দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







[হুদুর দুর্গা প্রসঙ্গ] অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি ❓

সত্যান্বেষী
0

 


- উৎসব চৌধুরী

'প্রহর' অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত।।
প্রধান উপদেষ্টা: অধ্যাপক অর্জুনদেব সেনশর্মা।।
২০১১ সালের ৫ অক্টোবর, পুরুলিয়ার গ্রাম্য অঞ্চলে একদল যুবক প্রথম শুরু করলেন মহিষাসুর-পূজা। তাঁদের প্রচারে, সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত কিংবদন্তীর নায়ক 'হুদুড়-দুর্গা' একীভূত হলেন মহিষাসুরের সঙ্গে, বলা হল- আর্য আগ্রাসনের সময় তাঁদের প্রেরিত ছলনাময়ী দেহোপজীবিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন এই হুদুড়-দুর্গা। খুব তাড়াতাড়ি, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দুর্গোৎসবের এই Counter Culture ছড়িয়ে পড়ল দেশ জুড়ে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে তাল মেলালেন সুষমা অসুর, যিনি 'অসুর' উপজাতির প্রতিনিধি। এই অসুর-ইস্যুটিকে কিছুদিন আগেই, মহালয়াতে, বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী কবীর সুমন মহাশয় সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, "হে আমার বীর, আমি তোমার অনুগত।" তাঁর এই মন্তব্য স্বাভাবিকভাবেই নেটিজেন দুনিয়াতে বিপুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাই, এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের অবতারণা।
কিন্তু কী ছিল, অসুর-পূজায় এই উদ্যোগের কারণ? আয়নানগর পত্রিকায় ২০১৭ সালের ২০ মে প্রকাশ পেল খেরোয়াল গোষ্ঠীভুক্ত সাঁওতাল বুদ্ধিজীবী অজিত প্রসাদ হেমব্রমের একটি সাক্ষাৎকার, যিনি ছিলেন এই অনুষ্ঠানের এক মূল উদ্যোক্তা। সেই সাক্ষাতকার খুঁটিয়ে পড়লেই জানা যাবে, অসুর-পূজার এই কার্যক্রমের প্রকৃত রহস্যের ইতিবৃত্ত।
 
হেমব্রম দাবি করেছেন, অসুর-পূজা প্রকৃতপক্ষে সাঁওতাল গোষ্ঠীর বীর নায়ক 'হুদুড়-দুর্গা'র স্মরণে শহীদ দিবস। তিনি সিধু, কানু, বীরসা মুণ্ডার সঙ্গে এক পংক্তিতে রাখতে চান হুদুড়-দুর্গাকে। কিন্তু, হুদুড় এক কিংবদন্তীর চরিত্র মাত্র, তাঁর ঐতিহাসিকতার কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। তাই সিধু-কানু-বীরসার সঙ্গে এক পংক্তিতে তাঁকে রাখা কতখানি যুক্তিযুক্ত, সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া 'সাঁওতাল' আর 'অসুর' দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী। এক গোষ্ঠীর মিথ অন্য গোষ্ঠীর মিথের সঙ্গে অবাধে মিশিয়ে ফেলা কতখানি গ্রহণযোগ্য, প্রশ্ন ওঠে সেখানেও। আসুন, এবার হেমব্রমের বলা কাহিনীটি নিয়ে একটু আলোচনা করি।
হেমব্রম বলেছেন, হুদুড়-দুর্গার বাসস্থান ছিল 'চাইচম্পা' নামক এক স্থানে। সেখানেই তিনি তাঁর খলস্বভাবা আর্যপত্নীর হাতে নিহত হন। "Whichever form this story may be narrated, the marriage is always mentioned in it."- বলেছেন হেমব্রম। অথচ, বহু শতাব্দী ধরে মহিষাসুরের বাসভূমি এবং দুর্গার হাতে তাঁর নিহত হবার স্থান হিসাবে খ্যাত যে নগরটি, তা হল কর্ণাটকের মহীশূর। সেখানে, অসুররাজের বধ্যভূমিতে রয়েছে মহিষাসুর-হন্ত্রী দেবী 'চামুণ্ডেশ্বরী'-র মন্দির। 'চাইচম্পা'-র কোনও উল্লেখ সেখানকার কোনও কাহিনীতে আছে বলে জানা যায় না। মহিষাসুরের বিধবা পত্নী হরিহরপুত্র আয়াপ্পানের হাতে নিহত হয়েছিলেন, এই মিথ কেরালায় প্রচলিত বহু শতক ধরে। অর্থাৎ মহিষাসুর ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের বাসভূমি দক্ষিণভারতে থাকার ইঙ্গিতই মিলছে, পূর্ব ভারতে কদাচ নয়।
 
আর, দুর্গা ও অসুরের বিবাহ? বামনপুরাণে দেখা যাচ্ছে, দেবী দুর্গার রূপে কামোন্মত্ত মহিষাসুর দেবীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলপ্রয়োগে তাঁকে অধিকার করতে এসে সসৈন্যে নিহত হয়। অন্যান্য পুরাণে ও উপপুরাণেও কাহিনীটি এরকমই- কোথাও দুর্গা ও মহিষের বিবাহের কোনও প্রসঙ্গ নেই। আরও স্মর্তব্য, মহিষ-বধের প্রতিটি কাহিনীতে দেবীর বাহন সিংহের উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু সাঁওতাল-গোষ্ঠীর আদি নিবাস ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল কখনওই সিংহের প্রাকৃতিক বাসভূমি ছিল না। এবং, তথাকথিত শহীদ-পুরুষ 'হুদুড় দুর্গা' নামের মধ্যে 'দুর্গা' শব্দটি আছে, অথচ 'দুর্গা' শব্দটি সংস্কৃত-সহ অজস্র আর্যভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ তথা নারীনাম রূপেই পরিগণিত।
 
হেমব্রম আরও জানিয়েছেন, "Those days our ancestors did not fight women." আর তাদের এই নীতিবোধকে দুর্বলতা হিসাবে কাজে লাগিয়েই নাকি, আর্যরা তার কাছে পাঠালো প্রচ্ছন্ন-ঘাতক এক সুন্দরীকে। অথচ, পৌরাণিক অসুরবধের প্রতিটি কাহিনীতে, দুর্গার সঙ্গে মহিষাসুর ও তার সেনাবাহিনীর বিপুল সংগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, শিব পুরাণ, বামন পুরাণ- সর্বত্র রয়েছে এই যুদ্ধকথা। তাহলে, কী করে এক হতে পারে দুটো কাহিনী?
 
হেমব্রম বলেছেন, দুর্গার নায়িকাত্ব ও মহিষাসুরের খলনায়কত্ব প্রচারিত হয়েছে "In the eyes of the foreigners." অথচ বহিরাগত-হিসাবে আর্যদের ভারত ভূখণ্ডে আগ্রাসনের তত্ত্ব এখন বহু ইতিহাসবিদই খারিজ করে দিয়েছেন। আর, দেবপক্ষ-অসুরপক্ষের সংগ্রামকে আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব বলে দাগিয়ে দেওয়ার যে বাইনারি-তাড়িত প্রবণতা- সেটিও আদ্যন্ত ভুল। হিরণ্যকশিপু, রাবণ, বৃত্র- পুরাণের তা'বড় তা'বড় খলনায়কদের শরীরে বইতো ব্রাহ্মণ বংশের রক্ত, কী করে তাঁদের খাঁটি অনার্য বলে চিহ্নিত করা হবে? আজ্ঞে হ্যাঁ, মহিষাসুরের ক্ষেত্রেও তাই! মহিষাসুরের পিতা রম্ভাসুর ছিলেন কশ্যপ-পত্নী দনুর সন্তান (দেবীভাগবত)। কশ্যপ ঋষি কে? ব্রহ্মাপুত্র মরীচির পুত্র তিনি। তাঁর পত্নী
দানব-কুলজননী দনুই বা কে? আর এক ব্রহ্মানন্দন প্রজাপতি দক্ষের তনয়া। অর্থাৎ, মহিষাসুরের শরীরে বইছিল ব্রাহ্মণ্য শোণিত! বরাহপুরাণেও তিনি দানবরাজ বিপ্রচিত্তির কন্যা মাহিষ্মতীর গর্ভজাত, এবং দানব বলতেই সেই কশ্যপ ও দনুর ব্রাহ্মণ্য শোণিত স্মরণীয়। কী করে 'মূলনিবাসী অনার্য নায়ক' হবেন তিনি? আজও যে দুর্গাপূজায় দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরকেও রীতিমতো পূজা করা হয়, এবং ব্রাহ্মণ-জ্ঞানে তাঁকে উপবীতও অর্পণ করা হয়! এবং, মহিষাসুরের ক্ষমতালাভের কারণটিও যে তপস্যার বলে আদায় করে নেওয়া প্রজাপতি ব্রহ্মার কৃপা!
 
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, বহু সুপ্রাচীন ভাস্কর্যে দেবী দুর্গা কেবল মহিষমর্দিনী, তাঁর দ্বারা নিহত শত্রুটি আস্ত একটি মহিষ। উদাহরণ, উড়িষ্যার বিরজাক্ষেত্রের বিরজা দেবী- ইনি দ্বিভুজা দ্বিনেত্রা, এক হাতে মহিষের লেজ ধরে আরেক হাতে তাকে শূলবিদ্ধ করছেন, সিংহ বাহনও নেই, প্রায় মানবী-মূর্তি বলা চলে। এছাড়া, রাজস্থানের অম্বিকা ভগবতী মন্দিরের ভাস্কর্যে চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনী দেবী, এবং মথুরার ভাস্কর্যের মহিষমর্দিনীর কথা উল্লেখযোগ্য। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে অর্জুনকৃত দেবীস্তবে তিনি "মহিষসৃকপ্রিয়ে", মহিষের রক্ত তাঁর প্রিয়। দাক্ষিণাত্যের বিষ্ণুদুর্গা মূর্তিতে তিনি মহিষের মুণ্ডে দণ্ডায়মানা। এইসব ক্ষেত্রে কোথাও মহিষের মনুষ্যোচিত রূপের ইঙ্গিত নেই। তাহলে কি এইটিই অনুমিত হচ্ছে না, যে এই বহু শতাব্দীপ্রাচীন মিথ-প্রবাহে একেবারে শুরুর দিকে দেবী কেবল 'মহিষমর্দ্দিনী'-ই ছিলেন, এবং মহিষকে মায়াবী অসুররূপে কল্পনা পরবর্তীকালীন? যার ট্রাঞ্জিসন ফেজ হচ্ছে মহাবলীপুরমের অর্ধ-মহিষ অর্ধ-নর অসুর, এবং যার সাম্প্রতিকতম রূপ হচ্ছে বঙ্গীয় দুর্গাপ্রতিমার মহিষ থেকে অর্ধনিষ্ক্রান্ত অসুর? অর্থাৎ মহিষ কোথায় বাদ নেই, সমস্ত সংস্করণেই মহিষ আছেই আছে।
 
তাহলে, বিশাল ভারতভূমি জুড়ে প্রচলিত দুর্গা সংক্রান্ত এই এতগুলি মিথ পরিত্যাগ করে, মহিষের নামগন্ধহীন 'হুদুড় দুর্গা' সংক্রান্ত একটি বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ জনজাতির অন্তর্ভুক্ত বিশেষ গোষ্ঠীর আখ্যানকে একমাত্র সত্য 'ইতিহাস' বলে মেনে নেবার যুক্তি কী?
 
আচ্ছা, তাহলে, কেন আর কীভাবে হুদুড় দুর্গার সঙ্গে মহিষাসুরকে মেলাতে চাইলেন হেমব্রম ও তাঁর সঙ্গীরা?
 
"...We call him Hudur Durga; never Mahishasura. Only later we realized that our Hudur Durga is known by others as Mahishasura."- বলেছেন হেমব্রম। ঠিকই, যেমন সাঁওতালদের কিংবদন্তীতে মহিষাসুরের নাম নেই, তেমনই পুরাণে কোত্থাও নেই হুদুড়ের নাম। তাহলে হেমব্রম কীভাবে এই দুই চরিত্রকে মেলালেন? ফাঁস করেছেন নিজেই। রাজনৈতিক গোষ্ঠীবিশেষের উত্থান শুরু হওয়ার পর, নিজের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচয় খুঁজতে গিয়েই তাঁর মাথায় এসেছিল এই চিন্তা। " First the thought of Ravana came to my mind. But the stories of Ravana did not have much intersection with our culture. His land was far away from ours." তাই রাবণ বাতিল হলেন, মঞ্চে নামানো হলো মহিষাসুরকে! এবং, তৈরী হল হিন্দুত্ববাদের Counter-fiction, প্রচলিত হলো Counter-culture। সাঁওতাল-অধ্যুষিত গ্রামের পাশাপাশি, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েও অসুর-পুজো তথা হুদুড়-পুজোর ধুম লাগল!
অর্থাৎ, এই হুদুড় পুজো কিংবা অসুর পুজো আদতে সাঁওতাল গোষ্ঠীর কোনও প্রাচীন ঐতিহ্যই নয়, নিতান্ত হাল আমলে, ২০১১ সালে তৈরী হওয়া একটি রাজনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা মাত্র!
 
আর, বাঙালির দুর্গোৎসব?
 
শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রাচীন উল্লেখ রয়েছে দুর্গাসপ্তশতীতেই, "শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী" (১২/১২)। মনে রাখতে হবে, শ্রীশ্রীচণ্ডীর মন্ত্রসংখ্যা নির্দিষ্ট হওয়ায় তাতে প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের অনুপ্রবেশ সম্ভব নয়, এবং, কোনও সংস্করণে উক্ত মন্ত্রের কোনও পাঠান্তরও পাওয়া যায় না। এই শারদীয়া মহাপূজার বিস্তৃতি পদ্ধতি রয়েছে কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ ও বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণে। দেবীভাগবতে রামচন্দ্রের শারদ নবরাত্রি উদযাপনের কাহিনী রয়েছে, আর কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ-কাব্যে রয়েছে অকালবোধনের বিবরণ।
 
ইতিহাস বলছে, ৮৮৭ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে, আচার্য রমেশ শাস্ত্রীর বিধানে শারদীয়া দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন রাজা কংসনারায়ণ। সেখানে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে দেবীমন্দির, আর তৎসংলগ্ন ফলকে লেখা রয়েছে এই ইতিহাস। অর্থাৎ, কম করেও বিগত পাঁচশো বছর ধরে প্রতি শরতে বাঙালির ঘরে আসছেন মা দুর্গা!
 
এবং, বাঙালির দুর্গা-ধারণায় দেবী মোটেও আর্য-পক্ষপাতী একদেশদর্শী কোনও চরিত্র নন। মনসামঙ্গল ও শিবায়নে মহাদেবকে ছলনা করতে তিনি ডোম্বী-বেশ ধারণ করেন, তাঁর শবরী রূপের কথা পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণে। দেবীর মাতঙ্গী মহাবিদ্যা রূপ চণ্ডালীরূপে প্রসিদ্ধা। বাংলার জনমানসে দেবীর গণরূপে ভূত প্রেত ডাকিনী যোগিনী দৈত্য দানা অত্যন্ত পরিচিত। এসব যে নেহাত প্রাদেশিক ভাবনা কিংবা অর্বাচীন কবিকল্পনা তা মোটেই নয়, বৈয়াসকী মহাভারতেই দেখা গেছে, সগণ কিরাত-রূপী মহাদেবের সঙ্গে কিরাতবধূর বেশে অর্জুনের তপস্যাস্থলীতে পার্বতীর আগমন!
 
আচ্ছা, আপনারা জানেন কি, এই হুদুড়-পুজো নিয়ে সাঁওতাল গোষ্ঠীর সকলে আদৌ একমত নন?
'দশানি' উৎসব, ওরফে 'দাঁশাই'- কে হেমব্রম বলেছেন হুদুড়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে শোকপালন, এবং সেজন্যই তাতে ঘটেছে "হায় হায়" শব্দের প্রয়োগ। কিন্তু এই ব্যাখ্যা সর্বত্র মান্যতা পায়নি আদৌ! সাঁওতাল বুদ্ধিজীবী বিবেকানন্দ সোরেন স্পষ্টই জানিয়েছেন, দাঁশাই হলো খরা-কবলিত দশা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য, বৃষ্টির জন্য প্রকৃতি-বন্দনার গান। "হায় হায়" শব্দের প্রয়োগ এখানে খরা-জনিত কষ্টের সূচক, কোনও শহীদ-স্মরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। (যে কোনও বুদ্ধিজীবীর বিশেষণ হিসাবে তাঁর গোষ্ঠীপরিচয় উল্লেখ করা আমাদের পক্ষে পীড়াদায়ক, কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা নিরুপায়।)
বর্তমানে, সাঁওতাল গোষ্ঠীর অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিই মহিষাসুরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অস্বীকার করতে চাইছেন। সুশীল মুর্মু, সুমন্ত হেমব্রম, সন্দীপন কিস্কু- বেলুড়ের শিক্ষামন্দিরের তিন তরুণ ছাত্র স্পষ্টই জানিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মানেন না। বাঁকুড়ার দোমোহানী গ্রামের সরস্বতী হাঁসদা দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে নিজেই প্রতি বছর সামান্য উদ্যোগে আয়োজন করছেন দুর্গোৎসব! মন্ত্র জানা নেই তো কী, নিজস্ব গান আর ভুয়াং নাচের মাধ্যমেই প্রতি বছর করছেন মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা!
 
শারদ দুর্গোৎসবের আদিতম উৎস মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত 'দুর্গাসপ্তশতী', বা 'শ্রীশ্রীচণ্ডী'। এই গ্রন্থের দেবীলীলা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে মণ্ডিত, কোনও রাজনৈতিক আধিপত্যের ইতিহাস খোঁজা সেখানে বৃথা। দেবী সেখানে "মহাদেবী মহাসুরী"- তিনিই দৈবীশক্তি ও আসুরীশক্তির একতম উৎস। "চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা", অসুর-বিরোধী সংগ্রামে তাঁর বাহ্য-নিষ্ঠুরতার আড়ালে সদাসক্রিয় তাঁর অন্তরস্থ কৃপা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধকের অন্তরস্থ অশুভ প্রবৃত্তির ক্রমাগত বিনাশই, দেবীমাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীতে যুদ্ধ আকারে উপস্থাপিত। শ্রীশ্রীচণ্ডীর তাৎপর্য অনুধাবন না করে, দুর্গোৎসব সম্পর্কে মন্তব্য করা তাই নিতান্তই অনর্থক।
 
সমস্ত বিতর্ক, সমস্ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে সরিয়ে রেখে, এই দুর্যোগ ও দুর্ভোগের বছরেও মা আসবেন বাংলার ঘরে ঘরে। নদীর ধারে চামর দোলাবে কাশবন, গালচে বিছিয়ে দেবে শ্বেতশুভ্র শেফালিকার দল। আর, আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠবে আলোকমঞ্জীর!
***
এই নিবন্ধটি একটি বহু বছর যাবৎ চর্চিত ঐতিহাসিক বিতর্ক সম্বন্ধে সত্য অনুসন্ধানের প্রয়াস। কোনও ভাষিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত বা বিরূপতা প্রদর্শন এর উদ্দেশ্য নয়।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)