দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







যবদ্বীপের মহাভারত ও তথাকথিত প্রাচীন গীতা বিষয়ে ভ্রান্তি নিবারণ

সত্যান্বেষী
0

 



  • ✅ যবদ্বীপের সংস্কৃত সাহিত্য -
দশম ও একাদশ শতকে যবদ্বীপীয় [ বর্তমানে জাভা দ্বীপ নামে অধিকতর পরিচিত ] সাহিত্যের পত্তন হয়। এই সাহিত্য সৃষ্টি হয় অনেকটা মহাভারতকে অবলম্বন করে। দশম শতকের শেষের দিকে রাজা পর্যবংশ যবদ্বীপে রাজত্ব করেন। তাঁর সময়ে যবদ্বীপীয় ভাষায় মহাভারতের একটি গদ্য অনুবাদ প্রস্তুত করা হয়। এই অনুবাদ একেবারে আক্ষরিক নয় তবে একে কতকটা সংক্ষেপে “মূল কথা লিখে যাওয়া” বলা যেতে পারে। তবে তখনকার দিনে যে সংস্কৃত মহাভারতের মূল গ্রন্থ যবদ্বীপে প্রচলিত ছিল, অনুবাদকগণ যে সেই মূল গ্রন্থ সামনে রেখে অনুবাদ করেছেন — তা বেশ বুঝা যায়। তারা মাঝে মাঝে মূল সংস্কৃত শ্লোকাংশ বা পুরো শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। মহাভারতের এই গদ্য অনুবাদ প্রায় নয় শত বৎসর পূর্বেকার যবদ্বীপীয় ভাষায় লিখিত। এখন যবদ্বীপে সাধারণ লোকে এ ভাষা বুঝবে না। এই প্রাচীন যবদ্বীপীয় ভাষার একটি নাম Basa Kawi ‘কবি ভাষা’ বা সংক্ষেপে Kawi 'কবি'। বোধ হয়, প্রাচীন কাব্য-সাহিত্যেই এই ভাষার প্রয়োগ ছিল বলে, মধ্য-যুগে যবদ্বীপীয়েরা এই নাম দিয়ে তাদের মাতৃভাষার প্রাচীন রূপকে নির্দেশ করত, যেমন প্রাচীন ভারতে বেদের ভাষাকে ‘ছান্দস' বা ‘ছন্দ:’ বলা হত। কবি-ভাষা সংস্কৃত শব্দে পূর্ণ; ভারতের বাহিরের একটি দেশে, আধুনিক বাংলা, উড়িয়া মারহাটির মত এত সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হতে হয়। কবি ভাষার গল্প মহাভারত দশম-একাদশ শতকে রচিত হলেও, এর পুঁথিগুলি কিন্তু তত প্রাচীন নয়; এগুলো বড়জোর দুই-তিন শত বৎসরের পুরোনো। যবদ্বীপ তখন মুসলমান হয়ে গিয়েছে—সংস্কৃতের চর্চাও তখন যবদ্বীপে লোপ পেয়েছে৷ এইজন্য পুঁথিতে উদ্ধৃত সংস্কৃত শ্লোক ও শব্দাবলী ভ্ৰমপ্ৰমাদ-পূর্ণ। সম্পাদনকালে শ্রীযুক্ত এনবল্ কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত মূল সংস্কৃত মহাভারতের সাথে মিলিয়ে শুদ্ধ পাঠ দিয়ে আলোচনার পক্ষে সুবিধা করে দিয়েছেন।

  • ✅ যবদ্বীপের সংস্কৃত সাহিত্যের পরিবর্তন , পরিবর্ধন ও বিকৃতি
ইতিমধ্যে যবদ্বীপে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের গল্পগুলিতে ধীরে ধীরে মূল সংস্কৃত-গ্রন্থের বহির্ভূত নানা বিষয় প্রক্ষিপ্ত হতে থাকে। মূল সংস্কৃতের সঙ্গে পরিচয়ক্রমে বিরল হতে আরম্ভ করে; হিন্দু ভারতের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হওয়া এর একটি প্রধান কারণ। দেশের আদিম ধর্ম ও মনোভাব এবং জনগণের মধ্যে প্রচলিত দেবতা-বাদ ও দেবতার লীলা—এই সমস্ত বস্তু একেবারে মরে যায় নাই। এগুলি ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল এবং ভারতবর্ষ হতে আনীত রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের গল্পের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেগুলোকে বিকৃত বা যবদ্বীপীয় মনোভাবের অনুকুল করে নবীনভাবে পুষ্ট করতে লাগল। ইতিপূর্বে, এক হাজার বৎসরেরও বেশিসময় যবদ্বীপে সাধারণের মাঝে মহাভারত পুরাণ প্রভৃতি প্রচলিত রয়েছে। এই সুদীর্ঘ কালে, লোক-মধ্যে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে মূল আখ্যানগুলির কিছু কিছু পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কমে আসায় ও অবশেষে যোগসূত্র ছিন্ন হওয়ার ফলে, এই পরিবর্তন আরও দ্রুত বেগে ঘটতে লাগল। ক্রমে সমুদ্রের পরপারে অবস্থিত ভারতবর্ষ বা জম্বুদ্বীপের অস্তিত্বের কথাই যবদ্বীপের লোক ভুলে গেল; এবং রামায়ণ-মহাভারতে ও পুরাণে বর্ণিত ঘটনাবলী যবদ্বীপেই ঘটেছিল—লোকের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল। এতে করে যবদ্বীপে মহাভারতের এক নূতন রূপ ক্রমে দাঁড়িয়া গেল—তাতে মূল আখ্যান ঠিক আছে, মূল পাত্রপাত্রীদের নাম ও বংশ-পরিচয় উভয়-ই কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হলেও একেবারে পরিবর্তিত হয়নি — মূলের বহু বস্তু আশ্চর্য্য-ভাবে অবিকৃত আছে—কিন্তু তথাপি ভারতবর্ষে অজ্ঞাত নানা পাত্রপাত্রী ও ঘটনা- সমাবেশ এসে জিনিসটিকে সম্পূর্ণরূপে যবদ্বীপের একটি বিশিষ্ট ব্যাপার করে তুলল।

  • ✅ বিকৃতির ধারা -

একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ব্যাপারটি এত পরিবর্তিত হতে পারেনি। দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে রাজা জয়াভয়ের কালে (১১৩৫-১১৫৫ খ্রীষ্টাব্দে) কবি Penuluh প''নুলুহ, 'ভারত-যুদ্ধ' কাব্য লেখেন—এটি মহাভারতের যুদ্ধেরই কথা; এতদ্ভিন্ন হরিবংশের কাব্যানুবাদও করেন।
যবদ্বীপে রামায়ণ ও মহাভারতের আখ্যান এখন কিরূপ দাঁড়িয়েছে , তার বিশদ বিবরণ ডচ্ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত J. Kats কাটস্ ডাচ ভাষায় লেখা Het Javaansche tooneel , I, Wajang Poerwa, Waltevreden ( Batavis) 1993 নামে তার সুবৃহৎ ও সুন্দর চিত্র দ্বারা অলংকৃত পুস্তকে লিখেছেন। এই পুস্তকের ইংরেজীতে বা ভারতীয় কোনও ভাষায় অনুবাদ হওয়া উচিত। এতদ্ভিন্ন, যবদ্বীপ হতে প্রকাশিত Inter-ocean নামক ইংরেজী পত্রিকায় শ্রীযুক্তা Moons-Zorab মুন্‌স-জোরাব যবদ্বীপের মহাভারত, পুরাণ ও আখ্যায়িকার সম্বন্ধে কতগুলি তথ্যপূর্ণ ইংরেজী প্রবন্ধ বহু বৎসর আগে লিখেছেন। যবদ্বীপীয় মহাভারত কাহিনী প্রথমতঃ দেবতাদের কতকগুলি আখ্যায়িকা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম প্রভৃতি অবলম্বন করে আরম্ভ হয়। পরে কুরুবংশের কথা এবং পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্রের চরিত বর্ণনা। তারপরে সংস্কৃত মহাভারতের মত পাণ্ডব ও কৌরবগণের ইতিবৃত্ত, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ প্রভৃতি পৰ্যায় সমস্ত-ই আছে। যবদ্বীপের লোক-প্রচলিত মহাভারতে কিন্তু মূল কুরুপাণ্ডব-কথা ব্যতীত, সাবিত্রী-চরিত্র, নলোপাখ্যান প্রভৃতি অন্য উপাখ্যানের স্থান নাই—অন্ততঃ কাট্‌স্-এর বইয়ে ২০০ পৃষ্ঠাব্যাপী যে যবদ্বীপীয় মহাভারতের সারাংশ দেওয়া আছে, তাতে পাচ্ছি না। মূল কৌরব পাণ্ডব-চরিত্র নিয়ে-ই এদের মহাভারত। তবে প্রত্যেক পাত্র-পাত্রী সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মহাভারত ও পুরাণে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত অনেক গল্পও আছে। বিশেষ খুঁটিনাটির সঙ্গে প্রত্যেক পাত্র-পাত্রীর জন্ম- ও বিবাহ-কথা বর্ণিত ও নাটিত হয়। অবশ্য মূল আখ্যানভাগ মোটের উপর অনুসৃত হয়েছে।

✅ মূল মহাভারতের পাত্রপাত্রীর সাথে যবদ্বীপের সংস্করণের ভিন্নতা -
সংস্কৃত-মহাভারত-বহির্ভূত যে-সকল নূতন গল্প ও নূতন পাত্র-পাত্রী এসে জুটেছে, তাদের অনেকগুলি যবদ্বীপের প্রাচীন লোক-ধৰ্ম-সংক্রান্ত দেবতা, যোদ্ধা বা রাজা-রাণী প্রভৃতি। এদের অনেকের নামও সংস্কৃত নয়। আবার যবদ্বীপীয়দের মুখে সংস্কৃত নামগুলি বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কিংবা নূতন নাম সৃষ্ট হয়েছে; যথা Palasrn = পরাশর, Poentadewa = যুধিষ্ঠির, Tjompala = পাঞ্চাল, Jama Widoera = বিদুর, Arimbi= হিডিম্বা, Ngastiar = হস্তিনাপুর, Soembadra - সুভদ্রা, Detarata=ধৃতরাষ্ট্র, Seugkuni = শকুনি, ইত্যাদি। মহাভারতের কতগুলি কথাবস্তু যবদ্বীপে এবং বালিদ্বীপেও বিশেষরূপে জনপ্রিয়। ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচ যবদ্বীপীয় মহাভারতের মতে অর্জুনের কন্যা Dowi Pregina ‘দেবী প্রগীবা(?)'-কে বিবাহ করেন। ঘটোৎকচের পুত্রের নাম 'শশিকিরণ'। পাশুপত অস্ত্র লাভের জন্য অর্জুনের তপস্যা, কিরাতার্জুনসমর (কিরাত-বেশী মহাদেবের আখ্যান) যবদ্বীপে ‘মিস্তরাগ' বা ‘বীতরাগ' অর্জুনের আখ্যায়িকা বলে প্রসিদ্ধ, এবং বিখ্যাত যবদ্বীপীয় কাব্য 'অর্জুন-বিবাহ' এই সমস্ত ঘটনা অবলম্বন করে লিখিত। অর্জুনের সঙ্গে বিকটাকৃতি Semar ‘সেমার' নামে তিনজন অনুচর সর্বদাই থাকত; সেই 'সেমার'-ত্রয় প্রাচীন যবদ্বীপীয় দেবলোক হইতে মহাভারতকে জগতে আনেন।

✅ বহিরাগত মুসলমানদের প্রভাব ও প্রক্ষিপ্ততা
যবদ্বীপীয় জনগণ ইসলাম মত অবলম্বন করার পরে, মহাভারতের এই বিস্তৃত আখ্যায়িকার ভিতরে কিছু-কিছু মুসলমানী ভাবও প্রবেশ করে। মহাভারতের উপাখ্যানটিকে একটি সূফী মতবাদের রূপক বলে ব্যাখ্যা করা হতে থাকে। কিন্তু তথাপি যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনেকটা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন। যুধিষ্ঠির এখনও যবদ্বীপীয়দের কাছে ‘ধর্ম-বংশ’ বা ‘ধর্ম-পুত্র' নামে পরিচিত, আদর্শ নরপতি রূপে সম্মানিত। তিনি শান্তিপ্রিয় লোক, এত বেশী ক্ষমাশীল যে লোকে তাঁহাকে কাপুরুষ বলিয়া মনে করতে পারে। তিনি শত্রু জয় করেন— তাঁহার সত্যের বলে ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। Kalima Sada 'কালিমা সাদা' নামে যুধিষ্ঠিরের একটি মন্ত্রপূত তাবিজ আছে, যার ইন্দ্রজাল-প্রভাবে তিনি জগতে সর্বত্র জয়ী হন। এই তাবিজে লিখিত hadji ‘হাজি' বা জ্ঞান যুধিষ্ঠিরের জানা আছে বলেই তাহার এই অপ্রতিহত প্রভাব।

✅ মূল মহাভারত ও যবদ্বীপের মহাভারতের পরস্পর বিরোধীতা
যবদ্বীপীয় মহাভারতে মূল সংস্কৃত মহাভারতের বিরোধী যে বহু কথা আছে, সেগুলির দুই-একটির উল্লেখ করা যেতে পারে। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ পাণ্ডব 'চম্পাল' বা পাঞ্চাল রাজ্যে গেলেন। সেখানে রাজা দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর হচ্ছিল। রাজা দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে দেখে চিনতে পেরে তাঁকেই কন্যা সম্প্রদান করতে চাইলেন। কিন্তু ভীম বীরত্ব না দেখ এইরূপে কন্যাগ্রহণ করা অনুমোদন করলেন না, – কারণ সেরূপ করলে পাণ্ডব-নামে কলঙ্ক পড়বে। তিনি রঙ্গক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়্ব দ্রুপদের ভ্রাতা Gandamana গন্ধমনের সহিত যুদ্ধ করে দ্রৌপদীকে জয় করলেন। যুধিষ্ঠির তখন দ্রৌপদীকে বিবাহ করলেন। যবদ্বীপীয় মহাভারতে অর্জুনের লক্ষ্যভেদের কথা নাই, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিত্বের কথাও নাই। যবদ্বীপীয় মহাভারতে দ্রোণাচার্য্য বরাবর-ই পাণ্ডবদের বিরোধী, তাঁর-ই চেষ্টায় পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয় ঘটে। মূল মহাভারতে বর্ণিত আছে যে, পাণ্ডবদের অরণ্যবাস-কালে একদা দ্রৌপদী যখন আশ্রমে একা ছিলেন, তখন সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তাহাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করেন, কিন্তু সফলকাম হন না, পাণ্ডবদের হাতে তাঁর যথেষ্ট লাঞ্ছনা ঘটে। এরপর, বিরাটের রাজসভায় কীচকের হাতে দ্রৌপদীর নিগ্রহ হয়, ফলে ভীম কর্তৃক কীচক-বধ ঘটে। এই দুই কথার আধারের উপরে যবদ্বীপের মহাভারতে ভারতবর্ষে অজ্ঞাত দুইটি নূতন ও সম্পূর্ণরূপে যবদ্বীপীয় গল্পের সৃষ্টি হয়েছে। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত দাতা ছিলেন, যে যা চাইত তিনি তাকে তাই দিতেন। দেবরাজ ইন্দ্র, যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করবার মানসে, Bismaradja ‘ভীষ্মরাজ' নামে অসুরের মূর্তি পরিগ্রহ করেন, দ্রৌপদীকে নিজের রাণী করবার জন্য যুধিষ্ঠিবের নিকট প্রার্থনা জানালেন। যুধিষ্ঠিরে রাজচিহ্ন Toonggoel Naga ‘তুঙ্গুল নাগ' নামে রাজচ্ছত্র ও 'কালিমা-সাদা' নামে ঐন্দ্রজালিক তাবিজ তাহার সঙ্গে থাকলে, কেউই তাঁর হানি করতে পারিবে না ; সেজন্য ভীষ্মরাজ-রূপী ইন্দ্ৰ তাঁহার বোনকে দেবর্ষি নারদের বেশে যুধিষ্ঠিরের কাছে যেয়ে ঐ দুইটি বস্তু চেয়ে আনবার জন্য পাঠালেন। যুধিষ্ঠির নারদ-বেশী ভীষ্মরাজ-ভগিনীকে বস্তু দুইটি দিলেন, এবং দ্রৌপদীকে ভীষ্মরাজের গৃহে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে আজ্ঞা করলেন। কিন্তু তাঁর ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদী এতে স্বীকৃত হলেন না—তাঁরা এ বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের অনুমোদন বিনা কিছু করবেন না স্থির করলেন। ভীমপুত্র ঘটোৎকচ দ্বারাবর্তী হইতে শ্রীকৃষ্ণকে আনার জন্য আকাশ-মার্গে উড়ে গেলেন। ইতিমধ্যে স্বীয় রাজচিহ্ন ও তদধীন রাজ-সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত হইয়া যুধিষ্ঠির উন্মাদের মত হয়ে গেলেন, এবং রাক্ষসবৎ যা সম্মুখে পড়ে তা-ই ধ্বংস করতে লাগলেন। অন্য পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী শ্রীকৃষ্ণের আগমনের অপেক্ষায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলেন। ঘটোৎকচের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ গগন-মার্গে এসে উপস্থিত হলেন। পথে নারদবেশী ভীষ্মরাজ-ভগিনীর নিকট হতে যুধিষ্ঠিরের রাজচিহ্ন ছত্র ও তাবিজ উদ্ধার করে, শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে তা এনে দিলেন; এতে যুধিষ্ঠির শান্ত ও প্রকৃতিস্থ হইলেন। ইতিমধ্যে ভীষ্মরাজ-বেশী ইন্দ্র উপস্থিত হওয়াতে, অৰ্জুন বাণ মেরে তাঁকে পরাজিত করেন; ইন্দ্র ভীষ্মরাজের রূপ পরিত্যাগ করে স্বরূপে দেখা দেন। যুধিষ্ঠির এদিকে প্রকৃতিস্থ হয়ে সুদূর দেশে গমনপূর্বক তপশ্চারণের
জন্য Mega-malang ‘মেঘ-মালঙ্' নামে বিরাট এক মেঘখণ্ডকে আসন করে বসে আছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁহাকে গৃহে ফেরানোর জন্য ‘মেঘ-মালঙ্’ অভিমুখে গমন করলেন। পথে Dewa Mambang ‘দেব মাম্বা' নামে এক রাক্ষসের সাথে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ হয়— শ্রীকৃষ্ণ তখন Tiwikrama 'ত্রিবিক্রম' নামে নিজ রাক্ষসী মূর্তি প্রকট করে চক্রান্তের দ্বারা দেব-মাম্বা-কে বধ করেন। তার পরে তিনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে আবার গৃহে পাঠিয়ে দেন৷
এই প্রকার নানা উপাখ্যান যবদ্বীপেই কল্পিত হয়েছিল । অনুরূপ আর একটি যবদ্বীপীয় গল্প হলো Erangbaya ‘এরঙ ভষ’-এর আখ্যান। Roedjemlawa ‘রুজিম্লর’ দেশের রাজা এরঙ ভয়-ও দ্রৌপদীকে কামনা করে। এই ব্যাপার নিয়ে দ্রৌপদীর কনিষ্ঠা ভগিনী অর্জুনের পত্নী Srikanti ‘শ্ৰীকান্তি’ জ্যেষ্ঠা দ্রৌপদীকে নানা বিষয়ে যথেষ্ট অপদস্থ করেন। বলা বাহুল্য, এই আখ্যানও আমাদের দেশে অজ্ঞাত।
সংস্কৃত মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডবদের স্বর্গারোহণ-কাহিনী ব্যতীত যবদ্বীপের লোক-প্রচলিত মহাভারতে পাণ্ডবদের পরলোক গমনের অন্য এক অদ্ভুত কাহিনী বিদ্যমান আছে। পাণ্ডবেরা পরীক্ষিৎকে রাজা করলেন, ও নিজেরা শ্রীকৃষ্ণের সহিত বনবাস করতে লাগলেন। পরে পরীক্ষিতের কাছে দূত পাঠিয়ে যুধিষ্ঠির, পঞ্চ-পাণ্ডব ও দ্রৌপদী, এদের জন্য ছয়টি ‘চাণ্ডী’ বা ‘চান্দি’ অর্থাৎ স্মৃতি- বা সমাধিমন্দির প্রস্তুত করলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, শীঘ্রই তারা অগ্নিপ্রবেশ করে মোক্ষলাভ করবেন। সমাধি-মন্দির প্রস্তুত হলে পরে, শ্রীকৃষ্ণ সহ পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তন করে মন্দিরগুলি অবলোকন করলেন। তারপরে চিতা প্রস্তুত ও প্রজ্জ্বলিত করে, প্রথমে দ্রৌপদী ও পরে অর্জুন নকুল সহদেব ও যুধিষ্ঠির তাতে প্রবেশ করে অগ্নিতে প্রাণবিসর্জন করলেন। কিন্তু ভীম অগ্নিপ্রবেশ না করিয়া কেবল তাঁর কেশচ্ছেদ ও হস্তপদের নখ কর্তন করে যোগাসনে বসলেন, এবং আকাশের সঙ্গে মিশিয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হলেন।

✅ মূল মহাভারতের কাহিনী বিকৃতি একটি চূড়ান্ত প্রমাণ ও উদাহরণ -
এতে মুসলমান-যুগে সংযুক্ত একটি বর্ণনায় যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু সম্বন্ধে এইরূপ আখ্যান আছে:— পাণ্ডবগণের নাশ হইল, কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁহার 'কালিমা সাদা'র ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার প্রভাবে অমর হয়ে রইলেন। পরে সুলতান Kalidjaga ‘সুলতান কালিজাগা' নামে একজন যবদ্বীপীয় Wali 'ওলী' বা ঐশ্বরিক-শক্তি-বিশিষ্ট প্রথম যুগের ইসলাম-প্রচারক — যুধিষ্ঠিরের 'কালিমা-সাদা'র মধ্যে নিহিত ‘হাজি' বা যোগবিদ্যা বা জ্ঞানের সন্ধান পান, ও তা পাঠ করে এই জ্ঞান আত্মসাৎ করেন। এইরূপে যুধিষ্ঠিরের যোগবিদ্যার অধিকার লাভ করে, এই মুসলমান সাধু, নিজেই যুধিষ্ঠিরের মত ধর্মরাজের পুত্র বা অংশ হয়ে গেলেন— প্রাচীন যবদ্বীপের সমস্ত আধ্যাত্মিক ও ঐন্দ্রজালিক সম্পদ মুসলমান গুরুর অধিকারে চলে গেল৷ যুধিষ্ঠিবের তখন আর জীবিত থাকার আবশ্যকতা রইল না—তিনি যবদ্বীপে ইসলাম-ধর্ম প্রচারের সঙ্গে-সঙ্গে দেশের প্রাচীন হিন্দুধর্মের সহিত-ই মরলেন। হিন্দু যবদ্বীপের উপরে মুসলমান ধর্মের বাহ্য চিহ্ন পড়ল, কিন্তু তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও তার গভীরতম অনুভূতির প্রতীক-স্বরূপ যুধিষ্ঠিরের নামের সহিত জড়িত এই যোগবিদ্যা রয়ে গেল। এ যেন একটি সজ্ঞানে খচিত রূপক ৷ এমনভাবে যবদ্বীপে মূল সংস্কৃত মহাভারতের বিকৃতি ,পরিবর্তন ও পর্যবসান ঘটেছে । অর্থাৎ মূল মহাভারতের সাথে কোনভাবেই প্রামাণ্য বলা যায় না ।

✅ সিদ্ধান্ত
এমতাবস্থায় -
  • ১। যবদ্বীপের মহাভারতকে প্রাচীন মহাভারত কোনমতেই বলা যায় না । কেননা এক সময়ে প্রাচীনতার নূন্যতম সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে তার কোন উপায়ই নেই ।
  • ২। উক্ত মহাভারতে কিছু যত্রতত্র পাওয়া শ্লোকের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ প্রাচীন পাঠ নির্ণয় অসম্ভব । রাজশেখর বসু তার সংক্ষিপ্ত রামায়ণেও মূল শ্লোক কতিপয় উল্লেখ করেছেন । এখন শতবছর পরে কেউ এই শ্লোকগুলোকেই মূল বললে যেমন হাস্যকর শোনাবে তেমনি প্রাচীন গীতা নামক তথাকথিত সংস্করণ সম্পর্কেও একই মন্তব্য ।
  • ৩। প্রাচীন গীতা মূল যে হিন্দি বইয়ের অনুবাদ তাতেও লেখক বলেছেন যবদ্বীপীয় কবিভাষা শিখে চূড়ান্তভাবে অনুসন্ধান করা উচিৎ । তাহলে এই গীতাকেই আদিরূপ বলার কোন প্রকার কোন যৌক্তিকতাই নেই ।
  • ৪। অতএব তথাকথিত ৭০ শ্লোকের গীতা যবদ্বীপীয় আঞ্চলিক মহাভারতের একটি সংস্করণ হতে পারে কিন্তু কোনভাবেই গীতার আদিমতম রূপ বলে স্বীকার্য কখনোই নয় ।

অলমিতি ।


বাংলাদেশ অগ্নিবীর


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)