(অ) নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দাতা ভগবান্ মনু
বৈদিক ঐতিহ্যে ‘মা’কে প্রথম শিক্ষক হিসেবে সম্মান করা হয়েছে। মনু একই ঐতিহ্যের অন্তর্গত। মহর্ষি মনু হলেন পৃথিবীর প্রথম মহাপুরুষ, যিনি নারী সম্পর্কে এমন এক সর্বোত্তম আদর্শ ঘোষণা দিয়েছেন, যা নারীদের মর্যাদা, গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়। পৃথিবীর কোনো পুরুষ নারীকে এত অহংকার ও সমতা দেয়নি। মহর্ষি মনুর শ্লোক হল-
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥
[মনুস্মৃতি ৩।৫৬]
অর্থাৎ, যে সমাজ বা পরিবারে নারীদের সমানভাবে সম্মান করা হয়, সেখানে ভগবান অর্থাৎ ঐশ্বরিক গুণাবলী, ঐশ্বরিক সন্তান, দৈব উপকারিতা ইত্যাদি অর্জিত হয় এবং যেখানে তাদের সমানভাবে সম্মান করা হয় না, সেখানে যারা তাদের অসম্মান করে তাদের সমস্ত গৃহস্থালী কাজকর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়।
নারীদের প্রতি মনুর অনুভূতির উপলব্ধি দেয় যা, স্ত্রীদের জন্য প্রযুক্ত সম্মানজনক এবং সুন্দর বিশেষণ ছাড়া অন্য কোন প্রমাণ থাকতে পারে না। তারা বলেন যে, নারীরা ঘরের সৌভাগ্য নিয়ে আসে, সম্মানের যোগ্য, ঘরের আলো, ঘরের সৌন্দর্য, গৃহলক্ষ্মী, গৃহকর্ত্রী ও গৃহিণী, ঘরের স্বর্গ ও সংসার যাত্রার ভিত্তি-
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রীয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোঽস্তি কশ্চন ॥
[ মনুস্মৃতি ৯।২৬ ]
অর্থাৎ, যিনি সন্তান জন্ম দিয়ে ঘরের সৌভাগ্য সৃষ্টি করেন, যিনি সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তিনিই এখানে ঘরের আলো । শোভা, লক্ষ্মী আর স্ত্রীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তারাই ঘরের দৃশ্যমান সৌন্দর্য ।
(আ) স্ত্রীদের সম্মানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার –
‘লেডিস ফার্স্ট’-এর নীতির ভক্তদের এই পড়ে আরও খুশি হওয়া উচিত যে মহর্ষি মনু সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন -
❝ প্রথমের পথ ছেড়ে দিতে এবং নববধূ, কুমারী, অসুস্থ, গর্ভবতী, বৃদ্ধা নারী ইত্যাদিকে প্রথমে অন্ন প্রদানের পর স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে খেতে হবে। ❞
এখানে উল্লেখের ক্রম ও তালিকাটা স্নেহ ও গুরুত্ববাচক । পারস্পরিক তুলনা কিংবা শ্রেষ্ঠতাবাচক নয় । ভগবান মনু নারীদের পূজ্য আসন কিভাবে প্রদান করেছেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মনুস্মৃতিতে বিদ্যমান ।
মনুর এই সমস্ত বিধান তাদের প্রতি সম্মান এবং স্নেহের প্রকাশ । কয়েকটি শ্লোক দেখুন –
চক্রিণো দশমীস্থস্য রোগিণো ভারিণঃ স্ত্রিয়াঃ।
স্নাতকস্য চ রাজ্ঞশ্চ পন্থা দেয়ো বরস্য চ ॥
[ মনুস্মৃতি ২।১৩৮ ]
সুবাসিনীঃ কুমারাংশ্চ রোগিণী গর্ভিণীস্তথা।
অতিথিভ্যোঽগ্র এবৈতান্ ভোজায়েদবিচারয়ন্ ॥
[ মনুস্মৃতি ৩।১১৪]
অর্থাৎ, যানবাহনে আরূঢ় ব্যক্তি, নব্বই বছরের বেশী মানুষ, রোগী, ভারবহনকারী ক্লান্ত মানব, নারী, স্নাতক, রাজা এবং বিয়ে করতে বের হওয়া বর এদের আগে পথ ছেড়ে দিতে হবে ।
নব বিবাহিতা [ বধূ, পুত্রবধূ ও কন্যা ], বালক-বাকিকা, রোগী এবং গর্ভবতী স্ত্রীদের অতিথির আগে খাবার দিতে হবে ।
অতঃপর অতিথি ও ভৃত্যদের অন্ন প্রদানের পর দ্বিজ-দম্পতিরা নিজেরা খেতে হবে।এ ধরনের অনুষ্ঠানে সম্মান ও শিষ্টাচার প্রবর্তিত হয়। মনু নারীর প্রতি শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী 'সংস্কারবিধি' গ্রন্থের 'গৃহাশ্রমপ্রকরণম্ 'এ মহর্ষি মনুর আরো কিছু শ্লোক ব্যাখ্যা করেছেন -
যদি হি স্ত্রী ন রোচতে পুমাংসং ন প্রমোদয়ে।
অপ্রমোদাৎ পুনঃ পুংসঃ প্রজনং ন প্রবৰ্ত্ততে ॥
[ মনুস্মৃতি ৩।৬০-৬১ ]
অর্থাৎ, হে গৃহস্থ ! যে কুলে ভার্যাদ্বারা পতি প্রসন্ন থাকে এবং পতিদ্বারা ভার্যা প্রসন্না থাকে, সেই কুলে নিশ্চয়ই কল্যাণ হয় এবং যে কুলে উভয়ে পরস্পরের প্রতি অপ্রসন্ন থাকে, সেই কুলে নিত্য কলহ লাগিয়া থাকে । যদি স্ত্রী পুরুষের প্রতি রুচি না রাখে বা পুরুষকে হর্ষযুক্ত না করে, তবে অপ্রসন্নতা হেতু পুরুষের শরীরে কখনও কামোৎপত্তি হয় না এবং এজন্য সন্তানও জন্মে না, জন্মিলেও সে সন্তান দুষ্ট হয় ।
স্ত্রিয়ান্ত রোচমানায়াং সর্বং তদ্ রোচতে কুলম্।
তস্যাং ত্বরোচমানায়াং সর্বমেব ন রোচতে ॥
[ মনুস্মৃতি ৩।৬২ ]
অর্থাৎ, যদি পুরুষ স্ত্রীকে প্রসন্ন না করে, তবে সেই স্ত্রীর অপ্রন্নতা হেতু সমস্ত কুল অপ্রসন্ন ও শোকাতুর থাকে। যখন পুরুষদ্বারা স্ত্রী প্রসন্না থাকে, তখন সর্ব কুল আনন্দরূপে দৃষ্ট হয়।
পিতৃভিভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীভিঃ ॥ য়ত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ । য়ত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥ শোচন্তি জাময়ো য়ত্র বিনশ্যত্যাশু তৎ কুলম্ । ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা ॥ জাময়ো য়ানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ । তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্বতঃ॥
[ মনুস্মৃতি ৩।৫৫,৫৭-৫৮]
অর্থাৎ পিতা, ভ্রাতা পতি ও দেবরের পক্ষে যথাক্রমে স্বীয় কন্যা, ভগ্নী, স্ত্রী ও ভ্রাতৃবধূ আদি স্ত্রীকে সর্বদা পূজা করা উচিত অর্থাৎ যথাযোগ্য মধুর ভাষণ, ভোজন, বস্ত্র ও অলঙ্কারাদি দ্বারা প্রসন্ন রাখিবে। যাহারা কল্যাণ কামনা করে, তাহারা স্ত্রীদিগকে কখনও ক্লেশ দিবে না। যে কুলে নারীরা স্ব স্ব পতির বেশ্যাগমনে বা ব্যভিচারাদি দোষে শোকাতুর থাকে, সেই কুল শীঘ্র বিনাশ প্রাপ্ত হয় এবং যে কুলে নারীরা পতির সদ্ব্যবহারে প্রসন্না থাকে, সেই কুল সর্বদা উন্নতি লাভ করে। যে কুলে ও গৃহে নারীরা অপূজিত হইয়া অর্থাৎ সম্মানিত না হইয়া যে গৃহস্থকে শাপ প্রদান করে, সেই কুল ও গৃহস্থ, বিষপ্রয়োগে অনেকে যেরূপ এক সঙ্গে বিনষ্ট হয়, সেইরূপ চারিদিক হইতে নষ্ট হইয়া যায় ।
তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ ।
ভূতিকামৈনরৈনিত্যং সৎকারেষুৎসবেষু চ॥
[ মনুস্মৃতি ৩।৫৯ ]
অর্থাৎ এইজন্য ঐশ্বর্যকামী পুরুষদের পক্ষে উচিত যে, স্ত্রীদিগকে উৎসব ও শুভানুষ্ঠান উপলক্ষে অলঙ্কার, বস্ত্র ও পানাহারাদিদ্বারা সদা পূজা করবে অর্থাৎ সম্মানপূর্বক প্রসন্ন রাখবে ।