• শাস্ত্রীয় ও যৌক্তিকতার আলোকে অনুসন্ধান।
বঙ্গদেশে সরস্বতী পূজায় বহুকাল ধরে চলে আসা দুটি ঐতিহ্য হল এদিন নতুন শিক্ষার্থীদের হাতেখড়ি দেওয়া এবং বাকিদের এদিন পড়ালেখা বন্ধ রাখা।
অনেকেই এই বিষয়টির নিয়ে জানতে চাইছেন৷ তাই কিছু কথার অবতারনা করছি।
❏ অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন বেদ এ নিয়ে কি বলে?
— বৈদিক রীতিতে এই হাতেখড়ি/ বিদ্যারম্ভ প্রকৃত রূপটি হল বেদারম্ভ সংস্কার। সকল তিথিকেই শুভ বিবেচনায় এই সংস্কার সম্পন্ন করা যায় এবং বৈদিক শাস্ত্রে অধ্যয়ন নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে বলা হলেও সে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। কারণ সরস্বতী পূজা পৌরাণিক স্মার্ত পূজা, বৈদিক কিছু তো নয়। তাই এখানে পুরাণ, স্মৃতি কি বলে শুনি বরং।
• দেবীভাগবত ৯/৪/৩৪-৫০ তে মাঘী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা মন্ত্রপাঠ ও বন্দনা ও তারপর ষষ্ঠীতে বিদ্যারম্ভ করার যে বিস্তৃত বিধি বর্ণিত হয়েছে, তাতে কোথাও অনধ্যয়নের বিষয়ে কোনো সতর্কবার্তা নেই।
এছাড়া অন্য কোনো পুরাণোক্ত সরস্বতী পূজাপদ্ধতিতেও এরকম কিছু এখনো পাইনি। সুতরাং এবিষয়ে পুরাণের দিক থেকেও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
❏ তো এইযে পূজার দিন পড়া নিষেধ এটা আসলো কোথা থেকে? তার উপর ইদানীং আবার শোনা যাচ্ছে এদিনে হাতেখড়ি দিলেও নাকি দেবী অভিশাপ দেন — এগুলোরই বা উৎস কি?
— এদেশে সরস্বতীর মূল পূজারীগণ হল শিক্ষার্থীগণ। এখনের মতোই সেই মধ্যযুগেও পড়ালেখায় ভালো করার আশায় তারা কালি-কলম, বইপত্র দেবী সরস্বতীর পায়ে উৎসর্গিত করে রাখতো, যেন ঐ কদিন বইগুলো দেবীর কাছ থেকে এমন আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে আসে যে তার জোরেই বাকি বছর পড়াশোনার বৈতরণী অনায়াসে পার হয়ে যাওয়া যায়।
যেহেতু পূজায় দিলে অন্তত একদিন পড়াশোনার এই উপকরণগুলো আটকে থাকতো, তাই অনধ্যয়ন অটোমেটিকই হয়ে যায়।
এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় মধ্যযুগীয় স্মার্ত-সংস্কারক শ্রী রঘুনন্দনের "তিথিতত্ত্বে" —
“মস্যাধারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ।"
- দোয়াত ও কলম দিয়ে পূজা করবে, কিন্তু লেখালেখি করবে না।
এবিষয়ে শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তার "সরস্বতী" গ্রন্থে বিষয়টি সুন্দর করে বলেছেন —
"দেশের লােকেরা যখন স্মৃতি ও অন্য শাস্ত্র ভুলিয়া যায়, অথচ যে কোন কারণেই হউক, কতকগুলাে সংস্কার যখন দেশাচার হইয়া দাঁড়ায়, তখন সেই অনুষ্ঠানগুলিকে সংশোধন বা সমর্থন করিবার জন্য নূতন করিয়া শাস্ত্র তৈরি করিতে হয়, এই শাস্ত্রই হল নিবন্ধ। রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব এইরূপ নিবন্ধগ্রন্থ।"
দেশাচারকে বৈধতা দিতেই বঙ্গীয় স্মার্তপ্রবর রঘুনন্দনের ঐ নির্দেশের অবতারনা।
• তবে এই বিবর্তনের একটা কুফলও দেখা যায়। যেমন :- ঐ নির্দেশের এককাঠি উপরে উঠে আবার শক্ত ফতোয়া দিয়ে মানুষজনকে সরস্বতীর কোপেই ফেলে দিয়েছেন মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ। ১৯০৯ সালে তার রচিত স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে লিখেছেন, —
শ্রী পঞ্চম্যাং লিখেন্নৈব্য ন স্বাধ্যায়ং কদাচন।
বাণীকোপমবাপ্নোতি লিখনে পঠনেহেপি চ।।
- শ্রীপঞ্চমীতে স্বাধ্যায় করবে না, লিখবে না। ঐ তিথিতে অধ্যয়ন করলে সরস্বতীর কোপভাজন হতে হয়।
সূত্র হিসেবে তিনি "শ্রীদত্ত উবাচ" বলেছেন। কে শ্রীদত্ত? কোথা থেকে নিয়েছেন? বা এই বিধানের যৌক্তিকতা কি? কিছু বলা নেই।
মাঝখান দিয়ে যুক্তি দিয়ে না ভেবে, সংস্কৃত বাক্য মাত্রই শাস্ত্রবাক্য ভেবে, এখনকার শিক্ষার্থীরা পূজার পরদিন পরীক্ষা থাকলেও পড়তে বসতে ভয় পাচ্ছে।
এজন্যই স্মৃতিশাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,
যুক্তিহীনে বিচারে তু ধর্মহানি প্রজায়তে।।
[বৃহস্পতি স্মৃতি/ ব্যবহার কাণ্ডম্ / ১১৪ তম শ্লোক]
— যুক্তিহীন বিচারে ধর্মহানি ঘটে।
সরস্বতীপূজার দিন এই পড়াশেনা বন্ধ রাখার রীতি কেবল বাংলায়ই আছে। তাই আলাদা করে বাঙালিদের প্রতি দেবীর কোপ পড়বে, এটা অযৌক্তিক ভিত্তিহীন চিন্তা ভাবনা । দেশাচার সংস্কার যদি মধ্যযুগে করা হয়, তো সেই সংস্কারের ধারা বহন করে নেওয়া এখনো কর্তব্য।
তবুও যদি কেউ বেদ-স্মৃতি-পুরাণ রেখে হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের বিধানকে শাস্ত্রীয় বলে মানতে চান, তাহলে বরং শ্রীপঞ্চমীতে আপনি লুচি দিয়ে ছোলার ডাল উপভোগ করে সাধারণ মানুষজনকে দেবীর কাল্পনিক কোপের ভয় দেখাতে থাকুন।
আর বাকি সবাই আসুন সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আনন্দও করি সেই সাথে স্বাধ্যায়ে আরও মনোযোগ নিযুক্ত করে জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ হই।
© ॐ শাস্ত্রপৃষ্ঠা
স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ
- অধ্যয়নে প্রমাদ করবে না।
[তৈত্তিরীয় উপনিষদ]
[ শিক্ষাবল্লী/১১ অনুবাক/১ম মন্ত্র ]