- ঈশ্বরের স্বরূপ—
এই
জগতে তিনটি অনাদি সত্তা রয়েছে; (১) প্রকৃতি (২) জীবাত্মা এবং (৩) পরমাত্মা
(ঈশ্বর) (শ্বেতা০ ৪/৫) । এই তিনটি অনাদি সত্তার প্রথমটি ভোগ্য, দ্বিতীয়টি
ভোক্তা এবং তৃতীয়টি অভোক্তা । অর্থাৎ অনাদি প্রকৃতিকে অনাদি জীবাত্মা ভোগ
করে, কিন্তু অনাদি পরমাত্মা জীব দ্বারা ভুক্ত প্রকৃতিকে ত্যাগ করেন অর্থাৎ
তিনি এই প্রকৃতিতে লিপ্তও হন না ভোগও করেন না ।
পরমাত্মা
জগতের স্রষ্টা (ঋ০ ১/১/৫) ও রক্ষক (ঋ০ ১/১/৪) । “তিনি (ঈশ্বর) সর্বব্যাপক,
সর্বশক্তিমান, শরীররহিত, ছিদ্ররহিত, স্নায়ু আদির বন্ধন রহিত, রোগরহিত,
জন্মরহিত, শুদ্ধ, নিষ্পাপ, সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, দুষ্টের দমনকর্তা ও অনাদি ।
(যজু০ ৪০/৮) ।”
জীবাত্মার
ভোগের নিমিত্তই ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন । সহজভাবে বললে জীবের
মোক্ষপ্রাপ্তির পথ সুগম করতেই ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন । প্রকৃতিই জগতের
উপাদান কারণ । ঈশ্বর এই সত্তাকে সৃষ্টি করেন নাই (পূর্বেই বলেছি প্রকৃতি
অনাদি) । জগৎ সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বরের ন্যায় ইহাদেরও অস্থিত্ব ছিল । জগৎ
ধ্বংসের পরও ইহাদের অস্তিত্ব থাকবে । সুতরাং ঈশ্বর জগতের উপাদান কারণ নয়,
নিমিত্ত কারণ । কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ
করেন, ঈশ্বরও তেমনি উপাদান কারণের সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেন ।
ঈশ্বর
এক ও অদ্বিতীয় । তিনি অসীম ও নিত্য । তাঁহার সৃষ্ট জগৎ তাঁহাকে সীমিত
করতে পারে না । জগৎ তাঁহার দেহ, আর তিনি জগতের আত্মা । আত্মার সঙ্গে
জীবদেহের যে সম্বন্ধ, ঈশ্বরের সঙ্গে জগতেরও সেই সম্বন্ধ । আর ঈশ্বরের সঙ্গে
জীবের সম্পর্ক হইল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক । পিতা যেমন পুত্রের ক্ষমতা ও
সামর্থ্য অনুসারে পুত্রকে কর্মে নিযুক্ত করেন, ঈশ্বরও অনুরূপভাবে তাঁহার
সৃষ্ট জীবকে তাহার অতীতের কর্মানুসারে বর্তমান কর্মে নিযুক্ত করেন । ঈশ্বর
জীবের কর্মফলদাতা । জীব নিজের ইচ্ছায় কর্ম করে বটে, কিন্তু কর্মফল তাহার
ইচ্ছার উপর নির্ভর করেন না । ঈশ্বরই জীবের কর্মের গুণাগুণ বিচার করিয়া
কর্মের গুণানুসারে ফলপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন । জীব কর্মানুযায়ী
পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় এবং এই পাপ-পুণ্য যেখানে সঞ্চিত থাকে তাহার নাম
অদৃষ্ট । ঈশ্বরই অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করেন । কারণ, অদৃষ্ট অচেতন, তাই
অদৃষ্টস্থিত কর্মফল জীবের ভোগার্থে প্রদানের জন্য একটি সচেতন সত্তার
প্রয়োজন । সেই সচেতন সত্তাই ঈশ্বর ।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ—
১. পাশ্চাত্ত্য দার্শনিক কান্ট বলেন–
মানুষের নৈতিক চেতনা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকে সমর্থন করে । নৈতিক
যুক্তি দেখাতে চায় যে মানুষের নৈতিক অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ
করে । যেভাবে যুক্তিটি উপস্থাপিত হয়েছে তা এইরূপ–
নৈতিক
মূল্য বস্তুগত এই অর্থে যে তারা মানবপ্রকৃতির প্রয়োজনীয় গুণ । সুতরাং
মানবপ্রকৃতি যেমন এই জগতের একটা বাস্তব অংশ । মানুষ মনে করে সে এবং তার
মূল্যগুলি বাস্তব এবং সেহেতু এই বিশ্বজগৎ একটি নৈতিক বিশ্বজগৎ । প্রয়োজন,
কামনা, বাসনা, স্বার্থ, মানুষের প্রকৃতি বা সমাজের গঠনের সাহায্যে নৈতিক
মূল্যের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না বা অন্য কোন ভাবেও তাকে ব্যাখ্যা করা যায়
না, যদি না সেই ব্যাখ্যাকে কোন অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত
করা না হয় । অর্থাৎ নৈতিক মূল্যের অপ্রাকৃতিক ভিন্ন কোন প্রাকৃতিক
ব্যাখ্যা সম্ভব নয় । এই বিশ্বজগতে মানুষ এবং মঙ্গলের আদর্শের স্থান আছে,
যা নৈতিক মূল্য বাস্তুব মানুষের প্রকৃতির একটা মৌলিক গুণ । কিন্তু এই
বিষয়টি স্বীকার করে নিলে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে এক চেতন বৌদ্ধিক
সত্তার অস্তিত্ব আছে যিনি নৈতিক জীব হিসেবে মানুষের নৈতিক চেতনাকে বিকশিত
করেন । এই অতিমানবীয় শক্তি অবশ্যই চেতন এবং বৌদ্ধিক হবে, যিনি উদ্দেশের
কথা চিন্তা করেন এবং সেইগুলিকে সিদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট হন । সংক্ষেপে তিনি
হবেন একজন পুরুষ । এই পুরুষই হলেন ঈশ্বর । তাই নৈতিক মূল্যকে বস্তুগত গণ্য
করলে অবশ্যম্ভাবীভাবে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় । সুতরাং
নৈতিক বিশ্বজগৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ করে ।
২. এই
নৈতিক বিশ্বজগতে মানুষের অবশ্যই কর্তব্য সম্পাদনের স্বাধীনতা থাকবে ।
কিন্তু কর্তব্য করার স্বাধীনতা থাকলেও মানুষের পক্ষে এই জীবনেই তার সব
কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব নয় । নৈতিক বাধ্যতাবোধের সব দাবীকে এই জীবনে
পূরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না । তাই এই জীবনের পরেও একটা ভবিষ্যৎ
জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় । ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে
হয় কেননা, ঈশ্বর ছাড়া আমাদের এই কর্তব্যের চেতনা বা পরমকল্যাণকে লাভ করা
যে আমাদের কর্তব্য, তা যে নিছক ভ্রান্তি নয়, এই সুনিশ্চিত আশ্বাস লাভ করা
যাবে কার কাছ থেকে ? কর্তব্য সম্পাদনের জন্য মানুষের প্রয়োজন অনন্ত জীবন
এবং ঐশ্বরিক সমর্থনের আশ্বাস । মানুষ যদি তার পরমকল্যাণকে লাভ করতে না পারে
তাহলে নৈতিক জীবন হয়ে পড়বে নিছক ভ্রান্তি । কিন্তু মানুষ যে তার
পরমকল্যাণকে লাভ করতে পারবে, তার আশ্বাস দিতে পারে একমাত্র ঈশ্বর । সুতরাং
ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় ।
৩. কান্ট আরও বলেন–
আমাদের নৈতিক চেতনা এই দাবি জানায় যে ধার্মিক অবস্থাই সুখী হবে । কিন্তু
ধার্মিক ব্যক্তিকে আমরা সাধারণতঃ সুখী হতে দেখি না । সাধারণ মানুষের পক্ষে
সব ধার্মিক ব্যক্তিকে সুখী করা সম্ভব নয় । তাছাড়া প্রায়শঃই দেখা যায়
ধার্মিক ব্যক্তিরা এই জীবনে বহু দুঃখ কষ্টের দ্বারা পীড়িত হন এবং অধার্মিক
ব্যক্তিরা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে । এই কারণেও কোন ভবিষ্যৎ জীবনের
অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় যেখানে সব অন্যায়ের সংশোধন করা হয় “ধার্মিক
এবং অধার্মিক ব্যক্তির, তাদের নিজ নিজ কাজের প্রতিফল লাভ করে ।” তাছাড়া
যেহেতু এই জীবনে যেমন ধার্মিকতা ও সুখের মধ্যে কোন অনিবার্য সংযোগ নেই,
তেমনি এই জীবনকে একটি ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেও সেই
অনিবার্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে না যা ধার্মিকতাকে সুখের সঙ্গে সংযুক্ত
করবে । তাই কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় যিনি নিরপেক্ষ
বিচারক হিসেবে ধার্মিকতা ও যুগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন । অর্থাৎ
ধার্মিক ব্যক্তিকে এই জীবনে সুখী করা না গেলেও ঈশ্বর পরবর্তী জীবনে সুখী
করতে পারেন । সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় ।
৪. পাশ্চাত্ত্য দার্শনিক মার্টিস্যুর মতে- নৈতিক দায়িত্ব ও নৈতিক আদর্শ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে । মনুষ্যের নৈতিক দায়িত্ব কার কাছে ?
সসীম মনুষ্যের কাছে হতে পারে না, কারণ সসীম মনুষ্যের পক্ষে মনুষ্যের সব
অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব নয় । তাই এই দায়িত্ব কোন সর্বজ্ঞ
অসীম পূর্ণ সত্তার কাছে । এই সত্তাই ঈশ্বর । তাছাড়া নৈতিক আদর্শের পূর্ণতা কোথায় ?
নিশ্চয়ই কোন সত্তার মধ্যে এই আদর্শ পূর্ণতা লাভ করেছে, তা না হলে এই
নৈতিক আদর্শ অবাস্তব ও মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে । এই আদর্শ ঈশ্বরে পূর্ণতা লাভ
করেছে । সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় ।
৫.
অচেতন প্রকৃতি জীব এবং জগতের মূল কারণ হইলে তদ্দ্বারা উদ্দেশ্য এবং
উপায়ের যথাযথ সমন্বয় হতে পারে না । প্রকৃতির নির্দিষ্ট কোন্ কার্যটি
পুরুষার্থের পক্ষে সহায়ক হবে, কোন্ কার্যটি তদনুকূল হবে না, অচেতন
প্রকৃতির পক্ষে তাহা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । অতএব, ঈশ্বরের অস্তিত্বে
বিশ্বাস রাখতে হয় ।
৬.
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র প্রভৃতি সবই যৌগিক
পদার্থ এবং পরমাণুর দ্বারা গঠিত । এই পদার্থগুলো সবই কার্য, যেহেতু ইহারা
অংশের সমষ্টি, সাবয়বও সীমিত পরিসরযুক্ত । সুতরাং ইহাদের কারণ থাকবেই । কারণ
আবার দুই প্রকারের; যথা- (১) উপাদান কারণ এবং (২) নিমিত্ত কারণ । যেরূপ
ঘটরূপ কার্যের উপাদান কারণ হইল মৃত্তিকা আর নিমিত্ত কারণ হইল কুম্ভকার ।
জগতের যৌগিক পদার্থগুলির উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ আছে । ইহাদের উপাদান কারণ
হইল ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ পরমাণু । এখন প্রশ্ন, ইহাদের নিমিত্ত কারণ কে ?
ইহাদের নিমিত্ত কারণ এমন কেউ হইবেন যাঁহার পরমাণুকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা
আছে, যাঁহার চিকীর্ষা (উদ্দেশ্য সিদ্ধির ইচ্ছা) আছে এবং কৃতি (উদ্দেশ্য
সিদ্ধির ক্ষমতা) আছে । অধিকন্তু তিনি না হইলে পরমাণুর মত সূক্ষ্মবস্তুকে
প্রত্যক্ষভাবে জানা সম্ভব নয় । সুতরাং এই সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান
নিমিত্ত কারণ ঈশ্বর ছাড়া আর কেহ নন । সুতরাং ঈশ্বর আছেন ।
৭.
যে সকল পদার্থের মাত্রাভেদ আছে, তাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন স্তর থাকবেই
। যেমন, আয়তনের দিক হইতে পরমাণু ক্ষুদ্রতম এবং আকাশ বৃহত্তম । জ্ঞান এবং
শক্তিরও মাত্রাভেদ আছে, অর্থাৎ কারও বেশী এবং কারও তার তুলনায় কম । সুতরাং
এমন কোন পুরুষ আছেন যাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বোচ্চ সীমায়, যিনি সর্বজ্ঞ ও
সর্ব-শক্তিমান । মানুষের জ্ঞান ও শক্তি সীমাবদ্ধ, কারণ মানুষ সসীম জীব ।
কাজেই সেই সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান পুরুষ ঈশ্বর ছাড়া আর কেহ নহেন ।
সুতরাং ঈশ্বর আছেন ।
৮.
প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগের ফলে জগতের অভিব্যক্তি এবং বিয়োগের ফলে জগতের
বিনাশ হয় । কিন্তু প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী । উদাহরণস্বরূপ-
প্রকৃতি অচেতন, আর পুরুষ সচেতন । প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী হওয়ার
কারণে তাদের সংযোগ বা বিয়োগ তাদের স্বাভাবিক ধর্ম হতে পারে না । এখন
প্রশ্ন, বিরুদ্ধধর্মী প্রকৃতি এবং পুরুষের সংযোগ বা বিয়োগ ঘটাইল কে?
এর
উত্তর এই যে, কোন একজন সচেতন, সর্ব-শক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ পুরুষের সাহায্যে
এই সংযোগ বা বিয়োগ সম্ভব হয়েছে । এই সংযোগ বা বিয়োগসাধনকারী পুরুষই
ঈশ্বর । সুতরাং ঈশ্বর আছেন ।
৯.
জীব তার অদৃষ্ট অনুসারে জন্ম-মৃত্যুর অধীন হয় । কিন্তু জীব সীমিত বলিয়া
তাহার অচেতন প্রকৃতি ও নিজের অদৃষ্ট সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান থাকে না ।
তাই সে নিজের অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । অদৃষ্ট জীবের কর্মজাত
শক্তি এবং অচেতন । প্রকৃতিও অচেতন । কাজেই অদৃষ্ট নিজে বা প্রকৃতি অদৃষ্টকে
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । অচেতন অদৃষ্ট এবং প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য
একজন সচেতন, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান পুরুষের প্রয়োজন । সেই পুরুষই ঈশ্বর ।
সুতরাং ঈশ্বর আছেন ।
১০.
মানুষের অদৃষ্ট হইল তার কর্মফলের ভাণ্ডারখানা । মানুষকে তার কর্ম অনুসারে
ফলভোগ করিতে হয় । অদৃষ্ট এক অচেতন শক্তি হওয়ার কারণে মানুষের কর্ম অনুসারে
তাহার অদৃষ্টরূপ ভাণ্ডারখানা হইতে কর্মফলের ব্যবস্থা করার জন্য একজন সচেতন
নিয়ন্তা দরকার । সেই নিয়ন্তাই হইলেন ঈশ্বর । সুতরাং ঈশ্বর আছেন ।
১১. এই জগতে সকল মানুষের অবস্থা এক রকম নয় । কেউ ধনী, আবার কেউ গরীব । কেউ সুখী, আবার কেউ দুঃখী । কেহ পন্ডিত, আবার কে মূর্খ । কিন্তু এই তারতম্যের কারণ কি ?
সর্বজনস্বীকৃত কার্য-কারণ নীতি অনুসারে এই তারতম্যের নিশ্চয় কারণ আছে ।
প্রত্যেক মানুষের অবস্থা তার কৃতকর্মের ফল । মানুষের সু-কর্ম সুফল প্রদান
করে, আর কু-কর্ম কুফল প্রদান করে । মানুষের শুভাশুভ কর্মফল সঞ্চিত থাকে এবং
যাহাতে সঞ্চিত থাকে তাকে বলা হয় অদৃষ্ট । সুতরাং অদৃষ্ট হইল মানুষের
শুভাশুভ কর্মফলের ভাণ্ডারখানা । মানুষ তাহার অদৃষ্ট অনুসারে সুখ-দুঃখ ভোগ
করে । অদৃষ্ট জড়ও অচেতন পদার্থ । তাই প্রশ্ন জাগে, অদৃষ্ট কি করে মানুষকে তাহার যথাযোগ্য কর্মফল প্রদান করে ?
কারণ কোন জড় ও অচেতন পদার্থের পক্ষে যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকু
দেওয়া সম্ভব নয় । তাই অনুমান করা যায় যে, কোন সচেতন সত্তা এই অদৃষ্টকে
নিয়ন্ত্রণ করেন ।
এখন প্রশ্ন কে এই সচেতন সত্তা ?
এই সচেতন সত্তা ত জীবাত্মা হতে পারে না, যেহেতু জীব নিজে তাহার অদৃষ্টকে
জানে না । সুতরাং জীবের পক্ষে তার অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় । তাই
বলা যায় যে, অদৃষ্টের নিয়ন্ত্রণকারী এই অচেতন সত্তা সর্বজ্ঞ এবং
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই নন । ঈশ্বরই পাপীর দুঃখভোগের এবং
পুণ্যাত্মার সুখ-ভোগের ব্যবস্থা করেন । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পাশ্চাত্ত্য
দার্শনিক কান্টও (Kant) অনুরূপ যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ
করিতে চেষ্টা করেছেন ।
১২.
ঈশ্বরই বেদের রচয়িতা বেদের সাহায্যেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় ।
সকলেই স্বীকার করেন যে বেদ অভ্রান্ত ও প্রামাণ্য গ্রন্থ । কিন্তু বেদকে
অভ্রান্ত ও প্রামাণ্য মনে করিবার কারণ কি ?
বেদের
রচয়িতাই বেদের প্রামাণ্যের কারণ । আমরা বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস করি বলেই
যেমন বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করি, তেমনি বেদের রচয়িতাকে বিশ্বাস করি বলে বেদকে
বিশ্বাস করি । এখন প্রশ্ন, বেদের রচয়িতা কে ?
কোন
মানুষের পক্ষে অভ্রান্ত বেদ রচনা করা সম্ভব নয় । কারণ মানুষ অসম্পূর্ণ,
তাই মানুষের ভুল-ত্রুটি থাকিবেই । সুতরাং বেদের রচয়িতা এমন কেউ হবেন, যিনি
সম্পূর্ণ এবং সর্বজ্ঞন । এই সম্পূর্ণ এবং সর্বজ্ঞ পুরুষই ঈশ্বর ।
সাংখ্যদর্শনে মহর্ষি পথঞ্জলি বলেছেন–
“বেদের কর্ত্তা কোন মনুষ্য নহে । বেদ ঈশ্বরীয় অভ্রান্ত জ্ঞান । জীবের জ্ঞান অভ্রান্ত নয় বলিয়া জীবে বেদপ্রণয়ন শক্তির অভাবই দেখিতে পাওয়া যায়” (সাংখ্য০ ৫/৪৬)
বৈশেষিক দর্শনে মহর্ষি কণাদ বলেছেন–
“বেদবাক্য বুদ্ধিপূর্বক । এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোন কথা নেই । অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান ।” (বৈশেষিক০ ৬/১/১)
মহর্ষি পথঞ্জলি যোগদর্শনে বলেছেন–
“সেই (ঈশ্বর) এর সর্বজ্ঞ হওয়া এতটাই নিমিত্ত যে, তিনি ছাড়া আর কারোরই সেই সামর্থ্য নাই ।” (যোগ০ ১/২৫)
তদুপরি
বেদে বহুবিধ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের উল্লেখ আছে, যা
সাধারণ মানুষের জ্ঞানগম্য নয় । সুতরাং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরকেই বেদের রচয়িতা বলে
স্বীকার করতে হয় ।
১৩.
বৈদিক শাস্ত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বের আর একটি প্রমাণ— বেদ, উপনিষদ, গীতা সহ
সকল শাস্ত্রই ঈশ্বর আছেন, এই কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছে ।
ঈশ্বর শরীররহিত (ঈশ০ ৮), জন্মরহিত (শ্বেতা০ ২/১৫), লিঙ্গহীন (কঠ০ ২/৩/৮), সর্বজ্ঞ (যজু০ ৪০/৮), মঙ্গলময় (যজু০ ১৬/৪১), এক ও অদ্বিতীয়, সর্বদ্রষ্টা (ঋ০ ৬/৪৫/১৬)ঈশ্বর দুষ্টের দমনকর্তা (যজু০ ৪০/৮), রক্ষাকর্তা ও স্রষ্টা (ঋ০ ১/১/৫,৪) ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন–
“আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই আচার্যরূপে বেদান্তের অর্থপ্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া বেদার্থ পরিজ্ঞাত হই ।” (গীতা- ১৫/১৫)
এই সকল শ্রুতি ও স্মৃতিবাক্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে । সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতেই হয় ।
এ ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে— শাস্ত্রবাক্যকে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে মানিয়া নিব কেন ? সাধারণ মনুষ্য মানলেও দার্শনিকেরা মানবেন কেন ?
এর
উত্তরে এইটুকু বলা যায় কোন বস্তুর অস্তিত্বের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হলো
তাহাকে প্রত্যক্ষ করা । ঈশ্বর সম্পর্কেও একই কথা খাটে । ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ
করতে পারলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সমস্ত সংশয় দূরীভূত হয় । কারণ,
যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না ।
“পাশ্চাত্ত্য
দার্শনিক কান্ট (Kant) ও লজে (Lotze) স্পষ্টরূপে প্রতিপন্ন করিয়াছেন যে,
যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না । কারণ, সব যুক্তিই
ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পূর্বে স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং পরে প্রমাণের চেষ্টা
করিয়াছে ।”
এখন
প্রত্যক্ষই যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ হয়, তবে যারা
ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিতে পারে নি তাদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের
আপ্ত-বচনের উপর নির্ভর করা শ্রেয় ।
উপরোক্ত আলোচনা হইতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ হইল । এক্ষণে প্রশ্ন হতে পারে “কিভাবে ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত করা যায় ?”
এর
উত্তরে বলা যায় “ঈশ্বরকে অনুধাবন করতে পারা যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
ইঙ্গিতে ।” কিন্তু সরাসরি ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব নয় । তাহলে
কিভাবে ঈশ্বরকে (ঈশ্বরের ধারনাকে) প্রতিষ্ঠিত করব ?
প্রমাণের
অর্থ ইন্দ্রিয় অঙ্গগুলি থেকে প্রাপ্ত উদ্দীপনার মাধ্যমে নির্ধারিত
সুস্পষ্ট জ্ঞান । তবে লক্ষ্য করুন যে ইন্দ্রিয়গুলি বৈশিষ্ট্য, গুন,
ধর্মগুলি ধরতে পারে, কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যগুলির কারণকে ধরতে পারে না ।
উদাহরণস্বরূপ,
আপনি যখন অগ্নিবীরের কোন আর্টিকেল পড়েন তখন আপনি অগ্নিবীরের অস্তিত্বকে
ধরেন না, শুধুমাত্র কিছু ছবি আপনার স্ক্রীনে/পৃষ্ঠায় আসছে যা আপনি
অর্থপূর্ণ জ্ঞানের মধ্যে ব্যাখ্যা করেন । তারপর আপনি উপসংহারে আসেন যে এই
আর্টিকেলের কোনো না কোনো লেখক আছেই এবং আপনি দাবি করেন অগ্নিবীর এর
অস্তিত্বের প্রমাণ আছে । এটিই হইল 'পরোক্ষ প্রমাণ' যদিও এটিকে 'প্রত্যক্ষ'
বলে মনে হয় ।
একইভাবে
এই পুরো সৃষ্টি যা আমরা দেখি এর বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো
দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করি । যখন আপনি একটি ইন্দ্রিয় সংক্রান্ত
ইনপুট কোন একটি বিষয়ের সাথে সরাসরি সংযোগ করিতে পারবেন, তখন "সরাসরি
প্রমাণ আছে" আপনি এমন দাবি করবেন । উদাহরণস্বরূপ- যখন আপনি একটি আম ভক্ষণ
করেন, তখন আপনি মিষ্টির বৈশিষ্ট্যকে অনুভব করে থাকেন এবং এটিকে আমের সাথে
জুড়ে দেন । গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আপনি এমন "প্রত্যক্ষ প্রমানের"
সহযোগী হন শুধুমাত্র ঐ বিশেষ ইন্দ্রিয় দ্বারা যেটি ঐ বৈশিষ্ট্যকে নিরীক্ষন
করেছে । এভাবেই পূর্বের উদাহরণ থেকে বলা যায় আপনি শ্রবনেন্দ্রিয় বা
কর্ণের মাধ্যমে আমের প্রত্যক্ষ প্রমান পাবেন না, আমের প্রত্যক্ষ প্রমান
পাবেন শুধুমাত্র জিহ্বা, নাক বা চোখ দিয়ে । বাস্তবতায় এটাও 'পরোক্ষ
প্রমাণ' যদিও এটাকে আমরা 'প্রত্যক্ষ প্রমান' রূপে মেনে নিয়েছি সহজভাবে
বোঝার স্বার্থে ।
এখন,
ঈশ্বর যেহেতু সবচেয়ে সূক্ষ্ম বিদ্যমান সত্তা, তাই চোখ, নাক, জিহ্বা, ত্বক
বা কর্ণের মত মোটা ইন্দ্রিয়ের অঙ্গগুলির মাধ্যমে ঈশ্বরের সরাসরি প্রমাণ
পাওয়া অসম্ভব । উদাহরণস্বরূপ- আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের
মাধ্যমেও অতিআনবিক কণা দেখতে পাচ্ছি না, আমরা অতিস্বনক শব্দ (ultrasonic
sound) শুনতে পাই না এবং আমরা প্রতিটি অণুর স্পর্শ অনুভব করতে পারি না ।
অন্য
কথায়, এই অস্পষ্ট ও দুর্বল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা
অসম্ভব, ঠিক যেমন শ্রবনেন্দ্রিয় বা কর্ণের মাধ্যমে আমকে অনুভূত হতে পারেনা
বা সাবটোমিক কণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় না আমাদের কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা ।
- এমন কোন পথ আছে কি যাতে আমরা সরাসরি ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত করতে পারি?
ঈশ্বরকে
অনুভব করিতে পারে একমাত্র যে ইন্দ্রিয়, তা হলো মন । যখন মন পুরোপুরি
নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিক্ষোভমুক্ত থাকে (সব সময় হাজার হাজার
ভাবনা আসছে) এবং ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অধ্যয়ন ও
অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাপ্ত করা হয় । ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হতে
পারে বুদ্ধির মাধ্যমে, সেই একই ভাবে যেমনটা আমের স্বাদের প্রমান পেয়েছিলেন
। ঈশ্বরকে অনুধাবন করাই জীবনের লক্ষ্য, এবং একজন যোগী এটাই করার উদ্যোগ
নেয় মনকে নিয়ন্ত্রন করার নানা কৌশলের মাধ্যমে, যেখানে কিছু বিষয় অনুশীলন
করা অন্তর্ভুক্ত থাকে যেমন অহিংসা, সত্যান্বেষা, ধৈর্য্য, সকলের জন্য
শান্তি অন্বেষন, উচ্চ মানবিক চরিত্র, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম,
মনুষ্যগনের মধ্যে একতা ইত্যাদি ।
একটি
উপায়ে, প্রতিদিন আমরা আমাদের জীবনে ঈশ্বরের সরাসরি প্রমাণ ইঙ্গিত পাই ।
যখন আমরা চুরি, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতার মতো কোনও ভুল কাজ করতে চেষ্টা করি,
তখন আমরা ভয়, লজ্জা, সন্দেহের আকারে সেই অস্পষ্ট 'ভেতরের নির্দেশ' শুনতে
পাই । এবং যখন আমরা অন্যকে সাহায্য করার মতো মহান কাজে নিয়োজিত থাকি (একটি
শিশুকে আশীর্বাদ করি) তখন আমরা আবার সেই 'ভেতরের নির্দেশ' শুনিতে পাই
ভয়হীন, সন্তুষ্টি, উৎসাহ এবং সুখের অনুভুতির আকারে । এই ভিতরের নির্দেশ
ঈশ্বর প্রদত্ত ।
অতএব,
প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় প্রমাণের মাধ্যমে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্পষ্টরূপে
প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যেমনভাবে অন্য সত্তাগুলো আমাদের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে
প্রত্যক্ষ হয়েছে ।
নমস্কার

- আশীষ সরকার
সহায়ক গ্রন্থবলী-
১. ভারতীয় দর্শন - ড. রমেন্দ্রনাথ ঘোষ
২. সাংখ্য দর্শন - স্বাধ্যায় প্রকাশনী
৩. ধর্মদর্শন - প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত
৪. ভারতীয় দর্শন - অর্জুনবিকাশ চৌধুরী
৫. বৈদিক প্রশ্নোত্তর - সঞ্জীব নেওয়ার
৬. অগ্নিবীরের বিভিন্ন আর্টিকেল