আমরা মানুষ বলেই ভুল ত্রুটি করি ❝ আগঃ পুরুষতা করাম ❞ [ যজু০ ১৯।৬২ ] ।
চিন্তা ভাবনা এবং কার্যকলাপে ভুল করা মানুষের পক্ষে শুধু যে স্বাভাবিক তাই নয় , অপরিহার্য ও বটে । স্বাভাবিক এইজন্য যে মানুষ বড় দুর্বল , সর্বদা নানাবিধ ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে পারে না অনেক কিছুর মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নেয় । অপরিহার্য এইজন্য যে তার জ্ঞান অতি সংকীর্ণ , কোনটি ভুল , কোনটি নির্ভুল তা নির্ধারণ করাই অনেক সময় কঠিন , এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়ে । ❝ তৃষ্টাসি তৃষ্টিকা বিনা বিষাতক্যসি ❞ [ অথর্ববেদ ৭।১১৩।২ ] বিষয়ভোগের তৃষ্ণা লোভময়ী , বিষরূপী এবং বিষাক্ত । জড়জাগতিক মোহমায়ায় প্রতিনিয়ত আমরা নানা অপরাধে জড়াই ।
আমাদের জীবনে ভুল মানুষগুলো অবদান যে কি পরিমাণ রয়েছে আমরা কখনো বিশ্বাস করতে চাই না , তারা আমাদের জীবনের এমন একটা অংশ হয়ে থাকে যেখানে আমাদের জীবন একটা জায়গায় এসে স্থির হয়ে যায় ; কিন্তু আমরা উঠে দাঁড়াতে ভয় পাই ; আমাদের মধ্যে যে একটা দৃঢ় মন আছে , সেইটাকে জাগাতে পারি না , আমরা কেবলই ভাবি আমরা ব্যর্থ , আমরা শুন্য সে ছাড়া আমরা বুঝি কিছুই না । ❝ মাত্র তিষ্ঠঃ পরাঙ্মনাঃ॥ ❞ [অথর্ববেদ ৮।১।৯] এই জগতে মনমরা হয়ে বা বিমর্ষ চেহারায় বসে থেকো না ।
তারপর কিছু মানুষ বিষন্নতায় ভুগে তাদের করার কিছু থাকে না , তারা সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে নির্দ্বিধায় বসে পরে তাদের দ্বারা কিছু হবে না । ❝ মা বি বেনতম্ তিরশ্চিদর্যযা ❞ [ ঋগ্বেদ ৫।৭৫।৭ ] হে মানবগণ ! হতাশ বা নিরাশ হয়ো না । জীবনটা আপনার আর আপনার জীবনের কারিগরও কিন্তু আপনি! আপনি চাইলেই জীবনে একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন আবার আপনি চাইলেই সেইটা শেষও করে দিতে পারবেন , তাই কেউ আপনাকে যদি আঘাত দিয়ে ভালো থাকে তাহলে সেইটা ছেড়ে দিন ; কেউ একজন রয়েছে , তিনি দেখবেন , অযথা নিজের জীবন টাকে কষ্ট কেনো দিচ্ছেন ? ❝ নৈষা গব্যূতিরপভর্তবা উঃ ❞ [ অথর্ববেদ ১৮.১.৫০ ] এই জীবন মার্গ অবশ্যই হতাশাপূর্বক পরিত্যাগের জন্য নয় । ❝ মা গতানামাদীধীথাঃ ❞ [ অথর্ববেদ ৮।১।৮ ] যা চলে গিয়েছে তার জন্য শোক করো না । ❝ মা বিভের্ন মরিষ্যসি ❞ [ অথর্ববেদ ৫.৩০.৮ ] জীবনপথে এগিয়ে যেতে ভয় পেও না , তুমি হত হবে না । ❝ বৃহস্পতির্মআত্মা নৃমণা নাম হৃদ্যঃ ❞ [ অথর্ববেদ ১৬.৩.৫ ] প্রভু! তুমি আমার অন্তরের প্রেরণা দানকারী , উন্নতির পথে পথপ্রদর্শক ও প্রিয়তম ।
গোলাকার এই পৃথিবীতে আপনার দেওয়া কষ্টগুলো ঘুরেফিরে কিন্তু আপনার কাছেই একদিন না একদিন ফেরত আসবে । আপনি নিজেই আত্ম অনুশোচনায় ভুগতে ভুগতে একটা সময় শেষ করে দেবেন নিজেকে হয়তো যেটা আপনার " so called " ইগোর জন্য ঐ মানুষটার কাছে ক্ষমাও চাইতে পারবেন না! সবার মনে রাখা উচিত , মানুষের দীর্ঘশ্বাস খুব খারাপ । সামনে এগোতে গেলে শেকলের মত পা জড়িয়ে টেনে ধরে । ভাল থাকুক চারপাশের মানুষগুলো । ভালোবাসার , ঘৃণার , কাছের , দূরের সবাই ভাল থাকুক । অভিশাপ না দিলেও Revenge of Nature বলে একটা কথা আছে । প্রকৃতি কিছুই ভোলে না , সময়ের ব্যবধান মাত্র । ❝ যো বাচ॒মনু॑দিতাং চি॒কেত॑ ❞ [ অথর্ববেদ ৫|১|২ ] না বলা কথাগুলোও পরমাত্মা জানেন ।
কখনো কারো প্রতি রাগ , ক্ষোভ , হিংসা বিদ্বেষ , ঘৃণা , অপমান কিংবা কোনও প্রতিশােধ স্পৃহা রাখতে নেই বিন্দুমাত্রও এতে অন্তত ' মেন্টালি স্যাটিসপেক্টেড ' হওয়া যায়না । ক্ষমা করাটা খুব করে প্রয়োজন । কিন্তু ক্ষমা করে দিয়েছেন তাই আপনি দূর্বল বিষয়টা এমন নয় ক্ষমা করাটা ও একটা মহৎ গুণ । সেই প্রাচীনকালেই মহাত্মা বিদুর বলেছিলেন— ❝ একঃ ক্ষমাবতাং দোষো দ্বিতীয়ো নোপলভ্যতে। যদেনং ক্ষময়া যুক্তমশক্তং মন্যতে জনঃ ❞ [ বিদুরনীতি ১।৪৭ ] অর্থাৎ ক্ষমা নামক গুণের মধ্যে শুধু মাত্র একটি দোষ রয়েছে , দ্বিতীয় কোনো দোষ নেই । সেই দোষটি হচ্ছে , যিনি ক্ষমাশীল হন বা অন্যকে ক্ষমা করেন তাঁকে সকলে দুর্বল ভাবতে শুরু করে । অবশ্য রবীন্দ্রনাথও ঠাকুর বলেছিলেন - ❝ সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে তাহা মানুষকে অভিভূত করে না , তাহা মানুষকে মুক্তি দান করে । ❞
আমরা যে যেখানে যা কিছুই করিনা কেন , যা কিছুই ভাবিনা কেন , ঈশ্বর তা দেখছেন , তিনি সবকিছুই জানেন । যে যেখানে যা কিছুই বলিনা কেন , করিনা কেন ঈশ্বর তা শুনছেন , প্রত্যক্ষ তার সব । কাউকে ঠকিয়ে কষ্ট দিয়ে খুব ভালো আছি ভাবছি কেউ কিছু বলছে না তো । কিন্তু নাহ্! এই সমগ্র জগতের প্রতিটি কিছুকে তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন , তিনি সর্বজ্ঞ সর্বব্যাপক । সব কিছুতেই ❝ ঈশা বাস্যমিদং ❞ [ যজু০ ৪০।১ ] তিনি কণায় কণায় বিদ্যমান । তুমি তাকে লুকিয়ে কি করবে ? তিনি যে ❝ পরীত্য সর্বা প্রদিশো দিশশ্চ ❞ [ যজু০ ৩২।১১ ] সব দিকেই আছেন ।
য়স্তিষ্ঠতি চরতি য়শ্চ বঞ্চতি য়ো নিলায়ং চরতি য়ঃ প্রতঙ্কম্ ।
দ্বৌ সংনিষদ্য য়ন্মন্ত্রয়েতে রাজা তদ্বেদ বরুণস্তৃতীয়ঃ ॥
অথর্ববেদ ৪.১৬.-২
ভাবার্থ- যে ব্যক্তি স্থির , যে ব্যক্তি চলমান , যিনি প্রবঞ্চনা করেন অথবা যিনি অন্তরে বা বাহিরে অপকর্ম করেন , দুইজন ব্যক্তি যখন ভাব বিনিময় করেন বা আলোচনা করেন , হোক তা ভালো বা মন্দ , তৃতীয় একজন , সেই সর্বজ্ঞ,সকল কিছুর সাক্ষী যিনি , সমগ্র জগতের শাসক , চরাচরের বিচারক , চালক ও প্রতিদাতা তিনি এই সবকিছুই শুনতে পান , দেখতে পান ।
উত যো দ্যামাতিসর্পোৎপরস্তান্ন স মুচ্চাতৈ বরুণস্য রাজ্ঞ ।
দিব স্পশঃ প্র চরন্তী দমস্য সহস্রাক্ষা অতি পশ্যন্তি ভূমিম্ ॥
অথর্ববেদ ৪.১৬.-৪
ভাবার্থ- যে ব্যক্তি মনে করে সে পালিয়ে যাবে সকল আলো হতে দূরে অন্ধকারে , নিভৃতে , সেও কখনো এই সমগ্র জগতের রাজা বরণীয় পরমেশ্বর হতে পালাতে পারেনা । তার সর্বদৃষ্টিময় , সহস্র অসংখ্য দৃষ্টি সমগ্র জগতে বিদ্যমান , সমগ্র ভুবন তার দৃষ্টির সীমায় , তার কাছে কোন কিছুই লুকায়িত নয় , অজানা নয় কেউই ।
কাউকে কষ্ট দিয়ে , কাউকে কাঁদিয়ে , কাউকে ঠকিয়ে বেমালুম ভুলে যাই আমরা , কিন্তু প্রকৃতি ভোলে না , প্রকৃতি ক্ষমা করে না । প্রত্যেকটা মানুষ তার খারাপ কাজের শাস্তি কিছুটা হলে ও পৃথিবীতে ভোগ করে! ক'দিন আগে কিংবা ক'দিন পরে! কিন্তু শাস্তি সে পাবেই কেননা ❝ অদব্ধানি বরুণস্য ব্রতানিঃ❞ [ ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮ ] পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না ; তা অটুট , অচল অপরিবর্তনীয় ।
এমনকি এই মুহূর্তে আপনি যার সাথে ইচ্ছাকৃত অন্যায় করে নিজেকে জয়ী ভেবে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন , মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- সে হয়তো প্রতিবাদ করবেনা , কিন্তু তার নীরবতা , কষ্ট থেকে আসা ' দীর্ঘশ্বাস ' আপনার সাথে বোঝাপড়াটা সঠিক সময়ে করে নেবে , কারণ পরমাত্মা যথাযথ কর্ম ফল সবাইকে দেন কাউকে ঠকান না , তিনি কারোর একার নন তিনি সবার । ঈশ্বর কদাপি বৈষম্য বা পক্ষপাত করেন না ।
বৃহন্নেষামধিষ্ঠাতা অন্তিকাদিব পশ্যন্তি ।
য স্তায়ন্মন্যতে চরন্তসর্বঁ দেবা ইদম্ বিদুঃ ॥
অথর্ববেদ ৪.১৬.১
ভাবার্থ- সর্বশক্তিমান , অসীম পরমাত্মা জগতের নিয়ন্তা যিনি সমগ্র জগৎকে একদম নিকট থেকে অবলোকন করছেন , সর্বক্ষণ জাগ্রত তিনি জগতের সবকিছুই জানেন , দেখেন , অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করেন । এই রহস্য জ্ঞানী দৈব ঋষিগণ জ্ঞাত রয়েছেন ।
উতেয়ং ভূমির্বরুণস্য রাজ্ঞ উতাসৌ দৌরবৃহতী দুরেঅন্তা । উতৌ সমুদ্রো বরুণস্য কুক্ষী উতাস্মিন্নল্প উদকে নিলীনঃ ॥
অথর্ববেদ ৪.১৬.৩
ভাবার্থ- এই সমগ্র ভূমি সেই বরণীয় শাসকের রাজ্য , এই দ্যু ও অন্তরীক্ষলোক ও তার হতেও দূর থেকে দূরে যত কিছু আছে সব ই , এই সমুদ্র , এই মহাকাশ সব তার মধ্যেই স্থিত । তিনি সকল স্থানে ব্যপ্ত , সর্ববৃহৎ কোনো কিছুতে এবং সবচেয়ে ছোট কণাটিতেও তিনি লুকায়িত ।
নৈমিত্তিক জগতে আমরা পারিবারিক মায়ামোহে কিংবা তথাকথিত ভালোবাসা সহ অন্যান্য বিষয়াদিতে আকৃষ্ট হয়ে ভুলে যাই যে এজন্মই শেষ । ❝ ইন্দ্র মা ত্বা যজমানসো অন্যে নি রীরমন্ ❞ [ অথর্ববেদ ২০.৯৬.১ ] হে জিতেন্দ্রিয় মানব! তোমাকে যেন জাগতিক কামনা-বাসনা গ্রাস না করে । যার প্রসাদে আমরা এই দূর্লভ মানবজন্ম লাভ করেছি সেই প্রভুর নিত্য উপাসনা আমার করা উচিত । ❝ ত্বং হি নঃ পিতা বসো ত্বং মাতা ❞ [ ঋ০ ৮।৯৮।১১ ] পরমাত্মাই আমাদের নিত্য মাতা পিতা ও বন্ধু । জগতে আমি যখন একাকী কাউকে আমার পাশে পাবো না তখন এই পরমাত্মাই আমার হৃদয়ে স্থিত হয়ে পথ প্রদর্শন করেন । আর এই জগৎই তো প্রভুর । ওহে জীব ❝ তব শরীরং পতয়িষ্ণ্ব' ❞ [ ঋ০ ১।১৬৩।১১ ] তোমার শরীর তো শুকনো পাতার ন্যায় পতনশীল । তুমি এসেছ একা মৃত্যুকালে এই জগতের সব কিছু পেছনে রেখে চলে যাবে । একমাত্র ধর্মই তোমার সাথে যাবে । ❝ ভদ্রাদধি শ্রেয়ঃ প্রেহি । ❞ [ অথর্ববেদ ৭.৮.১ ] প্রেয় মার্গের থেকে শ্রেষ্ঠ ; শ্রেয় মার্গের দিকে এসো ।
ReplyDeleteGod is Knowledge. God is Everything.
Thanks for the post.