মানবজীবনের
 চার আশ্রমের প্রথম আশ্রম হল ব্রহ্মচর্যাশ্রম । উপনয়নের পর গুরুগৃহে 
শিক্ষালাভের সময়কালকে বলার হয় ব্রহ্মচর্য আশ্রম । গার্হস্থ্য আশ্রমের পূর্ব
 পর্যন্ত এই আশ্রমের স্থিতিকাল । ব্রহ্মচর্য পালনকারীদের  বলা হয় 
ব্রহ্মচারী । আর নারীদের বলা হয় ব্রহ্মচারিণী  । ব্রহ্মচর্য শব্দটিকে 
বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় - ব্রহ্মন্ - চর - য ।  আলোচনার সুবিধার্থে আমরা 
ব্রহ্মচারী শব্দটিই ব্যবহার করবো কেননা বিধি ও বিধান উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য ।
 
ব্রহ্মচারী অর্থ  কি ? 
'
 ব্রহ্মন্' শব্দের অর্থ - পরব্রহ্ম, বেদমন্ত্র, বেদ, ওঙ্কার, ব্রাহ্মণ, 
ব্রহ্মশক্তি, জ্ঞান,  তপ, পবিত্রতা, মুক্তি, সত্য, অন্ন, ধন, জল , সূর্য , 
মহত্ত্ব, বৃহত্তম ইত্যাদি । 
'
 বৃন্হ - মন্' ধাতু থেকে ব্রহ্ম শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে । এই ধাতুর অর্থ  - 
বৃদ্ধি করা ,  উন্নত করা, বিকশিত করা, প্রগতিশীল করা, ব্যাপ্ত হওয়া । এই 
জন্য  'ব্রহ্ম' শব্দের অর্থ - বৃদ্ধি, প্রসারণ, বিকশিত ইত্যাদি হওয়া সম্ভব ।
  
' চারী' ( চারিন্ ) শব্দের অর্থ  - চলনকারী, গতিশীল, উদ্যমী,  পুরুষার্থী ইত্যাদি । 
অতএব , 
- ' ব্রহ্মচারী' শব্দের অর্থ আমরা পাচ্ছি -
(১) জ্ঞানের বৃদ্ধির জন্য প্রযত্নকারী 
(২) বেদের প্রচারের জন্য কার্যকারী  
(৩) পবিত্র হওয়ার জন্য কর্মকারী সত্যনিষ্ঠ ও ধর্মাচরণকারী 
(৪) বুদ্ধির বিকাশে সচেষ্ট 
(৫) ধন ও অন্নের বৃদ্ধিকারী 
(৬) তপস্বী
(৭) ঈশ্বরভক্ত 
(৮) ব্রহ্মতেজকে নিজের অভ্যন্তরে ধারণকারী
ব্রহ্মচর্য  সম্পর্কে যোগদর্শনে (২।৩৮) মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন  
' ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠায়াং বীর্যলাভঃ ' অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য অবলম্বনে শক্তি ও ব্রহ্মতেজ লাভ হয় ।
- ব্রহ্মচারীর কর্তব্যাকর্তব্য
বেদ
 [ ব্রহ্মচারী সূক্ত - অথর্ববেদ ১১।৫ ] ও মনুস্মৃতি [ ২।১৬২-১৮০] শাস্ত্রে 
ব্রহ্মচারীর কি কি করা উচিৎ ও কি কি উচিৎ নয় তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণ 
দেওয়া হয়েছে । উক্ত বিধিনিষেধ সমূহ নিম্নরূপ -
ব্রহ্মচারীর অবশ্যই পালনীয় -
১।
 প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে ধর্মতত্ত্ব চিন্তন এবং বেদমন্ত্রের [ 
গায়ত্রী মন্ত্র ,  যজুর্বেদ ৩৪।৩৪-৩৮ ]  মাধ্যমে পরমাত্মার বন্দনা করা । 
২। এরপরে শয্যা ত্যাগ করে হাত মুখ ধুয়ে স্নান করে নিতে হবে । 
৩। এরপরে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে দেবযজ্ঞ তথা অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করা । 
৪।
 তারপরে বিহিত ,  শুদ্ধ, পবিত্র ও পুষ্টিকর খাদ্য আহার করে নিজের অধ্যয়নের 
কাজে মনোনিবেশ করা । বেদ বিহিত ও গীতোক্ত [ ১৭।৮ ]  সাত্ত্বিক আহার করতে 
হবে । আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি- এসকলের বর্ধনকারী 
এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্ এবং প্রীতিকর- এইরূপ আহার সাত্ত্বিক আহার । 
৫। অষ্টাঙ্গ যোগ অনুশীলন চর্চা  ক্রমান্বয়ে শুরু করতে করতে হবে [ মনু০ ৪।২০৪]  ।
 যোগদর্শন [২।২৯ ] অনুযায়ী যম , নিয়ম , আসন,  প্রাণায়াম , প্রত্যাহার, ধারণ
 , ধ্যান  ও সমাধি । যোগসূত্রে [ ২।৩০ ] যম ৫ প্রকার । অহিংসা , সত্য ,  
অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ । 
অর্থাৎ
 ব্রহ্মচর্য আশ্রম যোগেরই একটি অংশ ৷  অধ্যয়নের জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে 
আমাদের পরিবার সমাজ ও মূখ্যভাবে বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করি । তৈত্তিরীয় 
উপনিষদে [ ১।১১।২ ] বলা হয়েছে - আমরা যেন মাতা - পিতা - আচার্যদের 
ধর্মসঙ্গত বিষয়ই গ্রহণ করি । দোষসমূহ নয়  । যা আমরা সত্য বলে জানবো 
শাস্ত্রের আলোকে তাই যেন আমরা মেনে চলি ও প্রচার করি । 
- ব্রহ্মচারীগণ কি পড়বে ও তাদের শিক্ষকগণ কি ভাবে পড়াবেন তা নিয়ে তৈত্তিরীয় উপনিষদে [ ১।৯।১ ] খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে -
(১)
 শাস্ত্রবিহিত ও যথাযথ আচরণ করে সত্যবিদ্যাসমূহ অধ্যয়ন করতে হবে । 
বৈরবুদ্ধি ত্যাগ করে সবাইকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাওয়া ও তার উপদেশ প্রদান 
করা সকলের কর্তব্য বলে মহর্ষি মনু [ ২।১৫৯-১৬০ ] বলেছেন । ঋত অর্থাৎ সত্য 
জীবনে আচরণ ও ধারণ করতে হবে । 
(২)
 তপের অর্থাৎ ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে রেখে, সকল দোষ বর্জন করতে হবে৷ মহর্ষি 
মনু [ ২।৮৮ ] বলেছেন সারথির অশ্বনিয়ন্ত্রণের মত বিদ্বান তার মন  ও আত্মাকে 
চিত্ত কলুষিতকারী বিষয় থেকে দূরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে । 
(৩)
 অগ্ন্যাদি পদার্থ বিজ্ঞানের তত্ত্ব অর্থাৎ বিজ্ঞানের সমস্ত 
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব নিবিড়ভাবে মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করতে হবে । 
অগ্নিহোত্রাদি দেবযজ্ঞ করতে হবে । 
(৪)
 অতিথিসেবা - মানবসেবা করতে হবে । পত্নীগমন , সন্তান উৎপাদন-পালন ,  তাদের 
বিবাহ ও নাগরিক - রাজ্য সংক্রান্ত বিষয় জানতে হবে । বীর্যরক্ষা সম্পর্কে 
অবগত থাকতে হবে । 
ব্রহ্মচারী নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ নিম্নরূপ -
১।
 ব্রহ্মচারী নেশা জাতীয় দ্রব্য , নিষিদ্ধ আহার,  ব্যভিচার পরিত্যাগ করবে । 
এছাড়াও কোন খাবারে যেন অতিরিক্ত আসক্তি না জন্মে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে ।
 
২। নিজের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট থাকবে । হস্তমৈথুন , অশ্লীল আচরণ-ভাষণ ও কর্ম সর্বথা পরিত্যাজ্য ।
৩।
 জুয়া খেলা , পরনিন্দা-পরচর্চা , মিথ্যাকথা বলা, অলসতার জন্য  
পরনির্ভরশীলতা, অপরের অপকার এসব সব সময় পরিত্যাগ করবে । ভিতরে এক ও বাইরে 
আরেক আচরণের নাম ছলনা ও কপটতা । কারো উপকারকে অস্বীকার করাকে বলে কৃতঘ্নতা ।
 আমাদের সর্বদা এসব দোষ ত্যাগ করতে সচেতন থাকতে হবে । 
- পরিশেষে আমাদের আপ্ত ঋষিগণ যে উপদেশ [ তৈ০উ০ ১।১১।১-৪ ] ব্রহ্মচারীসহ সকলকে দিয়েছিলেন মানবজীবনের পাথেয় স্বরূপে তার সার -
(১)  সত্য বলবে ,  ধর্মের আচরণ করবে । 
(২) বেদ পাঠ ত্যাগ করবে না । তার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনে অমনোযোগী হবে না । 
(৩) আচার্যকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে তার শিক্ষার সম্মান করবে । মাতা - পিতা - অতিথি আদি দেবের সম্মান করবে । 
(৪) সন্তানসূত্র ছিন্ন করবে না । বংশরক্ষার জন্য বিবাহ তথা গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশের নির্দেশ । 
(৫)  শ্রদ্ধা , নম্রতা , সম্ভ্রম ও বন্ধুভাবে দান করবে । দানে যেন অহং বোধ বা অশ্রদ্ধা না আসে । 
(৬) আত্মরক্ষা ত্যাগ করবে না । 
(৭)
 অনিন্দনীয় মানে যা কিনা খারাপ ও শাস্ত্র বিরোধী নয় সেকল কাজ ত্যাগ করবে না
 । ভালো কাজই মানবের অনুষ্ঠেয় । যদি কারো কাজে সংশয় আসে তবে বিদ্বান ও 
বেদাদি শাস্ত্র যা বলে সেই অনুযায়ীই চলবে । কেননা ' ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং 
প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ' [ মনু০ ২।১৩ ] ধর্মজিজ্ঞাসায় বেদই পরম প্রমাণ ।
প্রস্তুতকরণে  -
বাংলাদেশ অগ্নিবীর

