দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও বনবাস; ইতিহাসের নির্মোহ দৃষ্টিতে

Arindam
0



জীবন সংগ্রামের এই মহাযজ্ঞে জগৎ সর্বদাই হেসে বিদ্রুপ করে বলছে, "এখনও তোমার অগ্নিপরীক্ষা বাকী আছে।" 

জীবন পদে পদে আমাদের পরীক্ষা নেয়, নানারকম তার নাম ও রূপ। তাদের মাঝে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাখানিই নাকি দিয়েছিলেন মাতা সীতা, যাকে আজও আমরা অগ্নিপরীক্ষা নামে প্রবাদে, সাহিত্যে, গল্প ও আড্ডায় বলে থাকি। কিন্তু থমাস কার্লাইল নামের এক মনীষী একবার বলেছিলেন জনপ্রিয়তম মতগুলোই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মিথ্যা কথা। ভারতবর্ষের জনপ্রিয়তম তেমন ই একটা মত মাতা সীতা নাকি অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলেন নিজের শুদ্ধতা প্রমাণে। এই জনপ্রিয় গল্পও কি তবে তেমনই এক শ্রেষ্ঠ মিথ্যে? সে কথাই আজ আলোচনা করব।


শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতার জীবনীর প্রামাণ্য দুইটি উৎস হলো মহর্ষি বাল্মিকী রচিত বাল্মীকি রামায়ণ ও মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের বনপর্বের ২৭৫ হতে ২৯৩ নং অধ্যায় পর্যন্ত (ক্রিটিকাল ইডিশনের ২৫৮-২৭৫ নং অধ্যায়) যেটি রামোপাখ্যান নামে খ্যাত। এই দুটিই এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত শ্রী রামচন্দ্রের জীবনীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ও তুলনামূলকভাবে বিশুদ্ধ উৎস।


প্রাচীন ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য এটা যে তার কলেবর যত বড় হয় তাতে প্রক্ষেপণ তথা অনৈসর্গিকতা তত বৃদ্ধি পায়। তাই বাল্মীকি রামায়ণের সংক্ষিপ্তসার যেটি মহাভারতের ১৮ টি অধ্যায়ে রামোপাখ্যান নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেই ১৮ টি অধ্যায়ে প্রক্ষেপণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। তদুপরি রামায়ণ ইতিহাস হিসেবে প্রাচীনতর হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে বাল্মীকির রচিত রামায়ণ শ্রবণের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে লিপিবদ্ধ হয় মহাভারত লিপিবদ্ধ হবার পরবর্তী কালে। সুতরাং লিপিবদ্ধ হবার কালে উক্ত অংশে প্রচলিত প্রক্ষেপণের পরিমাণ এই দৃষ্টিকোণ থেকেও মহাভারতস্থিত রামোপাখ্যানে স্বল্পতর হবার কথা। যেমনটি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত, মূল বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধ কাণ্ডে তথা ৬ষ্ঠ কাণ্ডেই সমাপ্ত হয়েছে ঠিক তেমনি রামোপাখ্যানেও আমরা দেখতে পাই শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের মধ্য দিয়েই রামোপাখ্যানের সমাপ্তি ঘটে। এছাড়াও বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের ৭৪ নং অধ্যায়ে আমরা পাই হনুমান সেই শ্রীলংকা থেকে এক লাফে উড়ে নেপালস্থিত হিমালয় পর্বতমালায় যান এবং সেখান থেকে ঔষধি পর্বতকে তার গোড়া থেকে উপড়ে ফেলেন এবং গোটা সেই পর্বতকে হাতে নিয়ে একলাফে উড়ে আবার শ্রীলংকায় ফেরত আসেন। সেই ঔষধি পর্বতের ঔষধি বৃক্ষের ওষুধ সেবন করে মরণাপন্ন অবস্থা হতে ভ্রাতা লক্ষ্মণ আবার নবজীবন লাভ করেন। এই অতি অলৌকিক অবাস্তব কাহিনীর প্রকৃত যুক্তিসঙ্গত ইতিহাস পাওয়া যায় মহাভারতের রামোপাখ্যান পর্বে যেখানে ২৯০ নং অধ্যায়ের ৬ নং শ্লোকে আমরা দেখতে পাই বিশালবাহু সুগ্রীব তৌ লব্ধসংজ্ঞৌ বা নিকটবর্তী স্থানে প্রাপ্ত বিশল্য ঔষধি খাইয়ে অজ্ঞান লক্ষ্মণকে সুস্থ করে তুলেছিলেন-


বিশল্যৌ চাপি সুগ্রীবঃ ক্ষণেনৈতৌ চকার হ।

বিশল্যযা মহৌষধ্যা দিব্যমন্ত্রপ্রয়ুক্তয়া ॥

তৌ লব্ধসংজ্ঞো নৃবরৌ


একইভাবে আমরা রামোপাখ্যানের শেষাংশে অর্থাৎ যুদ্ধকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনায় মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা আদৌ আছে কিনা বা সেখানে কী আছে তা দেখব এবং সেই অংশটিকে বাল্মীকি রামায়ণে বর্ণিত মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা অংশটির সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখব আসলে সেখানে কী হয়েছিল, অলৌকিক অবাস্তব অগ্নিপরীক্ষার বাস্তব ইতিহাসটা কী।


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দেবতার মানবায়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন-


সাম্প্রদায়িক সংস্কারবশত অন্ধভাবে আমি কোন কথা বলচি নে । যখন থেকে আমি আমার জীবনের গভীরতম প্রয়োজনে আমার অন্তরতম প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যাকুলতার প্রেরণায় সাধনার পথে প্রবৃত্ত হলুম তখন থেকে আমার পক্ষে যা বাধা

তা বর্জন করতেই হয়েছে এবং যা অনুকূল তাই গ্রহণ করেছি। .....আমাদের দেশে দেবতা কেবলমাত্র মূর্তি নন, অর্থাৎ কেবল যে আমরা আমাদের ধ্যানকে বাইরে আকৃতি দিয়েছি তা নয়—তাঁরা জন্ম মৃত্যু বিবাহ সন্তান সম্ভতি ক্রোধ-দ্বেষ প্ৰভৃতি নানা ইতিহাসের দ্বারা অত্যন্ত আবদ্ধ ।



দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা, কবিগুরুর এ কথাটি যেন সংস্কৃত সাহিত্যে ফুটে উঠেছে বারেবারে। সংস্কৃত সাহিত্যে চরিত্রসমূহের দেবতায়ন তথা বেনামি অথচ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণিক চরিত্রসমূহকে দেবতারূপে দেখানো প্রচলিত একটি বিষয়। যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে কোন প্রাচীন অজানা বা বেনামি চরিত্রের  সাময়িক অবতারণা হয়েছে, তখন প্রচলিত দেবতা চরিত্র দিয়ে সেই বেনামি চরিত্রকে দেয়া হয়েছে পরিচয়। মূলত ক্লাসিকাল সংস্কৃত বিভাগের রচনাসমূহতে এই বিষয়টি বেশী দেখা যায়।


বাল্মিকী রামায়ণের লিখিত লিপিবদ্ধকরণকাল Vedic Sanskrit সময়কাল থেকে  Classical Sanskrit এর সময়কাল পর্যন্ত ব্যপ্ত ছিল, অধিকাংশ গবেষকদের মতে এর মূল অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতক থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক পর্যন্ত যেটি রামায়ণের মূল অংশের মগধ ও বৌদ্ধযুগ পূর্ববর্তী ভাষাগত গঠনে স্পষ্ট তাই সে অংশে Vedic Sanskrit এর ছাপ পাওয়া যায় । তবে এটিও ঠিক যে রামায়ণের লিপিটি সেই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং প্রায় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত এতে শ্লোকসমূহ যুক্ত করা হয়েছে, যুক্ত করা হয়েছে উত্তরকাণ্ড ও আদিকাণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেগুলে কিনা মূল রামায়ণের অংশ নয় এবং এই অংশগুলিতে পরবর্তীকালের Classical Sanskrit এর বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।


আর তাই ঠিক এই অংশগুলিতে বেনামি চরিত্রের দেবতায়ন বা নামহীন কোন চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্যামিওকে কোন দেবতার নামে নামাংকিত করার প্রবণতা আমরা দেখতে পাই। ক্লাসিকাল গ্রীক সাহিত্যেও এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্যণীয়। আর এই বিষয়টি মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষার পিছনের রহস্য জানার সাথে সম্পর্কিত। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে যে বাল্মীকি রামায়ণের লিপিবদ্ধকরণকাল আর শ্রীরামের সময়কাল এক নয়। শ্রীরামচন্দ্র এই লিপিবদ্ধকরণ সময়ের বহু পূর্ববর্তী ব্যক্তি ছিলেন যা হয়তো দুই সহস্রবছর বা তারও বেশী হতে পারে। তাঁর জীবনী পূর্বেই রামকথারূপে স্মৃতিপরম্পরায় মৌখিক কবিতাকারে গাঁথারূপে লোকসমাজে প্রচলিত ছিল। বৈদিক অনুষ্ঠানে তৎকালীনযুগে বীর ধর্মাত্মা মহাপুরুষদের আখ্যান নারাশংসী সূক্ত ও গাঁথার মূল বর্ণনীয় কাহিনীরূপে সর্বসমক্ষে পাঠ করার প্রচলন ছিল। আর এজন্যেই তৎকালীন সময়ে বৈদিক সভ্যতা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ তাঁরা পার্বণে মহাপুরুষদের জীবনদর্শন শ্রবণ করতেন এবং তা থেকে বীরত্বের ও জ্ঞানের শিক্ষা নিতেন, আজকের হিন্দুদের মতো মহোৎসবে নাচগানে আর প্রসাদ খাওয়ায় মত্ত থাকতেন না।


আমরা ইতিমধ্যেই দেখলাম যে মৌখিকভাবে ও ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে বাল্মীকির রামায়ণ মহাভারতের তুলনায় অনেক প্রাচীনতর হলেও এর অনেক অংশই খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকে রচিত। অপরদিকে মহাভারতের রামোপাখ্যান পর্ব যার কথা উপরেই আলোচিত সেটির রচনাকাল তুলনামূলকভাবে রামায়ণের অগ্নিপরীক্ষা অংশের তুলনায় প্রাচীনতর বলেই BORI এর বিশেষজ্ঞগণ এটিকে শুদ্ধপাঠ হিসেবে নিয়েছেন। এছাড়াও আগেই বলেছি যে সারাংশপাঠে(মহাভারতের রামোপাখ্যান) বিকৃতির বা প্রক্ষেপণের সুযোগ কম মূল ও বিস্তৃতপাঠের(সম্পূর্ণ রামায়ণ) তুলনায়। এজন্যেই এক্ষেত্রে রামোপাখ্যানের আখ্যান অধিকতর গ্রহণীয়।


এখন আমরা প্রথমেই দেখব বাল্মিকী রামায়ণে আসলে অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে কী বলা হয়েছে।


বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের ১১৫ থেকে ১১৮ নং সর্গকে মূলত অগ্নিপরীক্ষার প্রেক্ষাপট, সংঘটন ও অন্ত বলে ধরে নেয়া যায়। এখানে বলা হচ্ছে যুদ্ধজয় শেষে যখন মাতা সীতাকে শ্রীরামের সামনে নিয়ে আসা হয় তখন শ্রীরাম লোকলজ্জার কথা চিন্তা করে স্ত্রীর বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। এতে মাতা সীতা অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং বলেন-


যথা মে হৃদয়ং নিত্যং নাপসর্পতি রাঘবান্।

তথা লোকস্য সাক্ষী মাং সর্বত পাতু পাবকঃ।।

( বাল্মিকী রামায়ণ, ৬.১১৬.২৫)


অনুবাদ- যেহেতু আমার হৃদয় কদাপি কখনও রাঘব(শ্রীরাম) হতে বিচ্যুত হয়নি, তাই লোকসকল সাক্ষী থাকুক পাবক( অগ্নি) আমায় সর্বদিক থেকে রক্ষা করবে।


এই বলে তিনি আগুনে ঝাঁপ দিতে গেলেন। মাতা সীতার এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্তে চারপাশের সকলের বিপুল হায় হায় রব উঠল, হাহেতি বিপুলা স্বনঃ।


শ্রীরামের চোখ জলপূর্ণ হয়ে উঠল-


ততো হি দুর্মনা রামঃ শ্রুত্বৈবম্ বেদনাং গিরঃ।

দধ্যৌ মুহুর্তম্ ধর্মাত্মা বাষ্পব্যাকুললোচন।।

( বাল্মীকি রামায়ণ ৬.১১৭.১)


বেদনা জর্জরিত মহাত্মা শ্রীরামের দুঃখভরাক্রান্ত মন সেই হা হায় রব শুনে সে মুহুর্তে কষ্টচিন্তায় পরিপূর্ণ হলো, তাঁর চোখ দুটো জলপূর্ণ হয়ে উঠল।


অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে লোকনিন্দার সংশয়ের কারণে শ্রীরাম এই কথা বললেও তিনি নিজেও এর সমর্থন করতেন না। এটি স্পষ্ট হয় কিছু শ্লোক পরে তাঁর নিজের কথাতেই-


অনন্যহৃদয়াং ভক্তাং মচিত্তপরিবর্তিনীম্।

অহমপ্যবগচ্ছামি মৈথিলীল জনকাত্মজাম্।।

( বাল্মীকি রামায়ণ, ৬.১১৯.১৫)


অনুবাদ- আমি নিজেও জানি আমার চিত্তকে যে জনককন্যা মৈথিলী আবর্তন করে সে সর্বসময়ে আমার প্রতি অনন্য ভক্তিতে স্থিত ছিল।


প্রত্যযার্থ তু লোকানাং ত্রয়াণাম্ সত্যসংশ্রয়ঃ।

উপেক্ষে চাপি বৈদেহীং প্রবিশন্তীং হুতাশনম্।।

( বাল্মিকী রামায়ণ ৬.১১৯.১৭)

অনুবাদ- কিন্তু জগতের সকলের কাছে তা প্রমাণ করার জন্যই আমি সব জেনেও মৈথিলী অগ্নিতে প্রবেশ করবেন বলার পরেও তাকে উপেক্ষা করেছি।


অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের মনে কখনোই সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, তিনি অগ্নিপরীক্ষা চানও নি। 


এখন আবার পূর্বের অংশে ফিরে যাই। মাতা সীতা আগুনে ঝাঁপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই নাটকীয় অংশে


আর বাল্মীকি রামায়ণের এ পর্যায়েই পাণ্ডুলিপিটি খ্রিষ্টপূর্বীয় তৃতীয় শতক পরবর্তী বৈষ্ণবীয় গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। হঠাৎ করেই গ্রন্থের নরোত্তম রামকে গদগদ ভক্তিভরে ভগবান হিসেবে আবির্ভূত করা হয়, স্বর্গ থেকে হঠাৎ সব দেবতা নেমে আসেন, বিষ্ণুর মহিমা কীর্তন করতে থাকেন। শ্রীরামকে প্রথমবারের মতো জগতের কর্তা, সংহারকারী নামে পরিচিত করিয়ে দেয়া হয় যে শ্রীরাম এতক্ষণ পর্যন্ত ছিলেন একজন যুবরাজ, শ্রেষ্ঠ মানব। অষ্টবসু, একাদশ রূদ্রের সাথে তুলনা আসে, বৈষ্ণবীয় পরম্পরার নারায়ণের নাম আসে, বরাহ অবতার হিসেবে শ্রীরামকে সম্বোধন করানো হয় দেবতাদের মুখ দিয়ে। তাঁকে বলানো হয় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গী হিসেবে, দৈত্য মধুর বধকারী হিসেবে, বৈষ্ণব সাহিত্যের অপর বৈশিষ্ট্য গান্ধর্বদের গানের কথা আনা হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের এ পর্যায়ে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের বৈষ্ণবীয়করণ, নতুন বৈষ্ণবীয় গ্রন্থের রচনা এবং নতুন একটি সম্প্রদায়ের ক্রম আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠাকে ইতিহাসে পঞ্চরাত্র বিপ্লব বলা হয় যাতে বিষ্ণুকে কেন্দ্রীয় দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। গবেষকদের ধারণা এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নারায়ণ নামের একজন ঋষি পাঁচরাত্রি ধরে করা কঠোর তপস্যা করে দিব্যতা প্রাপ্ত হন এই বিশ্বাস থেকে এবং তিনিই এর প্রবর্তক যিনি নিজেই পরবর্তীতে বিষ্ণুর সাথে একীভূত হন। অপরদিকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে মথুরায় আবির্ভাব ঘটে ভাগবত সম্প্রদায় নামক আরেকটি শাখার যেখানে বৃষ্ণি নায়ক শ্রীকৃষ্ণকেই সর্বোচ্চ ভগবান হিসেবে মান্য করা হয়। পরবর্তীতে অনেকাংশেই এই দুটি সম্প্রদায়ের একীভূতকরণ ঘটে।


বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এই আবির্ভাবের ইতিহাস এই লেখাটির আলোচ্য বিষয় নয়। তাই কেবল এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে গবেষকরা রামায়ণে শ্রীরামের পরিচয়কে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন। একটি ভাগ মূল রামায়ণ যেখানে বাল্মিকী শ্রেষ্ঠ মহামানবের, সর্বগুণান্বিত নরোত্তমের জীবনী চিত্রিত করেছেন। অপর ভাগটি পরবর্তীকালে সংযুক্ত বৈষ্ণবীয় ভাবধারার কবিদের লেখা অংশসমূহ বিশেষ করে আদিকাণ্ডের অধিকাংশ ও উত্তরকাণ্ড সম্পূর্ণ ও অন্যান্য কাণ্ডগুলোর ক্ষুদ্রাংশ যেখানে শ্রীরামকে ভগবান বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অবতার হিসেবে চিত্রিত করবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। শ্রীরামের এই Apotheosis তথা দেবতায়ন হতে কত শতক সময় লেগেছে সেই কথা অন্য প্রসঙ্গ।


মোটামুটি সকল মতাদর্শের গবেষক ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদেরাই একমত যে বাল্মিকী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের এক প্রতিভূ, এই ঐতিহাসিক মহাকাব্যটিতে পরবর্তীকালে লেখনী যোগ করে তাঁকে অবতারে পরিণত করা হয়েছে। এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে গবেষকগণ অনেক বইও রচনা করেছেন। তার মধ্যে University of Edinburgh এর এমেরিটাস অধ্যাপক Dr. John Brockington এর লেখা Righteous Rāma: The Evolution of an Epic এর উদাহরণ ই তুলে ধরছি।


Dr. Brockington লিখেছেন বাল্মিকীর রচিত রামায়ণ মৌখিক হতে লিখিত গ্রন্থে রূপান্তরিত হয়েছে ৫ টি ধাপে।

সবচেয়ে প্রাচীন ধাপ তথা ১ম স্তরে রামায়ণের সেই অংশগুলো যেখানে শ্রীরামের গৌরব ও বীরত্বগাঁথা বর্ণিত হয়েছে, রাময়ণের সেই অংশটুকুর ভাষা ও সমাজবর্ণনা বৈদিক সময়কার কাছাকাছি, পৌরাণিক যুগের নয়। এই সময়কাল মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম ধাপ। খ্রিষ্টীয় ১ম- ৩য় শতকে রামায়ণের ৩য় স্তর রচিত হয় এবং সে সময়ে ভারতীয় সমাজে বিষ্ণু ও শিব আলাদাভাবে প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং রামায়ণেও তাই এই সম্পর্কিত শ্লোক প্রবেশ করানো হতে থাকে এই পর্যায়ে। এই সময়েই আদি বাল্মীকি রামায়ণে ১ম ও ৭ম কাণ্ড অর্থাৎ বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড প্রবেশ করানো হয়। ৪র্থ ও ৫ম স্তরে রামায়ণে সম্পূর্ণরূপে পৌরাণিক সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে এবং ১ম স্তরে যে রামচন্দ্রকে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছিল তাঁকে এই দুইটি স্তরে লেখা শ্লোকসমূহের মাধ্যমে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দেখানো হয়। এ পর্যায়ে রামায়ণে তীর্থ, ভক্তি, মন্দির ইত্যাদি তত্ত্বসমূহের আবির্ভাব ঘটে।






প্রখ্যাত রামায়ণ গবেষণক বেলজিয়ান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ Camili Bulcke তার রামকথা কা উৎপত্তি ও বিকাশ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগের সপ্তম অধ্যায়ের ১২২-১২৫ পৃষ্ঠায়

রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত বা নকল অংশকে মূল ৩ টি শিরোনামে ভাগ করেছেন, সেগুলো হলো- বালকাণ্ড, উত্তরকাণ্ড ও অবতারবাদ।




Bulcke ও এস্থলে BORI এর ন্যায় মহাভারতের রামোপাখ্যান পর্বকে ৪র্থ ও ৫ম স্তরের এসব শ্লোক থেকে প্রাচীনতর মেনেছেন এবং মহাভারতের সেই অংশের সাথে এর তুলনা করে এসবের প্রক্ষিপ্ততা নির্ণয় করেছেন।


মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। মাতা সীতা অগ্নিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ অবস্থা দেখে স্বর্গ থেকে সব দেবতারা নেমে আসলেন। তাঁরা শ্রীরামকে বিষ্ণু বলে ভূয়সী প্রশংসা ও স্তুতি করলেন, তাঁর গুণকথা বর্ণনা করলেন, অর্থাৎ দেখতেই পাচ্ছেন রামায়ণে প্রবেশ করানো ৪র্থ ও ৫ম স্তরের এই শ্লোকগুলোতে সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় পুরাণসমূহের কায়দায় বিষ্ণুস্তব করা হচ্ছে এবং শ্রীরাম নরচন্দ্রমা থেকে হয়ে উঠেছেন বিষ্ণুর অবতার। এই অধ্যায়ে এমনকি মাতা সীতাকেও বলা হচ্ছে লক্ষ্মীর অবতার একদম আধুনিক বৈষ্ণবীয় সাহিত্যের রাধাকৃষ্ণের মতো (বাল্মীকি, ৬.১২০)। রামায়ণের আর দ্বিতীয় কোনস্থানে মাতা সীতাকে এই উপাধি দেয়া হয়নি।


৬.১১৯.৩৩ নং শ্লোকে আমরা দেখতে পাই মহাভাগং প্রবিশন্তী হুতাশনম্ সীতাংকমত, মহান সীতা আগুনে প্রবেশ করলেন। এই দৃশ্য দেখে সকল দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে আসলেন। এরপর সেই জ্বলন্ত আগুনে

বৈদেহীংহব্যবাহনঃ উত্তস্থৌমূর্তিমানঃ অর্থাৎ অগ্নিদেব নিজে মূর্তিমান হয়ে সম্পূর্ণ অক্ষত বৈদেহীকে জ্বলন্ত অগ্নি হতে বহন করে নিয়ে আসলেন। তখন দেবতারা সকলে শ্রীরামকে বুঝাতে লাগলেন যে সীতা পাপহীন, পবিত্র, তাকে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।


তখন শ্রীরামচন্দ্র বললেন-

অনন্যহৃদয়াংভক্তাংমচ্চিত্তপরিবর্তিনীম্ ৷

অহমপ্যবগচ্ছামিমৈথিলীংজনকাত্মজাম্ ৷৷


আমি নিজেও জানি মৈথিলীর কোন পাপ নেই, তার হৃদয়ে আমি ব্যতিত আর কেউ নেই। 

প্রত্যযার্থংতুলোকানাংত্রযাণাং, সমস্ত জগৎকে সীতার পবিত্রতা বুঝানোর জন্যই আমি এমনটা করেছি।


অর্থাৎ রামচন্দ্র নিজেও মাতা সীতাকে নিয়ে সন্দেহ করেন নি, এই কথাগুলো তিনি বলেছেন যাতে আর কেউও উনাকে নিয়ে সন্দেহ না করতে পারে, সমাজের সন্দেহের ভয়ে তিনি এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেন যার প্রমাণ আমরা ১১৮ নং সর্গেও পাই-


পশ্যতস্তাংতুরামস্যসমীপেহৃদয়প্রিয়াম্ ৷

জনবাদভযাদ্রাজ্ঞোবভূবহৃদযংদ্বিধা ৷৷


হৃদয়ের প্রিয় সীতাকে কাছে দেখেও শ্রীরাম জনগণের সন্দেহের ভয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন।



কিন্তু মহাভারতের রামোপাখ্যান পর্বে আমরা দেখতে পাই ঘটনা অন্য। সেখানে মাতা সীতার আগুনে ঝাঁপ দেয়ার কোন কথা ই নেই। বরং সেখানে শ্রীরামের সন্দেহের কথা শুনে-



ততঃ সা সহসা বালা তচ্ছ্রুৎবা দারুণং বচঃ।

পপাত দেবী ব্যথিতা নিকৃত্তা কদলী যথা।।

( মহাভারত, ৩.২৭৫.১৪)

এই নিদারুণ কথা শুনে সীতাদেবী ব্যথিত হয়ে ভূপতিত হয়ে পড়লেন।


এরপর জ্ঞান ফিরলে তিনি বললেন-

রাজপুত্র ন তে কোপং করোমি বিদিতাহি মে।

গতিঃ স্ত্রীণাং নরাণাং চ শৃণু চদং বচো মম ॥ 

অন্তশ্চরতিভূতানাং মাতরিশ্বা সদাগতিঃ।

স মে বিমুঞ্চতু প্রাণান্যদি পাপং চরাম্যহম্ ॥


হে রাজপুত্র আমি তোমার কোন দোষ দিইনা কারণ তুমি স্ত্রীপুরুষ সকলের সাথেই সমদৃষ্টিতে সুব্যবহারে প্রশিক্ষিত। কিন্তু শুনে রাখ আমার এই কথা। প্রতি প্রাণীর অন্তরেই বায়ুদেব বিদ্যমান। আমি যদি পাপ করে থাকি তবে বায়ুদেব আমার প্রাণবায়ু নিয়ে নিক।


অর্থাৎ আলংকারিকভাবে বলা হচ্ছে প্রাণবায়ু ও বিবেকের কথা। তার বিবেক যদি আসলেই কলুষিত হয় তবে তার প্রাণবায়ু চলে যাক। এবং তিনি অন্যান্য পঞ্চভূতের কথাও বললেন-


অগ্নিরাপস্তথাঽঽকাশং পৃথিবী বায়ুরেব চ।

বিমুঞ্চন্তু মম প্রাণান্যদি পাপং চরাম্যহম্।।


বায়ুর সাথে সাথে অগ্নি, আকাশ, ভূমি ও জলও আমার প্রাণ নিয়ে নিক যদি আমি পাপ করে থাকি।


তখন পঞ্চভূতের রূপক এই দেবতারা সেখানে আসলেন, বিবেক তথা প্রাণবায়ুরূপী দেবতা বায়ু শ্রীরামচন্দ্রকে নিশ্চিত করলেন মাতা সীতা পাপহীন, পবিত্র। 


বোভো রাঘব সত্যং বৈ বায়ুরস্মি সদাগতিঃ।

অপাপা মৈথিলী রাজন্সংগচ্ছসহভার্যযা ॥

( মহাভারত ৩.২৭৫.২৭)


অন্যরাও একই কথা বললেন-

নাত্রশংকা ত্বয়া কার্যা


অর্থাৎ রামোপাখ্যানে আমরা দেখতে পাই মাতা সীতার কোন অগ্নিপরীক্ষা হয়নি। শ্রীরামচন্দ্র আগে থেকেই জানতেন মাতা সীতা নিষ্পাপ, হরণকালেও কখনও মাতা সীতার হৃদয় হতে শ্রীরামচন্দ্র বিচ্যুত হননি। সমাজকে বুঝাতে গিয়েই তিনি এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন এবং তখন বিবেকরূপী বায়ু সেই শংকার সমাধান করেন। 


Camile Bulcke তার বইয়ের নবম অধ্যায়, ৫২৮ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন-


সীতার অগ্নিপরীক্ষা যে প্রক্ষিপ্ত তা নিয়ে সন্দেহ নেই বললেই চলে।

 



আরও বলেছেন যেখানে কয়েকটি শ্লোক আগেও দেখা গেল শ্রীরাম এতদিন পর মাতা সীতাকে ফিরে পেয়ে খুবই আনন্দিত, অশ্রসজল সেখানে হঠাৎ করে তাঁর মন পরিবর্তন হয়ে গেল এটা খুবই অস্বাভাবিক। সীতাহরণের পর রামায়ণে বারবার শ্রীরামচন্দ্রের বিরহ দেখা গেছে সেখানে হঠাৎ মুহুর্তের মধ্যে এখানে লেখা হয়েছে মাতা সীতাকে নিয়ে শ্রীরামের কোন আগ্রহই নেই! এই যুদ্ধকাণ্ডের ৫ম সর্গের ৪র্থ শ্লোকে শ্রীরাম বলছেন-


শোকশ্চকিলকালেনগচ্ছতাহ্যপগচ্ছতি ৷

মমচাপশ্যতঃকান্তামহন্যহনিবর্ধতে ৷৷

যত কাল যায় তত শোক কমে, কিন্তু যতই কাল যাচ্ছে আমার প্রিয় সীতাকে না দেখার শোক আমার ততই বর্ধিত হচ্ছে।


সেখানে হঠাৎ অগ্নিপরীক্ষার সময় শ্রীরামকে দিয়ে নকল শ্লোকে বলানো হচ্ছে-


তদ্গচ্ছত্বানুজানেদ্যযথেষ্টংজনকাত্মজে ৷

এতাদশদিশোভদ্রেকার্যমস্তি ন মেত্বযা ৷৷


হে সীতা তোমাকে উদ্ধার করা শেষ হয়েছে, এখন তুমি যেখানে খুশি চলে যেতে পার। তোমার সাথে আমার আর কোন কাজ নেই!


অর্থাৎ কয়েকটি শ্লোক আগেও যে সীতার জন্য শ্রীরামের বিরহের শেষ নেই, মাতা সীতাকে এতদিন পর দেখে শ্রীরাম আনন্দে উদ্বেলিত হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই একদম পুরো ঘটনা উলটে গেল!  Camile Bulcke এই ঘটনাকে স্পষ্ট প্রক্ষিপ্ততা হিসেবে দেখিয়ে আরেকটি প্রমাণ দিয়েছেন যে অগ্নিপরীক্ষার প্রায় পুরো অধ্যায়টিই নকল বা পরবর্তীকালের রচিত।


উপরোক্ত একই কারণে Baroda Oriental Research Institute ও তাদের ব্যাখ্যায় এই অগ্নিপরীক্ষাকে পরবর্তীকালের কল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।






অর্থাৎ এই বিশদ আলোচনা হতে আমরা যা দেখতে পেলাম তা সংক্ষিপ্ত আকারে বললে এমনটা দাঁড়ায়-


  • রামায়ণের আদি বা বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড মূল রামায়ণের অংশ নয়।
  • মহাভারতের অরণ্যপর্বের অন্তর্গত রামোপাখ্যান পর্ব বাল্মীকি রামায়ণের অগ্নিপরীক্ষা অংশ হতে প্রাচীনতর রচনা।
  • সেই প্রাচীনতর রামোপাখ্যান পর্ব হতে আমরা দেখতে পাই মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা বলতে কিছু হয়নি, সবটাই পরবর্তীকালের রামায়ণের ৪র্থ ও ৫ম স্তরে রচিত শ্লোকের পৌরাণিক তথা বৈষ্ণবীয় কবিকল্পনা।
  • শ্রীরাম কখনোই মাতা সীতার বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন না, তিনি কেবল জনগণকে বুঝাতে ও বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন মাতা সীতা নিষ্পাপ। কারণ এত সহস্র বছর আগের সমাজের চিন্তাভাবনা আজকের ন্যায় এতটা অগ্রসর ছিলনা।গবেষকগণ মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা যে প্রক্ষিপ্ত তা নিয়ে একমত।
  • যেহেতু বিশেষজ্ঞগণ এটা নিয়েও একমত যে উত্তরকাণ্ডও রামায়ণের অংশ নয়, পরবর্তীকালের রচনা এবং মাতা সীতার বনবাস উত্তরকাণ্ডের অংশ, সেহেতু এটাও প্রমাণিত হয় যে এই বনবাসও পরবর্তীকালের কবিকল্পনা, প্রকৃত ইতিহাস নয়।


তাই এ বিষয়টি দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা যায় যে মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও বনবাস কেবলই কবিকল্পনা, ইতিহাসের দৃষ্টিতে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই।


ও৩ম্ শান্তি শান্তি শান্তি


তথ্যসূত্র-

১) বাল্মিকী রামায়ণ

২) রামকথা কি উৎপত্তি অউর বিকাশ- Camile Bulcke

৩) Righteous Rama; The evolution of an epic by J L Brockington

৪) Critical Edition of Ramayana by Baroda Oriental Research Institute; Dr P L Vaidya

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)