দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫



দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ -ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার বিষ্ময়

সত্যান্বেষী
0

 


প্রাচীন ভারত ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের লীলাভূমি৷ এখানেই বসে প্রাচীন মুনি ঋষিরা বিভিন্ন শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। সেই সব শাস্ত্র হতে এখনো বিজ্ঞানের বিবিধ বিষ্ময়কর বিষয়ের ধারণা পাওয়া যায়৷ তেমনই একটি বিষয় নিয়ে আজকে আলোচনা করা হবে৷ সেটি হলো "দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ"দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ শব্দটি দ্বারা এমন মানুষকে বোঝায়, যিনি সহস্র চন্দ্র দর্শন করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর তো চন্দ্র একটি৷ তাহলে পৃথিবী হতে কিভাবে সহস্র দর্শন করা সম্ভব ? তাই এই শব্দটি দিয়ে মূলত সহস্রটি পৃথক চন্দ্রকে দর্শন করা বোঝায় না, বরং একটি চন্দ্রকেই পূর্ণরূপে সহস্রবার দর্শন করা বোঝায় ৷ 

 
চন্দ্রে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়৷ প্রতি পূর্ণিমায় চন্দ্রকে পূর্ণরূপে দেখতে পাওয়া যায়৷ দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ–এর সহস্র চন্দ্র দিয়ে মূলত এই সহস্রবার পূর্ণিমার চন্দ্রকেই নির্দেশ করে। অর্থাৎ দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ হলো এমন এক ব্যক্তি যিনি সহস্র পূর্ণিমার চাঁদ দর্শন করেছেন ৷ এখন একজন ব্যক্তির দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ হতে গেলে বা সহস্র পূর্ণিমা দেখতে গেলে কত সময় লাগবে ? এই সময়েরই হিসেব পাওয়া যায় আমার প্রাচীন ভারতের বেদাঙ্গের অর্ন্তগত কল্পশাস্ত্রের বৈখানস গৃহ্যসূত্র নামক গ্রন্থে। এই গৃহ্যসূত্রের ৩য় প্রশ্নের ২১তম খণ্ডের ৫ম সূত্রে বলা হয়েছে–
 
❝তদেবং বর্তমানস্য যদ্যষ্টমাসাধিকাশীতিবর্ষাণি রবিবর্ষেণাধিকান্যধিগচ্ছেয়ুঃ স দৃষ্টসহস্রচন্দ্রো ভবতি৷❞
(বৈখানস গৃহ্যসূত্র– ৩।২১।৫)
অর্থাৎ সৌরবর্ষের আশি বর্ষ এবং আট মাস অধিক অতিক্রান্ত হলে যে ব্যক্তি বর্তমান থাকেন, তিনি সহস্র চন্দ্র দর্শন করেন৷
 
এই সূত্রানুসারে, সৌরবর্ষের হিসেবে যদি কোনো ব্যক্তির বয়স ৮০ বছর ৮ মাস হয়, তবে তিনি ১০০০ পূর্ণিমা দেখতে পাবেন৷ অর্থাৎ এই বয়সে তিনি দৃষ্টসহস্রচন্দ্রঃ হবেন। 
 
এবার আসা যাক আধুনিক হিসেবের দিকে৷ আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে৷ আবার চাঁদ ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে৷ মজার ব্যাপার হলো, সূর্যও স্থির নয়। সূর্যও ছায়াপথে গতিশীল।
এখন, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে = ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪০ মিনিট (প্রায়) = ২৭.৩২ দিন (প্রায়)।
 
কিন্তু এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময় ২৭.৩২ দিনের বেশি লাগে। কারণ চাঁদ যেমন গতিশীল, তেমনি পৃথিবী ও সূর্যও গতিশীল৷ আর পূর্ণিমা হতে হলে চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যকে একই সরল রেখায় অবস্থান করতে হয়৷ (বৈদিক শাস্ত্রে পূর্ণিমা ও অমাবস্যা হওয়ার প্রকৃত কারণ জানুন– 
 
 
 
পৃথিবী ও সূর্যের গতির কারণে চাঁদ একবার পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করলেও পূর্ণিমা হতে এর চেয়ে কিছুটা বেশি সময় লাগে৷ 
 
তাই হিসেব অনুসারে, এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময় লাগে = ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট = ২৯.৫৩ দিন (প্রায়)।
তাহলে ১০০০ পূর্ণিমা হতে সময় লাগে = ২৯.৫৩ × ১০০০ = ২৯৫৩০ দিন।
এদিকে আবার, ১ সৌর বর্ষ = ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড = ৩৬৫.২৪ দিন (প্রায়)।
অর্থাৎ, ১০০০ পূর্ণিমা হতে সৌরবর্ষে সময় লাগে = ২৯৫৩০ ÷ ৩৬৫.২৪ = ৮০.৮৫ বছর (প্রায়) = ৮০ বছর ১০ মাস (প্রায়)।
 
অপর দিকে, বৈখানস গৃহ্যসূত্রানুসারে, একজন মানুষের ১০০০টি পূর্ণিমা দেখতে সময় লাগে ৮০ বছর ৮ মাস৷ অর্থাৎ সূত্রের হিসেব ও আধুনিক হিসেবের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র ২ মাস! 
 
বৈখানস গৃহ্যসূত্রের মতো সূত্রগ্রন্থ লিখিত হয়েছে আজ থেকে সহস্র সহস্র বছর আগে ৷ ভাবতেও আশ্চর্য লাগে, সেই প্রাচীন সময়ে কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই মাত্র ০.২% হিসেবের ত্রুটি নিয়ে কত বিষ্ময়করভাবে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা এসব জ্যোতির্বিদ্যার গাণিতিক হিসেবগুলো করেছিলেন !

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)