দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







অষ্টাঙ্গযোগ - ৩য় পর্ব [ প্রত্যাহার - ধারণা - ধ্যান - সমাধি ]

সত্যান্বেষী
0

 

(৫) প্রত্যাহার :—
 
ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগত করাই প্রত্যাহার ।
 
দ্বিতীয় পর্ব - https://www.agniveerbangla.org/2023/09/blog-post_81.html
 
✅ প্রত্যাহার সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
 
স্ববিষয়াসম্প্রয়ােগে চিত্তস্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং
প্রত্যাহারঃ ।।
(যোগ০—২/ ৫৪)
অর্থ = নেত্র ইত্যাদি ইন্দ্রিয় নিজের বিষয়ের সাথে সম্বন্ধ না হলে এবং মনের অনুসারী হয়ে যাওয়াকে ‘প্রত্যাহার' বলা হয় ।
 
ব্যাখ্যা - সুস্বাদু খাবার খাওয়ার জন্য স্বাদেন্দ্রিয় বা জিহ্বা আকর্ষিত হয় । সুন্দর গান বা কথাবার্তা শুনলে সেটা শুনার জন্য শ্রবণেন্দ্রিয় বা কান আকর্ষিত হয় । সুগন্ধ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয় বা নাক আকর্ষিত হয় । একইভাবে দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয় নিজ নিজ বিষয়ের প্রতি আকর্ষিত হয় । যোগী ব্যাক্তি সাধনকালে ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজ নিজ বিষয়ের আকর্ষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন । যেমন কান যদি গানের দিকে আকৃষ্ট হয়, নাসিকা যদি সুগন্ধের দিকে আকৃষ্ট হয় তখন সেই আকর্ষণকে ত্যাগ করতে হবে । এককথায় এ সময় যোগী ব্যাক্তি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি ইন্দ্রিয়ের অনুগামিতা বিচ্ছিন্ন করে ইন্দ্রিয়সমূহকে মনের কাছে সমর্পণ করবেন । এবং মনকে ধ্যেয়র প্রতি নিবিষ্ট করবেন । এটাই হচ্ছে প্রত্যাহার । এ বিষয়ে একটি সুন্দর উদাহরণ দেয়া যায় । যেমন , রানী মৌমাছি উড়তে শুরু করে দিলে সকল মৌমাছি তার সাথে -সাথে উড়তে শুরু করে দেয় । যেখানে রানী মৌমাছি বসে সেখানেই সকল মৌমাছি বসে যায় । একই রকমভাবে সকল ইন্দ্রিয় গুলিও চিত্তের অনুকরণ করে ।
 
যদি তখন ইন্দ্রিয়সমূহের বাহ্য বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বিচ্ছিন্ন না হয় , যেমন নাসিকা ঘ্রাণের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে , কানে গানের শব্দ আসায় সেদিকে মন চলে যাচ্ছে , তখন বুঝতে হবে যে ‘প্রত্যাহার’ সিদ্ধ হয়নি । প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভের একটি উত্তম পন্থা বলা যায় এভাবে , যে যখন কোনো শ্রমিক যন্ত্রের শব্দে দূষিত কোনো কারখানায় প্রবেশ করে তখন প্রথম দিকে তার অনেক সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে যন্ত্রের বিকট শব্দের প্রতি তার মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয় । অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি এমন যে, শ্রবণেন্দ্রিয় সেই শব্দটিকে গ্রহণ করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করার পর মস্তিষ্ক তা অগ্রাহ্য করে । এখানে লক্ষণীয় যে , যন্ত্রের বিকট শব্দকেও অভ্যাস দ্বারা মস্তিষ্কে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে । এই অগ্রাহ্য করার ফলে শ্রমিক কারখানায় যেমন বিব্রতবোধ করেন না । একইভাবে প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভ হলে যোগী প্রতিকূল অবস্থাতেও যোগসাধনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হন । এর জন্য নিরন্তর অভ্যাস পালন করা উচিত ।
 
✅ যোগদর্শনে প্রত্যাহারের ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে
 
ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম ॥
(যোগ০ — ২/৫৫)
অর্থ= প্রত্যাহারে দৃঢ় স্থিতি হয়ে গেলে ইন্দ্রিয়ের সর্বোৎকৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হয় ।
 
➡️ ব্যাখ্যা- প্রত্যাহারের ফলে ইন্দ্রিয়সমূহ সম্পূর্ণভাবে যোগী ব্যাক্তির অধীন হয়ে যায় । তখন ইন্দ্রিয় জয়ের জন্য পুনরায় কোনো সাধনার প্রয়োজন হয় না । আর ইন্দ্রিয় জয় হলে চিত্তে বিষয়-আসক্তি নষ্ট হয় । এমতাবস্থায় চিত্তকে ধ্যেয়তে নিবিষ্ট করা সহজ হয় ।
 
শ্রীমদভগবদগীতায়ও শ্রীভগবান অর্জুনকে বলেন -
 
তানি সর্বানি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ|
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ||
(গীতা —২|৬১)
—আত্মপরায়ন মানুষ সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংঘত করে আত্মস্থ হয়ে ইন্দ্রিয়সমূহ বশীভূত করেছেন , তিনিই স্থির বুদ্ধি যুক্ত ৷
 
তস্মাদ যস্য মহাবাহু নিগৃহীতানি সর্বশঃ|
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ||
(গীতা —২|৬৮)
হে মহাবাহু! (অর্জুন), যার সমস্ত ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়ের বিষয় সকল থেকে নিগৃহীত হয়েছে, তাঁরই বুদ্ধি স্থির হয়েছে ।
 
✅ অর্থাৎ যিনি প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভ করেন , সেই জিতেন্দ্রিয় ব্যাক্তির বুদ্ধি স্থির হয় , চঞ্চল মন শান্ত হয় । এবং যার বুদ্ধি স্থির হয় , তিনি যোগমার্গে প্রভূত উন্নতি লাভ করেন ।
✅ প্রত্যাহারের ফলে ইন্দ্রিয়সমূহ সম্পূর্ণভাবে যোগী ব্যাক্তির অধীন হয়ে যাওয়ার কারণে ইন্দ্রিয় জয়ের জন্য পুনরায় কোনো সাধনার প্রয়োজন হয় না ।
✅ ইন্দ্রিয় জয় হওয়ার কারণে চিত্তে বিষয়-আসক্তি নষ্ট হয় । এমতাবস্থায় চিত্তকে ধ্যেয়তে নিবিষ্ট করা সহজ হয় ।
 
এখন পাঁচটি বহিরঙ্গ সাধনার আলোচনা শেষ হলো এবার তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা যথা ধারণা ধ্যান ও সমাধি নিয়ে আলোচনা করা হবে ।
 
উল্লেখ্য , তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা পরষ্পর গভীর সম্পর্কযুক্ত । যেমন, সাধক ধারণাতে মনকে ঈশ্বরে বা কোনো দেশে স্থির করেন । ধ্যানে সেই দেশ অথবা ঈশ্বর সম্পর্কে গভীর এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবনা চালিয়ে যান, এবং সমাধিতে তিনি ধ্যানের চরম শিখরে আরোহণ করেন ।
 
তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
 
৬. ধারণা :—
 
ধারণা হলো , অদ্বিতীয় লক্ষ্যে বা অভিষ্টে মনকে পূর্ণরূপে স্থির রাখার অভ্যাস । ধারণাকে একাগ্রতার সাধনাও বলা হয় । ধ্যেয় তথা অভিষ্টতে মনকে একাগ্রতার সাথেই স্থির রাখতে হয় । কারণ একাগ্রতা ছাড়া যোগসাধনাতে সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয় ।
যোগদর্শনে বলা হয়েছে ,
 
দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা ॥
(যোগ০—৩/১)
অর্থ=মনকে কোনো দেশ (স্থান) বিশেষে বেধে রাখাকে ‘ধারণা’ বলা হয় ।
 
ব্যাখ্যা - নাভিচক্র , হৃদপদ্ম নাসিকাগ্র , ভ্রূমধ্য , জিহ্বাগ্র , প্রভৃতি হল শরীরের ভিতরের দেশ এবং পৃথিবীর প্রকৃতি থেকে শুরু করে মহাকাশ , চন্দ্র , সূর্য , নক্ষত্ররাজি ইত্যাদি হলো শরীরের বাইরের দেশ । এগুলোর মধ্যে যে বিষয়টি যোগীর অভিষ্ট তিনি শুধুমাত্র তাতেই একাগ্রতার সাথে মনকে স্থির করবেন । যোগী যদি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে ইচ্ছা করেন তবে একমাত্র ব্রহ্মতেই মন স্থির করবেন । সর্বোপরি অদ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তুতে একাগ্রতার সাথে মনকে স্থির করাই হলো ধারণা ।
 
“বিষয়বতী বা প্রবৃত্তিরুৎপন্না মনসঃ স্থিতিনিবন্ধনী”।।
(যোগ০— ১|৩৫)
অর্থ= গন্ধ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সম্বন্ধ দ্বারা উৎপন্ন অনুভূতি মনের স্থিরতাকে বেধে রাখে।
ব্যাখ্যা— নাসিকার অগ্রভাগে ধারণাকারী সাধকের যে দিব্য গন্ধের অনুভূতি হয় তাকে গন্ধপ্রবৃত্তি বলে, জিহ্বার অগ্রভাগে যে দিব্যরসের অনুভূতি হয় তাকে রসপ্রবৃত্তি বলা হয়। তালুতে যে দিব্যরূপের সাক্ষাৎকার হয় তাঁকে রূপপ্রবৃত্তি বলে। জিহ্বার মধ্যভাগে যে দিব্য স্পর্শের সাক্ষাৎকার হয় তাকে স্পর্শপ্রবৃত্তি ও জ্বিহ্বামূলে যে দিব্যশব্দের সাক্ষাৎকার হয় তাকে শব্দপ্রবৃত্তি বলা হয়। এসকল প্রবৃত্তির মাধ্যমে মনকে স্থির রাখা হয়। একইভাবে সূর্য চন্দ্র, প্রদীপ ইত্যাদি কোনো এক বিষয়ে ধারণা করলেও মনকে স্থির করা যায়।
 
এভাবে মন স্থির করলে তা সমাধির উচ্চ অবস্থায় যেতে সাহায্য করে।
এর পরের সূত্রে বলা হয়েছে,
 
“বিশোকা বা জ্যোতিষ্মতী”।।
যোগ০— ১|৩৬
অর্থ= শোকরহিত বা প্রকাশযুক্ত প্রবৃত্তি মনের স্থিরতাকে বেধে রাখে।
যোগশাস্ত্রে গ্রাহ্য, গ্রহণ এবং গ্রহীতা ভেদে ত্রিবিধ ধারণার কথা বলা হয়েছে । আবার তত্ত্বজ্ঞানময় ধারণা ও বৈষয়িক ধারণা ভেদে ধারণাকে দ্বিবিধ বলা হয় ।
 
৭. ধ্যান—
ধারণার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহই ধ্যান । যোগদদর্শনে ধ্যান সম্পর্কে বলা হয়েছে-
 
“তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্”।।
(যোগ০ ৩|২)
অর্থ= যে স্থানে ধারণা করা হয়েছে সেই স্থানে জ্ঞেয় বিষয়ক জ্ঞানের এক সমান অবস্থা চলতে থাকাকে ‘ধ্যান’ বলা হয় ।
 
ব্যাখ্যা - যে প্রদেশে ধারণা করা হয়েছে সেই প্রদেশ সম্বন্ধী জ্ঞানের এক সমান প্রবাহ চলতে থাকা এবং অন্য কোনোও বিষয়ের জ্ঞানকে সেখানে উপস্থিত না করাকে ‘ধ্যান' বলা হয়।
সহজভাবে বলা যায় ধারণায় যে বিষয়ে মনকে স্থির করা হয়েছে ধ্যানে সেই বিষয় নিয়ে ভাবনার প্রবাহকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে । ধ্যেয়র প্রতি ভাবনার ধারাকে নিরন্তর একভাবে চালিয়ে যেতে হবে । তখন শুধুমাত্র ধ্যেয় সম্পর্কেই গভীরভাবে ভাবতে হবে । অন্য কোনো বিষয়ের চিন্তাকে মনে বিন্দুমাত্র স্থান দেওয়া যাবে না ।
 
পরমতত্ত্বকে উপলব্ধি করার জন্য ধ্যান অত্যন্ত আবশ্যক । ধ্যানশক্তির বলে সাধক যে কোন বিষয় অবলম্বন করে ধ্যান করতে পারেন ।
 
যোগদর্শনে বলা হয়েছে-
‘যথাভিমতধ্যানাৎ বা।’- (যোগ-১/৩৯)
অর্থাৎ : নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান করো না কেন, তার প্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হবে‌ ।
 
ধ্যানের লক্ষণ
 
ধ্যানের লক্ষণ সম্পর্কে সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে, 
‘‘ধ্যানং নির্বিয়ং মনঃ ’’
সাংখ্যদর্শন ৬/২৫
অর্থ = মন হইতে বিষয় চিন্তা রহিত বা নিরােধ করার নাম ধ্যান। অর্থাৎ একনিষ্ট হয়ে ধ্যেয়র চিন্তার নাম ধ্যান।
 
ব্রহ্মজিজ্ঞাসু ব্যাক্তির ধ্যেয় একমাত্র ব্রহ্মই হওয়া উচিত। ধ্যানের সময় সকল জাগতিক বিষয় থেকে মুক্ত হয়ে ধ্যেয়র ভাবনায় যুক্ত হওয়া উচিত। ব্যাক্তি যতক্ষণ জাগতিক বিষয়ে মগ্ন থাকে ততক্ষণ সে পরমাত্মা থেকে বিচ্ছন্ন থাকে। এজন্য মনকে জাগতিক বিষয় থেকে মুক্ত করেই ধ্যানে যুক্ত করা উচিত।
ধ্যানের লক্ষণ সম্পর্কে গীতায় শ্রীভগবান বলেন,
 
‘‘যথা দীপাে নিবাস্থাে নেঙ্গতে সােপমা স্মৃতা।
যােগিননা যতচিত্তস্য যুঞ্জতে যােগমাত্মনঃ ॥’’
(গীতা— ৬/১৯)
অর্থ= যে প্রকার বায়ুপ্রবাহ শূন্য স্থানে প্রদীপ-শিখা বিচলিত হয় না, সেইরূপ উপমা পরমাত্মার ধ্যানে সংযতচিত্ত যােগীর বশীভূত চিত্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
 
✅উল্লেখ্য —ধারণা ও ধ্যান পরষ্পর গভীর সম্পর্কযুক্ত । কারণ ধারণায় ইষ্টতে মন স্থির হয় এবং ধ্যানে সেই স্থিরতা অটুট থাকার সাথে সাথে, ইষ্টের অবিচ্ছিন্ন চিন্তায় যোগীর মন তন্ময় থাকে । ধারণায় সিদ্ধিলাভ না হলে ধ্যানে পৌছানো সম্ভব নয়।
 
(৮) সমাধি— সম্+আঙ্ পূর্বক নিষ্পন্ন "ধা" ধাতুর সাথে "কিঃ" প্রত্যয় যোগ করে সমাধিঃ শব্দ কে ব্যাসমুনি " যোগ " এর পর্যায় বানিয়েছেন যেটা "অঙ্গ " এবং " অঙ্গীর " অভেদ সূচক । যোগের পূর্ণতা হলো সমাধি, যা চিত্তের ধর্ম । এই দিকে সমাধির পরিভাষা সম্পর্কে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন যে, নিজের ধ্যানাত্মকরূপ থেকে রহিত কেবল ধ্যেয়রূপ দ্বারা প্রতীত ধ্যানের নামই সমাধি । বিগ্রহরূপেতে "বিগ্ন" এর নিবারণ করে মনকে একাগ্র করার নাম সামধিঃ
 
‘তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ’- (যোগসূত্র : ৩/৩)
অর্থাৎ : ধ্যান যখন ধ্যেয়ের স্বভাবের আবেশে জ্ঞানাত্মক স্বভাবশূন্য হয় তখন তাকে সমাধি বলা হয়।
 
ব্যাখ্যা - ধ্যান কালে ‘ধ্যাতা' অর্থাৎ ধ্যানকারী; ‘ধ্যান' অর্থাৎ যে জ্ঞান দ্বারা ধ্যেয় বিষয়ের গবেষণা করা হয় সেই জ্ঞান এবং ‘ধ্যেয়’ অর্থাৎ যে বিষয়ের গবেষণা করা হয় সেই পদার্থ। এই তিনটি ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ভাসিত হয়। কিন্তু সমাধি অবস্থায় কেবল ‘ধোয়'-এর অর্থাৎ পদার্থের স্বরূপ মুখ্য রূপে প্রকাশিত হয়। সমাধি অবস্থায় 'ধ্যাতা’ এবং, ‘ধ্যান গৌণ হয়ে যায় অর্থাৎ আমার দ্বারা ধ্যান করা হচ্ছে এবং ওই পদার্থের জ্ঞান এই দুটি শূন্যের মতাে হয় এবং পদার্থের স্বরূপ মুখ্য রূপে বিদ্যমান থাকে; এই অবস্থাকে সমাধি' বলা হয়। যেমন- কোনাে ছােট্ট শিশুকে মধু চাটালে সে মধুর জ্ঞান এবং আমি মধুকে চাটছি এই দুটি যেমন সে জানতে পারে না কিন্তু মধুর স্বাদেই সে নিমগ্ন হয়ে যায় । সেইরকম সমাধি অবস্থাকে জানা উচিত ।
 
সহজভাবে বললে তখন ধ্যান-কর্তা, ধ্যানের বিষয় এবং ধ্যান প্রক্রিয়া এই তিনটি মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে যায় । সমাধির অবস্থায় অবস্থায় ধ্যানকর্তার নিজস্ব কোনাে অনুভূতি থাকে না; বরং ধ্যেয়র সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
 
অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে.
 
(I) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (II) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
 
(I) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি—
সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যকরূপে জ্ঞাত। অর্থাৎ যে সমাধির অবস্থায় নিজ ধ্যেয়কে সম্যকভাবে জানা যায় তাকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে। সম্প্রজ্ঞাত সমাধির বিষয়ে যোগদর্শনে বলা হয়েছে
‘বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ’- (যোগ০—১/১৭)
অর্থ= বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা নামক অবস্থাসমূহের অনুভূতিকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।
 
1️⃣ স্থূল বাহ্যবস্তু,
যথা- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূত,
2️⃣স্থূল আন্তরবস্তু,
যথা- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়- যথা মুখ, হাত, পা, পায়ু, লিঙ্গ। এবং মন সর্বমোট একাদশ ইন্দ্রিয়।
3️⃣ সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু,
যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহ
4️⃣ সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু,
যথা- অহং ও বুদ্ধি।
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু তথা অবলম্বন ভেদে সম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে চারপ্রকারে ভাগ করা হয়েছে যথা - বিতর্ক, বিচার,আনন্দ ও অস্মিতা।
 
এখানে বিতর্ক’-এর অর্থ হল চিত্তের নিজ ধ্যেয় রূপ বিষয়ে স্থুল ভূত পৃথিবী-শরীর-বৃক্ষ ইত্যাদির সাক্ষাৎকার হওয়া। সম্প্রজ্ঞাত সমাধির প্রথম স্তরে স্থুল বাহ্যবস্তুকে বা কোনো জড় বস্তুকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
 
বিচার’-এর অর্থ হল চিত্তের নিজ ধেয় রূপ বিষয়ে গন্ধতন্মাত্রা, রসতন্মাত্রা, রূপতন্মাত্রা, সম্পৰ্শতন্মাত্রা এবং শব্দতন্মাত্রা-এর সাক্ষাৎকার হওয়া। এ অবস্থায় স্থুল আন্তরবস্তু বা একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
 
আনন্দ’-এর অর্থ হল মহৎতত্ত্ব অহংকার,
মন এবং ইন্দ্রিয়তে চিত্ত একাগ্র করলে; এইসব বস্তু সত্ত্বগুণ প্রধান হওয়ায় এগুলিকে
সাক্ষাৎকার করার সময় সুখের (আনন্দের) অনুভূতি হওয়া। এ অবস্থায় সূক্ষ বাহ্যবস্তুকে যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
অস্মিতা'-এর অর্থ হল জীবাত্মার  সাক্ষাৎকার হওয়া । এই অবস্থায় নিজের অহং ও বুদ্ধিকে অবলম্বন করতে হয়।
উল্লেখ্য —বিতর্ক বিচার আনন্দ ও অস্মিতা এই চারটি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধির একেকটি স্তর যেখানে বিতর্ক হলো প্রথম ও অস্মিতা হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ স্তর।
 
সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে উৎকর্ষ লাভ করলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। সম্প্রজ্ঞাত ও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির মধ্যকার পার্থক্য হলো — সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো অবলম্বনযুক্ত এবং অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো অবলম্বন বিহীন। যোগী ব্যাক্তি অবলম্বনকে ধরে সমাধি করতে করতে অবলম্বন ছেড়ে দিয়ে অভীষ্টে লীন হন।
 
(ii) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
 
শাস্ত্রে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থে বলা হয়েছে—
‘ন কিঞ্চিৎ প্রজ্ঞায়তে ইতি অসম্প্রজ্ঞাতঃ’।
অর্থাৎ : যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে—
 
‘বিরামপ্রত্যয়াভ্যাসপূর্ব্বঃ সংস্কারশেষোহন্যাঃ’- (যোগ০— ১|১৮)
অর্থ= সকল বৃত্তির নিরােধের যে কারণ পরবরাগ্য সেই পরবৈরাগ্যের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তির দ্বারা যে সমাধি হয় এবং যেখানে কেবল সংস্কারমাত্র অবশিষ্ট থাকে তাকে ‘অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি' বলা হয়।
 
ব্যাখ্যা - চিত্তের সকল বৃত্তি অস্ত হয়ে যাওয়ার পর যেখানে সংস্কারমাত্র শেষ থাকে, এরকম অবস্থাকে ‘অসম্প্ৰজ্ঞাত সমাধি' বলা হয়। এই সমাধির কারণ হল  ‘পরাবৈরাগ্য। অবলম্বন সহিত অভ্যাস এই সমাধির সাধন হয় না, এই জন্য বৃত্তি নিরোধের যে কারণ পদার্থহীন পরবৈরাগ্য তাকেই সাধন রূপে গ্রহণ করা হয় । যেহেতু পরবৈরাগ্য পদার্থহীন হয়ে থাকে ।
 
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে এসে জীবাত্মার এবং পরমাত্মার সাক্ষাৎকার হয় । জীবাত্মার সাক্ষাৎকার যদিও সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতেও হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে জীবাত্মার সাক্ষাৎকার আরােও সুস্পষ্ট ভাবে হয় ।
সংস্কারমাত্র শেষ কী ? সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পৌঁছে গেলে নিরােধ অবস্থার সংস্কার বর্তমান থাকে এবং ব্যুত্থান তথা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সংস্কার সুপ্ত রূপে বিদ্যমান থাকে। যখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি ভঙ্গ হয়ে যায় তখন সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সংস্কার কার্য করা শুরু করে দেয়। যখন সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ভঙ্গ হয়ে যায় সেই অবস্থায় ব্যুত্থান অর্থাৎ সাংসারিক বৃত্তির সংস্কার প্রকট হয়ে যায়। অতএব এর দ্বারা এটা সিদ্ধ হয়ে যায় যে- সম্প্রত সমাধি হয়ে গেলেও অন্য অবস্থার সংস্কার সুপ্ত রূপে বিদ্যমান থাকে, একেই সংস্কারমাত্র শেষ জানা উচিৎ। প্রসঙ্গত এটাও জানা উচিৎ যে- অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়ে গেলেই মােক্ষ হয়ে যায় না। চিত্তে বিদ্যমান পাঁচটি ক্লেশও দগ্ধবীজ হওয়া অনিবার্য।
 
যোগদর্শনে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকেও দুই’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং উপায়প্রত্যয়।
এ বিষয়ে যোগদর্শনে বলা হয়েছে।
 
‘ভব প্রত্যয়োবিদেহপ্রকৃতিলয়ানাম্’।-
(যোগ০-১|১৯)
অর্থ= বিদেহ এবং প্রকৃতিলয় নামক যোেগীদের 'ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়।
ব্যাখ্যা- । ‘ভব’ শব্দের অর্থ হল সংসার এবং প্রত্যয়'-এর অর্থ হল কারণ। অর্থাৎ যে সমাধিতে এই সংসার এবং সংসারের জ্ঞান কারণ হয়ে থাকে সেই সমাধিকে ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। সংসার এবং সংসারের জ্ঞান অর্থাৎ যােগী সংসারের ঘটনা গুলিকে দেখে তাঁর পূর্বজন্মের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে যায়। যার ফলে তাঁৱ বৈরাগ্য চরমে উঠে যায়। এখন তিনি সংসারের সমস্ত পদার্থকে নাশ মনে করেন এবং এই সমস্ত পদার্থের তা ঈশ্বরকে মনে করে সাধনা করেন। এই ‘ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রতি সমাধি দুই প্রকারের যোগীদের হয়ে থাকে -
 
(১) বিদেহ নামক যােগী—
বিদেহ নামক যােগীদের ‘ভবপ্রত্যয়’ নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। ‘বিদেহ’-এর অর্থ হল শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধির অভিমান হতে রহিত হওয়া এবং ঈশ্বরকে এই সকল পদার্থের স্বামী মনে করে উপাসনা
করা। এই অবস্থা প্রাপ্তকারী যােগীকে ‘বিদেহ’ যােণী বলা হয়। তিনি নিজের সংস্কারমাত্র অবশিষ্ট চিত্ত দ্বারা সমাধিতে কৈবল্য পদের মত অনুভব করতে-করতে নিজের সংস্কারের অনুরূপ ফলকে ভােগ করে সমাপ্ত করেন।
 
(২) প্রকৃতিলয় নামক যােগী। প্রকৃতিলয় নামক যােগীদেরও ‘ভবপ্রত্যয়
নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। প্রকৃতিলয়’-এর অর্থ হল তন্মাত্রা, অহংকার, মহৎ ও এবং প্রকৃতির স্বরূপকে গভীরতা পূর্বক জ্ঞান করে এই পদার্থের দোষকে জেনে; এগুলিকে উপাস্য না মনে করে, ঈশ্বরের উপাসনা করা। এই অবস্থা প্রাপ্তকারী যােগীকে ‘প্রকৃতিলয়’ যোগী বলা হয়। তিনিও বৌদ্ধিক ভাবে অকৃতকৃত্য চিত্তকে প্রকৃতিতে বিলীন করে সমাধিতে কৈবল্য পদের মত অনুভব করেন। চিত্ত অধিকারের জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি সমাধি অবস্থায় অবস্থিত থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু সমাধি ভঙ্গ হয়ে গেলে সেই অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। পুনরায় যখন সমাপি লাগান তখন তিনি পুনরায় ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করেন ।
 
উপায়প্রত্যয় নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি কিভাবে হয়, এটির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে
 
“শ্ৰদ্ধাবীর্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্বক ইতরেষাম”
(যোগ০— ১|২০)
অর্থ = বিদেহ এবং প্রকৃতিলয় যােগীদের হতে ভিন্ন যােগীদের অর্থাৎ উপায়প্রত্যয় নামক যােগীদের অসপ্রজ্ঞাত সমাধি শ্রদ্ধা (রুচি), বীর্য (উৎসাহ), স্মৃতি (যােগ সম্বন্ধী পঠিত এবং এ বিষয়ের সারণ), সমাধি (একাগ্রতা) এবং প্রজ্ঞা (ঋতম্ভবা প্রজ্ঞা) পূর্বক হয়।
 
ব্যাখ্যা - ‘উপায় শব্দের অর্থ হল অভ্যাস। উপায়প্রত্যয় নামক অসম্প্রপ্জ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত যােগীরা যে সকল সাধনগুলির দ্বারা সমাধিকে প্রাপ্ত করেন সেগুলি হল শ্রদ্ধা অর্থাৎ চিত্তের অভিরুচি অর্থাৎ সত্যকে ধারণ করার তীব্র ইচ্ছা। এই শ্রদ্ধা মায়ের মত কল্যাণকারিণী হয়ে যােগীকে রক্ষা করে। সেই শ্রদ্ধালু বিবেক অভিলাষী যােগীকে বীর্য’ অর্থাৎ বল (উৎসাহ) প্রাপ্ত হয়। এই ধরনের বলযুক্ত যােগীর স্মৃতি উপস্থিত হয়; স্মৃতি অর্থাৎ পূর্বকৃত যােগ সম্বন্ধী অনুভবের স্মৃতি উপস্থিত হয়। স্মৃতি উপস্থিত হলে চঞ্চল চিও 'সমাধি' অর্থাৎ চিও সমাহিত অর্থাৎ একাগ্র হয়ে যায় চিত্ত স্থির হয়ে গেলে যােগীকে ‘প্রজ্ঞা' অর্থাৎ পরম উৎকৃষ্ট বুদ্ধি প্রাপ্ত হয়; যার দ্বারা সেই যােগী বস্তুকে যথার্থভাবে জানতে পারেন। এই বিবেক জ্ঞানের অভ্যাস এবং এই বিবেক জ্ঞানের বিষয় হতে পরবৈরাগ্য হয়ে গেলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির সিদ্ধিলাভ হয়।
 
সমাধি সিদ্ধির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে
 
‘তীব্রসংবেগানামাসন্নঃ।’(যোগ০ —১|২১)
অর্থ উচ্চ বিবেক বৈরাগ্য এবং অভ্যাস যুক্ত যোগীদের শীঘ্রই সমাধি লাভ ও সমাধি ফলের প্রাপ্তি হয়
 
‘মৃদুমধ্যাধিমাত্রত্বাত্ততোহপি বিশেষঃ।’-
(যোগ০ -১|২২)
অর্থ= উচ্চ বিবেক বৈরাগ্য অভ্যাসকারী যোগীদের মধ্যেও নিম্ন মধ্য ও অধিক ভেদ (পার্থক্য) হওয়ায় অপেক্ষাকৃত যে অধিক বিবেক বৈরাগ্য ও অভ্যাসের অধিকারী তাঁর সমাধি লাভ এবং ফলের প্রাপ্তি সবার আগে হয় ।
 
✅ তবে শুধুমাত্র উচ্চ বিবেক, অভ্যাস ও বৈরাগ্য এসবের উপর নির্ভর করে থাকলেই সমাধির সিদ্ধি দ্রুত হয় না । সমাধিকে সিদ্ধির মার্গে আরও বেগবান করার জন্য মহর্ষি পতঞ্জলি আরো কয়েকটি বিধানের উল্লেখ করেছেন । যথা
 
↘️
‘ঈশ্বর প্রণিধানাৎ বা।’-
(যোগ০ -১|২৩)
অর্থ= ঈশ্বর প্রণিধানের দ্বারা আরও শীঘ্র সমাধি ফলের লাভ হয়ে থাকে।
 
↘️
‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।’-
‘তজ্জপস্তদর্থ ভাবনম্’
(যোগ০-১|২৭-২৮)
অর্থ= ঈশ্বরের নাম প্রণব বা ও৩ম্ । এই নামের জপ এবং ঈশ্বরের মহান গুণসমূহের চিন্তন করা উচিত ।
 
✅ উল্লেখ্য— ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটি যোগাঙ্গ হচ্ছে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন । এ তিন সাধনাকে একত্রে সংযম বলা হয় । যেমন যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
‘ত্রয়মেকত্র সংযমঃ’।
(যোগ০ -৩/৪)
পূর্বোক্ত বহিরঙ্গ সাধনার যম এবং এই সংযমের মধ্যে পার্থক্য হলো,, বহিরঙ্গ সাধনার যম হলো ইন্দ্রিয়জয়ের সাধনা এবং এই সংযম হলো চিত্তস্থৈর্যের এবং কৈবল্য প্রাপ্তির সাধনা ।
এ সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে
 
‘ত্রয়মন্তরঙ্গং পূর্ব্বেভ্যঃ’।
(যোগ০ ৩/৭)
অর্থাৎ পূর্ববর্ণিত সাধনার চেয়ে এই সংযম অন্তরঙ্গ।
 
‘তদপিবহিরঙ্গং নির্বীজস্য’।
(যোগ০-৩/৮)
অর্থ= সেই অন্তরঙ্গ সাধনা গুলোও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির পক্ষে বহিরঙ্গ সাধনা।
ব্যাখ্যা— ধারণা ধ্যান ও সমাধিকে নির্বীজ বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ক্ষেত্রে বহিরঙ্গ বলা হয়েছে কারণ এ তিনটি সরে গেলেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির সিদ্ধিলাভ হয় ।
 
সংযমে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে তার সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে ।
 
‘তজ্জয়াৎ প্রজ্ঞালোকঃ’।
(যোগ০-৩/৫)
অর্থ= সেই সংযমে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে সমাধি প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটে ।
 
সমাপ্ত । 
 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)