ আপ্তগণেরও গুরু স্বরূপ সেই পরমাপ্ত পরমেশ্বরের কৃত অর্থাৎ ঐশ্বরিক বিদ্যা বলিয়া বেদের নিত্যত্বের প্রমাণ অবশ্য যুক্তিযুক্ত হইতেছে ।

এই সূত্রে মহামুনি গৌতম পরম আপ্ত পরমেশ্বরের বাণী এবং অসত্য, পরস্পর বিরোধী এবং পুনরোক্তি দোষরহিত হওয়ায় বেদকে পরম প্রমাণ হিসেবে সিদ্ধ করেছেন ।

এখন বেদ ঈশ্বরকৃত প্রমাণিত হওয়ায় পর স্পষ্টভাবে এটাও নিশ্চিত করা যায়- যেমন ঈশ্বর সত্য তেমনি বেদবাক্য সত্য কেননা ঈশ্বরকে যে যুক্তিতে আমরা স্বতঃসিদ্ধ দাবী সেই একই দাবীতে বেদকেও তো স্বতঃপ্রমাণ বলতে হবে! তাই নয় কি ?

বেদান্তসূত্র(ব্রহ্মসূত্র/উত্তরমীমাংসা) ও মহাভারতে মহর্ষি ব্যাসদেব বলেছেনঃ - 

ব্রহ্মসূত্রে-

“শাস্ত্রয়োনিত্বাৎ” (১/১/৩) তে তথা “অতএব চ নিত্যত্বম্”(১/৩/২৯) ইত্যাদি সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরকে ঋগ্বেদাদি রুপ সর্ব জ্ঞানের কর্তা মেনে বেদের নিত্যতা প্রতিপাদন করা হয়েছে ।

️“শাস্ত্রয়োনিত্বাৎ”(১/১/৩)

উপরিউক্ত সূত্রের ভাষ্যে পৌরাণিকদের অতিপ্রিয় ভাষ্যকার আদিগুরু শঙ্করাচার্য লিখেছেন-

“মহৎ ঋগ্বেদাদেঃ শাস্ত্রস্যানেকবিদ্যা স্থানোপবৃংহিতস্য প্রদীপবৎ সর্বার্থাবদ্যোতিনঃ সর্বজ্ঞকল্পস্য য়োনিঃ কারণং ব্রহ্ম । নহীদৃশস্য শাস্ত্রস্য ঋগ্বেদাদি লক্ষণস্য সর্বজ্ঞগুণাচিতস্য সর্বজ্ঞাদন্যতঃ সংভবোস্তি ।”

অর্থাৎ - সর্বজ্ঞকল্প প্রদীপবৎ সর্ব্বপদার্থের প্রকাশক অনেক বিদ্যার আধারভূত বিধায় অতিপুষ্কল ঋগ্বেদাদি মহাশাস্ত্রেরও সেই ব্রহ্মই কারণ বলিয়া জানিবে । সর্বজ্ঞ ব্রহ্ম ব্যাতিরেকে অন্য হইতে এইরূপ সর্বজ্ঞত্বাধি গুন সমন্বিত এই ঋগ্বেদাদি মহাশাস্ত্রের উৎপত্তি সম্ভব না । 

অর্থাৎ ঋগ্বেদাদি যে চার বেদ আছে যা অনেক বিদ্যার দ্বারা যুক্ত, সূর্যের সমান সমস্ত সত্য অর্থের প্রকাশ করে,যা সর্বজ্ঞত্বাদী গুণযুক্ত পরমেশ্বরের বাণী ।

[ সূত্রঃ মহেশচন্দ্র পাল প্রকাশিত শাঙ্করভাষ্য ও বঙ্গানুবাদ ]

বৈশেষিক দর্শনে মহামুনি কণাদ বলেছেনঃ -

️“তদ্ বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্।”(১/১/৩)

ভাষ্যানুবাদঃ বেদ ঈশ্বরোক্ত বলিয়াই ইহাতে সত্য বিদ্যা ও পক্ষপাত রহিত ধর্মের প্রতিপাদন আছে, অতএব বেদ চতুষ্টয়কে নিত্য বলিয়া স্বীকার করা মনুষ্যমাত্রেরই কর্ত্তব্য, কারণ যখন ঈশ্বর নিত্য, তখন তাহার নিত্যজ্ঞানস্বরূপ বেদও অবশ্যই নিত্য হইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই ।

অর্থাৎ মহামুনি কনাদ এই সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরের বাণী হওয়ায় আম্নায় অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলেছেন ।

ভিন্ন আরকি সূত্রে বলেছেন -

“বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদ।”(৬/১/১)

অর্থাৎ বেদ বাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্বক । এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোনো কথা নেই । অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান ।

বেদান্ত দর্শন-
অতএব চ নিত্যত্বম্।।
বেদান্ত দর্শন ১/৩/২৯
পদার্থঃ
এই (বেদ) থেকে শুধুমাত্র নিত্যতা হয় ।
.
মীমাংসা দর্শন
চোদনালক্ষণোহর্থ ধর্মো।
--(মীমাংসা ১/১/২) 
.
যা বেদবিহিত তাই ধর্ম অার যা বেদবিরুদ্ধ তা অধর্ম‌ ।
.
এছাড়াও যোগদর্শনের রচিয়তা মহর্ষি পতঞ্জলি যোগ সম্পর্কে অারো বলেছেন,
.
শব্দের ব্যাবস্থাপনা মানবরচিত শাস্ত্রে শাশ্বত না কিন্তু তা পবিত্র বেদে শাশ্বত কেননা তা ঈশ্বরের বাণী ।
----(পতঞ্জলি ৪/৩/১০১)----
পবিত্র বেদের কথা ও শব্দের ব্যাবস্থাপনা শাশ্বত এবং তা ঈশ্বর হতে প্রকাশিত।
----( মহাভাষ্য ৫/২/৫৩)----
.
বেদ যে পরমেশ্বর কর্তৃক উৎপন্ন এই তথ্য আমরা উপনিষদেও পাই-

ছন্দাংসি যজ্ঞাঃ ক্রতবো ব্ৰতানি ভূতং ভব্যং যচ্চ বেদা বদন্তি।
অস্মান্মায়ী সৃজতে বিশ্বমেতৎ অস্মিংশ্চান্যো মায়য়া সন্নিরুদ্ধঃ॥ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৯)

সরলার্থঃ ঋক্ প্রভৃতি চারিবেদ, জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যজ্ঞ, ক্রতুসকল (নানাপ্রকার উপাসনা), চান্দ্রায়ণাদি ব্রত, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান এবং ইহা ছাড়া আর যাহা কিছু বেদশাস্ত্রে প্রতিপাদিত হইয়াছে—এই সমুদয়ই অক্ষর ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হয় । মায়াশক্তি-সম্পন্ন ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং সেই সৃষ্ট জগতেই জীব মায়াদ্বারা আবদ্ধ হইয়া থাকে ।

“এতস্য বা মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতত্।
য়ত্ ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোথর্ববেদঃ।।”(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৫/১১)
অর্থাৎ ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ সেই মহান পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ।
.
বাগ্ বিবৃতাশ্চ বেদাঃ ----(মুন্ডকোপনিষদ ২/১/৪)
বিবৃত বেদসকলই তার বাকস্বরুপ।
.
সেই পরমপুরুষ হতেই
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদাদি উৎপন্ন হয়েছে।
-----(মুন্ডকোপনিষদ ২/১/৭)---
.

এছাড়াও প্রধাণ বৈদিক উপনিষদসমূহের বক্তা ঋষিগণ অসংখ্য জায়গায় সরাসরি বেদমন্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ।
বিশেষ করে প্রাচীনতম ঈশোপনিষদের সম্পূর্ণই যজুর্বেদের চল্লিশ নং অধ্যায় থেকে নেওয়া । 
.
.
ইতিহাস বিষয়ক শাস্ত্র মহাভারত ও রামায়ণে বেদের স্তুতি -
.
মহাভারত-

মহাভারতে শান্তিপর্ব ২৩২ তম অধ্যায়ে মহর্ষি বেদব্যাস বেদকে ঈশ্বর কৃত বলেছেন-

️সৃষ্টির প্রথমে জগদীশ্বর আদ্যন্তশূন্যা বেদরূপা বাঙ্ময়ী বিদ্যার সৃষ্টি করিয়া তাহা হইতে ঋষিদিগের নাম, দেবগণের সৃষ্টি, প্রাণিগণের নানারূপ কার্য্য প্রবৃত্তির মন্ত্র সমুদায়ের নাম কল্পনা করিয়াছেন। লোক সমুদয় সেই বেদশাস্ত্র অবলম্বন করিয়াই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছে। বেদশাস্ত্রে বেদাধ্যয়ন, গার্হস্থ্য, তপস্য, নিত্যকৰ্ম্ম, নৈমিত্তিক কৰ্ম্ম, যজ্ঞ পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠাদি, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি এই দশবিধ জীবের মুক্তি লাভের উপায় যথাক্রমে কথিত হইয়াছে । বেদ ও বেদান্তে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা যাহারে পরব্রহ্ম বলিয়া নিরূপণ করিয়াছেন। তিনি উক্ত দশবিধ উপায় দ্বারাই প্রত্যক্ষ হইয়া থাকেন।

[অনুবাদকঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ]

মহাভারতে-
“অনাদিনিধনা নিত্যা বাগূত্সৃষ্টা স্বয়ম্ভূবা।
আদৌ বেদময়ী দিব্যা য়তঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ।।” 
--(মহাভারত শান্তি পর্ব ১২/২৩২/২৪)
.
অনুবাদ→ সৃষ্টির আদিতে স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা হতে এই বেদ বাণী প্রকাশিত হয়েছিল যার না আদি আছে,না অন্ত,যা নিত্যনাশরহিত এবং দিব্য।যা থেকে জগতের সমস্ত প্রবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে ।
.
“নানারুপং চ ভূতানাং, কর্মণাং চ প্রবর্তনম্।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ,নির্মিতীনে স ঈশ্বরঃ।।
নামধেয়ানি চর্ষীণাং,য়াশ্চ বেদেষু দৃষ্টয়ঃ।
শর্বর্য়ন্তে সুজাতানাং,তান্যেবৈভ্যো দদাত্যজঃ।।”
--(মহাভারত শান্তিপর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ২৩২/২৫/২৭)
.
অনুবাদ→(পূর্বকল্পের) প্রলয়ের শেষে এবং (নতুনকল্পের) সৃষ্টির প্রারম্ভে ঈশ্বর বস্তু ও ঋষিদের নামকরণ বেদের শব্দ দ্বারা করেছেন ,(জগতসংক্রান্ত) জ্ঞান ও কর্মের নির্দেশনা বেদ দ্বারা দিয়েছেন। 
.
“য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্ৰন্থধারণতত্পরঃ।
ন চ গ্ৰন্থার্য়তত্বজ্ঞঃ,তস্য তদ্ধারণং বৃথা।।
ভারং স বহতে তস্য গ্ৰন্থস্যার্থ ন বেত্তি য়ঃ।
য়স্তু গ্ৰন্থার্থতত্ত্বজ্ঞো নাস্য গ্ৰন্থাগমো বৃথা।।”
(মহাভারত শান্তি পর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ৩০৫/১৩/১৪)

অনুবাদ→ যে কেবল বেদ পড়ে কিন্তু বেদের অর্থ এবং তত্ত্ব জানেনা, তাঁর এই প্রকার অধ্যয়ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। অতএব সকলের উচিত বেদের অধ্যয়ণ অর্থ এবং তত্ত্বের সহিত করা ।
.
ঋষয়স্তপসা বেদানধ্যৈষন্ত দিবানিশম অনাদিনিধনা
বিদ্যা বাগৎসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব ২৩২।২৪)
.
অর্থাৎ মহর্ষিগণ তপোবলেই দিবানিশি বেদ অধ্যয়ন
করে থাকেন। সৃষ্টির প্রথমে জগদীশ্বর আদি অন্ত শূন্য বেদ রূপী বিদ্যার সৃষ্টি করিয়াছেন(ঋষিদের কাছে প্রকাশ করেছেন) ।
-
.
দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে শব্দব্রহ্ম পরং চ যৎ।
শব্দব্রহ্মণি নিষ্পাতঃ পরং ব্রহ্মাধিগচ্ছতি।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব ২৩২।৩০)
.
অর্থাৎ বেদ ও বেদ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন , তিনিই অনায়াসে পরম ব্রহ্ম লাভে সমর্থ হন ।
-
নাবেদনিষ্ঠস্য জনস্য রাজন প্রদেয়মেতত্ পরমং ত্বয়্
ভবেত্। বিধিত্সমানায় বিবোধকারণং প্রবোধহেতোঃ
প্রণতস্যশাসনম্।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৩০৮। ৩২)
.
যে মনুষ্য বেদে শ্রদ্ধা রাখে না, তাকে এই জ্ঞানের
উপদেশ দেওয়া উচিৎ নয় । যার বোধের জন্য অধিক পিপাসা তথা যে জিজ্ঞাসু শরণে আসে তিনিই শোনার অধিকারী ।
.
রামায়ণ
.
(অযোদ্ধা কান্ড ১/২০)
এ শ্রীরামচন্দ্রের ব্যাপক বেদজ্ঞান বিদ্যমান থাকার কথা উল্লেখ অাছে । 
.
পুরুষোত্তম রাম শ্রী হনুমানজী সম্পর্কে বলছেন,
" যে কখনো ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদের জ্ঞান অর্জন করে নি। তার পক্ষে এমন অনর্গল অার নিখুঁতভাবে কথা বলা সম্ভব না। 
------(কিষ্কিন্ধা কান্ড ৩/২৮,২৯)-----
.
.
প্রথমেই বিচার্য আমাদের সনাতন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কি ?

এক্ষেত্রে সকল সর্বমান্য আচার্যই একবাক্যে স্বীকার করেছেন বেদের কথা! বেদের বাইরে যে শাস্ত্র বা শাস্ত্রমর্যাদাপ্রাপ্ত গ্রন্থগুলো আছে তা মুলত বেদের জ্ঞানকে আলাদাভাবে ও বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য তৈরি করা হয়েছে ।

এখন প্রশ্ন হলো এত শাস্ত্রের ভিড়ে আমরা কিভাবে কোন শাস্ত্রসিদ্ধান্তে উপনীত হব!

আচার্য মহর্ষি মনু মহারাজের সিদ্ধান্ত এইযে -

মহর্ষি মনু প্রথমেই শাস্ত্রের এক শ্রেণি বিভাগ করেছেন - সেখানে তিনি শ্রুতি বলতে বেদ ও স্মৃতি বলতে বেদব্যাতীত অন্য ধর্মশাস্ত্রকে বুঝিয়েছেন ! একইসাথে তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করছেন এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত ।

মনুসংহিতা ২.১০-

শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্রং তু বৈ স্মৃতিঃ। তে সর্বার্থেষ্বমীমাংস্যে তাভ্যাং ধর্মো হি নির্বভৌ॥

অনুবাদঃ 'বেদ' বলতে 'শ্রুতি' বোঝায় এবং 'ধর্মশাস্ত্রের' নাম ‘স্মৃতি'। সকল বিষয়েই (অর্থাৎ সকল রকম বিধি-নিষেধের স্থানে) এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত, কারণ শ্রুতি ও স্মৃতি থেকেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে‌ ।১০।।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, মনুস্মৃতিতে স্মৃতি বলতে শুধু স্মৃতি শাস্ত্রকে নয় বরং বেদ ভিন্ন অন্য সকল শাস্ত্রকে বোঝানো হয়েছে । পরবর্তীতে এই বিষয়ে খেয়াল রাখার অনুরোধ রইল ।

তাহলে এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, বিরুদ্ধতর্ক দ্বারা মীমাংসা করা যাবেনা এত বুঝলাম কিন্তু কিভাবে আমরা এই দুইধরণের শাস্ত্রকে অবলম্বন করে ধর্ম নির্ণয় করব-

তার উত্তর তিনি দিয়েছেন মনুসংহিতা ১২.১০৬ এ- সেখানে তিনি বলছেন বেদোক্ত ধর্মোপদেশসমূহ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী অর্থাৎ অনুকূল তর্কের সাহায্যে অনুসন্ধান করতে হবে তাহলেই আমরা ধর্মসম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত পাব ।

আর্ষং ধর্মোপদেশং চ বেদশাস্ত্রাবিরোধিনা । যস্তর্কেণানুসংধত্তে স ধর্মং বেদ নৈতরঃ॥ 

অনুবাদ : যে ব্যক্তি বেদোক্ত ধর্মোপদেশসমূহ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী অর্থাৎ অনুকূল তর্কের সাহায্যে অনুসন্ধান করেন অর্থাৎ নিরূপণ করতে চেষ্টা করেন, তিনিই বেদের ধর্ম অর্থাৎ বেদের অর্থ অবগত হন; এর বিপরীত স্বভাব ব্যক্তি বেদার্থধর্ম বোঝে না ।। ১০৬ ৷৷

আচার্য শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন ও চৈতালী দত্তের অনুবাদ- যিনি বেদ এবং বেদমূলক স্মৃতি প্রভৃতি ধর্মোপদেশ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী তর্কের মাধ্যমে অনুসন্ধান করেন একমাত্র তিনিই ধর্মকে জানতে পারেন, অপর কেউ নয়॥ ১০৬

অর্থাৎ স্মৃতিশাস্ত্রের নিয়ম বেদমুলক হলেই মান্য, কোন স্মৃতিশাস্ত্রে বেদবিরোধী নিয়ম পাওয়া গেলে তা কোনভাবেই মান্য নয়!

এই কারণেই আর্যসমাজের সংস্থাপক মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন একমাত্র বেদই হলো স্বতঃপ্রমাণ এবং বেদব্যাতীত অন্যসকল শাস্ত্র বেদানুকুল হলে তবেই প্রমাণ ।

এখন মহর্ষি মনু কেন এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন-

বেদোঽখিলো ধর্মমূলং স্মৃতিশীলে চ তদ্বিদাম্ । আচারশ্চৈব সাধূনামাত্মনস্তুষ্টিরেব চ ॥ ২.৬॥

অনুবাদ: সমগ্র বেদ ধর্মের মূল (ধর্মের প্রমাণস্বরূপ); বেদবেত্তা মনু প্রভৃতি ব্যক্তির রচিত স্মৃতি এবং তাঁদের ব্রাহ্মণ্যতা প্রভৃতি ত্রয়োদশ প্রকার শীল- তা-ও ধর্মের প্রমাণ; তাদের সদাচার [অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধিতে অনুষ্ঠীয়মান তাদের কর্মকলাপ;] এবং ধর্মসম্বন্ধে সন্দেহ উপস্থিত হ’লে, বেদবিদ্ বেদার্থানুষ্ঠানপরায়ণ ব্যক্তিদের যে আত্মতুষ্টি অর্থাৎ যা করলে তাঁদের মন তুষ্টি লাভ করে তা-ও ধর্মের প্রমাণস্বরূপ ৷৷ ৬।।

উপরোক্ত ২/৬ শ্লোকটি দেখে অনেকে ধারণা করতে পারেন তাহলে কি স্মৃতি শাস্ত্রে যা লেখা আছে তা সবই মান্য ?

উত্তর মনুমহারাজ নিজেই দিয়েছেন মনুসংহিতা ২/১৩ তে- তিনি বলছেন বেদই প্রকৃষ্ট প্রমাণ এবং বেদের সাথে অবিরোধী হলেই স্মৃতিশাস্ত্র মান্য!

অর্থকামেষ্বসক্তানাং ধর্মজ্ঞানং বিধীয়তে । 

ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ ॥ ২.১৩॥

অনুবাদ : যাঁরা অর্থ ও কামে আসক্ত নন, ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান তাঁদেরই হয়। আর, ধর্মজিজ্ঞাসু ব্যাক্তিগণের কাছে বেদই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ( যেখানে শ্রুতি ও স্মৃতির মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হবে, সেখানে শ্রুতির মত-ই গ্রাহ্য। এই কারণে, শ্রুতিকেই সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে)।।

এই একই তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি আমরা ব্যাসস্মৃতিতে মহর্ষি ব্যাসদেবের মুখেও শুনি। তিনি ব্যাসস্মৃতি ১/৪ এ বলছেন,

শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে । তত্র শ্রৌতং প্রমাণন্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতিৰ্ব্বরা ॥৪

অনুবাদঃ যেখানে শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে শ্ৰুতিকথিত বিধিই বলবান্ এবং যেস্থলে স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেস্থলে স্মৃতিকথিত বিধিই বলবান ।

যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ ।

শ্রুতয়ো সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতাঃ ॥ ১২.৯৫॥

অনুবাদঃ বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক

অর্থাৎ অসৎ-তর্কযুক্ত মতবাদমসূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলি সব শেষ পর্যন্ত একেবারে নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিৎকর ব’লে প্রতিভাত হয় এবং সেগুলি তমোনিষ্ঠ ব’লে স্মৃত হয়ে থাকে৷৷ ৯৫ ৷৷

উৎপদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোঽন্যানি কানি চিৎ।

উৎপদ্যন্তে বিনশ্যন্তি তান্যর্বাক্কালিকতয়া নিষ্ফলান্যনৃতানি চ ॥ ১২.৯৬॥

অনুবাদ : এই বেদ ছাড়া আর যত কিছু শাস্ত্র আছে অর্থাৎ যেগুলি পুরুষ-কল্পিত সেগুলি কালক্রমে উৎপন্ন হয় এবং বিনাশও প্রাপ্ত হয়। সেগুলি সব অর্বাচীনকালীন; এজন্য সেগুলি সব নিষ্ফল ও মিথ্যা।

যোঽবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্দ্বিজঃ । 

স সাধুভির্বহিষ্কার্যো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ ॥ ২.১১॥

অনুবাদ : যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির প্রাধান্য) অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে – তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় করে রাখা) । কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক৷৷ ১১৷৷

পাষণ্ডিনো বিকর্মস্থান্ বৈডালব্রতিকান্ শঠান্ । হৈতুকান্ বকবৃত্তীংশ্চ বাঙ্মাত্রেণাপি নার্চয়েৎ ॥ ৪.৩০॥

অনুবাদঃ পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদপথবিরদ্ধব্রতধারী , বিকর্মস্থ, বৈড়াব্রতিক (বিড়ালতপস্বী, অথবা দাম্ভিক), শঠ (বেদে শ্রদ্ধারহিত), হৈতুক (বেদরিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ; মেধাতিথির মতে, নাস্তিক অর্থাৎ যারা এই রকম দৃঢ়নিশ্চয় করে যে, পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, হোম করারও কোনও ফল নেই) এবং বকবৃত্তিধারী (প্রবঞ্চক ও কপটবিনয়ী-দ্বিজ)–এই সব ব্যক্তি যদি অতিথি-যোগ্য কালেও উপস্থিত হয়, তাহলে বাক্যের দ্বারাও তাদের সম্ভাষণ করবে না (কিন্তু অন্নদান করতে বাধা নেই)।। ৩০।

আমাদের সনাতন ধর্মের যাত্রা বেদের হাত ধরে শুরু হয়েছে । যুগে যুগে মুনি ঋষিরা বেদের পথেরই অনুবর্ত্তন করে গিয়েছেন ।  তাই বেদ গোটা মানব জাতির জন্য অলঙ্ঘনিয় জীবন বিধান । মনু তার বচনে বেদের পথকেই কল্যাণ স্বরূপ বলে স্বীকার করে গিয়েছেন । আসুন দেখে নেই মনুর দৃষ্টিতে বেদ এবং বেদ বিরুদ্ধ শাস্ত্র সমন্ধ্যে-
.
=> বেদ সবার চক্ষু অর্থাৎ প্রথপ্রদর্শক -
.
পিতৃদেবমুষ্যাণাং বেদশ্চচক্ষুঃ সনাতনম।
অশকয়ং চাপ্রমেয়ং চ বেদশাস্ত্রমিতি স্থিতি।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৪)
.
পদার্থঃ (পিতৃ-দেব-মনুষ্যাণাম) পিতৃ এবং পালক পিতৃ আদি বিদ্বান এবং অন্যান্য মনুষ্যদের জন্য (বেদঃ সনাতন চক্ষু) বেদে সনাতন চক্ষু = পথপ্রদর্শক (চ) ইহা (অশকয়ম) অক্ষম অর্থাৎ যাহা কোন পুরুষ সৃষ্টি করতে পারে না।  এজন্য অপৌরুষেয়। (চ) তথা (অপ্রমেয়) অনন্ত সত্য বিদ্যা দ্বারা যুক্ত (ইতি স্থিতি) এই নিশ্চিতভাবে স্বীকৃত।
.
=> বেদ বিরুদ্ধ শাস্ত্র অপ্রামানিক -
.
যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুহষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাং প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাং স্মৃতা।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৫)
.
পদার্থঃ (যা, স্মৃতয়ঃ বেদবাহ্যাঃ) যেই গ্রন্থ বেদবিরুদ্ধ ( যাঃ চ কাঃ চ কুতষ্টয়ঃ) তাহা কুদৃষ্টিমূলক পুরুষ তৈরী করেছে এবং সংসার মধ্যে নিমজ্জিতকারী (তাং সর্বা নিষ্ফলাঃ) ঐ সব নিষ্ফল (প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি স্মৃতাঃ) অসত্য, অন্ধকাররূপ এই লোকে এবং পরলোকে দুঃখদায়ক।
.
=> বেদ বিরুদ্ধ শাস্ত্র অস্থায়ী-
.
উত্পদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোন্যানি কানিচিত।
তান্যর্বাককালিকতয়া নিষ্ফলান্যনুতানি চ।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৬)
.
পদার্থঃ ( যানি- অনঃ অন্যানি কানিচিত উৎপদ্যন্তে) যে এই বেদ বিরুদ্ধ শাস্ত্র উৎপন্ন করেছে ( তানি- অর্বাক কালিকতয়া চবন্তে) ঐ সব আধুনিক হওয়ার কারনে শীঘ্র নষ্ট হয়ে যাবে ( নিষ্ফলানি চ অনুতানি) উহা মানা নিষ্ফল এবং মিথা।
.
=> বেদে বর্ণ, আশ্রম, লোক, কাল আদির জ্ঞান-
.
চাতুর্বণ্য ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারশ্চাশ্রমাঃ পৃথক।
ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ সর্ব বেদাৎপ্রসিধ্যতি।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৭)
.
পদার্থঃ (চাতুর্বণম) ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য, শুদ্র এই চার বর্ণ এবং ইহার ব্যবস্থা ( ত্রয়ঃ লোক) পৃথিবী, আকাশ এবং দ্যুলোক অর্থাৎ সমস্ত ভূমন্ডল গ্রহ আদি (চত্বারঃ আশ্রমাঃ পৃথক) ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ,বানপ্রস্থ  এবং সন্ন্যাস  এই চারি আশ্রম কে পৃথক পৃথক বিধান ( চ ভুত্যং ভব্যং ভবিষ্যম) এবং ভুত, ভবিষ্যত, বর্তমান এবং কালের বিদ্যা ( সর্ব বেদাত প্রসিদ্ধতি) ইহা সব বেদ দ্বারা প্রসিদ্ধ প্রকাশ এবং জ্ঞান অর্থাৎ এই সব ব্যবস্থা এবং বিদ্যার জ্ঞান বেদ দ্বারাই হয়।
.
=> বেদে পঞ্চভূত আদি সুক্ষ্ম শক্তির জ্ঞান-
.
শব্দঃ স্পর্শশ্চ রুপং  চ রসো গন্ধশ্চ পঞ্চম।
বেদাদেব প্রসূয়ন্তে প্রসূতিগুণকর্মন্ত।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৮)
.
পদার্থঃ (শব্দঃ স্পর্শঃ রূপং রসঃ পঞ্চম গন্ধ) শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং পঞ্চম গন্ধ এই ( প্রসূতি- গুন - কর্মন্তঃ) উৎপত্তি, গুন এবং কর্ম্মের জ্ঞানরূপ ( বেদাত এব প্রূযন্তে) বেদ দ্বারা প্রসিদ্ধ= বিজ্ঞাত অর্থাৎ এই তত্তশক্তির উৎপত্তিবাস ইহার গুণের জ্ঞান, ইহার উপযোগীর জ্ঞান, ইহার উপযোগীর জ্ঞান এবং উৎপন্ন সমস্ত জড় চেতন সংসারের জ্ঞান বিজ্ঞান বেদ দ্বারা প্রাপ্ত হয়।
.
=> বেদ সর্ব প্রাণী ধাতা এবং সুখের সাধন -
.
বিভতি সর্বভুতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম।
তস্মাদেতত্পরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।৯৯)
.
পদার্থঃ (সনাতনং বেদশাস্ত্রম) এই যে সনাতন বেদশাস্ত্র ইহা ( সর্ব ভুতানি বিভর্তি) সর্ব বিদ্যার জ্ঞান দ্বারা সম্পূর্ণ প্রাণীদের ধারন এবং সর্ব সুখ প্রাপ্ত করায়। ( তস্মাত এতত পরং  মন্যে) এই কারনে [মনু আদি] আমরা সবাই তাহাকে উত্তমরূপে মানি এবং এই প্রকারে মানতে চাই (যত) কারন (জন্তোঃ অস্য সাধনম) সর্ব জীবের সুখের সাধন ইহাই।
.
=> বেদবেন্তা সকল রাজা সেনাপতি ন্যায়াধীশ-
.
সৈনপত্যং চ রাজ্যং চ দন্ডনেতৃত্বমেব চ।
সর্বলোকাধিপত্যং চ বেদশাস্ত্র বিদর্হতি।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।১০০)
.
পদার্থঃ (সৈনাপত্যম) সব সেনা (চ) এবং (রাজ্যম)  সেনাপতির উপর রাজ্যাধিকার (দন্ডনেতৃত্বম এব) দন্ড দেবার ব্যবস্থা ,  সর্ব কার্যের অধিপত্য ( চ) এবং (সর্বলোক অধিপত্যম) সবার উপর বর্তমান সর্বাধীশ, রাজ্যাধিকার এই চার অধিকারের মধ্যে ( বেদশাস্ত্রবিদ অর্হতি) সম্পূর্ন বেদশাস্ত্রে মধ্যে প্রবীণ, পূর্ণ, বিদ্যাবান,  ধর্মাত্মা, জীতেন্দ্রীয়, সুশীল জনকে স্থাপিত করতে চায়। অর্থাৎ মুখ্য  সেনাপতি ,  মুখ্য রাজ্যাধি কারী, মুখ্য ন্যায়াধীশ এবং প্রধান রাজা  এই চার বিদ্বান হতে চায়।
.
=> বেদ জ্ঞান দ্বারা পরমগতি এবং প্রগতি-
.
বেদশাস্ত্রর্থতত্ত্বজ্ঞো যত্র তত্রাশ্রমে বসন।
ইহৈব  লোকে তিষ্ঠন্স ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ১২।১০০)
.
পদার্থঃ (বেদশাস্ত্রর্থতত্ত্বজ্ঞঃ) বেদশাস্ত্রের জ্ঞাতা বিদ্বান (যত্র তত্র আশ্রমে বসন) কোন আশ্রমের মধ্যে অবস্থান করে (ইহ এব লোকে তিষ্ঠন) এই বর্তমান জন্মের মধ্যে  ( ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে) ব্রহ্মপ্রাপ্তির জন্য অধিকাধিক সামর্থযুক্ত হয়।
.
[
প্রশ্নঃ অনেক ব্যাক্তি বেদকে বাদ দিয়ে অন্য শাস্ত্রে অধিক মনোনিবেশ করেন। তাদের সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

উত্তরঃ এই প্রশ্নের উত্তরে মনু মহারাজ মনুসংহিতাতে বলেছেন-

যোঽনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রমম্ । স জীবন্নেব শূদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ ॥ ২.১৬৮॥

অনুবাদ : যে ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণ বেদ অধ্যয়ন না ক'রে অন্যান্য অর্থশাস্ত্র স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতিতে অত্যন্ত যত্ন করেন, তিনি জীবিতাবস্থাতেই অতি শীঘ্র সন্তানসন্ততিসমেত শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন৷৷১৬৮৷৷

এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন,

যথা যথা হি পুরুষঃ শাস্ত্রং সমধিগচ্ছতি । 

তথা তথা বিজানাতি বিজ্ঞানং চাস্য রোচতে ॥ ৪.২০॥

অনুবাদ : মানুষ যে শাস্ত্ৰ সমধিগত করে অর্থাৎ অভিনিবেশ (বা অভ্যাস) করে, সেই সেই শাস্ত্রই সে বিশেষভাবে জানতে পারে (অর্থাৎ শাস্ত্রের তাৎপর্য তার কাছে প্রকাশ পায়) এবং তার দ্বারা শাস্ত্রান্তরে তার জ্ঞান সম্যক্ প্রদীপ্ত হয় ৷৷ ২০ ৷৷

প্রশ্নঃ যদি তাই হয় তবে কি আমরা বেদকে বাদ দিয়ে অন্য সকল শাস্ত্র পরিত্যাগ করব?

উত্তরঃ না, সকল শাস্ত্রই অধ্যয়ণ করতে হবে তবে সিদ্ধান্তের প্রশ্নে বেদ ও বেদমুলক শাস্ত্র প্রয়োজন। অন্য শাস্ত্র কিরুপে ও কেন অধ্যয়ন করতে হবে তার প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে-

বুদ্ধিবৃদ্ধিকরাণ্যাশু ধন্যানি চ হিতানি চ । 

নিত্যং শাস্ত্রাণ্যবেক্ষেত নিগমাংশ্চৈব বৈদিকান্ ॥ ৪.১৯॥

অনুবাদ : যে সমস্ত শাস্ত্র আলোচনা করলে বুদ্ধির বিকাশ হয় (যেমন, ইতিহাস, পুরাণ, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি), যে শাস্ত্র থেকে ধনলাভ করা যায় (যেমন, অর্থশাস্ত্র, বৃহস্পতি ও শুক্রপ্রণীত নীতিশাস্ত্র), এবং যে শাস্ত্র জীবনের পক্ষে হিতকর (যেমন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতি) এবং বৈদিক নিগমাদি শাস্ত্র (যা থেকে বেদের অর্থজ্ঞান লাভ করা যায়, যেমন, নিরুক্তের নৈগমকাণ্ড) সর্বদা পর্যালোচনা করবে।। ১৯৷৷

প্রশ্নঃ বর্তমানে অনেক সমস্যা তৈরি হয় যেগুলোর সমাধান আমরা আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রে পাইনা সেক্ষেত্রে করণীয় কি?

উত্তরঃ এর সমাধানও মনু মহারাজ দিয়ে রেখেছেন তার মনুসংহিতাতে! দেখুন প্রমাণঃ

অনাম্নাতেষু ধর্মেষু কথং স্যাদিতি চেদ্ভবেৎ । 

যং শিষ্টা ব্রাহ্মণা ব্রূয়ুঃ স ধর্মঃ স্যাদশঙ্কিতঃ ॥ ১২.১০৮॥

অনুবাদ : বর্তমান মানবধর্মশাস্ত্রে যে বিষয় অনাস্নাত অর্থাৎ অনিরূপিত বা অনুপদিষ্ট [ যে যে বিশেষ ধর্মের উল্লেখ নেই] এইরকম বিশেষ ধর্মের উল্লেখ না থাকায়, সেই সম্বন্ধে কোনও রকম সংশয় এবং জিজ্ঞাসা উপস্থিত হলে, সেইরকম ক্ষেত্রে 'শিষ্ট' ব্রাহ্মণেরা যা বলবেন, অশঙ্কিত ভাবে তাকেই ধৰ্ম ব'লে গ্রহণ করতে হবে ।। ১০৮ ।।

অনেকে এখানে মনে করতে পারেন যে শিষ্ট ব্রাহ্মণ বলতে মনে হয় ব্রাহ্মণ বর্ণে জন্মানো কাউকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু না। এখানে ঐসব ব্রাহ্মণদের বোঝানো হয়নি বরং মনু মহারাজ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন পরের শ্লোকে-

ধর্মেণাধিগতো যৈস্তু বেদঃ সপরিবৃংহণঃ । 

তে শিষ্টা ব্রাহ্মণা জ্ঞেয়াঃ শ্রুতিপ্রত্যক্ষহেতবঃ ॥ ১২.১০৯॥

অনুবাদ : ব্রহ্মচর্যাদি ধর্মযুক্ত হ'য়ে যাঁরা 'সপরিবৃহংণ বেদ অর্থাৎ বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ইতিহাস ও পুরাণাদির দ্বারা পরিপুষ্ট বেদশাস্ত্র বিধিপূর্বক আয়ত্ত করেছেন সেই ব্রাহ্মণকে শিষ্ট ব’লে বুঝতে হবে; শ্ৰুতিই তাঁদের নিকট প্রত্যক্ষস্বরূপ এবং হেতুষরূপ অর্থাৎ অনুমানাদি অন্যান্য প্রমাণস্বরূপ ।। ১০৯।।

এখন এই সভায় কিভাবে মীমাংসক নিযুক্ত হবেন তার প্রমাণে দেখি-
দশাবরা বা পরিষদ্যং ধর্মং পরিকল্পয়েৎ । ত্র্য্ঽবরা বাঽপি বৃত্তস্থা তং ধর্মং ন বিচালয়েৎ ॥ ১২.১১০॥

অনুবাদ: কমপক্ষে দশজন অথবা দশজন ব্যক্তির [যাঁরা বিদ্বান, সদাচার সম্পন্ন ও ধর্মজ্ঞ হবেন] সমবিধান সম্ভব না হলে কমপক্ষে তিনজন বৃত্তস্থ অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ এবং সদাচার সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরিষৎ [সভা] গঠন করতে হবে; সেই পরিষৎ যা ধর্ম ব’লে নিরুপণ করে দেবে, তার অন্যথা করবে না, অর্থাৎ তাকেই ধৰ্ম ব'লে গ্রহণ করবে ।। ১১০ ।।

ত্রৈবিদ্যো হেতুকস্তর্কী নৈরুক্তো ধর্মপাঠকঃ । ত্রয়শ্চাশ্রমিণঃ পূর্বে পরিষৎস্যাদ্দশাবরা ॥ ১২.১১১॥

অনুবাদ : ঋগ্বেদ প্রভৃতি তিন বেদে অভিজ্ঞ তিনজন, হেতুক অর্থাৎ অনুমানাদি-নিপুণ একজন [ logician], তৰ্কী অর্থাৎ ঊহ্-অপোহকুশল একজন [মীমাংসক, বেদাঙ্গ-নিরক্তশাস্ত্র জ্ঞাতা একজন, মানবাদিধর্মশাস্ত্রজ্ঞ একজন এবং প্রথম তিনটি আশ্রমের তিন ব্যক্তি [অর্থাৎ ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ এবং বানপ্রস্থ এইরকম অন্যূন দশজনকে নিয়ে দশাবরা পরিষৎ গঠিত হবে।।১১১।।

এরপর বলা হয়েছে যদি অত বিদ্বান নাও পাওয়া যায় তবে বাধ্যতামুলক কাদের রাখতেই হবে-

ঋগ্বেদবিদ্যজুর্বিদ্চ সামবেদবিদেব চ । 

ত্র্য্ঽবরা পরিষদ্জ্ঞেয়া ধর্মসংশয়নির্ণয়ে ॥ ১২.১১২॥

অনুবাদ : ধর্মসংশয় উপস্থিত হ’লে তা নিরুপণ করার জন্য ঋগ্‌বেদজ্ঞ, যজুর্বেদজ্ঞ এবং সামবেদজ্ঞ এই অন্যূন তিনজনকে নিয়ে যে পরিষৎ গঠিত হয় তাকে বরা পরিষৎ ব'লে বুঝতে হবে ৷৷ ১১২ ।।

একোঽপি বেদবিদ্ধর্মং যং ব্যবস্যেদ্দ্বিজোত্তমঃ । স বিজ্ঞেয়ঃ পরো ধর্মো নাজ্ঞানামুদিতোঽয়ুতৈঃ ॥ ১২.১১৩॥

অনুবাদ : বেদবিৎ একজন উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণও যা ধর্ম ব'লে নিরুপণ করে দেবেন, তাকেই যথার্থ ধর্ম ব'লে বুঝতে হবে; কিন্তু বেদানভিজ্ঞ অযুত অযুত লোকের উক্তিও ধর্ম ব’লে গ্রাহ্য হবে না।।১১৩।।

এর কারণ সম্পর্কে মনু মহারাজ আগেই বলে রেখেছেন যে,

যথা কাষ্ঠময়ো হস্তী যথা চর্মময়ো মৃগঃ । 

যশ্চ বিপ্রোঽনধীয়ানস্ত্রয়স্তে নাম বিভ্রতি ॥ ২.১৫৭॥

অনুবাদ : যেমন কাঠের তৈরী হাতী ও চামড়ার তৈরী মৃগ অকেজো ও অসার, তেমনি যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন না করেন তিনিও অপ্রয়োজনীয় অসার; ঐ তিনটি পদার্থ কেবলমাত্র ঐ সমস্ত নাম ধারণ করে ( অর্থাৎ নামের যোগ্য প্রয়োজননির্বাহকতা তাদের নেই)।।১৫৭৷।

যং বদন্তি তমোভূতা মূর্খা ধর্মমতদ্বিদঃ । তৎপাপং শতধা ভূত্বা তদ্বক্তৄননুগচ্ছতি ॥ ১২.১১৫॥

অনুবাদ : তমোগুণবহুল ধর্মতত্ত্বানভিজ্ঞ মূর্খগণ যা 'ধর্ম' অর্থাৎ পাপকারীর প্রায়শ্চিত্ত ব’লে উপদেশ দেবে তাতে পাপকারীর সেই পাপ শতগুণ হ'য়ে ঐ ধৰ্ম-উপদেষ্টাগণকে আশ্রয় করবে।।১১৫।।

ন তেন বৃদ্ধো ভবতি যেনাস্য পলিতং শিরঃ । 

যো বৈ যুবাঽপ্যধীয়ানস্তং দেবাঃ স্থবিরং বিদুঃ ॥ ২.১৫৬॥

অনুবাদ : মাথার উপর কেশের শুভ্রতাই কারোর বৃদ্ধত্বের সূচক নয়। কিন্তু বয়সে যুবক হলেও যে ব্যক্তি অধ্যয়নশীল বা বিদ্বান্ দেবতারা তাঁকেই বৃদ্ধ ব'লে অভিহিত করেন৷৷১৫৬৷৷

ন হায়নৈর্ন পলিতৈর্ন বিত্তেন ন বন্ধুভিঃ । ঋষয়শ্চক্রিরে ধর্মং যোঽনূচানঃ স নো মহান্ ॥ ২.১৫৪॥

অনুবাদ : হায়ন অর্থাৎ বহু বৎসর অতিক্রাস্ত হওয়ায় পরিণত বয়সের প্রাপ্তি অনুসারে, কিম্বা কেশ-শ্মশ্রু-লোমাদির পক্কতা অনুসারে, বা বিপুল ধনসম্পত্তি লাভের দ্বারা, অথবা বহু আত্মীয়স্বজনের সংযোগে কেউ মহান্ হয় না। ঋষিরা এইরকম ধর্মব্যবস্থা করে গিয়েছেন যে, যিনি অনুচান অর্থাৎ সাঙ্গবেদের অধ্যেতা বা অধ্যাপনা করেন, তিনিই আমাদের মধ্যে মহান্ ৷৷১৫৪৷৷

বেদশাস্ত্রার্থতত্ত্বজ্ঞো যত্র তত্রাশ্রমে বসন্ । 

ইহৈব লোকে তিষ্ঠন্ স ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে ॥ ১২.১০২॥

অনুবাদ : বেদশাস্ত্রের অর্থ যিনি তত্ত্বতঃ অবগত হয়েছেন, সেই রকম বেদার্থজ্ঞ ব্যক্তি যে কোনও আশ্রমেই বাস করুণ না কেন তিনি ইহলোকে থেকেই ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব লাভ করেন ।। ১০২ ।।
কেননা,

যথা জাতবলো বহ্নির্দহত্যার্দ্রানপি দ্রুমান্ ।

 তথা দহতি বেদজ্ঞঃ কর্মজং দোষমাত্মনঃ ॥ ১২.১০১॥

অনুবাদ : অগ্নি যেমন প্রবল হলে ভেজা কাঠ, কাঁচা গাছ সবই পুড়িয়ে ফেলে সেইরকম বেদজ্ঞ ব্যক্তি নিজের কর্মজনিত দোষসমূহ দগ্ধ ক'রে থাকেন। ।। ১০১ ।।

এছাড়াও বলা হয়েছে,

সেনাপত্যং চ রাজ্যং চ দণ্ডনেতৃত্বমেব চ । সৈনাপত্যং সর্বলোকাধিপত্যং চ বেদশাস্ত্রবিদর্হতি ॥ ১২.১০০॥

অনুবাদ : যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্রবিৎ তিনি সেনাপতিত্ব, রাজ্য, দণ্ডনেতৃত্ব, সর্বলোকাধিপত্য প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েরই যোগ্য—উপযুক্ত পাত্র ।

এমনকি 
শুধু হিন্দু ধর্মগ্রন্থই না‌ । বৌদ্ধ, জৈন ও শিখধর্মেও একইভাবে বেদের স্তুতি পাওয়া যায় ।
.
বৌদ্ধ ধর্মে - 
.
"সম সমাদাম বতানি জন্তু উচ্চাবচ গচ্ছতি সজ্জসত্তো। 
বিদ্বা চ বেদেহি সমেচ্চ ধম্ম ন উচ্চাবচ গচ্ছতি ভূরিপঞ্জো।।"
[ত্রিপিটক– সুত্তনিপাত ২৯২]
ইন্দ্রিয়ের অধীন হয়ে নিজের ইচ্ছা দ্বারা কোনো কর্ম তথা তপ করতে থেকে মানব উচ্চ অবস্থা থেকে নিম্ন অবস্থায় পতিত হয়। কিন্তু যে বিদ্বান বেদ দ্বারা ধর্মের জ্ঞান প্রাপ্ত করেন, তাঁর এরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয় না ।

"বিদ্বা চ সো বেদগূ নরো দূধ ভবাভবে সম ইম বিসজ্জ। 
সো বাততণ্হো অনিঘো নিরাসো অতারি সো জারি জরৌতি বূমিতি।।"
[ত্রিপিটক– সূত্তনিপাত ১০৬০]

বেদের জ্ঞাতা বিদ্বান এই সংসারে জন্ম-মৃত্যুর আসক্তি পরিত্যাগ করেন এবং তৃষ্ণা তথা পাপ রহিত হয়ে জন্ম-মৃত্যু এবং বৃদ্ধাবস্থা রহিত হয়ে যান– এটি আমি বলছি।
.
এছাড়াও গৌতম বুদ্ধের বাণীতে অসংখ্য জায়গাই বেদের প্রশংসা , বেদজ্ঞ ঋষি ও প্রকৃত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের প্রশংসা পাওয়া যায় ।
.

শিখ ধর্মে - 
সামবেদ, ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ স্বয়ং ঈশ্বর হতে প্রকাশিত। কেউ এগুলোর মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। এগুলো অমূল্য ও শাশ্বত।
---(গুরু গ্রন্থসাহিব ১/১৭)
.
চারবেদ হল ঈশ্বরের দেওয়া চারটি মূল্যবান সম্পদস্বরূপ ।
গুরু গ্রন্থসাহিব ৫/১৭)
.
এভাবে শিখ ধর্মগ্রন্থসমূহে অারো অসংখ্য জায়গায় বেদের স্তুতি পাওয়া যায়‌ ।
.

জৈন ধর্মে -
জৈন অাচার্য কুমুদেন্দু বেদ সম্পর্কে বলেছেন,

" বেদের মন্ত্রসমূহ শাশ্বত এবং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বাণী। সৃষ্টির অাদি হতে বেদ থেকেই বহু ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে। সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বার্তা এক হয়েও তা পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মানুষের জন্য।
-( ভূবলয়া ৬/২-৬)

বেদোক্তঃ পরমো ধর্মঃ স্মৃতিশাস্ত্রগতোহপরঃ।
শিষ্টাচীর্ণেহপরঃ প্রোক্তস্ত্রয়ো ধর্মাঃ সনাতনাঃ।। -(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব- ১৪১/৬৫)

অনুবাদঃ- প্রথমেই বেদোক্ত ধর্ম, যা সব থেকে উৎকৃষ্ট (শ্রেষ্ঠ) । দ্বিতীয় বেদানুকূল স্মৃতিশাস্ত্রে বর্ণিত - স্মার্তধর্ম এবং তৃতীয় শিষ্ট পুরুষের আচরিত ধর্ম (শিষ্টাচার) এই তিনই সনাতন ধর্ম ।
.
গীতাতেও বলা হয়েছে 

বেদ স্বয়ং ঈশ্বর হতে প্রকাশিত‌ ।
-(গীতা ৩/১৫) 
.
অামিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য‌‌ ।
-(গীতা ১৫/১৫)

এছাড়াও ভাগবতে অসংখ্য জায়গায় অন্যান্য শাস্ত্রের মতই বেদের স্তুতি পাওয়া যায় ।

http://back2thevedas.blogspot.com/2016/08/blog-post.html
.

স্বতঃপ্রমাণ বেদই, প্রমাণ শিরোমণি।
লক্ষণা করিলে স্বতঃপ্রমাণতা হানি।
(চৈতন্যচরিতামৃত অাদিলীলা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, ১২৫)
.

অনেকেই বলে বেদ নাকি শুধু যজ্ঞের জন্য । বেদে শুধু
অপরা বিদ্যা আছে । বেদ পড়লে শুধু স্বর্গ প্রাপ্তি হয় মোক্ষলাভ নয় যদিও স্বর্গ-নরক বলতে আলাদা কোন কাল্পনিক ‌জায়গার অস্তিত্ব নেই বৈদিকশাস্ত্র সমূহে , অবশ্য স্বাধ্যায় বিহীন অসংস্কৃতজ বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত ব্যাক্তিগণ কিভাবে জানবে ? তারাতো তথাকথিত ফরম্পরার নামে ভণ্ডামি করতেই সময় পার করে দেয় । তাদের অনর্থক দ্বাবীর সত্যতা পর্যালোচনা করা যাক ।

বেদ দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। এখন কেউ যদি কুতর্ক করে একগুঁয়ে স্বভাব ধরে বলে, না, শুধু উপনিষদই পরাবিদ্যার গ্রন্থ তাহলে বলতে হয় উপনিষদের তালিকায় প্রথম যে, ঈশোপনিষদ্ তা তো পুরোটাই যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়। এখানে আপনি যদি এই উপনিষদকে পরাবিদ্যার গ্রন্থ মান্য করেন তবে তো পরোক্ষভাবে বেদেই পরাবিদ্যা মান্য করলেন। শুধু ঈশোপনিষদ্ নয়, যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তো অধিকাংশ উপনিষদেরই বিভিন্ন জায়গাতে বেদের মন্ত্র সরাসরি এসেছে। যথাঃ
.
★ কঠোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।১।১৮ (ঋগবেদ ৩।২৯।২)
(ii) অধ্যায় ২।১।৯ (অথর্ববেদ ১০।৮।১৯)
(iii) অধ্যায় ২।২।২ (যজুর্বেদ ১০।২৪)
.
★ শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ 
(i) অধ্যায় ২। ১-৫ (যজুর্বেদ ১১।১-৫)
(ii) অধ্যায় ৩।১৪-১৫ ( যজুর্বেদ ৩১।১-২)
(iii) অধ্যায় ৩। ৫-৬ (যজুর্বেদ ১৬।২-৩)
.
★ প্রশ্নোপনিষৎ
(i) প্রথম প্রশ্ন ১১ ( ঋগবেদ ১।৬৪।১২)
.
★ ঐতেরীয়পনিষৎ
(i) শিক্ষাবল্লী প্রথম অনুবাক (ঋগবেদ ১।৯০।৯)
(ii) শিক্ষাবল্লী দ্বাদশ অনুবাক (যজুর্বেদ ৩৬।৯)
.
★ বৃহদারণ্যকোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।৫।১৬ (ঋগবেদ ১।১১৬।১২
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৭ (ঋগবেদ ১।১১৭।২২)
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৯ ( ঋগবেদ ৬।৪৭।১৮) 
.
যে মুণ্ডকোপনিষদে পরা অপরার ভেদ দেখানো হয়েছে সে উপনিষদেও বেদের মন্ত্র এসেছে। যথা,
(i) মুণ্ডক ২।২।১ (অথর্ববেদ ১০।৮।৬)
(ii) মুণ্ডক ৩।১।১ (ঋগবেদ ১।১৬৪।২০)
.
অতএব বেদ যদি অপরা বিদ্যার গ্রন্থই হয়ে থাকে তবে পরা বিদ্যার গ্রন্থ উপনিষদে বেদের মন্ত্র কেন গ্রহন করা হলো। এ থেকে স্পষ্ট যে, বেদে শুধু অপরা বিদ্যাই নেই বরং পরা বিদ্যাও রয়েছে। অর্থাৎ "স পর্য্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম্" যজু০ ৪০।৮ ইত্যাদি মন্ত্রে যেখানে পরমব্রহ্মের প্রতিপাদন করা হয়েছে তাহা "পরা" বিদ্যা, আর যেখানে অগ্ন্যাদি ভৌতিক পদার্থের যজ্ঞপোযোগী হওয়ার বর্ণনা অথবা বিবাহ,উপনয়নাদি সংস্কারের বর্ণনা রয়েছে তাহা "অপরা" বিদ্যা। এখানে অপরা কোন নিন্দাসূচক শব্দ নয়, বিষয়ের প্রকারের দৃষ্টি দ্বারা বিদ্যার পরা অপরা দুটি ভেদ দেখানো হয়েছে। এখন যদি কেউ বেদ পাঠ করে অর্থ না বুঝে বলে যে, বেদে পরা বিদ্যা নেই সেটা তার মূর্খতা। যাস্কাচার্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন -
.
স্থাণুরয়ং ভারহারঃ কিলাভূদধীত্য বেদং ন বিজানাতিয়োহর্থম্।
য়োহর্থজ্ঞইত্যকলং ভদ্রমশ্নুতে নাকমেতি জ্ঞানবিধূতপাপ্মা।।
(নিরুক্ত নৈগম কাণ্ড ১/১৮)
-- অর্থাৎ- যে বেদ পড়ে তাহার অর্থ বোঝে না সে শুধু ভারবহনকারীই হয়, কিন্তু যে বেদের অর্থ বুঝতে পারে, সে সমস্ত সুখ আর কল্যাণ প্রাপ্ত হয়। সে ওই পবিত্র জ্ঞানের দ্বারা পাপকে নষ্ট করে পরমানন্দ রূপে মোক্ষ প্রাপ্ত করে নেয়।
.
মহাভারতেও একই কথা বলা হয়েছে, 
য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্রন্থধারণতপ্তরঃ।
ন চ গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞঃ, তস্য তদধারণংবৃথা।।
ভারং স বহতে তস্য, গ্রন্থস্যার্থ ন বেক্তি য়ঃ।
য়স্তু গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞো, নাস্য গ্রন্থাগমোবৃথা।।
(মহাঃভারত শান্তিপর্ব অঃ ৩০৫/১৩-১৪)

--অর্থাৎ যে বেদ এবং শাস্ত্রীয় গ্রন্থকে ধারণ করতে তৎপর, কিন্তু তার যথার্থ তত্ত্বকে না বোঝে তার এ ধারণ করা বৃথা। যে গ্রন্থের অর্থকে না বোঝে সে কেবল উক্ত গ্রন্থের ভারই বহন করে। কিন্তু যে গ্রন্থের অর্থ বুঝতে পারে তার জন্য সেই গ্রন্থের অধ্যয়ন ব্যর্থ নয়।
.
অতএব নিষ্কর্ষ এই যে, বেদ অপরা বিদ্যার সাথে সাথে পরাবিদ্যারও গ্রন্থ। মধ্যকালে কিছু সাম্প্রদায়িক লোক প্রচার করেছে বেদে পরা বিদ্যা নেই। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি বেদেও পরাবিদ্যার সমাহার রয়েছে, অপরদিকে উপনিষদ শুধুমাত্র পরা অথবা অধ্যাত্মবিদ্যারই গ্রন্থ, এতে লৌকিক জীবনের বর্ণনা নেই। কিন্তু সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডার যে বেদ তা কেবল পরা বিদ্যার গ্রন্থ না হয়ে অপরাবিদ্যারও গ্রন্থ । বেদ যেখানে ব্রহ্মবিদ্যার মূল, তদ্রুপভাবে মানুষের লৌকিক অথবা ভৌতিক জীবনের জন্য অপৈক্ষিত অনান্য জ্ঞানেরও আদিমূল ।

অবার অনেকেই বেদের চাইতে গীতাকে প্রাধান্য দেয় বেশি । এবং তাদের দ্বাবী কলি যুগে বেদ চলে না গীতাই প্রধান । এরকম অহেতুক প্রলাব বলে যা হাস্যকর ।

প্রধান হতে গেলে ভিত্তি হতে হয় । আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক আলোচনা থাকতে হয় । সামগ্রিক ভাবে মূল জীবন বিধান থাকতে হয় । তবেই সে প্রধান হতে পারে ।

এই সমস্ত গুণাবলী গীতার নেই । গীতায় সহজ ভাবে উপনিষদ, দর্শন এবং অন্যান্য কিছু শাস্ত্রের খুবই অল্প আলোচনা আছে । যা দিয়ে সনাতন ধর্মের জাস্টিফাই করা সম্ভব হয়না । কিন্তু বেদ দিয়ে সম্ভব হয় । গীতা মোক্ষ প্রদান করতেই পারে কারণ গীতায় যে ব্রহ্মবিদ্যার দর্শন দেওয়া হয়েছে সেটিই বেদাদি শাস্ত্রে রয়েছে । কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বেদের ধারে-কাছেও গীতা নেই । 

যদি গীতাকে আমরা সনাতন ধর্মের ভিত্তি বলি তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন আসবে সৃষ্টির শুরুতে গীতা কোথায় ছিল? যদি বলেন গীতার জ্ঞান সৃষ্টির শুরুতেই ছিল, তাহলে বলা হবে সেই জ্ঞান কীভাবে কোথায় ছিল? উত্তর: বেদ । আর গীতা সম্পূর্ণটাই শ্রীকৃষ্ণের বানী নয় । গীতা ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্য হয়ে প্রদত্ত জ্ঞান । গীতায় ধৃতরাষ্ট্র, অর্জুন, সঞ্জয়ের প্রত্যক্ষ ভাবে কথাবার্তা আছে । পরোক্ষ ভাবে দুর্যোধনের কথাবার্তা আছে । ইতিহাস ভিত্তিক ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সহজ উপস্থাপনায় জ্ঞান গুলো মুখনিঃসৃত হয়েছে। সেজন্য সাধারণ ভাবে গীতা সহজে বোধগম্য । কিন্তু বেদের মর্মার্থ বুঝতে হলে সাধনার প্রয়োজন হয়, আধ্যাত্মিকার স্তরে উঠতে হয়। এছাড়া আরো হাজার পার্থক্য রয়েছে । 

গীতা হল উপনিষদের সার । অনেক পণ্ডিত বলে থাকেন গীতা মূলত মূণ্ডকোপনিষদের প্রায় অবিকল প্রতিলিপি,বেদের ১ লক্ষ ভাগের ১ ভাগ তথ্যও এতে নেই । গীতা একটি দার্শনিক গ্রন্থ । এটাতে সনাতনের জীবন বিধি,সংবিধান,সকল আচার আচরণের নিয়ম কানুন কিছুই নেই । আর মানবজীবন ও সমাজ চালনা করতে গেলে সেগুলোই আসল । একজন রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর দার্শনিক ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনবেনা,শুনবে জীবনঘনিষ্ঠ কথা যা একমাত্র বেদে রয়েছে । তাকে নিষ্কাম কর্মের অবাস্তব প্রেস্ক্রিপশন দিলে সে দৌড়ে পালাবে,বড় বড় মোটিভেশনাল স্পিকিং এ তার পেট ভরবে না ।

গীতার দার্শনিক কথাবার্তা উচ্চশিক্ষিত অল্প কিছু লোকের মনের জন্য শান্তিদায়ক হলেও ৯০ ভাগ লোকের ই বাস্তব জীবনের জন্য তা কার্যকর নয় । বাস্তব পৃথিবী,সমাজজীবন,ব্যক্তির দৈনন্দিন চাহিদা ও রাষ্ট্রের জন্য একমাত্র সংবিধান পবিত্র বেদ । বিয়ে,শিশুর জন্ম,অন্নপ্রাশন,ষষ্ঠী,ক্রিয়াকর্ম সব ই বেদ থেকে হয়,গীতা থেকে নয় । অর্থাৎ জীবনের সব বাস্তব কাজের নির্দেশিকা বেদ আমাদের দেয়,আধ্যাত্মিক কাজের নির্দেশিকাও বেদ দেয় । সোজা বাংলায় এক পরিপূর্ণ সংবিধান যা গীতা বা অন্য কোন বই নয় ।

আর তাই সকল শাস্ত্রে মুনিঋষিগণ বারবার বলে গেছেন সকল যুগে সকল কালে প্রত্যহ বেদ অধ্যায়ন করতে হবে । গীতা বা অন্যান্য সকল ছোটখাটো সেকেন্ডারি গ্রন্থ কেবল পরবর্তীতে সময় পেলেই পড়া যায় আগ্রহের জন্য । বেদ পড়াই আসল এবং বেদ পড়লে গীতা বা অন্য কোন গ্রন্থই আর তেমন আবশ্যিক থাকেনা । 

উপরন্তু বেদের জ্ঞানের সাথে যদি গীতার জ্ঞানের তূলনা করি তাহলে দেখব বেদ যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান , প্রকৃতি, জীবাত্মা, অাধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অাইন, সমাজব্যবস্থা সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ জ্ঞান ভান্ডার সেখানে সনাতনধর্ম বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই গীতা থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায় না ।

যেমনঃ-

১)একটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের ষোড়শ সংস্কার গীতাই কোথাও নাই। অাছে পবিত্র বেদে ।

২)হিন্দুরা গো-হত্যা করে না
। এটা গীতাই কোথায় অাছে?অাছেত পবিত্র বেদে ।

৩) হিন্দুরা মৃতদেহ দাহ করে‌ । কবর দেয় না। এটা গীতাই কই অাছে? যা অাছে পবিত্র বেদে ।

৪) একজন হিন্দু দিনে কইবার ঈশ্বরের উপাসনা করবে । কোন কোন মন্ত্র পাঠ করে ঈশ্বরের উপাসনা করবে তা সবই বেদেই অাছে‌ । গীতাতে কোথাও নেই‌ । 

৫) অন্নগ্রহণের পূর্বে, শয়নের পূর্বে ইত্যাদি কাজ ও বিভিন্ন শুভকর্মে কি মন্ত্র পাঠ করবেন তা সবই বেদেই অাছে, গীতাতে কোথাও নেই‌ ।

৬) যখন কোন মুসলিম প্রশ্ন করবে সনাতনধর্মে নারী অধিকার বিষয়ে কি বলা অাছে তখন গীতা থেকে একটা শ্লোকও বের হবে না‌ । যেই বিষয়ে শত শত বেদমন্ত্র অাছে ।

৬) অাধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সেই সনাতনধর্ম কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? অাধুনিক যুগের যুবসমাজ যখন এই প্রশ্নগুলো করবে তখন গীতা থেকে একটা শ্লোকও বের হবে না যেখানে পবিত্র বেদে অাধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে শত শত বিস্ময়কর তথ্য অাছে‌ ।

৭) সতিদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ,বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা ইত্যাদি হিন্দুসমাজে বর্তমান ও পূর্ববিদ্যমান কুসংস্কারের সমাধান একমাত্র বেদ থেকেই যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব‌ । গীতার মধ্যে কোন শ্লোকই এই বিষয়ে দেওয়ার মত নাই ।

৮) দেশ সমাজ রাষ্ট্র চালানোর প্রেরণা নিয়ম কানুন বেদ থেকে পাই । এক কথায় আমাদের জীবনের জন্য প্রয়জনীয় সকল কিছু বেদ থেকে প্রেরণা পাই ।
.
এরকম শতশত প্রশ্নের উত্তর গীতাতে নেই । যা যথাযথভাবে পবিত্র বেদেই পাওয়া যায় ।
.
তাহলে কোন যুক্তিতেই বা গীতা প্রধাণ ধর্মগ্রন্থ হওয়ার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও রাখে ?

পরমেশ্বর আমাদের বেদ বাণীর দান করেছে সমগ্রবিশ্বের জন্য,সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য, বিশেষ কোন জাতি বা ধর্মের জন্য নয়‌ ।
বেদপাঠে সবার অধিকার রয়েছে । তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ,আপনারা সত্যের পথে ধাবিত হউন । বেদ অধ্যায়ন করুন, কুসংস্কার থেকে সমাজকে রক্ষা করুন ।

নমস্কার 🙏💖


Post a Comment

2Comments
  1. Great Writing covers with appropriate reference...

    ReplyDelete

  2. Namaskar dada ame somopono বেদ কিনতে চাই আমাকে কি সম্পূর্ণ একসেট বেদ পাব । কৃপা করে জানাবেন

    ReplyDelete
Post a Comment