দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







প্রকৃতি তত্ত্ব

সত্যান্বেষী
0

 

প্রকৃতি কি ?
 
এই জগতের ত্রিবিধ অনাদি সত্তার মধ্যে প্রকৃতি একটি । প্রকৃতি শব্দের উৎপত্তি ‘কৃ’ ধাতু থেকে (প্র–কৃ+তি) । ‘কৃ’ ধাতুর অর্থ হল করা । সুতরাং প্রকৃতি শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থে সেই প্রকৃতি, এই বিশ্ব যাহার কৃতি । বিশ্ব এবং তার যাবতীয় জড়বস্তু এবং প্রাণীর, মানুষের বুদ্ধি, মন, চিত্ত, অহং এবং ইন্দিয়াদির তথা আত্মা ভিন্ন মানুষের সমস্ত অবশিষ্ট সত্তার, বিশ্বের যাবতীয় পরিবর্তন এবং বিবর্তনের মূল অনিঃশেষ কারণ প্রকৃতি । বেদ বলছে—
“এই নিত্য প্রকৃতি সর্বদাই পরিণামযুক্তা, পুরাতন, নব নব রূপধারিনী এবং সর্ব কাজে করণ রূপে বিরাজমান । প্রত্যেক গতিশীল জীবের সঙ্গেই এই প্রকৃতি নিজের স্বরূপ ও সত্ত্বা প্রকাশ করিতেছে ।” (অথর্ববেদ- ১০/৮/৩০)
 
প্রকৃতি এই জগতের মূল উপাদান কারণ, কিন্তু তার মূল নাই । বিশ্বের যাবতীয় কার্য এবং সংঘাতের মূল কারণ এই প্রকৃতি । প্রকৃতি জগতের সব বস্তুরই মূল উপাদান কারণ, কিন্তু তার কোন উপাদান কারণ নাই । কিন্তু নাই কেন ? উত্তর দিচ্ছেন মহর্ষি কপিল—
 
“মূল কারণের কোন কারণ থাকিতে পারে না । কারণ রহিত না হইলে তাকে মূল কারণ বলা যায় না । মূল কারণ অকারণ অর্থাৎ কারণ রহিত হইয়া থাকে এবং তাহা অনাদি ।” (সাংখ্য০ ১/৬৭)
“এইরূপ ভাবে পরম্পরা হিসাবে কারণ মানিতে মানিতে অন্তে একস্থানে পৌছিতেই হইবে । যে কারণ অন্তে স্থিত হইবে তাহাকে প্রকৃতির সংজ্ঞা দেওয়া হয় ।” (সাংখ্য০ ১/৬৮)
প্রকৃতি জড়াত্মক, জড়শক্তির আধার, অচেতন এবং ত্রিগুণাত্মিকা । সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ, এই ত্রিবিধ গুণের সমষ্টি এবং শক্তির মূল সাম্যাবস্থার নাম প্রকৃতি । সৃষ্টির অনন্ত সম্ভাবনার অবিকৃত এবং পূর্ণ সাম্য-প্রকৃতিই প্রকৃতি ।
 
সাধারণত গুণ বলতে আমরা ‘ধর্ম’কে বুঝি । দর্শনে (সাংখ্য) গুণ বলতে উপাদানকে বুঝায় । সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, এই তিনটি প্রকৃতির উপাদান । একটি রজ্জু যেমন তিনটি তারের সমষ্টি হতে পারে তেমনি প্রকৃতিও সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের সমষ্টি । এগুলোকে গুণ বলার কারণ এই যে, এরা পুরুষ বা আত্মার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে এবং পুরুষ বা আত্মাকে জগতের সঙ্গে বেঁধে রাখে ।
 
প্রকৃতির গুণগুলি খুবই সূক্ষ্ম বলে এদের প্রত্যক্ষ করা যায় না । তবে গুণগুলোর কার্য হতে গুণগুলোর অস্তিত্বকে অনুমান করা যায় । এদের অস্তিত্বকে অনুমান করার পদ্ধতি হল এই,– সাংখ্যের সংকার্যবাদ অনুসারে কার্য এবং কারণ সমভাবাপন্ন । জগতের প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যে তিনটি জিনিস দেখা যায় । যথাঃ- সুখ, দুঃখ ও ঔদাসীন্য । যেমন, ‘প্রভাতে পাখীর গান’ সঙ্গীতপ্রিয় রসিককে দেয় সুখ, রুগ্ন ব্যক্তিকে দেয় দুঃখ, আর অরসিক জন থাকে ঐ গানের প্রতি উদাসীন । জগতের প্রতিটি বস্তুই যখন কার্য এবং কার্যের মধ্যে যখন সুখ, দুঃখ ও উদাসীন্য এই তিনটি জিনিস দেখা যায়, তখন জগতের সকল বস্তুর মূল উপাদান যে প্রকৃতি তার মধ্যে নিশ্চয়ই এই তিনটির কারণ থাকবে । তাদের কারণ হইল যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ ।
 
মহর্ষি কপিলও বলছেন—
 
“প্রকৃতি পুরুষের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না হইলেও অনুমানের দ্বারা তাহাদের জ্ঞান হইয়া থাকে । যেমন দূরে পর্বত মধ্যস্থ অগ্নির জ্ঞান ধূম ও প্রকাশাদির প্রত্যক্ষের দ্বারা হইয়া থাকে সেইরূপ পৃথিব্যাদি কার্য, ভোগাদি চিহ্ন ও রচনাদি কৌশল প্রত্যক্ষ করিয়া সৃষ্টির উপাদান কারণ জড় সত্বঃ রজঃ ও তমঃ স্বরূপ প্রকৃতি, ভোক্তা জীবাত্মা ও অনন্ত জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার জ্ঞান অনুমানের দ্বারা হইয়া থাকে ।” (সাংখ্য০ ১/৬০)
 
সত্ত্বগুণ সুখাত্মক, লঘু ও প্রকাশক । প্রীতি, তৃপ্তি, আনন্দ প্রভৃতি সুখের যাবতীয় অবস্থা সত্ত্বগুণের কার্য । অগ্নির ঊর্ধ্বগতি, বায়ুর অবাধ সঞ্চরণ প্রভৃতি লঘুতার পরিচায়ক । এই শ্রেণীর যাবতীয় কার্যের জন্য সত্ত্বগুণ দায়ী । সেই-রূপ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির বিষয়বস্তুকে প্রকাশ করার শক্তি, দর্পণের প্রতিবিম্ব গ্রহণের শক্তি প্রভৃতি ব্যাপারও ঐ সকল বস্তুতে সত্ত্বগুণের অবস্থিতির জন্য সম্ভব হয় ।
 
রজোগুণ দুঃখাত্মক, চলনাত্মক (নিজে গতিমান) এবং উপষ্টম্ভক (অন্য দ্রব্যে গতি সঞ্চারক) । জগতের যাবতীয় দুঃখের কারণ হল প্রকৃতির রজোগুণ । সেইরূপ সকল রকমের সক্রিয়তা ও চঞ্চলতার কারণও এই রজোগুণ । যেকোন কর্মপ্রচেষ্টা, চঞ্চলতা, উৎসাহ ও শক্তি– এই রজোগুণের লক্ষণ । সত্ত্ব ও তমোগুণ নিজে নিজে কোন কাজ করতে পারে না, এই রজোগুণই তাদের সক্রিয় করে তোলে ।
 
তমোগুণ হইল মোহাত্মক (মোহের সৃষ্টিকারী) গুরু ও আবরক (আবৃত করিয়া রাখে) । গুরু ও আবরক হওয়ার কারণে তমোগুণ সত্ত্বগুণের বিপরীত-ধর্মী । রজোগুণের চঞ্চলতার বাধা সৃষ্টি করে বলে এটি রজোগুণের বিপরীত ধর্মী । তমোগুণ সত্ত্বগুণের প্রকাশের বাধা সৃষ্টি করে এবং রজোগুণের গতিকে বাধা দেয় । উহা বিষয় ও জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে । তবে সত্ত্ব বা রজঃ যদি প্রবল হয়, তা হলে তমোগুণের বাধা অতিক্রম করেও তারা কাজ করতে পারে । তমঃ হতেই জড়তা, ঔদাসীন্য, বিষাদ, নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতি জন্মে । এই কারণেই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃকে যথাক্রমে শুক্লবর্ণ, লোহিতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণের সাথে তুলনা করা হয় ।
 
সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুনের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সহযোগিতার ভাব বিদ্যমান । প্রতিটি গুণ সব সময় চেষ্টা করে যাতে অপর দুইটি তাকে পরাস্ত করে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে । অন্য দিকে আবার এই তিনটি গুণ এমনভাবে পরস্পর মিশ্রিত হয়ে থাকে যে, একটিকে অপর আরেকটি থেকে পৃথক করা যায় না এবং গুণত্রয়ের সমবেত চেষ্টা ছাড়া কোন জিনিসের সৃষ্টি হতে পারে না । এদের সম্বন্ধ প্রদীপের তৈল, সলিতা (প্রদীপে ব্যবহৃত কাপড় বা তুলা) ও আগুনের সম্বন্ধের মত । তৈল, সলিতা এবং আগুন পরস্পর-বিরোধী হলেও যেমন একত্রে মিলিত হয়ে প্রদীপের আলো উৎপন্ন করে, তেমনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয় পরস্পর-বিরোধী হইলেও একযোগে সকল দ্রব্য উৎপন্ন করে । আত্মা বা পুরুষ ব্যতীত জগতের স্থূল ও সূক্ষ্ম, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র, মানুষ ও পশু, পক্ষী ও কীট-পতঙ্গ প্রভৃতি সকল বস্তুতেই এই তিন গুণের সমাবেশ দেখা যায় । তবে একটি গুণ অপর দুই গুণের উপর প্রাধান্য লাভ করতে চায় বলে কোন বস্তু বা ব্যক্তি সত্ত্ব প্রধান, কোনটা রজোপ্রধান, আবার কোনটা তমঃ প্রধান হয় । কিন্তু সবল হয়ে হোক বা দুর্বল হয়েই হোক, প্রতি বস্তুতেই এই গুণত্রয় বিদ্যমান আছে ।
 
প্রকৃতির গুণত্রয়ের আর একটি বৈশিষ্ট্য হইল ইহাদের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা । সৃষ্টিকালে গুণত্রয়ের বিরূপ পরিণাম এবং প্রলয়কালে স্বরূপ-পরিণাম হয় ।
 
প্রকৃতির দুই অবস্থা, সাম্য এবং বৈষম্য । প্রলয়ে সাম্য এবং সৃষ্টিতে বৈষম্য । প্রকৃতির পরিবর্তন এবং পরিণামে কোন ছেদ নাই । প্রলয়কালে সত্ত্বগুণ সত্ত্বে, রজোগুণ রজে এবং তমোগুণ তমোরূপে পরিবর্তনশীল । সৃষ্টিকালে এই তিনটি গুণ কার্যোন্মুখভাবে পরিবর্তনশীল । তখন গুণের বৈষম্য অথবা তারতম্যবশত সৃষ্টির বৈচিত্র্য সম্ভব হয় । গুণসংমিশ্রণের অসংখ্য সংখ্যায় বা অনুপাতে বৈষম্য ঘটে এবং প্রকৃতির বিচিত্র পরিণাম হয় । প্রতিসর্গাবস্থায় গুণত্রয়ের সদৃশ-পরিণাম হয় । প্রলয় কালে প্রকৃতির সদৃশপরিণামের ফলে এইরূপ সাম্যবস্থা ঘটে । যে ক্রমানুসারে সৃষ্টি হয়, উহার বিপরীত ক্রমে লয় হয় ।
প্রকৃতিকে ‘প্রধান’ও বলা হয় । এটি বিশ্বের আদিতত্ত্ব । এটি অব্যক্ত, নিত্য, জড়ায়ক এবং পরিণামী । প্রকৃতির গর্ভ হতে যেসব বস্তু এবং পদার্থ উদ্ভূত হয় সে-সমস্তই ব্যক্ত, অনিত্য, প্রকৃতির অনুমাপক, সংযোগী এবং পরাধীন । প্রকৃতি নির্বিশেষ জড়সত্ত্বা । এর সম্পর্কে নঞর্থক বিধেয়ই বেশী প্রযুক্ত হয় ।
 
প্রকৃতি সম্পর্কিত বিধেয়ের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ—
 
১. ব্যক্ত পদার্থের আবির্ভাব এবং তিরোভাব আছে। এই অর্থে ব্যক্ত পদার্থ মাত্রেই অনিত্য (অস্থায়ী) । অব্যক্ত প্রকৃতির আবির্ভাব এবং তিরোভাব নাই । এই অর্থে প্রকৃতি নিত্য ।
২. প্রকৃতি থেকে যা কিছু উৎপন্ন হয় সেসবের কিছুই কোন অবস্থায়ই প্রকৃতির বহির্ভূত নয় । প্রকৃতি সর্বাবস্থায় সৃষ্টিকে ব্যাপিয়া থাকে । সৃষ্ট কোন দ্রব্য সমস্ত প্রকৃতিকে ব্যাপিয়া থাকিতে পারে না । মাটি থেকে যে সমস্ত দ্রব্য প্রস্তুত হয় সে-সমস্তেই মাটি কোন না কোন অবস্থায় বর্তমান থাকে, কিন্তু মৃন্ময় বস্তুমাত্রেই সমস্ত মৃত্তিকাকে ধারণ করে না । দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মৃত্তিকা দ্বারা কেবল কলস প্রস্তুত হয় না । পুতুল এবং আরও অনেক জিনিস প্রস্তুত হয় । কলস সমুদয় মৃত্তিকাকে ব্যাপিয়া থাকিলে, উহা থেকে পুতুল প্রস্তুত হতো না । মাতা সকল সন্তানকে ব্যাপিয়া থাকেন, কিন্তু কোন একটি সন্তান সে-অর্থে তাকে ব্যাপিয়া থাকে না, বা থাকতে পারে না । কার্য অব্যাপক, কারণ ব্যাপক ।
৩. মূল প্রকৃতির পরিণাম আছে, কিন্তু স্পন্দন নেই । পূর্ণের স্পন্দন অসম্ভব । আকাশেরও স্পন্দন আছে, কিন্তু আকাশ অপেক্ষা প্রকৃতি আরও পূর্ণ । তাতে স্পন্দনের অনুভব হয় না ।
৪. মূল প্রকৃতির কারণ নাই । সুতরাং, ইহা অনাশ্রিত । বিবর্তিত পদার্থ মাত্রই আশ্রিত ।
৫. প্রকৃতি নিজেই নিজের অনুমাপক নয় । প্রকৃতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলিয়া কার্য দ্বারা তার অনুমান করতে হয় ।
৬. প্রকৃতি পরাধীন নয় । প্রকৃতি পরবল দ্বারা আত্মপুষ্টি করে না । নিজেই নিজের কার্য উৎপাদন করে ।
জড়শক্তিই জড়ের উৎপত্তির কারণ । অজড় জড়ে রূপান্তরিত হতে পারে না । সাংখ্যমতে অণু-পরমাণু এবং মৌলিক জড় উপাদানের দ্বারা বুদ্ধি, মন, অহং- এর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায় না । অণু-পরমাণু পরস্পরবিক্ষিপ্ত এবং বহু । মূল একটি জড়াত্মক তত্ত্বে পৌঁছানো কাম্য । এই তত্ত্বটি প্রকৃতি ।
 
প্রকৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ—
 
১. ব্যক্ত বস্তুমাত্রই সসীম, সাবয়ব, পরনির্ভর এবং আপেক্ষিক (শর্তাধীন) । সসীম কোন বস্তু, দ্রব্য কিংবা উপাদান এই বিরাট বিশ্বের কারণ হতে পারে না । ব্যক্ত কোন দ্রব্যই সর্বব্যাপী নয় । ব্যক্ত বস্তুসমূহের মধ্যে ব্যবধান অনেক । এই হেতু নিখিল ব্যক্ত জগতের মূল কারণস্বরূপ অব্যক্ত, অসীম, সর্বব্যাপী এবং নিত্য কোন কারণের অনুমান করতে হয় । ঐ অব্যক্ত কারণটিই প্রকৃতি ।
২. গ্রিক দার্শনিক আনেক্সামিণ্ডার মনে করেন, জল, কিংবা বায়ু নয়, একটি নিঃসীম জড়সত্তাই সমগ্র বিশ্বের মূল কারণ । সেই কারণটিই প্রকৃতি ।
৩. বুদ্ধির লক্ষণ ‘অধ্যাবসায়’, অহংকারের লক্ষণ ‘অভিমান’, গন্ধতন্মাত্রের লক্ষণ ‘সুক্ষ্ম গন্ধ’, পৃথিবী এবং ইহার ফুল-ফলের লক্ষণ ‘স্থূল গন্ধ’ । প্রত্যেক কার্যের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, কিন্তু এই বিভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট বস্তুসমূহের মধ্যে একটি সাধারণ ধর্ম বর্তমান । পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু তিনটি মানসিক অবস্থা উদ্রেক করতে সমর্থ; সুখ, দুঃখ এবং মোহ । এই তিন প্রকার মনোভাবের উপাদান কারণ সত্ত্বঃ, রজঃ এবং তমঃ । এই তিনটি মৌলিক গুণ বা উপাদানের সমন্বয় শক্তিই এই জগতের মূল কারণ । সেটিই প্রকৃতি ।
৪. কার্য-কারণের অন্তঃস্থিত শক্তি-সম্বন্ধের কারণেই কারণ কার্যে পরিণত হয় । যা কারণে অব্যক্ত থাকে তা কার্যের নামরূপে ব্যক্ত হয় । তিল হইতে তৈল হয়, বালুকা থেকে তৈল হয় না । তিলে তৈল উৎপাদন করিবার শক্তি আছে, বালুকাতে নাই । সমস্ত জগতের সম্ভাবনা এইরূপভাবে প্রকৃতির গর্ভে অব্যক্ত থাকে । এই প্রকার প্রবৃত্তি-বিশিষ্ট অব্যক্ত শক্তির যুক্তিই প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি অস্তিত্ব বিশিষ্ট ।
৫. শক্তি-সম্বন্ধের ক্ষেত্রে কারণ এবং কার্যে অভেদ এবং ভেদ দুই-ই থাকে । একই কার্য-কারণ প্রক্রিয়ায় কার্য একটি ব্যক্ত অবস্থা এবং কারণ উহার অব্যক্ত অবস্থা । সকল কার্যই ব্যক্ত বলিয়া পরিচ্ছিন্ন । কার্য নিজে তার কারণ হতে পারে না । সমস্ত কার্য প্রমাণ করে যে, জগতের একটি মূল কারণ আছে । সেটিই প্রকৃতি ।
৬. বুদ্ধি থেকে ক্ষিতি পর্যন্ত জগতের সকল বস্ত্রই সসীম ও পরাপর নির্ভর । সুতরাং তাদের কোন অসীম ও স্বনির্ভর কারণ থাকবেই । সেই কারণই প্রকৃতি ।
৭. জগতের প্রতিটি বস্তুই মনে সুখ, দুঃখ ও বিষাদ উৎপাদনে সক্ষম । সুতরাং এমন কোন সাধারণ কারণ আছে যার সুখ, দুঃখ ও বিষাদ, এই তিনটিকে উৎপন্ন করার ক্ষমতা আছে । সেই সাধারণ কারণই প্রকৃতি।
৮. উৎপত্তির পূর্বে সকল কার্য উপাদান কারণে অব্যক্তভাবে বিদ্যমান থাকে । সুতরাং জগৎরূপ কার্যই কোন একটি উপাদান কারণে অব্যক্তভাবে বিদ্যমান ছিল । সেই উপাদান কারণই প্রকৃতি ।
৯. যেকোন কার্য কোন কারণ হইতেই উৎপন্ন হয়, সেই কারণ আবার আর একটি কারণ হইতে উৎপন্ন হয় । এইভাবে যেতে যেতে এমন একটি কারণে পৌঁছায়, যার আর কোন কারণ নাই । সেই কারণই প্রকৃতি ।
১০. কয়েকটি কার্যের পশ্চাতে যেমন একটি কারণ থাকে, তেমনি সমস্ত কারণের পশ্চাতে একটি মূল কারণ কাজ করে । বিশ্ব-রূপের এইরূপ একটি অভিন্ন ঐক্যভাবই প্রকৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে ।
কারণ এবং কার্যের মধ্যে গুণগত এবং পরিমাণগত পার্থক্য হেতু বিভিন্ন কার্যের মধ্যে অনেক বিভিন্নতা সত্ত্বেও মূলত একই উৎসের কারণে কিছু সাধারণ সমন্বয় থাকে । কারণ এবং কার্যের মধ্যে বস্তুত একটি শক্তি-সম্বন্ধের প্রবণতার কারণে, কারণ এবং কার্যের বিভিন্নতা ও ক্রমশ সূক্ষ্মতর কারণের অভিন্নতা হেতু প্রমাণ করে যে, সমস্ত জড়শক্তির মূল উৎসস্বরূপ এবং সমস্তপ্রকার গুণ তথা সুখ, দুঃখ এবং মোহের সমন্বয়স্বরূপ প্রকৃতির অস্তিত্ব আছে ।
 
এখন প্রশ্ন, প্রকৃতির সাথে অন্য দুইটি অনাদি সত্তার (ঈশ্বর এবং জীবাত্মা) সম্বন্ধ কি ?
 
প্রত্যেকটি কার্যের তিনটি কারণ থাকে । ১. কর্তা, ২. কর্ম এবং ৩. কার জন্য । এগুলোই যথাক্রমে নিমিত্ত কারণ, উপাদান কারণ, সাধারণ কারণ । সহজভাবে বোঝালে, একটি সোনার গহনা প্রস্তুত করাকে যদি কার্য ধরি, তবে স্বর্ণকার গহনাটির নিমিত্ত কারণ, উপাদান কারণ হল সোনা এবং সাধারণ কারণ হল যিনি এই গহনাটি পড়বেন ।
 
ত্রৈতবাদমতে সাধারণ কারণ হল জীবাত্মা । কারণ ঈশ্বর নিজে এই জগৎকে ভোগ করেন না । সুতরাং জীবের ভোগের নিমিত্তই এই জগতের সৃষ্টি ।
 
সূত্র- তদর্থ এব দৃশ্যস্যা ssত্মা । (যোগ০ ২/২১)
শব্দার্থ- (তদ্-অর্থঃ) ওই জীবাত্মার ভােগ এবং অপবর্গের জন্য (এব) অবশ্যই (দৃশ্যস্য) দৃশ্যের (আত্মা) স্বরূপ হয় ।
সূত্ৰাৰ্থ- দৃশ্যের স্বরূপ জীবাত্মার ভােগ ও অপবর্গকে সিদ্ধ করার জন্য হয় ।
 
ব্যাখ্যা- এই সূত্রে দৃশ্যের কী প্রয়ােজন ; সেই বিষয়ে বলা হয়েছে এই দৃশ্যের রচনা ঈশ্বর, যাতে জীবাত্মা ভােগ এবং অপবর্গ রূপ প্রয়ােজনকে সিদ্ধ করতে পারে সেই জন্য করেছেন । এই সংসারে তিনটি পদার্থ রয়েছে ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি । ঈশ্বর সকল কামনা হতে রহিত ; তাই তাঁর কাছে এই দৃশ্যের কোনাে প্রয়ােজন নাই । প্রকৃতি একটি জড়পদার্থ হওয়ায় সে নিজেকে স্বয়ং ভােগ করতে পারে না । কিন্তু জীবাত্মার নিজস্ব কোনাে আনন্দ না থাকায় সে এই দৃশ্যকে ভােগ করে ।
[যোগদর্শন ভাষ্য, আচার্য্য কপিল আর্য]
 
সুতরাং প্রকৃতির সাথে জীবাত্মার ভোগ্য-ভোক্তার, ঈশ্বরের সাথে কর্তা-কর্মের সম্বন্ধ ।
 
অলমিতি ।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)