মহর্ষি দয়ানন্দ জীর বেদ ভাষ্যের বিশেষতা 
১. মহর্ষি দয়ানন্দ জীর বেদভাষ্য বেদাপৌরুষেয়ত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ।
এই বেদভাষ্যে কোথাও উপরোক্ত মত বিরুদ্ধ কিছুর উল্লেখ নেই । বেদ পূর্ণ ব্রহ্ম জগদীশ্বর দ্বারা প্রদত্ত হওয়ার কারণে তা পূর্ণজ্ঞান । এতে বিন্দুমাত্রও অজ্ঞানতার বিষয়বস্তু নাই ।
২. এই ভাষ্যে লৌকিক এবং বৈদিক শব্দসমূহের ভেদ লক্ষ্য রেখে যাস্ক-পাণিনি-পতঞ্জলি আদি ঋষি-মুনিগণের সিদ্ধান্তকে ধারণ করে বেদ এর শব্দসমূহের জন্য সমস্ত বৈদিক নিয়মকে আশ্রয়ণ করা হয়েছে ।
৩. বেদে উল্লেখিত নামশব্দ সমূহকে ধাতুজ মেনে ( যা যাস্ক এবং পতঞ্জলির সিদ্ধান্ত ) প্রকরণাদির ভিত্তিতে তার সকল সম্ভব অর্থগুলোর নিরুপণ করা হয়েছে । নির্বচনভেদ দ্বারা ভিন্ন-ভিন্ন অর্থের নিরুপণও এই ভাষ্যে লক্ষণীয় ।
৪. ধাতু সমূহের অনেকার্থত্বের সিদ্ধান্তকে, যা সমস্ত বৈয়াকরণগণের মুখ্য সিদ্ধান্ত, যেগুলোকে প্রায় সব বেদভাষ্যকারগণ তাদের স্বভাষ্যে মেনেছেন, সেসবের ভিত্তিতে মন্ত্রসমূহের অর্থ করা হয়েছে ।
অন্য শব্দগুলোতে বেদ এর শব্দসমূহের যৌগিক এবং যোগরুঢ়ির বর্ণন রয়েছে, রুঢ়ি নয়, যা এই ভাষ্যের আধারশিলা ।
৫. আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক এবং অধিযজ্ঞাদি তিনটি প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বেদ মন্ত্রের অর্থ হয়ে থাকে, এই সিদ্ধান্ত অনুসারে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্যের সংস্কৃত পদার্থে সমস্ত প্রক্রিয়ায় অর্থের দর্শানো হয়েছে ।
৬. অনেক স্থানে বৈদিক পদসমূহের অর্থ বেদ মন্ত্রের ভিত্তিতে করা হয়েছে । যেমন— যজুর্বেদ: ১/১৩ ।।
৭. অগ্নি শব্দ দ্বারা কেবল ভৌতিক অগ্নি অর্থই গ্রহণ হয় না, বরং " অগ্নি " শব্দের নির্বচনের ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায় পরমেশ্বর-বিদ্বান-রাজা-সভাধ্যক্ষ-নেতাদি তথা বিদ্যুৎ-প্রকাশ জঠরাগ্নি আদি অর্থও গ্রহণ হয়ে থাকে, এই প্রকারে বায়ু, আদিত্য, ইন্দ্র, যম, রুদ্র আদি শব্দের বিষয়ে এরূপ প্রক্রিয়া বুঝতে হবে এবং এই ইন্দ্র, বরুণ, মরুৎ, অগ্নি, বায়ু, মিত্রাদি শব্দ যেখানে ভৌতিক পদার্থের নাম, সেখানে মুখ্যবৃত্তি হিসেবে ঈশ্বর বাচক অর্থ হবে ।
এই প্রক্রিয়া মহর্ষির ভাষ্যে সর্বত্র বিদ্যমান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক ভেদ হলো অন্য কোনো ভাষ্যে এরূপ প্রক্রিয়াবিধির অনুসরণ নেই । এটাই মহর্ষির ভাষ্যের মূলাধারভূত বাদ বা সিদ্ধান্ত, এই প্রক্রিয়াবিধির ভিত্তিতেই এই ভাষ্যের রচনা হয়েছে ।
৮. এই ভাষ্য " বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদ "
( বৈ. ৬/১/১ ) অর্থাৎ, বেদের কোনো বচন বা বাক্য তর্ক বিরুদ্ধ নয় ; এই সিদ্ধান্ত অনুসারে বেদ মন্ত্রের অর্থ করা হয়েছে ।
৯. যাস্ক,-পাণিনি-পতঞ্জলি আদি ঋষিদের দ্বারা উল্লেখিত বা বর্ণনকৃত নিয়মানুসারে অনেক স্থানে প্রাচীন পদপাঠ সমূহের দ্বারা অবগত হওয়া ভিন্ন পদবিভাগও মহর্ষির বেদ ভাষ্যে বর্ণিত রয়েছে । " য়থাভিমতদৃষ্টয়ো ব্যাখ্যাতণাম্ " অর্থাৎ ব্যাখ্যা কারীর দৃষ্টি ভিন্ন-ভিন্ন হয়ে থাকে । " ন লক্ষণেন পদকারা অনুবর্ত্যাঃ পদকারৈনাম লক্ষণমনুবর্ত্ত্যম্ " ( মহাভাষ্য: ৩/১/১০৯ ) অর্থাৎ, পদকারের পশ্চাতে সূত্রকার কখনও গমন করবে না, বরং পদকারকে ব্যাখ্যাকরণের পশ্চাতে চলতে হবে । অতএব, মহর্ষির ভাষ্যে ব্যাকরণানুসারে পদকার থেকে ভিন্ন পদবিভাগেরও মান্যতা দেওয়া হয়েছে । বেদ এর অর্থের পিছনে স্বর রয়েছে, স্বরের পিছনে অর্থ নয় । স্বর অনুযায়ীই অর্থ হয়ে থাকে । এ দ্বারা বেদ বন্ধা হয় নাই, বরং অর্থ অনুযায়ীই স্বর বেদে হয়ে থাকে, এটাই নিয়ম ।
যাকে না বুঝে, প্রাচীন পরম্পরা থেকে অনভিজ্ঞ বা পড়া না থাকার কারণে ব্যাকরণাদি শাস্ত্রসমূহের মর্ম না জানা, বিদ্বান হিসেবে ধরে নেয়া ব্যক্তি ভ্রান্ত রূপে দৃষ্ট হন।
১০. কাব্যের অঙ্গভূত শ্লেষাদি অলঙ্কার সমূহের বর্ণনা এই বৈদিক কাব্যে সর্বপ্রথম মহর্ষি দয়ানন্দ জীই তাঁর ভাষ্যে বিস্তারিত ভাবে করেছেন, এবং এই অলঙ্কার সমূহ দ্বারা বর্ণনকৃত অর্থে বহুবিধ বৈচিত্র্য দর্শিত করেছেন ।
১১. বেদ-এ কোনো অনিত্য ( অর্থাৎ, ব্যক্তি-জাতি-দেশ বিশেষ ) ইতিহাস নেই । বরং বেদে প্রকৃতির ঔপচারিক বা আলঙ্কারিক বর্ণন রয়েছে ; যার সাক্ষীও বর্তমান সময়ের চলমান পরম্পরা । তদনুসার ইন্দ্র-কণ্ব-অঙ্গিরা আদি এগুলো কোনো প্রকার ব্যক্তিবিশেষ এর নাম নয় ।
১২. মহর্ষির ভাষ্যে দেবতাকে মন্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় মানা হয়েছে তথা ইন্দ্র-মিত্র-বরুণাদি সব দেবতাবাচী শব্দ সেই এক মহান আত্মা পরমব্রহ্ম জগদীশ্বরের বিভূতি বাচক এর অন্তর্গত ( যা নিরুক্ত ৭/৪-এ বর্ণনা রয়েছে ) ।
এমনটা মেনে যৌগিকবাদের ভিত্তিতে এসব অর্থ বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা রয়েছে ।
সর্বানুক্রমণীতে কোনো-কোনো বাত্যার্থকে দেবতা মেনে বিভিন্ন মন্ত্রের ব্যাখ্যা করা রয়েছে ।
১৩. মহর্ষির ভাষ্যে মন্ত্রসমূহের ছন্দও প্রায়ঃ অনুক্রমণ্যুক্ত ছন্দসমূহ থেকে ভিন্ন দর্শিত হয়েছে । এই ছন্দভেদও প্রাচীন আর্ষ পদ্ধতির মৌলিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী । মহর্ষি দয়ানন্দ জী মন্ত্রের ছন্দ পিঙ্গল-ছন্দঃ সূত্রের ভিত্তিতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন ।
১৪. " ব্যত্যয় " এর সিদ্ধান্তকে মান্য করে বেদ বিষয়ে " সর্ব জ্ঞানময়ো হি সঃ " এই বচন সঠিক নিয়মে প্রমাণিত হয়ে থাকে, অন্যথা সম্ভব নয় ।
এই সিদ্ধান্তকে খুবই সুন্দরভাবে বিস্তারিত বিশ্লেষণ পূর্বক সপ্রমাণ-হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা শুধুমাত্র মহর্ষির ভাষ্যেই সর্বত্র বিদ্যমান ।
১৫. " বাক্যং হি বক্তুরধীনম্ " অনুসারে মন্ত্রের পদসমূহের অন্বয় এর সাথে সম্বন্ধ করে অর্থ করা হয়েছে ।
১৬. মহর্ষির ভাষ্যে " যজ্ঞ " আদি শব্দসমূহের ত্রিবিধ আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক-আধিভৌতিক যজ্ঞের অর্থের গ্রহণ রয়েছে । কেবল ভৌতিক যজ্ঞের অর্থ গ্রহণ করে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্যের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি অসম্ভব ।
অন্য ক্ষেত্রে সমস্ত শুভ কর্মের নাম যজ্ঞ ।
" যজ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতমং কর্ম " ( শতপথ ব্রাহ্মণ. ১/৭/১/৫ ), শুধুমাত্র হবনকুণ্ডে আহুতি দেওয়া বুঝায় না ; এই প্রসঙ্গ স্মরণে রেখে মহর্ষির ভাষ্যের অধ্যয়ন করতে হবে ।
১৭. পিঙ্গল-ছন্দঃ সূত্রানুসারে প্রত্যেক মন্ত্রের ষড্জাদি স্বরও মহর্ষির ভাষ্যে বিস্তারিতভাবে বিদ্যমান ।
১৮. বেদ সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত অর্থাৎ, সার্বভৌম নিয়মের প্রতিপাদন করে থাকে, এই বিষয় মহর্ষির ভাষ্যে স্পষ্ট সর্বত্র বিদ্যমান ।
১৯. মহর্ষির বেদ ভাষ্যে নৈরুক্ত শৈলী অনুসারে অনেক এমন শব্দের নিদর্শন রয়েছে, যার নির্বচন নিরুক্ত এবং ব্রাহ্মণাদি শাস্ত্রেও উপলব্ধ হয় না ।
২০. মহর্ষির বেদ ভাষ্যের সবচেয়ে বৃহৎ এবং অন্তিম বিশেষতা হল, এই ভাষ্যে নৈরুক্ত শৈলী অনুসারে সংস্কৃত পদার্থ মন্ত্রগত পদসমূহের ক্রমে রাখা হয়েছে এবং সেখানে যত্রতত্র মন্ত্রের তিন প্রকার অর্থকে কেন্দ্র করে নির্বচন তথা অর্থ দর্শিত করা হয়েছে, যা অন্বয়-এ সম্ভব নয় । অন্বয়কে সংস্কৃত পদার্থের একটি অংশ বুঝতে হবে ; এবং এই সংস্কৃত অন্বয় হলো এরই ভাষার্থ , যা ভাষার্থ করার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থ দর্শিত হয় নাই ।
এই বেদভাষ্যের বিশেষতাকে অনুধাবন না করে অনেকেই প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয় ।
এখানে একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে,
যতই কোন বিদ্বান বিদ্যার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গসমূহের জ্ঞাতা তথা যোগাদি দিব্যশক্তিসম্পন্ন হবে, ততই তার বেদার্থের মান অধিক উৎকৃষ্ট হবে।
নমস্কার