দৈনিক বেদবাণী


এই সমগ্র সংসার নিরোগ এবং শুভচিন্তা যুক্ত হোক । যজুর্বেদ ১৬.৪                    সূর্য-এর আলোয় স্বয়ং আলোহীন চাঁদ আলোকিত হয় । ঋগ্বেদ ৫.৪০.৫                    প্রশংসনীয় সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মাতৃভূমি— এই ত্রয়ী সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করে। ঋগ্বেদ ১.১৩.৯                    উত্তম জীবন লাভের জন্য আমাদের জ্ঞানীদের সাহচর্যে চলা উচিৎ। ঋগ্বেদ ১.১২.১৬                    যে ব্যক্তি সম্পদ বা সুখ বা জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে দান করে, সে-ই প্রকৃত মিত্র। ঋগ্বেদ ২.৩০.৭                    মানুষ কর্ম দ্বারাই জগতে মহত্ত্ব ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৩.৩৬.১                    হে পতি! তোমার স্ত্রীই গৃহ, স্ত্রীই সন্তানের আশ্রয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৩.৪                    পরমাত্মার নিয়ম বিনষ্ট হয় না; তা অটুট, অচল ও অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদ ৩.৫৪.১৮                    এই ধর্মের মার্গই সনাতন, এই পথে চলেই মানবগণ উন্নতি লাভ করে। ঋগ্বেদ ৪.১৮.১                    পরমাত্মার নিকট কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়। সকল মানুষই সমান এবং পরস্পরের ভ্রাতৃস্বরূপ। ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫                    যে ব্যক্তি অকারণে অন্যের নিন্দা করে, সে নিজেও নিন্দার পাত্র হয়। ঋগ্বেদ ৫.২.৬                    নিশ্চিতরূপে এই চতুর্বেদ কল্যাণপ্রদায়িনী এবং মানবকে জ্ঞান প্রদান করে ধারণকারিণী। ঋগ্বেদ ৫.৪৭.৪                    বীর মানবের জন্য পর্বতও সুগম হয়ে যায়। ঋগ্বেদ ৬.২৪.৮                    আমরা অন্যের সঞ্চিত পাপের কর্মফল ভোগ করি না। ঋগ্বেদ ৬.৫১.৭                    হে মিত্রগণ! ওঠো— উদ্যমী হও, সাবধান হও এবং এই সংসাররূপী নদীকে অতিক্রম করো। ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৮







অষ্টাঙ্গযোগ - ২য় পর্ব [ নিয়ম - আসন - প্রাণায়াম ]

সত্যান্বেষী
0

 


 
  • ২. নিয়ম : -
একজন যোগাভ্যাসী ব্যাক্তির জন্য যা যা অবশ্যই পালনীয় তা হলো নিয়ম । যোগাভ্যাসী ব্যাক্তির জন্য পালনীয় নিয়ম পাঁচটি । যথা— 
 
শৌচসন্তোষতপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ।
(২/৩২)
অর্থাৎ-শৌচ , সন্তোষ , তপস্যা , স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান এই পাঁচ বিষয়কে একত্রে নিয়ম বলা হয় ।
পাঁচ প্রকার নিয়মের বর্ণনা-
 
(i) শৌচ — ‘শৌচ’ শব্দের অর্থ শুচিতা বা শুদ্ধি বা পবিত্রতা । এই পবিত্রতা দুই প্রকারের যথা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ । ভালোভাবে স্নান করা ও নিজে পরিচ্ছন্ন থাকা, বাসস্থান পরিচ্ছন্ন রাখা , সাত্ত্বিক আহার করা ইত্যাদির মাধ্যমে বাহ্যিক এবং ও নির্মল বুদ্ধি , সৎ চিন্তা , অহিংসা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্তঃকরণের বা মনের পবিত্রতা লাভ হয় । যোগসাধনার জন্য দেহ ও মন উভয়েরই পবিত্রতা আবশ্যক ।
 
✅ শৌচের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে -
 
'শৌচাৎস্বাঙ্গজুগুপ্সা পরৈরসংসর্গঃ' ।।
(যোগ০— ২|৪০)
অর্থ= বাহ্য এবং আন্তরিক শুদ্ধি হয়ে গেলে নিজের অঙ্গ হতে ঘৃণা উৎপন্ন হয় এবং অন্যের শরীর হতেও আসক্তি রহিত হয়ে যায় ।
 
(ii) সন্তোষ— সতত প্রসন্নচিত্ত ও সন্তুষ্ট থাকাকেই সন্তোষ বলে । যোগীর পক্ষে প্রাপ্তিতে অতি উল্লসিত কিংবা অপ্রাপ্তিতে ভারাক্রান্ত হওয়া অনুচিত । যোগী ব্যাক্তি সবসময় সন্তুষ্ট, প্রসন্ন ও প্রফুল্ল মনে থেকে সাধনায় মনোনিবেশ করবেন ।
 
✅ সন্তোষের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে ,
 
‘সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ’ ॥
(যোগ০ -২/৪২)
অর্থ= পূর্ণ সন্তোষ থেকে উত্তম সুখ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠসুখ লাভ হয় , যে সুখের অপর নাম দিব্যসুখ‌ ।
 
(iii) তপঃ— ‘তপঃ’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা বা ব্রত । কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্যাদি বেদমূলক ব্রত পালন করাকেই বলে তপস্যা‌ । লক্ষণীয় যে , এখানে ব্রত বলতে শুধুমাত্র বৈদিক শাস্ত্রনির্ধারিত ব্রতকেই বুঝতে হবে । অবৈদিক কোনো আচার অনুষ্ঠান ব্রত বলে গণ্য হবে না । সর্বদা সত্যে অবস্থান করাই ব্রত । ঋতবানা নি ষেদতুঃ সাম্রাজ্যায় সুক্রতু ব্ৰতা ক্ষত্রিয়া ক্ষত্রমাশতুঃ ॥ঋগ্বেদ- (৮|২৫|৮) অর্থাৎ ‌ব্রত পালন ও সত্যাচরণ দ্বারা ক্ষত্রিয়গণ ক্ষাত্রতেজ প্রাপ্ত হয় । তারপর শুভ কর্ম সম্পাদন করে সাম্রাজ্যের জন্য প্রযত্ন করে ।
 
রতং চরিষ্যামি তৎশকেয়ং তন্মৈ রাধ্যতাম্।ইদমহমনৃতাৎ সত্যমৃপৈমি।।
(যজুর্বেদ ১।৫)
পদার্থঃ (ব্রতপতে) হে সত্যভাষণাদি ধর্মের অধিষ্ঠাতা (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ পরমেশ্বর ! (ব্রতম্ চরিষ্যামি) আমি সর্বদা বৈদিক কর্মের অনুষ্ঠান করব । (ইদম্) আমি এই ব্রত ধারণ করছি যে (অহম্) আমি (অনূতাৎ) অসত্যকে ত্যাগ করে (সত্যম্) সদা সত্যকে (উপৈমি) গ্রহণ করব । হে পরমেশ্বর ! আমায় কৃপা করুন (তৎ শকেয়ম্) আমি যেন তা যথাযথভাবে পালন করতে পারি এবং (মে তৎ রাধ্যতাম্) আমার সেই সত্যের ব্রত যেন উত্তমপ্রকারে সিদ্ধ হয়।
 
✅ তপস্যার ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে
কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধিক্ষয়াত্তপসঃ॥
(যোগ০— ২|৪৩)
অর্থ= তপের অনুষ্ঠান দ্বারা বাত , পিত্ত এবং কফের বিষমতা হতে উৎপন্ন বিকার , তমোগুণ হতে উৎপন্ন আলস্য ইত্যাদি দোষের নাশ হওয়ায় শরীর স্বাস্থ্য , বলবান্ , স্বচ্ছ এবং স্ফূর্তিমান্ হয়ে যায় তথা ইন্দ্রিয়তে বিশেষ সামর্থ্য উৎপন্ন হয় । যেমন- দূরদৃষ্টি হওয়া , স্পষ্ট দেখতে-শুনতে পাওয়া ইত্যাদির সামর্থ্য বেড়ে যায় ।
 
(iv) স্বাধ্যায়— 'স্বাধ্যায়’ শব্দের অর্থ অধ্যয়ন ও জপ । প্রণব বা ওঁকারের জপ এবং বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রকে পাঠ করা এবং যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করাকে বলে স্বাধ্যায় । স্বাধ্যায়ের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান লাভ । যে জ্ঞানের জ্যোতিতে যোগীর জীবন আলোময় হয়ে উঠে । স্বাধ্যায়ের ফলে অর্জিত জ্ঞান যোগীর আচার আচরণে প্রতিভাত হয়ে উঠে । 
 
✅ স্বাধ্যায়ের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
 
‘স্বাধ্যায়াদিষ্ট দেবতা সম্প্রযোগঃ’।
(যোগ০ —২|৪৪)
অর্থ= স্বাধ্যায় সিদ্ধ হলে , ইষ্টদেবতা (ঈশ্বরের) সন্দর্শন হয়ে থাকে ।
 
ব্যাখ্যা— স্বাধ্যায় অর্থাৎ বেদাদি সত্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করার ফলে ঈশ্বরকেও সম্যকভাবে জানতে পারা যায় বা ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করা যায় ।
 
(v) ঈশ্বর প্রণিধান— সতত ঈশ্বরচিন্তা করা , ঈশ্বরে কর্ম ও আত্মসমর্পণ করা , বেদে বর্ণিত ঈশ্বরের আজ্ঞা মনে প্রাণে পালন করা , এবং ঈশ্বরের প্রতি অনন্য ভক্তি ও প্রেমে নিমগ্ন থাকা ইত্যাদিকে ঈশ্বর প্রণিধান বলা হয় ।
 
✅ ঈশ্বর প্রণিধানের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে ,
 
সমাধিসিদ্ধিরীশ্বরপ্রণিধানাৎ ।।
(যোগ০ —২|৪৫)
অর্থ= ঈশ্বর প্রণিধান দ্বারা শীঘ্রই সমাধিতে সিদ্ধিলাভ হয় ‌।
 
(৩) আসন: —
যোগদর্শনে আসন সম্পর্কে বলা হয়েছে 
 
"স্থিরসুখমাসনম্" ॥
(যোগ০—২/৪৬)
অর্থ = যে অবস্থায় অবস্থিত থাকলে শরীর স্থির এবং সুখযুক্ত হয় তাকেই আসন বলা হয় ।
 
ব্যাখ্যা = যোগাভ্যাসী যে অবস্থায় বসে সুখের অনুভব করেন তাকেই ‘আসন’ বলা হয় । যে আসনে বসে ব্যাথা অনুভূত হয় এবং ব্যাথার দিকে মন চলে যায় সে আসনে বসে যোগ অনুশীলন করা উচিত নয় ।
আসনের পদ্ধতি সম্বন্ধে গীতায় শ্রীভগবান বলেন,
 
সমং কায়শিরােগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলােকয়ন৷ (গীতা—৬/১৩)
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ।
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ॥
(গীতা— ৬/১৪)
অর্থ:- মেরুদণ্ড , মস্তক , গ্রীবা সমান ও অচলভাবে ধারণ করে স্থির হয়ে নিজের নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি রেখে অন্য দিকে না তাকিয়ে ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত হয়ে ; ভয় ছেড়ে ও প্রশান্ত-চিত্ত যােগী সতর্কতার সাথে মনকে সংযত করে আমাতেই চিত্ত-যুক্ত মৎপরায়ণ হয়ে স্থিত হবে ।
অনুরুপ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও বলা হয়েছে ,
 
যোগ তত্ত্ববিদ জ্ঞানী সাধক নিজের মস্তক গ্রীবা ও বক্ষ । শরীরের এই তিন অংশ সমুন্নত করে শরীরকে সমভাবে স্থাপন করবেন ।
(শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ ২|৮)
 
আসন নানা প্রকারের রয়েছে , যেমন- সুখাসন , পদ্মাসন , ভদ্রাসন , বীরাসন , স্বস্তিকাসন , দণ্ডাসন , বৃক্ষাসন , ইতাদি । এতোসব আসন থাকলেও সব আসনে স্থির হওয়া দুঃসাধ্য এবং সবার জন্য অসাধ্য ব্যাপার । তাই যে আসনে যোগী দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে বসতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাঁর জন্য সে আসনই গ্রহণ করা উচিত । এ কারণে সূত্রকার এই সূত্রে কোনো আসনের কথা উল্লেখ না করে শুধু বলেছেন "স্থিরসুখমাসনম্"। অর্থাৎ যে ব্যাক্তি যে আসনে সুখে এবং স্থির হয়ে বসতে পারবেন ; সে আসনই তাঁর জন্য উপযুক্ত ।
 
➡️ যদি কঠিন যোগাসনেও কেউ স্থির হতে পারেন তবে সে আসনও তাঁর জন্য উপযুক্ত হবে ‌।
আসন দুই প্রকারে সিদ্ধ হয় ‌। এ সম্পর্কে যোগ দর্শনে বলা হয়েছে
 
প্রযত্নশৈথিল্যান্তসমাপ্তিভ্যাম্ ॥
(যোগ০— ২|৪৭)
অর্থ= ১. প্রযত্নে শীথিলতা এনে , ও ২. অনন্তে চিত্ত নিবিষ্ট করলে আসনে সিদ্ধিলাভ হয় ।
 
এখানে‌ ,
 
➡️ প্রযত্নের শীথিলতা মানে =আসনে বসার পর শরীর সম্বন্ধীয় সকল চেষ্টাকে ত্যাগ করে দেওয়াকে বোঝানো হয়েছে‌ ।
➡️ আর অনন্তে চিত্ত নিবিষ্ট করা = অর্থাৎ ঈশ্বরচিন্তায় তন্ময় হওয়াকে বুঝানো হয়েছে ।
 
আসনে সিদ্ধিলাভ করলে যোগী যা প্রাপ্ত হন এ সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে ,  

ততাে দ্বানভিঘাতঃ || ৪৮ ৷
অর্থ= আসনের সিদ্ধিলাভ হয়ে গেলে শীত-উষ্ণ , ক্ষুধা-পিপাসা ইত্যাদি দ্বন্দ্ব সেই যোগীকে একটি সীমা পর্যন্ত বাধিত করে না ।
 
ব্যাখ্যা -আসনের সিদ্ধিলাভের ফলে যোগী শীতোষ্ণ , ক্ষুধা-পিপাসায় বাধিত হয় না । তার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে- বরফ দিয়ে তাঁর শরীরকে ঢেকে দিলেও তাঁর কোনও অনুভূতি হয় না অথবা আগুনের মধ্যে তাঁকে বসিয়ে দিলেও তাঁর শরীর জ্বলে না । কিন্তু একটি উচ্চতর গ্রহণ সীমা পর্যন্ত সে দ্বন্দ্ব গুলিকে সহন করতে তিনি সক্ষম হন । যোগীর সহ্যসীমা সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চ হয় । এটা আসন সিদ্ধিলাভেরই ফল ।।
 
একেকটি আসন অনুশীলনের ফলে শরীরে নানা রকম উপকার সাধিত হয় । এভাবে একেকটি আসনের আছে বহুবিধ উপকারিতা । আসন এবং আসন প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক । প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা আসনের প্রভাবে সুস্থ সবল ও নিরোগ দেহ নিয়ে দীর্ঘ আয়ু ভোগ করতেন । এখনও বিশ্বব্যাপী আসন অনুশীলন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে এবং আসনের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরে আসন অনুশীলনকারীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে বাড়ছে ।
 
⚠️⚠️ সতর্কতা— কঠিন যোগাসন অনুশীলনের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ শিক্ষক বা গুরুর পরামর্শ গ্রহণ এবং গুরুর সান্নিধ্যে থেকে নিজের দৈহিক সামর্থ্য অনুযায়ী অনুশীলন করা উচিত । নাহলে অবৈজ্ঞানিকভাবে আসন অনুশীলন করলে নানাভাবে অসুস্থ কিংবা আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
 
(৪) প্রাণায়াম :—
 
শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের আয়ত্তে আনা-কে প্রাণায়াম বলা হয় ।
প্রাণায়াম সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে ,
 
তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়াের্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ৷৷ (২/৪৯)
অর্থ = আসনের সিদ্ধি লাভ হয়ে গেলে শ্বাস এবং প্রশ্বাসের গতিকে যথাশক্তি নিরুদ্ধ করে দেওয়াকে 'প্রাণায়াম' বলা হয় ।
 
ব্যাখ্যা—এখানে আসন সিদ্ধির পরে প্রাণায়াম অনুশীলন করার কথা বলা হয়েছে । অর্থাৎ আসন সিদ্ধি না হলে প্রাণায়াম অনুশীলন করা যাবে না ।
 
প্রাণায়ামের তিনটি ভেদ হল—‘‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তি…. যোগ০ -(২/ ৫০)
অর্থাৎ প্রাণায়াম তিন প্রকারের যথা- বাহ্যবৃত্তি , আভ্যন্তর বৃত্তি ও স্তম্ভবৃত্তি ।
 
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম সম্পর্কে গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন ,
 
‘‘অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেঽপানং তথাঽপরে।
প্রাণাপানগতী রুদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ ॥ ’’
অর্থ = কেউ অপান বায়ুতে প্রাণ-বায়ুকে আহুতি প্রদান করেন । অপর কেউ প্রাণ ও অপানের গতিকে রোধ করে প্রাণায়াম পরায়ণ হন ।
 
✅ ব্যাখ্যা— এখানে প্রাণ = শ্বাসবায়ু/ অভ্যন্তরবৃত্তি/ পূরক । অপান = প্রশ্বাসবায়ু/ বাহ্যবৃত্তি/ রেচক । প্রাণ ও অপানের গতিকে রোধ করা বলতে = স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভককে বলা হয়েছে ।
 
তিন প্রকার প্রাণায়ামের বর্ণনা—
 
১) অভ্যন্তরবৃত্তি— প্রাণবায়ুকে গ্রহণ করে অভ্যন্তরদেশে যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক আটকে রাখা যায় ততক্ষণ আটকে রাখতে হবে ।
এ প্রক্রিয়ায় শ্বাস গ্রহণ করা হয় বলে এর অন্য নাম হয়েছে পূরক ।
২) বাহ্যবৃত্তি— মানে প্রাণবায়ুকে বাইরে বের করে যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক দম আটকে রাখা যায় ততক্ষণ আটকে করে রাখতে হবে । এ প্রক্রিয়ায় শ্বাসকে পরিত্যাগ করা হয় বলে , এর অন্য নাম হলো রেচক ।
৩) স্তম্ভবৃত্তি— স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ না করে , অর্থাৎ রেচক-পূরক কিছুই না করে প্রাণবায়ুকে কুম্ভের ভেতরে যেমনি রাখা হয় সেভাবে রুদ্ধ বা স্তম্ভিত করে রাখাকে বলা হয় স্তম্ভবৃত্তি । দেহকে কুম্ভের মতো ব্যাবহার করে বায়ুকে স্তম্ভিত করা হয় বলে ‘স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামের অপর নাম হল ‘কুম্ভক’ ।
 
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম অনুশীলনের বিধি
 
‘‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তির্দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ’’ ॥ (২/৫০ সম্পূর্ণ সূত্র)
অর্থাৎ ত্রিবিধ প্রাণায়াম , যথা- বাহ্যবৃত্তি , অভ্যন্তরবৃত্তি , স্তম্ভবৃত্তি দেশ কাল ও সংখ্যা দ্বারা ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয় এবং ক্রমে দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম হয় ।
 
➡️ এখানে দেশ দ্বারা= শ্বাস গ্রহণ , বর্জন ও স্তম্ভিত করে রাখার সময় প্রাণবায়ু শরীরের ভেতরে বা বাইরে যেখানে অবস্থান করে , সেটিই তার দেশ ।
➡️ কাল দ্বারা = শ্বাস গ্রহণ , ত্যাগ ও স্তম্ভিত করে বায়ুকে যতক্ষণ আটকে রাখা যায় তা হলো কাল ।
➡️ সংখ্যা দ্বারা = প্রাণের স্বাভাবিক গতি বা শ্বসনের হারকে বোঝানো হয়েছে । বা যখন প্রাণকে নিরুদ্ধ করা হয় তত সময়ে স্বাভাবিকভাবে যত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা যেত সেটিকে তার ‘সংখ্যা' বলা হয় ।
➡️ পরিলক্ষিত অর্থাৎ দেশ কাল এবং সংখ্যার হিসাব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে করে তিন প্রকার প্রাণায়াম অনুশীলন করা উচিত । যেমন বাহ্য , অভ্যন্তর কিংবা স্তম্ভবৃত্তি অনুশীলনের সময় প্রাণবায়ু কোন দেশে অবস্থান করছে , একে কতক্ষণ সুখপূর্বক আটকে রাখা যাচ্ছে এবং যতক্ষণ আটকে রাখা হয় ততক্ষণ স্বাভাবিকভাবে কতবার শ্বাস নেওয়া যেতো তার হিসাব করা উচিত । প্রাণায়ামকে এভাবে দেশ , কাল এবং সংখ্যা দ্বারা অভ্যাস করলে প্রাণায়ামের সময় বাড়তে থাকে এবং প্রাণায়াম করতে সহজতা অনুভব হয় অর্থাৎ বেশি পরিশ্রম করতে হয় না এবং ক্লান্তিও আসে না । পরবর্তীকালে সমাধি অবস্থায় শ্বাস গ্রহণ বর্জন জনিত উপবিঘ্ন গুলির দ্বারা সমাধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না ।
 
✅ উল্লেখ্য— কোনো সুস্থ মানুষের একবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে যে সময় লাগে তাকে মাত্রা বলা হয় । বারো মাত্রাকে এক উদ্ঘাত বলা হয় । চব্বিশ মাত্রাকে দ্বিতীয় উদ্ঘাত বলা হয় । ছত্রিশ মাত্রাকে তৃতীয় উদ্ঘাত বলা হয় । এক উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে মৃদু বলা হয় । দ্বিতীয় উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে মধ্য এবং তৃতীয় উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে তীব্র বলা হয় ।
 
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও আরেক প্রকারের প্রাণায়ামের কথা যোগদর্শনে বর্ণিত হয়েছে । যাকে চতুর্থ প্রাণায়াম বলা হয় ।
 
যথা —‘‘বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়ক্ষেপী চতুর্থঃ’’ ॥
(যোগ০—২| ৫১)
অর্থ= বাহ্য ও অভ্যন্তরের বিষয় সম্বন্ধীয় চিন্তা ত্যাগের ফলে যা সহজভাবে স্বতঃ সম্পাদিত হয় , তাই হল চতুর্থ প্রাণায়াম ।
 
ব্যাখ্যা— বাহ্য ও অভ্যন্তর বিষয়সমূহের চিন্তা ত্যাগ করে অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধিতে মনযোগ না দিয়ে মনকে গভীরভাবে ইষ্টের চিন্তায় নিমগ্ন রাখলে দেশ , কাল ও সংখ্যার হিসাব ছাড়াই প্রাণের গতি থামিয়ে রাখা যায় ।
 
চতুর্থ প্রাণায়াম ও ত্রিবিধ প্রাণায়ামের পার্থক্য হলো , চতুর্থ প্রাণায়ামের অবস্থায় মন পূর্ণরূপে স্থিরতা প্রাপ্ত হওয়ার ফলে প্রাণের গতি তথা শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অনায়াসেই নিয়ন্ত্রিত হয় । কিন্তু ত্রিবিধ তথা বাহ্য , অভ্যন্তর , ও স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামে অভ্যাস , অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় । এজন্য আগের ত্রিবিধ প্রাণায়াম থেকে এই চতুর্থ প্রাণায়াম সম্পূর্ণ ভিন্ন ।
 
✅ সঠিকভাবে অনুশীলনকৃত প্রাণায়ামের যেমন বহু উপকারী দিক রয়েছে তেমনি ভুল পদ্ধতিতে প্রাণায়াম অনুশীলন করলে কিছু সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয় ।
 
প্রাণায়ামের ফল বর্ণনায় বিভিন্ন শাস্ত্রের উক্তি ,
 
‘‘ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশবরনম্’’ ॥
(যোগ০—২|৫২)
অর্থ= ঐসকল প্রাণায়ামের অনুশীলন করলে বিবেক জ্ঞানের আবরণ তথা অজ্ঞানতা ক্ষীণ হয়ে যায় ।
✅ ‘‘ধারণাসু চ যােগ্যতা মনসঃ’’ ॥
(যোগ০ — ২| ৫৩)
অর্থ= প্রাণায়াম করতে থাকলে ধারণা প্রদেশে মনকে দীর্ঘ সময় স্থির করার যােগ্যতা বেড়ে যায় ।
➡️ ব্যাখ্যা— মনকে কোনাে একটি স্থানে স্থির রাখাকে ধারণা বলা হয় । প্রাণায়াম করার ফলে ধারণায় মনকে স্থির করার যোগ্যতা তৈরি হয় ।
 
✅ ‘‘দ্বাবিমৌ বাতৌ বাত অসিন্ধোরা পরাবতঃ ।
দক্ষং তে অন্য আবাতু ব্যহন্যো বাতু যদ রপঃ ॥’’
- অথর্ববেদ (৪/১৩/১)
➡️অনুবাদঃ প্রাণ বায়ু ও অপান বায়ু দুইই প্রবাহিত হইতাছে ৷ অপান বায়ু সমুদ্র সদৃশ গভীর ফুসফুস হইতে আসিতেছে এবং প্রাণবায়ু দূর বায়ুমন্ডল হইতে আসিতেছে । প্রাণবায়ু তোমার জন্য বল সঞ্চয় করিতেছে এবং অপান বায়ু শরীরের রোগ পাপকে শরীর হইতে বাহির করিতেছে ।
 
✅‘‘ ইহেব শৃণ্ব এষাং কশা হস্তেষু য়দ্বদান্ । নি য়ামং চিত্রমৃঞ্জতে’’ ॥(সামবেদ —০১৩৫)
সরলার্থঃ এই প্রাণসমূহের পূরক- কুম্ভক ক্রিয়ারূপ হাতে যে অশ্রুত সূক্ষ্ম বাণীসমূহ ধ্বনিত হয় , সেই শব্দকে যেন এই প্রণাভ্যাসের অতিরিক্ত অবস্থাতেও শুনতে পাচ্ছি । এই প্রাণসমূহ অভ্যাস মার্গে অদ্ভুত রূপে প্রাণায়াণামভ্যাসী যোগীকে যোগৈশ্বর্যসমূহ দ্বারা অলংকৃত করে ।
 
✅ আ গন্তা মা রিষণ্যত প্রস্থাবানো মাপ স্থাত সমন্যবঃ । দৃঢা চিদ্যময়িষ্ণবঃ ॥ (সামবেদ -০৪০১)
সরলার্থঃ পূরক-কুম্ভক-রেচক ইত্যাদিকে নিয়ম বিধি দ্বারা প্রাণায়ামের অভ্যাসকৃত যোগসাধক প্রাণকে সম্বোধিত করছে‌ । হে প্রাণায়ামের জন্য উপস্থিত আমার প্রাণ! তুমি রেচক প্রাণায়াম হতে বাহিরে গিয়ে পূরক প্রাণায়াম দ্বারা পুনঃ ভিতরে এসো , আমাদের স্বাস্থ্যহানি করো না । হে তেজস্বী প্রাণ! শরীরে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ রোগ , মলিনতা ইত্যাদিকে দূর করতে সমর্থ প্রাণ" তুমি শরীর থেকে বাইরে স্থিত হয়ো না , কিন্তু পূরক , কুম্ভক , রেচক আর স্তম্ভবৃত্তির ব্যাপার দ্বারা আমার প্রাণসিদ্ধি করাও । এখানে মূলভাব এমন যে , আমরা যেন প্রাণায়াম থেকে বিরত না হয়ে নিয়মমত এর অভ্যাস দ্বারা প্রকাশের আবরণ ক্ষয় করে ধারণাসমূহতে মনের যোগ্যতা সম্পাদিত করি ।
 
⚠️ প্রাণায়াম অনুশীলনে বিশেষ সতর্কতা —
 
(I) সর্বপ্রথম একজন যোগগুরুর সান্নিধ্যে থেকে প্রাণায়াম শিখে নেওয়া উচিত । নিজে থেকে ভুলভাবে অনুশীলন করতে গেলে বিপদ হতে পারে ।
(II) ভরা পেটে বা দুধ পান করে প্রাণায়াম করা উচিত নয় । খালি পেটেই প্রাণায়াম করা উচিত ।
(III) দুর্বল শরীরে প্রাণায়াম করা উচিত নয় ।
(IV) প্রাণায়াম কমপক্ষে তিনবার এবং অধিক পক্ষে একুশবার করা উচিত ।
(V) প্রাণায়াম করার সময় ও৩ম্ অথবা প্রাণায়াম মন্ত্র অথবা যে সকল মন্ত্রে ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণিত রয়েছে , তার অর্থ সহিত মানসিক জপ পূর্বক প্রাণায়াম করা উচিৎ ।
(VI) যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত নির্মল বায়ুতে প্রাণায়াম করা উচিত ।
(VII) একটি প্রাণায়াম দীর্ঘকাল অভ্যাস হয়ে গেলে অন্য প্রাণায়াম তার সাথে করা উচিৎ । অন্যথা একটি প্রাণায়ামই প্রাথমিক অবস্থায় করা উচিৎ ।
(VIII) প্রাণায়াম অনুশীলনের সময় যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক প্রাণবায়ুকে আটকে রাখতে হবে । অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণই । কখনোই জোর করে বেশি সময় রেখে অনুশীলন করা উচিত নয় । কারণ এতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে ।
 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)